আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৪৭+৪৮

0
612

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪৭

আদ্রের বুকে লেপ্টে আছে তুলি স্থির। নড়চড় নেই, একে অপরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ মানুষ দু’টোর নিঃশ্বাসের শব্দ কর্ণে প্রবেশ করছে বিনা বাঁধায়। নিরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দও যেন প্রকট। আদ্রের শেষ কথাটায় তুলির মন-মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে পড়েছে, সেই সাথে নেতিয়ে গেছে ছোট্ট দেহ টুকু। চোখ আবছা হয়ে আসছে,প্রতিবারে হাতের সাহায্যে তা পরম যত্নে মুছে দিচ্ছে আদ্র। তুলি একটু নড়েচড়ে উঠল। আদ্রর বুক থেকে মাথা তুলে অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে তাকাল রুমের এদিক সেদিক। আদ্রর উদ্দেশ্যে মিহি স্বরে বলে উঠল,

” আমাকে একটু ছাড়বেন ডাক্তার সাহেব?শুধু একটুর জন্য?”

তুলির আবেদন মিশ্রিত প্রশ্নে আদ্রর কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। শিথিল হয়ে এল হাতের বাঁধন। তুলি সময় নষ্ট করল না। গটগট পায়ে হেঁটে এসে বিছানার উপর থেকে ডায়েরি টা তুলে নিল। হাঁটতে গিয়ে ব্যাথায় টনটনিয়ে উঠল ডান পা টা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আড়াল করে নিল ব্যাথা টুকু। দ্রুত গতিতে উপস্থিত হল আদ্রর কাছে। মাথা তুলে আদ্রর দিকে চেয়ে মলিন কন্ঠে বললো,

” বাড়িতে চলুন। এখনই খালা মণির সাথে কথা বলবেন আপনি। আমার সামনে বলবেন ভালোবেসে। আমি জানি আপনি কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু খালা মণিও তো উনার জায়গায় ঠিক ছিলেন,আপনার প্রতি অগাধ ভালেবাসার কারণে এমন মনোভাব সৃষ্ট হয়েছিল। আপনি চলুন প্লিজ। মার সাথে অভিমান করে সুখে থাকা যায় না ডাক্তার সাহেব। প্লিজ!”

তুলির দিকে তীক্ষ্ণ চাউনি নিক্ষেপ করল আদ্র। তুলির হাত টা টেনে এনে বিছানায় বসালো। নিজে বসে পড়ল তুলির সামনে হাঁটু গেড়ে। উরুতে তুলে রাখল তুলির আহত পা টা। রক্ত জমাট বেঁধে আছে পায়ে। শিরশির করে কেঁপে উঠল তুলির দেহ। ভড়কে গিয়ে সরিয়ে আনতে লাগল পা। আদ্র আলতোভাবে পা টা চেপে ধরে রাখল উরুতে। কপাল কুঁচকে উত্তেজিত সুরে বলতে লাগল,

” পা কাটলে কিভাবে?কিভাবে কাটলে তুলা?রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ইনফেকশন হয়ে যাবে তো। ”

বলেই পায়জামার হুক খুলে সামান্য উপরে উঠিয়ে নিল। তুলি বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে বললো,

” তাড়াহুড়োয় সিএনজি তে উঠতে গিয়ে লেগে গিয়েছে। এখন বাসায় চলুন প্লিজ। খালামণির সাথে কথা বলতে হবে তো।”

রোষপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আদ্র। তুলি সাথে সাথেই দমে গেল। মিনমিন করে বললো,

” ব্যাথা পাচ্ছি না তো।”

“কিন্তু আমি পাচ্ছি।”

আদ্রের নিরলস জবাবে তুলি চকিতে মুখ তুলে চাইল। মানসিক তৃপ্তিতে ভরে গেল মনটা তৎক্ষনাৎ। নতুন নতুন অনুভূতির সঞ্চার ঘটল মনপাজরে। স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্ক কি এমন হয়?অর্ধাঙ্গীনির ব্যাথাতে কি প্রত্যেক টা স্বামীর মুখে ব্যাথার ছাপ ফুটে উঠে? হয়ত ফুটে উঠে। তুলির মাঝে মাঝে খুশিতে আত্মহারা হয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে ভীষণ। পুরো দুনিয়া তাকে তুচ্ছ করলেও আদ্রর মতো সুদর্শন পুরুষের প্রাণনাশিনী সে।

তুলির রুমের আলমারি তে অনেক খুঁজেও ফাস্ট এইড বক্স পেল না আদ্র। এক প্রকার রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তুলির মার কাছ থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এল। তিনিও এলেন পিছু পিছু। মেয়ের চিন্তায় মন কে ধরে রাখতে পারল না। আদ্র পুনরায় পা টা তুলে উরুতে রাখল। মায়ের সম্মুখে এমন কান্ডে লজ্জায় শিউরে উঠল তুলি। পা টা সরিয়ে আনার চেষ্টা করল ফের। সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকাল আদ্র। এতে তুলির কেঁদে দেওয়ার অভিপ্রায়। মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে আফসানা মাথায় হাত বুলিয়ে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে। মন টা একদম ভালো হয়ে গেল উনার। এতোক্ষণ ধরে পাথর চেপে ছিল বুকে। তুলির আকস্মিক বিধস্ত আগমনে অন্তর আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এসেই যখন রুমের দরজা আটকে দিয়ে মেলছিল না,কোনো শব্দ আসছিল না ভেতর থেকে শ্বাস ফেলতেও যেন ভুলে গিয়েছিলেন। পাগলের মতো অনবরত ফোন করে যাচ্ছিল আদ্রকে কিন্তু আদ্রর নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছিল প্রতিবার। শেষ/মেশ সায়েরা বেগম কে ফোন করে জানায়। আদ্রও গাড়ি নিয়ে ডিরেক্ট বাড়িতে এসেছিল। সায়েরা বেগমের মুখ থেকে শুনে মৌন মুখে ছুটে এল বাগান বাড়িতে।

তুলো দিয়ে জমাট রক্ত মুছে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিল আদ্র। তুলির মুখের দিকে না চেয়ে নজর নিবদ্ধ করে রাখল পায়ের ক্ষত তে। অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলে উঠল,

” আমি জানি আমি ভুল ছিলাম, নিছক ছিল অভিমান টুকু। মা-ও ভুল ছিল। অভিমান সম্পর্ক নষ্ট করে, কষ্ট দেয়, মানুষের মনে দূরত্ব সৃষ্ট করে তা একটা সময় বুঝতে পারি আমি। অভিমান কে কখনও দীর্ঘ হতে দিতে নেই। তবুও আমি দীর্ঘ করে ফেলেছি। যতবার মনে পড়েছে সেই মুহুর্ত টা আমার মন ভেঙেছে ততবার নতুন করে। আমি আমার মা কে ভালোবাসি তুলা। আমার মা তোমাকে খুব ভালোবাসে। খুব বেশি। বছর গড়িয়ে যেতে আমার অভিমানের তীব্রতা কমে এসেছে আর এখন নেই বললেই চলে। কোনো মানুষই ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। আমি যতই মাথা খাটায় ভুল আমার দ্বারাও হয়। তবে আজ বলছি আমি কখনও আমার পরিবারের মাঝে দূরত্ব আসতে দিব না। তোমাদের সবাইকে আগলে রাখব। ”

আদ্রের কথার প্রেক্ষিতে তুলির ঠোঁটের কার্ণিশে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল। ডান হাত টা আদ্রের চুলের ভাঁজে ডুবিয়ে বললো,

” চলুন বাড়িতে যাই।”

আদ্র এক নজর চাইল। উঠে দাঁড়াল পরক্ষণেই। পড়নের শার্ট টা শরীর থেকে খুলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো,

” শশুড় বাড়িতে এসেছি। বললেই চলে যাব নাকি!শাশুড়ির হাতে খেয়েই যাব,তার আগে এক পা-ও নাড়াচ্ছি না। তোমার বাপের একটু আকটু খরচে হিমশিম খেলে হয় তুলা?বাপের টাকা বাঁচানোর ধান্দায় জামাইকে বের করে দিতে চাইছো আমি সব বুঝি। যাও এখন আমার জন্য কাপড় নিয়ে এসো,কোথায় থেকে নিয়ে আসবে জানি না। তবে ভুলেও তোমার বাপের লুঙ্গি আনবে না,আই হেইট লুঙ্গি। ”

তুলির চক্ষু কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে প্রায়। তাজ্জব বনে গেল আদ্রের কথায়। বোকার মতো খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। পরমুহূর্তেই হেসে উঠল বিস্তর। শ্রবণ গ্রন্থিতে আদ্রর ডাক তরঙ্গিত হতেই হুড়মুড়িয়ে বলে উঠল,

” নিয়ে আসছি।”

তুলি মায়ের কাছে গেল দৌড়ে। আফসানা কিচেনে রান্না করছেন ব্যস্ত হাতে। মেয়ের জামাই এসেছে বলে কথা। তুলি কে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,

” আদ্র কই?তুই এখানে যে?কিছু বলবি?”

তুলি শুকনো একটা ঢোক গিলে ইতস্তত কন্ঠে বললো,

” আসলে আম্মু কাপড় লাগত। উনার সাইজের কোনো কাপড় কি হবে?”

আফসানা শব্দ করে হেসে উঠলেন। তরকারি নাড়তে নাড়তে বললেন,

” মায়ের সাথে এতো ইতস্ততায় ভোগার প্রয়োজন নেই। কোনো একদিন তুইও মা হবি,তুই কি চাইবি তোর সন্তান এমন করুক?”

নিমিষে তুলির হাত চলে গেল পেটে। ভিতর টা কেমন ঝংকার তুলে কেঁপে উঠল। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল মুখখানা। আফসানা মেয়ের ভঙ্গিমা দেখে হাসি বজায় রেখে বললেন,

” তোর রুমের আলমারিতে আদ্রের জন্য কাপড় রাখা আছে। তোর বাবা এনেছিল আদ্রর জন্য এবং পরিবারের সকলের জন্য। ভেবেছিল আজ বা কাল তোদের বাড়িতে যাবে। তোর বাবার প্রমোশন হয়েছে সেই খুশিটা তোদের সাথে শেয়ার করার জন্য। ”

তুলি উৎফুল্ল কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বললো,

” সত্যি বাবার প্রমোশন হয়েছে? ”

” একদম সত্যি তুলা।”

লজ্জায় চুপসে গেল তুলি মুহুর্তেই। অবশেষে তার মা-ও এমন করছে তার সাথে!কেন যে আদ্র সবার সামনে তুলা বলে ডেকে বেড়ায়,মান সম্মান সব শেষ করে দিল। মুখ ফুলিয়ে রুমে চলে এল দ্রুত বেগে। আলমারি খুলে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করল। আদ্র হাত বাড়িয়ে ড্রেস নিয়ে বললো,

” তোমার শরীর থেকে কেমন গন্ধ পাচ্ছি তুলা। জলদি কাপড় নিয়ে এসো তো। তুমি যদি গোসল না করো গন্ধের ঠ্যালায় রুমে শ্বাস ফেলতে পারব কিনা তাতে আমি সন্দেহাতীত। ডাক্তার হয়ে এসব সহ্য করতে পারব না। তাড়াতাড়ি এসো।”

আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইল তুলি ওয়াশরুমের দরজার অভিমুখে। আদ্রর কথা তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কপাল কুঁচকে চিন্তায় লেগে পড়ল সত্যিই কি গন্ধ পাচ্ছে? একবার কি নিজে শুঁকে দেখবে?বোকা মস্তিষ্ক একদম কাজ করছে না। গলার কাছে জামার অংশ ধরে একবার শুঁকে নিল। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে এল নিমিষেই। ঘামের গন্ধে অবস্থা ব্যাপক নাজেহাল। তাড়াতাড়ি আলমারি থেকে একটা ড্রেস নিয়ে এল। কিছুটা উচাঁনো স্বরে বলে উঠল,

” আমি অন্য ওয়াশরুমে করে নিব। আপনি শাওয়ার সেড়ে ডাইনিং টেবিলে চলে যাবেন।”

ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল প্রচন্ড জোরে। তুলি থমকে গেল তাৎক্ষণিক। আদ্র চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল,

” আমি যেতে বলেছি?মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলব।”

তুলি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়াল দু’দিকে। আদ্র বাঁকা হেসে বললো,

” গুড। গন্ধ টা প্রখর হচ্ছে তুলি। এতো পেত্নী কবে হলে তুমি?”

কথাটা বলেই কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিল আদ্র। তুলি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাতেই নাক টা গলার কাছে নিয়ে এল। ঠোঁটের পরশ বুলিয়ে দিল ঘর্মাক্ত গলায়। তুলির ভূতল কাঁপছে। আদ্রর উম্মুক্ত দেহে নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে ক্রমশ। গলায় নাক ছুঁয়ে আদ্র জোরে একটা নিঃশ্বাস টেনে নিল। তুলির দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টি ফেলে ক্ষীণ হেসে বলে উঠল,

” আসার সময় দিক বিদিক ভুলে দিশা হারিয়ে মাছ বাজারে গিয়েছিলে?কেমন মাছ মাছ গন্ধ পাচ্ছি।”

তুলি পিটপিট করে আদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকল অল্পক্ষণ। ব্যগ্র কন্ঠে বললো,

” কোথায় মাছের গন্ধ? আপনি অনেক মিথ্যা বলেন ডাক্তার সাহেব। বললেই তো পারেন আপনার সাথে গোসল করতে হবে!”

কথাটা বলে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল তুলি। ইশ!এমন কথা কি করে বের হয়ে আসল মুখ থেকে। এখন কোথায় লুকাবে এই মুখ!আদ্র ঠোঁট দুটো প্রসারিত করল, দেরি না করে তুলি কে কোলে তুলে নিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে।

লং একটা শাওয়ার নিয়ে তুলির নিজেকে একদম সতেজ, নির্মল লাগছে। সকালের বিষাক্ত মুহুর্তগুলো আদ্রর সাময়িক সময়ের ভালোবাসা একদম নিঃশেষ করে দিয়েছে। চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রবর্তী হলো তুলি। গোসল শেষে কাপড়গুলো ধোঁয়া হয় নি। ধুতে যাবে তার আগেই আদ্র বালতি ভর্তি কাপড় এনে সামনে রাখল। তুলির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

” আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ধোঁয়া হয়ে গেছে। তুৃমি ছাদে মেলে দিয়ে আসো।”

” আপনি কেন ধুতে গেলেন?আমিই তো পারতাম।”

” তুমি সকাল থেকে অসুস্থ আমার থেকে লুকিয়ে খুব খারাপ করলে তুলা।”

আদ্রর রাশভারি কন্ঠে তুলি চুপসে গেল। বালতি তুলতে যাবে তার পূর্বেই আদ্র নিজের হাতে নিয়ে নিল।

” আমি নিচ্ছি। তুমি নাহয় মেলে দিও।”
_______

গরমে অস্বস্তি নিয়ে তুলি বসে আছে। মাথার উপর ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে ফ্যান। কৃত্তিম বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে রুমের কোণে কোণে। তবুও এই বাতাসে শান্তি নেই তুলির। এসি অন করলে কেমন বমি বমি পাচ্ছে। এ কেমন রোগ তুলি ভেবে পাচ্ছে না। এতদিন তো এমন হয় নি। গত কয়েক দিন ধরে এসির ঠান্ডা টা সহ্য হচ্ছে না। তার জন্য গরমে অবস্থা খারাপ হলেও আদ্র মুখ বুঁজে সহ্য করে নিচ্ছে। আদ্র অনেক বার এসি অন করতে চেয়েছে কিন্তু তুলি বেঁকে বসে বার বার। তার একটাই কথা এসি চালালে রুম থেকে বের হয়ে যাবে সে। আচ্ছা তার কি একবার বলা প্রয়োজন আদ্র কে শরীরের ব্যাপারে?আদ্র হার্ট সার্জন হলেও নিশ্চয়ই অন্য বিষয়ে টুকটাক ধারণা আছে!নাকি পায়েল অথবা রিমি কে ফোন দিবে?দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে তুলি ক্রমাগত। বই টা বন্ধ করে আদ্রের দিকে ঘাড় কাত করে চাইল। ফাইলে চোখ বুলাতে মগ্ন আদ্র। চেয়ার ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে আদ্রর সামনে এসে উপস্থিত হলো। ফাইল থেকে মাথা তুলে আদ্র এক পলক তাকাল। পুনর্বার ফাইলে চক্ষু নিবদ্ধ করে বললো,

” পড়া শেষ?”

” উহু!”

” তাহলে?”

প্রশ্নবিদ্ধ চোখ জোড়া নিক্ষেপ করল আদ্র। তুলি,,

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৪৮

তুলি জিহ্বা দিয়ে শুকনো অধর যুগল ভিজিয়ে নিল। আমতা আমতা করে বললো,

” আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।”

” বলো।”

” আমার,,!”

কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না তুলি। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। গা গুলিয়ে আসতে লাগল হঠাৎ । গরগর করে বমি করে দিল আদ্রর সামনে,যা ছিটকে আদ্রর গায়ে পড়ল। চোখ বুঁজে নিল আদ্র। কীয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়া মাত্র তড়িৎ গতিতে উঠে ওয়াশরুম থেকে বালতি করে পানি নিয়ে এল। তুলি দুর্বল হয়ে বসে পড়েছে ইতিমধ্যে মেঝেতে হাঁটু ভেঙে। আদ্রর মনে হলো কেউ হাজারো তীর ছুঁড়ছে তার বুকের মাঝে। তুলির এই অবস্থা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে হৃদপিণ্ড। ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছে তুলি। আদ্রর উপর বমি করে দিয়েছে কেমন রিয়েক্ট করবে আদ্র!ব্যাথাতুর চোখে আদ্রর দিকে তাকাল। আদ্রর ভাব নির্বিকার যেন তুলি কোনো ভুল করে নি। তাড়াতাড়ি করে তুলি কে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিল। টাওয়াল ভিজিয়ে তুলির গা মুছে, কাপড় নিয়ে এল কার্বাড থেকে। হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠল,

‘ চেঞ্জ করতে পারবে তো?’

মাথা নাড়ল তুলি। টলমলে চোখ নিয়ে দৃষ্টি তাক করল আদ্রর দিকে। আদ্রর নীলাভ নেত্রে অস্থিরতা স্পষ্ট। লাল হয়েও আছে কিঞ্চিৎ। আদ্রের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে কাপড় নিল। ললাটে অনুভব করল আদ্রর গাঢ় স্পর্শ। নিমিষেই তুলির চক্ষু ভেদ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। উঁহু কষ্টে নয়,অতি সুখে, জীবনে এমন একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্যে। ব্যান্ড দিয়ে উন্মুক্ত, খোলা চুলগুলো বেঁধে দিল আদ্র। কপালে অবাধে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। ম্লান হেসে বললো,

‘ আমি নিচ থেকে আসছি। তুমি চেঞ্জ করে নাও।’

বিনা সময় বিলম্বিত আদ্র বেরিয়ে গেল। তুলি চেয়ে থাকল,চেয়ে রইল অপলক। একটু রাগ করতে পারত না আদ্র? অন্য কারো বমিতে কি ঘিন নেই তার?শার্ট টাও তো পাল্টায় নি,কোথায় গেল আবার। তুলি নানা চিন্তা ভাবনায় মগ্ন থেকে কাপড় পাল্টে ফেলল। পুরো শরীর কাঁপছে,দুর্বল অনুভূত হচ্ছে খুব। ফ্লোরের দিকে নজর যেতেই গা গুলিয়ে আসতে লাগল আবারও। খিঁচে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ! ফ্লোর তো সে ভরিয়েছে, তারই পরিষ্কার করা উচিত। এখানে যেহেতু একটা ঘিন ঘিন ভাব আছে,কাজের মেয়েকে বলাও ঠিক হবে না।

চোখ মেলে কিছুটা স্থির হলো। আদ্রর রেখে যাওয়া বালতি টা টেনে আনল সোফার কাছ পর্যন্ত। এতটুকুতেই যেন জান বের হয়ে যাচ্ছিল। কই বালতি তে তেমন পানি নেই, ওজনও নেই তবুও তুলির শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। হয়তো অবসাদ,দুর্বলতার জন্য এমতাবস্থা। তুলি ন্যাকড়া ভিজিয়ে নিচু হওয়া মাত্র শ্রবণ গ্রন্থিতে পৌঁছাল আদ্রর ভরাট কন্ঠ।

‘স্টপ তুলা!’

হাত থেকে আপনাআপনি পড়ে গেল ন্যাকড়া টা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তুলি। সম্মুখে চাইতেই দেখল আদ্রর হাতে শরবতের গ্লাস,চোখে রাগ। তুলি দু’কদম সরে গেল। আদ্র হেঁটে এল দ্রুত, শরবতের গ্লাস টা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

‘ বিছানায় বসে শরবত টা ফিনিশ করো। এতো পন্ডিতি করার প্রয়োজন নেই তোমার। জান চলে না, আসছে ফ্লোর পরিষ্কার করতে। ‘

আদ্রের রাগান্বিত কন্ঠে ভয়ে হিমশিম খাচ্ছে তুলি রীতিমতো। রাগল কেন আদ্র?তখনকার জন্য নাকি এখনকার জন্য?মুখে উচ্চারিত শেষ বাক্যটুকু জানান দিচ্ছে এখন করা কান্ডের জন্য। ধীর ধীর পায়ে তুলি বিছানায় এসে বসল। মুখের কাছে গ্লাস টা নিতেই সুন্দর একটা স্মেলে মন,প্রাণ মুহুর্তেই জুড়িয়ে গেল। লেবুর শরবত বানিয়ে এনেছে আদ্র। তুলির এ মুহুর্তে এটাই জরুরি ছিল। রুদ্ধশ্বাসে খেয়ে নিল সবটুকু। চোখের দৃষ্টি সামনে নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেল আদ্র মেঝে পরিষ্কার করে ফেলেছে প্রায়। বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই মুখশ্রী তে। তৎক্ষনাৎ তুলির আঁখিদ্বয়ে ফুটে উঠল অজস্র মুগ্ধতা।হৃদয়পটে বইতে লাগল শীতল হাওয়া।
.
.
কোমরে ঠান্ডা স্পর্শে তুলির দেহ একটু আকটু শিউরে উঠল। ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বললো,

‘ শাওয়ার নিয়ে এসেছেন?’

‘হু।’

‘ কাল হসপিটালে যাবেন?’

আদ্র জবাব দিল না। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলির মুখের দিকে। মুখটা শুকিয়ে গেছে অনেক। রোগা রোগা ভাব। আদ্র চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ তুমি তখন কি বলতে চাইছিলে?’

হুঁশ উড়ে গেল তুলির আদ্রর প্রশ্নে। কিছু সময় আগেও বলার জন্য যেই সাহসটুকু জুগিয়েছিল তা উবে গেল নিমেষে। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে!যদি সত্যি হয়ে যায় ভাবনা টা তবে কেমন হবে আদ্রর প্রতিক্রিয়া?না পারবে না তুলি বলতে৷ বহু বছর আগের কার মেয়েদের মতো স্বামী কে বলতে ভীষণ লজ্জা অনুভব হচ্ছে তুলির।বিষয়টা চাপা দেবার লক্ষ্যে চোখ খিঁচে ঘুমের ভান ধরল। তড়িঘড়ি করে বললো,

‘ অনেক ঘুম পাচ্ছে ডাক্তার সাহেব। কাল বলব।’

আদ্রর নিষ্পলক দৃষ্টি ভঙ্গ হলো না। তুলির মিছে মিছে ঘুমের ভান দেখে ভ্রুঁ উঁচিয়ে মৃদু হেসে কোমর জরিয়ে বুকে নিয়ে এল। বুকে তুলির মাথা চেপে ধরে গাঢ় স্বরে বলে উঠল,

‘ লজ্জায় তুমি আচরণ করছো ঠিক নব্বই দশকের নারীর ন্যায়।
মিছে মিছে তোমার অভিনয় ধরা পড়ে গেল আমার চক্ষে। কি কারণ এত লজ্জার তোমার লাজুকলতা?’

তুলি শুনল সবটা,ঠিক কর্ণগোচর হলো কানের অতি নিকটে আদ্রর ফিচেল,মুগ্ধময় স্বর। চোখ বুঁজেই গুটিসুটি মেরে গেল একটুখানি আদ্রর বুকে।
____________

‘ দরজা খুলে বেরিয়ে এসো তুলি। দেরি হচ্ছে কিন্তু!’

রুমের ভিতর থেকে কোনো সাড়া এল না। আদ্রর মাথায় রাগ চরে গেল। ধপ ধপ করে জ্বলে উঠল মস্তিষ্ক। সেই সাথে বিরক্তি যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রাগ সংবরণের চেষ্টায় নেমে পড়ল। তুলি রুমের দরজা মেলছে না। জোরে ধাক্কা দিতে গিয়েও থেমে গেল। গম্ভীর অথচ আদর মাখা স্বরে কিছুটা জোরেই বললো,

‘ ঠিক আছে আমাকে নাহয় ঢুকতে দিও না তবে দরজা একটুখানি মেলে কিট টা দেখাও বউ। কতক্ষণ অপেক্ষা করাবে বলো?এতক্ষণ অপেক্ষা করালে এর ফল কিন্তু সুমিষ্ট হবে না।’

তুলি চমকে উঠল, দ্রুত গতিতে বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে তাকাল হাতে থাকা প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট টার দিক। প্রচন্ড কাঁপছে বুক টা। বক্ষস্থলে চলছে তীব্র তোলপাড়। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যখন ওয়াশরুমে যেতে নিবে তখনই হতদন্ত হয়ে ছুটে এসে হাতে এটা ধরিয়ে দিল আদ্র। প্যাকেটে নাম পড়তেই তুলি লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। না বলতেই কিভাবে বুঝে গেল মানুষ টা?আগেই কি বুঝতে পেরেছিল?তাই বুঝি সবকিছু এতোটা স্বাভাবিক! আচ্ছা যদি নেগেটিভ হয় ভাবনা?তুলির বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। আদ্র প্যাকেট টা হাতে দিয়েই সাথে সাথে বেরিয়ে গেছে। হয়ত বুঝে গেছে এখন এক নজরও চাইল তুলির মরণ হবে লজ্জায়। তুলি দরজা বন্ধ করেছে আদ্র যাওয়ার পর পরই। এখনও মেলে নি। দরজায় দেহ ঠেকিয়ে কিট টার দিক তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ।

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। পুনরায় আদ্রর ডাকে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা টা খুলে দিল একটু। পুরোটা মেলল না। কিন্তু বোকা তুলি আদ্রর চাল টা-ই বুঝল না৷ কিট টা দরজার ফাঁক দিয়ে ধরতেই দরজা ঠেলে ভিতরে চলে আসল আদ্র। তুলি হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল কেবল। আদ্র এক হাতে তুলি কে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে অন্য হাতে দরজার ছিটকিনি আঁটকে দিল। কিট টার দিকে এক পলক তাকিয়ে তুলির দিকে তাকাল বিস্মিত চোখে। তুলির ভয় হচ্ছে। প্রবলভাবে বাড়ছে তা আদ্রর মুখভঙ্গি দেখে। কম্পিত গলায় বললো,

‘ ককক কিছু বলছেন না কেন?’

আচমকা ঠোঁটে কিছু মুহুর্তের স্পর্শে মাথা নত হয়ে গেল তুলির। আদ্র কোমরে হাত পেঁচিয়ে তুলির কপালে চুমু খেল গভীরভাবে। গালে তরল কিছুর অস্তিত্ব পেতেই তুলির হা পা অসাড় হতে শুরু করল। নত আখিপল্লব তুলে চকিতে চাইল আদ্রর পানে। আদ্র পকেট থেকে ফোন বের করল। তুলির কান্না পাচ্ছে, গাল স্পর্শ করা জল টুকু আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। আহা,কি সুখ মিশ্রিত এই জলে। সুখময় জল!
.
.
অন্তুর কাঁধে মাথা রেখে পায়েল সকালের আকাশ দেখছে। আজ আকাশ টা নীল নয় কেমন ধূসর রঙা। বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। পায়েলের চুলগুলো হালকা হালকা উড়ে বেড়াচ্ছে, ছুঁয়ে দিচ্ছে অন্তুর মুখ,ঘাড়,গাল। ফোনের শব্দে পায়েল নড়েচড়ে উঠল। প্রেমবিলাস ভঙ্গ হওয়ায় চোখ রাঙিয়ে তাকাল অন্তুর দিকে। অন্তু মিনমিন করে বললো,

‘ আমার কোনো দোষ নেই পায়েল,আমি তোকে একদম বিরক্ত করি নি। করেছে আমার ফোন।’

পায়েল পকেট থেকে ফোন টা বের করে হাতে নিয়ে আছাড় মারতে যাবে তার পূর্বে আবারও বেজে উঠল। স্ক্রিনে চাইতেই ঠোঁটের কোণ ঘেষে ফুটে উঠল হাসি। রিসিভ করলো সাথে সাথেই।

‘ জলদি দশ কেজি মিষ্টি নিয়ে আয়। পাঁচ কেজি বাসায় রাখবি এবং বাকি পাঁচ কেজি বিশেষ কারো জন্য। ‘

পায়েল আদ্রের কথা শুনে হতভম্ব। কন্ঠে অবাকতা নিয়ে বললো,

‘ কেন?’

‘ কারণ আমি বাবা হচ্ছি।’

আদ্রের নির্বিকার স্বীকারোক্তিতে পায়েল বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কিছু বলার আগেই কেটে গেল কলটা।
.
.
তুলির হাত টা ধরে কাবার্ডের সামনে আনল আদ্র। কালো রঙের একটা শাড়ি বের করে বললো,

‘ তৈরি হয়ে নাও।’

হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলি অল্পক্ষণ। অথচ আদ্র ভ্রুক্ষেপহীন। তাড়া দিচ্ছে বার বার তৈরি হওয়ার জন্য।

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)