আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৬+৭

0
809

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -[৬]

‘তুমি তুলা!আমি তোমাকে দেখেছি।’

একটা মিষ্টভাষী কন্ঠের কথা তুলির শ্রবণ হলেও তাঁর কোনো হেলদোল নেই। সে তো কাঁদতে ব্যস্ত। চোখের একেক ফোঁটা অশ্রু যেন অজস্র কষ্টের বোঁজা নিয়ে গড়িয়ে চলছে। সামনে দুই পা ভেঙে বসা মেয়েটা ছলছল নয়নে তুলির কান্না দেখে যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তুলির পিছনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে তাকাল মেয়েটা। করুন স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ তোমার তুলা কাঁদছে কেন বয়পেন?’

স্মিত হাসল আদ্র। হাঁটু গেড়ে তুলির সামনে বসে পড়ল। তুলির কোনো দিকেই হুঁশ নেই। জলে টুইটুম্বুর চোখ নিয়ে আদ্রর দিকে তাকাতেই আদ্রর হৃদয় কেঁপে উঠল। বক্ষপিঞ্জরে কাল বৈশাখীর ন্যায় প্রবল ঝড় শুরু হল। তুলির হস্তে আলতো স্পর্শ করতেই প্রচন্ড জোরে আদ্রকে ঝাপটে ধরল তুলি। নীল পাঞ্জাবির কিছু অংশ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে আদ্রর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। তার চোখের পানি নাকের পানি আদ্রর বুকের বা পাশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। অথচ তাতে কোনো হেলদোল নেই তুলির। কিন্তুর আদ্রর ভিতরের সর্বাঙ্গ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভূত করছে। তুলি আদ্রর বুকে সৃষ্ট হওয়া ঝড়ের আভাস পেলে লজ্জায় নিজের মৃত্যু কামনা করতেও পিছুপা হতো না। আমরিন তুলি কে আটকাতে গিয়েও ধরল না। আদ্রর দিকে ভয়মিশ্রিত নয়নে চেয়ে বলে উঠল- ‘ সরি ভাইয়া’। চোখে কষ্টের ছাপ থাকলেও আদ্রর ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখে আমরিন মনের মধ্যে তীব্র প্রশান্তি অনুভব করল। আদ্র বুকে আরেকটু চাপ অনুভব করতেই বলিষ্ঠ দু হাতে শরীরের সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল তুলি কে।তুলির কিঞ্চিৎ ব্যাথা হলেও শান্তির মাত্রা যে তার চেয়েও বেশি। বিকেল থেকে হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা সবটুকু কষ্ট নিঃশেষ করে দিয়েছে আদ্রর প্রতিটি হদস্পন্দন।

তুলি কে কোলে তুলে নিল আদ্র। তাতেও যেন ঘোর কাটে নি তুলির। সে যেনো অতি আনন্দে, আর অতি দুঃখে ভুল-খারাপ বিবেচনা করতেই ভুলে গেছে। নিজের অশ্রুমাখা নয়ন যে আদ্রর উজ্জ্বল মুখশ্রী থেকে সরাতেই পারছে না। তুলি নিজেও জানে না সে কেন এমন করছে!তবে তার কিশোরী মন প্রখর ভাবে অনুভূতিতে মিশিয়ে নিয়েছে আদ্র কে। আলতোভাবে অতি সন্তর্পণে তুলি কে বিছানায় বসিয়ে দিল আদ্র। মেয়েটা এখনো হেঁচকি তুলছে থেমে থেমে। ‘এতোটা নরম প্রকৃতির হয় বুঝি মেয়েরা?নাকি এই মেয়েটাই এমন?’ প্রশ্নটার সূচনা হতেই অন্য এক প্রশ্নে তুলির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা আদ্র পাশ ফিরে চাইল।

‘ বয়পেন কাঁদছে কেন মেয়েটা?’

সাদা ছোট্ট লেহেঙ্গা পরিহিতা জারিফা কে নিজের কাছে টেনে নিল আদ্র। মেয়েটা ভীষণ কিউট। বয়স আর কত হবে পাঁচ থেকে ছয় বছর!এতটুকু একটা মেয়ের কথা খুব পাকা পাকা। জারিফা আদ্রর ছোট ফুফু ইনায়ার মেয়ে। বিয়ের ১২ বছর পর তিনি মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছেন। মেয়েটা যখন উনাকে মাম্মাম বলে অভিহিত করে তখন শুধু ইনায়ার না প্রত্যেকটা মানুষেরই পরাণ জুড়িয়ে যায়। বহু আকাঙ্ক্ষার পর সবার জীবনে জারিফার আগমন বলে কথা। মেয়েটা আদ্র বলতে পাগল। সবাইকে বলে বেড়ায় আদ্র তার বয়পেন। জারিফার গালে আলতো একটা চুমু খেল আদ্র। নরম স্বরে বলে উঠল-

‘ তুলা কেমন হয় জানো তো গার্লফ্রেন্ড?’

‘ অনেক সফট।’

‘রাইট। তুলার মতো সফট এই ছিঁচকাদুনে মেয়েটা।’

‘ তাই বুঝি তুমি তুলা ডাকো?’

‘হুম গার্লফ্রেন্ড!তুলার মতোই খুব নরম ও কোমল এই মেয়েটার মনটা।’

‘ তুমি কিভাবে বুঝলে?’

‘ মনের কানেকশন গার্লফ্রেন্ড!’

তুলি হতভম্ব হয়ে জারিফা ও আদ্রর কথা শুনছে। কিন্তু কিছুই ঢুকছে না তার অধম মাথায়। শুধু এতটুকু বুঝতে সক্ষম হল আদ্র তার মনটাকে সফট হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সত্যিই কি তাই!ফ্যালফ্যাল চোখ দুটো জারিফাকেই পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। জারিফা আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমরিন ওকে কোলে তুলে নিল। ভাই যে তাকে বকবে না সেটা জানে তবে খুব রাগ করেছে হয়ত। কিন্তু আমরিন যে কিছু একটা ধরার জন্যই এমন করেছে।
জারিফা কে নিয়ে রুমের বাহিরে আসল আমরিন। তুলিকে সে কয়েকদিন ধরে বিশেষ খেয়াল করেছে। তার মনে হয় তুলির মনে অনুভূতি আছে। তাই সে তুলি কে পরীক্ষা করার জন্য এই কান্ডটা ঘটাল। মনে মনে খুব আনন্দ পাচ্ছে আমরিন। ‘আচ্ছা ভাইয়ার মনেও অনুভূতি আছে তো?না থাকলে ভাইয়ার চোখে কেন অস্থিরতা ছিল?কন্ঠে কেন এতটা বিষাদের রেশ ছিল?’ বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে রুমের দিকে যাচ্ছিল আমরিন।

হঠাৎ করে থমকে গেল সে। সামনে নিবিড় দাঁড়িয়ে। আমরিনের বুকে উতালপাতাল ঢেউ গর্জে উঠলো নিবিড় কে দেখে। কতকাল পড়ে দেখল। হবে বছর তিনেক। বছর তিনেক আগে সেই যে হুমকি দিয়ে প্রগাঢ়পাড় হল আর আজ সামনে এসে উপস্থিত হল মানুষটা। মানুষটা কি জানে একটা হুমকিতে আমরিনের মনের কতটা অংশ মানুষটার দখলে চলে গেছে?জানেনা,জানলে হয়তো ছুটে আসতো। ঢের অভিমান ঝেকে ধরল আমরিন কে। কিশোরী প্রণয়ের অনলে সে যদি জ্বলতে পারে তবে মানুষ টা কেন জ্বলে নি!জ্বললে তো এতোটা বছর এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে থাকতে পারত না। অভিমানে নিবিড় কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল আমরিন। তার আগেই নিবিড় চট করে জারিফা কে নিজের কাছে নিয়ে নিল। হালকা কেশে বলে উঠল-

‘তুই যেতে পারিস আমরিন। আমি আদ্রর গার্লফ্রেন্ডের খেয়াল রাখব। তাই না গার্লফ্রেন্ড?’

‘ হু।’–মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল জারিফা।

অভিমানী আমরিনের অতিশয় মাত্রায় রাগ হল। ভেবেছিল নিবিড় হয়তো অন্য কিছু বলবে। কিন্তু! একটা সূক্ষ নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে এল সেখান থেকে। দলা মুচড়ে যাচ্ছে ভিতরটা। তিনটে বছর আগে মিছে মিছে একটা হুমকি কে মন পাঁজরে আকড়ে ধরে ভুল করে ফেলেছে সে। হতে পারে বন্ধুর বোন বলেই শাসন করেছিল যেন বিপথগামী না হয় অল্প বয়সে।
________________

গায়ে বেগুনি রঙের একটা সিল্কের শাড়ি জড়িয়ে নিয়েছে তুলি। পিছনের খোঁপায় বেলীফুলের মালা গাঁথা। সামনে কিছু চুল মৃদু হাওয়ার তালে কপালে উপচে পড়ছে। দু’হাতে বেগুনি রঙের মেটাল চুড়ি রিমঝিম আওয়াজ তুলে চলেছে প্রতিটি পদক্ষেপে। চিকন গোলাপি রাঙা ঠোঁটে লজ্জালু রেখার ছড়াছড়ি। হৃদয়ে হওয়া ক্ষতগুলো ভরাট করে দিয়েছে আদ্র। তুলি আমরিনের কাছ থেকে জেনেছিল আদ্র একজন হার্ট সার্জন। তুলির হার্টের চিকিৎসা করতে আদ্রর কোনো মেডিসিন দিতে হয় নি বরং দিতে হয়েছে এক আকাশসম সুখ। সুখ!এ মুহুর্তে তুলির নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে মনে হচ্ছে। সুখের আস্বাদনেই তো আজ হাউমাউ করে কেঁদেছে। জারিফা কে দেখে এক পলকের জন্য স্তব্ধ হলেও খানিকটা সময় পর খুশিতে নিজেকে সামলাতে পারল না। চরম লজ্জা পেলেও পাগলের মতো কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে নি আদ্র তাতেই খানিক সময় বিস্মিত ছিল। উল্টো নিজের কাবার্ড থেকে একটা শপিং ব্যাগ এনে তুলির কোলে রেখেছিল। খোলার জন্য ইশারা করতেই তুলি শপিং ব্যাগ খুলে কয়েক পল নিস্তব্ধতায় কাটিয়ে দিল। আদ্র যে তার কথানুযায়ী তাকে একটা শাড়ি সাথে চুড়ি,কাজল,বেলি ফুলের মালা দিবে কল্পনাতীত ছিল তার কাছে। কাঁদতে চাইলেও কাঁদল না তুলি। একটা হাত আঁকড়ে ধরে হাতের মুঠোয় পুরে নিল আদ্র। নিমিষেই অজানা এক শিহরণ বয়ে গেল অন্তস্থলে। কর্ণপাত হল আদ্রর বিষন্ন কন্ঠস্বর।

‘ জারিফা ছোট ফুপির মেয়ে। ওর কাছে আমি খুবই বিশেষ। ঠিক জারিফাও আমার জীবনে বিশেষ। তুমি এতোটাও দুর্বল প্রকৃতির রূপ ধারণ করো না তুলি যা অন্যের হৃদয় দুর্বল করে দেয়।’

হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল তুলি। আদ্রের কথার পিঠে কি জবাব দিবে গুছিয়ে নিতে পারছে না। তন্মধ্যে এটাও ঠাওর করতে পারছে না আদ্র কেন এসব বলছে। কিন্তু আদ্রর কোমল আদরেমাখা স্বর তার মনে অসম্ভব ভালোলাগার সঞ্চার ঘটাল। শাড়িটার জন্য ধন্যবাদ জানাতে গিয়েও আঁটকে পড়ল আদ্রর শ্রুতিমধুর কথার মাঝে। বাক্যটা এখনো তুলির কানে বারংবার বেজে উঠছে।

~’ ধন্যবাদ দিতে হবে না,শুধু এক টুকরো হাসি আমায় নিবেদন করো শ্যামাঙ্গিনী।’
___________

আমরিনদের বাড়ির বাগানের পাশের জায়গাটায় মেহেদী অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হয়েছে। চারদিকে স্টার আকৃতির ফেয়ারি লাইট দিয়ে সাজানো। আলোতে ঝলমল করছে পুরোটা জায়গা। বাগান থেকে ফুলের ঘ্রাণ মৌ মৌ করে নাকে এসে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা দূরেই সবাই মিলে বসে বসে কথা বলছে,আড্ডা দিচ্ছে। আমরিন সবুজ একটা লেহেঙ্গা পড়ে মেহেদীর ঢালা নিয়ে স্টেজে যাচ্ছে। কিন্তু যার জন্য তুলি রমণীর রূপ ধারণ করল তার হদিসও পেল না। তবুও তাকে খোঁজার উদ্দেশ্য এগিয়ে যেতে লাগল। কিছু একটা ভেবে থেমে গেল। তুলি মন প্রাণে চায় সেই মানুষটাই তাকে প্রথম দেখুক। তাই আড়ালে দাড়িয়ে রইল।

দূর থেকে পূর্ব মুগ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুলির দিকে। পূর্বর নজরকে লক্ষ্য করে তার সাথে আসা দুই বন্ধুও তুলি কে দেখে অপলক তাকিয়ে রইল। রিশাদ নামের ছেলেটা লোভাতুর কন্ঠে বলে উঠল-

‘ জোশ তো!দোস্ত আমরা কিন্তু মিলেমিশে ভাগ করলেও পারি।’

চড়চড় করে মাথায় রাগ চেপে বসল পূর্বর। চোয়াল শক্ত হয়ে এল সেকেন্ডেই। রিশাদের কলার চেপে ধরে কঠোর কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ লাশ হতে না চাইলে ওই মেয়ের দিকে নিজের বাজে নজর দেওয়া বন্ধ কর। খুন করে ফেলব একদম। ‘

কাছের বন্ধুর কাছ থেকে এমন বাচনভঙ্গিতে ভড়কে গেল রিশাদ। পরমুহূর্তে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে উঠল,

‘ তোর বেড পার্টনার কতজন হয়েছে তার হিসেব আমাদের অজানা নয় পূর্ব। এই মেয়েটাও নিশ্চয়ই তাই হবে। তবে আফসোস একা একাই,,,’

পুরোটা বলতে পারল না রিশাদ। তার আগেই কন্ঠনালি চেপে ধরল পূর্ব। কড়া গলায় বলে উঠল,

‘ মেয়েটা চিরকালের জন্যই আমার।’

কথাটা বলেই নিজের রাগ দমাতে দূরে চলে গেল। ভাইয়ের হবু শশুর বাড়িতে কোনো সিন ক্রিয়েট করতে চায় না সে। তার পিছু পিছু ছুটে চলে গেল অন্য ছেলেটাও। কিন্তু রিশাদ নামের ছেলেটা দমে নি। তুলির দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অপমানে, ক্রোধে তুলিকে পাওয়ার জেদ চাপলো মস্তিষ্কে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পিছনে থেকে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁয়াতে উদ্যত হলো তুলির ঘাড়ে।

#চলবে,,,,,!

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -[৭]

ড্রইং রুমে বাবা ও মায়ের সাথে একটা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম তুলির। ভুল দেখছে ভেবে চোখ কচলে আবারও ভালোভাবে তাকাল। ভুল নয়,সবটাই সত্য। খুশিতে দৌড়ে গিয়ে ধপ করে সোফায় বসে ছেলেটার পাশে পড়ল। হতচকিত হয়ে উঠল ছেলেটা। ঘাড় কাত করে তুলির ঘুম ঘুম মুখটা চোখে পড়তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। তুলি ঠোঁট উল্টে বলে উঠল,

‘ এতোদিনে আসার সময় হলো আহান ভাই?’

‘ কালই ফিরেছি রাজশাহী থেকে। আর আজই সকাল সকাল এখানে।’

‘ আমার জন্য তো আসো নি। আমি নিশ্চিত তুমি ইনশিতা আপুর বিয়ের জন্য এসেছো।’

‘ দু’টো কারণেই এসেছি। প্রথমত তোর জন্য, তাই তো আগে তোর বাসায় এসেছি। এসেই খালা মণির কাছ থেকে শুনলাম তুই নাকি ইনশিতাদের বাসায়।’

‘ হু।’

আফসানা মেয়ের দিকে ভালোভাবে তাকালেন। তুলির ঘুমন্ত মুখ জানান দিচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে সরাসরি। বেশ মায়া লাগছে তুলির ঘুমন্ত চেহারাটা। হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কিরে ঘুম থেকে উঠেই চলে এলি?’

নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ওড়না দিয়ে ঢেকে ফেলল তুলি। ভড়কে যাওয়া কন্ঠে জবাব দিল,

‘ হ্যাঁ আম্মু। একটু পরেই তো সবার রওনা দিতে হবে। আমার এখনও অনেক কিছু গোছানো বাকি৷ তাই কাউকে না বলেই চলে এলাম।’

‘ আচ্ছা। ‘

তুলির বাবা তৌফিক সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। আদ্রদের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে আহানের সাথে উঠে দাঁড়ালেন। আহান তুলির মাথায় হাত রেখে বলে উঠল-

‘ আদ্র ভাইদের বাসায় দেখা হবে।’

তুলি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বুঝাল। ড্রইং রুম থেকে রুমে এসে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে খাটে বসে পড়ল এক প্রকার লাফিয়ে। মুঠো করে রাখা হাতটা মেলে ধরতেই চক্ষুদ্বয়ে ভেসে উঠল কড়া লাল রঙে রঞ্জিত মেহেদী রাঙা হাত ও হলুদ রঙের চিরকুট। তুলির জানা নেই তার হাতে মেহেদী কিভাবে আসল। গতরাতে বাগানেই চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু সকালে নিজেকে আবিষ্কার করল আদ্রর রুমে। কিছু সময়ের জন্য বিস্মিত হলেও তুলির চোখ কপালে উঠে গেল দু’হাতে মেহেদী দেখে। লজ্জায় আরক্তিম হয়ে উঠেছিল তার গাল। ‘মেহেদী কি আদ্র ভাইয়া দিয়ে দিল?’ আনমনে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন টা করল তুলি।
কিন্তু মস্তিষ্ক বলে উঠল- ‘উনি কেন মেহেদী দিয়ে দিবেন?’ তুলি মিনমিন স্বরে বলতে লাগল–‘ আমরিন দেয় নি তো?কিন্তু আমরিন দিলে এটা কেন লিখবে?’

সকাল সকাল মাথায় প্রেসার দিতে ইচ্ছে করল না আর। বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আঁতকে উঠল। তার গায়ে শাড়ি টা নেই বরং কালেকর নীল ড্রেস টা। শাড়ি টা কোথায় গেল?কে পাল্টাল?আদ্র! চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখা ফুটে উঠল। তুলির মন তুলির মস্তিষ্ককে কঠিন ভাবে শাসালো–‘ ডাক্তার সাহেব কে অবিশ্বাস করার আগে তোর মরণ হোক তুলি।’

‘ হয়তো আমরিন পাল্টিয়েছে’ এটা বলে তুলি গায়ের ওড়না টা দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিল। ড্রেসিং টেবিলের উপর তাকাতেই দেখতে পেল শাড়িটা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা কিন্তু তার উপর একটা চিরকুটও ভাজ করে রাখা, যা দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে এল। তুলি কিছু একটা ভেবে শাড়ি টা আদ্রর কাবার্ডে রেখে দিল। কারণ এটা এখন নেওয়া সম্ভব না। যদি মা দেখে সন্দেহ করে! তাই পরে নিয়ে যাবে। চিরকুট টা নিয়ে সোজা নিচে নেমে এল। ড্রইং রুমে আসতেই সোফায় ঘুমিয়ে থাকা আদ্রর দিকে চোখ পড়ল তার। আদ্রর ঘুমন্ত মুখ টা দেখে পরম ভালো লাগায় ছেয়ে গেল হৃদয়টা। চারদিকে তাকিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত মন নিয়ে আদ্রর দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ল। কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দিল আদ্রর খোঁচা খোঁচা দাড়িতে। যন্ত্রণা অনুভব করল তুলি। আদ্র নিজে কষ্ট করে সোফায় ঘুমোচ্ছে, অথচ তাকে সম্পূর্ণ রুমে একা থাকতে দিয়েছে এটা তার জন্য অনেক বেশি। দু চোখ বুঁজতেই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল। আবেগি মন টা সরে আসতে বাঁধা প্রদান করছে আদ্র থেকে। কিন্তু কেউ দেখে ফেললে অথবা আদ্র জেগে গেলে কি প্রতুত্তর করবে সে। তাই ধীর পায়ে হেঁটে বাসায় চলে এল তুলি।

চিরকুট টা তার জন্যই ছিল এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে কে রাখল?পড়েই তো দেখা হয় নি। যত্নসহকারে চিরকুটের ভাঁজ খুলে মেলে ধরল তুলি। চোখে ভাসমান হল খুব সুন্দর হাতের লেখা।

” চার বছর আগে দুই বেনুনী করা এক পিচ্চি তে আমার অবাধ্য চোখ দুটো আঁটকে গিয়েছিল। বেহায়া হয়ে গিয়েছিল আমার মন। আমার নির্ঘুম প্রতিটি রাতে প্রতি মুহুর্তে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেহায়া বলে অভিহিত করেছি আমি। শঙ্কায় কেটেছে নিদ্রাবিহীন আঁধার এই চিন্তায় পিচ্চির মনে আমার জায়গা হবে তো? সময়ের স্রোতে পিচ্চি আজ আঠারো তে পা রেখেছে। গতরাতে তাকে শাড়িতে দেখে বেসামাল হয়ে পড়েছিল আমার এতোদিনের বাধ্য হৃদয়। মন প্রতিবার একটা প্রশ্ন-ই করে যাচ্ছিল তবে কি আমার অপেক্ষার প্রহর গুণার সমাপ্তি ঘটবে এবার?শুভ জন্মদিন তুলা। ”

চিরকুট পড়ে কিছুক্ষণ থম মেরে রইল তুলি। আজ তার জন্মদিন সে তো ভুলেই বসেছিল। চিরকুট টার মালিক কে তা বুঝতে আর বাকি নেই তার। কিন্তু চিরকুটের লিখাগুলো! তুলির পরিচয় আদ্রর সাথে এ বাড়িতে আসার পরই। আগে কখনও দেখা হয় নি আদ্রর সাথে। নানুর বাড়িতে আমরিন,ইনশিতার সাথে পরিচয় হলেও আদ্রর মুখটা দেখার সৌভাগ্যও তার কখনও হয় নি। শুধু নামটাই শুনে গেছে।
_________

গোলাপি একটা লং টপস পড়ে তুলি গলায় সাদা একটা ওড়না পেচিয়ে নিল। ডান হাত টা লুকিয়ে অন্য হাতে টলি টানতে টানতে আদ্রদের বাড়িতে ঢুকল। সবাইকে নিজ নিজ গাড়িতে উঠতে দেখতে পেল তুলি। মায়ের সাথে উঠতে গিয়েও বাঁধা পেল আমরিনের জন্য। আমরিন টেনে নিয়ে তুলি কে গাড়িতে নিজের পাশে বসালো। এই গাড়িটা বেশ বড়। সামনে নিবিড় ও সাগর। পিছনে পায়েল,রিমি,অন্তু। নিজের পাশে অন্য একটা সিট খালি দেখে ভ্রু কুঁচকাল তুলি। তখনই জারিফা কে কোলে নিয়ে আদ্র হাজির হল। পড়নে কালো শার্ট, চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে স্মিত হাসি। তুলি রাতের জন্য কৃতজ্ঞতা সরূপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদ্রর দিকে। হাত বাড়িয়ে জারিফা কে নিজের কোলে নিতে গেলে জারিফা এমন এক বাক্য বলল যা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল তুলি। জারিফার বাক্যটা ছিল এমন,

‘ বয়পেন বলেছে তুমি নরম,তাই তোমার কোলে যাওয়া যাবে না। তুমি ব্যাথা পেলে আমার বয়পেনও তো ব্যাথা পাবে।’

কথাটা বলেই জারিফা আমরিনের কোলে গিয়ে বসল। পায়েল,রিমি, অন্তু,সাগর সবার সন্দেহের দৃষ্টি নিবদ্ধ আদ্রর দিকে। আদ্র এমন ভাব করল যেন ওদের পাত্তা দেওয়ার সময় নেই। তুলির পাশে বসে গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে দিল। বিড়বিড় করে বলে উঠল,

‘ গার্লফ্রেন্ড আমার হাঁটে হাড়ি ভেঙে দিল।’

কথাটা কারও কর্ণগোচর নাহলেও তুলির কর্ণগোচর হল ঠিকই। ভীষণ মজা পেল সে আদ্রর কথাটা শুনে। গাড়ি ছুটে চলেছে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। যাত্রাটা দীর্ঘ হলেও সবাই বেশ উৎফুল্ল। তুলির কখনো বান্দরবানে যাওয়া হয় নি। জীবনে প্রথম ইনশিতার বিয়ে উপলক্ষে বান্দরবান যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। ইনশিতার বিয়ে হবে ওদের দাদার বাড়িতে। ইনশিতাদের দাদার বাড়ি বান্দরবান। এতদূর কিভাবে কি তা প্রশ্ন জাগলেও সবটাই সম্ভব হয়েছে প্রেমের টানে। তুলি মায়ের কাছে শুনেছিল আদ্রর বাবা রাদিফ সাহেব কুমিল্লা ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ায় এখানে পড়তে আসেন বান্দরবান থেকে। ভার্সিটিতেই পরিচয় হয় সায়েরা বেগমের সাথে। তারপর প্রেম,বহু তিতিক্ষার পর বিয়ে। কারণ এতো দূর মেয়ে দিতে নারাজ ছিলেন আদ্রর নানা। কিন্তু মেয়েকে এতো বেশিই ভালোবাসতেন যে না মেনে উপায় ছিল না। বিয়ের পর রাদিফ সাহেব সায়েরা বেগম কে নিয়ে ঢাকায় সেটেল হন। ইনশিতার দাদা-দাদী বেচে নেই। তাই খুব একটা যাওয়া হয় না ওদের। তবে রাদিফ সাহেবের ইচ্ছে মেয়ে ওনি নিজের বাপের বিটে হতে বিদায় দিবেন। সেই সুবাদে বরপক্ষও যাচ্ছে সেখানে।

আকাশে মেঘ জমেছে। চারদিক কিছুটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। চট্টগ্রাম ছেড়ে বান্দরবানের দিকে ছুটে চলেছে গাড়ি। তুলি এতোক্ষণ সবার সাথে কম বেশি কথা বললেও আদ্রর সাথে একটা কথাও বলে নি। বলে নি বললে ভুল হবে চেষ্টা করেও পারে নি। কারণ ডাক্তার সাহেব যে ফোনে ব্যস্ত ছিল সারা রাস্তা। তুলির একবার মোবাইলে উঁকি দিয়ে দেখার ইচ্ছে হল, কিন্তু দেখতে হলে তো আদ্রর গা ঘেঁষে বসতে হবে তাই ইচ্ছে টা কে দমিয়ে ফেলল। পাছে যদি আদ্র তাকে ভুল বুঝে।

নিবিড় উঠে সাগর এর সিটে বসে পড়ল। আর সাগর ড্রাইভিং করতে লাগল। তুলি পাশ ফিরে দেখল আমরিন ও জারিফা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। পিছনে অন্তু ও পায়েল পরস্পরের মাথা একসাথে ঠেকিয়ে কি সুন্দর করে ঘুমোচ্ছে। এই দু’টো মানুষ যদি স্বচক্ষে নিজেদের এই দৃশ্য দেখত তাহলেও হয়তো বিশ্বাস করত না ভেবেই হাসি পেল তুলির। রিমি কানে এয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে রেখেছে। তুলির নিজেরও এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। এতো লং জার্নি এর আগে কখনো করে নি সে। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েও খুব একটা আরাম পেল না৷ তবে এছাড়া যে উপায় নেই। আকস্মিক চেনা স্পর্শে কেঁপে উঠল তুলি। একটা বলিষ্ঠ হাতের মালিক তাকে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল যত্ন করে। পরম আবেশে চোখ বুঁজে এল তুলির। ঠোঁটে প্রতীয়মান হল হাসির রেখা। মাথায় ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই শীতল স্রোত বয়ে গেল পুরো হৃদপিণ্ড জুড়ে। মনে মনে আওড়াল,

‘ এই মানুষটা আমার হোক। শুধুই আমার হোক।’
_________

‘ পেশেন্টের হুঁশ ফিরেছে মিস্টার পূর্ব। ‘

ডাক্তারের কথা শুনে উঠে দাঁড়াল পূর্ব ও তার সাথের সেই বন্ধু। দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকে দেখতে পেল বিধস্ত অবস্থায় পড়ে থাকা রিশাদ কে। গলায়,হাতে, পায়ে ব্যান্ডেজ। গত রাতেও ছেলেটা সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। রিশাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল পূর্ব। সাথে সাথেই ডাক্তার বললেন,

‘ উনি আর কথা বলতে পারবেন না। যেই ব্যক্তি,অথবা যারা উনাকে আঘাত করেছেন আমার ধারণা মতে খুবই বিচক্ষণ ছিলেন। প্ল্যান করেই কন্ঠনালিতে আঘাত করেছেন মেবি। হাত টাও অকেজো হয়ে পড়েছে।’

সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল পূর্ব । তার মুখের হাবভাব বুঝা দুষ্কর। পূর্বের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার জন্য ছটফটাতে লাগল রিশাদ। ভয়ে তার চোখের কার্ণিশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ভেসে উঠল কাল রাতের দৃশ্য,

তুলির ঘাড়ে নিজের ঠোঁট দুটো এগিয়ে নিতেই খুব শক্ত করে মুখ চেপে ধরল কেউ। টেনে হিঁচড়ে অতি সাবধানে নিয়ে এল বাড়ির পিছনের সাইডে। চাঁদের আলোয় মানুষ টা কে দেখে ভয়ার্ত চোখে তাকাল রিশাদ। ছোটার জন্য হাত পা ছোটাছুটির প্রয়াস চালাতেই বলিষ্ঠ আগ্রাসী হাতে গলা চেপে ধরল মানুষ টা। ছোট্ট একটা ছুরি দিয়ে আঘাত করল গলায়। হাতে রক্তের ছিটেফোঁটা লাগার আগেই লাথি দিয়ে রিশাদ কে নিচে ফেলে দিল। এলোপাতাড়ি লাথি মারতে লাগল রিশাদের পেটের নিচের দিকে। রিশাদ প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়েও পারছে না। চোখ দুটো থেকে যেন অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে। রিশাদের হাত মুচড়ে ধরে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল,

‘ প্রথম দেখায় অর্ধাঙ্গিনী রূপে মেয়েটা কে কবুল করে নিয়েছি আমি। নিজের প্রত্যেক টা শ্বাসে মিশিয়ে নিয়েছি তাকে। আর তুই তাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছিলি?তোর এমন হাল করব আজ যেন বেঁচে থেকেও মরণ যন্ত্রণা অনুভব করিস। কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে চাইতেও যেন তোর চোখের সামনে আমার চেহারা টা ভেসে উঠে। মেয়েরা সম্মানের যোগ্য, তোদের মতো কুত্তার ভোগের পাত্রী নয়। জানে মারব না,হসপিটালেও পাঠাব তোকে তবে তোর জীবনের সবটুকু শান্তি কেড়ে নিয়ে। নষ্টামি করার পথটাও রাখব না।

কথাগুলোই বলেই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে পাগলের মতো মারতে লাগল অনবরত। সাথের ছেলেটা থামাল না। এসব মানুষের প্রাপ্য এমনই হয়। নিজের হাতের মোটা লাঠি টা এগিয়ে দিল সুঠাম দেহের অধিকারী যুবকের নিকট। লাঠি নিয়ে বাঁকা হাসল ছেলেটা। রিশাদ ভয়ে করুণ চোখে চাইল। চোখ দুটো ব্যাথার চোটে বুঁজে আসছে তার। সহ্যশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। লোকটা তাচ্ছিল্যের স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ তুই কাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছিস জানিস?’

রিশাদ কোনো উত্তর দিতে পারল না। লোকটা হাঁটু মুড়ে হাসিটা প্রসারিত করে বলে উঠল,

‘যার থমকে যাওয়া নিঃশ্বাসে আমার সমাপ্তি। ‘

#চলবে,,,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)