#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_একুশ
আশেপাশে কোন জনমানব নেই। কয়েকজন খাবার বিক্রেতা ছাড়া সকলে যাত্রা ময়দানে।ধীর পায়ে এগোচ্ছে রুকু। মনে অসংখ্য প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই দিতে হবে। যাত্রামাঠ থেকে ওর বাড়ি পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। আজন্মকাল চেনা এই রাস্তা ছুটতে ছুটতে পার হয়েছে। তবে সেটা বিকাল অব্দি। নিকষ আঁধারে রাস্তা ঠাওর হবে না। নিদেনপক্ষে আশমানে চাঁদ থাকলেও পারা যেত। মনে সাহস রেখে চলতে শুধু করলে হয়ত পৌঁছে যাবে। কিন্তু পথঘাট সুরক্ষিত নয়। যদি কোনো দুষ্কৃতীর পাল্লায় পড়ে..মন্দ লোকের পাল্লায় পড়তে কী ফল হবে জানে রুকু। এই সব ভাবতে ভাবতে আলো-আঁধারের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করল। দ্রুতগতিতে উল্টোদিক থেকে একটা সাইকেল ধেয়ে আসতে থাকল। অগুন্তককে দেখে ছুটে গুমটির পিছনে আশ্রয় নিল। সাইকেল থেকে নামল সেই আগুন্তক। রুকুকে সে লক্ষ্য করেছে..
-এই কে রে?
লুকিয়ে থেকেও তিরতির করে কাঁপছে রুকু। এই বুঝি ধরা পড়বে।
গুমটির পিছনে পৌঁছে গেল ছেলেটা। সাহস করে নাম ধরে ডেকেই ফেলল।
-রুকু তুই?
ধড়ে প্রাণ এল রুকুর। হালকা আলোর আভাতে ছেলেটাকে চিনতে পারল না।
-কে তুমি?
-আমি রে..তিনু..তুই একা একা কোথায় যাচ্ছিস?
-আমি সোনালীদের সাথে যাত্রা দেখতে এসেছিলাম। ওদের সঙ্গ ছাড়া হয়ে গেছি। বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরিয়েছি। কিন্তু আঁধারে ডর লাগছে।
-চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি..
-তুমি যাবে?
তিনু রুকুর থেকে তিন বছরের বড়। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কলেজে পড়ছে। রুকুর গ্রামের থাকে। একে অন্যকে চিনলেও সেই ভাবে কথা হয়না। বিপদের সময় স্বল্প পরিচিত তিনুকেই রক্ষাকর্তা মনে হল রুকুর।
-প্রথম থেকে যাত্রা দেখতে নি। হাফ টাইমের পর এলাম। অরুণ কুমারকে দেখেই চলে যাব। ফকোটিয়াতে দেখব আর কী..
-তুমি যাও। আমি ভূত আমার পুত বলতে বলতে চলে যাব।
-না পারবি না। তোর গেদে ডর। তুই পারবি না। সাইকেলে চাপ। তোকে ঘরে দে আবার আসব।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল রুকু। বাড়ি ফেরার এর থেকে উত্তম মাধ্যম ওর জানা ছিল না।
-আয় চাপবি..
সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে গ্রাম মুখো করে রুকুকে আহ্বান জানালো তিনু।
বেনী ঝুলিয়ে তিনুর সম্মুখে এল রুকু। গোলাপি চুরিদার পরিহিত চতুর্দশীর ভয়মিশ্রিত মুখাবয়বে আলাদা মাদকতা লক্ষ্য করল তিনু। প্রথমবার রুকুকে অন্যরকম লাগল..
সাইকেলের সামনের রডে বসল রুকু। সাইকেল চালাতে শুরু করল তিনু। রুকুর মাথা স্পর্শ করছে তিনুর বক্ষদেশে। একটা ভালোলাগার আবেশ ছেয়ে গেল তিনুর অন্তরে..
-এ জন্য বলে বড়দের কথা শুনতে হয়। না এলেই হত। মায়ের মানা মানলাম না। এসে আর কী হল?
-হু..
-তোমার কোন কলেজ গো?
-সুভাষ চন্দ্র বোস কলেজ। রুকু তোকে একটা কথা বলব?
-হ্যাঁ বলো..
-তোকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। একেবারে অন্যরকম। এমনি সেজে থাকবি..
শিমুলপুর বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে রুকু। হেঁটে বাড়ি আসার সময় কোনো কোনো ছেলে ছোকরা টোন টিটকারি কাটে। ব্যাস ঐ টুকুই..কেউ সরাসরি এভাবে সুন্দর বলেনি। তিনুর বলার মধ্যে সত্যতা ছিল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল, সত্যিই ও সুন্দর। রুকুর কিশোরী মনে দোলা লাগল। হৃদস্পন্দন দ্রত হল। নড়ে উঠল রুকু। ফলস্বরূপ অন্ধকারে টাল সামলাতে না পেরে দুজনে এক সঙ্গে পড়ল।
***
-স্যার আর কতক্ষণ..
-আর একটু..
-অপনি হৈমপ্রভা সান্যালকে ফলো করতে এসেছেন। সে তো অনেক আগেই চলে গেছে।
-ওহ মাধব এত কথা বলো কেন বলো তো? আমার সময় মত আমি যাব। আর তোমাকে কে বলল আমি হৈমপ্রভাকে ফলো করছি? ওর সঙ্গে আমার বিরোধ আছে এটা ঠিক তবে ওকে ফলো করার জন্য আমি আসিনি। আমি এসেছি ঘুরতে।
ছায়া সঙ্গী মাধবকে এক ধকম দিল তীর্থঙ্কর।
স্যারের বকুনি খেয়ে মুখ ফুলিয়ে রইলো মাধব। তীর্থঙ্করের অনেক কাছের লোক আছে। তার মধ্যে মাধবের সঙ্গে সম্পর্ক বহু দিনের। এমন গোপন অভিযানের সাথী তাই শুধু মাধবই।
-বাংলার পাঁচের মতন মুখ করে আর থাকতে হবে না। এবার চলো..
-চলুন..
গম্ভীর গলায় বলল মাধব।
***
দেড় দিন গ্যাংটকে এসেও আশেপাশের জায়গা ঘুরতে পারছে না নির্ঝর ও সৃজিতা। বেশিক্ষণ গাড়িতে থাকলেই কাঁদছে বুবলাই। অত্যাধিক গরম জামাকাপড় পরানোর হেতু বিরক্ত হচ্ছে। মাথার বাঁদর টুপি টেনে খুলে দিচ্ছে। ওকে নিয়ে গাড়িতে বসা দুঃসহ হয়ে উঠছে। সকালে ছ্যাঙ্গু লেক ঘুরে আসতে পেরছে। সন্ধ্যায় এম জি মার্কেটে ঘুরতে এসেছে সৃজিতা-নির্ঝর। সাদা উলের পোশাকে ছেলেকে আবৃত করেছে সৃজিতা। দেখে মনে হচ্ছে একটা খরগোশ লাফালাফি করছে। খোলা জায়গা পেয়ে ছোটাছুটি করছে বুবলাই।
-খুব ভুল হল জানো..
স্বামীর এহেন আক্ষেপে অবাক হল সৃজিতা।
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_বাইশ
-কীসের ভুল?
-নিজের পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তোমাকে পাহাড়ে নিয়ে এলাম। নিয়ে এসে কী হল? তুমি ঘুরতেই পাচ্ছো না। এর থেকে সমুদ্রের দিকে গেলে অনেক ভালো হত। তুমি ঘোরা উপভোগ করতে পারতে। ছেলেটাও আনন্দ পেত।
-আমি ঘরের বাইরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে চেয়েছিলাম। পেয়েছি..এর থেকে বেশি কী চাই! ছেলেটা ছোট, তার উপর প্রথমবার বাড়ির বাইরে থাকল। তাই ওর অসুবিধা হচ্ছে। পরে পরে দেখবে অভ্যাস হয়ে যাবে।
-তাও..সমুদ্রে গেলে বালিতে ছুটে বেড়াত। এই ঠান্ডাটা থাকত না। তোমারো সমুদ্র প্রথম পছন্দ।
-হ্যাঁ পাহাড়ের থেকে সমুদ্র আমার প্রিয়। পরের বার যাব। এই গরমে সমুদ্রে কে যায় গো? বাড়ির বাইরে এসেছি। আমরা তিনজন একসঙ্গে আছি। তোমাকে সর্বক্ষণ কাছে পাচ্ছি। মজা করছি। আমাদের তিনজনের তিনজন ছাড়া কে আছে বলো তো? তুমি মনে কোনো আক্ষেপ রেখো না।
নির্ঝরের কাঁধে মাথা রাখল সৃজিতা। মা-বাবাকে একসঙ্গে দেখে মায়ের পায়ের কাছে এল বুবলাই।
-তোলে..
বলে হাত বাড়াল।
-হিংসুটে ছেলে!
ফিক করে হাসল নির্ঝর।
ছেলের গালে চুম্বন করে কোলে নিল সৃজিতা।
**
ফাইভ স্টার হোটেলে পৌঁছে এক কাপ কফি খেল তীর্থঙ্কর। তারপর আরামকেদারায় বসে সিগারেটে টান দিল।
-এই নিয়ে দিনে আট নম্বর চলছে। বয়েসটা বোধহয় দিন দিন কমছে।
শাল গায়ে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল মাধব।
-কথাটা কি আমাকে বললে?
-না না..ঘরে উপস্থিত অশরীরিকে বললাম।
-তা বলতে পার। ওদের সাথেই তো তোমার বেশি ভাব।
উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল মাধব। তার আগেই ফোন বেজে উঠল।
-ঐ ছেলেটা ফোন করছে।
-মেলা বকবক না করে ফোন করো..
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তীর্থঙ্কর।
ঘাড় নেড়ে নেড়ে অপর প্রান্তের কথা শুনে ফোন রাখল মাধব। দেখল সম্মুখে তীর্থঙ্কর দন্ডায়মান।
-উফ! উঠে পড়েছেন? একটু তর সয় না দেখছি..
-শাসন পরে হবে। খবর বলো..
-ওরা এম জি মার্কেট থেকে ফিরে গেছে।
-বাহ বাহ..আর হৈমপ্রভা?
-পাশের হোটেলে তো আছে খবর নিয়ে আসুন..
মাধবের মশকরায় চটে গেল তীর্থঙ্কর। মেজাজ হারিয়ে বলল,
-তোমার কী মনে হয় বিজনেস, ফ্যাক্টারী ছেড়ে আমি এখানে মজা মারতে এসেছি?? এই যে আমি ভিজিটে যাব না কত চুরি হবে জানো?? সব কিছু জেনেই আমি এখানে..
মালিকের ধমকানিতে শান্ত হল মাধব। বিগত পঁচিশ বছর মাধব তীর্থঙ্করের সাথে আছে। হেম ফ্যাক্টারী সৃষ্টির ইতিহাসে ওর নাম লেখা আছে। প্রতিটা ইটের খবর জানে মাধব। কত কষ্ট ও পরিশ্রম করে তীর্থঙ্কর হেমকে তৈরি করেছিল সেটাও জানে। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হৈমপ্রভার সাথে কীসের এত শত্রুতা জানে না মাধব। ব্লসম বা হৈমপ্রভার ফ্যাক্টরীর সাথে শত্রুতা তেমন নেই, শত্রুতা ব্যক্তি হৈমপ্রভার সাথে..
সঠিক কারণ অজানা মাধবের কাছেও..
***
পরের দিন:
রাজকীয় শয্যায় শুয়ে চোখ মিলল সুংযুক্তা। চাইলেও যেন উঠতে পারছে না। সাদা বিছানায় আরো ঢুকে যাচ্ছে। সমস্ত উন্নত সুবিধা যুক্ত এই ঘর। দুটো ঘর নিয়েছে ওরা। একটাতে হৈমপ্রভা আর বুবাইয়ের বেবি সিটার থাকবে, আর একটাতে ওরা। প্লেনের টিকিট উপলব্ধ না থাকায় ট্রেনে গ্যাংটকে পৌঁছেছে সেই পরিচারিকা। হৈমপ্রভার ঘরের বারান্দায় সোফা কাম বেডে ওর আশ্রয় হয়েছে। বুবাই বায়না করছিল তার দিনদিনের কাছে শোবে। মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল ছেলেকে। মধুরাত কাটিয়ে সকালে সানরাইস দেখার জন্য দ্রুততার সাথে ঘুম থেকে উঠল সংযুক্তা। আকাশের মুখ ভার দেখে নিজেরও মুখ ভার হয়ে গেল।
-কী গো কিছু দেখা যাচ্ছে?
-না তো..চারিদিকে অন্ধকার। কুয়াশা না মেঘ বোঝা যাচ্ছে না।
-মেঘই হবে।
-তুমি বারান্দা খুলেছিলে?
-পাগল নাকি..এত ঠান্ডায় কাঁচ খুলব। এই শোনো একটা কথা বলি..
শিবমের পাশে আবার শুয়ে পড়ল সংযুক্তা।
-বলো..
চোখ বন্ধ করেই বলল শিবম।
-আরে তাকাও না..
সংযুক্তা জড়িয়ে ধরল স্বামীকে..
-আজ আমরা কোথায় যাব?
-নাথুলার দিকে…
-সে যেখানেই যাই বুবাইকে নিয়ে যাব না। মায়ের সঙ্গে বুবাই থাকবে।
-কেন?
-এমনি ওয়েদার হলে মা বোধহয় যাবেনা। বুবাইও থাক মায়ের সাথে, এত ঠান্ডায় গিয়ে কী করবে। তাছাড়া ওকে সামলানোর জন্য মধুমতি তো আছেই..
-আমার কোনো সমস্যা নেই। দেখো তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলে। সেকেন্ড হানিমুন হয়ে যাবে আর কী..
স্ত্রীকে আরো কাছে টেনে ঠোঁটে ঠোঁট ডোবাল শিবম।
***
বেলা দশটা:
মেঘ কেটে সামান্য রোদের দেখা মিলল। যদিও সেই সূর্য চিরস্থায়ী নয়। এখুনি হয়ত আকাশের সঙ্গে বিবাদ ঘটিয়ে মেঘের মধ্যে আত্মগোপন করবে। সকাল থেকে মুখ ভার তীর্থঙ্করেরও..সূর্যাস্তের দিকে ফিরেও না তাকালেও সূর্যোদয় উপভোগ করে। গাঢ় আঁধারের পর আকাশে সোনালী আভা ছেয়ে যেতেই মনোস্থির করল ছাদে যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ, ওভারকোট পরে হাতে সিগারেট ধরে ছাদে এল তীর্থঙ্কর। কাঞ্চনজঙ্ঘার সামান্য শৃঙ্গ দৃশ্যমান হচ্ছে। সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে সামনে তাকিয়ে শুভ্রগিরির রূপ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে।
ওদিকে নাতির জেদাজেদিতে ছাদে আসতে বাধ্য হল হৈমপ্রভা। দুটো হোটেলের ছাদের পার্থক্য মাত্র দেড় ফুটের..
চলবে: