#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_তেইশ
-দিনদিন ঐ দেখো সূর্য..
বুবাই এই টুপিটা পরে নাও। হাওয়া দিচ্ছে।
বুবাইয়ের ন্যানি টুপি হাতে ছাদে এল।
-সূর্যের অনেক সকালে ঘুম ভেঙেছে দাদুভাই, আমরাই এখন দেখছি।
-সূর্য তো আমাদের বাড়ি থেকেও দেখা যায়। তাও মা এখানে সানরাইস দেখতে পেলাম না কেন বলছিল?
শিশু মনে প্রশ্ন করল বুবাই। নাতির কথাতে স্মিত হাসল হৈমপ্রভা।
-একদম ঠিক, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ঘর থেকেও দেখা যায়। তবুও মানুষ ঘুরতে এসে সূর্যকে দেখব বলে অস্থির হয়।
-কেন হয়?
-এই যে তুমি রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে চাও না। স্কুল যাব না বলে বায়না করো। এদিকে যেদিন স্পেশাল ডে থাকে, কালারিং ড্রেস পরে যাও, হরেক রকম মজাদার টিফিন নিয়ে যাও, সেদিন সকালে কী করে ওঠো? একই তো স্কুল..
হাঁ করে দিনদিনের অভিমুখে তাকিয়ে আছে বুবাই। স্কুলের সাথে সূর্যের কী সম্পর্ক বুঝতে পারল না।
-কেন ওঠো বলো তো? সেদিন তুমি উঠতে চাও। একটা আনন্দ কাজ করে তোমার মধ্যে। তুমি জানো তোমার প্রতিদিনের বোরিং স্কুলেও সেদিন অনেক মজা হবে। অনেক খেলা হবে। সেদিন স্কুলটাকেও অন্যরকম লাগে, তোমার খুব ভালো লাগে। কী তাই তো?
ঘাড় নাড়াল বুবাই..
-ঘুরতে এলে তো মানুষজন আনন্দে থাকে। পাহাড়ে হোক বা সমুদ্রে সূর্যের অবস্থান দেখতে চাই। একঘেয়েমি সূর্যকে তখন অন্যরকম লাগে। মানুষ আনন্দ পায়। এমনিতেই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় আকাশ অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয়ের দৃশ্য সত্যিই অপরূপ বুঝেছো দাদু ভাই?
-হু..
-ম্যাডাম আপনি কী সুন্দর ভাবে বোঝালেন। এইভাবে কখনো ভেবে দেখিনি।
হাস্যরত মুখে বলল বুবাইয়ের ন্যানি। প্রত্যুত্তরে হৈমপ্রভাও সামান্য হেসে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। অন্যপাশের ছাদে একই ভাবে সূর্য দেখছে তীর্থঙ্কর। সাথে জীবনের হিসাব কষছে..
বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি স্থির হল হৈমপ্রভার। মাত্র সাত হাত দূরের পুরুষকে পিছন থেকে দেখেও খুব চেনা লাগল। বুকটা ছ্যাত করে উঠল হৈমপ্রভার। সেই পুরুষের মুখাবয়ব দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠল।
-বুবাই বেশি ছোটাছুটি কোরো না। পড়ে যাবে..
সেই পুরুষের দিকে তাকিয়ে বুবাইয়ের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলল হৈমপ্রভা।
হৈমপ্রভার কন্ঠস্বরে ফিরে তাকাল সেই পুরুষ। দৃষ্টি বিনিময় হল দুজনের..দুই চোখ বিস্ফোরিত হল হৈমপ্রভার।
-আপনি?
-একি হৈমপ্রভা তুমি এখানে? আমাকে ফলো করছ নাকি?
সম্মুখে হৈমপ্রভাকে দেখে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই নাটক করল তীর্থঙ্কর।
জ্বলে উঠল হৈমপ্রভা।
-কে কাকে ফলো করছে বোঝাই যাচ্ছে। বুবাই চল আমরা নিচে যাই। এখানকার পরিবেশ দূষিত হয়ে গেছে।
রাগত স্বর হৈমপ্রভার।
-হাই বুবাই কেমন আছো..
কার্নিশের উচ্চতার হেতু বুবাই ভালো ভাবে তীর্থঙ্করকে দেখতে পেল না।
-ভালো..কে তুমি? আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।
-তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও। তাহলেই দেখতে পাবে।
বলেই ছাদ ছেড়ে নিচের দিকে যাত্রা করল তীর্থঙ্কর।
হৈমপ্রভাকে হোটেলে দেখে নিশ্চিন্ত হল।
***
খারাপ আবহাওয়ার জন্য হোটেলের ঘরে বন্দী থাকতে হল নির্ঝরদের। অচেনা জায়গায় এক কামরায় আবদ্ধ থেকে বিরক্ত হয়েছে বুবলাই। সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করছে।
গতকাল নির্ঝরকে আশ্বস্ত করলেও আজ ততোধিক বিরক্ত হয়েছে সৃজিতা।নির্ঝরের সঙ্গে এক চোট হয়ে গেছে। কেন পাহাড়ে এল, এলই যখন তখন এই রকম সময় এল কেন..
সৃজিতার আচরণে অবাক হল নির্ঝর। কাল অব্দি মেয়েটা ঠিক ছিল আজ আবার কী হল।
-ঘুরতে এসে তুমি ঝগড়া করছো কেন? এমন তো তুমি করো না। কিছু সমস্যা হয়েছে?
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সৃজিতা।
আজ সকাল থেকে কেন রেগে যাচ্ছে তা নিজেও জানে না। মনের কোণে স্মৃতিরা উঁকি ঝুঁকি মারছে। বারো বছর আগেও ওরা চারজন গ্যাংটক এসেছিল। বরফ নিয়ে দিদির সঙ্গে খেলেছিল। সেদিনও ছিল মেঘলাচ্ছন্ন দিন। হুটোপুটিতে অক্সিজেনের অভাবে ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেই ওর মা-বাবার কি দুশ্চিন্তা। ওর দিদি তো কাঁদতে শুরু করেছিল।
এত বছর পরেও দৃশ্যগুলো পর্দার শোয়ের মতন দেখতে পাচ্ছে সৃজিতা। প্রিয় বাবা এখন পরপারে, থাকার মধ্যে শুধু মা।
চোখ থেকে বড় বড় ফোঁটায় জল পড়ছে সৃজিতার।
-কি হল সৃজি, কাঁদছো কেন? আমি তো তোমাকে তেমন কিছু বলিনি। কালকেও ওয়েদার ভালো ছিল। আজ বৃষ্টি হবে কে জানত?
নির্ঝরের বুকে মুখ গুঁজল সৃজিতা।
-কী হয়েছে না বললে আমি বুঝবো কী করে?
কান্নার দমক বাড়ে সৃজিতার।
-মায়ের কথা মনে পড়ছে?
-হু..
কাঁদতে কাঁদতে বলল সৃজিতা।
-বাড়িতে ফেরার পর একবার ঐ বাড়ি যাবে?
-যাব।
-যদি তোমার মা ফিরিয়ে দেয়।
-তবুও একবার যাব।
-বেশ যাব। আমরা তিনজনেই যাব। খুশি?
-হু..
মুখ গুঁজেই বলল সৃজিতা।
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_চব্বিশ
রাত ভোর বৃষ্টির পর আকাশ সবে একটু ফর্সা হয়েছে। সূর্যের দেখা তখনো মেলেনি। হোটেলের সকল সদস্যেরা বিরক্ত হচ্ছে। ঘুরতে এসে গৃহ বন্দী হতে কোন পর্যটকের ভালো লাগে..
কালকেই ফিরে যাবে সৃজিতারা। আজকের দিনটাই কোথাও বেরতে না পারলে ঘুরতে আসা মাটি।
সংযুক্তাও রুমে পায়চারি করছে। আর ওদের দুই পরিবারের দিকে সজাগ লক্ষ্য রাখছে তীর্থঙ্কর।
সকালে সেভিং করতে করতে আয়ানার প্রতিবিম্ব হাসছে.. হেসে হেসে জিজ্ঞাসা করছে ঠিক কী কারণে তীর্থঙ্কর আজ গ্যাংটকে?
যদি মা-মেয়ের বিচ্ছেদ চিরস্থায়ী করা বা চির জীবনের করা তীর্থঙ্করের লক্ষ্য হয়..তাও কি শান্তি পাবে ? এখনো কীসের আশায় ছুটছে ও? বাজারে হৈমপ্রভার দুর্নাম করাই কি ওর প্রধান লক্ষ্য?
চোখ নামিয়ে নিয়েছিল তীর্থঙ্কর। নিজ প্রতিবিম্বকে উত্তর দেওয়ার সৎ সাহস ওর ছিল না।
***
মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে সাথে নিয়ে ছ্যাঙ্গু লেকের উদ্দেশ্যে বেরল সৃজিতারা। ঐ দিকে আজ আর হোটেলে থাকতে চাইলো না বুবাই। হৈমপ্রভাকে সাথে নিয়ে ওরাও বেরল। শুধুমাত্র তীর্থঙ্করের জাসুস সঠিক খবর দিতে না পারার জন্য ঘরেই থাকল তীর্থঙ্কর। অনেক পরে খবর পেয়ে মাধবকে গালমন্দ করল। উৎকণ্ঠা নিয়ে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করল।
***
সাইকেল থেকে পড়ার পর চিৎকার করে উঠেছিল রুকু। ভয়ে লজ্জায় শুকিয়ে গিয়েছিল তিনু। প্রেম শুরু হওয়ার আগেই না শেষ হয়ে যায়। নিজের আঘাতকে ভ্রুক্ষেপ না করে উঠে দাঁড়াল। তারপরেই রুকুকে আলতো ভাবে তুলল।
-কোথায় লেগেছে? বল বল..
কুনুই দেখাল রুকু। চোখে টসটস করে জল ঝরছে।
কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী তিথি। চারিদিক অর্ধেক চাঁদে সামান্য আলোকিত। সেই আলোকে রুকুর ক্ষত দশ্যমান হল না। তবুও মর্মাহত হল তিনু।
-আহা রে! কতটা লেগেছে..গেদে লাগছে বল?
ঘাড় নাড়ালো রুকু।
-বালি ছিল বুঝতে পারিনি। আমার গেদে খারাপ লাগছে।
আর কিছু বলল না রুকু। মনে মনে তিনুকেই দুষছে।
-তোকে রাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব?
-না ঘরকে চলো..
রুকুর গম্ভীর স্বরে ভয় পেল তিনু।
গায়ের বালি ঝেড়ে সাইকেল তুলল। মাথায় যন্ত্রণা করছে। হয়ত কেটে ছিঁড়ে গেছে। ক্ষত চিহ্নিত করার সময় তিনুর কাছে নেই।
বাজছে বল?
-নাআআ..
সাইকেল চালাতে শুরু করল তিনু। আবার কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করল..
-বল না..তোর কি গেদে বাজছে?
-না ঘরকে চলো..আজ কপালে শনি নাচচে..
এক ফোঁটা তরল রুকুর হাতে পড়ল। বৃষ্টি ভেবে ভুল করল রুকু। যেতে যেতে আবার এক ফোঁটা। ডান হাত দিয়ে তরল স্পর্শ করল। চ্যাটচ্যাট করল..
-তোমার কোথায় বেজেছে?
-জানি না..
-সাইকেল থামাও..
-কেন?
-থামাও..
সাইকেল থামাল তিনু। রড থেকে নেমে তিনুর দিকে তাকাল। তারপর কপালে হাত দিতেই চিৎকার করে উঠল তিনু।
-এ তো রক্ত!
**
ছ্যাঙ্গুতে এসে স্মৃতি রোমন্থন করছে সৃজিতা। যাদের অবয়ব চোখে ভাসছে, তারা মাত্র দশ-পনেরো হাত দূরেই অবস্থান করছে। থিকথিকে ভীড়ের কারণে কেউ কাউকে দেখছে পাচ্ছে না।
সৃজিতা ছেলেকে নিয়ে ইয়াকের পিঠে চাপল। ঠিক সেই সময় সংযুক্তারা ওদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বারো বছর আগেও দুই মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সাথে এসেছিল হৈমপ্রভা। তার ছয়মাসের মধ্যেই স্বামী মারা যায়।
-একজন এই পৃথিবীতে নেই। আর একজন কাছে নেই।
বিড়বিড় করল হৈমপ্রভা।
আজ বুকের ভিতরটা খালি খালি অনুভব করছে।
ছ্যাঙ্গুর অপরূপ সৌন্দর্য আস্বাদন করে
সংযুক্তাদের গাড়ি ছাড়ার দশ মিনিট পর নির্ঝরদের গাড়ি ছাড়ল।
গাড়িতে উঠে হৈমপ্রভার শরীর আনচান করে উঠল। সেই সঙ্গে মাথা ব্যথা। উপলব্ধি করল এই বয়েসে পুরী-সবজি খেয়ে পাহাড়ি রাস্তায় ওঠা ঠিক হয়নি।
মন ও শরীর এই দুইয়ের কষ্টে নাজেহাল হয়ে উঠল হৈমপ্রভা সান্যাল। মাথা নিচু করে বসে রইলো।
-দিনদিন তোমার কী হল?
জানালা থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো সংযুক্তা।
-মা তোমার কষ্ট হচ্ছে। দাদা সাইডে গাড়ি থামান..
পাহাড়ি সংকীর্ণ রাস্তায় একটু জায়গা দেখে গাড়ি থামাল ড্রাইভার।
গাড়ি থেকে নেমেই হড়হড়িয়ে বমি করল হৈমপ্রভা।
সৃজিতাদের গাড়ি চলছে। জানলার ধারের পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যাচ্ছে ও।
সংযুক্তাদের গাড়ি পেরিয়ে যেতেই রাস্তার ধারের তিনজনের জটলা চোখে পড়ল।
তিনজনকেই চেনা ঠেকল ওর দুই চোখে।
-মা!
অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল সৃজিতা।
ওর কন্ঠস্বর নির্ঝরের কানে পৌঁছালো না।
-নির্ঝর মা! গাড়ি থামাও..
-কী!
-মা ওখানে। আপ গাড়ি রুকিয়ে, মুঝে জানা হোগা।
সিট ছেড়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করল সৃজিতা।
-কোথায় তোমার মা?
-গাড়ি থামাও এখুনি। নাহলে আমি এখান থেকে ঝাপ দেব। মায়ের কিছু একটা হয়েছে। আমাকে যেতে হবে..
-আচ্ছা থামাচ্ছে। কোথায় দেখলে বলো..
-আরে গাড়ি থামাচ্ছে না কেন, এবার অনেক পিছনে ছুটতে হবে আমাকে।
চিৎকার করল সৃজিতা।
চলবে: