অবেলায় এলে তুমি পর্ব-২৮ এবং শেষ পর্ব

0
281

#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:২৮(প্রথম অংশ)
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা

নতুন এক সকাল। নতুন সব আশা নিয়ে আলোয় আলোকিত করে তুলেছে চারপাশ। নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন পথচলা এক নতুন অধ্যায় দিয়ে ঘিরে উঠা এক সকাল। সমুদ্রের পানির শব্দ ভেসে আসছে। সেই সাথে ঠান্ডা হিমশীতল বাতাস।
তীব্র মাথা ব্যথা করছে অরিত্রির। মাথা ব্যাথায় মনে হচ্ছে, মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। মাথা ব্যাথার পাশাপাশি শরীরের জায়গায় ব্যাথা অনুভব হতে লাগে। মাথা এবং শরীর ব্যাথা নিয়ে উঠে বসতেই মাথায় যেনো বাজ পড়লো। নিজের নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে। গতরাতের কথা সম্পূর্ণ স্মরণ করার চেষ্টা করে বৃথা হলেও আবছা আবছা মনে হতেই নিজের উপর রাগ করতে লাগলো। কিন্তু রাগ নিজের উপর প্রয়োগ না করে পাশে মাতাল হয়ে শুয়ে থাকা আয়ানের উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করলো।

“ইউ ইডিয়ট! তুমি আমার সাথে এইটা কি করলে নিজের কামকতা ধরে রাখতে পারো না? মদ খেয়ে আমার এতো বড় ক্ষতি করে দিলে?”

নগ্ন শরীরের ব্ল্যাংকলেট ভালো করে জড়িয়ে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে তেজি গলায় কথা গুলো বললো অরিত্রি। মাতাল হয়ে থাকায় আয়ান সঠিক ভাবে বুঝতে পারলো না অরিত্রি তাকে কি বলেছে। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে ফ্লোরে পড়ে থাকা অবস্থা থেকে উঠে বসলো।

” তুমি এখানে? তুমি এখানে কি করে এলে? গতরাতে তো এখানে তরী,,,,”

মাথা ব্যাথা নিয়েও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছিল আয়ান। কিন্তু তরীর জায়গায় অরিত্রিকে দেখে এবার যেনো মাথায় তরতর করে রাগ উঠে গেলো। কোনো ভাবে এখন অরিত্রিকে ঘেঁটে দিতে চাই না। নিজের কাজ আগে ঠিক ভাবে করতে হবে নয়তো সব কিছু ভেস্তে যেতে দুই মিনিট সময় লাগবে না। আয়ান নিজের চুল টেনে ধরে নিজের রাগ কমাতে চাইলো। কোনো রকম অরিত্রিকে বুঝিয়ে ওয়াশ রুমে পাঠিয়ে দিলো।‌

” গবেট একটা! ফোনে রিং হয় শুনতে পারিস না? মেয়েদের সাথে ফুর্তি করার কথা বললে ঠিক শুনতে পাস। শালা তোদের আন্ডা কোষের মধ্যে দিয়ে মারা উচিত। এখন একটা কথা বলছি মন দিয়ে শোন আজকের রাতের মধ্যে সব কিছু শেষ করবে। আমি আর সময় নিতে চাইছি না। তুমি নিজের কাজ শেষ করে আমাকে টেক্সট করবে। আমি এই দিকটা সামলে নিবো। একটা দেহেও যেনো প্রাণ না থাকে। যদি বেঁচে থাকে তাহলে সবার আগে তুমি মরবে।”

আরো কিছু কথা বলে ফোন কেটে দিলো আয়ান।সোহেলকে কথা গুলো বলে নিজের রাগ তাও যেনো কোনো ভাবেই কমাতে পারছে না সে। রুম জুড়ে পায়চারি করে কিছু ভাবতে থাকলো। অপরদিকে সোহেল এখনো কানের পাশে ফোন রেখে বসে আছে। একটু আগে বলা আয়ানের কথা যেনো ঠিক মতো হজম করতে পারছে না সে।

“শালা! নিজে তো প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়ে খদ্দেরের কাছে যাবে আবার আমাকে বলতে আসে। আমার গায়ে হাত তুলেছিলি না! এবার দেখ আমি কি খেল দেখায়। শুধু অপেক্ষা কর।”

সোহেল নিজে নিজে কথা গুলো বলে আবারও কাউকে একটা ছোট মেসেজ করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।

🍁🍁🍁🍁

নিজের উন্মুক্ত বুকপিঞ্জরে ঘুমিয়ে থাকা নিজের প্রিয়সীকে দেখে চলেছে নিহান। প্রিয়সীর নরম তুলতুলে হাত দুটো দিয়ে আবদ্ধ করে রেখেছে তার শরীর। বুকের উপর কেমন বাচ্চাছানার মতো করে শুয়ে আছে। বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে গালে স্লাইড করছে তো একবার ঘন কালো কেশের ভিতরে হাত ডুবিয়ে দিচ্ছে।
ঘুম হালকা হয়ে আসতেই আধো আধো চোখে চোখ মেলে তাকাতেই নিহানকে একদৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারও চোখ নামিয়ে নিলাম। ভদ্রলোকের দৃষ্টি আমাতেই আটকে আছে। যা আমাকে বরাবরের মতো এবারও এক রাশ লজ্জায় ঘিরে রেখেছে।

” এতো ভালোবাসার পরেও এখনো দেখছি বউ আমার লজ্জার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। একি আমার ব্যর্থতা? কিন্তু যদি কেউ চাই তাহলে আমি কিন্তু লজ্জা ভেঙ্গে দিতে পারি।”

ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে কথা গুলো বললো নিহান। নিহানের কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক কপালে অধর ছুঁয়ে দিলো।

“ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও আমরা বের হবো। আগে ব্রেকফাস্ট করবো তারপর ঘুরা ফেরা হবে।”

আবারো গালে চুমু দিয়ে কথা গুলো বলে নিহান নিজের হাতের বাঁধন আলগা করে দিতে আমিও টুপ করে নিহানের ঠোঁটে চুমু দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

কক্সবাজারের সব থেকে সুন্দর তম বিচ লাবণী বিচ। কক্সবাজার শহর থেকে নৈকট্যের কারণে লাবণী বিচকে কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্র সৈকত বলে বিবেচনা করা হয়। শহর থেকে নৈকট্যের কারণে লাবণী বিচকে কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্র সৈকত বলে বিবেচনা করা হয়। নানারকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে সৈকত সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ছোট বড় অনেক দোকান যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়া এখানে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে ঝিনুক মার্কেট।
বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, সারি সারি ঝাউবন, সৈকতে আছড়ে পড়া বিশাল ঢেউ। সকালবেলা দিগন্তে জলরাশি ভেদকরে রক্তবর্ণের থালার মতাে সূর্য। অস্তের সময় দিগন্তের চারিদিকে আরাে বেশি স্বপ্নিল রঙ মেখে সে বিদায় জানায়। এসব সৌন্দর্যের পসরা নিয়েই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে রচনা করেছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। প্রায় ১২০ কিলােমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী বলা হয় এ জায়গাটিকে। সড়কপথে ঢাকা থেকে প্রায় ৪৫০ কিলােমিটার এবং চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১৫০ কিলােমিটার দূরে রয়েছে নয়নাভিরাম এ সমুদ্র সৈকত। এখানকার সমুদ্রের পানিতে গােসল, সূর্যাস্তের মনােহরা দৃশ্য দেখেও ভালাে লাগবে। কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণের শুরুটা হতে পারে লাবনী পয়েন্ট থেকে। লাবনী বিচ ধরে হেঁটে হেঁটে পূর্ব দিকে সােজা চলে যাওয়া যায় যায় হিমছড়ির দিকে। যতোই সামনে এগুবেন ততােইসুন্দর এ সৈকত। সকাল বেলা বের হলে এ সৌন্দর্যের সাথে বাড়তি পাওনা হবে নানান বয়সী জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। শুধু সমুদ্র সৈকতই নয়, কক্সবাজার শহরের বৌদ্ধ মন্দির, বার্মিজ মার্কেট, হিলটপ রেস্টহাউস ইত্যাদি কক্সবাজার ভ্রমণের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। কক্সবাজার শহরের জদি পাহাড়ের উপরে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। শহরের যে কোন জায়গা থেকেই রিকশায় আসা যায় এখানে। সান বাঁধানাে সিঁড়ি ভেঙ্গে জাদির পাহাড়ের উপরে উঠলে সাদা রঙের এসব বৌদ্ধ প্যাগােডা দেখে ভালাে লাগবে। এই পাহাড়ের উপর থেকে কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্থান দেখতে পাওয়া যায়। শহরের আরেক জায়গায় রয়েছে অর্ঘমেধা কেয়াং নামে আরেকটি বৌদ্ধ প্যাগোডা। কাঠের তৈরি প্রাচীন এ বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে।

🍁🍁🍁🍁

নিজ রুমের মেঝেতে রক্তাক্ত পড়ে আছে নিহানের মা রৌশানা বেগম। সম্পূর্ণ রুম জুড়ে রক্তে ভেসে আছে। রৌশানা বেগমের থেকে একটু দূরে মুখ থেঁতলে অবস্থায় পড়ে আছে নিরাত্রির রক্তাক্ত দেহ। ছোট একটা নিষ্পাপ দেহ কি ভাবে পড়ে আছে। খু*নির মনে হয় এতটুকু শিশুকে এভাবে মেরে ফেলতে হাত কাঁপেনি। কি বিচ্ছিরি ভাবে দুটি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। রৌশানা বেগম এবং নিরাত্রির থেঁতলে যাওয়া দুটি দেহকে একবার ভালো মতো দেখে নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে আয়ানকে ফোন করে সোহেল। দুইবার রিং হতেই ফোন তুলে নেয় সে।

” এই দিকের কাজ সম্পূর্ণ শেষ স্যার। ডঃ সেন, নিহানে মা এবং নিরাত্রি এদের চ্যাপ্টার শেষ। এই দিকের কাজ সম্পূর্ণ শেষ করে ফেলেছি। আমার কাজ শেষ স্যার।”

সোহেলের কথা শুনে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে ওঠে আয়ানের। নিহানের দুর্বল পয়েন্ট গুলো এভাবে শেষ করতে পেরে এক আলাদা অনুভূতি হচ্ছে। সোহেলের ফোন কেটে দিয়ে কিছু একটা ভেবে অরিত্রির কাছে চলে যায় আয়ান। এখন অরিত্রির চ্যাপ্টার শেষ করতে হবে।

🍁🍁🍁🍁

অন্ধকারে রুমে হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে নিহান। টিমটিম করে জ্বলে ওঠে আবারো নিভে যাচ্ছে একটি ৬০ ভল্টের বাতি। মাথায় আঘাত পাওয়ায় মাথা যন্ত্রণা করছে খুব। ধুর থেকে পানির শব্দ ভেসে আসছে কিন্তু তা-ও অস্পষ্ট। গরমে ঘাম বেয়ে বেয়ে পরিহিত সাদা রঙের শার্ট গায়ে লেপ্টে আছে। কিন্তু সাদা রঙের শার্ট আর সাদা রঙে সীমাবদ্ধ নেই। বালি এবং মাটির আবরনে সৃষ্টি হয়েছে এক আলাদা রঙ। অন্যদিকে তৃষ্ণায় চৌচির হয়ে যাচ্ছে গলা। মিয়ে যাওয়া গলায় কয়েক বার পানি চাইলো কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। অন্যদিকে এখন সময় কয়টা সে-ই বিষয়ে ঠাউরে করতে পারছে না। কয় ঘন্টা ধরে এখানে এভাবে পড়ে আছে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। নিস্তব্ধ, অন্ধকার ঘরের মাঝে হঠাৎ করে দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসে। সে-ই সাথে কারো পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পারে ঘরের ভিতরে কেউ আসছে। আবারো মিনমিন কন্ঠে পানি চেয়ে মাথা নুইয়ে পড়ে গেলো।

চোখে মুখে পানির ঝাপটা পড়তেই দু’চোখ মেলে সামনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেলো। নিহান হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটা চেয়ারে বসে আছে। আর তার সামনে সে-ই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে যার সাথে আমার ধাক্কা লেগেছিল। ভালো করে চোখ মেলে তাকাতেই এবার অবাকের শেষ স্তরে পৌঁছে গেলাম। মেয়েটার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান। তার ঠোঁটে হাসি।

“আয়,,,!”

“অরিত্রি তুমি বেঁচে আছো?”

আমার কথা বলার আগেই নিহান কথা গুলো বলে উঠলো। নিহানের কথা শুনে অবাক নয়নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীকে দেখতে লাগলাম। অত্যাধিক সুন্দর এবং টানা টানা দুই চোখ। উচ্চতা বেশ। চুল গুলোও সুন্দর। মায়াবী চেহারার মাঝে ঠোঁটের বাম ছোট একটা তিল যেনো আরো আকর্ষন করে। এই নারী যে কোনো পুরুষের হৃদয়হরণ করতে সক্ষম এই মেয়ে। গায়ে কালো শার্ট যেনো সুন্দর শরীরের ফুটে উঠেছে। আমি নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে।
হঠাৎ করেই মনে এক অজানা ভয় কাজ করতে শুরু করলো। নিহান তো অরিত্রকে ভালোবাসে এবং নিজের সন্তানের মা সে। অরিত্রি বেঁচে আছে তাহলে কি নিহান আমাকে ছেড়ে দিবে? আমার ঠাঁই আবার সে-ই মামার বাড়ি হবে? আচ্ছা আমি নিহান, নিরাত্রি এদের ছাড়া থাকবো কি ভাবে? নিরাত্রি কি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?

” হ্যাঁ! বেঁচে আছি। এই দেখো তোমার সামনে জলজ্যান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছি।”

হাসতে হাসতে কথা গুলো বলতে বলতে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় অরিত্রি।

“তুমি খুব বোকা তরী। মাথায় বুদ্ধি নেই বললেই চলে। নিহান কি একটু মিষ্টি কথা বললো আর তুমি নিজের কাজ থেকে পিছিয়ে গেলো। একটা বার সত্যিটা জানতে চাইলে না। এতে অবশ্য তোমার দোষ নেই! নিহান ছেলেটা এমন। কি ভাবে নিজের পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়, কিভাবে নিজের দিক থেকে নজর সরাতে হয় এইসব খুব ভালো করেই নিহানের জানা আছে। ”

কথা গুলো বলতে বলতে এবার নিহানের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায় অরিত্রি। আমি শুধু মেয়েটাকে দেখেই যাচ্ছ যাচ্ছি। এই মেয়েই আমাদের রুমে এসে চিরকুট রেখে গিয়েছিল আর আমার মাথায় আঘাত করে।

“তুমি এসেছিলে তাই না আমাদের রুমে! চিরকুট এবং আমাকে আঘাত করো আর সে-ই দিন তুমিই ছিলে যার সাথে আমার ধাক্কা লেগেছিল।”

“তুমি এতো দিন কোথায় ছিলে অরিত্রি? আর এতো নাটক করার কি প্রয়োজন ছিলো তোমার? একটা বার নিজের মেয়ের কথা মনে হয়নি তোমার? কখনো এইটা ভাবোনি তোমার অবর্তমানে মেয়েটার কি হবে?”

” প্রয়োজন ছিলো নিহান! প্রয়োজন ছিলো। তোমাকে শেষ করার জন্য প্রয়োজন ছিলো। তোমার জন্য আমার আদরের বোন মা*রা গেছে। আমার বাবা মা*রা গেছে। আমার বোনের কি দোষ করেছিল? তোমার কুকর্ম গুলো দেখে নিয়েছিল তাই তুমি আমার বোনকে মেরে দিলে? আমার নির্দোষ বাবাকে মিথ্যে পুলিশ কেস দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছো তুমি। মেয়ে এবং স্বামীর এমন দুর্দশা দেখে আমার মা আমাকে একা রেখে পাড়ি জমালো না ফেরার দেশে। শুধু মাত্র তোমার জন্য নিজের পরিচয় থাকতেও আমাকে নামহীন পরিচয় দিতে হয়েছে। এতো অন্যায় করার পরেও আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো ভেবেছ? আমাকে যেই মানুষ শেষ করে দিয়েছে তাকে ছেড়ে দিবো? এইসব নাটক তো আমি তোমার জন্য করেছি।”

অরিত্রি কথা গুলো বলতে বলতে আমার হাতে ইনজেকশন পুশ করলো। ইনজেকশন পুশ করার কিছু মূহুর্ত পর চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।

“তুমি কিসের ইনজেকশন দিলে তরীকে?”

” ভয় পেও না নিহান। তরীর কিছু হবে না। শুধু এখানে যা হয়েছে তা ভুলে যাবে। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে আমার মতো তোমাকেও একলা করে দিতে। তখন বুঝতে পারবে কাছের মানুষদের হারানোর কষ্ট কতটা।”

” তুমি আমার উপর যেই ব্লেইম দিচ্ছ তার আগে তোমার বোন আর বাবার সম্পর্কে কিছু তথ্য দেয়। তোমার ভালো বোন এবং বাবা কতটা নির্দোষ সেটাও তোমার জানা উচিত।”

“চুপ! তোর মুখ থেকে আমার বাবা আর বোনকে নিয়ে কিছু শুনতে চাই না। তোর মতো খুনি, মিথ্যেবাদী আমার বাবা বোনকে কিছু বলবে তা আমি কিছুতেই শুনবো না।”

🍁🍁🍁🍁

“অরিত্রি!”

#চলবে

#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:২৮(দ্বিতীয় অংশ)
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা

যেই মানুষটিকে একটা সময় ভালোবাসতো, চোখের মাঝে ছিলো ভালোবাসা, সম্পূর্ণ মুখে ছিল মায়ার চাদরে ঘেরা আজকে সেই চোখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেখতে পারছে না নিহান। চোখ মুখ করে তুলেছে হিংস্র। অরিত্রি যেনো নিজের নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো কথা শুনতে রাজি না। কিন্তু এই ভুল থেকে যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে।

” তোমার বাবা নিজেই মারা গিয়েছে সেই দায় তুমি আমাকে কেনো দিচ্ছো?”

” শুধু মাত্র তোমার আমার বাবাকে মৃত্যু বেছে নিতে হয়েছে। তবুও বলছো তোমাকে দায়ী করবো না? আমার বাবার কি দোষ ছিলো? তোমার থেকে বড় পজিশন নেওয়া? নাকি তোমার এই অপকর্ম জেনে গিয়েছিল এইটা?”

” তোমার বাবার কোনো ভালো মানুষ ছিলো না। বরং রাতের অন্ধকারে তোমার বাবা মেয়ে পাচার করতো। শুধু মেয়ে পাচার না বরং তোমার বাবা মেয়েদের চাকরি দেওয়ার নাম করে নিজের গেস্ট হাউসে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতো এবং দিনের আলো ফোটার আগেই তাদের লাশ গুম করে দিতো।”

“চুপ একদম চুপ! আমার বাবাকে নিয়ে কোনো মিথ্যা কথা আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চাই না। আমার বাবা এইসব কাজে কখনো লিপ্ত ছিল না।”

নিহানে গলা টিপে দিয়ে চিৎকার করে কথা গুলো বললো অরিত্রি। নিজের বাবার বিরুদ্ধে এইসব কথা যেনো সে মেনে নিতে পারছিলো না।

” তোর মতো নোংরা, পিতৃহীন ছেলে কি করে বাবার মূল্য বুঝবে? জীবনে কখনো বাবার আদর, স্নেহ পেয়েছিস? জানিস বাবার আদর কেমন হয়? সন্তানের প্রতি বাবা কেমন হয়?”

” তুমি আমাকে চুপ করিয়ে দিলেও সত্য কখনো মিথ্যে হবে না অরিত্রি। আমার হাতে কখনো কোনো নির্দোষের প্রাণ যায়নি। তোমার বাবার এতো নাম ডাক, টাকা সব কিছু ছিল অবৈধ উপার্জন করা। তোমার বাবার সব কুকর্মের কথা তোমার মা সব কিছু জানতেন শুধু মাত্র তোমাদের জন্য চুপ করে থাকতো। তোমার বাবার কাছে তোমার কথা শুনেছি কিন্তু আমি এইটা জানতাম না তুমিই তার মেয়ে। আর বাকি রইল তোমার বোনের কথা! তাহলে তুমি তার কাছে যাও যার জন্য তুমি আমার ভালোবাসা ভুলে গিয়ে আরেক জনের সাথে জড়িয়ে পড়িয়েছিলে।”

নিহানের শেষ কথা গুলো শুনে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ানের দিকে তাকিয়ে আবারো নিহানের দিকে তাকায় অরিত্রি।

” আয়ান দিপ্তীকে চিনতো?”

“তোমার আশিককে জিজ্ঞেস করো। কি রে আয়ান তুই কিছু বল! তুই যে দিপ্তীকে চিনতি সেটা বল।”

পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ানের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো নিহান। নিহানের ঠোঁটে হাসি। বন্ধু এবং প্রাক্তনের সত্যি জানার পরেও চোখে মুখে কোনো বেদনা বা কষ্ট নেই। অপরদিকে দিকে আয়ান যেই ভয় পাচ্ছিল সেটাই যেনো ধীরে ধীরে বের হয়ে আসতে লাগলো। দ্রুত কিছু ভাবতে লাগলো।

“নিহান যা বলছে তা কি সত্যি আয়ান? কি হলো তুমি কিছু বলছো না কেনো আয়ান? তুমি চিনতে দিপ্তীকে?”

“তুমি আমার কথা গুলো শুনো অরি! প্লিজ কাম ডাইন।”

“অরিত্রি!”

অরিত্রিকে কথা গুলো বলতে বলতে অরিত্রিকে এক পা করে এগিয়ে আসতে থাকে আয়ান। যখনই অরিত্রির পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গলা বরাবর ছুড়ি চালিয়ে দেয়। মূহুর্তের মাঝেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অরিত্রি। গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অরিত্রিকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়তে দেখা মাত্রই অরিত্রি বলে চিৎকার করে নিহান।

” এইটা তুই কি করলি আয়ান। অরিত্রিকে কেনো মারলি?”

” যেটা করেছি বেশ করেছি। কি ভেবেছিল আয়ানের সাথে ডাবল গেইম খেলবে? আয়ান একবার যেই কাজে হাত দেয় সে-ই কাজ কখনো অসম্পূর্ণ রাখে না। কিন্তু এর কৈ মাছের জান। ঠিক বেঁচে গেছে। কিন্তু এবার তো মরতেই হলো। আমার সব প্ল্যান জেনে যাচ্ছিল। এই মেয়েকে দিয়ে আমার একটু বিশ্বাস নেই। পুরানো প্রেম যদি আবার ফিরে আসে? আর আমার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়। এই এই শালি বড্ড বেশি কথা বলে। আমার এতো কথা বলা মানুষ পছন্দ না। ভেবেছিলাম অরি তোকে শেষ করবে তারপর আমি অরিকে করবো। কিন্তু তুই সবটা ঘেঁটে দিলি।”

কথা গুলো শেষ হতেই নিহানের বুকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয় আয়ান।‌

” তুই তো আমার ভাই! বেস্ট ফ্রেন্ড আমার। তাহলে কি করে আমার সাথে এমন করলি?”

মেঝেতে পড়ে থাকা নিহানের কলার ধরে কথা গুলো বললো আয়ান। কিন্তু আয়ানের কথার উত্তর করলো না।

” ইউ নো এভরিথিং ফের এন্ড লাভ। তোর জন্য আমি সব সময় সেকেন্ড হয়েছি। তাই মনে মনে জেদ চেপে বসে আমাকে সব কিছুতেই প্রথম হতে হবে। তোর সাথে থেকেই তোরই ড্রাগস নিয়ে আমি আলাদা কাজ শুরু করলাম। কিন্তু দিপ্তী আমার সব কিছু দেখে নিয়ে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল করতে লাগলো। তাই তাকেও মেরে দিলাম। কিন্তু তুই হুট করে সিদ্ধান্ত নিলি ড্রাগ পুড়িয়ে দিবি। তাই আমি তোর পুড়িয়ে ফেলা ড্রাগস নতুন করে আবার শুরু করলাম। দেশের বাহিরে পাঠাতে শুরু করলাম। আমার প্রিয় মানুষকে তুই বরাবর আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিস। তোর থেকে আমার সব কিছু বেশি ছিল। টাকা পয়সা, গাড়ি বাড়ি, দেখতেও তোর থেকে অনেক বেশি সুন্দর এবং হ্যান্ডসাম কিন্তু তাও সবাই তোকে পছন্দ করে। কিন্তু কেনো করছ? তোর আগে আমি অরিত্রিকে ভালোবাসি কিন্তু অরিত্রি আমাকে ভালো না বেসে তোকে ভালোবাসলো।‌ কিন্তু যখন আবারো অরিত্রি আমাকে ভালোবাসলো তখন তোর থেকে প্রতিশোধ নিতে আমিও ভালোবাসার নাটক করলাম কিন্তু তুই আবার আমার থেকে কেড়ে নিলি। আমার অবর্তমানে তোরা বিয়ে করে নিলি।তুই না আমার বন্ধু তাহলে কেনো এমন করলি আমার সাথে? তুই যেমন আমার থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছিস আমিও ঠিক তেমন করে সব কিছু কেড়ে নিবো। ওই দিকে তোর মা আর মেয়েকে শেষ করেছে এই দিকে এখন আমি তোকে শেষ করে দিয়ে তরীকে নিয়ে চলে যাবো।”

কথা গুলো বলে নিহানের পাশে থাকা শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করে। শক্ত জিনিস দিয়ে কপালে আঘাত করার ফলে কপাল কেটে যায় এবং রক্ত ক্ষরণ হয়ে সম্পূর্ণ মুখে গড়িয়ে যায়।

” শালা! তোর জন্য আমার বাবা মা সবসময় আমাকে ছোট করেছে। ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে তুই সব সময় আগে ছিলি। তোর প্রতি রাগ আমার আজ থেকে না দীর্ঘ সময় ধরে। আজকে তোকে মেরে তরীকে নিয়ে এমন দূরে চলে যাব যেখানে কেউ থাকবে না। শুধু আমি তরী এবং আমাদের ভালোবাসা।”

কথা গুলো শেষ করেই আবারো নিহানের উপর আঘাত করতে যায় আয়ান। কিন্তু আঘাত করার পূর্বেই নিহান আয়ানের পেটে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়।

” তুই কি ভেবেছিস সব কিছু করে যাবি আর কেউ কিছু জানতে পারবে না? তুই হয়তো ভুলে গিয়েছিলি তুই যেই গেইম খেলতে শুরু করেছিলি সে-ই গেইমের মাস্টার মাইন্ড আমি। তোর কি ধারণা, আমি জানিনা অরিত্রি বেঁচে আছে? আমি জানতাম। যখন অরিত্রির ফরেন্সিক রিপোর্ট পেলাম সেখানেই আমার প্রথম খটকা লাগে। এরপর যখন আমি আরেকটা রিপোর্ট দেখলাম যেখানে লাশের শরীরে ড্রাগস পাওয়া গেছে সেখানে আমার দ্বিতীয় খটকা লাগে। এই ড্রাগস আমি নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়েছি সে-ই ড্রাগস আবার এলো কি করে? জানিস তোর প্রথম ভুল কি ছিলো? আমার পিছনে লাগা। আমার জিনিসের দিকে নজর দেওয়া তোর দ্বিতীয় ভুল। তোর তৃতীয় ভুল তরীকে কিডন্যাপ করিয়ে আবার নিজেই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া। তোর চতুর্থ ভুল, সোহেলের মতো গাধাকে ব্যবহার করা। আর তোর পঞ্চম ভুল, তোর অফিসের কর্মী ঐশীকে পাঠানো। তোর কি ধারণা নিহানের বাড়িতে যে কেউ চলে আসতে পারে? নিহান কোনো খুঁজ না নিয়ে বাড়িতে রেখে দিবে? এতোই সহজ নিহানের নাকের নিচে দিয়ে সব কিছু করে যাবে আর নিহান কিছু জানবে না? আবার হুট করেই কাজের মেয়ে ঐশী আমার বাড়িতে আসা, রাতের অন্ধকারে আমাকে ফলো করা, খালার কথা বলে মর্ডান মেয়েদের পোশাক পড়ে বাহিরে বের হওয়া, দামি গাড়িতে চলা এইসব আমি কিছু জানবো না?”

কথা গুলো বলেই আয়ানের পায়ে বারি মারে নিহান। পায়ে বারি মারার সাথে সাথে চিৎকার পায়ে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে।

” আমি সব কিছু জেনে শুনে তোর সাথে নাটক করে গিয়েছি। তোর চালেই তোকে মারার প্ল্যান করি। তুই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছিস? না! বরং আমি তোদের এখানে নিয়ে এসেছি। তুই আমাকে নিঃস্ব করে দিবি? ওয়েট তোকে লাইভ ঝটকা দেখায়।”

কথা গুলো বলে আবারো আয়ানের হাত এবং পায়ে আরো কত গুলো বারি দিয়ে আয়ানের হাতের উপর পা রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন করে নিহান। একবার রিং হতেই অপর প্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ করতেই স্ক্রিনে থাকা মানুষ গুলো দেখে মুহূর্তের মাঝেই চোখে মুখে রাগ ফুটে উঠল আয়ানের।

“আমাকে ঠকিয়েছে! আয়ানকে ঠকানোর শাস্তি পেতেই হবে।”

ফোন থেকে নজর সরিয়ে নিচ থেকে উঠতে গিয়ে কথা গুলো বলে আয়ান। কিন্তু নিহান আবারো আঘাত করে আয়ানকে। যার ফলস্বরূপ উঠে দাঁড়াতে পারে না।

“তুই আমাকে শত্রু মনে করলেও আমি তোকে বন্ধুর কম ভাই ভেবে এসেছি। তুই আর অরিত্রি যখন আমার ভালোবাসার মূল্য না দিলি তখনও আমি তোকে ভাই ভেবে এসেছি। কিন্তু তুই যে আমার ভাই হওয়ার যোগ্যতা রাখিস না। আমার পিছনে আমার হয়েই শত্রুতা করিস। তুই যাদের দিয়ে আমার পিছনে লেগে ছিলি তাদের আমি অনেক আগেই নিজের করছ নিয়েছি। দেখলি তো কার পাওয়ার বেশি। তোর সব দুই নাম্বারী কাজের সব কিছুর প্রমাণ চলে গেছে পুলিশের কাছে। হাজার হাজার মেয়ে বিদেশে পাচার করেছিস সেই সব কিছু এখন পুলিশের কাছে। আজকে তুই এখান থেকে বেঁচে ফিরলেও বাহিরে তোকে সাধারণ জনতা ছিঁড়ে খাবে। আর তুই আমার তরীকে আমার থেকে নিয়ে যাবি। এতোই সহজ? এই নিহানের দেহে যতদিন প্রাণ আছে তুই ছুঁয়েও দেখতে পারবি না। আর একটা কথা বলি শোন, নিরাত্রি তোর আর অরিত্রির মেয়ে। কিন্তু নিরাত্রি সহ সম্পূর্ণ দুনিয়ার কাছে নিরাত্রি আমার মেয়ে। হ্যাঁ সে আমার মেয়ে।‌শুধু আমার মেয়ে। আমার দুনিয়ার অংশ।”

শেষ বারের মতো কথা গুলো বলেই আয়ানের মাথায় বারি দিয়ে বসে নিহান।না। মুহূর্তের মাঝেই মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসে এবং সম্পূর্ণ ফ্লোর ছেয়ে যায়। সেকেন্ডের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে আয়ানের। সত্যি কথা জানার পর আয়ানের ভাবমূর্তির অপেক্ষা করলো না সে। কেনো করবে? নিরাত্রি তার মেয়ে। শুধুই তার। কাউকে নিরাত্রির ভাগ দিবে না।
দূরে কোথাও থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। মানে সময় এখন ভোর। হাতে থাকা লোহার রড ফেলে দিয়ে তরীর দিকে এগিয়ে যায় নিহান।

#চলবে

#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:২৯ এবং শেষ
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা

সকাল নয়টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। সকালের মিষ্টি রোদ চলে গিয়ে এখন সমস্ত আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা ছুটে চলেছে। দূর থেকে বজ্রপাতের শব্দ শুনা যাচ্ছে সে-ই সাথে আকাশে বিদ্যুৎ খেলছে। হঠাৎ করেই নিকটবর্তী স্থানে হয়তো বজ্রপাত হয় যার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় কিন্তু চোখ না খুলেই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ অবস্থায় রইলাম। কিন্তু একটু পরই মুখের উপর কারো নিঃশ্বাস পড়তেই চোখ মেলে দেখি নিহান আমার নিকট এসে ঝুকে আছে। কোনো দূরত্ব নেই। নিহানেয নাকের সাথে নিজের নাকের ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঘুম জড়ানো চোখে নিহানকে এভাবে কাছে দেখে আমার নিজের নিঃশ্বাস থেমে যাচ্ছে বারংবার।

” মেয়ে তুমি কি জানো ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে কতটা নিষ্পাপ লাগে? তুমি কি জানো মেয়ে, তোমার ঘুমন্ত চেহারা দেখতে দেখতে আমার রাত কেটে যায়? তোমার ঘুমন্ত মুখাবয়ব আমাকে কাছে টানে। আমি বারংবার তোমার ঘুমন্ত আঁখিতে আমার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে যায়। আচ্ছা তোমার ঘুমন্ত মুখাবয়ব আমাকে কেনো এতো উতলা করে তুলে?”

আমার এলোমেলো চুল গুলো বারবার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় কথা গুলো বললো নিহান।

” আপনি কি সারারাত না ঘুমিয়ে এইসব করে বেড়ান মিস্টার নিহান? পাহারাদারদের মতো কি পা….”

“আহঃ!”

” কি হয়েছে আপনার? কোথায় ব্যাথা পেলেন দেখি। আমার দিকে তাকান।”

আমার কথা শেষ করার আগেই নিহানের আর্তনাদ শুনে উঠে বসে উক্ত কথা গুলো নিহানের সমস্ত মুখাবয়ব হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলাম।

” কিছু হয়নি। এমনি একটু তোমাকে ব্যতিব্যস্ত করতে নাটক ক,,,,”

” একদম আমাকে মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করবেন না। ব্যাথা পেয়েছেন সেটা আমার থেকে কেনো লুকাতে চাচ্ছেন? আমাকে ভালো করে দেখতে দিন।”

নিহানকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে কথা গুলো বলে আবারও দেখতে শুরু করলাম। একসময় পেয়েও গেলাম। মস্তিষ্কে চাপ দিতেই গতরাতের ঘটনাগুলো মনে পড়তে শুরু করলো। সে-ই অন্ধকার রুমে অরিত্রি, আয়ান ছিল।

” নিহার আমি সবটা শুনতে চাই। অরিত্রি তো মারা গিয়েছিল তাহলে অরিত্রি বেঁচে আছে কি ভাবে? আয়ান সে-ই বা এখানে কি ভাবে এলো? নিহান আমাকে সব কিছু বলবেন আর সত্যিটা বলবেন।”

চোখ মুখ কঠিন করে নিহানের মুখমুখি হয়ে কথাটা বললে নিহানের দিকে তাকিয়ে রইলাম সব কিছু শুনবো বলে।

” হ্যাঁ অরিত্রি বেঁচে ছিলো কিন্তু এখন আর বেঁচে নেই। আমিও তোমার মতোই জানতাম অরিত্রি মারা গেছে। কিন্তু আমি কিছু বিষয়ে রিচার্স করতে গিয়ে জানতে পারি অরিত্রি মারা যায়নি আর এইসব কিছু অরিত্রি প্ল্যান করে করেছে। আর আয়ান অরিত্রির বোনকে মেরে ফেলে কিছু কারণে যেটা আমার জানা নেই কিন্তু আয়ান তার সম্পূর্ণ দায় আমাকে দেয় এবং অরিত্রিকে এইটা বলে প্রভাবিত করে যে, আমি অরিত্রির বোনকে মেরে ফেলেছি। যার ফলস্বরূপ অরিত্রি আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে নিজের মিথ্যে মারা যাওয়ার নাটক তৈরি করে।”

“আয়ানের এইসব করে আখের লাভ কি ছিল? সে তো আপনার বন্ধু ছিলো। বন্ধু হয়ে আরেক বন্ধুকে এভাবে কেনো ফাঁদে ফেললো?”

” হ্যাঁ! আয়ান আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল এখনো আছে। জানো আয়ানকে আমি সব সময় নিজের ভাইয়ের মতো ভেবে এসেছি। আমি আর আয়ান দুইজনেই ছিলাম লেখাপড়ায় মেধাবী। শুধু লেখাপড়া না বলতে গেলে সব কিছুতেই আমাদের জুড়ি মেলা ভার ছিল। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক সবার কাছেই আমরা প্রিয় ছিলাম। দুইজনে দুজনের সব কিছু শেয়ার করতাম। কিন্তু আমি সবাইকে নিজের কথা দিয়ে মায়ায় ফেলতে পারতাম আর এইটা আমার মা বলেছিল। আর এমনটা হাওয়ার জন্য সবার কাছে আয়ানের থেকে একটু বেশি প্রাধান্য পেয়ে গেলাম। আন্টি আংকেল মানে আয়ানের মা বাবাও আমাকে পছন্দ করতেন আর আয়ানকে বলতেন যেনো আমার মতো হয়। এই ভাবে যাচ্ছিল সব কিছু। সব কিছু ঠিক ভাবে চলছিল হুট করেই একদিন অরিত্রি আসে। ধীরে ধীরে পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয় আর এই বন্ধুত্ব থেকে ত্রিমাত্রিক প্রণয় ঘটে। আমি কখনো জানতে পারিনি আয়ান অরিত্রিকে ভালোবাসে। যদি জানতে পারতাম তাহলে আমি আয়ানের জন্য আমি অরিত্রিকে সেক্রিফাইস করে দিতাম। কিন্তু আমি কখনো বুঝতে পারিনি আয়ানের মনের কথা। আমি না বুঝতে পারিনি যে, আমি নিজের অজান্তেই নিজের কাছের বন্ধুকে নিজের শত্রু বানিয়ে নিয়েছি। প্রতিহিংসা থেকে আয়ান অরিত্রিকে নিজের ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে আমারই গোপনে। কিন্তু আয়ান উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ চলে যায় কয়েক বছরের জন্য কিন্তু ভার্সিটি অফ পেলেই মাঝে মাঝে দেশে আসতো। তখনো অরিত্রি এবং আয়ান গোপনে ভালোবেসে যাচ্ছিল। হুট করেই একদিন অরিত্রিকে আমি বিয়ে করে নিয়ে আসি বাড়িতে। মা অরিত্রির বিষয়ে জানতো তাই সহজেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বিয়ের পর থেকে আয়ান অরিত্রি থেকে এবং আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে উঠেপড়ে লাগে। আর এতো কিছু করে।”

কথা গুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিহান। এরই মাঝে বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। ঝুম বৃষ্টি। থেমে থেমে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আগের থেকে বেশি। আর ঘনঘন বজ্রপাত হচ্ছে কাছেপিঠে।

” তোমাকে আরেকটা কথা বলার ছিলো তরী।”

এতো সময় অন্যদিকে ফিরে কথা গুলো বলছিল নিহান। কিন্তু এবার আমার দিকে ফিরে কথাটা বললো। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে আগের মতো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

“আমার আর অরিত্রির বিয়ে হয়নি। অরিত্রি এবং আয়ান সম্পর্কে থাকাকালীন ফিজিক্যাল হয় এবং অরিত্রি প্রেগন্যান্ট হয়ে। আমি যখন সত্যিটা জানার পরেও আমি তখন অরিত্রিকে বিয়ে করতে চাই আর কিছুর জন্য না হলেও বাচ্চাটার জন্য বলি। কিন্তু অরিত্রি আয়ানের প্রেমে এতোটাই পাগল ছিল যে, বিয়ে করতে না করে দেয়। কিন্তু অরিত্রির তখন কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বলেই মিথ্যে কথা বলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। এক ছাদের নীচে থাকতে শুরু করি কিন্তু আলাদা আলাদা ভাবে। আমি সোফায় আর অরিত্রি বিছানায় ঘুমাতো। তরী আমি এই সত্যিটা লুকিয়ে রেখে এসেছি তার একটাই কারণ, নিরাত্রি। নিরাত্রি আমার মেয়ে। আমি চাই সম্পূর্ণ দুনিয়া নিরাত্রিকে আমার মেয়ে হিসেবে চেনোক।”

” নিরাত্রি আমার মেয়ে নিহান। নিরাত্রি আপনার আর আমার মেয়ে। আমি নিরাত্রিকে সব সময় আমার কাছে রাখতে চাই নিহান। সম্পূর্ণ পৃথিবী যেমন করে জানবে নিরাত্রির বাবা আপনি ঠিক তেমন ভাবেই পৃথিবী জানবে নিরাত্রির মা আমি। নিরাত্রি আমাদের সন্তান।”

নিহানকে কথা গুলো বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। মানুষটা কখনো নিজের ভিতরে জমে থাকা কথা গুলো মুখ ফুটে বলে না। সব কিছু নিজের ভিতর জমিয়ে রাখে। আজকে কথা গুলো বলে কতটা রিল্যাক্স ফিল করছে তা নিহানের হার্টবিট এবং নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছে। এই মানুষটা ভালোবাসার বিপরীতে কষ্ট পেয়ে এসেছে। আমি আর কখনোই কষ্ট পেতে দিবো না। নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবো।

🍁🍁🍁🍁

সময় যে কারো জন্য থেমে থাকে না সে নিজের আপন গতিতে ছুটে চলে। কেটে গেছে ছয়টি বছর। এই চার বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়নি ” সুখবিন্দর নিবাস” বাড়ির মানুষ গুলোর ভালোবাসা। নিহান সে-ই আগের মতোই আছে। আমার মেয়ে নিরাত্রি না হয়ে যাচ্ছে। আমার এখনো মনে পড়ে এই তো কিছুদিন আগে আমার শাশুড়ি আম্মা বাসর ঘরে নিরাত্রিকে নিয়ে রুমে আসলো। কিন্তু না এমন কিছুই না! সময় কেটে গেছে ছয়টি বছর। নিরাত্রি এখন স্কুলে যায়, নিজের ছোট্ট ভাই কাব্যর সাথে খেলা করে। শাশুড়ি আম্মারও বয়স হয়ে গেছে। পুরানো সব কিছু মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐশীর হাতে কফি দিয়ে চললাম ছাদের দিকে। বাহিরে মেঘ ডাকছে সাথে প্রবল বাতাস। মনে হচ্ছে ঝড় বৃষ্টি হবে। অনেক দিন হলো বৃষ্টি ভেজা হয় না। আজকে এই সুযোগে ভিজতে পারবো।
ছাদে পা দিতে না দিতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। মূহুর্তের মাঝেই ভিজে একাকার হয়ে গেলাম। এতো দিন পর বৃষ্টিতে ভিজতে পেরে কোনো দিক না তাকিয়ে ইচ্ছে মতো ভিজতে লাগলাম।

” তুমি বৃষ্টির মতো স্নিগ্ধ, তুমি মায়াবতী। হঠাৎ তোমার গর্জে উঠা আমার ভীষণ প্রিয়। প্রিয় তোমার চোখের ভাষা, তোমার ভালোবাসা, তোমার বোকার মতো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। তুমি যে আমার ভালোবাসা।”

হুট করেই কানের কাছে কথা গুলো বলতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। এই কন্ঠের স্বর যে আমার চেনা। খুব চেনা। এই কন্ঠের মালিকের সব কিছু আমার চেনা। আশেপাশে থাকলেই মানুষটার শরীরের গন্ধ ভেসে এসে জানান দেয় মানুষটা আমার কাছেই আছে।

“তুমি আমার অবেলায় বেড়ে উঠা ভালোবাসা, তুমি আমার অবেলায় কাছে আসা একমুঠো সুখ। তুমি আমার অবেলায় প্রেম বন্দনার দুঃখ। #তুমি_এলে_অবেলায় আমার জীবনে নিয়ে আসা একফালি বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যার পর নেমে আসা রোদ। তুমি আমার অপ্রাপ্তির খাতায় হঠাৎ ভালোবাসার বড় এক প্রাপ্তির নাম।”

সমাপ্ত