#অস্তরাগের_কলি
#পর্ব_ঊনিশ
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
পরিচিত রিংটোনে ফোন বাজছে সৃজিতার। বুবলাইকে স্তন্যপান করিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল ও। নড়েচড়ে উঠল বুবলাই। ফোন বাজার শব্দে বিরক্ত হল সৃজিতা।
“এই সময় যে কেন ফোন করে!”
হাত বাড়িয়ে ফোনটা কাছে টেনে সাইলেন্ট মোড করল।
বুবলাইকে আবার ঠুকে ঠুকে ঘুম পাড়াতে উদ্যত হল। ছেলেকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে এক সময় নিজেই ঘুমিয়ে পড়ল। এর মধ্যে চল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। একবার, দুইবার, সাতবার ফোন বেজে বেজে কেটে গেছে। দুশ্চিন্তায় ঐ প্রান্ত কাজে মন বসাতে পারছে না। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই বাড়ির রাস্তা ধরবে বলে মনোস্থির করল।
ঘুম চোখে পাশে হাত দিল সৃজিতা। ছেলের শরীরের স্পর্শ পেল না। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সৃজিতা। দেখে খাটের কোণে পৌঁছে গেছে সে। টেনে এনে সঠিক স্থানে শোয়ালো। তারপর ফোনে
নির্ঝরের সাত সাতটা মিসডকল দেখল।
সাথে সাথেই নির্ঝরের নম্বর ডায়াল করল।
-কি হল কী, এতক্ষণ ধরে ফোন করছি। টেনশনে বুকের ভিতরটা শুকিয়ে গিয়েছিল।
-ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ফোনটা সাইলেন্ট ছিল।
-তো বলতে পারো নি?
-সাইলেন্ট ছিল, জানবো কি করে!?
ছদ্ম রাগ দেখাল সৃজিতা।
-বাদ দাও, একটা কথা বলার জন্য ফোন করলাম।
-কী?
-সন্ধ্যায় রেডি থেকো। বাজার যাব।
-ঠিক আছে।
-কী কী লাগবে লিস্ট করে রেখো।
-শীতের পোশাক তো আছেই। টুকটাক কিছু কিনতে হবে।
-টুকটাক বললে চলবে না। নতুন চাই। প্রথমবার হানিমুনে যাচ্ছি।
-হ্যাঁ ছেলে সমেত..
শব্দ করে হাসল সৃজিতা। ওষ্ঠ প্রসারিত হল নির্ঝরেরও।
-ঠিক আছে রেডি থাকো..
***
অটো, ট্রেন আবার গাড়ি.. মোটামুটি কুড়ি ঘন্টার সফর শেষ করে গ্যাংটকে পৌঁছাল সৃজিতারা। ড্রাইভারের সাথে বাকবিতণ্ডার জড়িয়ে হোটেলে পৌঁছাতে আরো মিনিট কুড়ি সময় লাগল। দীর্ঘক্ষণের যাত্রায় বুবলাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। অত্যাধিক ঠান্ডায় গেল আরো কুঁকড়ে। হোটেলের বিছানায় ছেলেকে শুইয়ে দিল সৃজিতা। গায়ের উপর চাপাল মোটা কম্বল। শুয়েই থাকল বুবলাই।
ছেলের অবস্থা দেখে মায়া হল নির্ঝরের।
-সৃজি আমাদের এখানে আসা কি ভুল হল?
ট্রেন লেট, ড্রাইভারের সাথে ঝামেলা। একের পর এক ঘটনার জন্য হতাশ হচ্ছে।
-না না, ভুল কেন হবে? যা ঠান্ডা। আমরাই জমে যাচ্ছি। ও তো ছোট।
-তুমি আগে একটু খাইয়ে দাও। তারপর ফ্রেশ হবে।
-হ্যাঁ। জল গরম করি।
দ্রততার সাথে জল গরম করতে উদ্যত হল সৃজিতা।
***
আকাশি শাড়ি, গায়ে একটা কাশ্মিরী শাল, চোখের কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত একজন বছর আটান্নের পৌঢ়া এয়ারপোর্ট থেকে বেরল। মাথায় কোমর অব্দি লম্বা বেনি শোভা পাচ্ছে। এখনো চুলের কী গোছা..নিজের ছোট ট্রলিটা নিজেই বহন করছে। কী অসমান্য ব্যক্তিত্ব! দূর থেকে হৈমপ্রভাকে দেখে চমকে উঠল তীর্থঙ্কর। একই ফ্লাইটে এসেছে দুজন!
হোটেলের খোঁজ পেলেও কোন ফ্লাইটে আসছে জানা ছিলনা তীর্থঙ্করের।
এয়ারপোর্ট থেকে নেমে নির্ধারিত গাড়িতে চাপল হৈমপ্রভা।ভীড়ের মধ্যে মিশে থাকল তীর্থঙ্কর। মেয়ে-জামাই নাতিকে নিয়ে হৈমপ্রভার গাড়ি চলতে শুরু করল হোটেলের উদ্দেশ্যে..কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল তীর্থঙ্কর। হৈমপ্রভার পাশের হোটেল নিয়েছে সে। নিজেকে আত্মগোপন রেখে হৈমপ্রভার উপর নজর রাখবে। আবার চোখ জ্বলে উঠল তীর্থঙ্করের..
***
শুনুন শুনুন শুনুন..
প্রতিবছরের ন্যায় এই বছরেও পলাশতলির মাঠে তিনদিন ব্যাপী বিশাল যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়েছে। সদূর কোলকাতা থেকে নামিদামী অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা আসছেন আমদের শিমুলপুরে। আজকের যাত্রাপালা পতির পূণ্যে সতীর পূণ্য। যাত্রাতে অভিনয় করছে “অমর প্রেম ” খ্যাত অরুণ সেন। নায়িকাও বহুল পরিচিত মিস সেফালি। তাছাড়াও আছে আরো অনেকে..নামিদামী নক্ষত্রদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ একদম হাতছাড়া করবেন না। টিকিটের মূল্য শুধুমাত্র দুই টাকা.. দুই টাকা..দুই টাকা..
ঘর থেকে ঘোষণাটা শুনতে পাচ্ছিল রুকু। ছুটে বাইরে বেরিয়ে একটা লিফলেট হাতে নিল। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে থাকল। অরুণ কুমারের অবয়ব কল্পনা করেই দুই চোখ আনন্দে জ্জ্বলজ্জ্বল করে উঠল।
-ও মা..মা..
মাটির উনুন গোবর দিয়ে নিকাচ্ছিল রুকুর মা। সকাল থেকে দম ফেলার সময় পায়নি। আজ বারো জনের রান্না একা হাতে করতে হয়েছে। দুই জা গেছে বাপের বাড়ি। মাথা তেতেই আছে। তার উপর মেয়ে গলায় মধু ঢেলে ডাকছে।
-ও মাআআ..কী গো মা সাড়া দিচ্ছো না কেন?
-মা মা করিস না তো কী বলবি বল..
মেজাজ দেখিয়ে উচ্চস্বরে বলল রুকুর মা।
সব রাগ বছর চোদ্দোর মেয়েটার উপর পড়ল।
ভয় পেল চোদ্দো বছরের রুকু। নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করা নিয়ে মনে সংশয়ের সৃষ্টি হল।
-কী হল? সংয়ের মতন দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বল..
মায়ের উত্তর না শুনবে জেনেও বলল,
-মা তিনটা যাত্রা দেখার টিকিট একেবারে করা আছে।আমি আজকের যাত্রাটা সোনালি, রুপালিদের সাথে দেখতে যাব। তুমি ঘরে থেকো..
-কী!
চিৎকার করল রুকুর মা..
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_কুড়ি
-আমি যাই না মা।
-মেলা বকিস না। যা গরুকে পোয়াল দি দে। তখন থেকে শোর করছে..
-পোয়াল দি দেব। তোমার উঠান নিকান দেব। তুমি শুধু যেতে দিবে বল?
-এই টুকু থেকে যাত্রা দেখবি? এত নেশা কিসের?
-অরুণ কুমারকে খুব ভালো লাগে। ইটাই খালি দেখব।
-রেতের বেলায় কী করে ঘরে আসবি? তোর কাকিরা কাল আসবে। উরা থাকলে ডর হত না।
-সোনালীর মা যাবে। গেরামের সবাই যাবে। কারুর সাথে চলে আসব। যেতে দাও না মা।
বড় মেয়ের কাকুতিতে একটু নরম হল রুকুর মা।
-তোর বাপকে আগে শুধায়। যেতে বললে যাবি..
-না না বাবাকে না। যেতে দেবে না। ধমক চমকে আমাকে ঘরে বসায় রাখবে।
-তালে তোর বাপ জানবে না?
-রেতে বলবে। আমি ফিরলে..দাও না মা যেতে..কাল কাকিদের সাথে তুমি যাবে। আজ আমি যাব..
-বেশ! যাস..এখন আমার সাথে কাজে হাত লাগা।
-আমার সোনা মা।
মাকে জড়িয়ে ধরল রুকু।
-নে আর সোহাগ করতে হবে না। কাজটা সারলেই হবে। একা হাতে কত করব..
নিজের দুঃখ প্রকাশ করল রুকুর মা।
কথা না বাড়িয়ে খড়ের চালে রাখা দু আঁটি খড় টেনে গোয়াল ঘরের দিকে যায় রুকু। দুটো বাঁধা গোরুর মুখের সামনে খড় রেখে গোয়াল থেকে বের হয়। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায়না রুকু। পাওয়ার কথাও নয় গোয়ালটা ওদের বাড়ির পিছনে। ভরদুপুরে কেউ আসেও না। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে বাড়ির পিছনের গলি দিয়ে রাস্তায় পৌঁছায়। তারপর আবার সজাগ থেকে সোনালীদের গলি ধরে। এই ভাবে পৌঁছে যায় সোনালীদের বাড়ি।
সোনালীদের বাড়ি রুকুদের বাড়ির উল্টোদিকে। সকলের নজর এড়িয়ে বান্ধবীর বাড়ি আসতে কত কাঠখড় পোড়াতে হল।
নকশা করে পায়ে আলতা পরছিল সোনালী। পিছন থেকে ধাক্কা মারল রুকু।
-ধপ্পা..
-ও তুই..যা ডর লেগেছিল না।
-ও সব ছাড়। শুন আমি মাকে বলে অনুমতি নিয়েছি। অরুণ কুমারের যাত্রা দেখতে যাব। তু চল।নালে আমার যাওয়া হবে না।
-মা যাবে। ঠাকুমা যাবে। আমাকে নে যাবে না রে।
-তু তোর ঠাকুমাকে বল..তোকে যেতেই হবে। আমি বলেছি কাকির সাথে সোনালী যাবে। তবে মা রাজী হল..তু না গেলে আমার সাধ পূরণ হবে না।
-যা বলে দেখি..
বিকেল পাঁচটা:
মাঘ মাস অন্তিম লগ্নে পৌঁছেছে। তবুও বাতাসে শীতলতা। গ্রাম গঞ্জে শীত বেশিই থাকে। সন্ধ্যা হতে বেশ কিছুক্ষণ বাকি। তবুও মায়ের কাজ আসান করার জন্য লালপেড়ে শাড়ি পরে তুলসী তলায় ধূপ প্রদীপ জ্বালাল রুকু। তারপরেই ট্রাঙ্ক থেকে পূজোর সালোয়ার বের করল। ওর বাবা চোখ এড়িয়ে বেরতে হবে।এই বয়েসে এসে সালোয়ারের উপর নিষেধাজ্ঞা হয়েছে। বাইরে কোথাও গেলে শাড়ি পরা ধরিয়েছে ওকে। এখন শাড়িতেও স্বাচ্ছন্দ্য। আজকের জন্য গাঢ় গোলাপি চুরিদারটাকে বেছে নিল।
সাড়ে পাঁচটা বাজতেই মাকে বলে সকলের নজর এড়িয়ে সোনালীদের বাড়ি গেল রুকু। তারপর ছয়টার মধ্যে পৌঁছে গেল যাত্রা ময়দানে। ছয়টার যাত্রা শুরু হল সাতটায়। দেরি দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ল রুকু। বাড়িতে বাবা হয়ত কুরুক্ষেত্র শুরু দেবে। ওর দুই কাকাও যাত্রা দেখতে এসেছে। তারা কোথায় বসেছে জানেনা রুকু।
এই সব ভাবছিল রুকু তারমধ্যেই মঞ্চে লাল জামা আর কালো ঢোলা প্যান্ট পরে শহুরে বাবু সেজে প্রবেশ করল অরুণ কুমার। সকলে হাততালি, সিটি দিয়ে অভিবাদন জানাল তাকে। চোদ্দো বছরের জীবনে রুকু দু তিনটা সিনেমা দেখেছে। তার মধ্যে অমর প্রেম সবচাইতে প্রিয়। প্রিয় অরুণ কুমারও। এত কাছ থেকে স্বপ্নের নায়ককে দেখে আনন্দে আত্মহারা হল রুকু। ভালোই যাত্রা চলছিল, একঘন্টা পর বিরতি হল। সোনালী বাদাম খাবে বলে ওর মায়ের কাছে বায়না ধরল। এক ধমক দিল ওর মা। খিদে রুকুরও পেয়েছিল। কিন্তু হাতে পয়সা নেই। দশ পয়সা আনলে মশলা মুড়ি হয়ে যেত। আক্ষেপ করল রুকু। সোনালীর জেদাজেদিতে ওর মা বাদাম কিনতে বাইরে গেল। সাথে সোনালীও গেল। রুকু একা বসে থেকে কী করবে? চারিদিকে মানুষের জনসমাগম। সোনালীর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ওদের পিছন পিছন গেল রুকু। প্রধান গেট থেকে বেরিয়ে আর ওদের খুঁজে পেল না। মঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় বসেছিল ওরা।
ভয় পেয়ে আবার পূর্বের স্থানে ফিরে এল। বিরতি পেরিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল তবুও সোনালী ও তার মায়ের দেখা নেই। এবার সত্যিই ভয় পেল রুকু। ও জানে এখানে ওদের গ্রামের অধিকাংশ লোক আছে কিন্তু অন্ধকারে খুঁজবে কী করে? অসংখ্য মানুষদের ডিঙিয়ে, তাদের গায়ে পা দিয়ে গালাগালি খেয়ে গেটে এসে পৌঁছাল রুকু।
মনে একটাই প্রশ্ন অন্ধকারে বাড়ি কী করে যাবে?
চোখে জল এল রুকুর। যাত্রামাঠের আলো কিছুদূর অব্দি প্রসারিত। ততটা গিয়ে পদযুগল থেমে গেল। এর পরেই শুরু নিকষ অন্ধকার।
চলবে: