অভিলাষী পর্ব-০১

0
19

#অভিলাষী
#আরশিয়া_জান্নাত

আমার আর ডালি আপার বিয়ে মাত্র ক’দিনের আগপিছে হয়েছে। আপার বিয়েবাড়ির মেহমান বাসায় না ফিরে আমার বিয়ের দাওয়াত খেয়েই ফিরেছে এমন হাল। বিয়ের পর মানুষের জীবন কতখানি বদলায় তা নিয়ে আমার ধারণা ছিল না। তবে কয়েকদিনের মাঝেই টের পেয়ে গেছি Life isn’t a bed of roses.. আমার বিয়েটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল এমন নয়, ঝকঝকে রৌদ্রজ্জ্বল আকাশে হঠাৎ একপশলা বৃষ্টির মতোই আকস্মিক বলা চলে। আমি জানি না এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেয়ার কী আবশ্যকতা ছিল। যেখানে ডালি আপার বিয়ের জন্য প্রায় মাসখানেক শুধু পাত্র দেখেই কেটেছে সেখানে আমার বেলা এক দেখাতেই সব কীভাবে ঠিক হলো আমি সত্যিই জানি না। আমার সবসময় মনে হতো এই সংসারে আমার মূল্যায়ন কম। ডালি আপার তুলনায় খুবই নগণ্য একথা বলতে অপেক্ষা রাখেনা। একই পরিবারে দু’টো মেয়ের আদরযত্নে আকাশ পাতাল ফারাক। এতদসত্ত্বেও আমি সুখেই ছিলাম। বিয়ের পর সেই সুখের পরিমাণ আরো বেশি মনে হচ্ছিল, কেননা এখানে আমার সুখের ছিটেফোঁটাও নেই।

আমার ঘুম ভাঙ্গে খুব ভোরে দরজার ঠকঠক শব্দ শুনে। আমি আলগোছে উঠে খুব মৃদু গলায় জানান দেই উঠেছি। তারপর দ্রুত গোসল সেরেই রান্নাঘরের চৌকাঠ মারাই। একেকজন একেক পদ দিয়ে নাস্তা করেন, তাই আমাকে এই অল্প সময়েই কয়েকটা আইটেম বানাতে হয়। আমার সাথে যদিও একজন কাজের খালা থাকেন, তবে তিনি থাকা না থাকা সমান। সকাল ৭টায় ডাইনিং টেবিলে সব কিছু তৈরি থাকতে হয়। একটু হেরফের হলে আবার আমার শ্বশুর পানিও ছুঁয়ে দেখবেন না। এই খাওয়ার পর্ব শেষ হতে না হতে আবার ছুটতে হয় বরের জন্য লাঞ্চ প্যাক করার দৌড়। ১০টায় চা বিস্কুট দেওয়ার পর্ব তো আছেই। তাই বলা যায় আমার সকাল আগের মতো আরামে কাটেনা। “সংসারের কাজকর্ম করা খুবই সহজাত বিষয় আমাদের দেশে। এটা নিয়ে অভিযোগ করা বোকামি জানি। আমার ভাগ্যে ছিল এমন ভরা সংসারের বৌ হবো হয়েছি। তাই অন্যদের তুলনায় আমার কাজ বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কাজ করলে কারো ক্ষতি হয়না, বরং ফিটনেস বাড়ে!”
এমন কথাই আমার মা আমাকে বলেছেন যখন আমি অভিযোগ করে বলেছিলাম এখানে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। আমি যখন এই নতুন যাতায় পিষে গুঁড়ো হচ্ছি তখন ডালি আপা বরকে নিয়ে হানিমুনে গেছেন নেপালে। আপা খুব আদরের মেয়ে কি না! তাকে দেখেশুনে খুব ভালো ঘরেই বিয়ে দেয়া হয়েছে। যেখানে পানির গ্লাসটা পর্যন্ত তাকে বয়ে নিতে হয়না। তার বাড়িতে পরিবারের সদস্যের চেয়ে কাজের লোকের সংখ্যা বেশি। তাই বলা বাহুল্য আপা খুব আরামেই সুখেশান্তিতে আছেন। ঠিক যেমন বিয়ের আগে থাকতেন।
ঠিক এই জায়গাতেই আমার বুকে কাঁটা ফুটে! ভাগ্য বলে আমার উপর সবটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এমনটাই আমার মনে হয়। শুধু যে মনে হয় তা না, আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি এটাই সত্যি!
আমার সাথে আমার বাবা-মা অন্যায় করেছেন। খুব বড় অন্যায় করেছেন এবং এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুতাপ ও নেই। এই জিনিসটা যখন থেকে বুঝতে পেরেছি তখন থেকে আমি অভিযোগ করা ছেড়ে দিয়েছি। আমার মন পুড়ুক কী দেহ আমি কোনোকিছু ই তাদের বলি না। আল্লাহর কাছে খুঁজে এনেছি এই ভাগ্য এমন ভেবেই নিরবে সব করে যাই যেন কেউ কোনো অভিযোগ করতে না পারে। ডালি আপাকে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম সব জায়গা থেকে আনফলো করে রেখেছি। এটা হিংসা থেকে করেছি তা নয়, আমাকে যেহেতু এই জীবনে এডজাস্টমেন্ট করতে হবেই, তাই এডজাস্টমেন্টকে আরো কঠিন করে না তুলতেই নিজের বোনের সুখী জীবন থেকে নিজেকে বহুদূরে আড়াল করাটাই সহজ ছিল মনে করেই করেছি। আমি জানি ওরা আমার এই সরে যাওয়া বা দূরে থাকাকে হিংসা বলেই আখ্যায়িত করেছে। তবুও আমি কষ্ট পাই না। যে যা বলার বলুক, মনের শান্তি হচ্ছে আসল‌। যা আমাকে শান্তি দিবে না তা দেখে অশান্তি বাড়ানোর মানে হয় না।
এমন না আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ গরীব বা আমার হাজবেন্ড ডালি আপার হাজবেন্ড এর চেয়ে কম সুন্দর। সে আমার অযত্ন করেনা, আবার যত্ন ও করে না। এই আর কী!

আমি খুব কল্পনাপ্রবণ মেয়ে। সবসময় রোমান্টিক নাটক সিনেমা দেখে বড় হয়েছি। কল্পজগতের কোরিয়ান ড্রামা গলাধঃকরণ করা আমিটার কাছে সাদাকালো যুগের সিনামা বেখাপ্পা লাগবে এটাই স্বাভাবিক। আমি ভাবিনি ওরকম সুইট চকলেট বয় না হোক মিনিমাম কেয়ার করার পুরুষ আমি পাবোনা। জ্বর হলে কপাল ছুঁয়ে দেখার মানসিকতা অন্তত তার থাকবেনা! আমাদের দেশেও তো কত পুরুষ আছে যারা তার স্ত্রী কে অনেক যত্ন করে, অনেক ভালোবাসে। আমার ভাবনার মতো উচ্চপদস্থ না হোক সাধারণ যে বৈশিষ্ট্য আছে তাও বুঝি তার মাঝে থাকা গেল‌ না? আমাকে সবদিকেই কেন‌ এতোটা অভাগী হওয়া লাগলো?
আমি জানিনা আমাকে আপনারা কী নামে ডাকবেন, লোভী? অকৃতজ্ঞ? হিংসুক বা উচ্চাভিলাষী? জীবনে এতো আনফেয়ার হবার পরও হাসিমুখে স্যাটিসফাইড থাকার মতো মহীয়সী আমি নই। আবার যে সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবো সেই সাহস বা সামর্থ্য ও আমার নেই। তাই চুপচাপ বিস্বাদ মনেই ৮মাসের দীর্ঘ (!) সংসার বয়ে চলেছি দিনের পর দিন।

আকাশ কালো করে মেঘ জমা হয়েছে, খুব শীঘ্রই বৃষ্টি নামবে। তাই ছাদে শুকাতে দেওয়া আচারের বয়াম আর কাপড় নিতে আমি এক প্রকার দৌড়েই ছুটেছি। ছাদে গিয়ে দেখি কাপড় সব সিঁড়িঘরের রেলিং এ রাখা, আচারের বয়ামগুলোও ভেতরে‌। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কৌতুহলী দৃষ্টিতে ছাদে গেলাম। তাকিয়ে দেখি আমার উনি অর্থাৎ তৈমুর দাঁড়ানো।
ঝড়ো হাওয়ায় চারপাশে ধূলোবালি উড়ছে, বৃষ্টি শুরু হবার আগ মুহুর্ত বরাবরই আমার ভীষণ মনোরম লাগে।
আমি উনার পেছনে দাঁড়িয়ে ভাবছি ধন্যবাদ বলবো কী বলবোনা। উনি আমার উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ঘুরে দাঁড়ালেন। দু’হাত বুকে ভাঁজ করে রাখা, আমার দিকে মাথা নুইয়ে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন। আমি কৈফিয়তের স্বরে বললাম, “ঐগুলো আপনি সরিয়েছেন?”

“কী মনে হয়?”

“আপনি ছাড়া তো কাউকে দেখছি না, মনে হয় আপনি ই করেছেন। ধন্যবাদ…”

“ধন্যবাদ?”

“হ্যাঁ, কেন ধন্যবাদ বলেনা?”

“বলতে হবে কেন? আমি তো অন্য কারো কাজ করিনি। আপনজনের কাজ করলে ধন্যবাদ দিতে হয়?”

“না সেটা দিতে হয় না তবে অনুভূতি প্রকাশ করতে মুখের ভাষা ব্যবহার করতে হয়। নয়তো অপরজন মনের কথা বুঝবে কীভাবে! ছোট্ট একটা স্যরি বা থ্যাংক ইউ তে অনেক কিছু ঘটে।”

“আচ্ছা!”

আমি ওখান থেকে চলে আসছিলাম তখন হঠাৎ তৈমুর আমার হাত ধরে থামালো।

“কিছু বলবেন?”

“বৃষ্টিতে এলার্জি আছে? ঠান্ডা লেগে যায়?”

“নাহ! কেন?”

“এমনি জেনে নিলাম।”

“আপনার কী বৃষ্টিতে ভেজার মতলব আছে? বছরের ১ম বৃষ্টিতে ভিজতে নেই বলে…”

“ভিজলে কী হয় জানো?”

“শুনেছি প্রথম বৃষ্টি তুলনামূলক এসিডিক হয়, তাই এটা এড়ানোই ভালো।”

“বাহ তুমিতো বেশ জ্ঞানী! গুড..”

আমি ঐটুকু প্রশংসাতেই লজ্জায় গলে পানি হয়ে যাই। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন, আর কিছু বলেন না। বৃষ্টি দেখে সবার শখ হয়েছে খিচুড়ি খাবে। তাই গরুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে গোল গোল করে বেগুন আর ডিম ভেজে নিলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া এখন বেশ শীতল। বৃষ্টির এই এক মহত্ত্ব নিমিষেই সব উত্তাপ গায়েব করে চারদিকে সতেজতা ছড়িয়ে দেয়। আমি গুনগুন করে গান গাইছি আর রান্না করছি। মশলাপাতি সব গুছিয়ে রাখতে গিয়ে দেখি তৈমুর পানির বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ হয়ে গেলাম। আমি রান্না করার সময় সচরাচর এখানে কেউ আসেনা। সেও আসেনা তাই তাকে দেখে ভীষণ চমকে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে কাছে এসে কপালে আলতো হাতে ছুঁয়ে ঘাম মুছে দিলেন। তারপর যেভাবে এসেছেন সেভাবেই নিরবে চলে গেলেন। আমি কপাল মুছে দম ছেড়ে ভাবতে লাগলাম লোকটা শ্বাসরুদ্ধ করার মতো কার্যকলাপ ও করতে পারে দেখছি!

আমার রান্না নিয়ে এখন এ বাড়িতে আর কারোই অভিযোগ নেই। ইনফ্যাক্ট এখন আমার রান্না ছাড়া কারোই কিছু ভালো লাগেনা এমন কথাও বলতে শোনা যায়। আমি জানিনা এটা নেহাতই বলার বলা নাকি খাটিয়ে মারার কৌশল। তবে আমার শাশুড়ি মাঝেমধ্যে এটা ওটার দোষ ধরে বকা দিতে কার্পণ্য করেননা। বিশেষত যেদিন আমার রান্নার বেশি প্রশংসা হয়, সেদিন উনার দোষ ধরা বাড়ে। তাই আমি মনে মনে দোয়া করি কেউ আমার রান্নার প্রশংসা না করুক। আমার ননদ আঁখি ব্যাপার টা বুঝতো, সে মাঝেমধ্যে আমার পক্ষ নিয়ে বলতো, “আম্মু তুমি আসলেই রিনা খান হয়ে যাচ্ছ। বৌয়ের গুণ স্বীকার করতে তোমাদের শাশুড়িসমাজের কেন এত বাঁধে কে জানে!”
তার কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলেও তৈমুর হাসেনা। বরং গম্ভীর গলায় বলে, “মায়েরা দোষ ধরে বলেই সন্তানদের ত্রুটি কমে যায়। ব্যাপারটাকে নেগেটিভলি না নিয়ে পজেটিভলি নিলেই পারিস। ”

আঁখি তার ভাইয়ের সামনে দমে গেলেও সুযোগ পেলেই এমন বেফাঁস কথা বলে ফেলে। আমি এখানে কোনো প্রতিক্রিয়াই করি না, কেউ ভালো বললেও যা মন্দ বললেও তা। আমার কাছে দুই ই সমান। এভাবে দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেল। আমি পারতো পক্ষে বাবার বাসায় যাই না, তারাও আমাকে নেয়ার আগ্রহ দেখায় না। না আমার ভাইয়েরা কেউ আসে চোখের দেখা দেখতে। বিয়ে দিয়ে সবাই দায়সারা হয়ে গেছে। আমি ধরে নিয়েছি আমার খুব দূরে শ্বশুরবাড়ি হয়েছে তাই ওরা কেউ আসতে পারেনা। আমার জন্মদিন কারো মনে থাকেনা, আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া ছিল বলে হয়তো নোটিফিকেশন পেয়ে মনে পড়তো, বিয়ের পর আমি সেটা হাইড করে ফেলায় কেউই আর উইশ করেনা। সত্যি বলতে ওরা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আমিও তাদের এই পথ আরো সুগম করার ব্যবস্থা করেছি। নিজেকে একটা অদৃশ্য দেয়ালের আড়াল করে ফেলেছি, যেটার ঘনত্ব সময়ের সাথে কেবল বেড়েছে, কমেনি। কেউ কমানোর চেষ্টা ও করেনি। যে মানুষ তার আপন পরিবারের অবহেলা পেয়ে অভ্যস্ত সে অন্য পরিবারের মানুষের কাছে আর কতটাই প্রত্যাশা রাখবে? যেখানে প্রত্যাশা নেই সেখানে কষ্টও নেই।

আমি ১ম কনসিভ করেছিলাম বিয়ের ৪মাসের মাথায়। কিন্তু কেন জানি সেবার টিকেনি। পরবর্তীতে যখন কনসিভ করি আমার মনে ভয় ঢুকে যায় এবারো যদি মিসক্যারেজ হয়। আমি ব্যাপারটা কাউকে শেয়ার করতেও পারছিলাম না। কিভাবে কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বহু ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম তৈমুর কে বলবো, তার অন্তত জানা‌ উচিত আমি মানসিকভাবে কতোটা দুশ্চিন্তায় আছি। সেদিন রাতেই তার অফিস থেকে ফিরতে অনেক রাত হলো। তাই আর বলা হয়নি। এদিকে খাবার খেতে আমার অনেক অসুবিধা হচ্ছিল। সবকিছুতেই মাছের আঁশটে গন্ধ পাই। কোনোমতে দু লোকমা মুখে তুললেই বমি করতে করতে আমার জান‌ যায় দশা। আমি অভিমানের পাহাড়ের কথা ভুলে মাকে মিস করতে থাকি। আমার মনে হয় মায়ের কাছে থাকলে আমার এতো কষ্ট হতোনা। কিন্তু যখন মনে পড়ে ডালি আপাও মায়ের বাসায় আছে, তখন আর যেতে মন চায়না। আমি জানি ওখানে গেলে আমি আবারো বৈষম্য দেখবো। যা আমাকে আরো চূর্ণ বিচূর্ণ করবে। তারচেয়ে বরং এখানে ই থাকি, ওরা অন্তত আমাকে অবহেলা করবেনা। আমার শ্বশুর রোজ আমার জন্য এটা ওটা নিয়ে আসে, আমি কি খেতে চাই কোনটা আমার অপছন্দ সব খোঁজ নেয়। আমার ননদ আঁখি নানান দেশের রেসিপি দেখে কত কী বানায়, কিছু একটা যদি মুখে রুচে এই আশায়! আমি ভালো কিছু খেতে না পারলেও আজগুবি কিছু জিনিস খাওয়া শিখেছি। যেমন বোম্বে মরিচ। আমি প্রচুর মরিচ খাই, দেখা যায় খালি খালিও মরিচ চিবুচ্ছি। আমার একটুও ঝাল লাগেনা। বোম্বে মরিচের ঘ্রাণটা আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে গেছে। আমার হাতে এখন সারাক্ষণ ই মরিচ শোভা পায়। আমার শাশুড়ি মা ইতোমধ্যেই ছাদে কয়েক পদের মরিচ গাছ লাগিয়েছেন। উনার গাছের হাত মাশাআল্লাহ ভালো ই। গাছগুলো খুব দ্রুতই বেড়ে উঠে মরিচ দিয়েছে। মরিচ খাওয়া নিয়ে কেউ কিছু না বললেও তৈমুর মাঝেমধ্যে ডাক দেয়, বলে এতো মরিচ খেলে পাকস্থলীতে আবার কিছু হয় কি না! তার কথা কেউ কানে তুলেনা। সবার এক কথা বৌমা যা খেয়ে মজা পায় তাই খাবে। সে কাউকে কোনোকিছু না বললেও চেকাপ করাতে গেলে ডাক্তার কে ঠিকই জিজ্ঞেস করে ক্ষান্ত হয়। আমি তার এসবে আনন্দিত হই। আমার মনে হয় সে আমার কেয়ার করছে।


সাতমাসের সময় আমার বাবা-মা আসেন। হঠাৎ তাদের মনে পড়ে তাদের আরেকটা মেয়ে আছে! মা ভদ্রতার খাতিরে একবার বলেন আমাকে নেয়ার কথা। কিন্তু আমার শাশুড়ি রাজি না হওয়ায় ২য় বার আর অনুরোধ করেন নি। সবচেয়ে বড় কথা রাতে আমার প্রচুর পা ব্যথা করে, তখন তৈমুর আমার পায়ে তেল মালিশ করে দেয়। ওখানে গেলে কে এটা করবে? আমার মরিচের যোগান ই বা কে দিবে হেহেহে।
সবাই বলে আমি নাকি অনেক সুন্দর হয়ে গেছি। তাই আমার মেয়ে হবে। তৈমুর অবশ্য সেরকম কিছু বলেনা। আজকাল তার চাহনিতে বড়রকম পরিবর্তন এসেছে। সে কেমন করে যেন আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি বোঝার চেষ্টা করি চাহনি টার অর্থ কী। আমি মোটা হয়ে গেছি তাই তার অপছন্দ হচ্ছে? সে কি আমার ফোলা পেট দেখে বিরক্ত? নাকি অন্য কিছু? মাঝেমধ্যে আমি কেঁদেই ফেলি এই ভেবে সে বুঝি আমাকে আর পছন্দ করছেনা। আমার আজকাল অকারণেই কান্না আসে, আমি সবার আড়ালে অযথাই কান্নাকাটি করি। আমি আমাদের পুরনো ছবির এলবাম দেখেও কান্না করি। জীবনের সব দুঃখ যেন আমার সামনে এসে ভিড় করে। আমার কান্নার তোপ বাড়ে, অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলি কাঁদতে কাঁদতে। আমার এই নিরব যুদ্ধের সাক্ষী আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়। আমি জানিনা আর পাঁচটা মেয়ের ও এমন ফিল হয় কি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি যদি মরে যাই আমার বাচ্চাটার কী হবে? ওকে কী কেউ মাতৃস্নেহে বড় করবে নাকি অবহেলায় অনাদরে আগাছার মতো বেড়ে উঠবে সে? আচ্ছা তৈমুর কী আবার বিয়ে করবে? ও কী আমাকে খুব সহজে ভুলে যাবে? এরকম নানা উদ্ভট চিন্তাভাবনা আমার মাথায় ঘুরতে থাকে।

তারপর এক রাতে আমার সামনে সবটা উন্মোচন হয়। আমি আবিষ্কার করি এক চরম বাস্তবতা…..

চলবে,,