আঙুলে আঙুল পর্ব-২৫+২৬

0
198

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২৫)

” আমি বিয়ে করব না, আপু। বাবাকে বলো, এই বিয়ে ভেঙে দিতে। ”

অরুণিমা বাকরুদ্ধ। বিস্ফারিত নেত্রদ্বয়ে আবিষ্কার করল, শূভ্রার শরীরে লাল বেনারশী ও স্বর্নের গয়না। বুঝতে পারল, সঞ্জয়ান তাকে নয় শূভ্রাকে বিয়ে করতে আসছে। এই মানুষটার দেওয়া একের পর এক ঝটকায় তার ভেতরটা বরফের মতো জমে গেছে। বাহিরটা হয়েছে স্পাতের মতো শক্ত, ক’ঠিন। অনুভূতি শূণ্য হয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। অত:পর শুধুমাত্র ঠোঁটদুটোতে প্রাণ এনে বলল,
” আমি বলতে পারব না, তুই গিয়ে বল। ”
” আমার ভ’য় করে। ”

শূভ্রাকে নিজ থেকে সরাল। বাহু জোড়া চেপে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বলল,
” অন্যায় করার সময় তো ভ’য় পাস না। ভুলের পর ভুল করে এসেও বাবার মুখোমুখি হয়েছিস। তর্ক করেছিস অসংখ্যবার। ”

সে মাথা নত করে ফেলল। অরুণিমা খেয়াল করল, শূভ্রার চোখদুটি ভেজা, ফোলা। দীর্ঘ সময়ের কান্নাকাটির ফল। তার মায়া হলো। স্নেহ এসে জমছে চোখজোড়ায়, অন্তরের সর্ব পাশে। দরদ উতলে উঠে আসছে কণ্ঠস্বরে৷ সে দমিয়ে ফেলল। তৈরি হওয়া সকল অনুভূতিকে উপেক্ষা করে বলল,
” অন্যায় করে এসেও যখন নিজের জন্য ল’ড়’তে পেরেছিস তখন ন্যায়ের জন্যও ল’ড়’তে হবে। এই বিয়েতে শুধু তোর না আমারও মত নেই। যা বাবাকে গিয়ে বল, এই বিয়ে তুই করবি না। ”
” আমি পারব না, আপু। বাবা কষ্ট পাবে, খুব রা’গ করবে৷ ”
” কবে থেকে তুই বাবার কথা চিন্তা করছিস? ”

অরুণিমার কণ্ঠস্বরে বক্রোক্তি, শ্লেষ্মা। চোখের চাহনিতে কটাক্ষভাব। শূভ্রা মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। আড়ষ্টভাবে লজ্জিত স্বরে বলল,
” যেদিন থেকে বাবা আমাকে ‘ মা ‘ বলে ডাকতে শুরু করেছে সেদিন থেকে। মায়েরা কি ছেলেকে কষ্ট দিতে পারে? ”

বোনের মুখে এমন মমতাময় প্রত্যুত্তর পেয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হলো। মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়ে এলো দৃষ্টি জোড়া। কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে বলল,
” তাহলে বিয়ে করে ফেল। কান্নাকাটি করছিস কেন? ”

অরুণিমা তাকে পাশ কাটিয়ে বিছানায় বসল। মাথায় মুড়িয়ে রাখা হিজাব খোলায় মনোযোগ দিল। শূভ্রা তার এই নিরুদ্বেগ ভাবটাকে সহ্য করতে পারছে না। দৌড়ে এসে পাশে বসল। হাত চেপে ধরে বলল,
” এত নি’ষ্ঠু’র হয়ো না, আপু। আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো। কথা দিচ্ছি, তুমি যেমন বলবে তেমন শুনব। যেভাবে থাকতে বলবে সেভাবেই চলব। ”

শূভ্রা নানানভাবে অনুরোধ করল, পূ্র্বের অপরাধ স্বীকার করল। নিজেকে বদলে ফেলবে এমন প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে বারবার। অরুণিমা চুপচাপ শুনছে আর ভাবছে, বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে সবার চোখে খারাপ হয়েছে। দোষী হয়েছে। অপরাধি সেজে ঘুরঘুর করছে সারা বাড়িতে। পায়ে ধরেও সেই দোষক্ষালন করতে পারছে না। বোনের জন্য নাহয় আরও একটু দোষী হলো। সে উঠে দাঁড়াল। ওড়নাটা গলায় ও মাথায় ভালো করে জড়িয়ে দরজার দিকে এগুল। বের হতে পারল না। কোথাও থেকে মা এসে উপস্থিত হলেন দ্বারের মুখে। চোখ পা’কি’য়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় যাচ্ছিস? ”

অরুণিমা নির্ভয়ে দৃঢ়স্বরে বলল,
” বিয়ে ভাঙতে। তোমরা একই ভুল আবারও করছ। এই বিয়েতে শূভ্রার মত নেই। ”

উত্তরটা নাজিয়া বেগমের কানে পৌঁছাতে মেয়ের কনুই চেপে ধরলেন। নিচু স্বরে শাসিয়ে বললেন,
” বাবাকে যদি আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে চাস তাহলে এখান থেকে এক কদমও নড়বি না। আমাদের হয়ে অনেক করেছিস, এবার থাম। ”

কথাটা বলেই তিনি চলে গেলেন সঞ্জয়ানদের কাছে। হাসি বদন ও তুষ্টচিত্তে তাদের সাথে মিশে গেলেন।

__________
প্রথম দিন থেকেই শূভ্রা অ’ভ’দ্র আচরণ করে আসছে সঞ্জয়ানের সাথে। সে সয়ে এসেছে। ছাড় দিয়েছে। খুব বেশি অসহ্যের হয়ে গেলে অরুণিমার কাছে নালিশ করেছে। কিন্তু এই বার আর সয়তে পারল না। ধৈর্যের বাঁধ ভে’ঙে গেল। রা’গ’টাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এইটুকু মেয়ে তাকে কল করে হু’ম’কি দিচ্ছে! মা’রার কথা বলছে! এরপরও কি ছাড় দেওয়া যায়? সঞ্জয়ান দিতে পারল না। কিংবা পরিস্থিতির চাপে পড়ে নিজের মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। দুর্বল চিন্তা-ভাবনায় পড়ে হাজির হয়েছে শূভ্রাদের বাড়ি। নিজের ব্যক্তিত্ব, প্রকৃত সত্তাকে ভুলে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। শুরুতেই তারা রাজি না হলেও সঞ্জয়ানের বাবা-মাও যখন পিছু পিছু হাজির হলো তখন আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি। মত ও অমতের মধ্যে পড়ে বিয়ের আয়োজনটা জমেই গেল। কাজী সাহেব যখন বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন সঞ্জয়ানের নজর পড়ল দূরে, অরুণিমার পানে। দরজার মাঝামাঝি স্থানে আঁট হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে একভাবে। সে দূর থেকেও যেন সে চাহনির অর্থ বুঝে গেল। নিজের কান্ডে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। মাথা হেঁট হয়ে এলো আপনাআপনি। চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইল, পারল না। স্বর্ণলতার কাছে বাঁ’ধা পড়ে গেছে। সে নিচু স্বরে বলল,
” মা, ছাড়ো। ”

তিনি ছাড়লেন না। আরও শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে বললেন,
” না। ”

সে করুণ স্বরে বলল,
” এই বিয়ে আমি করতে পারব না। ”
” তাহলে এখানে এসেছিস কেন? ”
” সয়তানের প্ররোচনায় পড়েছিলাম। এখন মুক্ত হতে চাচ্ছি। ছাড়ো। ”
” বিয়ে সয়তানের ইচ্ছে হয় না। আল্লাহর ইচ্ছে হয়। পৃথিবীতে এর মতো পবিত্র নেয়ামত আর কিছু নেই। ”

সঞ্জয়ানের মন গলছে না৷ সিন্ধান্ত থেকে টলছে না৷ মায়ের হাত ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি শুরু করল। স্বর্ণলতা জানেন ছেলের সাথে জোরের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। হেরে যাবেন। তাই হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন,
” ঐ মানুষটার দিকে তাকা। তার ধৈর্য্য সম্পর্কে নিশ্চয় তুই অবগত? শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ”

মায়ের ইশারা পেয়ে সঞ্জয়ান তাকাল শূভ্রার বাবার দিকে। স্বর্ণলতা বললেন,
” অরুণিমার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটা যত সহজে সামলে নিয়েছেন। তত সহজে কি শূভ্রার বেলায়ও পারবেন? পারবেন না। এক বা’ড়িতে পাথর না ভাঙলেও ফাটল ধরে। দ্বিতীয় বাড়িতে খুব সহজেই ভেঙে যায়। ”

সঞ্জয়ান প্রতিবাদ করল,
” অরুণিমার বিয়ে ভাঙার কারণ আমি নই, মা। সে নিজে। ”
” শূভ্রার বেলায় তো তুই ভাঙছিস। মেয়ের বাড়ি বিয়ে ভেঙে যাওয়া ব্যাপারটি কিন্তু আমাদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না। সারাক্ষণ আঙুল তুলে, খোঁচাতে খোঁচাতে ঘা বানিয়ে ফেলে। ”
” এই বিয়েতে আমার মত নেই। তোমার মনে হচ্ছে না এটা অন্যায়? ”
” না। এই বিয়েটা একজন বাবাকে মৃ’ত্যু মুখ থেকে ফিরিয়ে আনবে। একটি পরিবারকে সুস্থভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আমার মনে হয় না, এত বড় ভালো কাজটা অন্যায়ের তালিকায় পড়বে। ”

এত কিছুর পরও সঞ্জয়ানের মন শান্ত হয় না। বুকের অস্থিরতা থামে না। নিজের সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারে না। সে বিনা বাঁ’ধায় দাঁড়িয়ে পড়ল। অসীউল্লাহ বিপদ অনুমান করে ফেললেন বোধ হয়। চেয়ার থেকে উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
” কী হয়েছে, স্যার? বসতে অসুবিধা হচ্ছে? ”

সঞ্জয়ান নিজের সিদ্ধান্তটা জানানোর পূর্বে অরুণিমার দিকে তাকাল। ঠিক তখনই নজরে এলো শূভ্রাকে। সে বধূ সাজে অরুণিমার পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকি মারছে এদিকে। সঞ্জয়ানের সাথে চোখাচোখি হতে সে হাত উঁচিয়ে একটি লাঠি দেখাল। চোখ রা’ঙি’য়ে, ঠোঁট কা’ম’ড়ে কিছু একটা বিড়বিড় করছে আর মুখ বাঁকিয়ে ইশারা করছে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে। এই সময় তার এই উদ্ধতস্বভাব ও বেয়াদবি আচরণটা সহ্য করতে পারল না। তার মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক পাখার মতো ঘুরতে লাগল একটি কথায়, এই মেয়েকে শায়েস্তা করতে হবে। যেভাবেই হোক, বেয়াদবি ছুটাতে হবে। সে অসীউল্লাহর দিকে চেয়ে বলল,
” না। রাত হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হলে ভালো হয়। ”

তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় কাজীকে বিয়ে পড়ানোর অনুমতি দিলেন। মায়ের আদেশমতো অরুণিমা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ছোট বোনের বিবাহ কার্য সম্পন্ন হলো। বিদায়ের সময় সকলের অগোচরে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল দ্রুতপায়ে।

চলবে

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২৬)

অরুণিমা বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদে এসেছে। একপাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোট বোনের বিদায় কান্না দেখছে। তার চোখেও কান্নার তৃষ্ণা এসেছে। সে পাত্তা দিল না। নিষ্ঠুরের মতো সংবরণ করে নিল। শূকনো চোখজোড়া শুধু র’ক্ত’বর্ণ হচ্ছে ধীরে ধীরে।

” মন খারাপ? ”

হঠাৎ অন্য কারও গলা পেয়ে সে চমকে কেঁপে ওঠে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সচকিত বদনে। অন্ধকারে ডুবে থাকা পুরুষ অবয়বটি অনুরণিত কণ্ঠটির মতোই পরিচিত।

” এগুলো তোমার জন্য। ”

মাইমূনকে চিনতে পেরে তার আ’ত’ঙ্ক কমেছে, ভ’য় দূর হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়টা এখনও কাটেনি। এই সময়ে এই জায়গায় তার উপস্থিতিটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয়।

” ফুলগুলো পছন্দ হয়নি? ”

অরুণিমা বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে তাকাল। দুই হাতের কোষ ভর্তি ঝরা বকুল ফুল। বেশ সতেজ, স্নিগ্ধ। সুগন্ধ ছড়াচ্ছে একটু একটু করে। মাতাল করে তুলছে চারপাশ। মাইমূন মনখারাপের সুরে বলল,
” তোমার পছন্দের ফুলের নাম জানা হয়নি এখনও। তাই এবারও আমার পছন্দের ফুল নিয়ে এসেছি। এজন্য খুবই দুঃখিত। ”

অরুণিমা হাত পাতল। মাইমূন ফুলগুলো তার হাতে দিতে দিতে বলল,
” জানো তো, ফুল ও মনখারাপ দুটোর একসাথে থাকতে নেই? ”

সে উত্তর দিল না। উদাস চোখে তাকিয়ে আছে দূরের রাস্তাটায়। যেদিক দিয়ে মাত্রই শূভ্রা ও সঞ্জয়ান একই গাড়িতে চড়ে চলে গেছে। মাইমূনও তাকাল সেদিকটায়। পরক্ষণে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল নিজের ভালোবাসার মানুষটির দিকে। বলল,
” এমনি এমনি ফুল নিতে হয় না। এতে তাদের সৌন্দর্যের অপমান করা হয়। ভালোবাসা, এই ফুলগুলোর বিনিময়ে আমি কী পাব? ”

অরুণিমার দৃষ্টিও ফিরে এলো। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি রাখলে সে পুনরায় বলল,
” আমার চাওয়ার সুযোগ থাকলে তোমার মনখারাপটা চাইব। এতে কিন্তু তোমারও লাভ। ফুল ও মনখারাপ একসাথে থাকতে পারবে না। ”

মাইমূন খালি হাত জোড়া নিয়ে আঁজল আকারে অরুণিমার মুখের সামনে এমনভাবে ধরে আছে যেন, তার মুখ থেকে মনখারাপ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে! অরুণিমা এই অদ্ভুত প্রেমবাচন, দরদ আচরণে মুগ্ধ হতে পারছে না। খুব একটা গুরুত্ব দিল না। তার মন ও মস্তিষ্কে দুটো কথায় ঘুরপ্যাচ খাচ্ছে। প্রথমটা শূভ্রার বিয়ে হয়ে গেছে, এ বাড়ি ছেড়ে চলেও গেছে অথচ কেউ তার খোঁজ করেনি। আপন পরিবার থেকে কি সে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে? দ্বিতীয়টা এত রাতে এখানে মাইমূন কী করে এলো? সে কী করে জানল, অরুণিমা ছাদে আছে। তার মনখারাপ। প্রথমটার উত্তর এখন না পাওয়া গেলেও দ্বিতীয়টা পাওয়া সম্ভব। মাইমূনকে প্রশ্ন করলেই পেয়ে যাবে। কিন্তু তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একেবারেই না। এমন নীরব, চুপচাপ থাকতে ভালো লাগছে।

” মনে হচ্ছে, কারণ না জানলে মনখারাপ দূর হবে না। অরুণিমা, কী হয়েছে আমাকে বলবে? ”

অরুণিমার হালকা দৃষ্টি এবার গাঢ় হতে বাধ্য হলো। মাইমূন তাকে সচরাচর ভালোবাসা বলেই ডাকে। অরুণিমা নামে আগে ডেকেছিল নাকি মনে নেই কিংবা আজকের মতো খেয়াল করে শুনেনি। সে ভালো করে সামনের মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। চোখদুটিতে পাহাড়ের মতো নিটোল গাম্ভীর্য, প্রবৃত্ত। কিছু একটা অর্জন করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।

” আমি জানি, আজ শূভ্রার বিয়ে হয়েছে। মনখারাপটা এই কারণে নাকি অন্য কিছু? ”

মাইমূন কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ব্যাকুল স্বরে সুধাল,
” আংকেলকে আমার ব্যাপারে বলেছ? তিনি কি আরও রেগে গেছেন? ”

অরুণিমার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শুরু থেকেই মাইমূনকে তার বাবা পছন্দ করেনি। সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়ার কোনো লক্ষণও দেখতে পারছে না। এরমধ্যে যদি মাইমূনের জন্ম ইতিহাত তুলে ধরে তাহলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। যে মুঠো পরিমাণ আশা নিয়ে চলাফেরা করছে সেটাও হয়তো আর থাকবে না। মাইমূন উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠল। খানিক অভিমানি সুরে প্রশ্নটা করল,
” তুমি কি এমন চুপই থাকবে? কিছু বলবে না? ”

অরুণিমা চোখের পলক ফেলল। মুখটা সরিয়ে নিল অন্যপাশে। একটু বামে সরে গিয়ে আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মাইমূন নিজ জায়গা থেকে নড়ল না। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
” আসছি। কথা বলতে ইচ্ছে হলে কল করো। ”

তার কণ্ঠ ভার, শীতল। বাক্যভাবে হতাশা, অবসন্ন। ধীর পদক্ষেপে ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার দরজাটার নিকটে গিয়ে পৌঁছাল। নিচে না নেমে আচমকা পেছন ফিরে ডাকল,
” ভালোবাসা? ”

অরুণিমা চমকে তাকাল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখলে সে জিজ্ঞেস করল,
” তোমাকে ‘ ভালোবাসা ‘ নামে ডাকি কেন, জান? ”

সে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে মাথা দুপাশে নাড়ল। মাইমূন দূর হতে মৃদু হেসে বলল,
” কারণ, তুমি হলে আমার ছোট্ট হৃদয়ের সবটা ভালোবাসার একমাত্র মালিক। যার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারিনি, কেউ নিতেও পারেনি। এ আমার দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য আজও বুঝতে পারিনি। বুঝার দায়িত্ব তোমাকে দিতে চাই। ভালোবাসা, দায়িত্বটা নিয়ে আমার ভাগ্যটাকে নির্ণয় করে দেও। ”

তার এই আকুল আবেদন, হৃদয় বিদারক প্রার্থনায় অরুণিমার বোবা ভাব কাটিয়ে দিল। নিশিরাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মতো জড়িয়ে ফেলল গভীর মায়ায়। নিজস্ব চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
” আরেকটু আমার কাছে থাকুন। ”

মাইমূন দৌড়ভঙ্গিতে তার পাশে এসে দাঁড়াল। চাঁদের জোসনার মতো চোখ ও ঠোঁটে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে। মিষ্টি হেসে মুক্ত স্বরে বলল,
” আর একটু না সারাক্ষণ তোমার কাছে থাকতে চাই। এই নিয়ে আমার মধ্যে বিরক্ত কিংবা অনিহা খুঁজে পাবে না কখনও। ”

বাক্যদুটোতে ভীষণ আবেগ, অনুভূতির প্রাবল্য। অরুণিমা টের পেল, তার মানব-চর্মের ফাঁকে ফাঁকে শিলাবৃষ্টির মতো তুমুল বেগে কিছু একটা পতিত হচ্ছে। শিউরে ওঠা শরীরটাকে দুই হাতে বেঁধে নিল। মাইমূন ব্যস্ত স্বরে সুধাল,
” শীত করছে? চাদর এনে দেব? ”

অরুণিমা এক ঝলক তাকিয়ে দৃষ্টি নিচু করে ফেলল। মাথা দুলিয়ে না বলতে সে পুনরায় বলল,
” এভাবে চুপ করে থাকলে থাকি কী করে? আমার খারাপ লাগে। মনে হয়, তুমি বিরক্ত হচ্ছ। ”

অরুণিমা দৃষ্টি উঁচু করল। সুধীর গলায় বলল,
” মাঝে মাঝে চুপ করে থাকার মধ্যেও স্বস্থি থাকে, আরাম পাওয়া যায়। তুমি কি চাও, আমি সেই স্বস্থি ভেঙে কথা বলি? ”
” সেরকম হলে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমি নাহয় তোমার নীরবতার সঙ্গী হয়ে থাকি। ”
” বাইরে হাঁটতে যাব? ”
” অবশ্যই। এসো। ”

মাইমূনের পেছন পেছন সেও ছাদ থেকে থেমে রাস্তায় এলো। এক কিনার ধরে চুপচাপ হাঁটল অনেক্ষণ। অরুণিমা যত সামনে এগুচ্ছে ততই যেন মাইমূনের উপস্থিতিটাকে ভুলে যাচ্ছে। মন ও মস্তিষ্ক দখল করে নিয়েছে সঞ্জয়ান ও শূভ্রার বিবাহের মুহূর্তটা। যে মানুষটা তাকে বিয়ে করতে এসেছিল সেই মানুষটা আজ তার ছোট বোনের স্বামী। হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলের কারণ কী হতে পারে? প্র’তি’শো’ধ?

” আর সামনে যাওয়া কি ঠিক হবে? বারোটা পার হয়ে গেছে। আংকেল-আন্টি নিশ্চয় খুব চিন্তা করছেন। ”

অরুণিমা থেমে গেল। মাইমূনের দিকে চেয়ে আছে। নিষ্পলক চাহনি। মুখমন্ডলে মেঘের আবির্ভাব। ইচ্ছে হলো বলতে, বাসায় তার জন্য কেউ চিন্তা করছে না। চিন্তা করার মতো যে একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল সেটি ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু বলা হলো না। নিরুত্তরে পা ঘুরিয়ে নিল ফেরার পথে। মাইমূন তাকে অনুসরণ করতে করতে একদম বাসার নিকটে এসে গেছে। মূল ফটকে ঢোকার পূর্বে বলল,
” অনেক ভেবে দেখলাম, সেদিন তোমাদের বাসায় আমার আসা উচিত হয়নি। ভাং’চু’র করাও খুব অন্যায় হয়েছে। আমি ভীষণ লজ্জিত ও অনুতপ্ত। তোমার বাবার কাছে কি ক্ষমা চাইব? ”

অরুণিমা ভেতরে ঢুকল। একটুক্ষণ নীরবে ভেবে বলল,
” আগে আমি ক্ষমা পাই, তারপরে তুমি চেষ্টা করো। ”
” আচ্ছা। ”

মাইমূনও ভেতরে ঢুকল। অরুণিমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
” সেই খারাপ মুহূর্তের মাঝেও একটি আনন্দিত মুহূর্ত ছিল। কী জানো? ”
” কী? ”
” তোমার ‘ আপনি ‘ থেকে ‘ তুমি ‘ তে নেমে এসে আমাকে গ্রহণ করা। ”

কথা বলতে বলতে দুজনে সামনে এগুচ্ছে। অরুণিমাদের ফ্ল্যাটের সামনে আসতে দুজনে থমকে গেল। অসীউল্লাহ দরজা মেলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখে সে ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। মাইমূন পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। এই সময় অরুণিমার স্মরণ হলো, মাইমূন এই বাড়ির ছেলে।

___________
শূভ্রাকে নিয়ে বাসায় আসার পর বিস্ময়ের অন্ত খুঁজে পাচ্ছে না সঞ্জয়ান। তার রুমে ফুল ও বেলুন দিয়ে সাজানো। বিছানায় সাদা চাদর, মধ্যখানে গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো-ছিটানো। সে ভেবেই পাচ্ছে না এত অল্প সময়ে বাবা-মা এত কিছু করল কখন!

” আমি বাড়ি যাব। এখনই যাব। ”

কাঁদতে কাঁদতে কথা দুটি বলেছে শূভ্রা। সঞ্জয়ান বিছানা থেকে নজর নামিয়ে আনল মেঝেতে। শূভ্রা এখানে বসে কাঁদছে। পরনের শাড়ি, গয়না ঠিক স্থানে নেই। পুরো মুখ, গলা ও বুকের একঅংশ ভিজে গেছে চোখের পানিতে। ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে আর নাক টানছে। তার এত মায়া লাগল! চাহনি বদলে গেল সহানুভূতিতে। বেদনা ও দরদ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। বয়সের মাপে মেয়েটি তার থেকে অনেকটাই ছোট, কথাটা পূর্বেই অবগত ছিল। এখন যেন, বয়সটা আরও কমে এসেছে। কিছুতেই স্বীকার করতে পারছে না এই মেয়েটি তার বিবাহিত স্ত্রী। সারা জীবনের সাথী। জেদের বশে পড়ে একি করল! এমন একটা ভুলে জড়িয়ো পড়ল যা শোধরানোর সুযোগ ও সময় কোনোটায় পাবে না। অনুতাপে সঞ্জয়ানের বুকের ভেতরটা পুড়ছে। মাথার ভেতরটা ঝিমিয়ে আসছে। চিন্তা-ভাবনার শক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। হাত-পা হয়ে আসছে অসাড়। সে দরজার নিকটেই দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে এগুতে পারল না আর। তার এই অনুভূতিশূন্য অবস্থায় শূভ্রা দৌড়ে এলো। সঞ্জয়ানের কলার চেপে ধরে বলল,
” আপনি এটা কেন করলেন? কেন? আমি আপনাকে ছাড়ব না। ”

তার কণ্ঠে একই সাথে তীব্র ধ’ম’ক, শা’সা’নি। সঞ্জয়ান রা’গ করতে চেয়েও করল না। ঠাণ্ডা স্বরেই বলল,
” শূভ্রা ছাড়ো। এ ধরনের ব্যবহার আমার পছন্দ নয়। ”

সে ছাড়ল না। আরও শক্ত করে চেপে ধরল। চিৎকার করে বলল,
” না ছাড়ব না। আপনাকে মে’রে ফেলব। ছোটলোক, বদমাশ, লুচ্চা, বুইড়া ব্যাডা। মেয়ে মানুষ দেখলে শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে। প্রথমে আপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তা না করে আমাকে কেন করলেন? কচি মেয়ে দেখেই মাথাটা বিগড়ে গেছে, তাই না? ”

বলতে বলতে সঞ্জয়ানের হাতের কনুইয়ের উপর কা’ম’ড়ে দিল। একবার, দুই বার। তিন বারের সময় বাঁধা পেল। সঞ্জয়ান তার মাথা হাত দিয়ে ধরে পেছনে ধা’ক্কা মেরে বলল,
” পাগল হয়ে গেছ নাকি? কা’ম’ড়াচ্ছ কেন? ”
” হ্যাঁ, পাগল হয়ে গেছি। আপনি আমাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছেন। ”

উত্তর দিয়ে সে দরজার দিকে ছুটল। বাইরে বেরুতে বেরুতে বলল,
” আপনার সাথে থাকব না। কখনও না। আমি এখনই বাড়ি চলে যাব। এখনই। ”

সে ছুটতে চাইলেও পারল না। সঞ্জয়ানের হাতে বাঁধা পড়ে গেল। ভেতরে টেনে আনল জোর করে। দরজায় খিল টেনে বলল,
” তোমার সাথে একঘরে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। চুপচাপ বসো, মাথা ঠাণ্ডা করো। আমি একটা উপায় বের করছি। ”

চলবে