অর‌ণ্যে রোদন পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
265

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখা: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৩৭

৩৯!!
কিছুক্ষণ আগে বর্ষ‌ণের স্ত্রী নীরা‌কে আনুষ্ঠা‌নিকভা‌বে তু‌লে আনা হ‌য়ে‌ছে। বরযাত্রীতে তূবার বাবাও গি‌য়ে‌ছি‌লেন। তূবা অবশ্য যায়‌নি। কথা অসুস্থ সে কার‌ণে ও-ও এবং শ্রাবণী যায়‌নি। শ্রাবণী, তূবা‌কে যে‌তে বল‌লেও তূবা যায়‌নি। কথা আর তূবা মি‌লে বর্ষ‌ণের রুমটা সুন্দর ক‌রে সা‌জি‌য়ে‌ছে। নীরা‌কে এনে প্রথ‌মে ড্র‌য়িং রু‌মে বসা‌নো হ‌য়েছিল।

সেখা‌নে সব আত্মীয়-স্বজন নতুন বউ দেখার পর নীরা‌কে নি‌য়ে বর্ষ‌ণের রু‌মে বসা‌নো হ‌লো। বর্ষণ তখন সবার সা‌থে বাই‌রের কাজ দেখ‌ছিল। কথা, তূবা, শান্তা আরও বেশ ক‌য়েকজন নীরার সা‌থে ব‌সে দুষ্টু‌মি কর‌ছে। নীরা‌কে বারবার এটা ওটা ব‌লে খোঁচাচ্ছে।

এক পর্যায় নীরা তূবা‌কে বলল, ‘শখের ননদিনী একটু কা‌ছে আসেন কথা আছে।’
তূবা কা‌ছে যে‌তেই নীরা, তূবার কান নি‌জের মুখের কা‌ছে নি‌য়ে‌ ফিস‌ফিস ক‌রে বলল,
‘এই আমা‌কে নি‌য়ে এত মজা নি‌চ্ছিস আমি য‌দি এখন সবার সাম‌নে তোর আর শ্রাব‌ণের বিষয়টা ফাঁস ক‌রে দি ত‌বে কেমন হ‌বে? আজ বা‌দে কাল তুই আমার জা হ‌বি।তখন কিন্তু কড়ায় গন্ডায় সব শোধ তুল‌বো।’

তূবা চোখ বড়ো বড়ো ক‌রে তাকাল। নীরা বলল, ‘ভয় পে‌য়ো না ননদিনী আমি এখন কাউ‌কে বলবো না। ত‌বে বি‌নিম‌য়ে তুুমি নাহয় আমার প্রিয় দেবর‌কে দু‌ই চারটা উম্মা দি‌য়ে দিও।’

তূবা লজ্জায় লাল হ‌য়ে গেল। নীরা মুচ‌কি মুচ‌কি হাস‌ছে। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ আসল। নীরা, শ্রাবণ‌কে দে‌খে দুষ্টু হে‌সে বলল,
‘ভাই শোন, তূবা তো‌কে কিছু ‌জি‌নিস দি‌বে। আমি দি‌তে ব‌লে‌ছি। তুই কিন্তু সুযোগ বু‌ঝে চে‌য়ে নি‌বি।’
শ্র‌াবণ বলল, ‘কী দি‌বে ভা‌বি?’
নীরা মুখ টি‌পে হে‌সে বলল, ‘আ‌ছে একটা জি‌নিস। সেটা তূবা‌কে জি‌জ্ঞেস ক‌রিস।’
তূবা অসহায় চো‌খে নীরা আর শ্রাব‌ণের দি‌কে চে‌য়ে রইল।

রাত দশটা,
তূবা, শ্র‌াবণীর কা‌ছে গি‌য়ে বলল, ‘চা‌চি বাসায় যাব।’
‘‌খে‌য়ে‌ছিস?’
‘হ্যাঁ। কথার সা‌থে খে‌য়ে‌ছি।’
‘‌একা যে‌তে পার‌বি।’
শ্রাবণ দৌ‌ড়ে এসে বলল, ‘আ‌মি দি‌য়ে আস‌ছি।’
তূবা, মুচ‌কি হাসল। শ্রাবনী বলল, ‘আচ্ছা। ত‌বে তূবা‌কে দি‌য়ে তুই জল‌দি আস‌বি। বাসায় কিছু কাজ আছে।’
‘আচ্ছা মা। তূবা… আপু… চ‌লেন…।’

যেতে যে‌তে তূবা ক‌পোট রাগ দে‌খি‌য়ে বলল, ‘সবসময় টান মে‌রে আপু ব‌লিস কেন?’
‘এই ধ‌রো মজা লাগে।’
‘এক‌দিন আচ্ছাম‌তো ধো*লা*ই দি‌লে মজা ছু‌টে যা‌বে।’
‘‌হা হা হা।’
‘ভূতের ম‌তো হা‌সিস না। চল।’

শ্রাবণ আবারও শব্দ ক‌রে হে‌সে তূবার হাত ধরল। তারপর বলল, ‘ভা‌বি তখন কী দি‌তে বলল?’
তূবা ঢোক গি‌লে বলল, ‘‌কিছু না। ভাবি দুষ্টু‌মি কর‌ছে। একটা কথা ব‌লো আমা‌দের সম্পর্কের কথা তু‌মি কা‌কে কা‌ছে বলছে‌া? আমার বন্ধুরা সবাই জা‌নে। কথা আপু আর তোমার বান্ধবীরা সবাই জা‌নে। আমাদের কা‌জিন‌দের ম‌ধ্যে শান্তা জানে। নীরাভা‌বি জা‌নে বাট বর্ষণ ভাই জা‌নেন না। ভাই জা‌নে তোমার পিছ‌নে আমি ঘু‌রি বাট তু‌মি পাত্তা দ‌াও না। আরও ক‌য়েকজন জা‌নেন।’

তূবা দাঁ‌তে দাঁত চে‌পে বলল, ‘তাহ‌লে বাদ আছে কে? দুনিয়ার সবার কা‌ছে তো ঢোল পি‌টি‌য়েই রেখে‌ছিস। আমার প‌রিবার‌কেও ব‌লে দে। তারপর একসা‌থে বি‌য়ে করে‌ নে।’
‘বাহ্! দারুণ আইডিয়া।’

তূবা, শ্রাব‌ণের টি-শা‌টের কলার টে‌নে বলল,’‌তোর পে‌টে কো‌নো কথা প‌চে না?’
শ্রাবণ, তূবার কপা‌লে কপাল ঠে‌কি‌য়ে বলল, ‘য‌দি শুধু প্রেম করার উদ্দে‌শ্যে তোমা‌র সাথে সম্পর্ক করতাম তাহ‌লে কাউ‌কে বলতাম না। যা করার চু‌পি চু‌পি করতাম। কিন্তু আ‌মি তোমা‌কে নি‌য়ে খুব‌ সি‌রিয়াস। তাছাড়া তোমা‌কে এত ভা‌লোবাসি যে, নিজের মা‌ঝে চে‌পে রাখ‌তে পার‌ছি না। আমার আশে পা‌শে সবাই‌কে ব‌লে দি‌চ্ছি। যা‌তে বি‌য়ের সময় তোমার বাপ রা‌জি না হ‌লেও সবাই মি‌লে রা‌জি করা‌তে পা‌রি।’

শ্রাব‌ণের কথাগু‌লো তূবার খুব ভা‌লো লাগল। ও টুপ করে শ্রাব‌ণের গা‌লে একটা চুমু‌ খে‌য়ে বলল, ‘ভা‌বি এটা দি‌তে ব‌লে‌ছি‌লেন।’
শ্রাবণ খু‌শি‌তে আটখানা হ‌য়ে বলল, ‘সম্পর্ক শুরুর পর প্রথম গা‌লে চুমু। ভা‌বি‌কে এ জন্য বি‌শেষ ধন্যবাদ।’

তূবা লাজুক হাসল। কিছুটা হাঁটার পর শ্রাবণ বলল,
‘তূবা!’
‘হুম।’
‘সব ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ কেন?’
‘‌কেন জা‌নি ম‌নে হ‌চ্ছে তু‌মি কিছু নি‌য়ে চিন্তা কর‌ছো?’
‘না তেমন কিছু না।’
‘সন্ধ্যা থে‌কেই খেয়াল কর‌ছি তু‌মি যতই সবার সা‌থে হা‌সিখু‌শিভাবে কথা ব‌লোনা কেন, কিন্তু ভিত‌রে ভিত‌রে অদ্ভুত অস্থিরতায় ভুগ‌ছো। কী হ‌য়ে‌ছে ব‌লো?’

দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে তূবা বলল, ‘‌ঠিক চিন্তা কর‌ছি না, কিন্তু মনটা ভীষণ অস্থির হ‌য়ে আছে।’
‘‌কেন?’
‘‌সেটাই তো বুঝ‌তে পার‌ছি না।’
‘বারবার ম‌নে হ‌চ্ছে খারাপ কিছু হ‌বে। মনটা খুব কু ডাক‌ছে।’
‘ওসব কিছু না।’

‘না‌রে নি‌শ্চিত খারাপ কিছু হ‌বে। আমার যখনই মন এমন অস্থির লা‌গে তখনই কিছু না কিছু খারাপ হয়। সেটা আমার সা‌থে হোক বা আমার কা‌ছের মানুষ‌দের সা‌থে। তুই প্লিজ ক‌দিন সাবধা‌নে চলা‌ফেরা ক‌রিস।’
‘অ‌া‌রে ওসব কিছু না। তোমার ম‌নের ভুল। জাস্ট ইগ‌নোর।’
‘‌সেটাই তো চা‌চ্ছি, কিন্তু মন ম‌স্তিষ্ক থে‌কে অস্থিরতা কাট‌ছে না।’

শ্রাবণ হুট ক‌রে তূবা‌কে পিছন দি‌য়ে জ‌ড়ি‌য়ে ধরে বলল, ‘সবসময় কেন এত টেনশন ক‌রো ব‌লো তো?’
তূবা কিছু সময় স্থির হ‌য়ে দাঁ‌ড়ি‌য়ে থে‌কে শ্রাব‌ণের দি‌কে ঘু‌রে ওর কপা‌লে আবার চুমু খে‌য়ে বলল, ‘‌প্লিজ নি‌জের খেয়াল রা‌খিস।’

শ্রাবণ হে‌সে বলল, ‘আচ্ছা। ত‌বে তু‌মি প্লিজ আমা‌কে তুই বা তু‌মি যে কো‌নো একটা ডাকো। কতক্ষণ তু‌মি ডা‌কো তো কতক্ষণ তুই। গোজা‌মিল ক‌রো না।’
তূবা হে‌সে বলল, ‘তুমিই ব‌লেছি‌লে হবু স্বামী‌কে তুই কেন ব‌লা ঠিক না। তাহ‌লে না‌কি পাপ হ‌বে।’
শ্রাবণ হে‌সে বলল, ‘তু‌মি, তুই ক‌রেই ডা‌কো সেটাই ভা‌লো লা‌গে। এখন একটা টাইট হাগ ক‌রো তো। বা‌ড়ি এসে গে‌ছে।’
তূবা শক্ত ক‌রে শ্রাবণ‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধরল।

খুব শীঘ্রই আমার নতুন বই “‌রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া” বইটা হা‌তে পা‌চ্ছে। অর্ডার ক‌রে‌ছেন তো? নয়‌তো অর্ডার লিংক সবার শে‌ষে দেওয়া।

রাত বা‌রোটা,
বর্ষণ রু‌মে ঢুকে দরজা বন্ধ কর‌তেই নীরা বর্ষণ‌কে দরজার সাথে চে‌পে ধ‌রে বলল,
‘ঐ কুত্তা তখন গা‌ড়ি‌তে ব‌সে আমা‌র কোম‌রে অত জো‌রে চিম‌টি কাট‌ছি‌লি কেন? কোম‌রে লাল দাগ প‌ড়ে গে‌ছে।’

বর্ষণ হে‌সে বলল, ‘‌দে‌খো নীরা আমরা এখন স্বামী স্ত্রী। বেস্ট ফ্রেন্ড না। নি‌জের স্বামী‌কে তুই তুকা‌রি ক‌রে না। আর বাসর ঘ‌রে তো একদমই না।’
নীরা বলল, ‘মা‌নে কি বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছে ব‌লে কি তুই আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড থা‌কবি না?’
‘‌কেন থাকব না? অবশ্যই আমরা জীব‌নের শেষ দিন পর্যন্ত বেস্ট ফ্রেন্ড থাকব। কিন্তু আমা‌দের তো আজ বাসর রাত। এভা‌বে তুই তুকা‌রি ক‌রো না।’

নীরা নাক ফু‌লি‌য়ে বলল, ‘এক বউ এর সা‌থে কয়বার বাসর করবা? বি‌য়ে হ‌য়েছে এক বছ‌রের বে‌শি। বাসর দিন রাইত কো‌নোটা বাদ রাখছো তু‌মি?’

বর্ষণ লজ্জা পে‌য়ে বলল, ‘আ‌রে তখন তো আনুষ্ঠা‌নিকভা‌বে কিছু হয়‌নি।’
নীরা চোখ ব‌ড়ো বড়ো ক‌রে বলল, ‘আনুষ্ঠা‌নিকভা‌বে মা‌নে কী? আমা‌দের বাসর কি এখন লোক দেখি‌য়ে হ‌বে?’
বর্ষণ শব্দ ক‌রে হে‌সে বলল, ‘পাগলী একটা! বেস্ট ফ্রেন্ড বি‌য়ে করার বে‌নি‌ফিটই আলাদা।’

নীরা বস‌তে বস‌তে বলল, ‘মা‌নে কী?’
‘এই যে, তু‌ই মা‌নে তু‌মি য‌দি বেস্ট ফ্রেন্ড না হইতা ত‌বে আজ লজ্জা পে‌য়ে বিছানায় ব‌সে থাকতা। অথচ ‌বেস্ট ফ্রেন্ড ব‌লে দে‌খো কীভা‌বে নি‌জের বর‌কে ভয় দেখা‌চ্ছে। ভা‌লোই লাগ‌ছে বিষয়টা।’

নীরা, বর্ষণ‌কে বলল, ‘‌বিছানায় ব‌সো।’
বর্ষণ বসার পর নীরা ওর বু‌কে মাথা দি‌য়ে বলল, ‘আহা শা‌ন্তি। বেস্ট ফ্রেন্ডকে বি‌য়ে করার সব‌চে‌য়ে বড় বে‌নি‌ফিট হ‌লো নি‌জের ব‌রের ক‌া‌ছে সব‌কিছু মনখু‌লে বলা যায়।’

বর্ষণ হে‌সে নীরা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে মাথায় চুমু খে‌লো। নীরা বলল, ‘শু‌য়ে প‌ড়ো। ঘুম পে‌য়ে‌ছে।’
‘ঘুম পে‌য়ে‌ছে মা‌নে কি?’
‘খবরদার উলটা পালটা চিন্তা করবা না। গত দু‌দিন ঠিকম‌তো ঘুমা‌তে পা‌রি‌নি।’
‘‌তো তাই ব‌লে আজ ঘুমব‌া?’
‘‌জি। আচ্ছা তোমার অফিস খোলা ক‌বে?’

‘‌সোমবার পর্যন্ত ছুটি পেয়ে‌ছি। তু‌মি কত‌দিন ছু‌টি নিয়ে‌ছো?’
‘আ‌মি মঙ্গলবার পর্যন্ত।’
‘বাহ্! কাল‌কে শ‌নিবার ‌তো বউ-ভাত। কালকে বিকা‌লে তোমা‌দের বা‌ড়ি যা‌বো। পরশু বিকা‌লে বা সন্ধ্যার পর বাড়ি ফি‌রে সোমবার আমি অফিস কর‌তে যা‌ব। তোমার এখান থে‌কে অফিস কর‌তে যে‌তে সমস্যা হ‌বে না তো?’

‘আ‌রে নাহ্। আমার বাড়ি থে‌কে আর এবা‌ড়ি থে‌কে অফিস দূরত্ব প্রায় সেইম। তাছাড়া আমার সুপার শাশু‌ড়ি মম থাক‌তে নো টেনশন। সি ইজ সুপার কুল।’
বর্ষণ হাসল। নীরা, বর্ষ‌ণের বু‌কের ম‌ধ্যে ঢু‌কে বলল, ‘জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রো তো।’
বর্ষণ জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল, ‘‌তু‌মি এমন থা‌কো সারাজীবন। এতটাই চঞ্চল, উচ্ছ্বল।’

প‌রের দিন,
‌বউ-ভাতের অনুষ্ঠা‌নে।
তূবা, শ্রাব‌ণের উপহার দেওয়া শা‌ড়িটা প‌রেই আসল। প্রথ‌মে অবশ্য শ্রাবণ, তূবা‌কে দে‌খে‌নি। কারণ শ্রাবণ ছা‌দে কা‌জে ব্যস্ত। বউ ভা‌তের সকল আয়োজন ওদের ছা‌দে করা হ‌য়ে‌ছে। প‌রে যখন দূর থে‌কে দেখল, তখন থে‌কে সু‌যোগ খুঁজ‌ছিল কখন তূবা‌কে একা পায়।

তূবা, কথা আর নীরার সা‌থে কিছুক্ষণ গল্প করল। তখন বুঝল ওর পেটি‌কো‌টের ফিতা ‌ঢিলা হ‌য়ে গে‌ছে। তূবা, কথার রু‌মে গি‌য়ে ফিতাটা ‌ঠিক ক‌রল। কারণ কথার রুমটাই কেবল খা‌লি, বা‌কি রু‌মে লোকজ‌নে ভরপুর। তূবা খেয়াল করল, শা‌ড়ির কু‌চির প্লেটগু‌লো এলো‌মে‌লো হ‌য়ে গে‌ছে। নিচু হ‌য়ে ঠিক কর‌তে লাগল। তখন শ্রাবণ দ‌রজা খুলে মিট‌মিট হাস‌তে হাস‌তে বলল,

তোমার জন্য এই বুকে বেঁধেছি ছোট্ট একটি বাসা,
মনের মাঝে সারাক্ষণ শুধু তোমায় দেখার আশা ।
তুমি যে শুধু আমারই হবে, এইতো মোর প্রত্যাশা,
মোর সব অনুভবেই তুমি, এইতো মোর ভালবাসা।

তূবা হে‌সে বলল, ‘কার ক‌বিতা চু‌রি কর‌লি?’
শ্রাবণ হে‌সে বলল, ‘কবি অধ্যাপক শফিক তপন।’
‘বাহ্।’
শ্রাবণ দরজা বন্ধ ক‌রে তূবার কা‌ছে এসে বলল, ‘এত সৌন্দর্য দেখ‌লে চোখ তো অন্ধ হ‌য়ে যা‌বে।’
‘তাহ‌লে চোখ বন্ধ ক‌রে রাখ।’
‘উঁহু। এ সে‌ৗন্দ‌র্যে চোখ অন্ধ হ‌লেও জীবন সার্থক।’

তূবা হে‌সে বলল, ‘ক‌বিগি‌রি ছে‌ড়ে, নি‌চে ব‌সে, আমার কু‌চির প্লেটগু‌লো ধরতো। কু‌চি ঠিক করব।’
শ্রাবণ ব‌সে তূবার কু‌চি ঠিক কর‌তে সাহায্য করল। তারপর দাঁ‌ড়ি‌য়ে তূবার কপা‌লে কপাল ঠে‌কি‌য়ে বলল, ‘কথা আপু, ঠিক বল‌ছিল। শা‌ড়ির রঙ আর তোমার গা‌য়ের রঙ সেইম। ত‌বে তোমা‌কে দারুণ লাগ‌ছে।’
‘বু‌ঝে‌ছি এখন যা। কেউ দে‌খে ফেল‌লে আজই ধ‌রে বি‌য়ে প‌ড়ি‌য়ে দি‌বে।’
‘ওয়াও গ্রেট। তাহ‌লে চিৎকার ক‌রে ডা‌কি সবাই‌কে?’
তূবা, শ্রাব‌ণের চুল টে‌নে নি‌জেই রুম থে‌কে বের হ‌য়ে গেল।

চলবে।

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৩৮

কথার শরীরটা খুব বেশ ক্লান্ত লাগ‌ছে। য‌দিও ওকে কো‌নো কাজ কর‌তে হ‌চ্ছে না, তবুও একটু হাঁটাহ‌াঁ‌টি‌তেই ইদা‌নিং খুব হা‌ঁপি‌য়ে ওঠে। শরীরটা দিন দিন এত ভারী হ‌য়ে যা‌চ্ছে যে কথার হাঁটাচলা মুশ‌কিল হ‌য়ে গেছে। কথা নি‌জের রু‌মে এসে পি‌ঠের নি‌চে বা‌লিশ দি‌য়ে বিছানায় হেলান দি‌য়ে বসল।

তারপর নিহাদ‌কে কল ক‌রে বলল, ‘একটু রু‌মে আসো।’
একটু পর নিহাদ আস‌লো। এসে বলল,
‘শরীর খারাপ লাগ‌ছে তোমার?’
‘ক্লান্ত লাগ‌ছে খুব।’
‘‌কিছু খা‌বে?’
‘না। তূবা আর ভা‌বির সা‌থে খা‌বো। তু‌মি একটু পা‌শে এসে বসো।’

‌নিহাদ পা‌শে বস‌তেই কথা ওর বু‌কে মাথা র‌াখল। নিহাদ জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল, ‘‌বে‌শি খারাপ লাগ‌ছে?’
‘না। ভয় কর‌ছে খুব।’
‘‌কে‌ন?’
‘য‌দি বাবু হওয়ার সময় আমার কিছু হ‌য়ে যায়।’
‘‌আল্লাহর রহম‌তে কিছু হ‌বে না তোমার।’
‘আচ্ছা নিহাদ, আমার কিছু হলে তু‌মি কি আবার বি‌য়ে কর‌বে?’

নিহাদ হে‌সে বলল, ‘হঠাৎ এ কথা কেন?’
‘এম‌নি।’
‘জা‌নি তু‌মি আমা‌কে বিশ্ব‌াস কর‌তে পার‌ছে‌া না। তোমার বিশ্বাসটা আমিই ভে‌ঙে‌ছি। অবশ্য বিশ্বাস ভে‌ঙেছিলাম তোমা‌কে হারা‌নোর ভয়। অথচ দে‌খো সেই তোমা‌কে কা‌ছে পে‌য়েও হা‌রি‌য়ে ফে‌লে‌ছি।’
কথা দীর্ঘশ্ব‌াস ছে‌ড়ে বলল, ‘আমা‌কে একটা ওয়াদা ক‌রো।’
‘কী?’
‘আ‌মি ম‌রে গে‌লেও তু‌মি কেবল আমারই থাক‌বে।’

‌নিহাদ একটুও না ভেবে সাথে সা‌থে বলল, ‘ওয়াদা করলাম। আমার জীবন থাক‌তে আমি কো‌নো দিন কথা ব্য‌তিত কারও হ‌বো না। আমার পূ‌র্বের করা অন্যা‌য়ের তো ক্ষমা হয় না, ত‌বে বারবার তওবা ক‌রে হলেও সৃ‌ষ্টিকর্তার কা‌ছে ক্ষমা চাই‌বো। তু‌মি ক্ষমা ক‌রো আর না ক‌রো তি‌নি হয়‌তো কর‌বেন।’

কথা দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে নিহা‌দের গা‌লে হাত রে‌খে বলল, ‘আ‌মি তোমা‌কে মন থে‌কে ক্ষমা ক‌রে দি‌য়ে‌ছি। স‌ত্যি ক্ষমা ক‌রে দি‌য়ে‌ছি। কিন্তু কেন জা‌নি আগের ম‌তো স্বাভাবিক হ‌তে পার‌ছি না। খুব জড়তা কাজ ক‌রে।’

কথা‌র কথা শু‌নে নিহাদ এতো খু‌শি হ‌লো যে, গভীর আবে‌শে কথার ‌ঠোঁ‌ট ছুঁ‌য়ে বলল,
‘তু‌মি, স‌ত্যি আমা‌কে মন থে‌কে ক্ষমা ক‌রে দি‌‌য়েছো?’
কথা হে‌সে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘ওহ কথা, তোমা‌কে বুঝা‌তে পারব না আমার কতটা খু‌শি লাগ‌ছে। ধন্যবাদ কথা। আই লাভ ইউ।’

খু‌শি‌তে নিহা‌দের চোখ জোড়া ভি‌জে গেল। কথা হে‌সে নিহা‌দে চোখে চুমু খে‌য়ে বলল,
‘ত‌বে একটা শর্ত।’
‘কী?’
‘আ‌মি এত দ্রুত তোমার সা‌থে আগের ম‌তো স্বাভাবিক হ‌তে পারব না। জড়তা কাটা‌তে সময় লাগ‌বে। হয়তো কিছু মাস কিংবা বছর।’

‌নিহাদ খু‌মি হ‌য়েই বলল, ‘‌তোমার য‌তো খু‌শি সময় নাও, শুধ‌ু আমার হ‌য়ে আমার কা‌ছে থা‌কো। আমি এতেই খু‌শি।’
কথা, নিহাদ‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধরল। নিহাদও, কথা‌কে শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধরল। দু’জনার চোখ থে‌কেই ঝর‌ছে অনন্দঅশ্রু।

“রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া অর্ডার ক‌রেছেন তো?”

ছা‌দের দা‌ঁড়ি‌য়ে তূবা, শ্রাবণ‌কে দেখ‌ছে। ও বউভা‌তে আসা অতিথী‌দের আপ্যায়ন কর‌ছে। দূর থে‌কে শ্রাবণ‌কে দে‌খে তূবা বিড়‌বিড় ক‌রে বলল, ‘‌ছে‌লেটা বড়ো হ‌চ্ছে না জা‌নি বোম হ‌চ্ছে। কোন মে‌য়ের নজর প‌ড়ে কে জা‌নে? ও কি জা‌নে, এই কা‌লো র‌ঙের পাঞ্জা‌বি আর সাদা পায়জামা, হা‌তে ঘ‌ড়ি পর‌নের ছে‌লেটা‌কে দে‌খে আমার ভিত‌রে বস‌ন্তের প্রবাল হাওয়া বই‌ছে। ও কি জা‌নে মুগ্ধতায় আমার ভিতরটা নড়ে ‌গে‌ছে।’ তূবা দূর থে‌কে বলল, ‘‌হে আল্লাহ পে‌ত্নি মে‌য়ে‌দের প্রে‌মের নজর থে‌কে আমার শ্রাবণটা‌কে বাঁ‌চি‌য়ে রেখো।’

তূবা ফোনটা হা‌তে নি‌য়ে শ্রাবণ‌কে কল করল। শ্রাবণ কল রি‌সিভ ক‌রে বলল, ‘হুম ব‌লো।’
‘আজ কি তোর বি‌য়ে?’
‘‌কেন?’
‘তাহ‌লে তো‌কে এত সুন্দর লাগ‌ছে কেন?’

শ্রাবণ মুচ‌কি হে‌সে বলল, ‘লাগ‌ছে না‌কি?’
‘খবরদার ওমন করে হাস‌বি না। তোর ওমন হা‌সি দেখ‌লে আমার বু‌কের মা‌ঝে কেমন যেন ক‌রে।’
‘বাহ্! তাহ‌লে তো বেশ। তা তু‌মি কোথায়?’
‘ব‌াম দি‌কে তাকা।’

শ্রাবণ বাম দি‌কে তা‌কি‌য়ে হে‌সে বলল, ‘ওখা‌নে ব‌সে কি আমার দি‌কে নজর রাখ‌ছো?’
‘হ্যাঁ। আজ যেমন বোম লাগ‌ছিস, কোন মে‌য়ে নজর দি‌য়ে ফে‌লে কে জা‌নে?’
শ্রাবণ শব্দ ক‌রে হে‌সে বলল, ‘‌বোম তে‌া তু‌মি লাগ‌ছো। আমার তো তোমা‌কে দে‌খেই অবস্থা খারাপ।’

তূবা হে‌সে বলল, ‘এখা‌নে ব‌সে নজর রাখ‌ছি, য‌দি দে‌খি কোনো মে‌য়ের সাথে ফ্লা‌টিং কর‌ছিস মে‌রে হা‌ড্ডি গুড়া ক‌রে দিব।’
‘বাপ‌রে! কত বড়ো হুম‌কি! খে‌য়ে‌ছো?’
‘না। কথা আসুক তারপর খাবো।’
‘আচ্ছা।’

শ্রাবণ কল কে‌টে তূবার কা‌ছে এসে বলল, ‘তু‌মি আর কখ‌নো গা‌লে এ গোলাপি ব্লা‌সিং করবে না।’
‘‌কেন বা‌জে লাগ‌ছে?’
‘আ‌রে না। এম‌নি তু‌মি দেখ‌তে এত গোলা‌পি, তার উপর এসব মেকাপ টেকা‌পে আরও বে‌শি সুন্দর লাগে। কখন কার নজ‌রে প‌ড়ে যাও, দেখা যাবে বা‌ড়ি বি‌য়ের প্রস্তাব নি‌য়ে গে‌ছে।’
‘‌তো গে‌লে সমস্যা কী? বি‌য়ের বয়স তো হ‌য়েই গে‌ছে।’
শ্রাবণ মন খারাপ ক‌রে বলল, ‘এমন বা‌জে কথা খবরদার বল‌বে না।’
তূবা, শ্রাব‌ণের চুল এলো‌মে‌লো ক‌রে বলল, ‘পাগল একটা।’

তূবার বাবা তা‌রিক সা‌হেব ওদের কা‌ছে এসে বলল, ‘‌কি‌রে ভাই বোন মি‌লে কী নি‌য়ে হাসাহা‌সি কর‌ছিস?’
শ্রাবণ ম‌নে ম‌নে বলল, ‘খা‌লি সবসময় ভাই বোন ব‌লে! এই ভাই বোন শুন‌তে শুন‌তে কানটা প‌চে গেল। শো‌নেন শ্বশুর আব্বা, আপনার মে‌য়ে আমার বোন নয় বরং আমার হবু বউ, আপনার ভ‌বিষ্যৎ না‌তি নাত‌নীর বাবা আমি।’
‌কিন্তু মু‌খে বলল, ‘‌কিছু না চাচ্চু। এই ভা‌র্সি‌টির কথা বল‌ছিলাম।’
‘ওহ।’
‘চাচ্চু খে‌য়ে‌ছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘‌কেমন হ‌য়েছে খাবার?’
‘ভীষণ ভা‌লো। ফি‌রনীটা চমৎকার হ‌য়ে‌ছে।’
‘বা‌টি‌তে ক‌রে একটু দি‌য়ে দিব? বাসায় ব‌সে খা‌বেন।’
‘‌দি‌বি? দিস ত‌বে।’

তূবা রাগ ক‌রে বলল, ‘একদম না। বাবার সুগার বে‌ড়ে‌ছে। বাবা, আমি খেয়াল ক‌রে‌ছি তু‌মি ক‌ব্জি ডু‌বি‌য়ে খে‌য়ে‌ছো। ফি‌রিনী দুই বার নি‌য়ে‌ছো। এখন বা‌ড়ি দেওয়া যা‌বে না।’
তা‌রিক সা‌হেব অসহায় চো‌খে তা‌কি‌য়ে বল‌লেন, ‘‌আমার নি‌জের মে‌য়ের চে‌য়ে, ভাই‌য়ের ছে‌লে‌মে‌য়ে গু‌লো ভা‌লো। দে‌খো কেমন বাবার খাওয়ার দি‌কে নজর দি‌চ্ছে।’

শ্রাবণ বলল, ‘চাচ্চু নো টেনশন আমি পা‌ঠি‌য়ে দিব।’
তূবা হে‌সে বলল, ‘এখন বে‌শি ক‌রে মি‌ষ্টি খা‌বে তারপর শরীর খারাপ ক‌রে ডাক্তার কা‌ছে দৌড়া‌বে। কো‌নো ফির‌নী টির‌নি হ‌বে না।’
তা‌রিক সা‌হেব বলল, ‘শ্রাবণ, ওর কথা একদম শুন‌বি না। আমি এখন গেলাম। একটু কাজ আছে। তুই পা‌ঠি‌য়ে দি‌বি।’
‘আচ্ছা চাচ্চু।’

তা‌রিক সা‌হেব যে‌তেই তূবা বলল, ‘খবরদার বাবার জন্য ফির‌নী দিবা না?’
‘আজব মে‌য়ে তো তুু‌মি। কোথায় শ্বশুর‌কে একটু ফিরনী দি‌য়ে পটা‌বো, তাও দি‌চ্ছো না।’
তূবা মুখ ঝামটা দি‌লো। তারপর বলল,
‘কথা‌কে নি‌য়ে আসি। আমার খুব খুদা পে‌য়ে‌ছে।’
‘আচ্ছা। তূবা?’
‘হুম।’
‘‌তোমা‌কে আজ স‌ত্যি মি‌ষ্টি লাগ‌ছে।’
তূবা হাসল। শ্রাবণ বলল,
‘প্র‌মিজ করো একা দেখা হ‌লে আজ একবার জ‌ড়ি‌য়ে ধরবা।’
তূবা লাজুক হে‌সে বলল, ‘আ‌গে নি‌রি‌বি‌লি হোক প‌রি‌বেশ।’
শ্রাবণ হে‌সে বলল, ‘খুব ভা‌লোবা‌সি।’
তূবা লাজুক হে‌সে আবার শ্রাব‌ণের চুল এলো‌মে‌লো ক‌রে দি‌য়ে চ‌লে গেল।

সবার খাবার শেষ। কথা চেয়া‌রের ব‌সে আছে। তূবা বলল, ‘‌নি‌চে গি‌য়ে রেস্ট নি‌তে পার‌তি।’
‘হুম এখন যাব।’
‘আচ্ছা পাঁচ মি‌নিট ব‌স। আমি একটু আস‌ছি।’

তূবা, শ্রাব‌ণের কা‌ছে গি‌য়ে বলল, ‘আমার ফোন দে। তখন তুই দুষ্টু‌মির ছ‌লে কোম‌রে হাত দি‌য়ে ফোন নি‌য়ে‌ছি‌লি। তখন লো‌কের মা‌ঝে কিছু ব‌লি‌নি। এখন বল, ফোন কেন নি‌ছি‌লি?’
শ্রাবণ হে‌সে বলল, ‘‌তোমার অনেক ছ‌বি তু‌লে‌ছি আজ। সব দি‌য়ে‌ছি।’
‘‌সেগুলো হোয়াট’স এ্যা‌পে দেওয়া যেত। স‌ত্যি ক‌রে বল কেন নিছি‌লি?’

শ্রাবণ প‌কেট থে‌কে ফোন বের ক‌রে তূবার হা‌তে দি‌য়ে বলল, ‘‌কথার আপুর কাছ থে‌কে শু‌নে‌ছিলাম, তোমার ফো‌নের লক পাসওয়ার্ড দেওয়া না‌কি আমার না‌মে। সে কার‌ণে দেখ‌তে চা‌চ্ছিলাম আমি কি স‌ত্যি তে‌ামার ভা‌লোবাসার‌ এতটা যোগ্য যে তোমার ফো‌নের পাসওয়ার্ড হ‌বো।’
তূবা হে‌সে বলল, ‘‌তো লক খু‌লে‌ছে?’
‘না।’

তূবা হে‌সে ওর ফোনটা আব‌ার শ্রাব‌ণের হা‌তে দি‌য়ে বলল, ‘কী টাইপ কর‌ছি‌লি?’
‘শ্রাবণ।’
‘ইং‌রেজী‌তে টাইপ কর, ‘শ্রাবনহার্ট’ সব‌ ছো‌টো হা‌তের অক্ষর। আর শোন, আমার এ্যাপলক, ফেইসবুক সব‌কিছুর পাসওয়ার্ড কিন্তু সেইম।’
শ্রাবণ, তূবার ফো‌নের ল‌কে ইং‌রেজী‌তে ‘শ্রাবণহার্ট’ লিখ‌তেই লক খু‌লে গেল। শ্রাবণ বেশ অবাক হ‌য়ে বলল, ‘এতটা কেন ভালোবাস‌লে?’

তূবা হে‌সে বলল, ‘‌শোন পাসওয়া‌র্ডে ভা‌লোবাসার প‌রিমাণ প্রকাশ পায় ন‌া। তো‌কে কতটা ভালোবাসি তার প্রমাণ তুই যে কো‌নোভা‌বে চাই‌তে পা‌রিস।’
শ্রাবণ চো‌খে দুষ্টু‌মি খেলা কর‌ছে। দুষ্টু হে‌সে বলল, ‘‌যে কো‌নো ভা‌বে?’

তূবা, শ্রাবণ‌কে অবাক ক‌রে দি‌য়ে ওর কা‌নের কা‌ছে ঠোঁট নি‌য়ে ফিস‌ফিস ক‌রে বলল, ‘হ্যাঁ যে কো‌নোভাবে। ত‌বে সা‌থে মা*ই*র খাবার জন্যও তৈ‌রি থা‌কিস।’
শ্রাবণ হে‌সে বলল, ‘আমি রে‌ডি।’

তূবা হে‌সে শ্রাবণের চুল ধ‌রে টে‌নে দি‌লো। শ্রাবণ ওর ফোনটা বের ক‌রে বলল, ‘ব‌সো তোমা‌কে তোমার কিছু ছ‌বি দেখাই। আজ তোমা‌কে স‌ত্যি স‌ত্যি বোম লাগ‌ছে। ছ‌বিগুলা এত মি‌ষ্টি হ‌য়ে‌ছে।’

তূবা, শ্রাব‌ণের পা‌শে ব‌সে ছ‌বিগু‌লো দেখ‌তে লাগল। আশে পা‌শের সবাই ওদের সম্পর্কটা‌কে স্বাভা‌বিক ভাই বো‌নের ম‌তো নি‌লেও ওরা জা‌নে আস‌লে একে অপর‌কে কতটা ভা‌লোবা‌সে।

কথা দূর থে‌কে দুজন‌কে দে‌খে নিহাদ‌কে বলল, ‘ওদি‌কে তাকি‌য়ে দে‌খো। কী সুন্দর লাগ‌ছে দুজন‌কে! যেন রূপকথার রাজপু‌ত্রের পা‌শে অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা বসা।’
‌নিহাদ বলল, ‘সত্যি দুজন‌কে চমৎকার মা‌নি‌য়ে‌ছে।’
‘ইশ! কা‌রো নজর না লাগুক।’
‘‌নিহাদ!’

‘হুম। আমার খুব ইউরিন লিক কর‌ছে। নি‌চে চলো ওয়াশরু‌মে যে‌তে হ‌বে। ইদা‌নিং প্রস্রাব পে‌লে একটুও চে‌পে রাখ‌তে পা‌রি না। সা‌থে সা‌থে লিক কর‌তে থা‌কে।’
‌নিহাদ কথার গা‌লে হাত দি‌য়ে বলল, ‘যা‌দের একটা বে‌বি তাদেরই সাত মা‌সের পর ইউরিন লিক ক‌রে। সেখা‌নে তোমার সা‌থে দুজন। তোমার লিক করা স্বাভা‌বিক। চ‌লো নি‌চে নি‌য়ে যা‌চ্ছি। আর এ ভারী কাপড় খু‌লে হালকা কিছু পর‌বে।’
‘হুম।’

‌নিহাদ, কথা‌কে নি‌য়েই যা‌বে, তখন কথার বাবা সো‌হেল নিহাদ‌কে ডাকল। কথা বলল,
‘তু‌মি বাবার কা‌ছে যাও আমি নি‌চে যা‌চ্ছি।’
‘পার‌বে?’
‘নিহাদ, আমি প্রেগ‌নেন্ট, অসুস্থ না। যে‌তে পারব।’
‘আচ্ছা সাবধানে।’

‌নিহাদ, সো‌হে‌লের কা‌ছে গেল আর কথা সি‌ড়ি দি‌য়ে নি‌চে নাম‌তে লাগল। ওদের সি‌ড়ি‌তে কো‌নো রে‌লিং দেওয়া নেই। কথা খুব সাবধা‌নে নাম‌ছিল তখন, একটা সাত আট বছ‌রের বাচ্চা দৌ‌ড়ে নাম‌তে গি‌য়ে কথা‌কে খুব জো‌রে ধাক্কা দি‌লো। কথা নি‌জে‌কে সামলা‌তে না পে‌রে সি‌ড়ি দি‌য়ে সোজা নি‌চে প‌ড়ে গেল। ‌যে‌হেতু সি‌ড়ি‌তে রে‌লিং ছিল না, আর বাচ্চাটা এত জো‌রে ধাক্কা দি‌লো যে কথা নি‌জে‌কে কো‌নো ম‌তে সামলা‌তে পারল না, ও ব্যা‌লেন্স হা‌রি‌য়ে ‌সি‌ড়ির প‌রের ধা‌পে না প‌ড়ে, পাশ দি‌য়ে একতলা থে‌কে নী‌চে প‌ড়ে গেল। কথার চিৎকা‌রে কিছু সম‌য়ের জন্য সবাই স্তব্ধ হ‌য়ে গেল।

‌নিহাদ, শ্রাবণ, বর্ষণ, সে‌া‌হেল, তূবাসহ সবাই দৌ‌ড়ে আসল। কথা নি‌চে শু‌য়ে যন্ত্রণায় ছটফট কর‌তে লাগল। মুহূ‌র্তের ম‌ধ্যেই র‌ক্তে ফ্লোর ভে‌সে গেল। কথা পে‌টে প্রচন্ড আঘাত পে‌য়ে‌ছে। যন্ত্রণা আর কথা বে‌শিক্ষণ সহ্য কর‌তে পারল না। প্রচন্ড যন্ত্রণায় অজ্ঞান হ‌য়ে গেল ‌কিছু মুহূ‌র্তেই।

চল‌বে…

#অর‌ণ্যে_রোদন
‌লেখক: শার‌মিন_আক্তার_সাথী
পর্ব: ৩৯

‌বি‌য়ে বা‌ড়ি মুহূ‌র্তেই যেন শোক সভায় প‌রিণত হ‌লো। এ্যাম্বু‌লেন্স ফোন দি‌লেও তার জন্য অপেক্ষা করল না নিহাদ। কথা‌কে তু‌লে নি‌জের গা‌ড়ি‌তে ক‌রে রওনা হ‌লো। নিহাদ, কথা‌কে নি‌য়ে পিছ‌নে বসল, বর্ষণ গা‌ড়ি চালা‌তে নি‌লো, ওর পা‌শেই সাম‌নের সি‌টে শ্রাবনী বসল।

পিছ‌নে অন্য গা‌ড়ি‌তে ক‌রে, নিহা‌দের বাব‌া, মা, কথার বাবা, নীরা, শ্রাবণ, তূবা আস‌তে লাগল। নিহাদ, বর্ষণ‌কে বলল, ‘ভাইয়া এ্যাম্বু‌লেন্স‌কে ব‌লেছেন তো? রাস্তার মাঝামা‌ঝি দেখা হ‌লেই ওকে এ্যাম্বু‌লে‌ন্সে শিফট করবো। কথার খুব শ্বাসকষ্ট হ‌চ্ছে।’

বর্ষণ খুব শক্ত মানুষ ও কান্নারত নিহাদ‌কে দে‌খে বলল, ‘‌নিহাদ, তু‌মি নি‌জে‌কে সামলাও। কথার কিছু হবে না। আমি এ্যাম্বু‌লে‌ন্সের ড্রাইভার‌কে সব ব‌লে দি‌য়ে‌ছি। একজন ডাক্তারও সা‌থে আস‌ছেন।’
শ্রাবণী বলল, ‘বর্ষণ দ্রুত গা‌ড়ি চাল‌া। মেয়েটা আমার র‌ক্তে ভে‌সে যা‌চ্ছে।’

‌নিহাদ, কথার গা‌লে হাত দি‌য়ে বারবার কথা‌কে ডাক‌ছে, ‘কথা! কথা! প্লিজ চো‌খ খো‌লো।’
‌কিন্তু কথা নিরুত্তর। কথা সারা শরীর র‌ক্তে ভেজা। ওর র‌ক্তে নিহা‌দের শরীরও মাখামা‌খি হ‌য়ে আছে। কিন্তু সেসব দি‌কে নিহা‌দের কো‌নো খেয়াল নেই। ও শুধু কথা‌কে আর ওর বাচ্চা‌দের চিন্তা হ‌চ্ছে।

নিহাদ, বর্ষণ‌কে বলল, ‘ভাইয়া র‌ক্তের ব্যবস্থা কর‌তে হ‌বে। শ্রাবণ‌কে কল দিন। ও দেখুক, আমিও দেখ‌ছি।’
বর্ষণ বলল, ‘আমা‌দের তিন ভাই বো‌নেরই ব্লাড গ্রুপ ও প‌জে‌টিভ। তাছাড়া তূবার ব্লাড গ্রুপও ও প‌জে‌টিভ। আমরা তিনজনই প্রথম ব্লাড দিব। পরে লাগ‌লে সে ব্যবস্থাও ক‌রে ফেলব।’

শ্রাবণ বিড়‌বিড় ক‌রে বলল, ‘সব দোষ আমার। আমার ওকে একা যে‌তে দেওয়া উচিত হয়‌নি। কথা প্লিজ চোখ খো‌লো।’

অপা‌রেশন থি‌য়েটার থে‌কে একজন ডাক্তার বের হ‌তেই তা‌কে ঘি‌রে ধরল সবাই। ডাক্তার নিহা‌দের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল, ‘স‌রি আপনার বাচ্চারা পে‌টের ম‌ধ্যেই মারা গে‌ছে। আপনার স্ত্রীর অবস্থাও ভা‌লো না। মাথায়ও দেখলাম বেশ চোট পে‌য়ে‌ছে। সেখা‌নের ব্লাড অবশ্য বন্ধ হ‌য়ে‌ছে। সিজার ক‌রে বাচ্চা‌দের ব‌ডি বের কর‌তে হ‌বে। নিহাদের সারা শরীর থরথর ক‌রে কাঁপ‌ছে। কাঁপা কাঁপা ক‌ণ্ঠে বলল, ‘কথার কিছু হ‌বে না তো?’
ডাক্তার নিহা‌দের কাঁধে হাত দি‌য়ে বলল, ‘আশাক‌রি তার কিছু হ‌বে না। বা‌কিটা আল্লাহ ভরসা।’

অ‌নেক্ষণ ধ‌রে কথার অপা‌রেশন চলল। শ্রাবণ, বর্ষণ, তূবা তিনজন তিন ব্যাগ রক্ত দি‌লো। সবাই চি‌ন্তিত মুখে হস‌পিটা‌লে অপা‌রেশন থি‌য়েটা‌রের বাইরে ব‌সে রইল। সব শু‌নে তূবার বাবা তা‌রিক সা‌হেব আর ছো‌টো চা‌চিও আস‌লেন ওদের দেখ‌তে।

এ সময় নীরা শক্ত ম‌নে সবাই‌কে সাম‌লে নি‌লো। সবার খেয়াল রাখল। তূবা, শ্রাবণীর হাত ধ‌রে ব‌সে ছিল। মে‌য়ের ওমন অবস্থা দে‌খে মা‌য়ের ম‌নের অবস্থা কেবল একজন মা-ই বো‌ঝেন। শ্রাবণ আর বর্ষণ বারবার নিহাদ‌কে ভরসা দি‌চ্ছে। শ্রাবণ নি‌জেও ম‌নে ম‌নে এত ভ‌য়ে আছে যা কাউ‌কে বল‌তে পার‌ছে না। বারবার সৃ‌ষ্টিকর্তা‌কে ডাক‌ছে।

অনেকক্ষণ পর ডাক্তার বের হ‌তেই সবাই ডাক্তা‌রের কা‌ছে গে‌লেন। ডাক্তার নিহা‌দের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বল‌লেন, ‘অপা‌রেশ সফলভা‌বে হ‌য়ে‌ছে। আপনার স্ত্রী য‌দিও এখন বিপদমুক্ত। ত‌বে জ্ঞান ফির‌তে সময় লাগ‌বে। ত‌বে তা‌কে নি‌য়ে এখন আর চিন্তা কর‌তে হ‌বে না।’

সবাই কিছুটা স্ব‌স্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ডাক্তার আরও কিছু কথা ব‌লে বল‌লেন, ‘আপনা‌দের বাচ্চা‌দের কি আপনারা দাফনের ব্যবস্থা কর‌বেন না‌কি আমরা হস‌পিটাল কতৃপক্ষ কিছু…!’
‌নিহা‌দের বাবা নয়ন ডাক্তার‌কে থা‌মি‌য়ে বলল, ‘ডাক্তার আমরাই দাফ‌নের ব্যবস্থা করব।’

এতক্ষণ যাবত মো‌মেনা চুপ ছিল এবার ডাক্তার‌কে জি‌জ্ঞেস করল, ‘ডাক্তার কী বাবু ছি‌ল?’
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বলল, ‘দু‌টো মে‌য়ে বাবু।’
মোমেনা কান্নারত ক‌ণ্ঠে বলল, ‘আমরা কি দেখ‌তে পারব?’

ডাক্ত‌ার বল‌লেন, ‘না দেখাই বেটার। আঘাত লে‌গে দু‌টো বাবুর মাথাই থেত‌লে গে‌ছে।’
‌মো‌মেনা আৎকে উঠ‌লেন। চিৎকার ক‌রে ফ্লো‌রে বসে কাঁদ‌তে লাগ‌লেন। কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে বল‌লেন, ‘কতটা কষ্ট পে‌য়ে আমার জানপা‌খি দু‌টো বিদায় নি‌লো।’

আবার সবাই ফু‌ঁপি‌য়ে কাঁদ‌তে লাগল। ডাক্তার বল‌লেন, ‘‌দেখুন দয়া ক‌রে রোগীর সাম‌নে আপনারা এমন ক‌রে কাঁদ‌বেন না। একজন মা‌য়ের বাচ্চা হারা‌নোর কষ্ট কেউ অনুভব করতে পার‌বে না। তাছাড়া তি‌নি একসা‌থে দু‌টো বাচ্চা হা‌রি‌য়ে‌ছে। তার কষ্ট আপনা‌দের সবার চে‌য়ে অনেক বে‌শি। আর তার শা‌রিরীক অবস্থাও খুব নাজুক। এমনি‌তেও সে ডি‌প্রেশ‌নে যে‌তে চাই‌বে। তা‌র স‌ামনে এমন কিছু করবেন না যা‌তে সে পু‌রোপু‌রি ডি‌প্রেশনে চ‌লে যায়।’

কিছুক্ষণ পর,
নিহাদ তা‌কি‌য়ে আছে ওর মৃত মে‌য়েদু‌টোর ছোট্ট শরীরদু‌টোর দি‌কে। ছো‌টো ছো‌টো হাত পা, মাথাদু‌টো বেশ বড়ো, হয়‌তো প‌রিপূর্ণ হ‌তে হ‌তে মাথাদু‌টো স্বাভাবিক আকা‌রে চ‌লে আস‌তো। ব‌ড়ো মাথা দু‌টো‌তে, ছো‌টো ছো‌টো দু‌টো মুখ। চোখ বন্ধ ক‌রে কি শা‌ন্তি‌তে ঘু‌মি‌য়ে আছে! ওরা হয়‌তো বুঝ‌তেও পা‌রে‌নি পৃ‌থিবী আসার আগেই ওরা আবার জান্না‌তে চলে গে‌ছে।

নিহা‌দের খুব মন চাইল নি‌জের মে‌য়ে দু‌টোর হাত ধ‌রে চুমু খায়। ছো‌টো ছো‌টো মুখ দু‌টো‌টে চুমু খে‌য়ে বলুক আমার বাবারা। কিন্তু এসব শুধু স্বপ্নই থে‌কে যা‌বে।

বাচ্চাদু‌টো‌কে বাঁচানোর জন্য নিহাদ নি‌জের ছো‌টো বেলার স্বপ্ন‌কে বিসর্জন দিয়ে এত শ‌খে‌র চাক‌রিটা ছে‌ড়ে দি‌লো। বাবা হওয়ার আন‌ন্দের কা‌ছে নি‌জের শখ, স্বপ্ন‌কে তুচ্ছ ম‌নে হ‌চ্ছিল। অথচ আজ নি‌জের প্রাণ প্রিয় সন্তান দু‌টো‌কে হা‌রি‌য়ে ফেলল।

নিহাদ ভেজা চো‌খে ওর মে‌য়েদের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বলল,’আমা‌কে ক্ষমা ক‌রিস না বাবা। আমি হলাম পৃ‌থিবীর সব‌চে‌য়ে ব্যর্থ মানুষ। যে নি‌জের স্ত্রীর বিশ্বাস ধ‌রে রাখতে পারে‌নি। যে নি‌জের প্রাণ প্রিয় সন্তান‌দের বাঁচা‌তে পা‌রে না। আজ য‌দি আমি কথা‌কে একা না ছাড়তাম ত‌বে তোরা বেঁ‌চে থা‌কতি। তোরা আল্লাহর কা‌ছে আমার জন্য ক‌ঠিন বিচার চাই‌বি। ক‌ঠিন বিচার।’

বাচ্চা‌দের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা রা‌তেই করা হ‌লো। নয়ন সা‌হেব, সো‌হেল সা‌হেব, শ্রাবণ, বর্ষণ মি‌লে সব ব্যবস্থা করল। নিহাদ রা‌তে কথার পা‌শেই রইল। নীরা এবং তূবা মি‌লে মো‌মেনা আর শ্রাবণী‌কে বা‌ড়ি নি‌য়ে গেল। হস‌পিটা‌লে তো বে‌শি লে‌াক এলাউ ক‌রে না। নিহাদ কেবল কথার পা‌শে ব‌সে রইল। ওকে এখনও ডাক্তার‌দের অবজার‌বেশ‌নে রাখা হ‌য়ে‌ছে। নিহাদ, কথার দিকে তা‌কি‌য়ে ভাব‌ছে, কথার জ্ঞান ফির‌লে ওকে কী জবাব দি‌বে? কীভা‌বে সামলাবে কথা‌কে?

কথার যখন জ্ঞান ফিরল তখন রাত তিনট‌া। কথার জ্ঞান ফির‌তে দেখেই নিহাদ নার্স‌কে ব‌লে ডাক্তার‌কে ডা‌কি‌য়ে আনল। ডাক্তার কথা‌কে চেক ক‌রে চ‌লে গেল।

কথা অসহায় চো‌খে নিহা‌দের দি‌কে তা‌কি‌য়ে আস্তে ক‌রে নিহাদ‌কে ডাকল, ‘‌নিহাদ!’
‘হ্যাঁ বলো, কথা?’
কথা কিছুক্ষণ চ‌ুপ থে‌কে বলল, ‘আমা‌দের সন্তানরা আর নেই তাই না?’
‌নিহাদ মাথা নিচু ক‌রে রইল। কথার চো‌খের কোণ বে‌য়ে অনর্গল জল ঝরছে।

নিহাদ‌কে বলল, ‘‌নিহাদ!’
‘হুম।’
‘আল্লাহ আম‌া‌দের দুজন‌কে আমা‌দের ক‌র্মের শা‌স্তি দি‌য়ে‌ছেন।’
‌নিহাদ মাথা নিচু করেই রইল। কথা বলল,
‘‌তোমা‌কে আর মাথা নিচু ক‌রে থাক‌তে হ‌বে না। তি‌নি তোম‌া‌কে তোমার ক‌র্মের শা‌স্তি দি‌য়ে‌ছেন আর আমা‌কে আমার। তু‌মি যে কাজ করে‌ছি‌লে, আমি তোমা‌কে তার শা‌স্তি দি‌তে চে‌য়ে‌ছিলাম বাচ্চা‌দের হত্যা ক‌রে। কিন্তু তু‌মি তখন বাচ্চা‌দের বাঁ‌চি‌য়ে নি‌য়ে‌ছি‌লে।

আমি জা‌নি তু‌মি ওদের জন্য কতটা অধির আগ্র‌হে অপেক্ষা কর‌ছি‌লে। আমিও কর‌ছিলাম। ওদের প্র‌তি যে মায়া, যে ভা‌লোব‌াসা জ‌মে‌ছিল তা আজ পর্যন্ত কা‌রও প্র‌তি আমার জন্ম হয়‌নি। সৃ‌ষ্টিকর্তা বোধ হয় এটাই চাইছি‌লেন। তি‌নি তখন তোমার মাধ্য‌মে ওদের বাঁ‌চি‌য়ে দি‌লেন। তারপর ওদের প্র‌তি আমা‌দের অসীম মায়া তৈরি ক‌রে আবার ওদের নি‌জের কা‌ছে নি‌য়ে নি‌লেন। যা‌তে ওদের হারা‌নোর যন্ত্রণাটা আমরা তীব্রভা‌বে বুঝ‌তে পা‌রি। নিহাদ ‌দোষটা আস‌লে কার?’

‌নিহাদ, কথার একটা হাত ধ‌রে বলল, ‘সব দোষ আমার। আমার অন্যা‌য়ের শা‌স্তি তু‌মি আর আমার বাচ্চারা পে‌য়ে‌ছো। সব দোষ আমার। আমি সারা জীবন ক্ষমা চাই‌লেও এ অন্যা‌য়ের ক্ষমা হ‌বে না।’
‌নিহাদ, কথার হাতটা চে‌পে ধ‌রে কাঁদ‌তে লাগল অনর্গল। কাঁদ‌তে লাগল কথাও।

“রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া অর্ডার ক‌রেছেন তো?”

৪০!!
সম‌য়ের সা‌থে সা‌থে কিছু শূণ্যস্থান পূরণ হয় আর কিছু স্থান থে‌কে যায় আজীবন শূণ্য। ক্ষত তো শু‌কি‌য়ে যায় কিন্তু থে‌কে যায় তার দাগ। কিছু দাগ থে‌কে যায় ম‌নের গভী‌রে। যে দাগ কখ‌নো মুছে না। চে‌য়েও মুছ‌া ফেলা যায় না। সে দাগ হয়‌তো অদৃশ্য কিন্তু তবুও ম‌নে তার স্বদৃশ্যতা থে‌কে যায় ম‌নে।

আব‌ার শরীরের কিছু দাগ ম‌নের দগদ‌গে ঘাঁটাকে বারবার খু‌ঁচি‌য়ে খুঁ‌চি‌য়ে তাজা ক‌রে দেয়। শা‌ড়ির আঁচল স‌রি‌য়ে তল‌পে‌টে সিজা‌রের দাগ গু‌লো দেখ‌তেই ডুক‌রে ‌কেঁ‌দে উঠে কথা। ঠিক এক বছর আগে এই দি‌নে ও ওর সন্তান‌দের হা‌রি‌য়ে‌ছিল। এই দি‌নে হা‌রি‌য়ে‌ছিল পরীর ম‌তো দুই মে‌য়ে‌কে। মে‌য়ে দু‌টো‌কে কথা প্রায়ই স্ব‌প্নে দে‌খে বারবার কথা‌কে তা‌চ্ছিল্য ক‌রে ব‌লে, ‘তু‌মি তো মার‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লে আমা‌দের। আমরা তাই চ‌লে গে‌ছি। এখন ত‌বে খু‌শি তো? কথা রাত বিরা‌তে চিৎকার ক‌রে কাঁ‌দে। নি‌জে‌কে নি‌জে আঘাত ক‌রে। নিহাদ অনেক ক‌ষ্টে ওকে সামলায়।

পিছন দিয়ে ‌নিহাদ, কথা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল, ‘জান!’
‘হুম।’
‘তু‌মি কি স্বাভা‌বিক হ‌বে না?’
‘আ‌মি তো পাগল কিংবা অস্বাভা‌বিক নই, নিহাদ।’
‘আ‌মি তোমা‌কে পাগল ব‌লি‌নি। ব‌লে‌ছি জীবনটা কি আব‌ার স্বাভা‌বিকভা‌বে চল‌তে পা‌রে না?’
‘আমার সময় লাগ‌বে।’
‘সময় নাও, কিন্তু প্লিজ কথা একটু হাসার চেষ্টা ক‌রো। গত এত বছ‌রে তোমার মুখে এক ফোটা হাসি দেখার জন্য আমার প্রাণটা ছটফট কর‌ছে।’

কথা, নিহাদ‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে ঝরঝর কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে বলল, ‘আ‌মি হাস‌তে চাই নিহাদ। খুব হাস‌তে চাই। কিন্তু যখনই হা‌সতে চাই তখনই চো‌খে সাম‌নে ভে‌সে ওঠে দূরে দা‌ঁড়ি‌য়ে থাকা দু‌টো বাচ্চা মে‌য়ে। যারা আমা‌কে হাস‌তে দেখ‌লেই কেঁ‌দে ফে‌লে। ওদের কান্না আমার সহ্য হয় না।’

‌নিহাদ কী বল‌বে ভে‌বে পে‌লো না। গত এক বছর যাবত হা‌সি তো ওর মুখেও নেই। কীভা‌বে হাস‌বে কথা তো মে‌য়ে‌দের না দে‌খেই সবসময় কল্পনা ক‌রে, কিন্তু ও তো দে‌খে‌ছে মে‌য়েদু‌টো‌কে। পরীর ম‌তো দু‌টো মে‌য়ে। সে‌দিন দূর্ঘটনা না ঘট‌লে আজ মে‌য়ে দু‌টো ওদের কো‌লে থাক‌তো ওদের হা‌সি‌তে ঘর ঝলমল কর‌তো। হয়‌তো কথার, সা‌থে ওর সম্পর্কটাও স্বাভা‌বিক হ‌য়ে যেত। হয়‌তো এখন মো‌মেনা, কথা, নিহা‌দের উপর রাগ ক‌রে ওদের সা‌থে কথা বলা বন্ধ রাখত ন‌া।

হ্যাঁ মো‌মেনা গত এক বছর যাবত কথা, নিহা‌দের সা‌থে কো‌নো কথা ব‌লে না। একই ঘ‌রে থে‌কেও মো‌মেনা তার ছে‌লে এবং ছে‌লে বউ এর সা‌থে কথা ব‌লে না।

কথা সুস্থ হ‌য়ে বা‌ড়ি ফেরার পর থে‌কেই খেয়াল করে‌ছিল, মোমেনা ওর সা‌থে কথা বল‌ছে না। হস‌পিটা‌লে থাক‌তেও তেমন বি‌শেষ কথা বল‌তো না। ত‌বে প্র‌তি‌দিন কথা‌কে দেখ‌তে যে‌তো। কথা যত‌দিন হস‌পিটা‌লে ছিল কিংবা বা‌ড়ি ফেরার পরও কথার খুব খেয়াল রাখত।

এক‌দিন বিকা‌লে কথা আর নিহাদ‌কে তি‌নি তার রু‌মে ডাক‌লেন। তারপর বল‌লেন,
‘‌তো‌দের দুজনার সা‌থে কথা আছে।’
‌নিহাদ বলল, ‘ব‌লো মা।’

‌মো‌মেনা দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে ব‌লে‌ছি‌লেন, ‘কথা, যারা চ‌লে গেছে তারা আর ফি‌রে আস‌বে না। তাই তা‌দের নি‌য়ে তোরা আর কান্নাকা‌টি ক‌রিস ন‌া। বরং তা‌দের জন্য দোয়া কর। যা‌তে তারা জান্না‌তে আরও ভা‌লো থা‌কে। আর তোরা নি‌জেরা নি‌জে‌দের ম‌তো গু‌ছি‌য়ে নে। অবশ্য বাচ্চারা চ‌লে যাওয়ায় তো‌দের তো খু‌শি হওয়ার কথা।’

কথা, নিহাদ অবাক হ‌য়ে তার দি‌কে তা‌কি‌য়েছিল। তি‌নি বল‌লেন, নিহাদ যে পাপ ক‌রেছে, সে পা‌পের শা‌স্তি দি‌তে কথাও পাপ কর‌তে গি‌য়ে‌ছিল। হয়‌তো নিহাদ, কথা‌কে সে পাপটা কর‌তে দেয়‌নি কিন্তু সৃ‌ষ্টিকর্তা তো‌দের দুজনারই হয়‌তো বিচার ক‌রে‌ছে। যদিও এ ধর‌ণের কথা বলা অন্য‌ায়। কারণ আল্লাহই জা‌নেন তি‌নি কা‌কে কেমন শা‌স্তি দি‌বেন! এগুলা আমরা মানু‌ষেরা নি‌জে‌দের মতো ক‌রে ভে‌বেনি।

যে‌হেতু আমিও সাধারণ মানুষ, মহামানবী নই তাই, আমিও আমার দুই নাত‌নীর মৃত্যুর জন্য তো‌দের দুজন‌কে দায়ী করলাম। নিহাদ, জা‌নি তুই অব‌াক হ‌চ্ছিস, তোর বিষয়টা আমি কী ক‌রে জা‌নি? কথার থে‌কে জে‌নে নিস সবটা। আর হ্যাঁ আমার দুই নাতনীর মৃত্যুর জন্য আমি আর কখ‌নো তো‌দের দুজনার সা‌থে কথা বলব না। আমি মা‌য়ের এবং শাশু‌ড়ির সকল দা‌য়িত্ব পালন করব। কিন্তু সা‌থে আমার নাতনী‌দের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তা‌দেরও শা‌স্তি দিব। আর তো‌দের শা‌স্তি এটাই যে, তোরা তোদের মা‌য়ের থে‌কে দূ‌রে থাক‌বি।

“রৌ‌দ্রোজ্জ্বল দি‌নে একটু মে‌ঘের ছায়া অর্ডার ক‌রেছেন তো? ৩৫% ছা‌ড়ে অর্ডার কর‌তে আমা‌কে নক করুন।’

চল‌বে…