আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-১৮+১৯

0
700

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_১৮

বিস্তর গগণে আজ অসংখ্য তারার বিচরণ। তারার ঝলমলে রূপে বারংবার চোখ আঁটকে যাচ্ছে তুলির। এতো সুন্দর রূপ! জোস্না ছড়ানো চাঁদও তুচ্ছ তারার রূপের কাছে। তুলির নেত্রযুগলে একটা সময় চাঁদ দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকতো। নিশি রাতে যখন সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতো,তখন তুলির চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতো চাঁদের আলো নিজের চক্ষে আবদ্ধ করতে। সময় বদলেছে,তুলির মনের আদান-প্রদান ঘটেছে। সেই সাথে বদলেছে পছন্দ। চিরতরে মনে গেঁথেছে একটা নাম,একজন সুদর্শন পুরুষ। তুলির নির্নিমেষ দৃষ্টি আকাশ পানে৷ কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বক্ষস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘাড়ের সবটুকু অংশে নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে। বাহ্যিক ক্ষেত্রে তুলি শক্ত। কিন্তু ভিতর!ভিতর জুড়ে প্রলয়।
আলতো স্বরে প্রশ্ন করলো,

” চাঁদ নাকি তারা?”

“তুমি।”

অন্তর স্থল কেঁপে উঠল তুলির। ঝটপট পিছন ফিরে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইল আদ্রর মুখশ্রী তে। সারা মুখ জুড়ে ম্লান হাসির রেশ। হুট করেই তুলির মনে হলো নীল বর্ণের মণি দু’টো ফেয়ারি লাইটের ঝলমলে আলোয় জ্বলজ্বল করছে। নেশাক্ত আঁখি জোড়াতে চেয়ে তুলির গলা শুকিয়ে এলো। মাদকতার নেশার ন্যায় তুলির আবেগি মনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল আকাশসম লজ্জা। পারল না বেশিক্ষণ আদ্রর চোখে চোখ রাখতে। এই চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলেই হৃদয় অনেক কথা বুনে। মনে আদ্র কে পাওয়ার তীব্র ভাষণা জাগে। বেহায়াপনা করে ছুঁয়ে দেওয়ার অভিলাষ হয়। কিন্তু আদ্র বড়ই নিষ্ঠুর!কেন কাছে টানে না তাকে?ইচ্ছে কি আদ্রর মনে জাগে না?নিদারুণ অধিকার বোধ থাকা সত্ত্বেও কাছে টেনে না নেওয়ার কষ্ট কি আদ্রর হয় না?সর্বোপরি আদ্র কি পুড়ে তুলির মতো করে বেহায়া যন্ত্রণায়?তুলির লজ্জা হয়!ভীষণ লজ্জা হয়,নয়তো কাছে এগিয়ে যেতে এক মুহুর্তও ভাবতো না সে। অস্ফুটস্বরে বললো,

” তারা গুলো খুব সুন্দর। ”

“তুমি বিহীন সবকিছু বিষাক্ত। “–নেশালো সুরে প্রতুত্তর করল আদ্র।

তুলি নিশ্চুপ! এই ছেলের কথার পৃষ্ঠে প্রশ্ন করার মতো সাহস হয় না তার। আদ্র হাত বাড়িয়ে তুলির ডান হাত টা চেপে ধরল। আকস্মিক কান্ডে হকচকাল তুলি। হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক উঠানামা নিয়ে আদ্রর বুকের বা পাশ আঁকড়ে ধরলো। রোষ পূর্ণ তেজী কন্ঠে বলে উঠল আদ্র,

” তোমার ভয়,হাসি,লজ্জা মিশ্রিত শ্যামবর্ণ রূপ সবটাই শুধু আমার জন্য তুলা। তুমি অন্য কারো সামনে কখনো এই রূপে আসবে না। তোমাকে আঘাত করার ক্ষমতা আমার নেই, তবে আমার হৃদপিন্ডে ক্ষত সৃষ্ট করার ক্ষমতা তোমার আছে। তোমার একেকটা নিঃশ্বাসে আমার হৃৎস্পন্দন নির্ভর করে।”

নিস্তব্ধ, নির্বিকার তুলি। চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে এক ফোঁটা সুখ মিশ্রিত অশ্রু গড়িয়ে গেল। অতি শোকে পাথর। তুলির অতি সুখের প্রমাণ এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জনে। পাশে থাকা গাড়ির দরজা খুলে তুলি কে ভিতরে বসিয়ে দিল আদ্র। নিজে উঠে বসতেই তুলি দ্রুত গতিতে বলে উঠল,

” ইনশিতা আপু কে বিদায় জানিয়ে আসি নি তো।”

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে আদ্র গম্ভীর স্বরে বললো,

” আমি বলে এসেছি। ইনশিতা কাল বাসায় যাবে। আমি চাই না তোমার পা আর কখনো এ বাড়িতে পরুক। নয়তো আমার হাতে রক্তের অস্তিত্ব ফুটে উঠবে।”

তুলি তৎক্ষনাৎ ভড়কে গেল। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। ধুকধুক শব্দ করে কেঁপে উঠল বুক টা। আদ্রর কথার মানে সে বুঝে নি। তবে গম্ভীরতার স্বর কেমন কম্পন ধরিয়ে দিচ্ছে। ভয়ার্ত স্বরে বললো,

” মানে?”

” মানে নেই। ওড়না টা ঠিক করে নাও। বড্ড বেসামাল হয়ে পড়ছি,নিজেকে আটকাতে কষ্ট হচ্ছে। এক রাশ বেহায়া ইচ্ছে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে। পরে তো বলবে,আমি নির্লজ্জ, অসভ্য। এগুলো মিথ্যে হলেও একটা জিনিস চিরন্তন সত্য থাকবে,আমি তোমার মাতাল প্রেমিক। ”

চোখ কপাল স্পর্শ করতে একটুও সময় ব্যয় হলো না তুলির। লজ্জায় নত মস্তকে ওড়না টা ঝটপট ঠিক করে নিল। ওড়নাটা কখন সরে গিয়েছিল খেয়াল হয় নি তার। সরে গিয়ে বুকের উপরের অনেকখানি অংশ দেখা যাচ্ছিল যা সত্যিই লজ্জাজনক। আদ্রর ক্ষীণ হাসিতে তুলি দ্বিগুণ লজ্জা অনুভব করতে লাগল। হাসফাস করতে করতে বললো,

” আমি খেয়াল করি নি আদ্র ভাইয়া। ”

আদ্র তৎক্ষনাৎ গম্ভীর ভঙ্গিতে তুলির দিকে তাকালো। গাড়ি থেমে গেল সাথে সাথেই । কন্ঠে রাগ এঁটে ভ্রু উচিয়ে বললো,

“ভাইয়া?”

অগ্নি দৃষ্টি, রাগী স্বরে ভয়ে চুপসে যাওয়ার উপক্রম তুলির। আদ্রর ফর্সা মুখটা নিমিষেই লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মুখভঙ্গি জানান দিচ্ছে ‘ভাইয়া’ শব্দে সে ক্রুদ্ধ। তুলির মাথায় ছোট্ট একটা বুদ্ধি এলো। কন্ঠে আবেগ ঢেলে আবেগি সুরে বললো,

” উঁহু,স্বামী। ভাইয়া শব্দ টা অভ্যাস বশত মুখ ফসকে বেরিয়েছে স্বামী মহাশয়। ”

আদ্রর অগ্নি দৃষ্টি তুখোড় হয়ে এলো। লাল আবরণ ছাপিয়ে ফর্সা চেহারায় হাসির ঝলক প্রতীয়মান হলো। তুলির দিকে খানিকটা নিচু হয়ে মুখ বরাবর ফুঁ দিতেই আঁখি জোড়া তড়িৎ গতিতে বন্ধ করে ফেলল তুলি। পাশে থাকা আদ্রর হাতে খামচে ধরল শক্ত করে। কানে এলো আদ্রর ফিচেল স্বর,

‘ আমাকে হ্যান্ডেল করা শিখে গেলে তুমি। ‘

তুলি নিরুত্তর চোখ বুঁজে রইল। আদ্র সরে গিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে হাতের দিকে তাকালো। সূক্ষ্ম ব্যাথার আভাস অনুভব হয়েছিল তার। এখন সম্মুখে ভেসে উঠলো রক্ত। হাতে টান পড়তেই সম্বিৎ ফিরে পেল তুলি। আদ্র প্রখর দৃষ্টিতে হাতের দিকে তাকাচ্ছে। হতবাক হয়ে পড়ল তুলি। আদ্র কি দেখছে হাতে ওমন করে তুলি ঠাওর করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অপলক চেয়ে থেকে আদ্র নির্পিল্ত সুরে বলে উঠল,

” এতটুকু তেই রক্তাক্ত করে দিলে। না জানি ফুলশয্যার রাতে কতো ক্ষত লিখা আছে আমার নামে। দয়া করে এই ময়লা যুক্ত ডাইনির মতো নখ গুলো কেটে বাসর ঘরে প্রবেশ করবে বউ।”

টুপ করে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে আলতো করে তুলির হাত ছেড়ে দিল আদ্র। তুলি রোবটের ন্যায় থমকে রইল। ভিতর টা চিৎকার করে বলছে-” এই লোক তোকে শেষ করে দিবে তুলি। লজ্জায় ডুবিয়ে নিশ্বাস আঁটকে ইতি ঘটাবে তোর। ”

রাঙা হয়ে উঠেছে তুলির দু’গাল। আঁড়চোখে একবার সেটা দেখে নিল আদ্র। মনোযোগী হলো ড্রাইভ করতে। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক করতে তুলি সেঁটে গেল নিজের সিটে। এক পলকও সাহস হলো না পাশের মানুষ টার দিকে তাকানোর। তাকালে বুঝি শেষ রক্ষে হবে না। তুলির মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে তুলির মন ঝাঁপিয়ে পড়বে আদ্রর প্রশস্ত বুকে। বাহিরে নিয়ন আলোতে গাড়ির জানালা দিয়ে তুলি লক্ষ্য করল গাড়িটা বাড়ির দিকে যাচ্ছে না। ঢাকা শহরে কয়েকদিন আগে আসলেও তুলি নিজেদের বাড়ির রাস্তা টা মুখস্থ করে নিয়েছে ঠিকঠাক। কোনো প্রকার চিন্তা অনুভব করল না সে, বরং কিছু একটা মনে পড়তেই মিনমিনিয়ে আদ্রর উদ্দেশ্যে বললো,

“তখন দাদীকে কি বলছিলেন আপনি?”

“বলেছিলাম বউ কে ঠিক কতোটা ভালোবাসি।”– নিরলস জবাব আদ্রর।

তুলি থমকালো। ভেংচি কাটল আদ্রর অগোচরে। অভিমানে মনে মনে বললো-” বউ কে দূরে দূরে রাখেন,আবার দাবি করেন ভালোবাসেন। আগেই জানতাম ডাক্তার রা ভীষণ পাষাণ। হয়তো কোনো একদিন আপনার কারণেই আপনি আমার হার্টের চিকিৎসা করতে বাধ্য হবেন ডাক্তার সাহেব। ”

আদ্র নরম স্বরে ডাকলো,

“তুলি!”

তুলি চটপট করে উত্তর দিল,

“জ্বি!”

” আশফিয়া চৌধুরী আমার রেগুলার পেশেন্ট। ওনার হার্টের ট্রিটমেন্ট শুরু থেকেই আমি করি। উনার সাথে আমার সম্পর্ক টা বেশ ভালো। মাঝে মাঝে উলটো পাল্টা কথা বলে বিব্রত করার চেষ্টা করি। তবে তিনি মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। অন্যের উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করা ওনার স্বভাব। যেমন টা আজ তোমার সাথে করেছিল। ওনার স্বভাবের সেই সুযোগটা নিয়েছে পূর্ব। ”

আদ্রর কথাগুলো বুঝতে পেরে তুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পূর্ব সম্পর্কে এতোটাও ভাবে নি সে। আদ্র তুলির হাত টা আকড়ে ধরে বিস্তর হেসে নিজ মনে আওড়ালো,

” সেদিন তোমার মুখে হাসি ছিল,আমার চক্ষে ভেসেছিল তোমাকে পাওয়ার ঝোঁক।”

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_১৯

একতরফা ভালোবাসা!বন্ধুমহলে হুটহাট শুনা যেতো একতরফা,একপক্ষ ভালোবাসার কোনো মানে নেই। কি লাভ নিভৃতে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার, শোকে কাতর হয়ে দেবদাস হওয়ার?অন্যদের ভাবনায় লাভ না থাকলেও আমার মনের সবটা জুড়ে রয়েছে ইউজলেস সেই একতরফা ভালোবাসার বসবাস। মেডিকেল কলেজের প্রথম দিনে কোনো এক গজদন্তিনী,নাকের ডগায় সর্বদা রাগ বহন করা নাক ফুলো নিজের অজান্তেই প্রণয় শিখা জ্বালিয়েছিল আমার হৃদয়ে। জ্বলন্ত সেই প্রণয় শিখায় আমি আজো জ্বলছি, মুহুর্তে মুহুর্তে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হচ্ছি, তবুও তাকে ভালোবাসা ছাড়তে পারিনি। নিয়ম করে ক্ষণে ক্ষণে তাকে আমি ভালোবাসি আমার কল্পনার রাজ্যে। খাবার বিহীন যেমন মানুষ ক্ষুধার্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে, তেমনি তার দেখা না পেলে,তাকে কল্পনায় আলিঙ্গন করতে না পারলে প্রগাঢ় ব্যাথা অনুভব করি আমি বুকের বা পাশে। সময় স্রোতের ন্যায় ভেসে গেছে, গড়িয়েছে বহু বছর,তবে প্রকাশ করা হয় নি কোনো কালে। কল্পনার জগতে আমার সেই গজদন্তিনী কে ভালোবাসতে বাসতে একসময় ভালোবেসে ফেলেছি একতরফা ভালোবাসা কে। আজও বাসি,কাল ও বাসব,অতঃপর শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আমি তাকেই ভালোবাসবো।

রূদ্ধশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেল অন্তু। কিছুক্ষণ আগে হৈচৈ করা আড্ডায় নিস্তব্ধতা নেমে এল। সবার বিস্মিত দৃষ্টি অন্তুর দিকে। অন্তু সেদিক পাত্তা না দিয়ে কিচেন রুমের ফ্রিজ থেকে পানি এনে ঢকঢক করে খেতে লাগল। নিষ্পলক চেয়ে রইল পায়েল অন্তুর পানি খাওয়ার পানে। প্রবল আর্তনাদ করে উঠছে তার ভিতর টা। চোখ প্রায় জলে টুইটুম্বুর হয়ে এসেছে। চোখের কার্নিশে জল ছুঁই ছুঁই। গড়িয়ে পড়ার আগেই অতি সন্তর্পণে মুছে নিল তা। কাজটা অগোচরে করার প্রচেষ্টা হলেও তুলি দেখল। খুব করে দেখল পায়েলের পানিতে ভরপুর আখিঁদ্বয়। ঝটপট দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে৷ পায়েল তো কাউকে অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া দেখাতে চায় না, তবে সে কেন দেখে বিব্রত করবে পায়েল কে?

কিছুক্ষণ পূর্বে তুলি আদ্রর ফ্ল্যাটে এসেছে। ইনশিতার শশুড় বাড়ি থেকে আদ্র এখানে নিয়ে আসছিল বলে তুলি তখন রাস্তা চিনতে পারে নি। তুলির অজানা ছিল আদ্রর এই ফ্ল্যাট। গাড়ি থেকে নেমে যখন হাতের ভাঁজে তুলির ছোট্ট হাত টা আকড়ে নিয়ে আদ্র একটা বিল্ডিংয়ে ঢুকেছিল তখনও কোনো প্রশ্ন করে নি তুলি। কোনোরূপ আগ্রহ পর্যন্ত প্রকাশ করে নি। তার নজর স্রেফ আদ্রকে দেখতেই ব্যস্ত ছিল। লিফটে উঠে নিঃসংকোচ আদ্রর বুকে মিশেছিল। কারণ বদ্ধ জায়গায় ফোবিয়া কাজ করে তার। আদ্র কিছুই বলে নি। বরং সবটুকু দিয়ে প্রশস্ত বুকে আগলে রেখেছিল নিজের প্রাণভোমরা কে। নির্জীব, নিশ্চুপ তুলি শেষ পর্যন্ত মুখ তুলেছিল। ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুড়েছিল,

” কোথায় এসেছি আদ্র?”

“তোমার ছোট্ট সংসারে। ”

তুলির চোখে জানার কৌতূহল বেড়ে গেল। ‘সংসার’ শব্দটা তুলি বুঝে। আঠারো বছর বয়সে এতোটাও অবুঝ না সে। এটা কি আদ্রর আরেকটা বাসা!প্রশ্ন টা মনে না রেখে করে বসলো,

” এটা আপনার বাসা?”

আদ্র কলিংবেল চাপতে চাপতে ছোট করে হ্যাঁ বোধক শব্দে সম্মতি জানাল। তুলি হতবিহ্বল হয়ে বললো,

” আরেকটা বাসা কেন?আপনি কি আলাদা থাকেন আদ্র?”

” ফ্ল্যাট টা আমার দাদা আমার বিংশতম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। তুমি একেবারে ঢাকা শহর আসার আগের রাত পর্যন্ত আমি এখানেই থাকতাম। ”

তুমি চমকাল। পরিবার এতো নিকটে থাকা সত্বেও আদ্র বিচ্ছিন্নভাবে থাকত?চমকিত স্বরে প্রশ্ন করল,

” কেন ডাক্তার সাহেব? ”

আদ্রর মুখে গম্ভীরতা ছেয়ে গেল। শক্ত কন্ঠে জবাব দিল,

” সময় টা উত্তর দেবার নয়। কোনো এক সময় প্রশ্ন না করতেই উত্তর পেয়ে যাবে। জানিনা সেদিন তোমার রিয়াকশন কেমন হবে,তবে এটুকু মস্তিষ্কে চিরকাল ধারণ করে রাখবে তোমার জন্ম শুধুই আমার জন্য। ”

বিরক্ততিতে মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠল আদ্রর। অনবরত কলিংবেল চেপেই যাচ্ছে। তুলি সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে ভয়টা চেপে রাখার চেষ্টা চালালো। আদ্রর কিছু কিছু কথায় ভীষণ ভয় অনুভব হয় তার। এতো রহস্যময় কথা কেন বলেন আপনি আদ্র? মনে মনে বিড়বিড়িয়ে তুলি আদ্রর কাছ থেকে কিছু টা সরে এলো। মুহুর্তেই বলিষ্ঠ হাতে টেনে এনে বাহুতে আবদ্ধ করে নিল আদ্র। আকস্মিক টানে তুলি শ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। আদ্রর বুকে কপাল ঠেকিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগল। বুকে উষ্ণ, গরম নিশ্বাসের উপস্থিতিতে আদ্রর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত গড়িয়ে গেল। চোখ বুঁজে নত হয়ে তুলির চুলের ভাঁজে অধর যুগল ছুঁয়ে দিল গাঢ় ভাবে। নিমিষেই কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো,

” আমার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে ডাক্তার সাহেব। ”

আদ্র থমকাল। হৃদয়ের তোলপাড় তীব্র থেকে তীব্র হলো। খানিকক্ষণ স্তব্ধ থেকে ক্ষীণ স্বরে বললো,

“ভয় পাচ্ছো?”

“না। তবে আমার হার্টবিট বেড়েই চলেছে ডাক্তার সাহেব। ”

আদ্র নির্নিমেষ চেয়ে থাকলো তুলির দিকে। মেয়েটা কে ঝাপটে নিজের মাঝে মিশিয়ে নেওয়ার প্রবল বেহায়পনা জেগে উঠল। কেন এতো সহজে মেয়েটা ব্যক্ত করছে সবকিছু?আদ্রর সহ্য হয় না। একদম সহ্য হয় না দূরত্ব। তবুও পরিস্থিতি বিবেচনা করে তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে সোজা করে দাঁড় করালো। তুলি দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,

” ভিতরে কি কেউ আছে?”

” হুম।”

“কে?”

তুলির প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই দরজা খুলে গেলো। দরজার সামনে পায়েল কে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল তুলি। ঝাপটে ধরল পায়েল কে। পায়েলও তুলি কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,

” ফাইনালি আবারও তোমাকে দেখার সুযোগ হলো কিউটি।”

তুলি আলতো হাসল। আদ্র উগ্র মেজাজে পায়েলের উদ্দেশ্যে বললো,

” তোদের এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?দশ মিনিট যাবত দাঁড়িয়ে ছিলাম। পায়েল তোর গাইনোকোলজিস্ট হওয়ার চেয়ে কানের ডাক্তার হওয়া উচিত ছিল।”

ভড়কে গেল পায়েল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠল,

“তুই আমায় বকছিস আদ্র?সব দোষ তো অন্তুর। এক তো তোর বাসার দু’টো রুমই সাউন্ড প্রুফ তার উপর অন্তু হারামি টা আমাদের কানে হেডফোন গুঁজে দিয়েছিল। লাউড স্পিকারে গান বাজিয়ে কি যেনো একটা গেমস খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ”

ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকাল আদ্র। ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

” বাচ্চাদের মতো গেম খেলা বন্ধ হবে কবে তোদের? ”

তেতে উঠলো পায়েল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,

” আমরা নাহয় বাচ্চা, তুই তো বুইড়া। তুই বুইড়া হয়ে বাচ্চা বিয়ে করলি। আমরা গেমস খেললে দোষ আর তুই বাচ্চা বিয়ে করেও নির্দোষ?”

“আমার বউ আঠারো বছরের কিশোরী। বাচ্চা না।”

চোখ কটমট করে তাকাল পায়েল। আদ্র ভাবলেশহীন ভাবে সোফায় গা এলিয়ে দিল। তুলি মিটমিট করে হাসছে পায়েলের অভিব্যাক্তিতে। কান্না কান্না স্বরে বলে উঠল পায়েল,

“জানো তুলি!এই ছেলের সাথে আমরা কখনও কথায় পেরে উঠি নি। আমাদের প্রফেসর সহ যুক্তিতে হার মানতো এই ছেলের সাথে। অত্যন্ত মেধাবী বলে কথা। দেখবে এই মেধা দিয়ে তোমার জীবন ছাড়খাড় করে দিবে। আচ্ছা তুলি তুমি থাপ্পড় খেয়েছো?”

প্রশ্নটা কর্ণপাত হতেই তুলি প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পায়েলের দিকে। পায়েল তুলির চাহনির মানে বুঝতে পেরে হায় হুতাশ স্বরে বললো,

” তুমিই বোধ হয় আদ্রর কাছ ঘেষা প্রথম মেয়ে যার গালে আদ্রর শক্ত হাতের প্রলেপ পড়ে নি। ডাক্তার সাহেব তোমাকে ভালোবাসে বলে কথা!নয়তো কলেজে কতো,,”

আদ্র দ্রুত বেগে উঠে এসে তুলি কে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। সোফায় ফের মাথা এলিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে আওড়ালো,

” মাথা টিপে দাও তো বউ।”

পায়েল হা করে চেয়ে রইল। আজকের আদ্র আর মেডিকেল কলেজ জীবনের আদ্রর মাঝে বিস্তর ফারাক অনুভব করল। তাই কিছু কথা চেপে রাখাই শ্রেয়। তুলি কে কতোটা চায় তা পুরোপুরি না বুঝলেও কিঞ্চিৎ স্পষ্ট পায়েলের কাছে। পায়েলের মনে একটা কথায় উদয় হলো-” মানুষের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে।”
________

তুলির ভাবান্তর দৃষ্টি অন্তুর দিক। মন শুধু বলছে অন্তুর কথার প্রেক্ষিতে পায়েলের চোখে জল কেন এলো?আর অন্তু কি শুধু খেলায় জেতার জন্যই ‘একতরফা ভালোবাসা ‘ সম্পর্কে বানিয়ে বললো?নাকি গোপনে ছিল সত্যতা?’ এতোক্ষণ ধরে একটা খেলা খেলছিল ওরা। খেলাটা এমন ছিল সবাই একটা একটা চিরকুট তুলবে। যার চিরকুটে যেই টপিক লিখা থাকবে,তা নিয়ে বাস্তব, অবাস্তব মিলিয়ে কয়েক টা বাক্য বলতে হবে। কেন যেন তুলির কাছে অন্তুর বলা প্রত্যেক টা বাক্য বাস্তব মনে হয়েছে। বাক্য গুলো শুনেই তুলির বুকে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে, তাহলে অন্তু?অন্তুর বেদনা হয়তো পাহাড়সম,নয়তো আকাশের ন্যায় বিশাল। ভেতর থেকে বেদনা মিশ্রিত দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। কেন হৃদপিণ্ডের গোপন প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে থাকা ব্যাথা সবাই হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারে না? তুলি অতি সন্তর্পণে লোকচক্ষু লুকিয়ে আদ্রর এক হাত চেপে ধরল শক্ত করে। কেঁপে উঠল আদ্র। চোখের ইশারায় কি হয়েছে বুঝাতেই তুলি মাথা নাড়িয়ে কিছু না বুঝালো। আনমনে আওড়ালো,

” আপনার সাথে দূরত্বের চেয়ে মরণ আমার জন্য শ্রেয়। কেন কিছু কিছু মানুষের ভালোবাসা অপ্রকাশিত রয়ে যায়? প্রতিটা মুহুর্তে
মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করার জন্য? ”

#চলবে,,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)