আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-২৯

0
1186

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২৯।

শ্যামা নিপাকে ঠাটিয়ে এক চর বসালো। রাগে শরীর কাঁপছে তার। সে চেচিয়ে বলল,

” একদম মিথ্যা কথা বলবে না, নয়তো, ইজহান তোমাকে কাজ ছাড়া করেছে, আর আমি তোমায় শহর ছাড়া করবো!”

নিপা ঘাবড়ে গেলো, গালে হাত দিয়ে মিনমিন করে বলল,

” মেডাম? আমি কেন মিথ্যা বলবো? স্যার আমাকে মেডিসিন দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, রোজ আপনাকে দিতে। আমি তো অতোটা শিক্ষিত নই, কিভাবে বুঝবো কোনটা সেটা বাচ্চা নষ্ট করার পিল ছিলো? ”

নিপার লাষ্ট কথা গুলোতে কান্নার স্বর স্পষ্ট। শ্যামা তার পরেও বিশ্বাস করছে না দেখে নিপা বলল,

” মেডাম আমি আমার সন্তানের কসম খাইছি, ইজহান স্যার আমাকে মেডিসিন এনে দিয়েছিলো! আর বলেছিলেন রোজ আপনাকে দিতে, তা কিসের ছিলো? আমি জানি না…! ”

শ্যামার মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি স্বরে গেছে। সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হলো। চোখ ভর্তি করে জল গড়িয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়লো শ্যামা। সত্যি… এসব কি সত্যি? ইজহান তার বাচ্চা নষ্ট করেছে। এই জন্যই? এই জন্য সে দিন য়খন ইজহানকে প্রেগনেন্সির কথা বলেছিলো, যে সে যদি কখনো প্রেগনেন্ট হয়? তখন কোনো ভাবান্তর ছিলো না মানুষটির মাঝে? এই জন্যই…!

শ্যামা এবার ল্যাংড়া তে লাগলো। গাড়ির পাশ কাটিয়ে আপন খেয়ালে হেটে চলে যেতে লাগলো সে অনির্দিষ্ট গন্তব্য….! পিছন থেকে ড্রাইভারের কথা-ও কানে এলো না। ড্রাইভার চিন্তিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আধিরাজকে কল করে।

এদিকে শ্যামা যেতেই নিপা হাসে। পকেট থেকে নোকেয়া ১২০০ মডেলের ছোট ফোনটি বের করে একটি নাম্বারে ডায়েল করে। ওপাশ থেকে রিং হতেই একটি মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে,

“হ্যালো… নিপা!”

” জ্বি মেডাম। আপনার কাজ হয়ে গেছে। .. যা আপনি বলেছিলেন? তেমনি হয়েছে৷ আমি শ্যামা মেডামকে সত্যি কথা বলে দিয়েছি..!”

বলেই মুচকি হাসলো নিপা। ফোনের ওপাশ থেকে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে বসে, মেয়েটি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। বলল,

” তোমার টাকা তোমার একাউন্টে চলে গেছে নিপা! এবার যেন এ-শহর না দেখি!”

” ওকে মেডাম!”

ফোন কাঁটতেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসে বলল,

” ইজহান তো তোমাকে ছাড়বে না, কিন্তু এত কিছুর পর? তুমি অবশ্যই ইজহানের জীবন থেকে নিজেই চলে যাবে। আর তারপর… অসহায়, ভেঙে পড়া ইজহানকে আমি সামলাবো, আদর করবো,তার সাথেই শুইবো!”

বলে খিলখিল করে হেসে উঠলো মেহরিন। বিড়বিড় করে আবার বলে,

“খেলা তো সেই কবেই শুরু হয়েছে, এবার শুধু বাউন্ডারির বাইরে ফেলা বাকি!”

বলেই অট্ট হাসিতে মেতে উঠলো। যেন রাজ্যকে রানী হারা করতে পেরে তার খুশির শেষ নেই।

এদিকে শ্যামা নিজের ভাঙ্গা মন নিয়ে হেটে হেটে চলছে রাস্তার ধারে। সাই সাই করে গাড়ি ছুটছে রাস্তার বুক চিঁড়ে। শ্যামার সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। ছোট থেকেই তার জীবনটা কেমন ছন্নছাড়া। বাবা মাকে কাছে পায়নি সে খুব একটা। যতটুকু পেয়েছে ছুটির দিন গুলোতেই। বাবা তার কাজে ব্যস্ত.. মা তার কাজে। তার পরে তো শ্যামা পড়াশোনার জন্য পারি জমালো হোস্টেলে। স্কুলে থাকাকালীন রিদকে পেয়ে শ্যামা নিজের একাকিত্ব ভুলে গেছিলো। কিন্তু সেই কি না তাকে ঠকালো। প্রথমবার প্রেম নাকি টিকে না.. অনেক বার শুনে ছিলো শ্যামা, কিন্তু মনে প্রাণে সে বিশ্বাস করতো! এই প্রেম ভালোবাসা টিকবেই। কত গর্ব করেছিলো শ্যামা। কিন্তু সে ভুল মানুষের হাত ধরে ফেলেছিলো। তাই নিজেকে যেভাবেই হোক সামলে নিয়ে গিয়ে আবারো আরো বার ভুল করে বসে। সুফিয়ানকে ভালোবেসে ফেলে। রাত জেগে আঁধারিয়া অম্বরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু কে জানতো? কে জানতো? শ্যামা এবারো ভুল করে বসবে? এর পরে কত গুলো বছর কেঁটে গেলো। সুফিয়ানের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে ছিলো শ্যামা। কিন্তঁ হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার মতো ইজহান এসে উপস্থিত হলো। হাজার কষ্টে দিলেও ইজহানের প্রতি বরাবরই টান অনুভব করতো সে। সে টান থেকে যে আবারো ভালোবাসার এক ফোঁটা গোলাপ তৈরি হবে? সে কি জানতো? সেই মানুষটি-ও কিনা এভাবে ঠকালো? কি চায় এই ব্যক্তিটি? কেন করছে এমন? যতবার কাছে যায় ততবার একটা করে ঘা বসিয়ে দেয় সে। শ্যামা আর ভাবতে পারলো না। রাস্তার ধারে বসে জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো। বুক ফেঁটে বেড়িবাঁধে কষ্ট গুলোর ঢল নেমে এলো। বিষন্ন মন বিষিয়ে উঠলো এক রাশ তেতো অনুভূতিতে। কেন কেন এসব তার সাথেই হচ্ছে? সে কি পারতো না? আর পাঁচটা মানুষের মতো সুন্দর জীবন অতিবাহিত করতে? সে কি পারতো না? একটা সুন্দর সংসার, হাসি খুশি পরিবার পেতে? সে পারতো না? একটা ভালোবাসার মানুষ পেতে? তাহলে কেন?

শ্যামার কান্নার বেগ বাড়ছে। সময়-ও গড়াচ্ছে যেন দ্রুত গতিতে… অফিসের সময় আজ শেষ হয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। ঠিক সে সময় একটি দামি গাড়ি এসে থামলো শ্যামার সামনে। হলদে লাল পারের শাড়ি পরে এক মধ্য বয়সি নারী এসে দাঁড়ালো শ্যামার সামনে। তার৷ কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তা দেখে শ্যামা তার লাল ফোলা চোখ মেলে চাইলো। কান্নার ফলে চোখে ঘোলা দেখছে এখন খুব। শ্যামা যখস বুঝতে পারলো, ব্যক্তিটি আর কেউ না, তার মা আফিয়া? সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। যদিও তার পা দুটি অচল, এদিক সেদিক পড়তে পড়তে দাঁড়ালো। মুখটি গম্ভীর করে বলল,

” কি জন্য এসেছেন? দেখতে? বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি? ”

আফিয়া শ্যামার এই হাল দেখে নিজেও কষ্ট পায়। সে শ্যামার হাত ধরে বলে,

“আমাকে ভুল বুঝিস না মা!”

“,মা? বাহ্? ওই দিন না চিনতেই পারলেন না? আপনার ছেলে আমাকে দু টাকা মেয়ে বলে গেলো। আর আজ,?মা। বিষয়টা কেমন হাস্যকর হয়ে গেলো না?”

আফিয়া লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নত করে ফেললো,

” আমার কোনো উপায় ছিলো না শ্যামা। আমি তো সারা জীবন মেহতাবকে ভালোবেসে ছিলাম। কিন্তু তোমার বাবা? তোমার বাবা আমার ফায়দা উঠায়। আমাকে মেহতাবের কাছে ভুল ভাল বলে আমাকে খারাপ করে ফেলে তার নজরে। আর তার পরেই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করে। ”

শ্যামা হতভম্ব। সে কাঠ কাঠ গলায় বলে,

” আমি কেন বিশ্বাস করবো আপনার কথা?”

আফিয়া হেসে বলে,

” না করারই কথা! যে মহিলা তার দুটি মেয়েকে ফেলে চলে যায়? তার কথা কেন বিশ্বাস করবে বলো? কিন্তু এটি-ই সত্যি। আমি চাইনি তোমাদের ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিলো তোমার বাবা। হ্যাঁ তোমার বাবা। যখন তার ব্যবসার অবনতি হচ্ছিলো? সে আমাকে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড করাতো তার পার্টনাদের সাথে। যখন আমি আওয়াজ তুলতাম? আমার উপর অত্যাচার চলতো। মানসিক, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতাম। আমার সাহায্য করবে কেমন কেউ ছিলো না। তাই আমি মেহতাবের কাছে যাই। সাহায্য চাই, ভিক্ষা চাই তার কাছে। আর সে সব কিছু তোমার বাবা যেনে ফেলেন। মেহতাবের বউ সানিয়া খুব সেনসিটিভ মানুষ ছিলেন। আজিজুল যা যা দেখিয়ে ছিলেন? তাই বিশ্বাস করে ফেলেন। তোমার বাবা সব কিছুর মিথ্যা ভিডিও ক্লিপ তৈরি করে পাঠায় সানিয়ার কাছে। আর তা সইতে না পেরে সানিয়া আত্মহত্যা করে।”

এইটুকু বলেই চোখের জল মুখে ফেললো আফিয়া। শ্যামা হতবাক হয়ে বসে রইলো রাস্তার ধারের উঁচু জায়গায়টায়। একদিনের মাঝে মেয়েটি আর কত সত্যির মুখোমুখি হবে? শ্যামা এবার শুকনো ঢুক গিললো,,

” এ সব… আগে কেন বলেন নি? ”

” কিভাবে বলতাম? তোমার বাবা জায়গায় বদলে ফেলেছিলো।”

” তাহলে জান্নাত যা দেখেছিলো?”

” তা অংশবিশেষ মাত্র!”

” তাহলে সিফাত ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ের কথা কেন বলেছিলেন?”

” চেয়েছিলাম তোমার লাইফটা সিকিউর করতে!”

শ্যামা ব্যথা ভরা মুখ নিয়ে হাসলো,

” আপনাদের দুজনের পিসাপিসিতে আমাদের দু বোনের জীবন ধংস হয়ে গেলো!”

আফিয়া অপরাধীর মতো মাথা নুইয়ে ফেললো। শ্যামা ভার মুখ করে বলল,

” আসি! ছেলের সাথে ভালো থাকবেন! ”

“আমাকে ক্ষমা করা দিও শ্যামা!”

শ্যামা আর দাঁড়ালো না রোবটের মতো হেঁটে চলে গেলো সে নিজ গন্তব্য। মাথার মধ্যে গিজগিজ করতে লাগলো সব ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো। সত্যি বাবা-মা যদি দু মেরুর হয়, সন্তানরাতো ভেসে যাবেই,। এসব ভাবতে ভাবতে এসে দাঁড়ালো ইজহানের রাজ প্রাসাধে। ঠিক সেই মুহূর্তে গর্জণ করে বেজে উঠলো মুঠোফোন। ফোনটি তুলতেই ইজহানের হাসি হাসি কন্ঠ ভেসে এলো,

” তুমি কি আমাকে মনে করেছো? আমার আজ বার বার তোমার কথা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে ছুটে চলে আসি!”

শ্যামা ফোনের এপাশ থেকে বিদ্রুপের হাসি হাসলো, শূণ্য দৃষ্টিতে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে বলল,

” হ্যা! করেছিতো খুব মিস করেছি!”

ফোনের ওপাশের মানুষটির মনের মাঝে কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। শ্যামার কি কিছু হয়েছে?

” তোমার কি মন খারাপ শ্যামা?”

“নাহ্! আমি তোমার সাথে সামনাসামনি কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, কবে আসবে তুমি?”

ইজহানের মন মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেলো। হাসি খুশি মুখটিতে নেমে এলো বিষন্নতার ঢল,

“খুব শীঘ্রই..!”

চলবে,