#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_নয়
এক আকাশ ভালোলাগা ও বেশ খানিকটা বিষণ্নতার দোলাচলে দুলছিল সৃজিতা। আগত সন্তানের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করল। কলপাড়ের দিকে এগিয়ে গেল সৃজিতা। চোখ মুখে জল ছিটালো।
নির্ঝর আসার আগে ও নিজেকে সাজিয়ে তুলবে। আজ যে ওদের আনন্দের দিন। বিশেষ ভাবে উৎযাপন করবে ওরা দুজন।
সেইমত আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করল। বিয়ের পর নির্ঝরের প্রথম কিনে দেওয়া নীল শাড়ি পরিধান করল সৃজিতা। কপালে দিল নীল টিপ।
ভাগ্যের কী পরিহাস! যাদের শোরুমে লাখ টাকার শাড়ি বিক্রি হয়, যে কখনো পাঁচ হাজারের নিচে শাড়ি পরেনি, সে আজ পাঁচশো টাকার শাড়িতে খুশি থাকছে..
***
পরের দিন:
বড় একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সোনার অফিসে প্রবেশ করল নির্ঝর। তখনো তীর্থঙ্কর ফ্যাক্টারিতে আসেনি। প্রতিদিন অবশ্য আসেও না..আবার অনেক সময় অতর্কিত হানা দেয়। আজ বুধবার, আজ আসার সম্ভবনা প্রবল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিল নির্ঝর। ঠিক তখুনি তীর্থঙ্করের সাথে মুখোমুখি হল।
-নির্ঝর যে! এখানে কেন?
-গুড মর্নিং স্যার।
-গুড মর্নিং। একটা কথা ছিল..
বলে মিষ্টির প্যাকেটটা তীর্থঙ্কর দাশগুপ্তের হাতে দিল।
-এটা কীসের জন্য?
শ্রদ্ধায় মাথা ঝুঁকে এল নির্ঝরের। পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
-এই ওঠো ওঠো। কী সুখবর শোনাবে বলো।
-আপনি দাদু হতে চলেছেন..
নির্ঝরের গালে লালচে ছোপ।
-সকাল সকাল খুব ভালো খবর শোনালে নির্ঝর। সৃজিতা ভালো আছে তো?
-হ্যাঁ ভালো আছে।
-কে আছিস..দুই কাপ চা আমার ঘরে এনে দে। কেবিনে এসো নির্ঝর।
নির্ঝর তার প্রভুকে অনুসরণ করল।
নির্ঝর বেরিয়ে যেতেই কোনো একটা ভাবনায় বিচলিত হয়ে পড়ল তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত।
**
দিন পনেরো পর:
-মা শুনেছো তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত শাড়ির নতুন শোরুম খুলছে।
সংযুক্তার কথা কানে গেলেও কোনো উত্তর দিল না হৈমপ্রভা। ভাবখানা এমন যেন কোনো কথা কর্ণ গহ্বরে প্রবেশ করে নি।
মাসের শেষের ফ্যাক্টারির হিসাব মেলাচ্ছিল।
-ও মা শুনছো ঐ লোকটা শাড়ির শোরুম খুলছে। শাড়ির কী বোঝে বলো তো?
-শুনলাম।
মুখ না তুলে উত্তর দিল হৈমপ্রভা সান্যাল।
পরের কথা উচ্চারণ করার ইচ্ছে চলে গেল সংযুক্তার। খবরটা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে মাকে বলতে এসেছিল। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল ও। চাইলেও আবার ফিরে যেতে পারল না। বাবার প্রতিমূর্তির দিকে তাকিয়ে রইলো ও। হাসিমুখে বাবাও যেন ওকেই দেখছে। বাবার মৃত্যুর পর মা যেন ইস্পাতে পরিণত হয়েছে।
আবার মায়ের দিকে তাকালো সংযুক্তা। তখনো মাথা নিচু করে হিসাব মেলাচ্ছেন তিনি।
-আমি যাই, ছেলেটা এবার কাঁদবে।
এবার নিরাশ হয়ে চলে যাচ্ছিল সংযুক্তা।
-যা বলতে এসেছিলে বলে যাও।
মাথা নিচু করেই বলল হৈমপ্রভা।
বলার ইচ্ছেটা মরে গেছিল সুংযুক্তার। তবুও বলতে হল,
-খবরটা তোমার জামাই দিল। পাকা খবর। আমি শুধু ভাবছি সেই লোকটা শাড়ির কি বোঝে যে আমাদের মতন শোরুম খুলছে।
-শত্রুকে কখনো হাল্কা ভাবে নিও না। বরঞ্চ ও যেন আমাদের ছাপিয়ে যেতে না পারে সেটা লক্ষ্য রাখো। আরো নতুন নতুন ডিজাইন খোঁজো। ব্লসমের দায়িত্ব তোমার উপর ছেড়েছি। সেটাকে ভালো করে দেখো।
-সে তো দেখি মা।
-বুবাইকে দেখাশোনার জন্য লোক আছে। এবাড়িতে আছে, তোমাদের ঐ বাড়িতেও আছে। ঐ বাড়ির লোকেদের আপত্তি নেই। তুমি সপ্তাহে তিন দিন যেতেই পারো।
-দুই দিন যাই তো। বেশ অনেকক্ষণ থাকিও।
-সেটা সপ্তাহে তিন-চারদিন করার চেষ্টা করো।
মায়ের আদেশ বেশ ভারী ঠেকল সুংযুক্তার কাছে। বিরক্ত হল ও।
-তাই করবো..
দায়সারা ভাবে উত্তর দিয়ে চলে যাচ্ছিল সুংযুক্তা। দরজা অব্দি গিয়েও মায়ের দিকে ঘুরে তাকালো ও।
-ঠিকই বলেছো মা। শত্রুকে কখনো হাল্কা ভাবে নিতে নেই। হয়তো বোনই তীর্থঙ্কর দাশগুপ্তের নতুন শোরুম সামলাবে। তখন লড়াইটা কঠিন হয়ে যাবে।
প্রত্যুত্তরের আশায় না থেকে এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে গেল সংযুক্তা।
মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল হৈমপ্রভা সান্যাল। ভ্রু যুগল নিকটবর্তী হল। সুযোগ পেলে কেউ আর কথা শোনাতে ছাড়ছে না। ছোট মেয়ের জন্য আর কত ভাবে অপদস্ত হতে হবে কি জানি। বড় মেয়ের জন্মের পর দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হওয়ার সময় ভ্রণজ সন্তানকে পুত্র রূপে কামনা করেছিল । সব আশায় জল ঢেলে সৃজিতার জন্ম হয়েছিল। সদ্যজাতের থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল হৈমপ্রভা। ওর স্বামী প্রথম কোলে নিয়েছিল একরত্তিটাকে। বরাবর সৃজিতা ছিল বাবার মেয়ে। হৈমপ্রভা সুংযুক্তার ব্যপারে অন্ধ ছিল। তাই বলে কনিষ্ঠাকে ভালো কি বাসতেন না? তাও কি হয়! জন্মদাত্রী কি নিজ সন্তানকে না ভালো বেসে থাকতে পারে। শুধুমাত্র স্নেহে আঠেরো-বিশের তারতম্য ছিল।
-সুজি কত দিন হয়ে গেল তুই ঘর ছাড়া। আমাকে ছেড়ে বেশ ভালোই আছিস বল? হ্যাঁ রে একবারো কি আমার কথা মনে পড়ে না? মাকে ভালোবাসিস না বল?
আবারো চোখ ভিজল হৈমপ্রভা সান্যালের।
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_দশ
সকালে সোনার ফ্যাক্টারীতে ঘুরে আসা ইস্তক তীর্থঙ্করের মনটা অশান্ত। সৃজিতার গর্ভবতীর খবরে প্রথমে খুশি হলেও পরক্ষণেই অস্থির হয়ে উঠল। সন্তান জন্মানো একটা সুখের বিষয়। এই সুখ সেতুকে অবলম্বন করে যদি মা মেয়ের মিলন ঘটে? হৈমপ্রভা নির্ঝরকে জামাই হিসাবে মেনে যদি কোম্পানির কোনো দায়িত্ব দেয়? তাহলে কী হবে? নির্ঝর পরিশ্রমী, ভালো মতন কাজ করে। তবে বাজারে খুঁজলে ওমনি দশটা নির্ঝর পাওয়া যাবে। তাই চলে যাওয়াটা কোনো ব্যপার না। মা-মেয়ের সম্পর্ক পুনরায় জুড়লে তীর্থঙ্করের হার হবে। হৈমপ্রভার কাছে পুনরায় হারবে না। মা-মেয়ের সম্পর্কে আরো ভাঙন ধরাতে একটা যুতসই উপায় বের করল। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে এখন শিখে গেছে তীর্থঙ্কর।
***
কাজ সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছিল নির্ঝর। টিফিন বক্সটা পিঠের ব্যাগে ঢোকাল। হেলমেটটা যথাস্থানে রেখে দিল। জলের বোতলটা থেকে কিছুটা জল খেয়ে ব্যাগে রাখল। গত কয়েক মাসে ওর জীবন-জীবিকার মধ্যে অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে। কর্পোরেট অফিস ছেড়ে কারখানায় এসে পড়েছে। চিৎকার করে, জোর গলায় কাজ করাতে হয় শ্রমিকদের..চোখের আড়াল হলেই সকলে ফাঁকি মারে। প্রতিদিনের টার্গেট পূর্ণ হয় না। এখন গালিগালাজ মুখে আনতে হচ্ছে। নাহলে ওদের বাগে আনা যাচ্ছে না। সাড়ে পাঁচটা থেকে উশখুশ করে নির্ঝর। সব গুছিয়ে পৌনে ছয়টা থেকে অপেক্ষা করতে থাকে। ছয়টার সাইরেন বাজতেই ফ্যাক্টারী থেকে বেরিয়ে পড়ে। সেদিনও তাই করছিল। এক কর্মচারী এসে ওর রাস্তা আটকালো..
-আপনাকে বড় স্যার ডাকছে?
-কে??
নির্ঝরের অবাক হওয়া দেখে ছেলেটা হতবাক হল।
-বড় স্যার গো। কারখানার মালিক..
-স্যার!? কেন?
এবার কিঞ্চিত ভয় বুকে রেখে হতবাক হল।
-আমি কী করে জানব? আমি যাই..আমার সিফ্ট শেষ।
কাজ শেষে বাড়ি ফেরার জন্য একটা টান তো ছিলই, কিছু মাসে সেটা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন প্রিয়তমার জন্য সর্বদা অস্থির হয়ে থাকে। এই বুঝি কোনো শরীর খারাপ হল, এই বুঝি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল। পেটেরটার জন্য চিন্তাটা বেশিই হয়।
অনেকটা বিরক্তি আর বেশ কিছুটা ভয় মনে নিয়ে তীর্থঙ্কর দাশগুপ্তের কেবিনের দিকে গেল।
-স্যার আসবো?
কাঁচের দরজা ঠেলে জিজ্ঞাসা করল নির্ঝর।
-হ্যাঁ এসো এসো। আমি তোমার অপেক্ষায় বসে আছি।
তীর্থঙ্করের হাসিমুখ দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল নির্ঝর। যাক, তাহলে ও কোনো দোষে দুষ্ট নয়।
-হ্যাঁ স্যার বলুন..
নির্ঝরের অভিমুখে তাকাল তীর্থঙ্কর।
-তুমি এত টেনশন নিচ্ছ কেন? তেমন কোনো ব্যাপারই না। আমি এমনিই কথা বলার জন্য ডাকলাম।
“কেন স্যার, যাওয়ার সময় কেন আটকালেন। আমার সৃজি দুশ্চিন্তা করবে”
মনে মনে উচ্চারণ করল নির্ঝর।
-সকালে সুখবরটা শুনে আমি আমি ইমোশোনাল হয়ে পড়েছি। সৃজিতা নিজে কত ছোট, ওর আবার বেবি হবে।
চওড়া হাসল তীর্থঙ্কর। ওর কথায় লজ্জা পেল নির্ঝর।
-আজ রাতে কি তোমাদের কোথাও যাওয়ার আছে?
-না স্যার। কেন বলুন তো?
-তোমাদের বাড়ি যেতাম। সৃজিতার সাথে দেখা করতে..
দুই চোখ বিস্ফোরিত হল নির্ঝরের। ফ্যাক্টারীর মালিক বলে কী!
-সত্যি স্যার?
-শতকরা সত্যি..ওখানে আজ ডিনার করব।
ভিতরে ভিতরে শুকিয়ে গেল নির্ঝর। অত বড় মাপের মানুষকে কীভাবে আপ্যায়ণ করবে। বসতে দেবে কোথায়?
নিজের মনের অবস্থাকে গোপন রেখে আবার মুখে হাসি টেনে বলল,
-এটা আমার কাছে ভালো খবর। সৃজি শুনলে খুব আনন্দ পাবে। স্যার তাহলে কটা নাগাদ যাবেন..
-ঐ সাতটা অথবা সাড়ে সাতটার দিকে..নয়টার মধ্যে ডিনার করব। এই অবস্থায় সৃজিতারও বেশি দেরি করা উচিত নয়।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল নির্ঝর। তারপর আসছি বলে পিছন ঘুরল।
-এই নির্ঝর মেইন কথাটা বলতে ভুলে গেছি?
-আবার কী কথা স্যার?
নির্ঝরের কন্ঠে হতাশা। সেই হতাশা প্রকাশ পেল তীর্থঙ্করের কাছেও..নিজের অভিব্যক্তি, অন্তরে অবস্থা কারুর কাছে গোপন রাখতে পারেনা, মুখে চোখে প্রকাশ করেই ফেলে। এমনই একজন মানুষ।
স্মিত হাসল তীর্থঙ্কর।
-বাড়ি গিয়ে একবার সৃজিতার সাথে কথা বলিও..ভুলে যেও না।
তীর্থঙ্কর এমন উচ্চ স্থানে অধিস্থিত যে তার কাছ থেকে সরাসরি কারণ জানা যাবেনা। কৌতূহল দমন করে বাইরের রাস্তা ধরল।
-সৃজিতা যা খেতে চায় তাই খাওয়াবো। কিনে নয়, আমার কুককে দিয়ে রান্না করাব। আমি খাবার নিয়ে গিয়ে তিনজনে এক সঙ্গে খাব।
-স্যার তা কী হয়? আমার ঘরে যাচ্ছেন..
-অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে সৃজিতা চিন্তা করবে। তুমি কথা না বাড়িয়ে বাড়ি যাও। এমন শুভ দিনে তোমার জন্য আমিও একটা সুখবর তুলে রেখেছি। সৃজিতার কাছেই বলব। এখন যাও।
কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে পায়ের গতি বাড়াল নির্ঝর। মনে একটাই প্রশ্ন..
“স্যার সত্যিই আমার বাড়ি যাবে?”
চলবে: