আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৪+৫

0
802

#আকাশে_তারার_মেলা_২ ✨
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -[৪]

চোরকে কখনও অতি খাতির যত্ন করতে দেখেছেন?হয়ত দেখেছেন অত্যধিক সমাদরের নামে উত্তম মধ্যম দিতে। তুলি স্বয়ং অভিলাষ কে সমর্থন জানিয়ে, মন স্পৃহা পূর্ণ করার অতীব আকাঙ্ক্ষায় লজ্জা -সংকোচকে মাটি চাপা দিয়ে চোরের মতো উপস্থিত হয়েছিল এক যুবকের সুদর্শন চেহারা দেখতে। অথচ তুলি নামক চোর কে অত্যন্ত যত্নের সাথে খাওয়ানো হচ্ছে। চেয়ারে বসে একটু একটু করে স্যান্ডউইচে কামড় বসাচ্ছে তুলি। তার বড় বড় কাজলে অঙ্কিত চোখ দুটোর দৃষ্টি সূদুরে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রর দিকে। কিন্তু আদ্র এক পলকও ফিরে তাকাচ্ছে না,যা ভীষণ পীড়া দিচ্ছে তুলির নতুন নতুন জন্মানো সুপ্ত অনুভূতিগুলো কে। তবুও প্রসন্নতা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। তুলি এখনও প্রচন্ড চমকিত যে আদ্র তার রুমে আসা নিয়ে কিছুই বলে নি। বিন্দু মাত্র রাগের আভাও ফুটে উঠে নীলাভ চোখের মণিতে। ছিল শুধু মাদকত!আর এক চিলতে হাসির রেখা। অতঃপর হাসিতে বিভোর হওয়া তুলি কে পরম যত্নের সহিত চেয়ারে বসিয়ে আদ্র নিচ থেকে নাস্তা এনে খেতে দিল। তুলি হতবিহ্বলতার রেশ কাটিয়ে উঠার আগে আদ্র তাকে খাওয়ার ইশারা করে বারান্দায় চলে গেল।


বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চিন্তায় মগ্ন আদ্র। সূর্যের কিরণ এসে আদ্রর উজ্জ্বল ফর্সা চেহারায় ছুঁয়ে চলেছে অনবরত। হাতে ধোঁয়া উঠা সিগারেট। সিগারেটের দূষিত ধোঁয়া সকালের নির্মল বায়ু কে বিষাক্ত করে তুলছে। তুলি ধীর পায়ে হেঁটে এসে আদ্রর পাশে দাঁড়াল। কিছুটা সাহস জুগিয়ে আলতো স্বরে বলে উঠল-

” ডাক্তার হয়ে সিগারেট খেয়ে ভিতরটা বিষাক্ত করে চলেছেন। তাহলে অন্যের চিকিৎসা কিভাবে করবেন?অন্যকে সুস্থ করার জন্য নিজেকে সুস্থ রাখা অধিক জরুরি তা কি আপনি জানেন না আদ্র ভাইয়া?”

তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি হাসল আদ্র। সিগারেট টা ফেলে দিয়ে দ্রুত বেগে তুলির হাত টা আকড়ে ধরে একদম কাছে টেনে নিল। আকস্মিক হামলায় ঘাবড়ে গেল তুলি। ধুক করে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। প্রখর ভাবে ছুটতে লাগল হৃৎস্পন্দন।

” বিষাক্ততা অনুভব করার ক্ষমতা কি হয়েছে তোমার তুলি?আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে বিষাক্ত ফোঁড়ার ন্যায় বিষ ছড়িয়ে রয়েছে। এই বিষের উপশম পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করি আমি প্রতি রাত,বহু আঁধার কাটে আমার নিদ্রাহীন। সিগারেটের ধোঁয়ার বিষ সেই বিষের নিকট অতি নিছক।”

আদ্রর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন ঝংকার তুলে তুলির শ্রবণ গ্রন্থিতে প্রবেশ করল। প্রবল স্রোতের ন্যায় ভয়ংকর কিছু অনুভূতিরা হৃদয়পটে আছড় কেটে গেল। সমস্ত লজ্জা সংবরণ করে মুখ উঁচুতে তুলে আদ্রর দিকে করুন চাহনি নিক্ষেপ করল তুলি। আদ্রর কন্ঠে বিষাদের রেশ ছিল তা বেশ অনুভব করেছে সে। খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, ” সামান্য নিছক বিষটা নাহয় ত্যাগ করুন। ” তুলিকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে নিলেই গড়গড় করে মনের কথাটা ব্যক্ত করে ফেলল। মৃদু হাসল আদ্র। তুলির পা থেকে মাথা পর্যন্ত চক্ষু নিবেদন করল। মেয়েটা বেশ পিচ্চি। বয়স বলুক আর উচ্চতায়!দু’টো ক্ষেত্রেই বেশ পিচ্চি। তবুও কেন এতো তোলপাড় হয় তার হৃদপিণ্ডে?আদ্রর চাহনিতে দৃষ্টি পড়তেই দমে গেল তুলি। এমন চাহনি এর আগে দেখে নি সে। মাদকতাময় চাহনি যেন তুলির মন টা কেও তীব্র নেশার অতল গহ্বরে তলিয়ে দিচ্ছে। শ্যামবর্ণা তুলির আদ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,

” এভাবে তাকাবেন না আদ্র । আমার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন?হৃদয়ে উঠা ঝড় কি আপনাকে ছুঁতে পারছে?নিজেকে রক্ষা করতে আপনার ওই প্রশস্ত বুকে মুখ লুকালে তো উপাধি দিবেন আমি নির্লজ্জ,চরিত্রহীনা।”

কাঁপা কাঁপা পা দুটো সামনে বাড়াল তুলি। আদ্রর দিকে তাকানোর সাহস যে তার আর নেই। এখন তার পালিয়ে যাওয়ায় শ্রেয়। আদ্রর সাথে পরিচয় হয়তো চার থেকে পাঁচ দিনের তবে তার সম্পর্কে যতটুকু জানে আদ্রর রাগের শিকার যে হবে তার আর রক্ষে নেই। অন্যায় ও মুখের উপর কথা বলা এই লোকের মোটেও পছন্দ না তুলি আমরিনের কাছ থেকে জেনেছে। তুলি তো এতো ছোট হয়েও মুখের উপর কথা বলেছে আবার মেরে বসবে নাতো!তুলির ভাবনার জগতকে উচ্ছেদ করে একটা কোমল কন্ঠ কর্ণপাতে ভেসে আসল। নিমিষেই আঁটকে গেল তুলির দু’পা মেঝেতে।

“ছাড়িয়ে দাও।”

“কি?” (ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল)

” বিষাক্ততার ধোঁয়া ছাড়িয়ে মুক্ত করো আমায়।”

আদ্রর দিকে এক পলক চেয়ে তুলি কিছু একটা ভেবে বলে উঠল,

” সিগারেট? ”

” জ্বী”

অতিশয় বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল তুলি। সে কিভাবে ছাড়াবে সিগারেট? এমন আজব কথা বলছে কেন আদ্র নামের লোকটা?কিছুক্ষণ ভেবে প্রতিত্তোর করল,

“ছাড়িয়ে দিলে কি দিবেন?”

” তুমি যা চাও।”

” একটা বেগুনি রঙের শাড়ি দিবেন?”

ভ্রু কুঁচকে এল আদ্রর। দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেলকনিতে ঘেঁষে দাঁড়াল। রসাত্মক স্বরে বলে উঠল,

“তোমার শাড়ি পড়ার বয়স হয়েছে? ”

প্রশ্নটা তুলির ছোট্ট মনে এক ঝাঁক রাগের বাসা বেঁধে দিল। সতেরো বছর বয়স কি শাড়ি পড়ার জন্য যথেষ্ট না?তুলি যদি পারত তবে এ মুহুর্তে আদ্রর কানে চিৎকার করে বলত–” নীল বর্ণের নেশা মিশ্রিত চোখ দুটো কে একজন চক্ষু ডাক্তারের সাক্ষাৎ করিয়ে আনেন ডাক্তার সাহেব।” কিন্তু মেয়েটা বড্ড অসহায়। বলার অপরাধে না জানি গাল লাল হয়ে উঠে। সেই আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে থমথমে গলায় বলল,

” আমার শুধু শাড়ি না সংসার করার বয়স ও হয়েছে ডাক্তার সাহেব। ”

নিজের কথায় নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল তুলি। মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে আদ্রর দিকে তাকাল। কারণ আদ্র হুট করেই একদম মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে উঠেছে নিমিষেই। ভয়ে তুলির প্রাণ পাখি বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিছু বলতে নিবে তার আগেই আদ্র ডান হাত টা খপ করে ধরে কনিষ্ঠ আঙুলে কামড় বসিয়ে দিল। গাঢ় স্বরে বলে উঠল,

“সহ্য করার বয়স হয়েছে তো?”

শীতল হয়ে উঠল তুলির পুরো দেহ। লজ্জায় মরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগল। প্রথমবার! কিশোরী জীবনে প্রথমবার এমন স্পর্শের সম্মুখীন হয়েছে। কি করল এটা আদ্র!তুলির চোখে লজ্জার ছাপ। তাতে যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মানুষটার। কালো ওড়না টা আঁকড়ে ধরে একটা অংশ দিয়ে তুলির চোখের কাজল গুলো মুছে দিল অতি যত্নসহকারে। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,

” আমি দেখেছি,আর কারো দেখার প্রয়োজন নেই ।”

এক মুহুর্ত ও দাঁড়াল না আদ্র চলে গেল পাশ কাটিয়ে। কিন্তু রেখে গেল অজানা ঘোরে ডুবন্ত তুলি কে।
___________

উত্তপ্ত দুপুর। চৈত্র মাসের শেষ প্রহর তবুও কতটা উত্তাপ। রোদের প্রখরে ঘেমে একাকার তুলি। তার পাশেই সমান তালে হাঁটছে আমরিন। কলেজ ছুটি হয়েছে খানিক সময় আগেই। মৃদুস্বরে বলে উঠল-

” আজ সব মেহমান চলে আসবে তুলি। তুইও কিন্তু আজ থেকে আপুর বিয়ে অব্দি আমাদের বাসায় থাকবি।”

তুলি খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠল,

” আমি তো এখনই চলে যাব।”

তুলির হাসি দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল আমরিনের। মেয়েটা কে তার ভীষণ ভালো লাগে। কারো সাথে সহজে মিশতে পারে না আমরিন। বিশ্বাস করার অযোগ্য হলেও এটাই সত্য সতেরো বছরের জীবনে একটাও ফ্রেন্ড নেই তার। তবে এখন আছে। তুলি এখন তার শুধু বেস্ট ফ্রেন্ড না তার চেয়েও বেশি। অন্যদিকে তুলির পুরো অন্তর জুড়ে প্রফুল্লতা বিরাজমান। কয়েকটা দিন আদ্রর একদম সান্নিধ্যে থাকতে পারবে ভাবতেই মন চাইছে খুশিতে নাচতে। তুলি জানে না অনুভূতি গুলোর সঠিক ব্যাখা। কিন্তু তার কিশোরী মন টা আসক্ত হয়ে পড়েছে আদ্র তে। “আদ্র” নামটা শুনলেই প্রশান্তির নির্মল বাতাস বয়ে যায় মনের প্রতিটি কোণায় কোণায়। তেজস্বী রোদ অবিরাম বিরক্ত করলেও তুলির ঠোঁটে ভালোলাগার হাসি। হাসিটাও হয়তো তুলির চিকন দুটো ওষ্ঠদ্বয়কে আলিঙ্গন করে বলছে “তোর কিশোরী জীবনে গভীর প্রণয়ের আগমন তুলি।”


গেইটের সামনে আসতেই দেখল ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির। আমরিন ও তুলি গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইভার কে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলল। সাথে সাথেই কেউ গাড়ির দরজা মেলে তুলির পাশে বসে পড়ল। ক্লান্ত কন্ঠে ড্রাইভার কে গাড়ি চালানোর অনুমতি দিল। চমকে তাকাল আমরিন ও তুলি দু’জনেই। কিন্তু অপর পাশের মানুষ টার যেন তাতে কোনো খেয়ালই নেই। আমরিনের দৃষ্টির আড়ালে তুলির এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল। আতঙ্কিত চোখে আমরিনের দিক চাইল তুলি। আমরিন বিস্মিত গলায় বলে উঠল,

” তুমি কখন এলে ভাইয়া?”

” আগেই এসেছি। তোদের জন্য ওয়েট করছিলাম। একটা কল এটেন্ড করার জন্য কিছু টা দূরে ছিলাম।”

“ওহ্। আজ তুমি এদিকে?”

” হসপিটাল থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম।আজ গাড়িটা আমি নিয়েছি। শরীরটা ভালো লাগছিল না তাই ড্রাইভার কে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তোদের নিয়েই ফিরি।”

কথাটা বলেই আমরিনের অগোচরে তুলি কে কাছে টেনে নিল আদ্র। তুলি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই আদ্রর অগ্নিদৃষ্টি দেখে নিভে গেল। আজকাল মানুষ টা কাছে আসলেই তুলির হৃদপিণ্ডটা ব্যাথা অনুভব করে। অসহনশীল ব্যাথা! কানের কাছে গরম নিশ্বাস পড়তেই নখ দাবিয়ে দিল আদ্রর ফর্সা হাতে প্রখরভাবে। কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো,

” প্রতিশোধ নিলে তুলা?”


সারা রাস্তা নিরব ভূমিকা পালন করেছে তুলি। তুলিদের বাসার সামনে দিয়েই আদ্রদের বাসায় যেতে হয়। সেই সুবাদে আগে আমরিন নিজে নেমে তুলি কে নামার সুযোগ করে দিল। আদ্রর দিকে এক পলক চাইল তুলি। মোবাইল টিপতে ব্যস্ত তার ডাক্তার সাহেব। তুলি কে জড়িয়ে ধরল আমরিন। মোলায়েম স্বরে বলল,

” একটু পরেই ব্যাগ প্যাক গুছিয়ে চলে আসবি কিন্তু। আজকে তোকে ভাইয়ার জীবনের স্পেশাল একজনের সাথে পরিচয় করাব।”

তমসার ঘোর অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল তুলির অনুভূতিরা। প্রচন্ড জোরে ধারালো একটা ছুরির নেই কিছু একটা ঠিক বুকের বা পাশে গিয়ে বিঁধল। রক্তক্ষরণ হতে লাগল অনবরত। কম্পনরত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

” ক,ককক কে?”

আমরিন ফিসফিস করে হাসিমুখে জবাব দিল,

” ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড!”

#চলবে,,,

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -[৫]

আধাঘন্টা যাবত মেয়ের সামনে বসে আছেন ইশরাত আফসানা। উনার চেহারায় বিস্তার করে চলেছে বিরাট দুশ্চিন্তা। তুলির চোখ মুখ ফুলে আছে। দেখতেই কেমন বিধস্ত দেখাচ্ছে। শতবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পেলেন না তিনি। বুঝতে পারলেন তুলি হয়ত কোনো কারণে খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে। বিছানায় বসে মেয়ের হাত টা টেনে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মায়ের বুকের উষ্মতা পেয়ে কঠোর আঘাত পাওয়া তুলি ডুকরে কেঁদে উঠল। আঁতকে উঠলেন আফসানা। একটা মাত্র মেয়ে ওনাদের। মেয়েটার কষ্ট তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কি হয়েছে তুলি?’

চমকে উঠল তুলি। আবেগের বশে নিজের হৃদয়ের গহীনে সৃষ্ট হওয়া ব্যাথা লুকাতে ব্যর্থ হয়েছে সে। মাকে কিভাবে বলবে যে তার বোনের ছেলের জন্য এভাবে কাঁদছে। তাই চোখের পানি মুছে আমতা আমতা করে জবাব দিল,

‘ আসলে আম্মু পেট ব্যাথা করছিল। তাই মনটাও খারাপ ছিল।’

মেয়ের জবাবে ভ্রু যুগল কুঁচকে এল আফসানার। তবুও তার বিশ্বাস তুলি মিথ্যে বলবে না, আর যদি বলেও হয়ত কোনো না কোনো কারণ লুকিয়ে রাখতে চাইছে। তাই তিনি আর ঘাঁটালেন না। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ বিকাল থেকে আমরিন, ইনশিতা কতগুলো কল দিয়েছে জানিস?তোর মোবাইল নাকি বন্ধ? ওরা দু’জন তো রীতিমতো কেঁদে ও দিয়েছে তুই যাবি না বলাতে। শরীর ভালো লাগলে রেডি হয়ে আয় মা। নাহলে ওরা সবাই কষ্ট পাবে।’

‘ আমি যাবো না আম্মু।’

ক্রন্দনমিশ্রিত স্বরে তৎক্ষনাৎ প্রতুত্তর করল তুলি। আদ্রর মুখোমুখি আর হতে চাই না সে। সুদর্শন সেই যুবককে দেখলেই মনটা আবার ব্যথিত হয়ে উঠবে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলো আবারও আঘাত প্রাপ্ত হবে। এতে দোষ শুধুই তুলির। আদ্র তো তার প্রতি কোনো অনুভূতি প্রকাশ করে নি তবে তার অন্তরে কেন অনুভূতিরা বাসা বাঁধল? নিজেকে নিজেই বিকেল থেকে দোষরূপ করতে মগ্ন।
আফসানা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

‘ আদ্র আধাঘন্টা যাবত ড্রইংরুমে বসে আছে। আমায় পাঠাল তোকে ডাকতে। বলেছে তোকে ছাড়া এক চুল পরিমাণও নড়বে না। আমিও পারব না ছেলেটা কে না করতে। পারলে তুই করে দে।’

কথাগুলো বলেই রুম থেকে প্রস্থান করলেন তুলির মা। তুলি অবাকের শীর্ষপর্যায়ে পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যেই। মনের সুপ্ত কোণে প্রস্ফুটিত নেতিয়ে পড়া অনুভূতি গুলো সজীব হওয়ার যুদ্ধে নেমে পড়ল। পরক্ষণেই কঠিন ভাবে নিজের মনকে শাসাল তুলি। আদ্র হয়তো আমরিন,ইনশিতার জন্যই তাকে নিতে এসেছে। মনে মনে বলল,

‘ যার জন্য এক অজানা কষ্টে আমার অন্তর টা মুচড়ে যাচ্ছে উনি তো আমার জন্য বিন্দু মাত্র কষ্ট অনুভব করেন না। উনি বেশ সুখে আছেন উনার জীবনে। ভুলবশত আমিই উনার সুখের বাঁধা হতে যাচ্ছিলাম। আজ থেকে উনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখব। উনাকে নিয়ে একটুও চিন্তা করব না।’

মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাক্যগুলো আওড়াল তুলি। বুঝ দিল নিজের ভেঙে যাওয়া হৃদয় টাকে। তবুও চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবাধ্য জল। কার্বাড থেকে ব্লু কালার একটা রাউন্ড ড্রেস নিয়ে ঝটপট রেডি হতে শুরু করে দিল। লম্বা কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া স্ট্রেইট চুলগুলো আঁচড়ে ছেড়ে রাখল। চোখে কাজল লাগিয়ে, ঠোঁটে হালকা গোলাপি কালার লিপস্টিক দিয়ে তড়িঘড়ি করে হাতে এক ডজন ভেলভেটের নীল চুড়ি পড়তে পড়তে ড্রইং রুমে আসল। হাত থেকে একটা চুড়ি ফস্কে গিয়ে মেঝেতে গড়াতে গড়াতে আদ্রর পায়ের কাছে গিয়ে থেমে গেল। থেমে গেল বললে ভুল হবে আদ্র পা দিয়ে আঁটকে দিয়েছে। চোখ বড়সড় করে তাকাল তুলি। তার চুড়িটা ভেঙে যায়নি তো?গেলে খুব কষ্ট পাবে। চুড়িগুলো তার খুব কাছের একজন উপহার দিয়েছে যেই মানুষ টা তার জীবনের অনেকখানি অংশ জুড়ে বিরাজমান। আতঙ্কিত নয়নে আদ্রর দিকে চকিতে তাকাল তুলি। তবে সেই নয়নে মুহুর্তেই প্রতীয়মান হল মুগ্ধতা। নীল একটা পাঞ্জাবি পড়েছে আদ্র। চেহারাটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আদ্রর সাথে এই মুহুর্তে তুলির নিজেকে ফিকে লাগছে। ‘এতো সুন্দর লোকের সাথে একটা সুন্দর মেয়েকেই মানায়,আমার মতো শ্যামবতী কে নয়।’ মনে কথাটা উজ্জীবিত হতেই কয়েক পল্লব চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মা কে বলে বেরিয়ে এল বাসার বাহিরে।

মেজাজ খিঁচে এল আদ্রর। তুলির মায়ের কাছ থেকে নম্রতার সহিত বিদায় নিয়ে বাহিরে আসল। আসতেই চোখে পড়ল তুলি ঢেই ঢেই করে হেটে চলেছে। আদ্রর ইচ্ছে করছে উপরে তুলে আছাড় মারতে। ঝাঁঝালো স্বরে ধমকে উঠল,

‘ স্টপ তুলি!’

তীব্র ধমকের চোটে থমকে গেল তুলি। আদ্রর তীক্ষ্ণ, রাগান্বিত স্বর তার শরীরের প্রত্যেক টা ভাজে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। পিছন ফিরে দাঁড়াতেই ডাগর ডাগর আঁখি যুগল আটকে গেল আদ্র রক্তবর্ণ দু চোখে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ রেগে আছে সে। তুলি অতি সন্তর্পণে একটা ঢুক গিলল। চারদিকে তাকিয়ে কোনো উপায় না পেয়ে পায়ের জুতো জোড়া হাতে নিয়ে দৌড় লাগাল। তুলির এহেন কান্ডে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আদ্র। বেচারি তুলি এক দৌড়ে আদ্রদের বাড়িতে এসে ঢুকল। সোফায় বসে বুকে হাত দিয়ে জোরেসোরে হাঁপাতে লাগল ক্রমাগত। কিন্তু তার কি সেই খেয়াল আছে, বহু জোড়া উৎসুক দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। মিনিট পাঁচেক ধরে হাঁপিয়েই যাচ্ছে।
________

চোখের সামনে পানির গ্লাস দেখে চমকপ্রদ দৃষ্টিতে তাকাল তুলি। হাতের মালিক কে দেখার আশায় মুখ তুলতেই কয়েক দফা ধাক্কা অনুভব করল। ‘আদ্র!’ অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল নামটা। ভয়মিশ্রিত চোখে চারপাশে তাকাতেই তার চক্ষুদ্বয় চড়কগাছ। দশ-বারো জন মানুষ তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন এ মুহুর্তে তুলি কোনো শো পিস,যাকে দেখাই সবার নিকট মুখ্য। ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল তুলির। হয়তো সবাই ভাবছে হঠাৎ কোথা থেকে পাগলের আমদানি হল। হ্যাঁ পাগল!এভাবে বাড়ি ভর্তি মেহমান কে উপেক্ষা করে পাগলের মতো ছুটে এসে দীর্ঘক্ষণ হাফাতে থাকায় তুলির এখন নিজেকেই পাগলের লিডার মনে হচ্ছে। এক তো আদ্র ভাবলেশহীন ভাবে তার সামনে বসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়েছে অন্যদিকে কতগুলো অপরিচিত মুখ তার দিকে নিষ্পলক চাহনি নিক্ষেপ করে রেখেছে। আদ্রর চোখে কোনো প্রকার রাগের ছিটেফোঁটা নেই বিধায় তুলি নির্ভয়ে পানির গ্লাস টা নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে সম্পূর্ণ পানিটুকু খেল। ভিতরে ভয় হলেও আদ্রর ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চোখ রেখে হালকা হাসল। খালি গ্লাসটা এগিয়ে দিল। আশেপাশে সবার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। সবার খুব মায়া হচ্ছে সামনে বসা ছোট্ট অবুঝ মেয়েটার জন্য। পাশ থেকে একটা মেয়ে ভয়ার্ত স্বরে একটা ছেলের কানে ফিসফিস করে বলে উঠল,

‘ দোস্ত আমার মনে হচ্ছে মেয়েটার মাথায় গ্লাস টা ভাঙবে। মেয়েটা বোধহয় আদ্র কে চিনে না। আমার ভীষণ মায়া হচ্ছে পিচ্চি মেয়েটার জন্য।’

‘ আমারও।’

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আদ্র গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে রাখল। উপস্থিত থাকা সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। একটা ছেলে চোখ কচলে আদ্রর দিকে অবিশ্বাসের স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ তুই আদ্র তো?’

এহেন প্রশ্নে চোখ গরম করে তাকাল আদ্র। তুলির চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। প্রশ্নটা শুনে পেট ফেটে হাসিও আসছে তুলির। সাথে সাথেই আদ্র কটাক্ষ করল,

‘ আমি নাহয় আদ্র, কিন্তু তুই অন্তু তো?’

হি হি করে হেসে উঠল অন্তু। পাশে বসে থাকা সুন্দর রমণী কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,

‘ এই পায়েল বেবী আমি অন্তুই তো তাই না?’

সাথে সাথেই দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিল পায়েল,

‘ না তুই তো অন্তুর যমজ ভাই সন্তু। তুই অন্তু হতে যাবি কেন?’

‘ তুমি সন্তু বললে আমি অন্তু শুধু নিজের জীবন কেন নামটাও ত্যাগ করে দিব।’

‘স্টুপিড!’

‘ অনলি ফর ইউ বেবী।’

তুলি বেক্কলের মতো পায়েল ও অন্তুর দিকে তাকিয়ে ছিল। পায়েল ও অন্তুর জবাবে সেও সবার সাথে হু হু করে হেসে উঠল। নিমিষেই মন থেকে সমস্ত ব্যাথা গায়েব হয়ে গেল। হাসতে হাসতে আদ্রর দিকে তাকাতেই দেখল আদ্র এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পলকও ফেলছে না। থতমত খেয়ে গেল তুলি। সামনে বসা মেয়েগুলোর দিকে আরেকবার তাকাল গাঢ় দৃষ্টিতে। আচ্ছা এখানে উপস্থিত দু’টো মেয়ের মধ্যে কি আদ্রর গার্লফ্রেন্ড আছে?ভাবতেই হৃদয়ের ক্ষতটা আরো গভীর হতে লাগল। ব্যাথায় কুঁকড়ে গেল অন্তরটা। তবুও মনটা বলে উঠল আদ্রর গার্লফ্রেন্ড হবে না এখানকার কেউ। তবে এরা কি আদ্র ভাইয়ার বন্ধু?তুলির মস্তিষ্কে প্রশ্নটা উদয় হওয়ার সাথে সাথেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ল আদ্রর কথায়। আদ্র মুচকি হেসে বলল,

‘ মিট মাই ফ্রেন্ডস। অন্তু, নিবিড়, সাগর,পায়েল,রিমি।’

সবার দিকে চেয়ে তুলি আলতো হাসল। অন্তু,নিবিড়, পায়েল,রিমি,সাগরও তুলির দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে। তাদের চোখ দুটোও তুলির পরিচয় জানতে অধীর আগ্রহে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে । তুলি নম্র স্বরে বলে উঠল,

‘ আসসালামু আলাইকুম, আমি তুলা!’

তুলির নাম শুনে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সবাই। তুলি মুখে হাত দিয়ে লজ্জায় হাসফাস করছে। কি বলতে গিয়ে কি বলল!আদ্রর জন্যই তো আজ তার এই অবস্থা। মুখ থেকে হাত সরিয়ে দাঁত কেলিয়ে হি হি করে বলে উঠল,

‘ তুততত,তুলা না। তুলি!ইশতাক তুলি। আমি আদ্র ভাইয়ার মায়ের চাচাতো বোনের মেয়ে। মানে আদ্র আমার ভাই। না না আদ্র ভাইয়া। আদ্র ভাইয়া আমার খালাতো ভাই। ‘

কি বলতে গিয়ে কি বলেছে তুলি নিজেও জানেনা। তবুও কথাগুলো বলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। টেবিলের উপর গ্লাসটা প্রচন্ড জোরে নিচে ফেল দিল আদ্র। ঝংকার তুলে ভেঙে তছনছ হয়ে গেল গ্লাসটা। ভয়ে কেঁপে উঠল সবাই। হঠাৎ আদ্রর কি হল কিছুই বুঝতে পারছে না সবাই। শুধু চোখে পড়ল তুলির দিকে তাক করা আদ্রর রক্তিম দৃষ্টি। ভয়ে লাফিয়ে উঠল অন্তু। পায়েলের হাত টা শক্ত করে ধরে বলে উঠল,

‘ আদ্রর রাগে ভস্ম হয়ে যাওয়ার আগে আমার ভালোবাসা টা একসেপ্ট করে নাও পায়েল বেবী। আমি মরতে চাই না এতো তাড়াতাড়ি। তোমার বাচ্চার বাবা হতে হবে তো!’

মেজাজ গরম হয়ে গেল পায়েলের। অন্তু কে ধরে কিল ঘুষি দিতে পারলে বেশ স্বস্তি পেত। আদ্র কাউকে কিছু না বলে হনহনিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। তুলিও চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে এক প্রকার ছুটে চলে এল ইনশিতার রুমে। আজ ইনশিতার মেহেদী অনুষ্ঠান। চুপচাপ বসে আছে সে ইনশিতার পাশে। ইশ!কি সুন্দর দেখাচ্ছে সবুজ লেহেঙ্গায় ইনশিতা কে। আদ্রর ভয়ে রুম থেকেই বের হচ্ছে না বেচারি। রক্তিম সেই চক্ষুদ্বয় তুলির অন্তর কাঁপিয়ে তুলেছে। তবে আদ্র কেন এমন করল কারণটা সবার অজানা। তুলির নিকট অজানা হলেও তুলি ঠাওর করতে পারছে রাগটা তার জন্যই ছিল।তাই আজ এই রুমেই থাকবে সে। এমনিতেই তার ছোট্ট একটা প্রাণ, কে চায়বে ছোট্ট প্রাণ টাকে বাঘের খাঁচায় ঠেলে দিতে।

কিন্তু তুলির চিন্তা -ভাবনা কে জলাঞ্জলি দিয়ে দিল আমরিন। দৌড়ে রুমে এসে খপ করে তুলির হাত টা ধরে টেনে তুলল। বিস্মিত তুলি কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেনে আদ্রর রুমে নিয়ে আসল। রুমে আসতেই তুলি যা দেখল তাতে কয়েকদফা চমকে গেল। একটা সাদা লেহেঙ্গা পরিহিতা মেয়ে। চুলের ভাঁজে সাদা গোলাপ গেঁথে রাখা। ঠোঁটে মিষ্টি হাসির ঝলক। মায়াবিনী বললেও কম হবে,এতো নিষ্পাপ তুলি চাইলেও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। আমরিন তুলি কে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসা সেই মায়াবিনীর কাছে টেনে এনে এল বলল,

‘ ভাইয়ার জীবনের মায়াবিনী তুলি। এই সেই স্পেশাল মানুষ। ‘

প্রখর ধাক্কা অনুভব করল তুলি। সামলাতে না পেরে খানিকটা পিছিয়ে গেল। পিঠ গিয়ে ঠেকল কারো বুকে। সেদিকে কোনো হদিস নেই মেয়েটার। মুখে হাত দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শব্দ করে।

#চলবে,,,,

{ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। }