আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-১২+১৩

0
722

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১২

হৃদয়ে সৃষ্ট অনলের তীব্রতা কমে এল। প্রগাঢ় হয়ে এল তুলির কোমরে রাখা আদ্রের হাতের বাঁধন। প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে আদ্রর দিকে তাকাল তুলি। শুধু হাতের বাঁধন নয় নীলবর্ণ চোখ দুটোর দৃষ্টিও প্রগাঢ়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল তুলির আদ্রর মাদকতাময় নেশাক্ত আঁখিদ্বয়ে নিজের চক্ষুদ্বয় নিবদ্ধ করতেই। কানে ভেসে এল আদ্রর ঘোর লাগা কন্ঠস্বর,–‘ তুমি সর্বনাশী। ‘

‘সর্বনাশী’ শব্দটা তুলির কর্ণপাত হতেই চোখ ছোট ছোট করে চাইল। তুলি ঠাওর করতে পারছে না সে সর্বনাশী কীভাবে হলো। মনে মনে বলল,’ আমি কি আদ্রর কোনো সর্বনাশ করলাম? আদ্রর সাথে আমার পরিচয় তো কয়েকদিনের আমি কীভাবে সর্বনাশ করবো?সর্বনাশ তো এই লোক করেছে। আমার ছোট্ট মনটা এলোমেলো করে দিল।’

তুলির ভাবান্তর দৃষ্টি দেখে আদ্রের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি প্রস্ফুটিত হলো। মেয়েটার মনে নিশ্চয়ই সর্বনাশের বর্ণনা ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়ছে নয়তো মনে মনে আদ্র কে বকছে। তুলি কে নিচে নামিয়ে আদ্র নিজের চুল গুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি টা ঠিক করল। হাত ঘড়িটা টেবিলের উপর থেকে তুলে হাতে পড়ে নিল। আহাম্মকের মতো আদ্রর কান্ডকারখানা নিষ্পলক দেখতে লাগল তুলি, যা আদ্রর দৃষ্টি এড়ায় নি। আয়নাতে তুলির প্রতিবিম্ব ও চিন্তিত মুখখানা স্পষ্টত। তুলি একনাগাড়ে বিড়বিড় করছে-‘ আমাকে সর্বনাশী বলল কিন্তু কারণ বলল না। ডাক্তার সাহেবের মাথায় হাজারো প্যাঁচ। কিন্তু আমার কি হবে?আমি তো সহজ সরল, হালকা-পাতলা, কোমল তুলা।’

আদ্র দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে তুলির দিকে ঝুঁকে পড়ল। অন্যমনস্ক তুলি আচমকা আদ্র কে নিজের এতো কাছে অনুভব করতেই পিছনের দিকে ছিটকে পড়ল। বাঁকা হাসল আদ্র। টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস টা উঠিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু খেয়ে নিল। তুলির দিকে চেয়ে ভ্রুঁ উঁচিয়ে মৃদু ধমকের স্বরে বলল,

‘ এদিকে এসো!’

নিশ্চুপ হয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল তুলি। ধমকের চোটে দৌড়ে এসে আদ্রর সামনে উপস্থিত হলো। আমতাআমতা করে বলে উঠল,

‘ আমাকে ডাকছিলেন?’

তুলির বোকা প্রশ্নে আদ্র চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘ না আমার বউ কে ডেকেছি।’

‘ কেন?’

‘ আদর করার জন্য। ‘

তুলির একদম কাছে এসে কথাটা বলে উঠল আদ্র। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তুলির সারা মুখ আদ্রর বেপরোয়া লাগামহীন বাক্যে। চঞ্চল মনে জড়তা-সংকোচ এসে ভিড় জমাল। থরথর করে কাঁপছে পা দুটো। আদ্র হাত বাড়িয়ে কপালে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিল। হাঁটু মুড়ে তুলির শাড়ির কুঁচি গুলো ঠিক করে দিতে দিতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল,

‘ ছোট্ট একটা চুমু খেতে পারি তোমার নাভির পাশের কুচকুচে কালো তিলে?’

শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ অনুভব করল তুলি। দেহের প্রত্যেক টা লোম খাঁড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বুকে হাতুড়ি পেটা শব্দ বেড়েই চলেছে, যা আদ্রর কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অবলীলায়। কতটা সহজে এমনটা একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আদ্র!সে কি অনুভব করতে পারছে তুলির হৃদয়ের গহীনে হওয়া তোলপাড়। তুলি বুঝতে পারছে না আদ্র অনুমতি চাইল নাকি তুলির হৃদয়ের অস্বাভাবিক উঠানামা বাড়িয়ে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করল!নিজের বউয়ের কাছ থেকে অনুমতি চাইছে আদ্র বিষয়টা তুলিকে ভাবাচ্ছে। কিছু মুহুর্ত অতিবাহিত হতে না হতেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ল আদ্রর গম্ভীর স্বরে।

‘জবাবের অপেক্ষা করছি তুলা।’

তুলি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদ্রর দিকে। আদ্র যা বুঝার বুঝে গেল। ভেজা ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিল গভীরভাবে। দু চোখ বুঁজে এল তুলির। রাশভারি পলক ছুঁয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল আদ্রর হাতের পৃষ্ঠে। শাড়িটা ঠিক করে দিয়ে আদ্র উঠে দাঁড়াল। চোখের পানির ফোঁটা বহন করা হাত টা তুলির মুখের সামনে তুলে ধরে বলল,

‘ সুখের অশ্রু। তবুও সুখের অশ্রু টুকু আমি দেখতে চাই না। দেখতে চাই সর্বনাশী তুলার স্নিগ্ধময় নির্মল হাসি।’

সাথে সাথেই তুলির ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে গেল। মিনমিন স্বরে বলে উঠল,

‘ সর্বনাশী কেন?’

‘ কারণ “ভালোবাসি “বলে তুমি আমার সর্বনাশ করেছো। চার বছর আগেও করেছিলে। আজ আবার করলে। লাগামহীন করে দিলে,বেপরোয়া বানিয়ে ছাড়লে। সামলাতে পারবে তো তুলা?’

তুলি লজ্জিত ভঙ্গিতে আলতো হেসে বলল,

‘ বাহিরে যাবেন না?’

‘তুলা!’

আদ্রের আকস্মিক ডাকে তুলির হৃদয়ের কম্পন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। ইচ্ছে জাগল আদ্রর বুকে ঝাপিয়ে পড়তে। না ফিরেই নিচু স্বরে উত্তর দিল,

‘ জ্বি,,!’

‘ মানুষ জীবনে শুধু একবার নয় বহুবার প্রেমে পড়ে। আমিও পড়েছি, তোমাকে নিজের অস্তিত্বে মিশিয়েছি,ভালোবেসেছি।’

ধুক করে উঠল তুলির বুক টা। কথাটা তুলির মনে প্রশান্তি,বিষাদ দুটোই ছড়িয়ে দিল। তুলি আদ্রর চলে যাওয়ার দিকে অপলক চেয়ে রইল। তুলির তো খুশি হওয়ার কথা তবুও কেন মনটা আনচান করছে! না আর কিছু ভাববে না তুলি। আদ্র তার স্বামী। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে এই মানুষ টা কে আঁকড়ে ধরে রাখবে। মিনমিন স্বরে বলে উঠল-‘ কে চায় নিজের অস্তিত্ব বিলীন হতে দিতে?আমি আপনার মতো ভালোবাসতে পারবো না। তাই বলে কখনও নিজের সুখ বিসর্জন দিতে পারব না। আপনি আমার সুখ আদ্র। ‘
_______

মেঘলা আকাশ। হালকা হালকা বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। বৃষ্টি দেখেই তুলির মন টা ভালো হয়ে গেল। গতকাল ইনশিতা ও রনকের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। নিয়ম ভঙ্গ করেই রাদিফ সাহেব রনকের পরিবার কে প্রস্তাব দিলেন রাত টা থেকে আজকে ঢাকা যাওয়ার জন্য।কিন্তু রনকের পরিবার মানল না।তাদের কথা হলো বিয়ে যখন হয়ে গেছে আর বিলম্ব করে লাভ নেই। ইনশিতা কে নিয়ে চলে গেলেন গত রাতেই। তুলি ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ টা হাতে নিয়ে একটা উপন্যাসের বই পড়তে লাগল। ঝুমুর কাছ থেকে নিয়েছে বই টা। ঝুমু যে বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে তা তার রুমের বুক শেলফের দিকে তাকালেই যে কেউ অনাসয়ে বুঝতে পারবে। চায়ের সাথে উপন্যাস অথবা উপন্যাস পড়তে পড়তে চা খাওয়া তুলির মনে অন্যরকম ভালো লাগার উদয় ঘটাল। উপন্যাসের নায়কের বর্ণনা পড়তে পড়তে তার চোখের পাতায় ভেসে উঠল আদ্র নামক মানুষ টার প্রতিচ্ছবি। মানুষ টা আজকাল তার দহনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। হলুদের রাত থেকে বিয়ে অব্দি কোনো কথা বলার সুযোগ হয় নি তুলির আদ্রর সাথে। বিয়ের কথাও কেউ জানে না। ঢাকা ফিরেই আমরিন,ইনশিতা, পায়েল,নিবিড় সবাইকে জানানো হবে। আদ্রর সাথে কথা বলতে না পেরে তুলির চৌচির হয়ে যাওয়া মনে এক পশলা বৃষ্টি নিয়ে গতরাতে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয়েছিল আদ্র। তার হাতে ছিল একটা ডায়েরি। তুলি কিছু বলার আগেই ডায়েরি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ ঢাকা গিয়ে পড়বে। তোমার মনের প্রতিক্রিয়া যেমনই হোক আমার বেঁচে থাকার কারণ তুমি। আর আমাকে মেরে ফেলার সাহস তোমার মনে কোনোদিনও না জাগুক এটাই আমার প্রার্থনা। ‘

তুলি পাথরের ন্যায় শুধু চেয়েছিল। সারারাত ডায়েরি পড়ার জন্য মন টা নিশপিশ করেছিল। যখনই হাতে নিবে আদ্রর বলা কথাটা মন কে বাঁধা দিত। আর আদ্রর কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস তুলির নেই। বাহিরে চিল্লানোর আওয়াজ কানে আসতেই তুলি চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় ছুটে আসল। খোলা বেলকনিতে বৃষ্টির পানি তাঁকে একটু একটু করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। চায়ে বৃষ্টির টপ টপ ফোঁটা মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। সেদিকে খেয়াল করার সময় যেন তুলির নেই। তুলির সারা চোখ জুড়ে নীলাভ চোখের অধিকারী সুদর্শন যুবক বিরাজমান। প্রকৃতির ন্যায় বৃষ্টির পানি তুলির মন টা স্বচ্ছ করে দিচ্ছে। সেই সাথে এক প্রবাহমান বাতাস তুলির অন্তর জুড়ে শীতলতা ছড়াতে ব্যস্ত। আদ্র,নিবিড়, অন্তু,আহান,সাগর ফুটবল খেলছে কাঁদা মাটিতে। হঠাৎ করে আদ্রর নজর গিয়ে ঠেকল বেলকনিতে। চোখে পড়ল তুলির বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ চেহারা। মেয়েটার শরীর কাটা দিয়ে উঠছে অথচ কোনো হেলদোল নেই তার। আদ্রর মেজাজ খিঁচে এল। গলা উঁচিয়ে বলল,

‘ ভিতরে যাও তুলা।’

আদ্রের তীর্যক কন্ঠ কানে পৌঁছাতেই তুলি ঠান্ডায় কেঁপে উঠল। পা বাড়িয়ে ছুটে গেল রুমে। আদ্র পিছন ফিরতেই দেখল সবাই তার দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ নাচাচ্ছে। আদ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ফুটবল টা পায়ে ঠেলে দিল আহানের দিকে। অন্তু চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে উচ্চস্বরে রসাত্মক কন্ঠে বলে উঠল,

‘ চারপাশে কাল বৈশাখী ঝড়ের আনাগোনা
অথচ কারো কারো হৃদয়ে জ্বলছে প্রণয়ের শিখা।’

#চলবে,,,,

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব – ১৩

সকালের প্রহর কেটে দুপুরের আগমন। বৃষ্টি থেমে গিয়ে বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে এক মুঠো রোদ উঁকি দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তুলি ভেজা চুলগুলো আঁচড়ে গোলাপি ওড়না টা টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। পিছু ফিরে আরশিতে নিজেকে দেখে নিল গভীর নয়নে। নিজেকে শূন্য শূন্য লাগছে তার। মনে তীব্রভাবে নিজেকে সাজিয়ে নেয়ার ইচ্ছে উদয় হলো। কাজল টেনে নিল ডাগরডাগর আখিঁদ্বয়ে। হালকা গোলাপি শেডের লিপস্টিক রাঙিয়ে নিল চিকন ওষ্ঠযুগলে। নিমিষেই তুলির শ্যামলা মুখশ্রী জুড়ে লজ্জার আভা ছেয়ে গেল। নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে তার। এতোক্ষণ কেমন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী লাগছিল নিজেকে। তুলি আনমনে হাসতে হাসতে বিড়বিড় করল–” ওহে,শ্যামবর্ণা তোমাকে এখন লাগছে ডাক্তার সাহেবের বউ।”

বাহিরের ঝলমলে রৌদ্র রুমের মেঝেতে ছুঁয়ে যাচ্ছে। একটু আগেও বৃষ্টির তীব্র বেগে সারা প্রকৃতি বৃষ্টি বিলাসে মত্ত ছিল আর এখন রৌদ্রময় রূপ শুষে নিতে মগ্ন। এ যেন, কখনও বৃষ্টি কখনও রৌদ্দুর। তুলির কাছে প্রত্যেক টা মানুষের জীবন ঠিক এমন মনে হয়। কখনও সুখ তো কখনও কান্না।’ আচ্ছা আমার জীবন টা এখন কোন পরিস্থিতিতে আছে?’প্রশ্ন টা মনে জাগতেই তুলি মুখে উচ্চারণ করল-‘ রৌদ্রময় রূপে। যেই জীবনে আদ্রর ভালোবাসা রোদের ন্যায় প্রখর। তবে একটুখানি পার্থক্য আছে!রোদের প্রখরতা কমে এলেও কখনও কমবে না আদ্রর ভালোবাসা।’

নিজের ভাবনায় এতোটাই মত্ত ছিল তুলি তার খেয়ালই ছিল না ঝুমু দুপুরের খাবারের জন্য নিচে যেতে বলেছিল। কাজের মেয়ে রিমার ডাকে হুঁশ ফিরে এল তার। রিমা দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল-

‘ আদ্র ভাই আমনের লাই ওয়েট করতাছে ছোডো আফামণি। বাহি সবাইও ওয়েটিং। তাড়াতাড়ি আইয়েন।’

রিমার কথা শুনে পেট ফেটে হাসি আসার উপক্রম তুলির। কিন্তু হাসা যাবে না। এতে মেয়েটার মন ক্ষুণ্ণ হতে পারে। কথায় কথায় ভুলভাল ইংলিশ বলা মেয়েটার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। বয়স পনেরো কি ষোলো হবে। আদ্র একটা স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দিয়েছে রিমা কে। কিন্তু স্কুল ফাঁকি দেওয়ার জন্য ওস্তাদ মেয়েটা। আদ্র বাড়িতে না থাকায় তো আরো সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু বেচারির সেই সুযোগ শেষের পথে আদ্রর আগমনে। তুলি আলতো হেসে সায় জানিয়ে রিমার পিছু পিছু হাঁটছে। মাথা টা ভার ভার লাগছে তার সকালে বৃষ্টি তে ভেজার পর থেকে। গা টাও হালকা গরম। হয়তো দু’দিন আগে হুট করে উদাও হওয়া জ্বর টা বৃষ্টির পানির স্পর্শে ফিরে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তুলির কর্ণকুহর ভেসে আসতে লাগল হাসির কলরব। তুলি দিব্যি ঠাওর করতে পারল এই হাসির কারণ অন্তু। অন্তু নিশ্চয়ই তার মজার মজার কথা দিয়ে ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবাইকে হাসাতে ব্যস্ত। কিন্তু এই মানুষ টা মনে মনে হাসে তো?নাকি মন পাঁজরে বেঁধে রেখেছে অজস্র বিষাক্ত বেদনা!এই চার দিনে অন্তুকে বেশ খেয়াল করেছে তুলি। মানুষ টা তাকে বড় ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। তুলির মনে পড়ে গেল ইনশিতার গায়ে হলুদের রাতের সেই দৃশ্য। সেদিন কেঁদে কেটে অস্থির হওয়া তুলি কোনোমতে নিচে এসেছিল। বাগানের এক পাশে দাড়িয়ে যখন সবার অগোচরে নিঃশব্দে চোখের জল ভাসিয়ে দিচ্ছিল ঠিক তখনই কেউ একজন তার সামনে এক প্যাকেট হাওয়ায় মিঠাই ধরেছিল। হাওয়ায় মিঠাই দেখে তুলির অশ্রুসিক্ত চক্ষুদ্বয় লোভাতুর হয়ে উঠেছিল পলকেই। সেই কবে হাওয়ায় মিঠাই খেয়েছিল মেয়েটা!তার যতদূর মনে পড়ছে ক্লাস সেভেনে থাকতে খেয়েছিল শেষ বার স্কুলের ক্রীড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। হাওয়ায় মিঠাইয়ের প্রতি চরম দুর্বলতা তুলির। মুখে দিলেই চুপসে যায় তাতে পেট না ভরলেও মনটা দিব্যি ভরে যায়। মুখের সামনে হাওয়ায় মিঠাই ধরা মালিক কে দেখে তুলি কিছুটা চমকপ্রদ হলেও পরক্ষণেই ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে এল। অন্তু হাওয়ায় মিঠাই টা নেওয়ার ইশারা করতেই প্যাকেট টা এক প্রকার লুফে নিল তুলি। হাতে নিয়েই ফিক করে হেসে উঠল। তার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে অন্তু ও খানিকক্ষণ হেসে নিল। হাসি থামিয়ে বলে উঠল,

“বিষাক্ত যন্ত্রণাগুলো কে জমাতে নেই, পারলে গিলে ফেলো তুলি। রেহাই দাও নিজের মন কে যন্ত্রণার পাহাড় বানানো হতে।”

তুলির কি হয়েছিল সে জানেনা তবে দ্রুত গতিতে প্রশ্ন করেছিল,

” আপনি পারেন গিলে ফেলতে?”

তুলির প্রশ্নের প্রেক্ষিতে অন্তু নিজের চিরাচরিত হাসি টা উপহার দিয়েছিল। অবলীলায় প্রতুত্তর করেছিল,

” পারি বলেই তো এতো হাসি-খুশি থাকতে পারি। বাই দ্যা ওয়ে, হাওয়ায় মিঠাই চুপসে যাওয়ার আগে খেয়ে নিও। আদ্র ভালোই করেছে গায়ে হলুদে হাওয়ায় মিঠাইয়ের আয়োজন করে। আমার পছন্দের একটা জিনিস। ”

তুলি অতিশয় বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে শুধু অন্তুর উত্তর টা ভেবেছিল কিছু সময়। তখনই কিছু একটা খেলে গিয়েছিল তার ছোট্ট মস্তিষ্কে। মন বলেছিল–” একটা মানুষ যেমন কখনও পারফেক্ট হয় না, কোনো না কোনো দিক দিয়ে ত্রুটি থাকে তেমনই সর্বদা হাসি খুশি থাকা মানুষগুলোর মন কোনো না কোনো কিছুর শূন্যতায় ভুগে।”
__________

ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই তুলি সবাইকে দেখতে পেল। বিশাল বড় ডাইনিং টেবিল। হরেক রকমের খাবার সাজিয়ে রেখেছে ডাইনিং টেবিলে। কিন্তু সবাই খাবার খাওয়া শুরু না করে আড্ডা দিচ্ছে যা দেখে তুলি বুঝে গেল সবাই তার অপেক্ষায়। আর এই জমপেশ আড্ডা জমিয়েছে অন্তু। কিন্তু এই আড্ডায় যেন কোনো খেয়াল নেই এক বান্দার। আদ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে মোবাইল টিপছে। তুলি কে দেখে সবাই তাড়াতাড়ি বসতে বলল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে তুলি একটা চেয়ারও খালি পেল না। হতভম্ব হয়ে গেল সে। তাকে খেতে ডাকল অথচ চেয়ার খালি নেই! ভীষণ অবাকও হলো সামনের চেয়ারে বসা এক সুন্দরী রমণী কে দেখে। এখানে এসেছে তিনদিন। মেয়েটা কে তো তুলি আগে দেখে নি। মুমতাহিনা খানমের অর্থাৎ আদ্রর ফুপি মেয়েটার পাশে বসে আছে। মোবাইল টিপতে ব্যস্ত মেয়েটা কে আরেকবার তীক্ষ্ণ নজরে দেখে নিল তুলি। বুঝতে পারল এই মেয়েই মুমতাহিনা খানমের মেয়ে রূপসা। নিমিষেই হৃদয়পটে প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করল তুলি। পরমুহূর্তেই সেই যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস চেষ্টা চালাল। নিজের মন কে শুধালো, ‘ ডাক্তার সাহেব আমার বর। আমার বর মানে শুধুই আমার। আমার চারপাশে কখনও মিথ্যের বেড়াজাল সৃষ্ট হলেও উনার ভালোবাসা চিরকাল সত্য থাকবে।”

তুলির বসার জায়গা না পেয়ে ইতস্তত অনুভব করতে লাগল। পাশের চেয়ার থেকে ছোট্ট জারিফা কে নিজের কোলে নিয়ে নিল আদ্র। চেয়ার টা দেখিয়ে বসার জন্য ইশারা করল। তুলি নম্র স্বরে বলল,

” এটা তো জারিফার চেয়ার। আমি নাহয় পরে খেয়ে নিব।”

” তোমার জন্যই চেয়ার টা। জারিফা আগেই খেয়ে নিয়েছে। ”

আদ্রর গাম্ভীর্য স্বর কর্ণপাত হতেই তুলি তড়িৎ গতিতে দুই কদম এগিয়ে এসে চেয়ারে বসে পড়ল। রাদিফ সাহেবের দিকে চেয়ে বলল,

” আপনারা খাওয়া শুরু করলেন না কেন খালু?”

রাদিফ সাহেব ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে জবাব দিলেন,

” তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম প্রিন্সেস। ভাবলাম আজ সবাই একসাথে লাঞ্চ করি। আর কবে এমন একটা সুযোগ হবে কে জানে!”

রাদিফ সাহেবের কথায় মুমতাহিনা খানম তীর্যক নজর তাক করল তুলির দিকে, যা তুলির চোখ এড়ায় নি। এই মহিলা যে তাকে একদমই সহ্য করতে পারছে না তা মহিলার মুখের হাবভাবে প্রকাশিত। অবশ্য এতে ওনার কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছে না তুলি। একটা মানুষ কাকে পছন্দ করবে বা অপছন্দ করবে এটা সেই মানুষের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। নিজের শশুড়ের মুখে প্রিন্সেস ডাক টা শুনে তুলির মন টা খুশিতে ভরে গেল। সবাই খেতে শুরু করে দিয়েছে। তুলি আঁড়চোখে পাশের মানুষ টার দিকে এক নজর চাইল। এই চাওয়া যেন কাল হয়ে দাঁড়াল তার জন্য। আঁড়চোখে চাইতে গিয়ে ফেঁসে গেল আদ্রর নীলাভ চোখের মণিতে। তার দিকেই নিষ্পলক চেয়ে আদ্র। তুলির বুকটা দরফর করতে লাগল। আদ্রর মুখ টা কেমন শুকনো শুকনো ঠেকল তুলির নিকট। আচ্ছা উনি কি অসুস্থ! চোখের সাদা অংশ টা লাল দেখাচ্ছে। তুলি পরখ করার জন্য আরেকবার তাকাতেই আদ্র বলে উঠল,

” খাবার খাওয়া শুরু করো। ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।”

তুলির ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করতে ‘আপনি কি অসুস্থ ডাক্তার সাহেব?’ কিন্তু এতো মানুষের সামনে জড়তা -সংকোচে দমে গেল। খাবার দেখে গা গুলিয়ে আসল তার। টানা কয়েকদিন মাংস,মাছ,ডিম এসব ধরনের খাবার খেতে খেতে বিরক্ত সে। জ্বরে আক্রান্ত তুলির এ মুহুর্তে খাবার গুলোকে বিষ মনে হচ্ছে। কয়েক পল স্থির নয়নে চেয়ে রইল প্লেটের দিক। হঠাৎ পাশ থেকে আদ্র কে উঠে দাঁড়াতে শঙ্কিত মনে মাথা তুলে তাকাল তুলি। আদ্র তুলির প্লেট টা সরিয়ে দিয়ে নরম স্বরে বলল,

‘ এসব খেতে হবে না। একটু অপেক্ষা করো।’

হতভম্ব তুলি মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। গটগট পায়ে আদ্র ছুটে গেল কিচেনের দিকে। মিনিট পনেরো পর ফিরে এল হাতে ভেজিটেবল স্যুপ ও পাস্তা নিয়ে। তুলির সামনে খাবারগুলো রেখে দ্রুত বেগে উপরে উঠে গেল। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানেই থার্মোমিটার নিয়ে এসে জারিফা কে ড্রইং রুমে পাঠিয়ে চেয়ার টেনে তুলির পাশে বসে পড়ল। সবকিছু এতো দ্রুত দ্রুত হচ্ছে যার জন্য তুলি স্তম্ভিত হয়ে আদ্রর কান্ড অবলোকন করছে। দু ঠোঁটের কিঞ্চিত দূরত্বে সৃষ্ট হওয়া ফাঁক দিয়ে আদ্র থার্মোমিটার টা তুলির মুখের ভিতর পুড়ে দিল। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে বোকা বনে গেল তুলি। কপালে ভাজ ফেলে আদ্রর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সাথে সাথেই ভেসে এল আদ্রর রাগান্বিত নিচু স্বর,

” স্টুপিড একটা!বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছে অথচ বলার নাম নেই।”

কথাটা তুলি ব্যতীত অন্য কারো কর্ণগোচর হয়েছে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে তুলির। তবে সবার দৃষ্টি যে ওদের দু’জনের উপর নিবদ্ধ তা বেশ উপলব্ধি করতে পারছে। তুলির মা তো প্রশ্ন করেই বসল,

” কি হয়েছে আদ্র?”

” জ্বর হয়েছে খালামণি।”

অন্তু খাবার খাওয়া বন্ধ করে হেসে বলে উঠল,

” বাহ্!দুজনেরই জ্বর। ভালোই হলো এবার তাহলে মিলেঝিলে ওষুধ খা ।”

আদ্র চোখ গরম করতেই অন্তু মুখে কুলুপ এঁটে ফেলল। আফসানা মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠে আসতে নিলে আদ্র আলতো স্বরে বলল,

” তুমি খাবার ফিনিশ করো খালা মণি। আমি ওষুধ খাইয়ে দিব। আশা করি সুস্থ হয়ে উঠবেন উনি।”

এমনিতেই তুলির মন জুড়ে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে আদ্রের জ্বরের কথা শুনে। এখন আদ্রর রাগের বলা বাক্যটা ও তার মনে আষাঢ়ে বর্ষণ নিয়ে এল। জ্বর হয়েছে বলে নি এটাও বুঝি তুলির অপরাধ!তুলি চুপচাপ স্যুপ টা বহু কষ্টে খেতে লাগল আদ্রর আদেশে। তুলির জন্য আদ্রর এতো অস্থিরতা দেখে আগুনে ফুটন্ত লার্ভার ন্যায় জ্বলে উঠলেন মুমতাহিনা খানম। নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন রাগান্বিত দৃষ্টি নিয়ে। অথচ রূপসা ভাবলেশহীন যেন এসবের কিছুই পাত্তা দেওয়ার সময় তার নেই। জ্বরে বেহাল অবস্থা নিয়েই আদ্রর তুলির প্রতি কেয়ার দেখে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,

” শুনলাম তুমি নাকি নিজের বাবার কথা শুনো না?আমার মেয়েকে বিয়ে করতে কি সমস্যা তোমার? বাবার খাও কিন্তু তার কথা শুনতেই অপারগ তোমার।”

সোজা হয়ে বসল আদ্র। তুলির হাতে ওষুধ দিয়ে পানি এগিয়ে দিল। নিজের আঁখিযুগল রাদিফ সাহেবের দিকে নিবদ্ধ করে কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” বাবা আমি কি আপনার টাকায় খাই?”

” একদম না। তুমি তোমার ইনকাম করা টাকায় খাও এবং চলো।”-খেতে খেতে জবাব দিলেন রাদিফ সাহেব।

মুমতাহিনা খানমের মুখটা চুপসে গেল সাথে সাথেই। ওনার নিকট মনে হলো–” যেমন ছেলে তেমন তার বাবা। যেমন বাপ তেমন ছেলে প্রচলিত বাক্য টা বুঝি আদ্র ও রাদিফ সাহেবের ক্ষেত্রে উল্টো হলো।” টেবিলের সবাই মিটমিট করে হাসছে। মুমুতাহিনা খানম তুলির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,

” এই মেয়েটার প্রতি তোমার এতো দরদ কেন?খালাতো বোনের প্রতি এতো দরদ ভালো ঠেকছে না আদ্র।”

” ফুপু আম্মু কে বলেছে তুলি আমার খালাতো বোন?আমার জানামতে তুলি আমার বউ।”–নির্লিপ্ত জবাব আদ্রর।

#চলবে,,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)