আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-২৪+২৫

0
1185

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২৪।
ইজহান মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। শ্যামা বলল,

” আ.. মি য.. দি কখনো কনসিভ করি তখন?”

ইজহান খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,

” তুমি কনসিভ করেছো?”

কিছুটা গম্ভীর শুনালো ইজহানের কন্ঠ। শ্যামা আমতাআমতা করে বলল,

” এমা না.. না.. তেমন কিছু না। আমি শুধু জানতে চাইছি, যেহেতু আমরা একটা কন্ট্রাকের মাঝে আছি! সেখানে কোথাও লিখা ছিলনা এ বিষয়ে তাই আর কি…!”

গাড়িটা জোরছে ব্রেক কসে ইজহান ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকালো শ্যামার দিকে। শ্যামা ভয় পেয়ে গেলো একদম। ইজহানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। ইজহান গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” নামো..!”

শ্যামা বুঝতে পারলো না। লোকটা কি রেগে গিয়ে অর্ধেক রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে যাবে নাকি? সে বলল,,

” হুমম!”

ইজহান আবার বলল,

“গাড়ি থেকে নামো!”

শ্যামা অবাক হয়ে বলল,

” কিন্তু কেন?”

ইজহান চোখের ইশারায় বাহিরে তাকিয়ে বলল,

” বাড়ি এসে গেছে তাই!”

শ্যামার জানে জান এসে গেলো যেন। বাহিরে এক ঝলক তাকালো, কখন বাড়ির বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে গাড়ি বুঝতেই পারেনি ইজহান। শ্যামা হাসার চেষ্টা করে বলল,

” ওহো হ্যাঁ বাড়ি.. বাড়ি এসে গেছি…!”

বলে গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে গেলো শ্যামা। এদিকে শ্যামা যেতেই ইজহান হাসলো। মনের কোনে দমিয়ে রাখা এক্সপ্রেশন বেড়িয়ে এলো এবার। চট করে ফোন বের করে অধিরাজকে কল করলো। অধিরাজ ফোন তুলতেই শুনতে ফেলো তার বসের খুশিতে গদগদ হওয়া কন্ঠ। ইজহান বলল,

” আধিরাজ… আমি.. আমি মনে হচ্ছে বাবা হতে চলেছি। আমি.. আমি কি করবো? বলো তো? বাচ্চার জন্য খেলনা কিনবো আগে? না দৈনন্দিন সামগ্রিক? না না? আগে ডাক্তার দেখাই? কি বলো? আরে কথা বলছো? না যে? বলো কিছু! আমি কি করবো?”

অধিরাজ ইজহানের প্রতফুল্লো কন্ঠ শুনে কি বলবে বুঝতে পারছেনা। সে ধাতস্থ হয়ে বলল,

” স্যার আপনি শান্ত হোন আগে! আপনি কি শিউর? ”

ইজহান বলল,

” নাহ্ তবে.. শ্যামা বলল, কনসিভ এর কথা। হুট করে এমনিতে বলবে না সে তাই না?”

অধিরাজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” স্যার তাহলে বরং আগে চেক-আপ করিয়েন।”

ইজহান মাথা নাড়লো,

” তাই হবে!”

বলেই গাড়ি থেকে সে-ও নেমে পড়লো। এদিকে শ্যামা সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাচ্ছিলো। গেস্ট রুম ক্রস করতেই কিছু টুকরো কথার মাঝে তার নাম শুনে থমকে গেলো। কন্ঠের মালিক তার অচেনা। কিন্তু তার সাথের জনের কন্ঠ যে নিপার সে ভালোই বুঝতে পারছে..

” মেডাম স্যার যদি জানতে পারে, আপনার কথায় আমি এত বড় পাপ করেছি স্যার আমাকে মেরে ফেলবে।

অচেনা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো এবার,

” কেউ জানবে, ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি কাউকে বলবে না, এ বাড়িতে আমি এসেছিলাম? তাও যেন কেউ জানতে না পারে!’

এর পর নিপার কান্না কন্ঠ ভেসে এলো,

” স্যার জানলে আমাকে মেরে দিবে!”

” তুমি ভয় কেন পাচ্ছো? আমি আছি তো? তুমি যেভাবে শুরু থেকে আমার কথা মত চলেছো তেমনি চলো না।”

” আমার এবার ভয় করছে, যদি তারা জানতে পেরে যায়?”

“তুমি শুধু৷ ভয় পাচ্ছো কেউ জানবে না। শ্যামাকে এই ঔষধ খাওয়াতে থাকবে প্রতিদিন। ধীরে ধীরে ওর শরীরের অঙ্গ পতঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিবে। শুধু আর কিছু মাস।”

এইটুকু শুনতেই লোম দাঁড়িয়ে গেলো শ্যামার শরীরের। জট জলদি রুমের দরজা ধাক্কিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই আর কাউকে পেলো না শ্যামা। শ্যামা অবাক হয়ে গেলো। নিপা ছাড়া কেউ নেই ঘরটিতে। শ্যামা রাগে তেরে গিয়ে নিপাকে বলল,

” কে ছিলো এখানে?”

নিপা শুকনো ঢুক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল,

“কেউ না মেডাম। কেউ ছিলো না।”

শ্যামা আরো কিছু বলতে নিবে তার আগেই আলিয়ার চিৎকার শোনা গেলো। শ্যামা দৌড়ে সেখানে যেতেই দেখতে পেলো, মাটিতে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আলিয়ার নিথর দেহ সিঁড়ির নিচে পড়ে আছে। শ্যামা এক চিৎকার দিয়ে দাদিজান বলে নেমে এলো আলিয়ার কাছে। অালিয়ার হুশ নেই। ইজহান গাড়ি পার্ক করে ফোনে কথা বলতে বলতে মাত্র ঢুকছিলো। দাদির এই হাল দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। কাছে এসে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল ইজহান,,

“দাদিজান? কি হয়েছে? কিভাবে হলো এমন? উঠুন!”

কোনো ফায়দা হলো না। রা নেই আলিয়ার মুখে। ফর্সা মুখে রক্তে মাখা মাখি। শ্যামা ইজহানকে উদ্দেশ্যে বলল,

“হসপিটালে নিতে হবে! নয়তো অনেক দেড়ি হয়ে যাবে, অনেক রক্ত বেড়িয়ে গেছে।”

ইজহানের চোখে জল। স্তম্ভিত সে, মার পরে দাদিজান তাদের সামলেছে। তাদের জন্যই তো তার পছন্দের রাজনৈতিক কাজ সব ছেড়ে দিয়ে তিন নাতি, নাতনিকে মানুষ করতে লেগে পড়েছে। আলিয়ার এ অবস্থা দেখে ইজহান ভেঙেই পড়েছে যেন। শ্যামা তাই দেড়ি না করে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে। আরেক জন কাজের মহিলার সাহায্যে গাড়িতে তোলে। ইজহান জমে গেছে একেবারে। শ্যামা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

“ইজহান দাদিজানের হাসপাতাল যাওয়া জরুরি, নয়ত..! বুঝতে পারছো তো?”

ইজহান শ্যামার দিকে তাকিয়ে বলল,

” দাদিজান বেঁচে যাবে তো?”

শ্যামা মাথা নেড়ে বলল,

“ইন শা আল্লাহ! ”

——-

হসপিটালে…

ইজহান করিডরে বসে আছে। আয়ানা ভাইকে জড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আরমান তার উল্টো পাশে বসে আছে। জান্নাত শ্যামার সাথে দাঁড়িয়ে আছে৷ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। অপারেশন এখনো চলছে। অধিরাজ অন্য পাশে বসে আছে। শ্যামা ইজহানের দিকে নিস্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি বরাবরই চাপা স্বভাবের এখন আরো চুপ চাপ হয়ে গেছে। আয়ানা ইজহানকে ধরে বার বার বলে যাচ্ছে,

” দাদা ভাই.. দাদিজান ঠিক হয়ে যাবে তো? এমন কেন হলো উনার সাথে?”

ইজহান কিছু বলতে পারলো না। শুধু বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে যেতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর ওটির দরজা খুলে সাদা ঝকঝকে পোশাকে একটি ছেলে বেড়িয়ে এলো। বলল,

“o+ ব্লাড লাগবে। এই মুহূর্তেই।”

চকিতে শ্যামা বলল,

” আমার o+ আমি দিতে পারবো। ”

ডাক্তার তখন একজন নার্সকে ডেকে শ্যামাকে ব্লাড ব্যাংকে পাঠিয়ে দিলো। রক্ত দিয়ে শ্যামা যখন বেড় হলো তখনি একজনের সাথে ধাক্কা খেলো শ্যামা।

“আম সরি মা!”

একটি পরিচিত কন্ঠ শুনে শ্যামা চোখ তুলে তাকালো। ছিমছাম গড়নের মাঝ বয়সি মহিলাকে দেখে শ্যামা থমকে গেলো। মহিলা ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে। শ্যামা যখন ঠাহর করলো,,

” মা…! মা.. বেঁচে.. বেঁচে আছে!”

ভেবেই শ্যামা মহিলার পিছনে দৌঁড়ালো। সাথে চেচাতে লাগলো,

” মা.. মা.. মা দাঁড়া-ও….মা…!”

এত বছর পর নিজের মাকে এভাবে সামনে দেখবে ভাবেনি শ্যামা। শ্যামা তো তার মায়ে মরা মুখটি দর্শণ পর্যন্ত করতে পারেনি। আচ্ছা যদি আফিয়া মারাই না যেয়ে থাকে? তাহলে কি বাবা মিথ্যা বলল তাকে? নাকি এটি তার চোখের ভুল মাত্র?

শ্যামা নিজের সব ভাবনা ঠেলে দু তালার বাহিরে ফেলে আরো জোরে দৌঁড়াতে লাগলো। ঠিক তখনি সে থমকে গেলো………

চলবে,

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২৫।

বুকের ভিতর ভাড়ি অনুভব হচ্ছে। মাথাটাও ঝিম ঝিম করছে। পাশেই বসে আছে জান্নাত। হাত দুটি শক্ত করে ধরে রেখেছে বোনের। বার বার বলে যাচ্ছে,

” বড়পু সামলাও তুমি নিজেকে? তুমি না স্ট্রং ছিলে? ইউ আর ব্রেভ গার্ল!”

কোনো লাভ হলো না তাতে। শ্যামা কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

” মা জীবিত আমার সামনে ছিলো? অথচ সে… সে আমাকে চিন্তে পারলো না? কিভাবে?”

জান্নাত বলল,

” বড়পু… আমাদের মা সেই কবেই মারা গেছে, উনি আমাদের মা না। উনি এখন অন্যের স্ত্রী। ”

শ্যামা ফুপিয়ে উঠলো। জান্নাত তখনো স্বাভাবিক। হবেই বা না কেন? যখন তার মাকে খুব দরকার ছিলো, পরীক্ষার রাতগুলোতে যখন অন্য সব মেয়েদের মা পাশে থেকে সারা রাত তাদের খেয়াল রাখতো, মুখে তুলে খাইয়ে দিতো? বয়ঃসন্ধি সময় যখন মা-রা এত কিছু বুঝায়, পাশে থাকে। জান্নাতের বেলায় কিছুই হয়নি। এবং কি শ্যামা-ও থাকতো হোস্টেলে। শেষ পর্যন্ত তার বাবাই তাকে সাহায্য করে। সেদিন সে ধিক্কার দিয়েছিলো তার লোভী মাকে। এক মাত্র তারাই বুঝতে পারবে তার দুঃখ, যাদের মা তাদের ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যায়। জান্নাত গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে একে একে সব বললো। শ্যামা হতভম্ব হয়ে গেলো।

“আগে বলিস নি কেন এসব আমায়?”

” আমি সুযোগ পাইনি আপু!”

শ্যামা চোখের জলটুকু মুছে হাসলো। বলল,

” তার মানে.. ইজহানের দাদিজান যা বলেছিলেন, তার সব সত্য!”

জান্নাত কিছুই বলল না। কি বলার আছেই তার? শ্যামা এবার দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো বলল,

” এই জন্য-ই এত ঘৃণা করে আমাদের এই পরিবার? ”

তখনি চকিতে বলল জান্নাত,

“আপু তারা সবাই যদি ঘৃণা-ই করতো? তাহলে ইজহান ভাই কেন তোমাকে বিয়ে করলো?”

শ্যামা জান্নাতের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

” আমি জানি না। চল এবার যাওয়া যাক ওই দিকে!”

শ্যামা কথাটুকু এড়িয়ে গেলো পুরোপুরি। কিভাবে বলবে সে? যখন এদিক ওদিক ছুটেও বাবার চিকিৎসার টাকা সে পাচ্ছিলো না? তখন এই ব্যক্তিটাই তাকে সাহায্য করেছিলো। কিন্তু আফসোস তার বাবা… বেশিদিনের মেহমান ছিলেন না…!

কিছুক্ষণ পর…

ওয়ান্টাইম গ্লাসে চা নিয়ে এলো জান্নাত আর শ্যামা। ইজহানের চোখ এতক্ষণ তাকেই খুঁজে যাচ্ছিলো। শ্যামা বলল,

” তোমরা চা খেয়ে নাও, ভালো লাগবে!”

বলো একে একে এগিয়ে দিলো সবাইকে। শ্যামা মেহরাবের হাতে দিলো। উনি মায়ের খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন অন্য শহর থেকে তাই একটু দেড়িই বৈকি..! তারপর শ্যামা ইজহানের হাতে কাপ ধরিয়ে দিলো। ইজহান বিনা বাক্যে কাপ নিয়ে নিলো। এবং তার ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,

“কোথায় ছিলে তুমি?”

শ্যামা মুচকি হেসে বলল,

” এই তো সবার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করতে গেছিলাম!”

ইজহান বলল,

” আমার পাশে বসো!”

শ্যামা তাই করলো। ইজহান সাথে সাথে তার ঘাড়ে মাথা এলিয়ে দিলো। শ্যামার বুঝতে বাকি নেই ইজহানের মতো এত শক্ত পক্ত মানুষ একদম ভেঙে পড়েছে।

এদিকে জান্নাত আয়ানাকে চায়ের কাপ নিয়ে আরমানের কাছে যেতেই এক রাশ বিরক্তি নিয়ে নাক ছিটকালো। বিনা বাক্য অবজ্ঞা করে পাশের চেয়ারে রেখে চলে এলো। যেন এখানে আরমান নয়, কোনো রাক্ষস বসে আছে। তা দেখে আরমান হা হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো, ভার্সিটিতে করা রেগিং করাতে জান্নাত অনেকটাই রাগ করেছে তার উপর। কিন্তু তাতে তার কি? তবে এই মেয়ের আরমানের সাথে এমন ব্যবহার করার সাহস হয় কিভাবে? একে তো মজা দেখিয়েই ছাড়বে আরমান।


শ্যামা তিন তলার হসপিটালে দাঁড়িয়ে বাহিরটা দেখে নিয়ে চোখ বুঝলো। ভেসে উঠলো তার মায়ের অবজ্ঞা, অবহেলার কথা গুলো। ভেসে উঠলো কিছুক্ষণ আগের কথা গুলো। যখন শ্যামা দৌড়ে তার মায়ের কাছে গেছিলো, তার মা তাকে চিনতেই অস্বীকার করে দিলো। কিন্তু শ্যামা তার মায়ের মুখটা বার বার দেখে যাচ্ছিলো। ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। বলেছিলেন,

” সরি মা তুমি ভুল করছো! অন্যকারো সাথে হয়তো গুলিয়ে ফেলেছো আমাকে!”

শ্যামা আফিয়ার হাত ধরে বলেছিল,

” মা তুমি তোমার সন্তানকে কিভাবে চিন্তে পারছো না?”

“আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি, এত গায়ে পড়া কেন? আমার মা যখন বলছে সে তোমাকে চিনে তার পরেও এমন করছো? বুঝকে পেরেছি, টাকার লোভে এসব করছো তো? দাঁড়াও দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। ”

কথাটুকু বলল আফিয়ার পাশে থাকা একটা টিনএজ ছেলে। তার হাত বেন্ডেজ করা। হয়তো তাকেই নিয়ে এসেছিলো আফিয়া। শ্যামা ছেলেটির কথায় হা হয়ে গেলো। এর আগে কিছু বলবে তখনি ছেলেটি শ্যামাকে ধাক্কা দিয়ে বসে। এবং শ্যামা টাল সামলাতে না পেরে দু কদম পিছিয়ে পড়ে যায়। আফিয়া তখন ছেলেকে শাসন করে বলে,

“নিয়ন! এসব কি? সে তোমার বড় না? সে সরি?”

ছেলেটি তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে বললো,

” দুটাকার মেয়ে আমার মাকে কেড়ে নিতে চাও? নেক্সট টাইম সামনে এসো না গাড়ি চাপা দিয়ে দিবো!”

শ্যামা শুধু বিস্ময় নিয়ে নিচে পড়ে এদের কথা শুনছিলো। সেই মুহূর্তে-ই জান্নাত এসে বোনকে ধরে। নিজের মায়ের দিক এক পলক তাকায় সে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আফিয়ার চেহারা-ই যেন জান্নাতের মুখটিতে বসানো। তাই জান্নাত বার বার এই চেহারাকে ঘৃণা করে। জান্নাতকে দেখে আফিয়া-ও হা হয়ে গেলো। মায়ের দিক তীক্ষ্ণ দৃস্টিতে তাকিয়ে জান্নাত বলেছিলো,

” আপু? কেন ভুলে যাস, আমাদের মা মারা গেছে। উনি অন্য কেউ।”

আফিয়া অবাক হয়ে দেখেছে শুধু তার মেয়েদের। তখনি সেই টিনএজার তার মাকে টেনে নিয়ে চলে গেছে।

একটা ঠান্ডা আর পেশীবহুল শক্ত হাত শ্যামার কাঁধে পড়তেই শ্যামা চোখ মেলে যায়। পিছনে ফিরে ইজহানের বিষন্ন মুখটা দেখতে পায়। ইজহান এতক্ষণ শকডে ছিলো। দাদিজানের কেবিনের বাহিরেই ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। কিন্তু ডাক্তার যখন বলল,

“চিন্তার কারণ সেই,ডেঞ্জার কেটে গেছে। ২৪ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে আসবে।”

ইজহান সে সময় স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আয়ানা, আরমান, আর জান্নাতকে বাসায় পাঠিয়ে, সে শ্যামাকে এদিক ওদিক দেখতে না পেয়ে খুঁজতে লাগলো তাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে হাসপাতালের শেষ কর্ণারে বর্ডার ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্যামাকে। ইজহান সময় ব্যয় না করে চলে আসে। ইজহান বলল,

” কাঁদছো কেন?”

শ্যামা মাথা নাড়লো,

” কিছু না.. চোখে কি জানি গেছিলো, ঝাল পোকা হবে। খুব জোলছিলো আর কি! এখনি ঠিক হয়ে যাবে। ইজহান দাদিজান এখন কেমন আছে?”

ইজহান শ্যামার মুখের দিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবলো, কেন শ্যামা তার থেকে সব লুকিয়ে বেড়ায়? কেন? শ্যামাকি বুঝতে পারে না? ইজহান তার সব দুঃখ কষ্ট মুছে দিতে চায়,? কিন্তু প্রতিবার-ই সে আরো কষ্ট দিয়ে ফেলে তার এক ফালি চাঁদকে। ইজহান সপ্তপর্ণে একটা শ্বাস লুফে নিলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“ভালো!”

তারপরেই আবার বলল,

” তুমি কিছু খেয়েছো?”

না করলো শ্যামা। এতক্ষন তো খুদার কথা বেমালুম ভুলে গেছিলো। ইজহানের কথায় যেন পেটের ভিতর ইঁদুর দৌড়াতে লাগলো। এর মাঝেই তার পেটের ভিতর ডেকে উঠতেই, শ্যামা লজ্জা লাল হয়ে গেলো। ইজহান বলল,

” রাত অনেক হয়েছে, ক্যান্টিন ও বন্ধ, চল বাহির থেকে কিছু খাওয়া যাক!”

শ্যামা বলল,

” কিন্তু দাদিজান?”

“সমস্যা নেই নার্স আছে তার সাথে”

“আচ্ছা! ”

এ বলেই তারা রাস্তায় বেড়িয়ে গেলো। মধ্যরাত। চারিদিকে নিস্তব্ধতায় মোড়া। শুধু শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা স্টেডিয়ামের হোলদে আলো।তাতে দেখা যাচ্ছে ইজহান আর শ্যামার রাস্তায় পড়া ছায়াটুকু। আবার কখনো এদিক-ওদিক ছুটে যাওয়া দু-একটা গাড়ি। শ্যামার রাতে শহর খুব পছন্দ। সুফিয়ানের সাথে রাতের শহর ঘুরবে বলে কত রকম প্ল্যান করেছিলো শ্যামা। যদিও তা শুধু স্মৃতিতেই। ইজহান কি ভেবে যেন গাড়ি নেয়নি। তাইতো.. তার সুবাদে রাতের শহর দেখতে পারছে সে। সেই সময় শ্যামা অনুভব করলো। ইজহান তার আঙুলের ভিতর শ্যামার আঙুল গুলো চেপে ধরেছে শক্ত করে। যেন শ্যামা ছুটে পালিয়ে যেতে না পারে। শ্যামা অবাক হয়ে দেখছে তখন ইজহানকে। ইজহান তখন মুচকে হেসে বলল,

” এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

শ্যামা হেসে বলল,

” আমার বরটাকে দেখছি!”

ইজহান এবার লজ্জা পেয়ে গেলো। এই প্রথম ইজহানকে লাজুক হাসতে দেখে শ্যামা হা হয়ে গেলো। ইজহান তা বুঝতে পেরেই বলল,

” পিঠা খাবে?”

শ্যামার ধ্যান ভাঙ্গলো। মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। ইজহান পাবলিক ফিগার হওয়াতে রাস্তায় হাটা, যখন তখন বেড়িয়ে, যাওয়া, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে খাওয়া, এসব কিছুই করতে পারতো না। কিন্তু এত রাতে শ্যামার সাথে এভাবে রাতে ঘুরতে পাওয়ার সুযোগ কিভাবে হাত ছাড়া করতো সে? তাই তো ইচ্ছে করে সঙ্গে গাড়ি আনেনি। তার যে এখনো মনে আছে, শ্যামার সেই দিনের কথা,

” জানো আমার রাতের শহর দেখার খুব শখ। যখন পুরো শহর ঘুমিয়ে থাকবে, আমি আর তুমি মিলে ঘুরবো, খালি পথ ধরে হাটবো। গরম গরম চা আর চিতই পিঠা খাবো আলুভর্তা দিয়ে!”

ইজহান প্রতি উত্তরে বলেছিল,

” যেমনটি আমার মহারানী চায়, তেমনটিই হবে! সব সময় এ বান্ধা হাজির থাকবে আপনার জন্য!”

এসব শুনে শ্যামা খিল খিল করে হেসে উঠতো।আর সেই হাসির শব্দ ইজহানের মন, প্রাণ সতেজতায় ভরে উঠতো।

আজো তার ব্যতিক্রম নয়…..

চলবে,