আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
641

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_৪৪

নিস্তব্ধ, নির্বাকতায় কাটিয়ে দিল তুলি কয়েক মুহুর্ত। আদ্রর মুখের দিকে চেয়ে শুকনো একটা ঢোক গিলল। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পরিস্ফুটিত আদ্রর। দৃষ্টি প্রশ্নসূচক। ভোরের সূর্যের কিরণ তির্যকভাবে আছড়ে পড়ছে দু’জনের মুখশ্রীতে। নির্মল হাওয়া ধেয়ে এসে শরীরে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে। সূর্যের দীপ্ততায় ও বিশুদ্ধ,নির্মল হাওয়ার মিলনে শরীরে অন্যরকম শিহরণ খেলে যাচ্ছে দু’জনের। ডায়েরি দিয়েছে আদ্র প্রায় কেটে গেছে একটা বছর। যখন হাতে পেয়েছিল পড়ার জন্য মনটা সারাক্ষণ আকুপাকু করেছিল তুলির। ঢাকায় এসে নানা রকম ব্যস্ততা, বিয়ে নিয়ে ভেজালে ডায়েরির কথা টা মনের মাঝে চাপা পড়ে গিয়েছিল। এখন কি প্রতুত্তর করবে আদ্রকে ভেবেই গলা বার বার শুকিয়ে আসছে তুলির। তবুও এখন তো আর সম্ভব না নিরুত্তর থাকা,কেননা আদ্র উত্তরের আশায় চেয়ে আছে নিষ্পলক, চাকত পাখির ন্যায় ঠাঁই। তুলির মাথা নত হয়ে গেল। নত মস্তকে জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিল শুকনো, লাবণ্যহীন ঠোঁট দুটো। অতঃপর ভাঙা কন্ঠে বলে উঠল,

” আ’ম স্যরি ডাক্তার সাহেব। আমি ডায়েরি টা পড়ার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। বান্দরবান থাকতে পড়ব পড়ব করেও পড়া হয় নি। কারণ আপনি বলেছিলেন ঢাকা এসে যেন পড়ি। আর ঢাকা এসে নিত্যদিনের ব্যস্ততা, ভেজালে বেমালুম ভুলে বসেছি আমি।”

রুদ্ধশ্বাসে কথাগুলো বলে নতমস্তকে ক্লান্ত একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করল তুলি। একদম সাহস হচ্ছে না আদ্রর উজ্জ্বল ফর্সা মুখশ্রী টা দেখার। যদি রেগে থাকে?মুখখানি যদি ধারণ করে রক্তিম আভা?প্রচন্ড ভয় হচ্ছে তুলির। একতাল কান্না জমাট হচ্ছে মনের এককোণে। অত্যাধিক সাহস জুগিয়ে তীররেখা নজরে চাইল আদ্রর দিক। নিমিষেই তব্দা খেয়ে গেল। একি অবস্থা আদ্রর!রাগ নেই কেন?পুরো মুখে শঙ্কাভাব স্পষ্ট। শিগগির তুলির কন্ঠনালি হতে আওয়াজ বেরিয়ে এল। বাক্য নয় অতি সংক্ষিপ্ত একটা শব্দ, একটা নাম।

” আদ্র!”

তুলির কন্ঠে আদ্রর মুখভঙ্গির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটল। উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল,

” কেন পড়ো নি?কি করে ভুলতে পারলে তুমি এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়?ডু ইউ নো?ডায়েরি টা আমার, তোমার জীবনের সাথে ওপ্রোতভাবে জড়িত। আমার দেওয়া একটা জিনিসই তোমার দ্বারা সামলানো হয় না,ভুলে যাও! গুড তুলা। ”

আদ্রর কন্ঠে রাগের আভাস পাচ্ছে তুলি। আঁড়চোখে খুব ভালোভাবেই চোখে পড়ল আদ্রর কপালের ফুলে উঠা রগ। আদ্রর কথার মানে উদ্ধার হলো না তার তবে এতটুকু বুঝতে পারল ডায়েরি না পড়ে ভীষণ ভুল করে বসেছে। তুলির চোখে জল টলমল করছে। গড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা আপ্রাণ। পলক ফেললেই বুঝি গড়াবে অতি নিশ্চিন্তে। সমস্ত মনটাতে ভিজে হাওয়া যেন শ্রাবণের অরণ্যের গন্ধ নিয়ে নিয়ে ঘনিয়ে ওঠছে। হৃদয়ে বইছে এলোমেলো বাতাস। তুলি অনঢ় রইল। কথায় কথায় কাঁদবে না বলে পণ করল মনে মনে। আদ্রর রাগ করাটা সঠিক, এর প্রেক্ষিতে কান্না করাটা একদমই বেঠিক মনে হলো তুলির। ধীরস্থ পায়ে খানিকটা আগাল আদ্রর দিকে। কিছুটা দূরত্ব সংবরণ করে আনত স্বরে বললো,

” ক্ষমা করা যায় না ডাক্তার সাহেব?”

তুলির মোলায়েম স্বর কর্ণগোচর হওয়া মাত্র শীতল স্রোত বয়ে গেল আদ্রর বক্ষে। বলিষ্ঠ আগ্রাসী হস্তে তুলিকে টেনে আবদ্ধ করে নিল বাহুতে। তুলি থতমত খেয়ে গেল। আকস্মিকতায় অনেকখানি চমকালো। পরক্ষণেই আদ্রর বুকে মাথা এলিয়ে হাসল মৃদু। বেশ শান্তি অনুভূত হচ্ছে তার। প্রশ্নের জবাবে প্রশস্ত বুকে জায়গা দেওয়ার মানেই তো রাগ নেই তুলা,ক্ষমা করব কি!পিঠে আদ্রের হাতের বন্ধন শক্ত হয়ে এল। তুলিকে জড়িয়ে রেখে পার হলো কয়েক সেকেন্ড, কয়েক মিনিট। হাতের বাঁধন শিথিল করে নিল একটা সময়। তুলির অযত্নে এলোমেলো হওয়া চুল গুলো হাতের সাহায্যে গুছিয়ে দিল আদ্র। হলুদ ওড়না টা দিয়ে মাথার ঘোমটা টা টেনে দিল। এক হাতের ভাঁজে তুলির ছোট কোমল হাত টা নিয়ে এগিয়ে চলল অন্যদিকে। বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তুলি হাতের দিকে একবার তাকাল,ঘাড় ফিরিয়ে আরেকবার তাকালো কবরস্থানের দিকে। একপাশে সারি বেঁধে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূঁড়া গাছগুলো থেকে ঝরে পড়ছে পাতা। ফুল নেই গাছগুলোতে তবুও কি আকর্ষণ করার ক্ষমতা নিয়ে স্থির হয়ে আছে এরা। তুলির মনে হলো আজ বুঝি বসন্ত। ফাল্গুনের বাতাসের ন্যায় পথে পথে ঝরছে পাতা। হলুদ রাউন্ড ড্রেস পড়ে এক শ্যামবর্ণা প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাচ্ছে অজানা কোথাও। সত্যিই কি আজ বসন্ত এসেছে ধরণীতে?অস্থির আঁখি যুগল নিয়ে তুলি চারপাশে তাকাল। মনে মনে বললো,

” উহু!আজ তো বসন্ত নয়। বসন্ত হলে তো কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে ছেয়ে থাকত গাছগুলো, ডাক্তার সাহেবের সুঠাম দেহে জড়িয়ে থাকত একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি।”

আদ্রর পা থমকাল পুকুর পাড়ে এসে। সেই সাথে থেমে গেল তুলির কদম। সামনে তাকিয়ে দেখল বিশাল বড় একটা পুকুর। সবুজ হয়ে আছে পানি। খুব বেশি বড় নয় তবে ভীষণ সুন্দর একটা ঘাট বাধিয়ে রাখা হয়েছে পুকুর পাড়ে। তুলির মনটা ক্ষণিকের জন্য হলেও আনন্দিত হয়ে উঠল। কিছুটা উঁচানো স্বরে বললো,

” ঘাটে বসি?”

হাতের ভাঁজ ঢিল হতেই তুলি উত্তরের প্রতীক্ষায় ব্যায় করল না সময়। লুব্ধনেত্রে, গটগট পায়ে এসে বসে পড়ল ঘাটে। পাশেই পাথরকুচি ও কন্টিকারীর জঙ্গল। হাত এগিয়ে নিয়ে একটা পাথর কুঁচি পাতা ছিঁড়ে নিল। মৃত বাচ্চাটার মুখ টা মনে পড়তেই ঝিমঝিম করে উঠল দেহের সর্বাঙ্গ। ক্রমে আনন্দ ছড়িয়ে পড়া মনটা তে হঠাৎই নেমে এল শ্রাবণ ধারা। পাশে আদ্রর বসার উপস্থিতি অনুভব করল। মলিন,বিষন্ন দৃষ্টি তাক করল সঙ্গে সঙ্গে। দাদার কথাটা মনে পড়তেই নিষ্প্রভ স্বরে জিজ্ঞেস করল,

” আপনাদের বাড়ি তো বান্দরবান ও ঢাকা এই দুই শহরে। তাহলে দাদা কে রাজশাহী তে কেন কবর দেওয়া হয়েছে আর এই জায়গাটার সাথেই বা আপনাদের কিসের যোগসূত্র?”

আশ্চর্য! তুলির প্রশ্নে আদ্র হাসছে। আদ্রর ঠোঁটের কার্ণিশে লেগে আছে ম্লান হাসি। মোহে আটকা পড়ে গেল তুলি। একবারের জন্যও অদ্ভুত লাগল না আদ্রর হাসি টা। তুলির খুব জঘন্য, বেহায়া একটা স্পৃহা, বাসনা জাগল মনে। আদ্রর হাসিতে মাখামাখি অধর যুগলে স্পর্শ করার ইচ্ছে হল। হাতে নয় বরং নিজের ওষ্ঠ দ্বারা । সমুদ্রের উতালপাতাল ঢেউয়ের ন্যায় তুলির অন্তর টা উতালপাতাল করছে,এবড়ো থেবড়ো হয়ে পড়ছে,আদ্র কে স্পর্শ করার তৃষ্ণায় খাঁ খাঁ করছে মন। আদ্র তুলির দিকে চেয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়। তাকানোর ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে যেন তুলির মন পড়তে মগ্ন সে। চোখে চোখ পড়তেই তুলি বিমূঢ়তায় বাক হারা হয়ে পড়ল। নজর সরিয়ে নিক্ষেপ করল দূরের গাছপালাতে। কর্ণে এলো আদ্রর দৈবাৎ, লহু স্বর।

” ভালোবাসার টানে এই জায়গার সাথে জড়িয়েছিলেন আমার দাদা। প্রণয়ে এমনভাবে ডুবেছিলেন মৃত্যুর আগে আমার কাছে অনুরোধ করেছিলেন উনার দেহ টা যেন রাজশাহীতে সমাহিত করা হয়,উনার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর পাশে।”

একরাশ বিস্ময় নিয়ে তুলি চক্ষুদ্বয় বড়সড় করে চাইল আদ্রর দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠল,

” আপনার বুবু রাজশাহীর ছিলেন?আমি তো ভাবতাম উনার বাড়ি ঢাকা। আপনার দাদা এতদূর পাত্রী দেখে বিয়ে করেছেন!”

সায়েরা বেগমের কাছে এক দু’বার উনার শাশুড়ির কথা শুনেছিল তুলি। কথায় কথায় জানতে পেরেছিল আদ্র কখনও দাদি বলে ডাকত না। সবসময় কন্ঠে মায়া নিয়ে বুবু বলেই ডাকত উনাকে। আর আদ্রর নীল বর্ণী চোখের মণির সাথে তার দাদির চোখের মণির মিল রয়েছে। আদ্র যখন ছোট ছিল তখন নাকি সবাই বলে বেড়াত ছেলেটা একদম দাদির চোখগুলো পেয়েছে। আর স্বভাব হয়েছে দাদার মতো। গম্ভীর, রগচটা ছেলে। তুলি তখন মনে মনে হেসেছিল,বলেছিল-” শুধু রাগী, গম্ভীর নয়, প্রচন্ড কেয়ারিং ছেলেটা।”

শার্টের উপরের বোতাম খুলে ফেলল আদ্র। হুট করেই উত্তাপ টা বেড়ে গেছে। প্রকৃতিতে বাতাসের আনাগোনা নেই বললেই চলে। রোদ উঠছে মাথাচাড়া দিয়ে। তুলির দিকে তাকিয়ে ধীর স্থির ভঙ্গিতে বলতে আরম্ভ করল,

” আমার বুবুর বাড়ি রাজশাহীতে। পরিবারে বলতে বাবা মা আর উনিই ছিলেন। তবে খুব ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলেন তিনি। এই যে জায়গা টা দেখছো এটা সবটা বুবুকে উনার বাবা চব্বিশতম জন্মদিনে গিফট করেছিলেন। পেশায় মেডিক্যাল স্টুডেন্ট ছিল। আমার ডাক্তার হওয়ার পেছনে উৎসাহ আমার বুবু জাগিয়েছিলেন। কিন্তু মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার আগেই চলে গেলেন উনি আমাদের একা ছেড়ে। ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত হওয়ার পর উনার অনেক ক্যান্সারে আক্রান্ত ছোট বাচ্চাদের সাক্ষাৎ হতো। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার আছে যাদের পক্ষে ক্যান্সার চিকিৎসা করানো সম্ভব না। এসব দেখে বুবু খুব কষ্ট পেতেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানো তুলা?আমার বুবু একদম তোমার মতো নরম মনের ছিলেন। কোনো কিছুরই অমিল নেই স্বভাবের দিক থেকে তোমার সাথে। উনার বাবা-মার এতো টাকা উনি একা ভোগ করবেন অথচ এসব শিশুগুলো বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে,শৈশবেই সমাপ্তি ঘটবে তাদের জীবকাল এটা তিনি মানতে পারছিলেন না। তাই এই জায়গাটাতে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের থাকার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। নিজের একাকিত্ব লাইফটা কাটাতে শুরু করলেন বাচ্চাদের সাথে। বুবুর পঁচিশ বছর বয়সে উনার বাবা-মা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। তখন থেকেই কাটাতে শুরু করেন নিঃসঙ্গ জীবন।

দাদার এক বন্ধু ছিলেন তখন এখানকার সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্বে। তিনি দাদার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। দাদা প্রায় বছর খানেক পর পর উনার সাথে দেখা করতে রাজশাহী চলে আসতেন। উনার মুখে বাচ্চাদের জন্য নেওয়া উদ্যোগের কথা শুনে দাদা বেশ অবাক হয়েছিলেন। ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন এতো ভালো মনের মানুষ কে দেখার, যিনি অন্যদের জন্য ভেবেছেন। কথামতো চলে এলেন, বুবুর সাথে পরিচয় হলো। প্রথম দেখাতেই কোনো কিছু না ভেবে বিয়ের প্রস্তাব রাখেন দাদা। পরে জানতে পেরেছিলাম আগে থেকেই না দেখে বুবু কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ দাদা নিজের জন্য এমন একটা জীবনসঙ্গী চাইতেন সবসময়। বুবু প্রথমে একটু দ্বিধাবোধ করলেও পরে আর না করেন নি। বুবুর ইচ্ছে ছিল উনি মারা গেলে যেন উনার এই প্রিয় জায়গাটাতে সমাহিত করা হয়। দাদা কথা রেখেছিলেন, আর আমি রেখেছিলাম উনার কথা। জানিনা কতটুকু পারছি তবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব বুবুর দেওয়া দায়িত্ব টা পালন করতে। বাবাও হেল্প করে, আমিও নিজের আয় করা টাকার বেশ অর্ধেক টাকা এখানেই ব্যয় করি। তাতে তোমার প্রবলেম নেই তো তুলি?”

আদ্রের বলা শেষ বাক্যে ভড়কে গেল তুলি। মাথা দু’দিকে নাড়াল তৎক্ষনাৎ। তৎপরে উগ্রতার সহিত বললো,

” আপনার দাদা-বুবু কিভাবে মারা গিয়েছেন আদ্র?”

আদ্র দুর্বোধ্য হাসলো। জবাবে বললো,

” অবাক করা ব্যাপার কি জানো তুলা?যারা নিরীহ,ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের জন্য করে গেছেন নিজেদের সবটুকু দিয়ে তারাই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।”

তুলির বুক টা কেঁপে উঠল প্রচন্ড বেগে। নিয়তি বড়ই অদ্ভুত! ভালোবাসার মানুষের টানে এতদূরে চলে এল আদ্রর দাদা। সত্যিই ভালোবাসা খুব সুন্দর। আচ্ছা তুলির কিছু হলে আদ্র কি কষ্ট পাবে?দাদার মতো কি কারো কাছে আবদার করবে তুলির নিকট আসার?সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল তুলি। আদ্রর হাতে হাত রেখে মনে মনে বললো,

” পূর্ণ একটা পরিবার চাই, ডাক্তার সাহেবের ভালোবাসার অস্তিত্ব ধারণ করা বাকি এখনও। এর আগে প্রাণ ত্যাগ করতে চাই না আমি। জানি দিনকে দিন লোভী হয়ে যাচ্ছি। মন টা মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। ডাক্তার সাহেবের বৃদ্ধ রূপ টা দেখার লোভ টা বেড়ে যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। ”

#চলবে,,,

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪৫

রাজশাহী থেকে ফিরার দু’দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। এতো জলদি সময়গুলো চলে যাচ্ছে অথচ টের পাচ্ছে না তুলি। সময় তো এমনই, কারো জন্য অপেক্ষা করার নিয়ম নেই। হিজাব বাঁধতে বাঁধতে তুলি সারা রুমে চোখ বুলালো। শূণ্যতায় ছেয়ে আছে পুরোটা কক্ষ। তুলির মনটা মাত্র কয়েক ঘন্টায় আদ্র দেখতে না পারার বিতৃষ্ণায় ক্লান্তিতে ভুগছে। আদ্র বিহীন বিষাক্ত, যন্ত্রণাময় লাগছে সবকিছু। ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে নেমে এল নিচে। সায়েরা বেগম, রাদিফ সাহেব নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছেন তার জন্য। তুলি রাদিফ সাহেবকে উদ্দেশ্যে করে বললো,

” আসসালামু আলাইকুম বাবা।”

রাদিফ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে তুলির মুখের দিকে তাকালেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে আওড়ালেন,

” চেহারাটা মলিন হয়ে আছে কেন প্রিন্সেস?”

আচমকা এমন প্রশ্নে তুলি হকচকালো। নিরব থেকে ভাবল কয়েক পল। কোনো সদুত্তর খুঁজে পেল না। মেকি হাসার ভান করে ক্ষীণ স্বরে প্রতুত্তরে বললো,

” কই না তো বাবা। আমি একদম ঠিক আছি।”

উত্তর টা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকল না রাদিফ সাহেবের কাছে। তুলির প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন,

” তুই দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস। আজ আমার সামনে বেশি বেশি খাবি। কাজের ব্যস্ততার জন্য তো সুযোগ পায় না তোদের সাথে টাইম স্পেন্ড করার। আদ্র কে কতবার বললাম ডাক্তারির পাশাপাশি আমার বিজনেস টা একটু আকটু সামলাতে। ছেলেটা শুনেও যেন শুনে না। কবে যে নিস্তার পাবো কাজ থেকে আর কবে যে তোকে নিয়ে,আমরিন,ইনশিতা কে নিয়ে লং লং ট্যুর দিতে পারবো সেটাই ভাবছি। ”

খলখলিয়ে হাসল তুলি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাদিফ সাহেবের মন রাখতে খেয়ে নিল। কোচিং এর জন্য উঠে দাঁড়াতেই সায়েরা বেগম পিছু ডেকে উঠলেন। কর্ণপাত হওয়া মাত্র অগ্রবর্তী পা টা ফিরিয়ে আনল তুলি। সায়েরা বেগম দরজার কাছাকাছি এসে বললেন,

” আমরিন তো নিবিড়দের বাসায়। হয়ত আজকেও আসবে না। তুই একা যেতে পারবি তো মা?”

” কেন পারব না খালা মণি?ড্রাইভার আংকেল তো নিয়ে যাবে আমাকে। তুমি একদম টেনশন করবে না। পরে তোমার কিছু হলে ডা.আদ্র আহনাফ আমাকে শূলে চড়াবে।”

সায়েরা বেগম কে অবয়ব দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। গাড়িতে উঠে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিণে নজর দিতেই মন খারাপ,অভিমান টা বেড়ে গেল হুড় হুড় করে। গত রাতে বেরিয়ে গেছে তারপর আর ফিরে নি আদ্র। রাতে কল দিয়ে জানিয়েছে হসপিটালে ইমারজেন্সি থাকায় আজ ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে। ইদানীং তুলির একা থাকতে খুব ভয় লাগে। কেমন উল্টো পাল্টা অনুভূতি জাগে মনে। কারণবশত, গত রাতে সায়েরা বেগম কে তুলির সাথে থাকতে বলেছিল আদ্র। রাতে ফোন দিয়েছে অনেকবার। কিন্তু সকাল হতে একটা কলও আসে নি। মোবাইলটাও কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে। তুলি কয়েকবার কল দিয়েছে প্রতিবারে কানে ভেসে আসছে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না। শেষমেশ সাগরকে কল দিল। কয়েক সেকেন্ড পার হতেই অপরপাশ থেকে কানে এলো,

” মাত্রই তোমাকে কল দিতে যাচ্ছিলাম বউ।”

সাগরের ফোনে পরিচিত সেই কন্ঠ শুনে তুলির বুকের উচাটন বেড়ে গেল হঠাৎ। ঝটপট মোবাইলটা চোখের সামনে আনল। ভালো করে চেক করে দেখল নাম্বার টা সাগর এর। তাহলে আদ্রর কাছে কি সাগরের মোবাইল টা?আদ্রের টা কোথায়?পুনরায় কানের কাছে ফোন টা নিল। বিচলিত স্বরে বলে উঠল,

” আপনার ফোন কোথায় ডাক্তার সাহেব?”

” ভেঙে গেছে।”

আদ্রর সাদামাটা উত্তরে তুলি চমকালো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” ভেঙে, ভেঙে গেছে মানে?”

” এক ওয়ার্ড বয়ের সাথে খুব রাগ উঠেছিল। রাগ তো ওর উপর দেখাতে পারব না তাই মোবাইলের উপর দিয়ে গেল। এখন আর চলছে না। সাগরের কেবিনে এসে ওর থেকে মোবাইল নিয়ে কল দিলাম তোমাকে। ”

এতটুকু বলে থেমে গেল আদ্র। তুমি নিশ্চুপ হয়ে আদ্রর নিঃশ্বাসের শব্দ অনুভব করতে লাগল। পিনপতন নীরবতা বিরাজমান দু’জনের মধ্যে। আবেগি স্বরে ডাকল আদ্র।

” তুলি!”

মাদকতায় ভরপুর ছিল যেন ডাকটা। তুলির সারা দেহে বয়ে গেল শীতল স্রোত। কম্পিত কন্ঠে সাড়া দিয়ে বললো,

” জ্বি!”

“ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত ছিলাম আমি। তোমার রিনঝিনে স্বর এক নিমিষেই প্রশান্তিতে ভরে দিয়েছে মন টা। তুমি শুধু তুলা নয়,জাদুকরী লাগছে আমার কাছে। ”

আদ্রের কথায় তুলি আলতো হাসল। খুব করে বলতে ইচ্ছে করল,

” আপনার কথাবার্তা কলেজ প্রেমিকদের মতো মনে হচ্ছে আদ্র। আপনি কি কলেজে এভাবে ফ্লার্ট করতেন?ইশ!জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

কথাটা মনে চেপে রেখে তুলি মুখে কিছু বলবে তার পূর্বেই আদ্র বলে উঠল ব্যস্ত কন্ঠে,

” খুব জলদি ফিরব বউ। সাবধানে যেও।”

তুলি ফোন টা রেখে মাথা এলিয়ে দিল সিটে। হুট করে শরীর টা খারাপ করতে শুরু করল। মাথা টা ঝিমঝিম করে উঠল। গলায় উঠে এলো খাবারগুলো। ড্রাইভার কে বহু কষ্টে বলে উঠল,

” চাচা গাড়ি একসাইডে থামান।”

ড্রাইভার এক সাইডে গাড়ি থামাল। তুলি দ্রুত পায়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। পেটে হাত দিয়ে গড় গড় করে ঢেলে দিল সবকিছু। একটু আগে যা খেয়েছিল তা সব বেরিয়ে গেল। বমি করে দাঁড়ানোর মতো শক্তি অবশেষ রইল না যেন শরীরে। ড্রাইভার পানির বোতল নিয়ে দৌড়ে এলো। তুলি মুখ ধুয়ে,সামান্য একটু পানি পান করে দুর্বল কন্ঠে বললো,

” অতিরিক্ত গরমের কারণে হয়ত শরীর টা একটু খারাপ লাগছে চাচা। বাড়িতে কাউকে জানাবেন না প্লিজ। পরে দেখা যাবে আদ্র,খালা মণি অস্থির হয়ে পড়বেন।”

“আইচ্ছা মা। তাহলে বাড়িতে ফিরে চলো এহন। তোমার শরীল ডা বেশি দুর্বল মনে হইতাছে।”

ক্লান্ত স্বরে বলে উঠল তুলি,

” না চাচা। কোচিং সেন্টারে নিয়ে চলুন। ফিরে গেলে খালা মণির মনে সন্দেহ জাগবে। এছাড়া ঠিক আছি আমি। যেতে যেতে আরও সুস্থ হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। ”

তুলির কথার পৃষ্ঠে আর কিছু বললো না ড্রাইভার চাচা। কোচিং সেন্টারের সামনে গাড়ি থেমে গেল। তুলি নেমে বললো,

” ক্লাস শেষে আমাকে নিয়ে গেলেই হবে চাচা। আপনি এখন বাড়িতে চলে যান।”

” আইচ্ছা মা। তুমি সাবধানে থাইকো। আবার শরীর খারাপ লাগলে কিন্তু আদ্র বাবাজি রে ফোন দিবা। নইলে আমার সাথে রাগ করব।”

” ঠিক আছে। ”

ড্রাইভার কে বিদায় দিয়ে তুলি ভিতরে প্রবেশ করল। ক্লাসে ব্যাগ রেখে বসতে না বসতেই কোচিং এর একজন কর্মচারী এসে জানালো অফিস রুমে অনেকক্ষণ যাবত কেউ অপেক্ষা করছে তার জন্য। তুলি কন্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে বললো,

“আমার জন্য?”

ছেলেটা সম্মতিসূচক উত্তর দিল। তুলি প্রচন্ড অবাক হলো এতে। কে হতে পারে কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলেটার পিছু পিছু রুমে ঢুকল। চোখের সামনে যাকে দেখল তাতে মনে হলো তুলির পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। মুখখানা বিষিয়ে এসেছে তবুও শান্তকন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” আপনি এখানে?আমার জন্য কেন অপেক্ষা করছিলেন?”

ইতি ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললো,

” যাক চিনতে পারলে। তোমার মেমোরাইজিং খুব ভালো তো। নয়তো এক দেখায় এভাবে চেনা যায়?তাও কয়েক পলকের দেখাতে!”

ইতির ঠেস মেরে কথাতে তুলির বিরক্তি ধরে গেল। এমনিতেই প্রথম দেখাতেই এই মেয়কে ভালো লাগে নি তার। উদ্যেগি সুরে বলে উঠল,

” কেন এসেছেন?”

বাঁকা হাসল ইতি। আফসোসের সুরে বললো,

” তোমার সাথে জরুরি অনেক কিছু বলার আছে আমার। যেগুলো না শুনলে তুমি খুব প্রস্তাবে। দিনের পর দিন কিভাবে ঠকে যাচ্ছো সেটাও জানতে পারবে না কখনও লিটল গার্ল। ভীষণ আফসোস হয় আমার তোমার জন্য। তাই ভাবলাম তোমাকে সবকিছু জানানো দরকার। ধরে নাও আমি তোমার বড় আপু হিসেবে তোমাকে হেল্প করতে চাইছি।”

” কিন্তু আমি আপনার হেল্প চাই না। সেধে সেধে হেল্প করতে চেয়ে নিজেকে নিচে নামাচ্ছেন।”

কাঠকাঠ গলায় বলে তুলি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। ইতি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে সামনে এসে বাঁধা প্রদান করলো। স্থির হয়ে পড়ল তুলি। বিরক্তি যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ইতি তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠল,

” এতটুকু মেয়ের এত বেশি কনফিডেন্স ভালো নয়। তুমি কি জানো তুমি আদ্রের মন স্পর্শ করা প্রথম মেয়ে নয়?”

তুলি চকিতে মুখ তুলে তাকাল। কেঁপে উঠল অন্তস্থল। চোখ জোড়া ছলছল করছে। ইতির উচ্চারিত বাক্য টা বোধগম্য না হলেও কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বার বার। ধরা গলায় বললো,

” মমমম,মানে?”
______________

ভ্যাপসা গরমে অবস্থা নাজেহাল আদ্রর। কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে কল দিয়ে যাচ্ছে তুলি কে। কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আসছে। মেজাজ চওড়া হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। হাতের মোবাইলটা চেপে ধরে নিজের রাগ নিবারণের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাল। পরক্ষণেই অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠল বুক টা। তড়িঘড়ি করে কল দিল সায়েরা বেগমকে। রিসিভ হতেই ব্যগ্র কন্ঠে প্রশ্ন করল,

” আমার বউ কোথায় মা?”

সায়েরা বেগম বিস্তর হাসলেন। স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

” তোর বউ আসছে বোধ হয়।”

গাড়ির আওয়াজ শুনে ফের বলে উঠলেন,

” গাড়ি চলে এসেছে। আমি গিয়ে দেখছি তুলি এলো কিনা।”

আদ্র ফোন টা রেখে মাথার চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে নিল। পাশে দাঁড়ানো সাগরের উদ্দেশ্যে বললো,

” রিমি ফোন দিয়েছিল। তখন পেশেন্ট দেখায় বিজি ছিলি তুই। মোবাইল তো আমার কাছে ছিল। এখন কথা বলে নে।”

মোবাইলটা সাগরের হাতে দেওয়ার আগেই পুনরায় শব্দ সৃষ্ট করে বেজে উঠল। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সায়েরা বেগমের নাম্বার টা। বিলম্ব না করে ফোনটা রিসিভ করল। মুহুর্তেই কর্ণধার হলো সায়েরা বেগমের আশঙ্কাজনক কন্ঠস্বর।

” তুলি কে কোচিং সেন্টারে পাওয়া যায় নি আদ্র। ড্রাইভার একা ফিরে এসেছে। এটাও বললো ওর নাকি সকাল থেকে শরীর খারাপ ছিল। আমার চিন্তা হচ্ছে। তুই ওকে খুঁজে বের কর বাবা। কোথায় গেল মেয়েটা,,”

মায়ের কথা শোনার তর সইল না আদ্রের। ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল হৃদস্পন্দন। সূক্ষ্ম ব্যাথা করে উঠল বুকের বা পাশ টা। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ল পুরো বক্ষে। পাথরের মতো ভার হয়ে গেল বুক টা।সাগর ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। আদ্রর রক্তিম চোখ দেখে পিলে চমকে উঠল তার। তড়বড় করে বললো,

” কি হয়েছে আদ্র?”

আদ্র মোবাইলটা সাগরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এলোমেলো পায়ে দৌড়ে গাড়ির কাছে এলো। সাগরের ডাক উপেক্ষা করে গেল সম্পূর্ণ। দ্রুত ড্রাইভ করে কোচিং সেন্টারে এলো। কিন্তু তুলির কোনো হদিস পেল না। সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করে দেখল ইতির সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে তুলি। কিন্তু কোথায় গেল? কিভাবে খুঁজবে আদ্র! হৃদয়ে তোলপাড় হচ্ছে। নিজের প্রাণনাশিনী কে হারানোর ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে বার বার। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। ড্রাইভ করতে করতে ঝাঁঝালো গলায় আওড়ালো,

” প্রত্যেক মানুষের দু’টো দিক থাকে ভালো এবং খারাপ। আমার মাঝেও দু’টো আছে- গভীর চাওয়া এবং শ্যামবতীর জন্য হিংস্র হয়ে উঠা।”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪৬

মেডিক্যাল লাইফ, স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ। নিজের গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে চলতেই ভীষণ পছন্দ করি আমি ছোটবেলা হতে। এতোকাল আমার সঙ্গী হিসেবে আমি নিজেই ছিলাম। বিনা কারণেই একা থাকাটা প্রচন্ড পছন্দ আমার। কিন্তু মেডিক্যাল ক্লাসের প্রথম দিন থেকে নিজের স্বভাবের পরিবর্তনের নড়চড় না হলেও একাকীত্বটা ঘুচে গেল অনেকাংশে। জীবনের সাথে জড়িয়ে গেল বন্ধু নামক সম্পর্ক। অন্তু,রিমি,পায়েল,সাগর,নিবিড়, ইতি এই নামের মানুষগুলো আমার কাছের মানুষ হয়ে উঠল। মেয়েদের সাথে চলাচল টা বিশেষ পছন্দ নয়। পায়েল,রিমি,ইতির সাথে বরাবরই দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম। কিন্তু পায়েল,রিমির ব্যবহার ছিল আমার সাথে একদম ইনশিতা, আমরিনের মতো। বন্ধুত্ব পেরিয়ে বোনের তালিকায় নাম লিখালো ওরা অতি নিভৃতে,যতনে। তবে ইতির দৃষ্টি কেমন মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ থাকত। একটা বছর পার হতেই ইতির অন্যরকম বিহেভিয়ার লক্ষ্য করতে লাগলাম। এমনিতেই মেয়েটা ভিন্ন ছিল। কেমন যেন সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে থাকত আমার দিকে। আমি যা বুঝার বুঝে গেলাম। বুঝতে পারলাম বন্ধুত্ব ডিঙিয়ে অভিনব সম্পর্ক গড়তে চাইছে ইতি। কিন্তু! কিন্তু আমার এতো বছরের জীবনে কাউকে মনে ধরে নি। কোনো মেয়ে আমার মন স্পর্শ করার যোগ্যতা টা অর্জন করতে পারে নি।

এতটুকু পড়ে মুখে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল তুলি। চোখ ছাপিয়ে অঝোর ধারায় ঝরছে জল। ডাগরডাগর শান্তিপূর্ণ আঁখি যুগলে অশ্রুদের দখল হলেও অধর কোণে প্রস্ফুটিত হাসি। ভেজা কন্ঠে বারংবার ” কোনো মেয়ে আমার মন স্পর্শ করার যোগ্যতা টা অর্জন করতে পারে নি” বাক্যটি পড়লো। উচ্চারণ করল অনেকবার।আটঁকে আসা নিঃশ্বাস যেন মুক্তি পেল এতক্ষণে। তবে পরবর্তী পাতায় কি লিখা থাকতে পারে?কি হতে পারে ভেবেই তুলির খুশি টা উবে গেল নিমিষেই। মনের সুপ্ত কোণে ব্যাথা জড়ো হলো দৈবক্রমে, মনে পড়ে গেল ইতির বলা বিষাক্ত বাক্যগুলো।

” আদ্র কে ভালোবাসি আমি। আদ্রও একটা সময় আমাকে ভালোবাসত। তোমার মতো কালো, গ্রামের মেয়েকে আদ্রর মতো সুদর্শন একটা ছেলে যে কি-না ভালো একজন হার্ট সার্জন সে কেন ভালোবাসতে যাবে?তুমি কখনও আদ্রর টাইপ ছিলে না,আদৌ হতে পারো নি। তুমি তো বাজিমাত করেছ তোমার খালা মণির জন্য। হ্যাঁ মিসেস সায়েরা বেগম! মিসেস সায়েরা বেগম তোমাকে আদ্রর বউ করে আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। সুইডেন থাকতে শুনেছি আদ্র আলাদা থাকত,কেন থাকত বলো তো?শুধু মাত্র তোমার জন্য। তোমাকে বিয়ে করতে রাজি ছিল না সে। কারণ তার ভালো লাগা,মন স্পর্শ করা মেয়ে টা তো আমি। তুৃমি ঠকে গেছো,আদ্র তোমাকে কোনো কালেই ভালোবাসে নি। কোনো কালেই না। লজ্জা করল না নিজের যোগ্যতার চেয়ে উঁচুতে হাত বাড়াতে? যদি বিন্দু মাত্র আত্মসম্মান থাকে তাহলে আদ্রকে মুক্তি দাও। ও পরিবারকে ভালোবাসে বলে সংসার করছে তোমার সাথে মায়ের মন রাখতে। তবুও তুমি থাকবে?”

তুলি তখন হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ইতির মুখের দিকে। মনে হচ্ছিল ইতির কথাগুলো ছুরি হয়ে বার বার আঘাত করছে কলিজাতে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আটকে ছিল কন্ঠনালিতে। তুলি কয়েক মুহুর্ত স্তব্ধ থেকে বিনা বাক্যে বেরিয়ে এল কোচিং সেন্টার থেকে। ইতি পিছু পিছু এসে আরও অনেক কিছু বলছিল কিন্তু তুলি শুনে নি। অথবা শুনেও না শোনার ভান করে একটা সিএনজি ধরে চলে এসেছে বাবা মায়ের কাছে। এসেই কারো সাথে কোনো কথা বলে নি, এলোমেলো পায়ে কোনোরকমে রুমে ঢুকেছে। মিনিট কয়েক নিঃসাড় হয়ে পড়েছিল বিছানায়। ড্রয়ার থেকে অতিশয় যত্নে গুছিয়ে রাখা আদ্রর ডায়েরি টা বের করে পড়তে লাগল। তখনও আঁখিদ্বয়ে টলমল করা জল গড়িয়ে পড়ে নি। গড়াতে দেয় নি তুলি। ভেঙে পড়ে নি সে। নরম,কোমল মনের বোকাসোকা মেয়েটা হুট করেই কেমন কঠোর রূপ ধারণ করে ফেলল।

তুলি ধুরুধুরু বুক নিয়ে পরের পাতায় গেল। নেত্রযুগল নির্মিল্ত করে জোরে একটা শ্বাস টেনে নিল নিজের অভ্যন্তরে। নিমেষে আঁখিপল্লব ছুঁয়ে কপোল বেয়ে ঝর্ণার ন্যায় নেমে গেল জলধারা। অতঃপর অনেকখানি সাহস জুগিয়ে চক্ষু মেলে ধরল ডায়েরির পৃষ্ঠায়।

সময় আপন গতিতে অনেক হতে অনেকখানি পেরিয়ে গেছে। মাঝে কেটে গেছে বছরের পর বছর। মেডিক্যাল লাইফ শেষের পথে। বন্ধুত্ব গভীর হয়েছে বললেও ভুল হবে, ওরা যেন আমার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এক মুঠে শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চলার পথে। আশ্চর্য হলেও সত্য এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে ইতি প্রেমের হাত বাড়ায় নি। তাই একটা সময় মনে হলো আমি ভুল। নিতান্তই ভুল আমি। বন্ধু হিসেবে ও আমার মন স্পর্শ করলেও আমার ভালোবাসা হতে পারে নি,না হতে পেরেছে ভালো লাগা।

মুখোশ! মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অনেক নিকৃষ্ট মানুষের চেহারা। একটা সময় সেই মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল আমার জন্য, সকলের জন্য ইতির অপ্রত্যাশিত মুখশ্রী টুকু। শী প্রপোজড টু মি ফর শেয়ারিং বেড উইথআউট ম্যারেজ। হ্যাঁ ঠিক বলেছি,যাকে শুদ্ধ বাংলাতে বলতে পারি অবৈধ সম্পর্ক গড়তে হবে, ভালোবাসা নয়।

এতটুকু পড়া মাত্র সারা শরীর শিরশির করে উঠল তুলির। মুখটা কেমন তেঁতো হয়ে এল। রাগে চেপে বসল মস্তিষ্কে। ইতি কে ধ্বংস করে দেওয়ার জেদ চাপলো মনের কুঠুরিতে। একটা মেয়ে এতোটা নিচু হতে পারে!

কথাটা শুনেই পায়ের রক্ত তড়তড় করে মাথায় উঠে গিয়েছিল। সাথে সাথে রক্তজমানো চিৎকার করে উঠলাম আমি। চোখ দুটো জ্বালা করছিল ভীষণ। যাকে বন্ধুত্বের সম্পর্কে বেঁধে নিয়েছিলাম তার এহেন চেহারা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল আমার নিকট। নিজের আক্রোশ দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি আমি। প্রস্তাব টা নিচুস্বরে করলেও থাপ্পড় টা সবার সামনেই মেরেছি। অন্তু,সাগর,নিবিড় না আটকালে ওকে খুন করেই ক্ষান্ত হতাম। মেয়ে জাতি নরম,কোমল,আবেগি হয়। নিজেদের আত্মসম্মানের ব্যাপারে বেশ সচেতন হয় তারা কিন্তু একি রূপ দেখলাম আমি!পায়েল,রিমি কেঁদেছে অনেক হয়ত ভেবেছে ইতি বন্ধুত্বের মান না রেখে অশালীন প্রস্তাব করেছে এতে আমি ওদের ভুল বুঝবো। কিন্তু ওরা দু’জন ভিন্ন, একদম ভিন্ন। আমরিন,ইনশিতার মতো দু’টো বোন আমার।

বন্ধু মানে কেবল বন্ধু নয়,বন্ধু মানে বিশ্বাস,সুখ -দুঃখের সঙ্গী। আমরা আমাদের জীবনে বরাবরই বন্ধু নির্বাচনে ভুল করি। তবে সব মানুষ এক রকম না। যেমন পায়েল,নিবিড়, অন্তু,রিমি,সাগর আমার জন্য প্রাণ ত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করবে না। কারণ আমার জন্য ওদের কাঁদতে দেখেছি,আমার সুখে হাসতে দেখেছি,আমার চলার পথের পথচারী হতে দেখেছি সর্বদা। অন্যদিকে ইতি বন্ধুরূপে কালসাপ। ইতির নিকৃষ্টতা এতটুকুতেই সমাপ্ত থাকে নি।

যখন ইতির বিষয়টা আমাকে ভেঙে দিয়েছে,আমার বিশ্বাসে আঘাত হেনেছে তখনই মা আমাকে নিজের মনের একটা ইচ্ছে প্রকাশ করল। মায়ের নাকি একটা পিচ্চি মেয়ে কে প্রকান্ডভাবে মনে ধরেছে আমার জন্য। ব্যাপারটা সেই সময়ে একদম আমলে নিলাম না। মা বার বার বলত গ্রামে নানুর বাড়ি যেতে,মেয়েটাকে দেখতে,তাকে বউ করে আনতে এ বাড়িতে। মায়ের ইচ্ছে টা পূরণ করার ইচ্ছে আমার হলেও পিচ্চি মেয়ে বলে পিছিয়ে গেলাম। গম্ভীর তা ধরে রেখে প্রশ্ন করলাম -“বয়স কত?”

মা খুঁৎখুঁৎ স্বরে প্রতুত্তর করল-” সেভেনে পড়ে।”

ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য। বিরক্তি প্রকাশ করে পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। এতটুকু একটা মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারি না আমি। মা পিছন থেকে অনেকবার বলেছে-“মেয়েটা আরও বড় হলেই বিয়ে করাবো আদ্র। তোর আফসানা খালা মণির মেয়ে। ”

সেদিন মায়ের কথাগুলো কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার ফলে মা অন্য কিছু ভেবে বসল,যা আমার হৃদয়ে আঘাত করার কারণ হয়ে দাঁড়াল। রক্তাক্ত হৃদয়টা দ্বিতীয় বার রক্তাক্ত হয়ে গেল। তাজা হয়ে গেল সবটুকু ক্ষত। উনি নিজের ছেলের উপর বিশ্বাস রাখতে পারল না। যেই ছেলে নিজের জীবনের সবকিছু মা কে বান্ধবী ভেবে শেয়ার করেছে তার উপর অটল বিশ্বাস রাখতে পারল না। লিখতে গিয়ে খুব তাচ্ছিল্যের হাসি পাচ্ছে আমার। মায়ের ধারণা ছিল আমি ইতি কে ভালোবাসি,তাই উনার প্রস্তাব এড়িয়ে যাচ্ছি, এড়িয়ে গিয়ে নাকচ করছি। নিজের ইচ্ছে পূরণের জন্য হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। পিচ্চি মেয়েটা আমার মায়ের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। ইতি কে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ইতি যা চাইবে তা-ই করবে বলে কথা দেয় আমার মা। আর ইতি সে তো সেদিনের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে বসেছিল হাতে। মা কে পুরো রেষ্টুরেন্টের সামনে বলেছিল পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে আমার হয়ে তবেই সরে যাবে সে। সেদিন অন্তু,পায়েল,আমরা সকলে রেষ্টুরেন্টে উপস্থিত না থাকলে আমি স্বচক্ষে দেখতেই পেতাম না ইতি কে সরানোর নিমিত্তে আমার মা কতটা অন্যায় কাজ করতে যাচ্ছিল। ইতি খারাপ,চরিত্রহীনা মেয়ে তা সম্পর্কে অবগত ছিল মা। ভেবেছে ইতি কে ভালোবেসে ফেলেছি বলেই এতোটা কষ্ট পাচ্ছি,গম্ভীর হয়ে থাকছি সারাক্ষণ। তাই নিজের ছেলের জীবন থেকে সরাতে অন্যায় কাজে সায় দিতে,নিচে নামতে একটুও ভাবে নি মা। মায়ের এই অন্যায় মানসিক ভাবে শেষ করে দিয়েছে আমাকে। ঐ মুহুর্তে মনে হয়েছে আমার মৃত্যু হোক।

মা’কে ইতির পা ধরতে দেয় নি তবুও অন্যায় করেছে মা। অবিশ্বাস করেছে আমাকে। মায়ের কাজ টা অন্যায় হয়ে গেথেঁ গেছে আমার হৃদয়পটে। মা আমার উপর এতোটাই বিশ্বাস হারিয়েছিল কখনও বুঝতেই পারে নি ইতি তো কখনও আমার জীবনেই ছিল না,মন-মস্তিষ্ক তো অনেক দূর। তবে ছিল ঘৃণার লিস্টে এবং থাকবে। জীবন থেকে সেদিনই সরিয়ে দিয়েছি যেদিন ওর মুখোশ খুলে গিয়েছিল,সেদিনই ধরে নিয়েছিলাম ইতি নামের কোনো বন্ধু বা মানুষের ছায়া বা চিহ্ন আমার জীবনে ছিল না। ইতির পুরো ডিটেইলস বের করে জানতে পারি ওর কাজিনের সাথে রিলেশন আছে। কেমন তা বোধ হয় ব্যক্ত করা প্রয়োজন নেই।

একজন সন্তানের কাছে বাবা-মার থেকে আপন কেউ হয় না। সেই বাবা-মা যদি বিশ্বাস হারায় তাও অহেতুক কারণে তবে তা মৃত্যু সমতুল্য। আমার অভিমান এতোটাই প্রখর আমি পারি নি মায়ের সাথে আর কখনও মুখ ফুটে কথা বলতে। বাড়ি ছাড়ার আগে শুধু এটাই বলেছিলাম -” ইতি আমার জীবনে ছিল না,এতে সরানোর প্রশ্নও আসে না, তবুও তোমার চেষ্টা দেখে বলব অন্যায়ভাবে তুমি মেয়েটা কে আমার জীবন থেকে সরিয়েছ মা। খুশি তো তুমি?পারবে তো আমার অভিমানে রটানো মিথ্যে একটা বাক্য বয়ে বেড়াতে?জানি পারবে না, আমিও পারছি না তোমার মিথ্যে ভ্রান্ত ধারণা বয়ে বেড়াতে।”

খটখট শব্দে তুলির হাত থমকে গেল। সাদা পর্দা গুলো উড়ছে বাতাসের তালে তালে। কেমন একটা গুমোট ভাব ছড়িয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ কক্ষ জুড়ে । আচমকা নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে তুলির। তুলির হাত কাঁপছে। ডায়েরি টা বন্ধ হয়ে গেল। কর্ণকুহরে দরজা ভেদ করে হুড়মুড় করে প্রবেশ করল আদ্রর অস্থির, শঙ্কিত ডাক। তব্দা খেয়ে গেল তুলি। ডায়েরি টা বিছানায় ফেলে দরজার কাছে আসল দৌড়ে। আবারও কানে এল-” ওপেন দ্যা ডোর তুলা।”

ছিটকিনি খুলে দিল তুলি কাঁপা কাঁপা হস্তে। মনে এক রাশ ভয় ঝেঁকে ধরল। দেয়ালের একপাশে দাঁড়িয়ে রইল ঠেসে। বক্ষস্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে উঠানামা করছে। আদ্র ভুল বুঝবে না তো! দরজা ঠেলে আদ্র প্রবেশ করতেই চোখ বুঁজে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে উঠল,

” আমি আপনাকে অবিশ্বাস করি নি ডাক্তার সাহেব। বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করি নি, ভুল বুঝি নি। মানুষ অন্যকে অবিশ্বাস করতে পারে,আমি আমার আত্মাকে কিভাবে অবিশ্বাস করব বলুন?অন্যের মিথ্যা অথবা সত্য বাক্যে নিজের উপর বিশ্বাস হারানো যায় না। আপনি তো আমার প্রাণ, আমার অস্তিত্ব ডাক্তার সাহেব। আমি,,”

হাতে টান পড়তেই তুলির কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। চোখ মেলে নিজেকে আদ্রর নিকটে, খুব নিকটে আবিষ্কার করল। নীলাভ নেত্রে চক্ষু রাখতেই ভূকম্পন ন্যায় কেঁপে উঠল পুরো অন্তর। রক্ত ঝরে পড়া বাকি কেবল দু’চোখ হতে। রক্তের বদলেই হয়ত ঝরছে জল। তুলির মনে পড়ছে না আদ্র কে কখনও কাঁদতে দেখেছে কিনা!এক ফোঁটা, এক ফোঁটা করে অশ্রুকণা কখনও গড়িয়েছে কিনা!পড়নের ছাই কালার শার্ট টা কুঁচকে গেছে সম্পূর্ণ। ফর্সা মুখে বিধস্ত, ব্যাথার ছাপ স্পষ্ট প্রতীয়মান। তুলির সারা অঙ্গ ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। করুণ চাহনি নিক্ষেপ করল আদ্রর পানে। নড়বড়ে হাতে চোখের জল মুছার জন্য হাত বাড়াতেই কোমরে মৃদু চাপ অনুভব করল। উঁচুতে তুলে নিল আদ্র। ইশারা করল মুছে দিতে। তুলি কাঁপা কাঁপা হাতে চোখের জল মুছতে সক্ষম হলো। তৎপরে আদ্রর কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিজেই কেঁদে উঠল হাউমাউ করে। আদ্রের বুকের বা পাশের ব্যাথা টা হঠাৎ বৃদ্ধি পেল। অস্থির হয়ে তুলির চোখে মুখে চুমু খেল অজস্র। ললাটে ওষ্ঠযুগল ছুঁয়ে স্মিত হেসে বললো,

” আমি জানি তুমি অবিশ্বাস করো নি,তবে তোমার সান্নিধ্য না পেয়ে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আমার। তুমি বিহীন মনে হচ্ছিল এই মুহুর্তে অস্তিত্ব ধূলিসাৎ হয়ে যাক। ট্রাস্ট মি তোমাকে আমার থেকে আলাদা করার ক্ষমতা আল্লাহ ব্যতীত কারো নেই বউ,যদি কখনও নিজেকে আমি বিহীন অনুভব করো, সেদিন হয়ত কবরে সমাহিত থাকবে আমার দেহ।”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)