#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব- ৩১)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
পড়ন্ত বিকেল। সূর্যের রৌদ্রদীপ্ত আলো নরম হয়েছে। মন মাতানো হাওয়া বইছে। ভার্সিটি ক্লাস শেষে হাসপাতালের পথ ধরেছে মুন। সৈকতকে কাল রিলিজ দিবে। আজকের পর আর সেভাবে দেখা হবে না। সৈকত বেডরেস্টে থাকবে, বেরুতে পারবে না। বন্ধুরা মিলে ব্যাচেলর বাসায় থাকবে। রুবাব এর কাতারের বাইরে নয়। ভাইয়ের উপস্থিতিতে মুন চাইলেও হুটহাট গিয়ে দেখে আসতে পারবে না। এমনিই সকালের ওমন কান্ডের পর আজ ভাইয়ের সামনে যেতেই অস্বস্তি লাগছে। ভাইকে দেখিয়ে তো আর প্রেম করা যায় না। সৈকতকে না দেখার দুঃখটা যেন এখান থেকেই শুরু হয়েছে।
হাসপাতালের পৌঁছে কেবিনের কাছে যেতেই ভেতর থেকে মৃদু হাসির আওয়াজ এলো। সাধারণত, একটা মুমূর্ষু রোগী থাকা বেড নিরব নিস্তব্ধ থাকে। স্বজনের উপস্থিতি সল্প আলাপচারিতা চলে, তাও গুরুগম্ভীর। সবার মুখ মলিন থাকে, হাসি থাকে না কারোর মুখে। কিন্তু রোগীটা যদি সৈকত হয় এবং স্বজন যদি তার বন্ধুরা হয় তবে দৃশ্যটা বিপরীত হয়। সৈকতের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল, সেন্স ফিরছিল না। এ অবধি সবার মাঝে গম্ভীর ভাব থাকলেও কেবিনে শিফট করার পর তার ছিটেফোঁটা ও দেখা যায়নি। এরপর কেবিনটা যে একটা আড্ডাখানা। কেবিনে বিয়ের আলাপ চলছে। সকাল বিকাল আড্ডা জমছে, বন্ধুরা হৈ-হুল্লোড় করছে। রাতে এরা নাকি আবার মুভি টুভি ও দেখতেছে। এ নিয়ে নার্সরা মুনের কাছে অনেক অভিযোগ করে গেছে। বুঝিয়েও লাভ নেই, এরা শুনবেনা। শুধু স্বজনরা হলে এককথা, এখানে রোগীই বড় ভূমিকা রাখছে। তার যে ভয়ানক অবস্থা হয়েছে, সে খেয়ালটি নেই যেন। সে সেন্স ফেরার পরই প্রেমিকার খোঁজে মেতেছে, প্রেমিকা আসতেই প্রেম জুড়ে দিয়েছে। কথা বলতে পারার পর থেকে তার মুখে খই ফুটছে। মুনের অবাক লাগে তার মনোবল দেখে।
এখনো সবার আড্ডা বসেছে। রুবাবের কথা শোনা যাচ্ছে। মুনের অস্বস্তি হচ্ছে ভেতরে যেতে। কেমন যেন লজ্জা লাগছে। জড়তা নিয়ে কেবিনের ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল। হুট করে দরজা খোলায় সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল ওকে। সবার দৃষ্টি আটকে রইল ওর উপর। রুবাব অন্তর, নাহিদ এক্সট্রা বেডে বসা। সিফাত দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সৈকত বেডে আধশোয়া হয়ে আছে। কাধের কারণে ডান হাত এখনো নড়াচড়া করা বারণ। বাঁ হাত উন্মুক্ত। স্যালাইন ও চলছে না।
সুরমা ছেলের পায়ের কাছে বসে আছেন। মা-ছেলে কথা বলছিল বোধহয়। সুরমাকে দেখে মুনের আবার মনে পড়ল সকালের কথা। অস্বস্তি হলো। সবার চাহনি দেখে সে পিছু হাটল।
” চলে যাচ্ছো কেন? ভেতরে আসো!” ওকে চলে যেতে দেখে কেউ একজন যেন চেঁচিয়ে উঠল। সেই কেউটা সৈকত। মুন জড়তা নিয়ে দাঁড়াল। অস্বস্তি নিয়ে চাইল পিছু। সৈকতের দিকেই দৃষ্টি ফেলল প্রথমে। সৈকতের চোখের ভাষা ভিন্ন। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। সেই হাসি দেখেই মুন ভড়কে গেল। কোন ঘাপলা আছে।
মুনের ভয় বাড়িয়ে সৈকত বলল,
“এদিকে এসো।”
সৈকতের কথার টোন ভিন্ন। কোমল, আদুরে। চোখে তার ভিন্ন রেশ। সৈকতের মাথায় যখন , মুনকে বেকায়দা ফেলবার বুদ্ধি ঘুরে তখন এই ভাব আসে। মুন চমকাল, এই লোকটা কী করতে চাইছে সবার সামনে? তার ভাই আছে। সৈকত ইশারা করে মুনকে ওর কেবিনের ভেতরে নয়, ওর বেডের কাছে যেতে বলছে। এতেই মুনের সন্দেহ সত্যি হলো। মুন ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। এক পাও নড়ল না।
সবাই কথা থামিয়ে উৎসুক হলো। এদিকে দৃষ্টি নিবিদ্ধ করল। সুরমা বেগম ছেলের ভাব দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।
মুনকে আসতে না দেখে সৈকত আবার ডাকল,
” ডোন্ট বি এফ্রেইড, আই এম হিয়ার। কাম অন! ”
সৈকত স্বর শান্ত, ভরসার। সেই ভরসাতেই মুনের ভয় বাড়ল। ওর মনে হচ্ছে, সৈকত কোন অঘটন ঘটাতে চাইছে। তবুও না গিয়েও উপায় নেই। এখন আবার পালালে বিষয়টা খারাপ দেখায়। অগত্যা মুন ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল সৈকতের দিকে।
সুরমা ছেলের ইংরেজি কথা বুঝলেন না। তবে ছেলের কথার ভাব ভালো ঠেকল না তার কাছে। তিনি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন। এখানে হচ্ছেটা কী? সৈকত রুবাবের বোনের সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।
বেডের কাছে যেতেই সৈকত হুট করে মুনের হাত ধরে ফেলল। মুন চমকে তাকাল। আতঙ্কে লজ্জায় ওর হৃদপিণ্ড বেরিয়ে আসার জোগাড়। অথচ সৈকত একবারে স্বাভাবিক।
সুরমা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলেন ছেলের ধরা মুনের হাতখানার দিকে। সৈকত মুনের হাত ধরল কেন! তিনি তীক্ষ্ম চোখে চাইলেন ছেলের দিকে। মায়ের তাকানো দেখেও সৈকত হাত ছাড়ল না। বরং হাতটেনে মুনকে বেডে ওর বাঁ পাশে বসাল।
বন্ধুরা হা করে দৃশ্য গিলছে। সৈকতের মনোভাব ধরতে পেরেছে ওরা। হাসি হাসি ভাব ওদের মুখে। কেবল রুবাব থম ধরে বসে আছে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে আছে এদিকে। সিফাত ঘটনার আঁচ করতে না পেরে উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে। সৈকত মুনের হাত ধরেই মাকে বলল,
“মা, এই মেয়েটাকে তোমার ছেলেবউ হিসেবে পছন্দ হয়?”
এক মুহুর্তের জন্য সব যেন থমকে গেল। মুন স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। বিস্ময়ে হতভম্ব সে। তড়িৎ চাইল সৈকতের পানে। সৈকতের চোখে দৃঢ়তা। মুন চাইতেই পলক ঝাপটে ভরসা দিল। মুন অসাড় হয়ে বসে রইল। বন্ধুদের চোয়ালে হাসি বাড়ল। সুরমার চোয়ালে বিস্ময়। তিনি বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। থ বনে বসে রইলেন। মুনকে ছেলেবউ হিসেবে পছন্দ মানে? সৈকতের না কোন শহুরে মেয়ে পছন্দ আছে। তবে এ কথা ক্যান জিজ্ঞেস করতেছে? কী হচ্ছে বুঝতেই পারছেন না সুরমা। খানিক বাদে হকচকিয়ে বলল,
“কী কইতাছো?”
সুরমার তীক্ষ্ম প্রশ্নবিদ্ধ চোখ সরাসরি পড়ছে ছেলের উপর। বিপরীতে একটুও বিচলিত হতে দেখা গেল না সৈকতকে। সুরমার ভাব দেখে মুন ভয়ে তটস্থ। যদি ওকে পছন্দ না করেন। এই বুঝি সবার সামনে ওকে রিজেক্ট করলেন। মুনের হৃদপিণ্ড যেন গলার কাছে এসে পড়েছে। আতঙ্কে হাত পা কাঁপন ধরেছে। জড়োসড়ো হয়ে সৈকতের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। সৈকত এক পলক চাইল এর দিকে। হাত ছাড়ল না, বরং বন্ধন আর শক্ত করে দৃঢ়তার সাথে বলল,
” এই মেয়েটা সেই, যাকে আমি আমার জীবন সঙ্গিনী বেছে নিয়েছি ।”
মুনের দিকে ইশারা করল সৈকত। ওর চোখে, মুখে, স্বরে দৃঢ়তা। চেয়ালে একটা গম্ভীরতা উদয় হয়েছে। যা বলে দেয়, তার কথাতে বিন্দুমাত্র খাদ নেই। কথা, ভাবে মাঝে শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। ভরা মজলিশে মায়ের সামনে বসে এমন করে ক’জন স্বীকৃতি দিতে পারে? কী মনোবল তার! ভয়, লজ্জার সাথে একরাশ মুগ্ধতা এসে ভীড় করল মুনের মাঝে। মানুষটা এখনো শক্ত করে ওর হাত ধরে আছে। মুন তাকিয়ে আছে সেই হাতের দিকে। সেই বন্ধন যেন বলল, পরিস্থিতিতে যে কূলেই যাক, তোমার হাত ছাড়ব না আমি। সবসময় তোমার সাথে থাকব। এই ভরসা দেখে চোখে পানি চলে এলো মুনের।
সুরমা তখনো ঘোরে আছেন। ছেলের কথা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছেনা তার। তিনি অবাক হয়ে একবার ছেলের দিকে, একবার মুনের দিকে তাকাচ্ছেন। তার মনে হচ্ছে তিনি ভুল শুনেছেন। সৈকতের পছন্দের মানুষ মুন! যেই মেয়েটার জন্য সৈকত বাড়ি থেকে পালিয়েছে সে মুন! কাল থেকে তিনি যেই মেয়েকে পুত্রবধূ করার আফসোসে মেতেছেন ছেলে তাকেই পছন্দ করে বসে আছে? এটা বিশ্বাস হচ্ছেনা সুরমার। তিনি তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে বললেন,
” এই তোর পছন্দ?”
সুরমার কথায় অবিশ্বাস ছিল, অথচ সবাই সেটাকে অগ্রাহ্য ধরে নিল। সৈকত আর সিফাত ছাড়া সবার চোয়াল অপ্রতিভ হলো। নাহিদ অন্তরের হাসি থেমে গেছে। ওরাও ধরে নিয়েছে মুনকে সুরমা মানতে পারছেন না। বোনের কথা ভেবেই রুবাবের মুখ লাল হলো। এদিকে মুনের চোখে ভাসা জল গালে গড়ালে। শ্বাস আটকে এলো। আন্টি না মানলে কী হবে! কেবিনটায় পিনপতন নীরবতা। চলছে গুরুগম্ভীর আলোচনা।
সৈকত শান্ত স্বরেই মাকে বলল,
“হ্যাঁ। আমার পছন্দে তোমার আপত্তি আছে?”
সুরমা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন না। গম্ভীরমুখে তাকিয়ে রইলেন। তার এই গম্ভীরতাই সবার দম আটকে দিল যেন। সুরমা অনেকক্ষণ বাদে মুখ খুললেন। ভরাট স্বরে বললেন,
” ওর হাত ছাইড়া দে ।”
মায়ের ভরাট স্বরের আদেশে ভয় পেয়ে গেল সৈকতও। এই ক্ষণে এসে ওরও মনে হলো, মা মুনকে মানেনি। সিফাতের কথা বোধহয় ভুল। সৈকতের চোয়ালে হারানোর ভয় দেখা গেল। সে কাতর চোখে মায়ের দিকে তাকাল। সুরমাও তাকালেন, চোখ রাঙালেন ছেলেকে। সৈকত হাত ছাড়ল না। মুন কেঁদেই ব্যাকুল। সুরমা রাগ নিয়ে মুনের উদ্দেশ্যে বললেন,
” এই তুমি, আমার ছেলের পাশ থেইক্যা উইঠ্যা আসো।”
সৈকত গম্ভীরমুখে বলল, “মা তুমি তো …
সুরমা থামিয়ে দিলেন ছেলেকে, ” এগুলান মা গো বিষয়। আমি বুইজ্জা লোমু। তুই একখান কথাও কইবিনা। আমি যেটা কমু হেটাই অইব। ওরে ছাইড়া দে।”
সৈকত চোখ লাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সিফাত ও ভয় পেয়ে গেছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মা খুশি হওয়ার কথা, তবে এমন করছে কেন?
সৈকতের দৃঢ়তা দেখে সবার ভাবনা ছিল সৈকত মুনের হাত ছাড়বে না। কত সাধনার পর পেয়েছে, এত সহজে ছেড়ে দিবে? কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সৈকত মুনের হাত ছেড়ে দিল। চাপা স্বরে বলল,
” যাও।”
ছাড়া হাত আর একটা শব্দই যথেষ্ট মুনকে ভেঙে দিতে। সৈকত মায়ের কথায় ওকে ছেড়ে দিল। একটু আগেই না বলছিল, কোন পরিস্থিতিতে ছাড়বেনা। অথচ কিছু সময় যাবার আগেই ছেড়ে দিল। এর অর্থ মায়ের বিপরীতে যাবে না সৈকত। ওকে ছেড়ে দিল একবারে।
মেয়েটা ডুকরে উঠল। মুখ চেপে কেঁদে উঠল। রুবাব হাত মুঠোবন্দি করল। তেড়ে আসছিল সৈকতের দিকে। নাহিদ অন্তর ঠেকাল। ওদের চোয়ালেও ক্রোধ। প্রলয়ঙ্কারী লঙ্কা বেধে যাবে যে কোন মুহুর্তে।
চলবে…..
#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-৩২)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
ঝড়ের পূর্বে যেমন পরিবেশ গুমোট হয়ে থাকে। ভ্যাপসা একটা আবহ তৈরি হয়, এই ক্ষণে সৈকতের কেবিনে তেমন গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। ‘ মুনকে সৈকতের মা রিজেক্ট করেছেন’ এই কথাটা এফোঁড়ওফোঁড় করছে সবার মন। মায়ের কথায় সৈকত মুনকে ছেড়ে দিয়েছে এ যেন মানতেই পারছেনা বন্ধুরা। ওদের চোখে ক্রোধ, পারলে সৈকতকে পি ষে ফেলে। কিন্তু সুরমার জন্য পারছেন না। সবাই ক্রু র চোখে তাকিয়ে আছে। নাহিদ অন্তর কিছু বলতে গিয়েছিল, সুরমা তাদের ও ধমকে থামিয়ে দিয়েছেন। মুন তখনো সৈকতের পাশে বসা। মুখে হাত চে পে ফোঁ পাচ্ছে। সৈকত কাতর চোখে চেয়ে আছে ওরপানে। মৃদু স্বরে ডাকল,
“শোনো? ”
মুন শুনল না। ওর ভাব পরিবর্তন হলোনা। সৈকত আবার কিছু বলতে গেল, তখন সুরমা ছেলেকে ধমকে উঠলেন,
“তোরে নাক গলাইতে মানা করছি না? ”
সৈকত অনুরোধের সুরে বলল, “প্লিজ মা!”
সুরমার দয়া হলো না। স্বর নামল না। উঁচু স্বরে ফিরতি আদেশ দিলেন, “ওরে উইঠ্যা আইতে ক।”
সৈকত চাপা শ্বাস ফেলে কী যেন বিড়বিড় করল। মুনকে কত কিছু বলতে চাইল, মুন শুনল না। কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়াল। ভেজা চোখে সৈকতের দিকে এক পল চেয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। তাতেও সমস্যা বাঁধল সুরমার। ফিরতি গম্ভীর স্বর ভেসে এলো,
“যাইতাছো ক্যান? তোমারে যাইতে কইছি? ”
মুন থেমে গেল। প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে চাইল সুরমার পানে। কেমন রাগ রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছেন মুনের দিকে। দেখেই মুনের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। সে চোখ নামিয়ে নিল। সুরমা ভরাট স্বরে বললেন,
” বসো এইহানে। আমারে জবাব দিয়া যাও।”
সুরমা কী জবাবদিহি চান ওর কাছে? কেন তার নাকের তলায় বসে তার ছেলের সাথে প্রেম করেছে সেই জবাবদিহি? মুন জবাবদিহি করবার মতো অবস্থায় নেয়। ওর পৃথিবী ঘুরছে। সৈকত ওর হাত ছেড়ে দেয়াটা মানতে পারছে না ও। সব এলোমেলো লাগছে। মুন সৈকতের দিকে চাইল আবার। সে কী যেন ইশারা করছে। মুনের মনে হঠাৎ রাগ চাপল, সে আজ এর শেষ দেখে যাবে। সৈকত ঠিক কী কী করতে পারে। সে কি মায়ের উপর একটা কথাও বলবে না? ওকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথেই ছেড়ে দিবে? পারবে? দেখতে চায় মুন। চোখমুখ শক্ত করে বসল সুরমার পাশে। সুরমা অসন্তোষের সাথে বললেন,
“কাজটা কি তুমি ঠিক করলা?”
সুরমার প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে মুন মাথা নিচু করে ফেলল। আবার চোখ বেয়ে জল গড়াল। সে তো প্রেম করতে যায়নি, সৈকত এসেছে। প্রেমের পথ নিজে এগিয়ে এখন ওকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে সৈকত। ওর পক্ষ হয়ে একটা কথা ও বলবে না মানুষটা? এই ওর পাশে থাকা? মুনের বুক ভেঙে কান্না এলো। মুন যেন ঘোরে চলে গেছে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে আছে।
“মা, বেচারিকে আর ভয় দেখিয়ো না। এবার সেন্স হারিয়ে ফেলবে।”
সুরমা তড়িৎ চাইলেন ছেলের পানে। সৈকত মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। নরম সুরে অনুরোধ করল,
” ওকে আমি বলতে নিষেধ করেছি। শাস্তি দেয়ার হলে আমার দাও!”
সুরমার চোখে বিস্ময় দেখা গেল। বিস্ময় নিয়ে চাইলেন ছেলের পানে। প্রশ্ন করলেন,
“তুই বুইজ্জা গেছস?”
সৈকত দৃঢ় স্বরে বলল, “না বুঝলে হাত ছাড়তাম না। ”
“বিপক্ষে যাইতি?”
” পক্ষেও যেতাম না। ”
এদিকে মন নেই মুনের। সে উদাস হয়ে ঘোরে মেতে। হঠাৎ সুরমার ডাকে বাস্তবে ফিরল,
“হাত দাও?”
উনি কি এবার মা রবেন? এমন প্রশ্ন খেলে গেল মুনের মুখে। সে আবারও অসহায় চোখে চাইল সৈকতের দিকে। সৈকত গম্ভীরমুখে বলল,
” কান্না বন্ধ করে মায়ের কথা শুনো।”
রাগে ক্ষোভ মুখ ফিরাল মুন। হাত দিল না। কোলেই মুঠো করে রাখল। সুরমা তার হাত থেকে সোনার বালা খুলে নিলেন। চোখের পলকে মুনের হাত টেনে পরিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় মুন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। একবার হাতের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার সুরমার দিকে। কী হলো এটা! উনি চুড়ি পরালেন কেন? চুড়ি পরানোর মানে তো….
মুন বিস্ফোরিত চোখে চাইল সৈকতের পানে। সৈকত চোখে ঝলমলে হাসি । চোখে চোখ পড়তেই বলল,
“মা, মজা করতেছিল। ”
মুন হতবাক হয়ে গেল। মজা করতেছে মানে কি? এতক্ষণ আন্টি যা করলেন ওগুলো কী ছিল? মজা? তারমানে মুনকে পছন্দ হয়েছে উনার? তড়িৎ মুন সুরমার দিকে তাকাল, বিস্ময় নিয়ে। এতক্ষণে হাসি দেখা গেল সুরমার ঠোঁটে। আকস্মিক হেসে ফেললেন তিনি। মুনের হাত ধরে বললেন,
” আইবার পর থেইক্যা কতবার জিগাইলাম। এতদিন এক লগে থাকলা, খাইলা তাও কইলানা ক্যান আমার পোলার পছন্দ তুমিই। দুইডা মিলে আমার ঘুম হারাম কইরা রাখছো। এর লেইগ্যা শাস্তি দিতে চাইছিলাম। পোলা তো বুইজ্জা গেছে, তুমি না বুইঝা ভয় পাইছো। মজা করতেছিলাম, মা।”
মুন বিস্ময়ের জন্য কথা বলতে পারল না। ওর কান্না থেমে গেছে। ও স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। চোখের পলক অবধি ফেলছে না। খানিক আগের ব্যাপারটা ফান ছিল? সৈকতকে ও হারাচ্ছে না? মুনের বিশ্বাসই হচ্ছে না। মুন থ বনে তাকিয়ে আছে সুরমার দিকে। ওর তাকানো দেখে হাসলেন সুরমা। মেয়েটা বেশি ভয় পেয়ে গেছে। তিনি মুনকে সস্নেহে আগলে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন। বললেন,
” তোমারে আমার আগ থেইক্যা পছন্দ। কাইলকাই আফসোস করতেছিলাম, তোমারে পোলার বউ করতে পারুম না বইলা। যাক, পোলার পছন্দ আছে। তুমিই হইবা আমার পোলার বউ। ” সুরমা খুশিতে গদগদ করে উঠলেন।
সৈকত মায়ের খুশি পরখ করল প্রশান্ত চোখে। এতক্ষণের আটকে থাকা শ্বাস ফেলল তিন যুবক। চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেছে। চোখে মুখে বিস্ময়। সৈকত বন্ধুদের দিকে বিরক্তচোখে তাকাল। যার অর্থ, তোরা ও বুঝলি না আমার?
সৈকত চোখ ফিরিয়ে মাকে বলল, “ভাগ্যিস বলে দিয়েছো, নয়তো কিছুক্ষণ বাদে এরা সবাই মিলে আমার জান নিয়ে টানা টা নি করতো।”
সুরমা বুঝলেন না। প্রশ্ন করলেন, “ক্যান?”
“ওরা সবাই কনেপক্ষ। ”
সুরমার এতক্ষণে বোধহয় ছেলের বন্ধুদের খেয়াল হলো। তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,
“তোমরা তো কইতে পারতা?”
নাহিদ অন্তর এবার নিজেকে ধাতস্থ করে সুরমার সাথে আলাপচারিতায় বসল। সুরমা আজই বাড়ি ফিরে রুবাবের বাবা মায়ের কাছে মুনের হাত চাইবার কথা জানালেন। তাতে আপত্তি জানাল সবাই। সৈকত এক কথায় মানা করে দিল। ও জানাল, বেকার অবস্থায় সে মনির সাহেবের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না। বিসিএস হলে তবেই যাবে। সুরমা এত সময় দিতে নারাজ। তিনি পারলে আজই মুনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাব। মুনের প্রতি তীব্র স্নেহ তার। নাহিদ অন্তর বুঝাল।
রুবাব স্থির চোখে দেখছে। ওর বোনটাকে, বোনের পাশে বসা মহিলাকে, মহিলার ছেলেকে। মুন কেবিনে আসার পর যখন হুট করে সবার সামনে মুনের হাত ধরে ওকে স্বীকৃতি দিল। তখন রুবাবের বুকটা ভরে এলো। একটা ছেলে কতটা সাহসী হলে এমনটা করতে পারে। রুবাবের তখন মনে হয়েছিল, এমন একটা ছেলেকেই সে সবসময় বোনের জন্য চেয়েছে। সাহসী, প্রেমী, ব্যক্তিত্ববান। বন্ধুর প্রতি গর্ব হচ্ছিল ওর। সেই গর্ব উবে গেল খানিক বাদে। সৈকত যখন হাত ছেড়ে দিল তখন ওর মনে হচ্ছিল, ওর জানটা কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সৈকতের হাত ছেড়ে দেয়া কিছুতেই মানতে পারছিল না। সুরমার আচরণ দেখে রুবাব নিজেও ভয় পাচ্ছিল। বন্ধুর মা না হলে কটা কথা শুনিয়ে দিত। এত রাগ লাগছিল ওর। কিন্তু হঠাৎ করে যখন সুরমার আচরণ বদলে গেল। খানিক আগের রাগ এখন স্নেহে রূপ নিয়েছে। মহিলা মুনের হাতে বালা পরিয়ে দিয়েছেন, সস্নেহে কপালে চুমু খেলেন। তার হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে তিনি কতটা খুশি। রুবাবের দেখে শান্তি লাগছে। কিন্তু কোথাও ভয় ও হচ্ছে।
মা মজা করলেন ঠিক আছে, কিন্তু সৈকত কিভাবে পারল মেয়েটাকে কাঁদাতে। ওর বোনটা খুব ভেঙে পড়ছিল, সৈকত তো ওকে আশ্বস্ত করতে পারত। করল না, উলটো মজা নিল। রুবাব বন্ধুর উপর ক্ষিপ্ত হলো।
মুন অসাড় হয়ে বসে আছে। খানিকের ব্যবধানে ওর উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেল। ও যেন বুঝে উঠতে পারছেনা কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা। ওর মনের অবস্থা দেখে সৈকত অন্তরের দিকে ইশারা করল। অন্তর নাহিদ সুরমাকে বাহানা দিয়ে কেবিনের বাইরে ডেকে নিল। রুবাব বের হলো না। বরং ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে এসে বলল,
“তুই আজ আবার আমার বোনকে কাঁদাইলি। ”
বন্ধুর কান্ডে অবাক হলো না সৈকত। সে জানতো এমন কিছু হবে। আজ যদি রুবাব সৈকতের গায়ে হাত ও উঠাতো তবুও অবাক হতো না সৈকত। রুবাব স্বভাবে হাইপার। বোনকে সে অধিক ভালোবাসে, তা অজানা নয় সৈকতের। সে হেসে বলল,
” মা কথার মাঝেই হিন্টস দিছে। উইঠ্যা যাইতে আর উইঠ্যা আইতের পার্থক্য তোর বোকা বোন না বুঝে কেঁদেছে। আমি তো তখন থেকে বলার চেষ্টা করতেছি, তোর বোন শুনলে তো!”
বোনকে কী দোষ দিবে, সে নিজে ও তো বুঝে নি। রুবাবের রাগ নামল না। সে চোখে রাগ নিয়ে বলল,
” হাসি মজায় ও আমার বোনকে কাঁদানোর রাইট আমি তোরে দিই নাই। আমার বোনকে আমার কাছে দিয়া দে। তোদের কাছে ও সিকিউর থাকবে কি না এই নিয়েই ভয় হচ্ছে। বোনই বিয়ে দিব না তোর কাছে।”
সৈকতের বেডে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসল। বলল,
“স্যরি শালাবাবু, আপনার বোনকে দেয়া টেয়ার অপশন নেই আমার কাছে। তাই দিতে পারছি না। তবুও যদি আপনার বোনকে নেয়ার ইচ্ছে থাকে, চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আমি কোন বাঁধা দিব না। পারলে নিয়ে যান দেখি।”
রুবাব বোনের দিকে তাকাল। তার ধ্যানমন এদিকে নেই। কোন উদাস হয়ে বসা। কোন খেয়ালে মেতেছে কে জানে। রুবাব বেশ বুঝতে পারল, তার বোন এখন সৈকতের কাছ ছাড়বে না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাগ নিয়ে সৈকতের দিকে চেয়ে বলল,
“তোরে আমি দেইখ্যা লোমু।”
সৈকত চোখমুখ কুঁচকে বলল, ” আস্তাগফিরুল্লাহ। কদিন বাদে বোনজামাই হবো তোর, অথচ তুই আমাকে দেখতে চাইতেছিস! ছিঃ ছিঃ! আমি আগেই বলছিলাম, তোর মতলব ভালা না। তাওবা পইড়া ভালা হইয়্যা যা। এবার তো আমার শ্বশুরবাড়ি গিয়েও ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে। এই বুঝি শালাবাবু..
সৈকতের কথা শুনে রুবাব চট করে বোনের দিকে তাকাল। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
” লা ত্থি মাইরা হাড্ডি গুড্ডি ভা ইঙা ইলামু তোর। আমার লগে বেয়াদবি করবি পায়ে পইড়া মাফ না চাইলে বোইন বিদায় দিমু না। ভালা হইয়্যা যা।”
সৈকত হাসতে হাসতে বলল, ” আমার কিছু হইলে তোর বোনের কী হাল হবে তার ডেমো তুই পেয়ে গেছিস অলরেডি। এসব মাফ টাপের হুমকিতে তুই বোনকে আটকাইতে পারবি না। আর ভালা আমি না তুই হ, কদিন বাদে ভগ্নিপতি হব। নজর ঠিক কর।”
রুবাব রাগ নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। সৈকত পিছু ডাকল,
” শুন রুবাব?”
রুবাব দাঁড়াল। বিরক্তি নিয়ে পিছু ফিরে বলল, ” প্রেমিকাগো মতন পিছু ডাকিস ক্যান? এবার তোর চরিত্র খারাপ লাগতেছে আমার।”
সৈকত হাসল, “আমার চরিত্র ফুলের মত পবিত্র। তোর বোইনরে জিগাইস, ডাউট থাকলে। আচ্ছা শুন, একটা কথা বলা হয়নি তোরে।”
“কী?” রুবাবের ধারণা সৈকত ফাজলামো করবে। ওর ধারণা ভ্রান্ত করে আকস্মিক সৈকতের চোয়াল গম্ভীর হলো। সিরিয়াস স্বরে সে বলল,
” তুই যা নিয়ে চিন্তা করছিস, তা অমূলক। আমি আমার কোন কথার খেলাপ হব না। সব আগের কথা মাফিকই হবে। তোর বোন তোর শহরেই তোদের পরিবারের মেয়ের মত লাইফ লিড করবে। ”
রুবাব চলে যেতে গিয়েও থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে শুনল। চমকে চাইল বন্ধুর পানে। সৈকত কিভাবে বুঝল যে, রুবাব বোনের ভবিষ্যত নিয়ে ভয় পাচ্ছে? সুরমার কথা শোনার পর থেকে রুবাবের ভাবনা এসেছে, সৈকতের সাথে বিয়ে হলে সুরমা মুনকে গ্রামে রাখবেন, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে ওর। ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার করতে হবে। ওর বোন গ্রামীণ জীবন মানিয়ে নিতে পারবে? ওর ভয়টা তো কারো কাছে প্রকাশ করেনি তবে সৈকত জানল কিভাবে? রুবাব প্রশবিদ্ধ চোখে তাকাতেই সৈকত অভয় দিয়ে বলল,
” চিন্তা করবেন না, শালাবাবু। আমি আপনার বোনের স্বপ্নের খেয়াল রাখব।”
এই ভরসাটুকুর দরকার ছিল রুবাবের। আকস্মিক ওর মনের সব চিন্তা দূর হয়ে গেল। মন প্রাণ ভরে এলো। বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল, ভরসা এলো। রুবাবের রাগ সরে গেল, প্রসন্ন হাসল বন্ধুর পানে চেয়ে। বলল,
“আমি তোকে ভরসা করলাম, অমর্যাদা করিস না।”
কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রুবাব। সৈকত সেদিক পানে চেয়ে চাপা শ্বাস ফেলল। এই যে ভরা মজলিশে মায়ের সামনে মুনকে হাজির করানোটা সার্থক। রুবাবকে ভরসা দিতে পেরেছে যে, সৈকত মুনের সাথে থাকবে। সৈকত চাইল পাশে থাকা রমনীর পানে।
__________________
মুন ভাবনার অকূলে বিভোর। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে আছে। চারদিকের খেয়াল নেই। সৈকত প্রিয়তমার মুখখানা দেখল গভীর চোখে। হুট করেই অনুধাবন করল, ওর নার্ভাস লাগছে। এতক্ষণ ভরা মজলিশে মায়ের সামনে অকপটে নিজের পছন্দের কথা বলতে একটুও জড়তা হয়নি। অথচ ঘোরে থাকা নিশ্চুপ মেয়েটার সাথে কথা বলতে নার্ভাস লাগছে। ভয় লাগছে, ভীষণ রেগে আছে ওর উপর। না জানি কী করে আজ! সৈকত চাপা শ্বাস ফেলে গলা ঝেড়ে কাশল। নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চাইল। মুন বাস্তবে ফিরল। চমকে চাইল আশপাশ। কাউকে না দেখে আপনমনে বলল,
“সবাই চলে গেছে?”
পিছু থেকে আওয়াজ এলো, ” হ্যাঁ, শুধু তুমি আর আমি আছি।”
মুন তড়িৎ চাইল সৈকতের দিকে। ওকে দেখেই যেন কিছু মনে পড়ল। কিছুটা দূরে সরে গেল। রাগ নিয়ে বলল,
“আমি আপনার সাথে কেন?”
“তো তোমার কোথায় থাকার কথা?”
” আন্টি আমায় রিজেক্ট করেছেন। তার কথায় আপনি আমায় ছেড়ে দিয়েছেন। ”
কাঁপা স্বরে বলল মুন। ওর চোখ ভিজল আবার। উঠে দাঁড়াল। যাবার জন্য উদ্যত হতেই সৈকত হাত ধরে ফেলল।
“মা মজা করছিল।”
মুন চোখ লাল হলো। এত রেগে গেল মেয়েটা। ক্ষীপ্ত গলায় বলল,
” এটা ফান! আপনি কী করেছেন? আমার আবেগের সাথে খেলা করলেন? আমার হাত ছেড়ে দিলেন! আমি এতক্ষণ দম আটকে ছিলাম, আপনি দেখে মজা পাচ্ছিলেন তাই না? আমার করুণদশা এঞ্জয় করছিলেন। এটা আপনার কাছে ফান? আমার কান্না, কষ্ট পাওয়াতে আপনার কিছু যায় আসে না, আপনার ফান মনে হয়? ”
সৈকত বলতে চাইল, “আমি তো অনেকবা…
মুন ওকে কথা বলতে দিল না। ক্রুর চোখে চেয়ে বলল,
” সব মজা মনে হয়, তাই না? ঠিক আছে, আজ একটা মজা আমিও করছি। আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি যেমন মায়ের সামনে আমাকে চিনেননি, আমিও আপনাকে চিনব না। ”
মুন ঝামটা মেরে সৈকতের হাত ছাড়িয়ে নিল। এক পা বাড়াতেই সৈকত ফিরতি হাত ধরল। মুন রেগে বলল,
“হাত ছাড়ন। ”
“আমাদের ওদিকে ছেলের মা বালা পরানো মানে মেয়েটা ছেলেটার হয়ে গেছে। এরপর আর ছাড়াছাড়ি নেই, শুধু কাছে আসাআসি। ” সিরিয়াস মুহুর্তে ও এই ছেলের দুষ্টুমি যাবে না। মুনের রাগ কমার বদলে বেড়ে গেল,
“লাগবে না আমার কোন বালা। আমি এখুনি খুলে ফেলব। হাত ছাড়ুন।”
“ছেড়ে দিলে থাকতে পারবে?”
প্রশ্নটা ভেতরে কাঁপন ধরাল মুনের। লাগাতার ঝটকায় রাগ যেন আর অনুভূতির কথা ভাসছে না। সে তেজী স্বরে বলল,
” পারব।”
“কিন্তু আমি পারব না। ” সরল স্বগতোক্তি সৈকতের। ওর স্বর গভীর। সেই গভীর স্বর মুনের হৃদয় গিয়ে ছুঁলো। রাগদের করে দিল ভণ্ডুল। এর নিরবতা দেখে সৈকত ওর হাত ছেড়ে দিল। তারপর বলল,
” আমাকে ছাড়া যখন থাকতে পারবে, তখন খুলে ফেল বালা। মনে রেখো, এই বালা খোলা মানে আমাকে চিরতরে ছেড়ে দেয়া। ”
সৈকত আবার বেডে হেলান দিল। অন্তর্ভেদী নয়ন ফেলল মুনের পানে। মুনের চোখ মুখের ভাব পরখ করছে স্থির চোখে। মুনের চোখে পানি টলমল করছে। কিন্তু গড়াতে দিচ্ছে না। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রেখেছে। খানিক আগে সুরমার ঠাট্টায় সৈকতের সায় দেয়ার রাগটা আছে এখনো। সে প্রাণপণে রাগতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। কোমলমতি মনে রাগের চেয়ে আবেগটাই বেশি কি না।
মুন চাপা রাগ নিয়ে বাঁ হাতের বালায় হাত দিল। টেনে কবজি অবধি ও নিয়ে এলো। কিন্তু আর আগাতে পারল না। বালা টাইট বলে নয়, হাতের কাঁপুনিতে। ডান হাতটা কেঁপে উঠল আকস্মিক। কানে বাজল, বালা খোলা মানে ছেড়ে দেয়া। মুন পারবে সৈকতকে ছাড়তে? কদিন আগে যখন সৈকতের অসুখ হলো, তখন ওর কিছু হবে ভেবেই মুনের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আর এখন সেই মানুষটাকে হারাবে ও? সৈকত ওর প্রাণে বাসে। প্রাণ হারালে বাঁচে কেউ? মুনের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। সে পারল না। মুন ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। না খুলল বালা আর না চাইল সৈকতের পানে।
ওর ভাব দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল সৈকতের। সেই হাসিকে লাই দিয়ে সারামুখ ঝলমল করে উঠল। মুনের দিকে তাকানোর মাঝেই আকস্মিক মলিনকন্যার হাতটি ধরে টানল কাছে। অবচেতন মনেই মুন এসে পড়ল প্রিয়তমের বুকে। চমকে চাইতেই প্রিয়তম এক হাতে আগলে নিয়ে প্রগাঢ় স্বরে বলল,
” তুমি আমাকে ছাড়বেনা জেনেই ছাড়ার সুযোগ দিয়েছি তোমায়, সম্ভাবনা থাকলে সেই সুযোগ দিতাম না। আমি তোমাকে তোমার আগ থেকে তোমার চেয়ে বেশি ভালোবাসি।”
কথার জাদুকর সৈকত। ওর কথারবাণে প্রতিবারই রাগ উবে যায় মুনের। এত গভীর কথা বলে যে রাগটা আর ধরে রাখা যায় না। এই যে এখন ওমন করে ভালোবাসার বাণী শুনাল, এতে মুনের রাগ কি আর আছে? নেই। ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে, হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। সে স্তব্ধ, পরাস্থ। খানিকক্ষণ চুপ রইল। তারপর আকস্মিক ডুকরে উঠল,
“আপনি আমার হাত ছেড়ে দিয়েছেন।”
সৈকত নরম সুরে বলল,
” মা তোমাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি সত্য গোপন রেখেছো বলেই মা একটু অসন্তোষ হয়েছেন। এই জন্য একটু ভয় দেখিয়েছেন। মা মজা করতেছেন জেনেই ছেড়েছিলাম। তোমাকে কতবার ইশারায় বলার চেষ্টা করেছি, তুমিতো খেয়ালই করলেনা।”
“আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। সবসময় আপনি আমার সাথে এমন করেন। কদিন আগে আমার দম আটকে রেখেছেন, এখনও। আমি আপনাকে ছেড়ে দিব সত্যি সত্যি। ”
সৈকতের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল মুন। ছাড়ার কথা বলে আরও আঁকড়ে ধরল। তা দেখে সৈকতের হাসি বাড়ল। মুনের মাথায় অধর চেপে বলল,
“আচ্ছা, এবার কান্না বন্ধ করো। তোমার শ্বাশুড়ি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। বালা টালা পরিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের সানাই বাজাতে যাচ্ছেন তোমার বাড়িতে। আনন্দে একটু হাসো।”
মুনের কান্না বন্ধ হলো। তবে মাথা উঠাল না। অভিমানে মন ঘিরেছে। সেই অভিমানের সাথেই বলল,
” আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”
” তাহলে কি লিভ-ইন?”
সৈকতের কথায় মুনের অভিমান পালাল যেন। সে তড়িৎ মাথা উঠাল। মুখ কুঁচকে বলল,
” আসতাগফিরুল্লাহ! ”
সৈকতের মুখে দুষ্টুমির লেশ। আকস্মিক সে গম্ভীর হয়ে বলল,
” আমরা বরং ছোটো করর বিয়ে করে ফেলি? তুমি লিভ ইনের প্ল্যানটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল, প্লিজ!”
সৈকত ভারি সিরিয়াস যেন। মুন চটে গেল। সৈকতের বাঁ হাতে এলোপাতাড়ি কিল বসিয়ে বলল,
” আমি বলেছি, আমার এমন প্ল্যান আছে? সবসময় বাজে কথা।”
সৈকত শব্দ করে হেসে ফেলল। চঞ্চল স্বরে বলল,
” এক অসুস্থ রোগীর গায়ে হাত তুল ছো। তুমি তো ডা কা ত মহিলা!”
মুন রাগী চোখে তাকাল। প্রতিবাদীর সুরে কিছু বলতে গেল, ওমনি সৈকত ওর গাল টেনে বলল,
” ডা কাত হলে ও আমারই তো।”
মুন লজ্জা পেল। লাজুক হাসল। রাগ তাগ সরিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসল। হাতে পরা বালাখানার দিকে চেয়ে রইল। আনমনে বলল,
“আমার সব স্বপ্ন লাগছে।”
ওই হাতটা ধরে সৈকত বলল, “স্বপ্ন না সত্যি। তুমি সত্যিই আমার বউ হতে যাচ্ছো। আমার বউ!”
কথা বলে নিজেই হাসল সৈকত। ‘আমার বউ’ কথাটা আলোড়িত করল মুনকে। লজ্জায় গাল লাল হলো। ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি। হঠাৎ প্রশ্নবিদ্ধ মনে বলল,
” কিন্তু বাবা ?”
মুনের স্বরে আতঙ্ক। যার অর্থ এখন বেকার অবস্থায় সৈকতকে কি মানবে বাবা? সৈকত অভয় দিল,
” মা পারলে আজই বিয়ে সেরে ফেলেন। কিন্তু বিয়ে যেহেতু দুই পরিবারের সম্মতিতে হবে, তাই শুধু মায়ের কথায় হবে না। সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। বাইরে নাহিদ অন্তর সিফাত মিলে মাকে বুঝাচ্ছে। ওরা মাকে মানিয়ে নিবে। বিসিএসের আগে প্রস্তাব যাবে না। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেই যাব তোমার হাত চাইতে। ততদিন অপেক্ষা করো।”
মুন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এখন গেলে নিশ্চিত বাবা সৈকতকে রিজেক্ট করতো। যাক, বিসিএসের পরে যাওয়ায় যথাযথ হবে। মুন সৈকতের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হাসল। সৈকত আফসোসের সুরে বলল,
” কবে যে বিসিএস হবে আর তুমি আমার বউ হয়ে ঘরে উঠবে? এত অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না।”
সৈকতের আফসোস মাখা মুখপানে চেয়ে রইল মুন। মুগ্ধচোখে। মনের কোণে সুখপাখিরা ডানা মেলে উড়ছে। কী যে ভালো লাগছে ওর! এই মানুষটা ওর হবে? ওর জীবনসঙ্গী, ওর স্বামী! একসাথে থাকবে ওরা, যখন খুশি তখন দেখতে পারবে। বাবা ভাইয়ের ভয় থাকবে না। ভাবতেই খুশিতে মনটা ভরে গেল। মুনের মন চঞ্চল হলো। সৈকতের মতো আফসোস ওর ও হলো,
“বিসিএস হতে কত দেরি? সময়টা আসে না কেন তাড়াতাড়ি। ”
চলবে….
#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-৩৩)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
বহুপ্রতীক্ষিত দিন অবশেষে। আজ ফলাফল প্রকাশ হবে। চিন্তায় কপালের ভাঁজ মুনের। সকাল থেকে উদগ্রীব হয়ে আছে, কী হবে না হবে। প্রেমিক, ভাই দুজনের ফলাফলের উপর নির্ভর করছে তার আর সেঁজুতির কনে হবার স্বপ্ন। উৎকন্ঠায় ক্লাসে ও মন বসেনি। দুটো ক্লাস করে বেরিয়ে গেছে। মানুষগুলোর কী অবস্থা কে জানে। ফলাফলের চিন্তায় রুবাব অফিস অবধি যায়নি। নাহিদ অন্তর ও ছুটি নিয়েছে। কেবল সৈকতই ছুটি পায়নি। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে অফিসে ছুটেছে সকালবেলা।
রিটেনের পর অখন্ড অবসরে চার বন্ধই চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে। রুবাব বাবার অফিসে বসেছে। অন্তর ব্যাংকে, নাহিদ সৈকই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। এখনো সৈকত, নাহিদ অন্তর ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে। সদস্যপদ না থাকলেও সপ্তাহে পাঁচদিন রুবাব থাকে বন্ধুদের সাথে। এলে আর যাবার খেয়াল হয়না। চারবন্ধু হাসি আড্ডায় সময় কাটায়। আজও রুবাব আছে বন্ধুদের ফ্ল্যাটে। মুন নিশ্চিত আগামী দু’দিন ভাই শেখবাড়ি মুখো হবে না।
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’জন মানুষের বিশেষ দিনটায় পাশে থাকবার মনস্থির করল মুন। আজ টেনশনে নিশ্চয়ই রান্নাবান্না করেনি কেউ। বলা বাহুল্য, ব্যাচলর বাসায় বুয়া পাওয়া যায়নি। রান্নাটা নাহিদ আর সৈকত মিলে করে। অন্তরের কাজ কেবল খাওয়া। মুন ভাবল সবার জন্য লাঞ্চ নিয়ে যাবে। ভাবনামাফিক সবার জন্য লাঞ্চ নিয়ে গেল বাসায়। দরজা খুলল নাহিদ। হেসে বলল,
“আরে ভাবি যে! আসুন আসুন!”
আজকাল নাহিদ মজা করে ওকে ভাবি ডাকছে। মুন ও মজা করে বলল,
” তা আপনার ভাই কোথায়?”
” আমার ভাই অফিসে, আপনার ভাই ড্রয়িং এ।” ঠাট্টার হাসি দিল নাহিদ। মুন ওর হাতে লাঞ্চের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ভাইয়ের কাছে এগুলো। সে ধারণা করল, গিয়ে দেখবে দুজন মানুষ ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে। কিন্তু তার ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দৃশ্যপট বাহুমূলে বদলে এলো সামনে। রুবাব কোকের বোতল হাতে বসা। সামনে টিভিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা চলছে। দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ। টিভির দিকে তাকিয়ে হাসছে। খানিক পরপর আনন্দ চিৎকার দিয়ে উঠছে। চিন্তার লেশমাত্র নেই। শুধু সে একা নয়, তার সাথে অন্তর ও আছে। দুজন মহা আনন্দে খেলা দেখছে। চোখমুখে উৎফুল্লতা। এদের দেখে কে বলবে, আজ এদের রিটেন রেজাল্ট দিবে। মুন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কী ভেবেছে কী হয়েছে!
ভাইয়ের সাথে কথা হলো। কথায় চিন্তার লেশ অবধি নেই। কী উৎফুল্ল! মুন দ্বিধায় পড়ে গেল। আজ সত্যিই এদের রেজাল্ট দিবে! খানিক বাদে নাহিদ ও এসে যোগ দিল।
বিস্ময়ের পারত বাড়ল কিছুক্ষণ বাদেই। কলিংবেল বাজল। বাকিরা খেলায় মেতে থাকায় মুন দরজা খুলল। দরজা খুলে আড়ালেই দাঁড়াল। ওকে না দেখেই দু’হাতে খাবার ভর্তি প্যাকেট সমেত ভেতরে ঢুকে আগন্তুক বলল,
” ভাবছিলাম ছুটি নিব না, কিন্তু ম্যাচ যেভাবে জমে উঠেছে, অফিসে থাকতে পারলাম না। বসকে কোনমতে ম্যানেজ করে ছুটি নিছি। পিৎজা নিয়ে আসছি। খেলা দেখা জমবে। ”
ভারি চঞ্চল গলায় বলে গেল আগন্তুক। মুন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল সামনের মানুষটার দিকে। অস্ফুটে বলল,
“তুমিও!”
দরজার দিকে খেয়াল না করে খাবার নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল যুবক। আকস্মিক নারী কন্ঠ শুনে থেমে গেল। তড়িৎ পিছু ফিরল। প্রিয় নারীর মুখখানা দেখে বিস্ময় নিয়ে চাইল এক পল। পরক্ষণেই চমৎকার হাসল,
” আমার ঘরে এই ভরদুপুরে চাঁদ নেমেছে! হোয়াট আ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ!”
মুন সুক্ষ্ম চোখে পরখ করল মানুষটাকে। তার চেহারায় ও বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। কেবল খেলা দেখার উৎকন্ঠার ছড়াছড়ি। অথচ সে এই মানুষটাকে সাহস দিবে বলে ছুটে এসেছে। মুন আশা করেছিল, ভাইমহল না হলেও প্রেমিকমশাইয়ের কপালে অন্তত চিন্তার ভাঁজ দেখবে। সান্ত্বনা, সাহস দেয়ার সুযোগ মিলবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সান্ত্বনা নিজেকেই দিতে হবে। মুন অবাক হয়ে বলল,
” তোমারও চিন্তা হচ্ছে না, সৈকত!”
সৈকতকে এবার সত্যিই চিন্তিত দেখাল, ” আজকের ম্যাচ হারলে সুপার ফোরে যেতে পারবে না। চিন্তা তো হচ্ছেই। ”
মুন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। দরজা অবধি বন্ধ করতে ভুলে গেছে এদের কান্ড দেখে। সৈকত এগিয়ে এসে দরজা লক করল। মুনের কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
” কী নিয়ে এত চিন্তা করছো? কোন সমস্যা হয়েছে চন্দ্রকথা? আমাকে বলো।”
মুন বলল না। রাগ রাগ চোখে তাকাল। দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।
হনহন করে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগল মুন। হাতের প্যাকেট ফেলে দৌড়ে পিছু নিল সৈকত। পিছন থেকে আটকাবার জোর চেষ্টা,
” কেন রেগে আছো বলবে তো? দাঁড়াও চন্দ্রকথা। ”
মুনের অসন্তোষ মনে থামার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সৈকত এক প্রকার লাফ দিয়ে দিয়ে সিড়ি টপকে এসে পথ আটকে দাঁড়াল মুনের সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“এভাবে চলে যাচ্ছো কেন?”
মুন অগ্নিরূপ ধারণ করে জবাব দিল, ” তো কী করব? তোমাদের রেজাল্টের চিন্তায় ক্লাস করতে পারিনি। ভেবেছিলাম তোমরা খুব টেনশনড আছো। রান্নাবান্না হবে না। লাঞ্চ নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এসে দেখি চিন্তার বালাই নেই সবাই মিলে চিল করে বেড়াচ্ছ। মানুষ এতটা দায়সারা কিভাবে হয়?”
মাঝে বছর পেরিয়েছে। বদলেছে অনেক কিছু। সৈকত-মুনের সম্পর্কের বয়স বেড়েছে, ভালোবাসা বেড়েছে। আপনি থেকে তুমি তে নেমেছে। মুনের রাগ বেড়েছে, সৈকতের যত্ন বেড়েছে। মুনের কথা শুনে সৈকতের কপালের ভাঁজ মিলে গেল। আকস্মিক হেসে ফেলল সে।
“এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে কেউ রাগ করে বাসা ছাড়ে! আমাকে ভয় লাগিয়ে দিয়েছো।”
“তোমাদের বিসিএসের উপর আমার আর সেঁজুতিপুর ফিউচার নির্ভর করছে, তা জেনেও বলছো এটা সামান্য ব্যাপার! বাবা ইদানীং আমার বিয়ের কথা ভাবছেন। তোমার বিসিএস না হলে ভাইয়াও আটকাবে না। বাবার কথাতেই সায় দিবে। আমাকে বাবার পছন্দের পাত্রকেই বিয়ে করতে হবে। ভাবলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, আর তুমি…..!”
আবেগী মুনের আবেগ উপচে পড়ল ফের। চোখ জল এসে ভীড়ল। সৈকত সেই গম্ভীরমুখে বলল,
” তুমি অযথাই চিন্তা করছো চন্দ্রকথা। তোমার বিয়ের বর সৈকত ছাড়া কেউ হবে না। ”
“আমি কিন্তু পালিয়ে বিয়ে করব না।” দৃঢ় স্বরে বলল মুন। সৈকত হেসে বলল,
” পালিয়ে বিয়ে করে ভীতুরা। আমি বীর। শ’মানুষ নিয়ে তোমার বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসব তোমায়। ”
” এত সোজা!”
“রুবাবের সাথে কথা হয়েছে। বিসিএস না হলে দুজন একসাথে বিয়ে করব। আমাদের যে জব আছে তাতেই এনাফ। আমি নেক্সট মান্থে প্রমোশন পাব। সেলারি, পদ দুটোই বাড়ব। রুবাব আংকেলের ব্যবসা শক্তপোক্তভাবে রপ্ত করে ফেলেছে। অভিভাবক মেনে যাবে। ওর শালাকে মানানোর দায়িত্ব আমার আর আমার শ্বশুরকে মানানোর দায়িত্ব ওর। ”
সৈকত চঞ্চল মনে শোনাল তার ব্যাক-আপ প্ল্যান। মুন ওদের ব্যাক-আপ প্ল্যান দেখে অবাক। এরা তো আগে ব্যাক আপ নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছে। মুন অতীত ভেবে ক্ষিপ্ত হলো,
” এতটা কষ্ট করে বিসিএস দিয়ে এখন ব্যাক আপের আশা করছো! আশ্চর্য! আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি। ”
সৈকত দুষ্টু হাসল, ” কী আশা করেছো তবে!”
ওর চোখমুখ দেখে দুষ্ট মনোভাব ধরতে পারল মুন। থতমত খেয়ে বলল, “আমি ক্যারিয়ারের কথা বলেছি। এই বিসিএসের পেছনে কেমন শ্রম দিয়েছো মনে নেই তোমার? এখন এত দায়সারা বিহেভ করছো কিভাবে? তোমার কী একটুও চিন্তা হচ্ছে না? আজ তোমার রিটেন রেজাল্ট দিবে।”
সৈকতকে সিরিয়াস হতে দেখা গেল না এইক্ষণেও। উৎফুল্ল হয়ে বলল, ” আমার ভীষণ চিন্তা হয়। চিন্তায় রাতে ঘুম আসেনা। চোখ বুজলেই তোমার চেহারা চোখে ভাসে। মনে পড়ে একটা মেয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য অধৈর্য হয়ে বসে আছে। বিসিএস হলেই তাকে ঘরে তুলতে হবে, ভালোবাসতে হবে, বছর বছর নতুন অতিথি আনতে হবে। কত দায়িত্ব ! এত দায়িত্ব নিয়ে ঘুম আসে!”
মুন এক মুহুর্তের জন্য আড়ষ্ট হলো, পরক্ষণেই কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“সৈকত! ”
সৈকত ও হেসে ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল, “চন্দ্রকথা!”
মুন রেগে ঝড়ের বেগে নেমে গেল। বেচারি এসেছিল সাহস দিতে, হতাশ হয়ে নিজের সাহস হারিয়ে বাড়ি ফিরছে। নিচে নেমেই রিক্সা নিল। সৈকতকে ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকে আসতে দেখা গেল। মুন চট করে রিক্সায় চড়ে চালককে তাড়া দিল,
“রিক্সা টানেন মামা।”
রিক্সা চলতে শুরু করল কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। একপ্রকার লাফ দিয়ে চলন্ত রিক্সায় উঠে পড়ল সৈকত। মুন থ বনে গেল। পরক্ষণেই সৈকতের হাত চেপে ধরে হকচকিয়ে বলল,
“করছো কী! এক্সিডেন্ট হবে তো।”
মুন সর্বশক্তি দিয়ে সৈকতের হাত চেপে ধরে রাখল, যাতে পড়ে না যায়। মুখখানা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে আছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর ভয় দেখে প্রাণবন্ত হাসল সৈকত। কান থেকে ফোন সরিয়ে বলল,
“রাগ করলে এত ভালোবাসা দেখাতে হয়না। তুমি এখনো ঠিকঠাক রাগ করতে শিখোনি। ট্রেনিং নেয়া উচিত। ”
মুন যেন বাস্তবে ফিরল। ঝট করে হাত ছেড়ে দিতে চাইল। সৈকত ছাড়ল না। বরং শক্ত করে ধরে রাখল। মুন রেগে তাকাল।
সৈকত ফোন কানে দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমার সাথে আছে। বেচারি সাহস দিতে এসেছিল । তোদের অবস্থা দেখে হতাশ। শা লা একটু চিন্তিত হতে পারলি না? তোদের ভাইমহলের কারণে আমি তোপের মুখে পড়েছি।”
মুন আন্দাজ করল ফোনটা রুবাবের। দুই নাটেরগুরু। রুবাব কী বলছে শোনা যাচ্ছে না। সৈকত বলল,
” বিয়ের চিন্তায় বেচারিমহল শ্যাষ হইয়্যা যাইতেছে। তুই আর আংকেল না কি ওরে বিয়ে দিয়ে দিবি। রুবাব আমি তোরে আগেই বলে দিচ্ছি, এমন কিছু যদি করিস তবে আমি তোর বোনকে তু লে নিয়ে বিয়ে করব, তারপর সাদাত ভাইয়ের সাথে হাত মিলাব। এবার ম ল পুকুরে ডুবাব তোরে। ”
অপাশ থেকে রুবাব কী বলল কে জানে, দুজন একসাথে হেসে উঠল। রাগে গা রি রি করল মুনের। সৈকতের কানে এয়ারপডস। মুক্ত হাতে একটা চিনিয়ে কানে নিল। ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
” খুব মজা লাগছে না তোমাদের? কোনদিন যে আমি আর সেঁজুতিপু মিলে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনশন করে বসি। ”
বোনের উপস্থিতি টের পেয়ে হাসল রুবাব। নরম সুরে বলল,
“কী হয়েছে আমার বোনটার? এত রাগ কেন? ভাইয়াকে বল? সৈকত কিছু বলেছে? এখনো সময় আছে, তুই বল সৈকতকে বিয়ে করবি না। আমি অন্য পাত্র দেখব। গতকালই বাবার কাছে একটা সমন্ধ এসেছে, ইউকের সিটিজেনশিপ পাওয়া এক পাত্রের। ওখানে অফিসিয়াল জব নিয়ে সেটেল্ড। বিয়ের পর বউ নিয়ে যাবে। দেখতে শুনতে ও বেশ। আমরা কি সমন্ধটা আগাব? তুই শুধু একবার হ্যাঁ বল। বাকিটা ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।”
ভাইয়ের কথা শোনা রাগের বদলে এবার কান্না পেল মুনের। কোথায় ভাই বোনকে সান্ত্বনা দিবে, তা না উলটো ভাই তো সৈকতকে ছেড়ে দিতে বলছে। আবার নতুন পাত্রের সন্ধান দিচ্ছে। মুন রাগ নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই সৈকতের ধমকানো সুর শোনা গেল,
” আমার ফোন দিয়ে আমার পাশে বসা আমার হবু বউরে কুপরামর্শ দিস, কত বড় সাহস তোর! তোরে তো রাস্তায় ফেলে গনধোলাই দেয়া উচিত। তুই আমার বন্ধু না শত্রু! কোথায় বোনরে সান্ত্বনা দিবি, তা না পাশের বাসার আন্টির মতো কূটনামি করছিস! ইউকের পাত্র না? ওই পাত্রের সাথে সেঁজুতিরে বিয়ে দিব, তখন হাতে মেহেদী লাগিয়ে চান্না মেরি আ মেরি গাইতে থাকিস।”
রুবাব কেশে উঠল। তবে দমল না। বলল, “একশ’বার দিব। আমার বোন, আমি যা ইচ্ছে পরামর্শ দিব ওরে। কী করবি তুই?”
সৈকত ও ঝগড়ার ভঙ্গিতে বলল, ” আমার ও বউ, আমি ও যা ইচ্ছে করব। দরকার হলে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলব। খালি একবার বিয়েটা হইতে দে। তারপর তোর সাথে ওর যোগাযোগ বন্ধ করব। তুই আমার বউরে খারাপ বানিয়ে ফেলবি। ওরে নিয়া দূরে চলে যাব, দেখাও পাবি না। তখন তুই কী করবি? ”
দুই বন্ধুর ঝগড়া চলছে। মাঝে মুন হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। বিস্ময়ের পলক অবধি ফেলতে ভুলে গেছে। মুন এদের এহেন ঝগড়ার মুখোমুখি হয়নি আগে। অবাক লাগছে ওর। তবে তার চেয়ে বেশি হাসি পাচ্ছে। ওকে নিয়ে এর ভাই আর প্রেমিক এভাবে ঝগড়া করে! আর সৈকত অনায়েসে ওকে ‘বউ বউ’ বলছে। একটু দ্বিধাও হচ্ছেনা? হোক বন্ধু, কিন্তু সাথে তো প্রেমিকার ভাই ও বটে। সেই বালাই কী করবে না ছেলেটা? তাকে পাশে বসিয়ে তার ভাইয়ের কাছে বউ বউ করছে, অস্বস্তি লাগছে মুনের। মুন ওদের থামাতে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“থামবে তোমরা?”
থেমে গেল দুজন। ওরা বোধহয় ভুলে গেছে মুনের উপস্থিতি। বিব্রতবোধ করল দু’জন। ফোন রাখল। মুন রাগ নিয়ে বলল,
” উনি তোমার বন্ধু হওয়ার সাথে সাথে আমার ভাই ও হয়, আমার ব্যাপারে তার সামনে একটু সংযত থাকতে পারো না? ”
সৈকত ভ্রু বাঁকাল, ” রুবাব তোমার ভাইয়ের আগে আমার বন্ধু। সবসময় বন্ধুই থাকবে। ওসব রাখঢাক আমাদের বন্ধুত্বে ছিল না, থাকবে ও না। তোমাকে নিয়ে তো একদমই না। কদিন বাদে আমার বউ হবে, আমার সব কথায় তুমি আসবেই। চাইলেও আমি নিজেকে সংযত করতে পারব না।”
সৈকতের ঠাট্টার স্বর। হাসি-ঠাট্টা মেশানো কথাগুলি কী চমৎকার! প্রেম এবং বন্ধুত্বকে সে একসাথে মেশায়নি। দুটো আলাদাভাবে গুরুত্ব বহন করে তার জীবনে। সৈকতের সব কথায় মুন আসবে ‘কথাটা ভারি হৃদগ্রাহী লাগল মুনের। হুট করেই রাগ সরে গেল। লাজুকতা হানা দিল। সে একটু খানি হাসল অন্যদিকে চেয়ে। স্বর নরম করে বলল,
” আমার অস্বস্তি লাগে।”
এর স্বর বদল দেখে সৈকত হাসল। কাছঘেঁষে বসে বলল, “সেটা ভাইয়ের বন্ধুর সাথে প্রেম করার আগে ভাবা উচিত ছিল। এখন তোমার আর কোন অপশন নেই। কদিন বাদে আমাদের বিয়ে হবে, তোমার ভাইয়ের সামনে দিয়ে আমার সাথে রুমে যেতে হবে, আমার বাচ্চার মা হতে হবে। এখনই লজ্জা পেলে তখন কী করবে? ”
লজ্জা কমার বদলে বেড়ে গেল মুনের। সৈকতের বাহু খামছে বলল,
“তুমি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছো!”
“বিয়ে করে ফেলো আমায়, সভ্য হয়ে যাব।” প্রসন্ন হাসল সৈকত। মুন সুন্দর করে হাসল,
” বরবেশে শেখ বাড়ি এসো। আমি বিয়ের সাজে অপেক্ষায় বসব।”
” আজ ফলাফল দেখি। ভালোমন্দ এলে আগামী মাসে প্রমোশন হবার পরই মাকে নিয়ে যাব শেখবাড়ি।”
” প্রমোশন নয়, ক্যাডার হয়ে যাবে তুমি। মন্দ হবে না, ভালোই হবে দেখো। এক বছর অপেক্ষা করলে আর কটামাস ও অপেক্ষা করব। তুমি পজেটিভ ভাব।”
মুনের চোয়ালে এক জলন্ত শিখা উজ্জ্বল হয়ে আছে। চোখে সৈকতকে নিয়ে হাজার স্বপ্ন। সৈকত নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে রইল মুনের দিকে। মেয়েটা যে ওকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখছে যদি বিসিএস না হয়! এক চিন্তা ঘিরে ধরল ওকে।
চলবে…..