#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০৭
হিমের মুখে নিজের নামের বি*ভৎস রকমের বিকৃতি শুনে সাত বছরের বাচ্চা ছেলেটা ঠোঁট ভেঙে কান্না করে দেয়। একটু মজা করায় বাচ্চাটা এভাবে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেঁদে দিবে সেটা ভাবতে পারেনি হিম। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, চোখের সামনে এমন পরিস্থিতি দেখলে যে কারোর ই মনে হতে পারে যে হিম বোধহয় বাচ্চাটা কে জোর করে কিড*ন্যাপ করতে চাচ্ছে।
আর কোনো উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে হিম বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়ায়। জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বাচ্চাটাকে আদর করতে করতে বলে,
– আমার দু*ষ্ট ইদুর ছানা, জোরে জোরে কেঁদে আমাকে বি*পদে ফেলিস না বাপ। পাবলিক ক্ষে*পলে আজ কপালে গণধো*লাই আছে, বাসর রাতে খাট ভাঙার বয়সে আমি হাত পা ভেঙে প*ঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই না।
বাবলু কান্না থামিয়ে নাক টানতে টানতে বলে,
– আপনে আমারে গা*লি দিসেন, আর আমি কাদমু না? গা*লি খাইলে আমার ক*ষ্ট লাগে না বুঝি। আমি ছোট বাচ্চা মানুষ , কষ্ট পাইলে আমি কাদাম ই তো , আরও বেশি করে কাদমু।
এই বলে বাবলু আবারও কান্না শুরু করলে হিম তাকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
– আরে বাপ, থাম থাম আর কাঁদিস না। আমি আর কখনো তোকে বা*ল বুলু বলে ডাকব না, মা*ফ চাই, এখন সাউন্ড বক্স টা দয়া করে বন্ধ কর।
বাবলু চোখ মুছতে মুছতে বলে,
– আমাকে নিচে নামান।
হিম বাচ্চাটাকে নিচে নামালে সে তার ঝুড়ি থেকে বিশটা গোলাপ হিমের হতে দিয়ে বলে,
– দুইশো টাকা বাইর করেন।
হিম অবাক চোখে তাকায় তার দিকে।
– বিশ টা কেনো? আমি তো দশটা চেয়েছি।
– বিশটা না নিলে আমি কিন্তু আবার কান্না শুরু করমু। আর এবার শুরু করলে আপনারে গনধো*লাই না খাওয়াইয়া থামবো না।
বাবলুর কথা শুনে হিমের চোখ ছোট হয়ে আসে। গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ সে বাচ্চাটাকে পর্যবেক্ষণ করে। এতজীবন হিম সবাইকে ঘোল খাইয়েছে, আর আজ কিনা এক সামান্য মিনি ফুল বিক্রেতার কাছে সে হেরে গেলো। ভাগ্যিস এখানে তার পরিচিত কেও নেই, তানাহলে আজ আর মান সম্মান কিছুই অবশিষ্ট থাকত না।
– তার মানে তুই এসব নাটক করেছিস, আমার কাছে তোর বাসী পঁ*চা ফুলগুলো বিক্রি করার জন্য। এত ছোট বয়সেই বিজনেস পলিসি শিখে গেছিস, যেটা আমার শিখতে কিনা ছাব্বিশ বছরের লেগেছে। 🙂🙂
– আজকালকার দিনে এসব পলিসি একটু আধটু না শিখলে হয় না সাহেব। আপনেরা গেঞ্জি তো কি? আমরাও আলফা, আপনাদের দুই কাঠি উপুর দিয়ে যায়। তাই পরের বার থেইক্কা পিছনে লাগার সময় বয়সটা দেইখ্যা লয়েন। কেমন?
এই বলে বাবলু একটা ফোকলা হাসি দেয়। হিম কপাল কুঁচকে ওয়ালেট থেকে দুইশো টাকার একটা নোট ছেলেটার হাতে ধরিয়ে তাকে বিদায় করে। হাতে বিশটা ফুলের গুচ্ছ নিয়ে বাইকে উঠে পুনরায় জ্যামে বসে থাকে।
– সব দোষ ওই ছে*মরির, ওর জন্যই আজকে আমার পকেট থেকে কড়কড়ে দুইশো টাকার নোটটা হলে গেলো। না আমি ওকে ছাড়বো না। এই দুইশো টাকা তো উশুল করেই ছাড়বো। হিম দেখেছো, হিমের ডিম দেখনি। যেদিন হিমের ডিম থেরাপি খাবে , সেদিন বুঝবে হিম কি জিনিস। 😎😎
_________________________________________
হিম বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই মিনা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে হিম কে জাপটে ধরে। ঘটনাটা এতটাই দ্রুত ঘটে যে হিম কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিনা নিজের সাথে হিমের শরীর মিশিয়ে নেয়। কিন্তু পরক্ষণেই হিম নিজের সর্বশক্তি দিয়ে মিনা না নিজের থেকে আলাদা করে।
হিমের রু*ক্ষ স্পর্শে মিনার হাতের কয়েকটা জায়গায় নখের আঁচ*ড় পড়ে। হাতে কিছুটা জ্বা*লা অনুভব করলে মিনা কাঁদো কাঁদো চোখে হিমের দিকে তাকায়। হিম তখন নিজে শরীর ঝাড়তে ব্যস্ত, যেনো মিনার স্পর্শে তার গা ভয়াবহ ভাবে নোং*রা হয়ে গেছে।
– What nonsense মিনা, তোকে না বলেছি আমাকে যখন তখন জড়িয়ে ধরবি না, জ*ঘন্য লাগে আমার এসব।
– তুমি আমাকে মার*লে? জানো কত ব্য*থা পেয়েছি, তুমি তো আমার দিকে –
– তোর ন্যাকা*মি বন্ধ কর, গা জ্ব*লে আমার তোর ন্যাকা*মি দেখলে। সামনে থেকে সরে দাঁড়া।
হিমের ধমকা*নিতে মিনার গা শিউরে উঠে, হালকা কাঁপু*নি ও ধরে তার শী*র্ণ গায়ে। মাথা নিচু করে সরে দাঁড়ালে হিম দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে যায়। মিনা একবার জলে ভিজা চোখে হিমের দিকে তাকায়। ছেলেটাকে বড্ড সুদর্শন লাগে তার কাছে, কিন্তু কখনোই সে হিমের কাছে পাত্তা পায় না। কাছে যেতে নিলেই হিম যেনো সহস্তে তাকে নিজের থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ছেড়ে দিয়ে আসে।
_______________________________________
প্রায় এক ঘন্টা ধরে বাথটাবের বরফ পানির মধ্যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে শীতল। আর তার সামনে স্টিলের স্কেল হাতে সাদাত তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। মাঝেমধ্যে শরীর অবশ হয়ে গেলে শীতল আরেক পা নামাতেই স্টিলের স্কেলের বাড়ি পড়ছে তার গায়ে। এতে শারীরিক ভাবে যে শীতল আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে, তাতে সাদাতের কোনো খেয়াল নেই। তী*ব্র রাগ আর হিং*সা যেনো তার বিবেককে গ্রা*স করে ফেলেছে। শীতলের ক্লান্ত মুখের দিকে চেয়ে মনটা সামান্য নরম হলে পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় শীতল এর পরপুরু*ষের দিকে তাকানোর মতো সাঙ্ঘা*তিক অপরা*ধের দৃশ্য। মুহুর্তের মধ্যেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সাদাতের। সে ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের দিকে তাকানোর অধিকার নেই শীতলের চোখ জোড়ার, হোক সে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু হিম। হিমের জন্য সে তার জীবন দিতে পারবে, কিন্তু শীতল নামের তার একমাত্র ভালবাসা কে নয়।
শীতলের চোখ বন্ধ হয়ে আসে ক্লান্তিতে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। শীতল বাধ্য হয়ে পা নামিয়ে দাঁড়ায়, এতে তার দিকে সাদাতের হাত উঠলে শীতল দ্রুত সাদাতের হাত চেপে ধরে। এরপর রক্তি*ম চোখে তাকায় তার দিকে। এতে সাদাত তার থেকে ডু পা পিছিয়ে যায়। সে বিশ্বাস করতে পারছে না তার খাঁচার বন্দি পাখি আজ তার দিকে চোখ রাঙিয়েছে।
– খুব সাহস বেড়েছে তোর, এই সাহস বাড়ার কারণ নিশ্চই হিম। ল*জ্জা লাগলো তোর, আমার বন্ধুর দিকে কু*নজর দিতে। ওপর মধ্যে এমন কি আছে যেটা আমার মধ্যে নেই, কি এমন সুখ পেয়েছিস ওর কাছ থেকে যেটা আমি তোকে দিতে ব্য*র্থ।
শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সাদাতের বলা কথা গুলো মি*থ্যা নয়, খুব অল্প দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে তার সাথে হিমের, কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যেই হিম যেনো তার মনের এক বিশাল জায়গা দখল করে নিয়েছে, যেটা সাদাত বহু বছরের চেষ্টার পরও পারেনি, উল্টো নিজের নাম লিখিয়েছে শীতলের ঘৃ*ণ্য ব্যক্তিদের খাতায়।
– আপনার বন্ধু আপনার মত নিচু মানসিকতার নয় অন্ততপক্ষে, মেয়েদের সম্মান করতে সে জানে, আপনার মত যখন তখন আমার ওপর অধিকার ফলায় না।
শীতলের কথা গুলো মনে মাঝেই চাপা পড়ে, বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পায় না। সাদাত শীতলের কাছে এসে তার মুখ চেপে ধরে।
– ডানা গজিয়েছে তাই না? হিমের সাথে থাকলে আমার থেকে দূরে থাকতে পারবি, এই চিন্তা মাথায় ঢুকেছে তোর। আচ্ছা, দুদিন পরে হিম চলে গেলে তখন তোর ডানা ছাটার ব্যবস্থা করবো, ছোট বলে কিছু করিনি, কিন্তু আমার বুঝতে ভুল হয়ে গেছে। তোকে এখনি না সামলাতে পারলে সারাজীবনের মতো তোকে হারাতে হবে আমায়। শীতল কান খুলে শুনে রাখ, তোর জন্ম হয়েছে আমার জন্য। যতই বিষা*ক্ত লাগুক, তুই শুধুই আমার।
_______________________________________
– ছেম*রি ছে*মরি ডাক পারি,
ছেম*রি গেছে শ্বশুরবাড়ি,
ওই ছেম*রি তুই জলদি আয়,
তোর লাগি হিমের পড়ান যায়।
কবিতার মতো চারটা লাইন গাইতে গাইতে হিম এদিক ওদিক শীতল কে খুজতে থাকে। ধারণকৃত সকল জায়গায় খুঁজলেও হিম শীতল এর দেখা পায় না। এতে হিম খানিক বিরক্ত হয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। সে হাতে করে শীতলের জন্য আনা গোলাপ গুলো নিয়ে এসেছিল। কিন্তু যত জন্য এনেছে গোলাপ গুলো তারই তো দেখা নেই।
– নবাবজাদী আমার,তার ইচ্ছে হলে আমার সাথে দেখা করেন, না ইচ্ছে হলে কুঠুরিতে গিয়ে লুকিয়ে পড়েন। এখন কোথায় পাই তাকে? ধুর আজ রাতেও ঘুম হবে না।
হিম নিজের রুমের সামনে এলে সে স্পষ্ট কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। শব্দটা যেনো তার পাশের রুম থেকে আসছে। হিম প্রথমে না যেতে চাইলেও পরে কি একটা মনে হয় সে পাশের রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলে সে তার বরফ কন্যাকে মেঝেতে বসে কান্নারত অবস্থায় দেখতে পায়। শীতলের কোমর সমান চুলগুলো খুলে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। হালকা বাতাসে চুলগুলো নড়ছে, বড়ই মায়াবী লাগছে তাকে। তার এই রূপ যেকোনো পা*ষাণ হৃদয়ের পুরুষকে বিগলিত করতেও এক মুহুর্ত সময় লাগবে না।
হিম কিছু মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে শীতলের দিকে পা বাড়ায়। তার কাছে গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তারপর হালকা করে মাথায় হাত রেখে তাকে ডাক দেয়,
– বরফ কন্যা, কি হয়েছে তোমার? কাদছ কেনো? তোমার চোখে পানি ভীষণই বেমানান। কেঁদো না কেমন?
ধীর স্থির ঠান্ডা পরিচিত কন্ঠ কানে এলে শীতল মাথা তুলে তাকায়। হিম কে দেখতেই তার অশান্ত মনে যেনো এক ঠান্ডা বাতাস বইয়ে যায়। সাথে সাথেই শীতলের কান্না বন্ধ হয়ে যায়। তবুও কিছু পানি চোখের কোনে জমা ছিল যা, হিম নিজের হাতে মুছে দেয়।
– আজকে তোমার জন্য এই গোলাপ নিয়ে এসেছি, গোলাপ গুলো যদিও তোমার মত সুন্দর না তবে তোমার স্পর্শে তাদের সৌন্দর্য আরো দশ গুন বৃদ্ধি পাবে। কেঁদো না, কাদলে তোমায় বিচ্ছি*রি দেখায়।
এই বলে হিম একটা গোলাপ শীতলের কানে গুজে দেয়। হাস্যোজ্বল মুখে সে শীতলের দিকে চেয়ে বলে,
– যেমন ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে। তবে ফুলের চেয়েও তোমাকে বেশি পবিত্র লাগছে।
শীতল এক মোহ লাগা চোখে তাঁকিয়ে আছে হিমের দিকে। এই প্রশান্ত সে আগে কখনো অনুভব করেনি, কেও এতটা যত্ন করে তাকে সাজায় নি। বারবার সে হিমের গভীর দৃষ্টিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। একসময় শারীরিক মানসিক দুর্বলতা শীতল কে এতটাই দুর্বল করে দেয় যে সে ঘোরের মাঝেই হিম কে জড়িয়ে ধরে।
চলবে……………………