অরুণরাঙা প্রেম পর্ব-০৩

0
973

#অরুণরাঙা_প্রেম
#পর্বঃ০৩
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” কি হলো আহির?রোলটা কি খেতে খুব বাজে হয়েছে?”

” না ঠিক আছে।”

” তোমার পছন্দ হয়েছে?” খুশি মনে জিজ্ঞেস করে আরোশী।

” হুম।”

” তাহলে এই নাও,আরো দুটো।”

আহির চুপচাপ টুলে বসে রোলগুলো খাচ্ছে আর আরোশী দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সেটা দেখতে।

কিছুক্ষণ আগেই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে আকাশ।জুতা খুলে সে যখন সেগুলোকে স্ট্যান্ডে রাখবে তখন সে একজোড়া মেয়েদের জুতো দেখতে পায়।জুতোগুলো দেখে আকাশের ভ্রু-কুচকে যায়।

” শিলা,বাড়িতে কি কেউ এসেছে নাকি?কই তুমি তো আমাকে জানালেনা।”

” কোথায় স্যার?আপনি যাওয়ার পর কেউ তো আসেনি।”

” তাহলে জুতোর স্ট্যান্ডে জুতোগুলো কার?ওগুলো তো তোমার জুতো না।”

” ও আপনি হয়তো আরোশীর জুতো দেখেছেন।”

” আরোশী?সে কি এখনো যায়নি?উনি না বললো উনি কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাবেন?”

” না স্যার আরোশী এখনো যায়নি।”

” কোথায় সে?”

” আহির এর রুমে।”

আকাশ তার ব্যাগটা সোফায় রেখে দ্রুত পায়ে আহিরের রুমের সামনে এলো।সে নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতরের দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো।পড়ার টেবিলে বসে আছে আহির আর আরোশী।আরোশী খুব সুন্দর ভাবে আহিরকে তার পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে।

” আহির।”

হুট করে আকাশের কন্ঠস্বর শুনে আরোশী ঘাবড়ে যায়।আরোহী বই খাতাগুলো বন্ধ করে ধীর পাশে আকাশের কাছে এসে তাকে জরিয়ে ধরে।আকাশ আহিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আরোশীকে প্রশ্ন করে,

” আপনি এখনো গেলেন না যে?আমি তো ভেবেছিলাম আপনি সকালেই চলে গিয়েছেন।”

” আসলে আমিও ভেবেছিলাম কিছুক্ষণ থেকে চলে যাবো কিন্তু আহিরের সাথে সময় কাটাতে গিয়ে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি।যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো তাই ভেবেছিলাম আপনি না আসা পর্যন্ত না হয় থেকেই যায়।এখন তো আপনি চলে এসেছে।তাহলে আমার কাজ আজকের মতো এখানেই শেষ।আমি তাহলে আজ আসি।”

” কিছু খেয়ে যান।”

” না স্যার আমি খেয়েছি কিছুক্ষণ আগে।শিলা আপু আমাকে খাবার দিয়েছেন।আমি তাহলে আজকে যায়,আহির বাবু নিজের খেয়াল রেখো কেমন।”

” তুমি আবার কবে আসবে আন্টি?”

আহিরের মুখে এধরণের কথা শুনে চমকে উঠে আকাশ কারণ আহির কখনো কাউকে এভাবে জিজ্ঞেস করেনি।আরোশী আহিরের মুখে আলতো করে হাত রেখে বলে,

” আমি আবার কালকে আসবো বাবু,তুমি সময় মতো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো কেমন।আমি এখন আসি,বাই।”

” বাই বাই আন্টি।”

আরোশীকে আহিরের গালে একটা চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

” আমি তাহলে আজকে আসছি স্যার।কালকে আবার আসবো।”

” চলুন আমি আপনাকে ড্রপ করে দিয়ে আসছি।”

” না তার দরকার নেই।আমি চলে যেতে পারবো আর আপনি বেরিয়ে গেলে বাড়িতে আহির একা হয়ে যাবে।আমি চলে যেতে পারবো সমস্যা হবেনা আমার।”

আকাশ আর আহির আরোশীকে মেইন গেইট পর্যন্ত দিয়ে এলো।কিছুদূর হেঁটেই আরোশী একটা রিকশা পেয়ে যায়।

বাসায় এসে রাতের খাবার রান্না করে ফ্রেশ হতে চলে যায় আরোশী।ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আরোশী শুনতে পেলো তার ফোন বাজছে।তোয়ালেটা বারান্দায় মেলে দিয়ে আরোশী ফোনটা রিসিভ করে।

” কিরে ঊর্মি(আরোশী)সেই যে বিয়ে থেকে বের হলি আর তো কোন খবরই নিসনি।ভুলে গেলি নাকি?”

” আরে মুমু কি বলছিস!তোকে ভুলতে পারি আমি?আমার সুখ-দুঃখের একমাত্র সাথি তুই।আসলে তোর বিয়ে হয়েছে এখন তো তুই ব্যস্ত থাকবি তাই আর তোকে বিরক্ত করিনি।”

” বুঝি বুঝি।”

” আরে নারে মুমু সত্যি বলছি আর আজ থেকে একটা বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য পাঠানো হয়েছে আমাকে।সেখান থেকেই কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে এলাম।”

” ও মা তাই নাকি!আমি তো জানতামই না।”

” আচ্ছা সেসব বাদ দে।এটা বল সব ঠিকঠাক আছে তো?আর দুলাভাই কেমন?তুই তো আর জবটা করবিনা তাই না?”

” তোর দুলাভাই আছে মোটামুটি আর চাকরিটা আর করতে দেবেনা।তুই তো জানিসই আমার শশুড়বাড়ির লোকেরা কতটা রক্ষণশীল।”

” হুম জানি।আচ্ছা আমি এখন রাখি তাহলে।বেশি কথা বললে আবার তোর শশুড়বাড়ির লোকেরা খারাপ ভেবে বসবে।আমি তোকে পরে ফোন দেবো আর কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিবি।”

” আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।নিজের খেয়াল রাখিস কিন্তু।”

” হুম নিজের যত্ন নিস,তোকে অনেক মিস করবো মুমু।”

” আমিও,রাখছি।ভালো থাকিস।”

আরোশী ফোনটা রেখে দেয়।তার চোখে পানি জমে গিয়েছে।এই মুমুই আরোশীর সুখ-দুঃখের সাথী ছিলো।মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মুমুর সাথে কাকতালীয় ভাবে পরিচয় আরোশীর।তারপর থেকেই তাদের কথা আর মুমুই তাকে এই পার্টটাইম জবটা পাইয়ে দিয়েছিলো।যদিওবা মুমু আরোশী থেকে বয়সে অনেকটাই বড় কিন্তু তাও তাদের অনেক মিল।

পরেরদিন সকালে,

বাড়ির কাজগুলো সব শেষ করে আরোশী সময় মতো আকাশের বাড়িতে চলে আসে।আজও শিলা বাড়ির দরজা খুলে দেয়।

” কেমন আছো শিলা আপু?” ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে আরোশী।

” আমি ভালো আছি আরোশী।তুমি কেমন আছো?”

” আমিও ভালো আছি।স্যার কি বাসায় নেই?দেখতে পাচ্ছিনা।আর আহির কোথায়?”

” স্যার তো আজ তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়েছে।আর আহির নিজের রুমে আছে।”

” আচ্ছা ঠিক আছে আমি আহিরের কাছে যাচ্ছি।”

আরোশী আহিরের রুমের মধ্যে ঢুকে দেখে আহির ঘুমিয়ে আছে।আরোশী আহিরের মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত রেখে তাকে ডাকতে লাগলো।

” আহির?আহির বাবু উঠে পড়ো।দেখো কত বেলা হয়ে গেলো।উঠো বাবু।”

আহির পিটপিট করে চোখ খুলে আরোশীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।

” কি দেখছো বাবু?আমার মুখে কি কিছু লেগে আছে?”

আহির মাথা নাড়িয়ে নাবোধক উওর দিলো।

” তাহলে?কিছু বলবে?”

এবারো আহির মাথা নাড়িয়ে নাবোধক উওর দিলো এবং উঠে আরোশীর কোলে বসে পড়লো।তারপর নিজের মাথাটা আরোশীর কাঁধে রাখলো।আহিরের হঠাৎ এধরণের কাজে আরোশী প্রথমে একটু চমকে গেলেও পরমুহূর্তেই নিজে সামলে নিয়ে আহিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে জিজ্ঞেস করে,

” কি হয়েছে আহির?শরীর খারাপ লাগছে?”

” না।” নিচু স্বরে উওর দিলো আহির।

” তাহলে?”

” আমার ভালো লাগছে এভাবে তোমার কাঁধে মাথা রাখতে।”

” আরে আমার আহির বাবু,এটা আগে বলবেনা।আচ্ছা রেখে মাথা তবে আগে মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো তারপর রেখো।”

আরোশীর কথা শেষ করার পরমুহূর্তেই আহির একমিনিটও দেরি না করে ওয়াশরুমে চলে যায়।আহির চলে যাওয়ার পর আরোশী বিছানাটা গুছিয়ে রেখে নিচে চলে আসে আহিরের খাবার তৈরি করার জন্য।

টেবিলে খাবার রেখে পেছনে ফিরতেই আরোশী খেয়াল করে আহির তার ছোট ছোট পা গুলো দিয়ে নিচে নেমে আসছে।আরোশী তাড়াতাড়ি আহিরের কাছে গিয়ে তাকে নিচে নামিয়ে আনে।

” তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে ফেরি আন্টি?জানো আমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তোমাকে কত খুঁজেছি রুমে।”

” আমি তো আহির বাবুর জন্য খাবার তৈরি করতে নিচে এসেছিলাম।খাবার তৈরি না করলে আহির বাবু খাবে কি।আর ফেরি আন্টি কে সোনা?”

” কেন তুমি।”

” ফেরি অর্থ জানো তুমি?”

” হুম ফেরি অর্থ ভালো পরি।আর তুমি অনেক ভালো।” মুচকি হেসে উওর দেয় আহির।

” কিন্তু আমি ভালো তুমি কি করে বুঝলে?আমি তো মাত্র কালকেই এলাম।”

” আমি জানি তুমি ভালো।কারণ তুমি আমার সাথে খেলো,আমার সাথে গল্প করো,আমার সাথে বসে কার্টুন দেখো,তোমার কাঁধে আমাকে মাথা রাখতে দিয়েছো।”

” এইগুলোর কারণে আমি ভালো?” হেঁসে জিজ্ঞেস করে আহির।

” হুম এইজন্যই তুমি ভালো।জানো আমার সাথে না কেউ খেলেনা,বাবাই ছাড়া কেউ আমাকে আদর করেনা কিন্তু বাবাই তো সারাদিন অফিসের কাজ নিয়ে থাকে তাই বাবাইও আমার সাথে খেলেনা আর জানো বাবাই না আমার সাথে বসে কার্টুনও দেখেনা।দেখতে বললেই বলে তুমি দেখো আহির,আমার কাজ আছে।আমাকে বিরক্ত করোনা।” মন খারাপ করে কথাগুলো আরোশীকে বলে আহির।আহিরের কথা শুনে আরোশীর চোখে পানি জমে যায়।সে জানে বাবা-মা ছাড়া একটা বাচ্চার কতটা কষ্ট হয়।আরোশী আহিরকে জরিয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

” মন খারাপ করোনা আহির বাবু।এখন আমি আছিনা আমি তোমার সাথে সময় কাটাবো,তোমার সাথে খেলবো।মন খারাপ করোনা।”

কথাগুলো বলতে বলতেই আনমনা হয়ে যায় আরোশী।

চলবে……