#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_এগারো
ফ্যাক্টারী থেকে বেরিয়ে সৃজিতাকে ফোন করল নির্ঝর। বাড়ি ফেরার মোটামুটি সময় জানিয়ে দিল। ঐ প্রান্ত থেকে দেরির কারণ জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিলনা। শুধু বলল গিয়ে বলছি..
বিষয়টাকে বেশি পাত্তা না দিয়ে ডিম আর ময়দা ফেটাতে থাকল সৃজিতা। পিঁয়াজ, বাঁধাকপি কুচি, গাজর কুঁচি মিশ্রণ করে ছিলা বানাবে। কাজ থেকে ফিরে এটা খেতে ভালোবাসে নির্ঝর।বিয়ের আগে কখনো রান্নাঘরে পা রাখেনি।বিয়ের পর যেন প্রশান্ত সাগরে পড়েছে।পাঁচফোড়ন চেনা দূরে থাক, সরষের তেল ও রিফাইন তেলের পার্থক্য অব্দি বুঝতনা। গোটা জিরে ও মৌরির তফাৎ বোঝার জন্য সৃজিতাকে চেখে নিশ্চিত হতে হয়। বিয়ের পর রান্না নিয়ে ভয়ানক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অসুস্থ শরীর নিয়েই নির্ঝরের মা হাতে ধরে রান্না শেখাত। মুখে বলে বলে দিত। তার উদ্যোগে অকাট মূর্খ থেকে সামান্য স্বাক্ষর হয়েছে। এখন রান্নার পরীক্ষায় পাস নম্বর উঠে যায়। তারপর ইউটিউব তো আছেই..
মিনিট পনেরো পর হাসি মুখে ঘরে ঢুকল নির্ঝর। সৃজিতাকে দেখে ওষ্ঠ আরো প্রসারিত হল।
-শুনবে আমার কেন দেরি হল?
-সব শুনব, আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি চায়ের জল বসাচ্ছি।
-ও সৃজি, ও সব পরে হবে। এখন এখানে এসে বসো তো..
-কী হয়েছে বলো তো?
-আসার সময় স্যার কেবিনে ডেকেছিল। আজ উনি আমাদের বাড়ি আসবেন।
-বাহ! দারুণ ব্যপার..কখন আসবে?
সৃজিতার কন্ঠে মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেল না। অবাক হল নির্ঝর। ফ্যাক্টারীর মালিক আসবে তাও কোনো বাড়তি উত্তেজনা নেই?
-কী গো..কী ভাবছ? কখন আসবে বলো..
-আসবে, মানে সাড়ে সাতটার দিকে..
-ও..ঘর গুলো একটু গুছিয়ে রাখি। হাতে সময় বেশি নেই..
-ওনার আসার খবরে তুমি অবাক হও নি?
-অবাক কেন হব? উনি আমাদের ভালোবাসেন তাই আসছেন। যাও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হও।
সোফা থেকে উঠে রান্নাঘরে গেল সৃজিতা।
ধনীর দুলালী সৃজিতার শরীরে হৈমপ্রভার রক্ত বইছে। সমকক্ষ তীর্থঙ্করের বাড়ি আসাটা ওর কাছে স্বাভাবিক একটা বিষয়। যেটা বোঝা নির্ঝরের সাধ্য নয়।
-তোমার সঙ্গে উনি কথা বলবেন..আজ উনি এখানে ডিনার করবেন?
-কী!? আমি কী রান্না করে খাওয়াবো?
এবার অতল জলে পড়ল সৃজিতা। মুচকি হাসল নির্ঝর। তীর্থঙ্করের আগমনের হেতু না হোক, নৈশভোজের কারণে সৃজিতার মনে দুশ্চিন্তা দানা বেঁধেছে।এই উত্তেজনা স্ত্রীর চোখে মুখে দেখতে চেয়েছিল। স্ত্রী চিন্তা করবে, উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করবে। ঠিক তখুনি আশ্বস্ত করে বলবে, চিন্তা কী, আমি আছি। সব ভালো হবে।
-এত চাপ নেওয়ার কিছু নেই..আসলে উনি…
সবটা খুলে বলল নির্ঝর।
***
রাত আটটা:
রজনীগন্ধার গন্ধে মম করছে চতুরর্দিক। ভিতরে ঘরে একটা ফুলের তোড়া। ফুলের মাধ্যমে অভিবাদন জানানো হবে বিশেষ সদস্যকে..
সময় আধঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। অস্থির হচ্ছে দুজন। তারপরে বড় গাড়ি থামার শব্দ। ফোন না করেই সঠিক জায়গায় এসে থেমেছে তীর্থঙ্করের গাড়ি।
অবাক হওয়ার সময় টুকু ছিল না, স্বাগতম জানাতে ছুটে বাইরে গেল ও। দেখে গাড়ি থেকে তীর্থঙ্কর দাশগুপ্তই নামছে।
-আসুন স্যার আসুন..
-একটু দেরি হল।একেবারে খাবার গুলো নিয়েই এলাম।
-কোনো ব্যপার না। আসুন স্যার..সাবধানে আসবেন।
দরজা দাঁড়িয়ে ছিল সৃজিতা। তীর্থঙ্কর সামনে যেতেই ঝুঁকে প্রণাম করতে উদ্যত হল।
-আরে করছ কী! এখন কেউ ঝোঁকে নাকি! ঐ সব প্রণাম তোলা থাক।
-আপনি কেমন আছেন?
-আজকে তো আমি খুব ভালো আছি। নির্ঝর সকাল সকাল সুখবর শুনিয়েছে। তাই আমি তোমার সাথে দেখা করতে চলে এলাম। ঐ দেখো খাবার চলে এসেছে। খাবার গুলো কোথায় রাখা হবে একটু বলে দাও।
-হ্যাঁ হ্যাঁ।
সৃজিতা খাবার বাহককে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে গেল। রান্নাঘর বলতে আলাদা কিছু নেই। বারান্দার একদিকে রান্না হয়। প্রায় ছয়টা ক্যাসারোলে খাবার এসেছে। এত খাবার পরিবেশনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা সৃজিতার রান্নাঘরে নেই। নিজেদের জাইন্ট ডাইনিং টেবিলের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। বিব্রত হল সৃজিতা। না চাইতেও একটা দীর্ঘনিশ্বাস নির্গত হল সৃজিতার অন্তঃস্থল থেকে.. আবার স্বাভাবিক হয়ে ওদের কাছে উপস্থিত হল।
-বসো সৃজিতা। আজ আমার আসার উদ্দেশ্য দুটো।
-কী কী?
-তোমাকে দেখতে আসা। আর একটা খবর দেওয়া। নির্ঝর কাল থেকে তোমার সোনাতে যাওয়ার দরকার নেই।
ভালো কিছু অপেক্ষা করছে বুঝতে পেয়েও ভয় পেল নির্ঝর। নিশব্দে ঢোক গিলে বলল,
-কেন স্যার?
-আমার নতুন শাড়ির শোরুম ওপেন হচ্ছে। ওখানে থাকবে তুমি। মাইনে বাড়বে। কষ্টও কমবে। তবে সময়টা একটু বেড়ে যাবে। তুমি ঐ সাড়ে দশটার দিকে যেও। দুপুরে দুই ঘন্টা ব্রেক। তখন বাড়ি ফিরতে পারো..
তীর্থঙ্কর দেখল দুজনে হাসিমুখে ওর অভিমুখে তাকিয়ে আছে। নির্ঝরের চোখে কৃতজ্ঞতা। মুখে বলল,
-থ্যাঙ্কু স্যার।
-এই নির্ঝর আমি কোল্ডড্রিংস আনতে ভুলে গেছি। তুমি যদি নিয়ে আসো।
-আমি মানে..এখন?
সৃজিতাকে একা ছেড়ে যেতে ইতস্তত করল নির্ঝর।
-যাও না নিয়ে এসো..আমি ততক্ষণ মিষ্টি মুখ করাই।
-না না আমি এখন কিচ্ছু খাব না। একটু পরেই রাতের খাবার খাব। নির্ঝর তুমি যাও।
সৃজিতার আশ্বাস পেয়ে চলে গেল নির্ঝর। সেই সুযোগে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল তীর্থঙ্কর।
চলবে:
কী বুঝলে তোমরা?
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_বারো
-সৃজিতা
পায়ে পায়ে রান্নাঘরে পৌঁছাল তীর্থঙ্কর।
পিছনে তীর্থঙ্করের উপস্থিতি বুঝতে পেরে চমকে উঠল সৃজিতা।
-এ কী! আপনি এখানে?
-তোমার সঙ্গে কথা আছে সৃজিতা। একবার এসো।
বলেই বসার জায়গায় গেল তীর্থঙ্কর।
সৃজিতাও সেখানে পৌঁছাল।
-তুমি কী ভাবছ সৃজিতা?
-কী বিষয়ে?
-তোমার মাকে কী এই সুখবরটা জানাবে?
মৌনতা অবলম্বন করল সৃজিতা।
হাঁ করে অধীর আগ্রহে সৃজিতার অভিমুখে তাকিয়ে থাকল তীর্থঙ্কর। সৃজিতার বক্তব্যের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
-না জানাব না। মা এই বিয়েটা মেনে নেয় নি। আমার স্বামীকে মানেনি। আগত সন্তানের খবর জানার অধিকার মায়ের নেই।
কঠোর মুখাবয়বে বলল সৃজিতা।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল তীর্থঙ্কর।
-আমি হৈমপ্রভাকে অনেকদিন ধরে চিনি। খুব ভালো করে চিনি। ও টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না।
শুকনো মুখে তীর্থঙ্করের দিকে তাকাল সৃজিতা।
-জানি তোর শুনতে খারাপ লাগল। কিন্তু এটাই সত্যি। তবে তোর সাহস আর ভালোবাসা দেখে আমি অবাক। একটা মেয়ে এত ঐশ্বর্য ছেড়ে কী ভাবে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে। শুধু দিন কাটাচ্ছে বলা ভুল। ভালোও আছে…টাকাটা সব না, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ভালোবেসে দিন কাটানোটা আসল। টাকার সমুদ্রে শুয়েও অনেকে ভালো থাকে না। শান্তি থাকা আসল রে মা। নির্ঝর একটা খাঁটি সোনা। তোর মা ওকে চিনতে পারেনি। আমি ওকে আস্তে আস্তে উপরে তুলব। তোর মায়ের সমকক্ষ করব। তারপর তুই তোর মায়ের সামনে দাঁড়াস…
কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে অন্নদাতার অভিমুখে তাকাল সৃজিতা। শ্রদ্ধায় মাথা নত করে প্রণাম করল।
**
দিন দশ পর বেশ জাঁকজমক করে গোধূলির উদ্ভোধন হল। শাড়ির শোরুমের বিজ্ঞাপনের জন্য অনেক টাকা খরচ করেছিল তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত। সারা শহরে হোডিং পড়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে খোলা হয়েছে এই শোরুম। প্রথমদিনের বিক্রির পরিমাণ অন্য বিপণীর কাছে ইর্ষাজনক।
দিন কাটতে লাগল, নির্ঝর শাড়ির স্টকের দায়িত্বে আছে। প্রতিদিন শাড়ি চেনার ট্রেনিং চলে। সেই ট্রেনিং শেষ হলেই ভারতের প্রতিটা রাজ্য থেকে দুর্লভ সংগ্রহের শাড়ি আনার দায়িত্ব ওর উপর থাকবে। নিজের কাজ সর্বদা মনোযোগ দিয়ে করে নির্ঝর। মালিকের কথা শোনে। মালিকের সুনজরে থাকে। অন্যেরা হিংসার চোখে দেখলেও নিজের কাজ শেষ করে যথাসময়ে বাড়ি ফেরে। উৎসবের সময় দুপুরে বাড়ি ফেরাও হয়না। দুশ্চিন্তা নিয়ে হাসি মুখে কাজ করে নির্ঝর।
এদিকে ঘরে আরো একা হয়ে পড়েছে সৃজিতা। একটা কোনো প্রাণী নেই কথা বলার। সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। একটা কাজের লোক আর রান্নার লোক রেখেছে। ওদের উপস্থিতিতে বকবক করতে থাকে সৃজিতা। কিন্তু কেউ না থাকলে যেন ওকে বোবায় ধরে। ভয় পায় ও.. এক ছুটে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে।
এখন প্রায় দিনই সকাল সাড়ে দশটায় সান্যাল বাড়ির ল্যান্ডফোনটা বেজে ওঠে। অন্য কেউ ধরলে সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে যায়। শুধুমাত্র হৈমপ্রভা হ্যালো বললেই ওপার থেকে ভেসে আছে একরাশ নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ঐ প্রান্ত লাইন চ্যুত করে। ফোনটা এখন প্রায় ঘনঘন আসে। আজকাল হৈমপ্রভাও সেই ফোনের অপেক্ষায় থাকে।
তারপরেও কেটে গেছে তিনবছর। সৃজিতা এখন এক সন্তানের মা। পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে ও। বুবলাই নামের ছোট্ট গোপাল ওর দুই কামরার ঘর আলো করে রাখছে। ছেলের বয়স দুই বছর তিন মাস।তার দৌরাত্ম্যে একটু বসার উপায় নেই.. স্বামী, পুত্র নিয়ে এখন ভালোই আছে সৃজিতা।
সেদিন ও ভাতের থালা নিয়ে ছেলের সাথে উঠোনময় ছোটাছুটি করছিল। ফোনটা সেই সময় বেজে উঠল। ফোন ধরার কিংবা ফোন দেখার সময়
এখন সৃজিতার থাকে না। বোঝার সুবিধার জন্য নির্ঝরের ইনকামিং টোনটা আলাদা রেখেছে।
-এই সময় তোর বাবা ফোন করছে। আজও কি দুপুরে আসবে না?
সৃজিতার ভাবনার মাঝেই ফোনটা কেটে গেল।
ছেলের খাওয়া শেষ হলে ফোন করবে ভেবে আবার ছেলের পিছনে ছুটল।
-এই বুবলাই কোথায় গেলি রে..
ততক্ষণে ছোট্ট বুবলাই ঘরে দরজার পাশে আত্মগোপন করেছে।
ছেলেকে খুঁজে জোর করে মুখ খুলিয়ে আবার মুখে ভাত চালান করল।
আবার ছুটল উঠোন।
-ওহ! বুবলাই তোকে নিয়ে আমি আর পারিনা। এবার কিন্তু না খাইয়ে রাখব। সারাদিন খেতে..
বকুনি সম্পূর্ণ হওয়ার আগে আবার ফোন বেজে উঠল। সৃজিতার সারা হাতে এঁটো। নাইটিতে এঁটো।
-থাক তোকে আর খেতে হবে না।
থালাটা কলতলায় নামিয়ে হাত ধুয়ে নির্ঝরের নম্বর ডায়াল করল।
-কী করছিলে?
-ঘুমাচ্ছিলাম..তোমার ছেলে আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছিল।
-আজ তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে গেছে তো..
সৃজিতার ব্যাঙ্গ বুঝতে পারে না নির্ঝর।
-ছাই হয়েছে..ওর পিছনে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। এখন ফোন করলে? আজও দুপুরে বাড়ি আসবে না? তুমি আগে কেন বলো না? শুধু শুধু ভাত বেঁচে যায়। সেই ভাত রাতে আমাকে খেতে হয়।
এক নাগাড়ে কথা গুলো বলল সৃজিতা।
-আমি বাড়ি আসছি..
নির্ঝরের শান্ত গলায় বুকটা ছ্যাত করে উঠল সৃজিতার।
-কী হয়েছে নির্ঝর?
-বাড়ি ফিরে বলছি..
-নির্ঝর কিছু কী হয়েছে?
-তোমার মায়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সৃজি।
-কী??
সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল সৃজিতার।
চলবে: