#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
৬.
সপ্তাহের পাঁচদিনের ব্যাস্ততায় টাউনে যেমন শব্দদূষন হয় তেমনিভাবে ছুটির দিনে থাকে শান্ত, শব্দহীন, নীরব। সেদিন কর্মজীবী মানুষদের সকাল শুরু হয় বেলা এগারোটায়। বাচ্চারাও নিজেদের মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার জন্য বেলা করেই ঘুম থেকে উঠে।
হিমাও তেমন। ছুটির দিনে বেলা করেই উঠে। তার উপর গতকাল রাতে সে সিনেমা দেখেছে। চোখ ভরা তার ঘুম।
সাউন্ড বক্সের ডামডাম আওয়াজ হিমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। সে বালিশ কানের উপর রেখে ঘুমুতে চেষ্টা করে। অতি উচ্চ আওয়াজে তার চেষ্টা বিফলে যায়। শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে আওয়াজের উৎস কেথায় তা বুঝতে চেষ্টা করে। হিমার কম্পিউটার সাউন্ড বক্স সব নিজের ঘরেই থাকে। অন্যঘরে সাউন্ড সিস্টেম নেই। হিমার সর্বপ্রথম কম্পিউটারের টেবিলের দিকে নজর যায়। কাঙ্খিত স্থানে কম্পিউটার না পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘর থেকে বের হয়ে যায়। হিমার ঘর থেকে সামন্য এগিয়েই মেহমানদের থাকার ঘর। সেখান থেকেই সাউন্ড বক্সের আওয়াজে আসছে। ভালো গান হলেও মনকে বুঝানো যেতো। হিমার সবচেয়ে অপছন্দের গান বাজছে। মূলত এই কারণেই হিমার মাথার মস্তিষ্কের আগুন টগবগ করে জ্বলছে। সে গেস্ট রুমের দরজা জোরে খুলে দেখে মীর ফুল ভলিউমে সাউন্ড বক্স ছেড়ে নিজেই কানে হেডফোন দিয়ে কারো স্কেচ আঁকছে। মীরকে এই সময়ে এভাবে দেখে হিমা হতভম্ব হয়ে যায়। মীরের কাছে এসে কান থেকে হেডফোন খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলে,“ গান বন্ধ করো, মীর ভাই!”
মীর গান বন্ধ করে না বরঞ্চ কম্পিউটারের কাছে গিয়ে হিমার অপছন্দের আরেকটা গান ছেড়ে দিয়ে নিজেও গাইতে থাকে,
হাতে আমার নে’শা’র বোতল
চক্ষু দুইটা লাল
কার ঠোঁটের আজ পরশ পাইয়া
হয় প্রিয়ার সকাল
হিমা রাগে কান চেপে ধরে জোরে চিৎকার দিয়ে আবারো বলে,“ আমার ঠোঁটে কারো পরশ পরেনি,মীর ভাই! তুমি এই গান বন্ধ করো!”
মীর সাথে সাথে গান বন্ধ করে দেয়। গলা তার শুকিয়ে গেছে। হিমাকে জ্বালাতে এসে সে-ই ভেতরে জ্বলে যাচ্ছে।
টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি ঢকঢল করে পান করে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে। হিমা নির্বিকার চিত্তে মীরের কাণ্ড দেখে কাছে এসে বলে, “ আরেক গ্লাস পানি এনে দিব, মীর ভাই?”
মীর আহত দৃষ্টিতে হিমার দিকে তাকায়। কম্পিউটারে একটি সফট গান ছেড়ে বলে, “ তুই তো এখনই আমাকে মে’রে ফেলছিলি হিমা। তোর ঠোঁটের পরশ সম্পর্কে কী আমি একবারও জিজ্ঞেস করেছি?”
“ তোমার কি সব কথা মুখে বলতে হয় নাকি মীর ভাই। তোমার আচরণেই তো সব কথা বুঝিয়ে দাও।”
মীরের মনে এবার দুষ্টুর রাজা ভর করে সে হিমার আরেকটু কাছে এসে বলে, “ আমি তো এবার কিছুই করিনি, তবুও তুই তোর ঠোঁটের বিশ্লেষণ করে দিলি! কিন্তু তোর ঠোঁটের টেষ্ট কেমন তা তো বললি না, হিমালয়!”
মীরের কথা শেষ হতেই হিমার হাত আপনাআপনি তার ঠোঁটে চলে যায়। আলতোভাবে ঠোঁট স্পর্শ করে দূরে সরে যেতে যেতে বলে, “ তুমি আমার দিকে আর একবারও তাকাবে না, মীর ভাই! তোমার নজর খারাপ হয়ে গেছে। তোমার জন্য ঐ রিপ্তীই ঠিক আছে।”
রিপ্তীর কথা বলতোই মীরের চিঠির কথা স্বরণে আসে। তার আসার মূল উদ্দেশ্যই তো ঐ চিঠি। হিমা চলে যাচ্ছিল। মীর তাকে উচ্চ স্বরে ডাকে, “ দাঁড়া হিমালয়!”
হিমা দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু মীরের দিকে ফিরে তাকায় না। উল্টো হয়েই উত্তর দেয়,“ ফিরতে ডাকতে হয় না তা তুমি জানো না মীর ভাই! শুনেছি অমঙ্গল হয়।”
“ কুসংস্কার কথা বলবি না, হিমালয়। চিঠিতে কি কি লিখেছিলি, মুখস্ত বল। এক লাইন এদিক সেদিক হলে তোর এই ছবি আমি সবাইকে দেখিয়ে দিব।”
হিমার সামনে তার অগোছালো একটি ছবি ধরে মীর। যেখানে হিমা ঘুমের মধ্যে হা করে ঘুমাচ্ছে। মীর তা কম্পিউটার আনার সময় তুলেছিল। হিমা তা দেখে কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা। সে কোনরকম নাক টেনে প্রশ্ন করে, “ সবটাই বলতে হবে, মীর ভাই? আমি তো মুখস্থ করিনি।”
মীর একটি চেয়ার টেনে উলটো করে সিরিয়াস মুডে তাতে বসে। মীরের ভাবসাব দেখে হিমা বুঝতে পারে আজ সে বাঘের খপ্পরে পরেছে এর থেকে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। সে মনে মনে ফন্দি আঁটে কীভাবে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। এদিকে মীর এক দৃষ্টিতে হিমাকে দেখছে। ভ্রূ জোড়া উঁচু নীচু করে সে কোন ফন্দি করছে। ফোলা ফোলা চেহারায় ঘুমন্ত ভাব বিরাজমান। পরিধানে শোয়ার পোশাক কাঁধে একটা ওড়না জড়ানো। মীরকে শায়েস্তা করতে নিশ্চয়ই তাড়াহুড়ায় পরে এসেছে! হিমার মাথার চুল কোমড় পর্যন্ত একদম স্ট্রিট নয় সামান্য আঁকাবাকা। মীরের ঐ কেশব খুব পছন্দের। ঢেউ খেলানো চুলে তো মাঝে মাঝে লাল গোলাপ পরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার। হিমাকে দেখতে দেখতে মীরের নেশা ধরে যাচ্ছে। হৃদয়ের যন্ত্রটা দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। মীর আস্তে করে বুকের বাম পাশটায় হাত রাখে। অনুভব করে হৃদয়ের অস্থিরতা। হিমা অনেকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বলে, “ তুমি কি আমাকে ভালোবাসো, মীর ভাই?”
মীর স্তব্ধ বনে যায়। উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই গেস্ট রুমে আশা প্রবেশ করে। হিমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, “ ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়ে গেছে তোর পাকনামি? মীর কখন থেকে এসে বসে আছে, চা নাশতার কথা জিজ্ঞেস না করে বকবক করছিস! ফ্রেস হয়ে নিচে যা।”
হিমা ঘর থেকে বের হতে নারাজ। সে আশার কথা উপেক্ষা করে বলে, “ মা, মীর ভাইয়ের থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর শুনেই চলে যাবো। তুমি তাকে বলো, বলতে।”
আশা বিছানায় বসতে বসতে শুধায়, “ কোন প্রশ্নের উত্তর দিবে? হ্যাঁ রে মীর!”
মীর থতমত খেয়ে যায়। হিমাকে চোখ রাঙিয়ে ধমকে বলে, “ ঐ কিছু না ফুফু।”
এরপর হিমার উদ্দেশ্যে বলে, “ তোর মতো খচ্চর মেয়ে আমি এই জীবনে আর কোথাও দেখিনি, হিমালয়! ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ না করেই কথা বলছিস? তোর মুখের গন্ধ আমি এখানে বসে থেকে পাচ্ছি।”
হিমা ঠিকই বলে, মীরের কথায় জাদু আছে। সেটা হিমাকে জ্বালানোর জন্য হোক বা অন্য কোনো মেয়ে পটানোর জন্য হোক। মীরের কথা হিমার গায়ে লেগে গেছে। সে ক্ষোভে ক্রোধে হন হন পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে চলে যায়।
আশা মীরের কথায় হাসছে। সে মীরের সাথে কথা বলতে শুরু করে।
——————–
বিকালের অবসর সময়ে হিমেল সাহেব বাচ্চাদের নিয়ে বাহিরে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করে। হিমা এটা শুনে খুব খুশি হয়। আলমারি থেকে বেছে বেছে কালো রঙের থ্রি পিস বের করে। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে চোখে কাজল পরে নেয়। ঠোঁটে ন্যুড কালারের লিপস্টিপ কানে মাঝারি ঝুমকা। ব্যস হিমা তৈরী। হিমেল সাহেব নিচ থেকে হিমাকে ডাকছে। সে আসছি বলে হাত ঘড়ি পরতে পরতে সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামতে থাকে।
মীর সোফায় বসে ফোন ঘাঁটছিল। হাইহিলের খটখট আওয়াজে চোখ তুলে সিঁড়ির দিকে তাকায়। মুহূর্তেই মীরের হার্টবিট বেড়ে যায়। মীর সোফা থেকে না পড়ে গেলেও তার হাত ঠিকই ঢলে পড়ে। হিমা সোজা মীরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাম হাত মীরের সামনে ধরে বলে, “ ঘড়িটা ঠিকমতো লাগিয়ে দাও তো, মীর ভাই!”
মীর এক দৃষ্টিতে হিমার ফর্সা হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ইচ্ছে করছে হিমাকে বলতে, “ আমাকে মে’রে ফেল, হিমালয়! তবুও এভাবে কাছে আসিস না। নয়তো আমি হার্ট অ্যাটাক করব।”
মনে মনে বললেও মীর নিশ্চুপে তার হাত জোড়া এগিয়ে দেয়। কাঁপা হাতে হিমার হাতের বন্ধনীতে হাত লাগায়।
“ তোমার কী কাঁপুনি রোগ আছে নাকি, মীর ভাই! সবসময় এতো কাঁপো কেন? ঔষধ খাও না?”
মীর কাজ শেষ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে। লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে নেশা জড়ানো কণ্ঠে উত্তর দেয়, “ তোরও এই রোগ হবে, হিমালয়! সেদিন তুই আমার কাছে আসবি। আমার মতোই ছটফট করে বলবি, আমাকে বাঁচাও মীর ভাই! আমি আর সইতে পারছি না। আমি সেদিন ঔষধী বলে দিব!”
চলবে ইনশাআল্লাহ………..