#অরুণরাঙা_প্রেম
#পর্বঃ০৪
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
সোফায় বসে আছে আরোশী আর আহির।আরোশী ছোট ছোট করে রুটি ছিড়ে সবজি দিয়ে আহিরকে খাইয়ে দিচ্ছে।আহির এক টুকরো রুটি নিচ্ছে আর তারপর আরোশীর কাঁধে আবারো মাথা রাখছে।এভাবেই আহির সকালের খাবারটা শেষ করলো।আরোশী প্লেটটা রেখে আবারো আহিরের পাশে বসলে আহির আরোশীর গায়ে হেলাম দিয়ে বসে।তবে আরোশী কিছু বলেনা কারণ সে বুঝতে পেরেছে এই সময়েই একাকিত্ব ঘিরে ধরেছে আহিরকে।বাবা-মা কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে আহির ছোট থেকেই একা বড় হয়েছে,তাই এখন একটু আদর পেয়েই সে খুশি।সে এটাকেই অনেক বড় কিছু মনে করছে।
” আহির তোমার বোর লাগছেনা?”
” না।”
” কিন্তু আমার তো প্রচুর বোর লাগছে।কি করা যায় বলো তো?” গালে হাত দিয়ে চিন্তা করার ভঙ্গিতে আহিরকে প্রশ্ন করে আরোশী।আহির কিছু না বলে পিটপিট করে আরোশীর দিকে তাকিয়ে রইলো।
” আহির বাবু এভাবে আমার দিকে দেখোনা।”
” কেন ফেরি আন্টি?”
” তোমার ওই চোখগুলো এতো কিউট,দেখলে মনে হয় খুলে আমার চোখে লাগিয়ে নিয়।”
আহির না বুঝেই নিজের মুখটা আরোশীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,” তো নাও।”
আহিরের কান্ড দেখে আরোশী হেসে দেয়।তারপর আহিরের গালে চুমু দিয়ে তাকে আদর করে।
” আচ্ছা আহির আমাকে কি তোমাদের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবে?”
” হুম চলো ফেরি আন্টি।”
” কিন্তু স্যার কি জানলে বকবেন?”
” আরে না বাবাই কিছু বলবেনা।তুমি চলো আমার সাথে।”
আহির আরোশীকে বাড়ির প্রতিটা কোণা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো।দরজা খুলতে খুলতে আরোশী প্রশ্ন করে,
” এটা কার রুম আহির?”
” বাবাই।”
” আচ্ছা আহির তুমি কি রাতে একা ঘুমাই?”
” নাতো।বাবাই ঘুমাই আমার সাথে।”
” আর?”
” শুধু আমরা দুজন।”
” তাহলে তোমার মা?তোমার মা ঘুমায় না তোমার সাথে?আর এসেছি পর্যন্ত তো ম্যাডাম মানে তোমার মাকে দেখলাম না।উনি কি রাত করে বাড়ি ফিরেন?”
আরোশীর প্রশ্ন শুনে আহির কিছু বলেনা,চুপ করে আরোশীর দিকে তাকিয়ে থাকে।আরোশী খেয়াল করে আহিরের মুখটা গোমড়া করে আছে,তাই সে কথা কাটানোর জন্য বলে,
” আচ্ছা চলো আমরা বাইরে গিয়ে কার্টুন দেখি।”
আরোশী আর আহির সোফায় বসে বসে কার্টুন দেখছে।এরই মধ্যে কলিংবেলটা বেজে উঠে।শিলা গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।
” আহির কেমন আছো তুমি?”
আরোশী পেছনে ফিরে দেখে সেইদিন আকাশের সাথে থাকা ছেলেটা মানে অভ্র।অভ্রকে দেখে আরোশী দাঁড়িয়ে যায়,আহির গিয়ে অভ্রকে জরিয়ে ধরে।
” আঙ্কেল বাবাই কোথায়?”
” তোমার বাবাই তো অফিসে।সে একটা ফাইল ফেলে গিয়েছে সেটা নিতেই আমি এসেছি।” এবার অভ্র আরোশীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে তাকে জিজ্ঞেস করে, ” কেমন আছেন আপু?”
” ভালো।”
” এখনো সেইদিনের জন্য রেগে আছেন?আসলে সেদিন আকাশ সত্যিই বুঝতে পারেনি সে ভুল মানুষকে তুলে এনেছিলো।আমাদের সত্যি খা*রাপ কোন উদ্দেশ্য ছিলোনা।”
” তা না হয় বুঝলাম কিন্তু আপনারা কেন শুধু শুধু একটা মেয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন?আপনাদের দেখে তো ভালো মানুষই মনে হয় আর ভালো জবও তো করেন।তাহলে এসব কেন করেছিলেন?”
ধপ করে সোফায় বসে দুঃখভরা কন্ঠে আরোশীকে বলে,” আর দুঃখের কথা কি বলবো আপু।এগুলো ভাবলেই আমার হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করে।”
” আসলে কি হয়েছে সেটা একটু খুলে বলুন।”
” শুনবেন?তাহলে শুনুন।আজ থেকে ৬ মাস আছে একটা মেয়ে আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দেয়।আইডির নাম ছিলো ‘ মরিনা খান’।তো আমি তখনই মেয়েটাকে মেসেজ দি।”
” কি মেসেজ দিয়েছিলেন?” আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে আরোশী।
” লিখেছিলাম ‘কেন মর*বেন শুধু শুধু?কেউ কি কিছু বলেছেন?আর কি খাবো?আপনি কি বিরিয়ানির ব্যবসা করেন?ফ্রীতে বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছেন নাকি?তাহলে আমাকে ঠিকানাটা দিন,আমার না বিরিয়ানি খুবই ভালো লাগে।”
” তারপর?”
” তারপর সেই মরিনা খানের রিপ্লাই এলো ‘কিসব বাজে কথা বলছেন?মাথা ঠিক আছে তো?’ ‘আমি উওরে বললাম মাথা কেন খারা*প হবে?’ সে এরপর বললো, ‘ মাথা খারাপ না হলে এসব কি লিখে পাঠিয়েছেন?আমি মর*তে যাবো কেন?আমার বিরিয়ানির ব্যবসায় বা কেন করবো?আমার বাপের থেকে অনেক টাকা।” এতটুকু বলে থামে অভ্র।
” এরপর কি হলো?”
” আমি তারপর মেসেজ দিলাম, ‘ তাহলে আইডিতে মরিনা খান লিখেছেন কেন?’ মেয়েটা দুটো রাগের ইমোজি সেন্ড করে বলে, ‘ আপনার মাথার ডাক্তার দেখানো উচিত।ওটা আমার নাম মরিনা খান।’ ‘ এটা আমার কেমন নাম?’ মেয়েটা আবারো দুটো রাগের ইমোজি সেন্ড করে বলে, ‘ জরিনা,কারিনা যেমন নাম তেমনি আমার নাম মরিনা।’ এতক্ষণে আমি বুঝলাম আসল ঘটনা।”
” কি বুঝলেন?” উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করে আরোশী।
” এটাই যে এইটা মারিনা হবে,আর মেয়েটা ভুলে মরিনা লিখেছে ফেলে।”
” তারপর?”
” তারপর আমি মেয়েটাকে সেটা বললাম।এটা বলার পর মেয়েটা আবারো দুটো রাগি ইমোজি পাঠায়।আমি তখন জিজ্ঞেস করি, ‘ আপনার কি খুব গরম লাগছে?এই নিন বরফ।’ এটা বলেই আমি দুটো বরফের ইমোজি পাঠিয়ে দি।”
” মেয়েটা এরপর কি করলো?”
” মেয়েটা আমাকে পাগল বলে অফলাইনে চলে গেলো।” একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে অভ্র।
” শেষ?”
” আরে না কি যে বলো শেষ হতে যাবে কেন?মাত্র তো শুরু।”
” তাহলে পরেরটা বলুন।”
” এ-র কয়েকদিন পর মেয়েটা নিজ থেকে আমাকে মেসেজ দিয়ে সরি বলে।এরপর থেকেই মরিনা থুরি মারিনা খানের সাথে আমার প্রতিদিন কথা হতো।কিন্তু একদিন ঘটলো অঘটন।”
” কি হয়েছিলো?”
” একদিন সে আমার প্রপোজ করে বসলো।আমি তখন বললাম, ‘ আমি ম*রে যাবো,নিজের প্রা*ণ দিয়ে দেশ স্বাধীন করবো তাও প্রেম করবোনা।’ কিন্তু কে শুনে কার কথা।মারিনা আমার সাথে জোর করে প্রেম করলো।”
” কিন্তু সেইদিন না আপনারা রাইমা নামের কাউকে তুলে আনার কথা বলছিলেন?”
আরোশীর কথায় মনোযোগ না দিয়ে বলতে লাগলে,” প্রেম করার কয়েক মাস পর আমরা বিয়েও করে ফেললাম।”
” বিয়ে!”
” হুম বিয়ে।আর আমাদের দুটো মেয়েও আছে।”
” বাচ্চা!তাহলে আপনার বউ বাচ্চা কোথায়?”
” মেসেঞ্জারে।”
” এ্যাঁ?”
” জানেন আপু আমার ছেলে-মেয়েগুলো না অনাথ হয়ে গিয়েছে।ওদের মা ওদের ধোঁকা দিয়েছে,ওদের বাবাকে ধোঁকা দিয়েছে।কি জানি আমার বাচ্চাগুলো কতদিন চকলেট,আইসক্রিম,কেক এগুলো খাইনি।” দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বলে অভ্র।
” সব না হয় বুঝলাম কিন্তু রাইমা?ওনার সাথে এখানের সম্পর্ক কি?ওখানে কেন কিডন্যাপ করতে চেয়েছিলেন?”
” কারণ রাইমাই আমার বাচ্চাদের মা মারিনা।সে আমাদের ধোঁকা দিয়েছে।আমার আর বাচ্চাদের ডির্ভোস দিয়ে সে অন্য জায়গায় সংসার শুরু করেছে।”
” বাচ্চাদের ডির্ভোস!”
” রাইমা কি করে পারলো এটা আমার সাথে!ও আমার আমের আম্মু,ও আমার লিচুর আম্মু তুমি আমাদের সংসার ভুলে গেলে।আমরা না ১২ টা বাচ্চা নিবো ভেবেছিলাম কিন্তু মাত্র ২ টো নিলাম বাকি দশটা তো এখনো বাকি।তুমি আমাদের সুন্দর সংসার ছেড়ে কি করে চলে গেলে।আমার বাচ্চাগুলো প্রতিদিন স্বপ্নে এসে আমাকে বলে, “আব্বু ও আব্বু গো,তুমি আর আমাদের আম্মু আর মেসেঞ্জারে সংসার করোনা কেন?আমাদের খাবার খাওয়ানো কেন?তুমি না বলেছিলে আমাদের আরো ভাই-বোন আসবে?তোমরা আর মেসেঞ্জারে বড় বড় বাড়ি কিনোনা কেন?জানেন আপু আমার আম আর লিচুগুলো মেসেঞ্জারে বোরিং হচ্ছে।তারা আমাদের শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে।আগে কি সুন্দর হাত-পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে খেলতো আর এখন তো নাড়াচাড়াও করেনা।আরে আমার আম,লিচু।তোরা কষ্ট পাসনা বাছা,আমি তোদের বাপ তোদের মানুষ করবো।দরকার পরলে মাটি খোঁড়ার কাজ করবো,তাও আমি তোদের মানুষ করবো,বড় স্কুলে পাঠাবো।”
আরোশী এতোক্ষন চুপচাপ অভ্রের কথা শুনছিলো।অভ্র চুপ হলে আরোশী আর আহির একে অপরের দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠে।
চলবে…..