#ধারাবাহিক গল্প
#অশ্রুজলে লেখা
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী
আজ রাতে রানুর গিটার বাজাতে ইচ্ছে হলো না। তবে মন খারাপ থাকলে গিটার বাজালে ওর মনটা ভালো হয়ে যেতো। কিন্তু আজ এসব কিছুই ভালো লাগছে না। শুধুমাত্র মনটা চাইছে জায়নামাজে বসে আল্লাহপাকের কাছে নিজের কষ্টের সব কথা উগড়ে দিয়ে আপন মনে কাঁদতে। কষ্টের এই ভার বয়ে বেরাতে বেরাতে রানু যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন একমাত্র জায়নামাজে বসে অঝোর ধারায় কাঁদতে পারলে মনটা হালকা হয়ে যায়।
গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর একটা প্রমিন্যান্ট প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে প্রভাসক হিসাবে জয়েন করে। এরপর রানু অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এডিনবরা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি যোগাড় করে নেয়। আসলে আল্লাহপাকের কাছে ওর শোকরিয়ার শেষ নেই। জীবনে ঠকে গিয়ে আল্লাহপাকের কাছে একটাই দোয়া করেছিলো বাবা মায়ের স্বপ্ন যেন ও পূরণ করতে পারে। সেটা করতে পারাতে আজ নিজের জীবনটাকে বোঝা মনে হয় না। শুধু বিয়ে করতে ওর মন চায় না। কিভাবে বিয়ে করবে? ওর শরীর তো নোংরা হয়ে গিয়েছে। ক,জন পুরুষের স্পর্শে আজ নিজের শরীরটাকে নিজের কাছে অশুচি লাগে। যদিও ওর এখানে পরিপূর্ণ দোষ ছিলো না তারপর ও নিজের অযাচিত এই ভুলটাকে ওতো এড়াতে পারে না। ছিঃ সে রাতের কথা মনে হলে আজও মনে হয় এই পৃথিবীতে কি এমন কোনো পানি নাই যেখানে নিজেকে পবিত্র করে নেওয়া যায়? হা নিজেকে পবিত্র করে নেওয়ার একটা উপায় ও আবিস্কার করেছে। সেটা হচ্ছে জায়নামাজে বসে নিজের পাপের অনুশোচনায় কেঁদে কেঁদে আল্লাহপাকের কাছে মাফ চেয়ে নিতে। তখন চোখের পানির অঝোর ধারায় নিজেকে পবিত্র মনে হয়। রানু মনে মনে ভাবে ওর মা কেন ওর বিষয়টা বুঝতে চায় না। বিয়ে করে ও যদি আবার কোনো আঘাত পায় তাহলে হয়তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে। তখন ওর বাবা মায়ের কি অবস্থা হবে। একটা ভুলে তিনটা জীবন নষ্ট হবে। সে জন্য বিয়ে করতে ওর এতো ভয়।
যে যাই বলুক না কেন দাম্পত্য সম্পর্কে তো শারীরিক বিষয় জড়িয়ে আছে। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। এটা মেনে নেওয়া তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। রানু ভাবে যদি বিপরীত পাশে ওর স্বামী যদি এরকম খারাপ জায়গায় আসা যাওয়া করতো তাহলে ওর পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হতো। সেকারনে এই বিষয়টাকে ও স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। কোনো ছেলের পক্ষে ওর অতীতটাকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সে কারনে বিয়ের প্রতি ওর কোনো আগ্রহ জন্মায় না।
তাছাড়া ওর তো এটা নিয়ে আফসোস নেই। বাবা মায়ের সাথে ওতো সুখেই আছে। ও এই সুখটুকু নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। তারপরও ওর অতীত জেনে কোনো পুরুষ যদি ওকে বিয়ে করতে রাজী হয় তাহলে হয়তো ও বিয়ে করতে পারে। তা,না হলে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ওর ইচ্ছে নেই। একটু পরেই ফজরের আযান শোনা যায়। রানু ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। এরপর বারান্দায় বসে ভোরের হাওয়াটুকু গায়ে মাখে। আবারও নিজের অতীত ভাবনায় ডুবে যায়।
প্রতিটি মানুষের কিছু গোপন বিষয় থাকে। রানুর ও আছে।ছোটোবেলা থেকে দেখতে খুব সুশ্রী ছিলো বিধায় পুরুষের চোখে ও সহজেই পড়ে যেতো। রানু তখন ক্লাস সেভেনে এ পড়ে। কেবল বড় হতে শুরু করেছে। তবে পিরিয়ড তখনও শুরু হয়নি। ও জয়নাল নামে এক টিচারের কাছে অংক করতে যেতো। ওর মা ওকে সেই টিচারের কাছে পড়াতে নিয়ে যেতো। স্যার বাসাতেই পড়াতেন। রানুর মায়ের সাথে এতো অমায়িক আর ভদ্রভাবে কথা বলতেন দেখে মনে হতো উনার মতো ভদ্রলোক এই পৃথিবীতে খুব একটা দেখা যাবে না। কিন্তি বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। স্যারের কাছে ওরা চারজন মেয়ে পড়তো। স্যারের কাজ ছিলো অংক করার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েদের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকা। দৃষ্টিটা এতো খারাপ ছিলো মনে হতো উনি যেন জামা ভেদ করে সব দেখে নিচ্ছেন। রানুর দিকে স্যার যখনি তাকাতো ওর শরীরটা গুলিয়ে উঠতো। স্যার আরো একটা কাজ করতেন। বোর্ডে অংক না বুঝিয়ে একদম কাছে এসে গা ঘেঁসে অংক বুঝাতে শুরু করতেন আর মুখ মুখ দিয়ে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়তেন। রানুর খুব অস্বস্তি হতো। পরে একসময় পড়া ছেড়ে দেয়। যদিও ওর মা খুব রেগে গিয়েছিলো। কিন্তু রানু ছোটোবেলা থেকে খুব চাপা স্বভাবের। তাই সত্যিকথাটা মাকে জানাতে পারেনি।
একবার ওর বাবা অফিসের ট্যুরে ঢাকার বাইরে ছিলো। ও তখন ক্লাস এইটে পড়ে। সেদিন বাংলা পরীক্ষা ছিলো। ওর মায়ের শরীরটা ভালো ছিলো না। প্রচন্ড জ্বর ছিলো। রানুকে কে নিয়ে যাবে স্কুলে? এটা নিয়ে ওর মায়ের খুব চিন্তা হচ্ছিলো। তখন ওদের পাড়াতেই ওর এক সহপাঠির বাবা এসে বললো,রানুকে উনি স্কুলে নিয়ে যাবেন। ঐ সহপাঠির নাম ছিলো মায়া। মায়া ন,টার সময় রানুদের বাসায় চলে আসে। রানুও সরল বিশ্বাসে মায়ার সাথে রওয়ানা দেয়। তিনজন একরিকশায় উঠতে পারবে না দেখে মায়ার বাবা একটা সিএনজি নিয়ে নেয়। রানুকে মাঝখানে বসায়। রানুও বসে। স্কুলে যাওয়ার পুরোটা পথ ঐ লোক রানুর শরীরে খারাপভাবে হাত বুলায়। ওর ভীষণ কান্না পায়। কিন্তু কাউকে কোনোদিন বলতে পারেনি। আর শেষ পর্যন্ত ওর একটা ভুলে আস্তাকুৃঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। সেখান থেকে কতো কাঠখড় পুড়িয়ে ওকে জীবন নতুন করে আবার সব শুরু করতে হয়।
—-কিরে তুই এখানে কেন বসে আছিস? আমি তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। তুই রাতে ঘুমাসনি?
মায়ের কথায় ভাবনার জগত থেকে রানু ফিরে আসে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-ঘুমাবো না কেন? তুমি চা খাবে?
—–হুম,চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়েছি। চাপাতা আর দুধ মিশিয়ে চা,টা বানিয়ে নিলেই হবে।
রানু চা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে পিরীচে করে টোস্ট বিস্কিট দিয়ে দিলো। ডোর বেলটা বেজে উঠলো। মনে হয় মিনারা খালা এসেছে। রানু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। মিনারা বেগম সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলো। রানুর মিনারা খালার এই বিষয়টা খুব ভালো লাগে। সবসময় আগে ছালাম দেয়। চা খেয়ে রানু রুমে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। চোখটা কেবল লেগে এসেছে। ফোনটা বেজে উঠলো। রানুর প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো। তারপরও ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গুরুগম্ভীর কন্ঠে একজন বললো,
—-কেমন আছেন?
—-ভালো,কে বলছেন?
—-আহনাফ চৌধুরী,
—-আমি তো আপনাকে চিনি না।
—এখন চেনেন না। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমরা একে অপরকে চিনে নিবো।
একথা বলেই কট করে লাইনটা কেটে দিলো। রানুর প্রচন্ড বিরক্ত অনুভব হলো। বালিশটা সরিয়ে ফোনটা রাখতেই একটা খাম নজরে পড়লো। খামটা খোলা মাত্রই একটা সোম্য চেহারার মানুষের ছবি দেখতে পেলো। মানুষটার মাথার চুল কম তবে চোখ দুটো দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত। একটা বায়োডাটা। সেখানে নামটা লেখা আছে আহনাফ চৌধুরী। ছেলেটা ওরই মতো আরো একটা প্রাইভেট ভার্সিটির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ায়। তবে বাবা মা কেউ নেই। মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। মানুষটার চেহারাটা দেখে ওর বেশ ভালোই লাগছে। মনে মনে ভাবছে ওর সাথে দেখা করাই যায়।
অবশেষে পাত্রপক্ষের আসার দিন চলে আসলো। রানু এই মুহুর্তে ওর বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাত্র। সেই আহনাফ চৌধুরী। না আজ আর ও নিজ থেকে কোনো উল্টা পাল্টা কথা বলেনি। শুধু ছেলেকে বলেছিলো ওর একটা নোংরা অতীত আছে। সেটা শুনে আহনাফ বললো,
— আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নাই। তবে বর্তমান পুরোটাই আমাকে দিয়েন তাতেই চলবে।
রানু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই ও আবার আহনাফকে বললো,
—-সেদিন যদি আমাকে ছেড়ে চলে যান?
—-ছেড়ে যাওয়ার জন্য তো আপনার কাছে আসিনি। আপনাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আমার ভার্সিটিতে। পরীক্ষার সময় আমার ভার্সিটিতে পরীক্ষক হিসাবে এসেছিলেন। প্রথম দেখায় আপনাকে ভালো লেগে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আপনি আমার মামার বন্ধুর মেয়ে। বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মামা বললো,আপনি নাকি বিয়েতে আগ্রহী না। অতঃপর কি আর করবো? কিন্তু আপনাকে ভুলতে পারছিলাম না। অগত্যা আপনার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই তিনমাসে আপনাকে মাত্র তিনদিন দেখেছিলাম। কিন্তু আমার চোখ দুটো বড্ড অবুঝ। ও শুধু সারাক্ষণ আপনাকেই খুঁজে বেড়ায়। অগত্যা মামাকে দিয়ে একরকম জোর করেই প্রস্তাব পাঠালাম। এবার আমি যদি বলি, আপনি আমার এই দুচোখে আমার দুচোখ রাখবেন?
রানু মন্ত্রমুগ্ধের মতো আহনাফের কথাগুলো শুনছিলো। আর অবাক হয়ে ভাবলো,এতো প্রেম ওর ভাগ্যে লেখাছিলো? চোখের দুকোন আদ্র হয়ে উঠলো। কিশোরী বয়সে ঘটে যাওয়া ট্রমা থেকে বেরিয়ে এসে আহনাফের হাত ওর শক্ত করে ধরতে মন চাইছে। রানু আজও একদম সাজেনি। শুধু চোখে কাজল এঁকেছে। আর ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। বুটিক্স এর একটা সুতি শাড়ি পরে নিয়েছে। আঁচলটা আলতো করে মাথার উপর টেনে নিয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে আহনাফ বললো,
—-আপনাকে জুঁই ফুলের মতো স্নিগ্ধ লাগছে। শুধু চোখের কাজল টুকু লেপ্টে গিয়েছে। আমার কাছে টিস্যু আছে। যদি অনুমতি দেন তাহলে মুছে দিতে পারি।
রানু মুচকি হেসে বললো,
—-আপাতত চোখে চোখ রাখার অনুমতিটুকু দিলাম। চলেন নীচে যাই। সবাই অপেক্ষা করছে।
সমাপ্ত।