অব্যক্ত প্রিয়তমা পর্ব-২৪

0
361

#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_24

অনিন্দিতা মনের খেয়া তে যেন পানি উঠেছে। সেই থৈ থৈ জলে যেন মেয়েটা ভেসে যাচ্ছে। একটু আগে শুনতে পেয়েছে রোজ প্রেগনেন্ট। ঠিক সেই সময় থেকে বুকের ভেতর নুইয়ে থাকা ভালোবাসার জ্বালা টুকু হাজার খানেক সৈন্য নিয়ে রক্তক্ষরণ করে যাচ্ছে। চোখ থেকে পানি না গড়ানো টা যেন ওকে আরো বেশি যন্ত্রনা দিচ্ছে। এলোমেলো হাতে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পরে অনিন্দিতা। মেয়ে কে বেরিয়ে যেতে দেখে শাহানা বলেন
” অনি এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছিস মা ?”

” একটু দরকার আছে আম্মু। ”

” তোকে তো বলেছিলাম আজ তোকে দেখতে আসবে। তুই তো বললি বিয়ে তে আপত্তি নেই। আমাদের পছন্দ ই তোর পছন্দ। ”

চোখ বন্ধ করে নেয় অনিন্দিতা। রোজের প্রেগনেন্ট হওয়ার খবর শুনে কি বলেছে নিজে ও জানে না। সোফা থেকে উঠে অনিন্দিতা কাছে আসেন শাহানা। কপালে হাত রেখে বলেন
” শরীর অসুস্থ লাগছে ? ”

” না আম্মু। আমার একটু বাহিরে যাওয়া প্রয়োজন। ”

” আচ্ছা যাহ। তবে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবি কেমন ? ”

” আচ্ছা। ”

বেরিয়ে আসে অনিন্দিতা। হঠাৎ করেই রোজ কেন ওকে জুরুরি তলব করলো ঠিক বুঝতে পারছে না। কঠোর বেদনা দেওয়ার জন্য ই কি এই স্বাক্ষাৎ। আনমনেই হেঁটে যাচ্ছিলো অনিন্দিতা। অন্যমনস্ক হওয়ার কারনে পা পিছলে যায়। খপ করে হাত ধরে ফেলে নিহাল। ভ্রু কুটি করে বলে
” মন প্রান সব কিছু কোথায় ফেলে যাচ্ছো অনি ? সাবধানে যাও। ”

” আসলে স্লিপার টা পিচ্ছিল। ”

” ওহ। সাবধানে যাও। ”

নিহাল পথ আগায়। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় অনিন্দিতা। চোখ দুটো কেমন জ্বলছে। কান্না আসতে চাইছে না বরং দু আঁখি তে আগুনের উত্তাপ নেমে যাচ্ছে। ডায়েরী টা মেলে অনিন্দিতা। আজ এই ডায়েরীর পরি সমাপ্তি ঘটবে।

পেটে হাত দিয়ে বসে আছে রোজ। ভালোবাসার চিহ্ন বহনে এমন স্বাদ পাওয়া যায় জানা নেই মেয়েটার। চোখের কোনে পানি জমেছে। আবার কোথাও একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। আপন মানুষ গুলো ভালো না থাকলে সব সুখ যেন তিক্ততার রূপ ধারন করে। প্রায় মিনিট দুয়েক ধরে রোজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দিতা। রোজ কোনো কথাই বলছে না। রাগে চোয়াল শক্ত হয় মেয়েটার। অনাগত অতিথি কে কেন জানি সহ্য হচ্ছে না। নিজের প্রেমের পরিনতি এভাবে অন্যের হতে দেখে বোধহয় কেউ ই সহ্য করতে পারে না। চার পাশে চোখ বুলিয়ে বলে
” কোন দরকারে আমাকে ডেকেছেন রোজ। ”

” পাশে বসো। ”

” ইচ্ছে নেই। ”

” আরে বসোই না। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে আমার কষ্ট হবে। বসো ”

অনিন্দিতা বসে না। বরং চোখ মুখ শক্ত করে বলে
” আমি জানি আপনি প্রেগনেন্ট। আপনি বোধহয় এটা জানাতেই আমাকে ডেকেছেন। সমস্যা নেই নির্ভীক মাহতাবের সন্তানের জন্য শুভ কামনা। এখন আমি আসি। ”

পথ বাড়ায় অনিন্দিতা। রোজ যেন আকাশ থেকে পরেছে। পরমুহূর্তেই মনে পরে অনিন্দিতার কথা। এগিয়ে আসে রোজ। বলে
” তুমি ভুল জানো অনিন্দিতা। আমি তোমাকে অন্য কিছু জানাতে চাই। ”

” কি জানাবেন আপনি ? এই যে নির্ভীক ভাই আমাকে ভালোবাসে না। এই যে এক আকাশ সমান ভালোবাসা কে অভিনয় ভাবেন তিনি। এটাই যে আমার সূক্ষ্ম মনের অনভূতি কে কবর দিয়েছেন তিনি। এটাই যে আমি ওনার জীবনের কাঁটা স্বরূপ। এটাই যে আমি ওনাকে মৃত্যু সম যন্ত্রণা দেই। এটাই যে আমি ওনাকে নিয়ে কোনো বাজি তে মেতেছি ? আমি বাজে মেয়ে। ভালোবাসা কে কাছে পাওয়ার কল্পনা কে নষ্ট চিন্তা ধারা বলে। মেনে নিয়েছি তো ? আর কি জানাতে চান। নির্ভীক ভাই আমাকে ভালোবাসে না। সব থেকে বড় কথা ওনি আমাকে ঘৃনা করেন। সব মেনে নিয়েছি।
জানি না তারপর ও কোন কারনে এই বাচ্চার জন্ম। আদৌ কি এটা কোনো নৈতিক প্রান তাও জানি না। আপনাদের মানসিকতা আমাকে রক্তাক্ত করেছে। ছিই আমি তো ”

কথা শেষ করতে পারে না অনিন্দিতা। তাঁর আগেই থাপ্পড় বসিয়ে দেয় রোজ। এক হাত পেটে রেখে বড় বড় শ্বাস নেয়। অনিন্দিতার দিকে আঙুল শাসিয়ে বলে
” এই মেয়ে কি জানো তুমি ? কতো টুকু জানো তুমি। এই বাচ্চা টা নির্ভীকের একবার ও বলেছি আমি। এটা আমার সন্তান , আমি যাকে ভালোবাসি তাঁর সন্তান। আমাদের বিচ্ছেদের তিন বছর পার হওয়ার পর আমরা আবার এক হয়েছি। সেই ভালোবাসার সন্তান। ”

রোজের কথা বুঝতে পারে না অনিন্দিতা। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ডুকরে কেঁদে উঠে রোজ। বলে
” ইশরাক হলো আমার স্বামী। আমি , নির্ভীক আর ইশরাক বেস্ট ফ্রেন্ড। ভালোবেসে সবার মতামত নিয়েই বিয়ে হয় আমার আর ইশরাকের। মাঝে আমার সাথে প্রতারনা করে ওহ। অন্য মেয়ের সাথে প্রেমে জড়ায়। ভেঙে যায় আমাদের সংসার। কাগজে কলমের বিচ্ছেদ না ঘটলে ও মনের বিচ্ছেদ ঘটে যায়। তাঁর থেকে বড় কথা নির্ভীকের সাথে ইশরাকের সম্পর্ক তিক্ততায় পরিনত হয়। ইশরাক কে খুব মেরেছিলো সেদিন। আমি আটকে নিয়েছিলাম ওকে। কারন ভালোবাসি তো।
সেদিন থেকে নির্ভীক আর আমার বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়। আমাকে আগলে রাখে ওহ। আর এই সম্পর্ক কে তুমি অনৈতিক বলে সম্বোধন করছো ? ”

কাঁদতে কাঁদতে বেঞ্চে বসে পরে রোজ। অনিন্দিতার দু চোখে বৃষ্টির ফোয়ারা নেমেছে। একটু আগে কি বলে দিয়েছে ওহ। বুকের ভেতর ধক করে উঠে। দু চোখ মুছে রোজ। অনিন্দিতার বাহু তে হাত রেখে বলে
” বাঁচাও নির্ভীক কে। ছেলে টা মরে যাবে। শেষ হয়ে যাবে ওহ। অনেক ভালোবাসে তোমায়। অনেক ভালোবাসে, যতো টা তুমি বাসো তাঁর থেকে বেশি ভালোবাসে। কানাডায় এমন কোনো দিন নেই যেদিন পাগলামি করে নি নির্ভীক। এমন কি এক্সাম হলে ও তোমার নামে সংলাপ বলেছে। খাতায় লিখেছে তোমার নাম। সেই পাগল প্রেমিকের গল্প শুনেছে স্বয়ং প্রফেসার । ওহ তোমায় ভীষন ভালোবাসে অনিন্দিতা। বিশ্বাস করো তোমাকে করা আঘাতের দ্বিগুন যন্ত্রনা নিজে নিয়েছে। কখনো বুঝতে দেয় নি। কখনো বুঝতে দিবে ও না। ছেলেটা কে বাঁচাও অনিন্দিতা। ফ্লাইট মিস হওয়ায় আজকে কানাডায় যেতে পারবে না ওহ। তবে অতি দ্রুত চলে যাবে বলেছে। ”

সর্বাঙ্গে যেন কেউ পাথর চেপে দিয়েছে। শরীর কাঁপছে মেয়েটার। অস্ফুটন স্বরে বলে
” ওনি কোথায় ? ”

” ইশরাকের সাথে পাশের লেকেই আছে। ওহ জানে না আমি তোমাকে আসতে বলেছি। দ্রুত যাও অনিন্দিতা। আজকে তোমার বিয়ের ”

রোজের কথা শুনতে পায় না ওহ। তাঁর আগেই ছুট লাগায় বহদূর। রোজ চমকায়। হিচকি উঠে যায় ওর। এ প্রেমের পরিনতি এতো নিষ্ঠুর কেন হচ্ছে ? একটা সংসারের জন্য দুটো মানুষের মন ই কি যথেষ্ট নয় ?
.

পাশে জমিয়ে রাখা কংক্রিট। একটা একটা করে লেকের পানি তে ছুড়ছে নির্ভীক। ওর পাশেই বসে নিষ্পলক চেয়ে আছে ইশরাক। বহু যন্ত্রনা জমে আছে মনে। হৃদপিন্ড যেন বুক চিরে বেরিয়ে আসে।নির্ভীকের চশমা খুলে ফেলে ইশরাক । আনমনেই হেসে বলে
” কি দরকার চশমা পরার ? সেক্রিফাইস করেই জীবনে অনেক জ্ঞানীর পরিচয় দিচ্ছিস। আর তো প্রয়োজন নেই। ”

” জ্বালাস না ইশরাক। বলেছি তো তোকে কখনোই ক্ষমা করবো না। ”

” নেশা তো করিস নি। নেশাক্ত কথা কেন বলিস ? ”

” মনের নেশার থেকে তোর দু প্যাকের ওয়াইন বড় কোনো নেশা হয়ে গেল। মন কে মানাতেই মনের নেশা করেছি। ওয়াইন পান করি নি আমি। ”

” নিজেকে সামাল দেয় নির্ভীক। এখনো অনেক সময় আছে। ”

” সময় তো ফুরিয়ে গেছে আরো নয় বছর আগেই। ভালোবেসে পাপ করেছিলাম আমি। কিশোরীর প্রেমে পরে অন্যায় করেছিলাম। আমার মতো পাগল কেউ নেই রে। তেরো বছরের মেয়ের প্রেমে পরেছি আমি। কিংবা আরো ছোট থেকেই অনভূতি গড়েছি। ”

” এতো ভালোবাসার পর ও কেন জীবন্ত কবর দিচ্ছিস নির্ভীক। সব কিছুর সমাধান হয় আর তুই নিজেই চাইছিস না সমাধান।”

” প্রকৃত প্রেমিক হলে অনিন্দিতা কেই বেছে নিতাম আমি। ছোট্ট সংসার গড়ার এবিলিটি আমার আছে। তবে কি জানিস আমি স্বার্থপর নই। ”

নির্ভীকের বাহু তে হাত রাখে ইশরাক। ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে
” প্লিজ নির্ভীক আমি কথা বলি সবার সাথে ? ”

” একদম নয়। ভালোবাসার শাস্তি আমার আর অনিন্দিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আমি চাই না আমাদের জন্য বাকি মানুষ গুলো কষ্ট পাক। ”

” ডাফার সারা জীবন কষ্ট পাবি তোরা। ”

” সব জেনেই তো ভালোবেসে যাচ্ছি। শুধু ক্ষমতা নেই কাছে টানার। সমস্ত ভালোবাসার পূর্নতা হয় না। কিছু প্রেম তো অব্যক্ততার মাঝেই শেষ হয়ে যায়। অথবা শেষ হয়ে ও হয় না শেষ। আমার ভালোবাসা অব্যক্ত ই থাক। ”

একটু থামে নির্ভীক। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন চোখ জ্বলসে যায়। অনিন্দিতা ও সূর্যের মতো। বলে
” দেখ তোর আর রোজের বিষয় টা ছিলো অন্য রকম। ইনফেক্ট তদের মাঝের দূরত্বের কারন ছিলি তুই। নিজের ভুল বুঝতে পেরে এখন ফিরে এসেছিস। রোজ ও তোকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমার আর অনিন্দিতার মাঝে আছে দেয়াল। শক্ত পোক্ত দেয়াল।কিছু প্রতিজ্ঞা কিংবা প্রতিশ্রুতি। সেই সময় টা আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি নিজের স্বার্থের জন্য ওদের কষ্ট দিতে পারবো না। ”

” পাগল একটা। ”

” বদ্ধ পাগল। অনিন্দিতা কে ভালোবেসে মরে যে যাই নি এটাই আমার শত জন্মের ভাগ্য। অদ্ভত ভালোবাসা, দুটো মন একে অপর কে আঁকড়ে আছে অথচ বাস্তবতায় অনিন্দিতা কে কাছে টানার কোনো এবিলিটি নেই আমার। রাসকেল আমি। মেয়েটার চোখের পানি দেখে ও চুপ থাকতে হয়। বলতে পারি না অনিন্দিতা আমি আপনাকে ভালোবাসি , নিজের থেকে ও বহু গুন বেশি ভালোবাসি। ”

” কেন বলতে পারেন না নির্ভীক ভাই ? ”

চলবে