আজও বৃষ্টি নামুক পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
344

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৩
_________________

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে প্রিয়তা চোখে মুখে অশেষ বিস্ময়ের ছোঁয়া। শরীর জুড়ে শীত শীত বিষন্নতা, খানিকটা অস্বস্তিতা তার ওপর অচেনা সেই মানুষের চিরকুট আর মোবাইল। প্রিয়তার পাশেই ড্রাইভিং সিটে বসে আছে অপূর্ব। কতক্ষন আগেই প্রিয়তাকে নিয়ে এখানে বসেছে অপূর্ব।’

হঠাৎই গায়ে মোটা কিছুর ভাড় লাগতেই খানিকটা চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকালো প্রিয়তা। অপূর্ব তার গায়ের মোটা কোটটা প্রিয়তার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে। প্রিয়তা কয়েকবার পলক ফেলে তাকালো অপূর্বের দিকে। এরই মাঝে অপূর্ব বলে উঠল,

‘ এভাবে তাকিয়ে থেকো না মেয়ে আমি যেন নিস্তব্ধ হয়ে যাবো।’

প্রিয়তা যেন চমকালো, ভড়কালো, অবাক হলো খুব। বললো,

‘ জ্বী,

হাসে অপূর্ব, প্রান খোলা এক মিষ্টি হাসি দেয় সে। তারপর বলে,

‘ তোমার অসস্থিতা আমি বুঝেছি মেয়ে তাই ওটা তোমায় দিলাম। তবে ভেবো না সবসময়ের জন্য দিয়েছে কাল ভার্সিটিতে নিয়ে আসবে আমি এসে নিয়ে যাবো।’

উত্তরে মাথা নাড়ায় প্রিয়তা। তবে কিছু বলে না।’

অপূর্ব হাসে। আজকে অপূর্ব একাই গাড়ি নিয়ে এসেছিল উদ্দেশ্য তেমন কিছুই ছিল না। তবে মনে মনে চেয়েছিল প্রিয়তার সাথে দেখা হোক তার। সত্যি সত্যি হয়ে যাবে এটা ভাবে নি। অপূর্ব বেশি ভাবলো না গাড়ি নিয়ে ছুটলো দূরে। বৃষ্টির রেশ এখনও অনেক বেশি। রাস্তার দুইপাশে বড় বড় গাছ আর মাঝখানে ভেজালো সরু রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে প্রিয়তা আর অপূর্ব। প্রিয়তা তাকিয়ে আছে অপূর্বের মুখের দিকে। সে সত্যি বুঝচ্ছে না ওই পার্সেলটা কি অপূর্ব পাঠিয়েছে। অপূর্বই হবে কারন এই অচেনা শহরে তার চাচা আর বোন সম্পর্কে অপূর্বই জানে, আর মোবাইল নিয়েও তো আগেরবার কথা বলেছিল অপূর্ব। তাহলে কি অপূর্বই পাঠিয়েছে মোবাইল। প্রিয়তা যখন অপূর্বের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ব্যস্ত ঠিক তখনই হুট করে অপূর্ব তার গাড়ি থামিয়ে দিলো আচমকা এমনটা হওয়াতে খানিকটা চমকে উঠলো প্রিয়তা। বিস্ময়কর চোখ নিয়ে তাকালো সে অপূর্বের দিকে। অপূর্ব জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো তারপর বললো,

‘ কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো প্রিয়তা এভাবে তাকিয়ে থাকো কেন?’

প্রিয়তা লজ্জায় যেন আড়ষ্ট হলো। সে তো তেমন ভাবে তাকায় নি আর অপূর্ব তো গাড়ি ড্রাইভিং করতে ছিল তাহলে বুঝলো কি করে? প্রিয়তা তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা খানিকটা সাহস নিয়ে বললো,

‘ আপনায় একটা প্রশ্ন করবো অপূর্ব?’

অপূর্ব বেশি না ভেবেই বললো,

‘ হুম বলো,

‘ আপনি কি আমায় মোবাইল পাঠিয়েছেন অপূর্ব, সাথে চিরকুট।’

অপূর্ব কি ভড়কালো প্রিয়তার কথা শুনে মোটেও ভড়কালো না উল্টো স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

‘ কিসের চিরকুট?’

প্রিয়তা থমকে গেল তাহলে কি অপূর্ব পাঠায় নি ওগুলো পাঠালে তো এমন প্রশ্ন করতো না। প্রিয়তা জবাব দেয় না কি বলবে বুঝতে পারছে না। অপূর্ব যেন বুঝলো প্রিয়তার অবস্থাটা। গাড়ি স্ট্যার্ট দিতে দিতে বললো,

‘ এতো বেশি ভেবো না মেয়ে। জীবন যেভাবে চলে তাকে সেভাবেই চলতে দেও, বেশি ভেবে হবে কি? যদি মনের অশান্তি এক অচেনা চিরকুটপ্রেরক মিটিয়ে দিতে পারে।’

প্রিয়তা কি বুঝলো অপূর্বের কথার আগামাথাটা ঠিক বোঝা গেল না। কারন সে কোনো প্রশ্ন করে নি।’

অতঃপর নিশ্চুপতার ভিড়েই এগিয়ে চলো প্রিয়তা আর অপূর্ব।’

___

বড়জোর বিকেল ৫ঃ০০টা বাজে। আজ প্রিয়তার স্টুডেন্টটা পড়বে না মায়ের সাথে কোথায় যেন গেছে। গ্র্যান্ডমার কাছে ফোন করে বলেছে। তাই প্রিয়তা আর বের হয় নি বাড়ি থেকে। বর্তমানে নিজের রুমে চুপচাপ শুয়ে আছে প্রিয়তা সামনেই দড়ির ওপর টানিয়ে রাখা অপূর্বের দেওয়া কালো কোটটা। বাহিরে বৃষ্টি কমেছে অনেক আগেই তবে অন্ধকার হয়ে আছে এখনও। প্রিয়তা একা একাই বললো,

‘ অপূর্ব বলেছে কোটটা কাল এসে নিয়ে যাবে তার মানে কাল আবার অপূর্বের সাথে দেখা হবে।’

‘অপূর্বের সাথে দেখা হবে’ কথাটা ভাবলেই কেমন যেন লাগে প্রিয়তার। ভালোও লাগে আবার কেমন কেমন যেন করেও। অনুভূতিরা মাঝে মাঝে বড্ড জ্বালাতন করে প্রিয়তাকে। এক অদ্ভুত ফিলিংস যেটা মাঝে মাঝে নিতে পারে না প্রিয়তা।’

প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎই বিছানার পাশে থাকা প্রিয়তার ফোনটা বেজে উঠলো। প্রিয়তা যেন আচমকাই লাফ দিয়ে উঠলো। ফোনটা দেখলো সে, উপরের নাম্বারটাও দেখলো অচেনা কেউ। প্রিয়তা ফোনটা তুলবে কি তুলবে না ভাবতে ভাবতেই প্রথম কলটা কেটে গেল। সেকেন্ডবার ফোনটা বাজতেই প্রিয়তা ফোনটা তুললো। খুব নমনীতার সাথে বললো,

‘ আসসালামু আলাইকুম কে বলছেন?’

উত্তরে অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটি বলে উঠল,

‘ ওলাইকুম আসসালাম। আমি কে সেটা কি আমার কন্ঠে শুনে বোঝা যায় না মেয়ে?’

প্রিয়তা ভয়ংকরভাবে চমকে উঠলো,চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল মুহূর্তেই। এটা তো অপূর্বের গলা। তার মানে অপূর্বই ফোনটা পাঠিয়েছে প্রিয়তাকে। প্রিয়তা বেশি না ভেবেই বললো,

‘ তাহলে আপনি ফোনটা পাঠিয়েছেন অপূর্ব?’

হাল্কা হাসে অপূর্ব। বলে,

‘ এখনও সন্দেহ হচ্ছে বুঝি।’

অপূর্বের কথা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো প্রিয়তা। বললো,

‘ তাহলে তখন জিজ্ঞেস করার সময় বলে নি কেন? না জানার ভান কেন করলেন?’

আবারও হাসে অপূর্ব। বলে,

‘ কি জানি সত্যি ভান করেছিলাম বুঝি আমার কেন মনে পড়ছে না।’

চোখ বন্ধ করে ফেলে প্রিয়তা। এ ছেলে তো বড্ড ত্যাড়া। প্রিয়তা নিজের চোখ খুলে জবাব দেয়,

‘ ফোন গিফট কেন করলেন?’

উত্তরে ফটাফট জবাব অপূর্বের,

‘ ভালো লেগেছে তাই।’

‘ আর চিরকুট?’

‘ ওটা তো তোমায় বিপাকে ফেলার জন্য। You may not know আমার আবার মানুষকে বিপাকে ফেলতে বেশ লাগে।’

প্রিয়তা যেন চরম ভাবে ভড়কালো এ ছেলে বলে কি মানুষকে বিপাকে ফেলতে নাকি বেশ লাগে। প্রিয়তা কি ভেবে যেন বলে উঠল,

‘ আপনার কি মাথা ঠিক আছে অপূর্ব?’

স্বাভাবিক জবাব অপূর্বের,

‘ আগে ঠিক ছিল কিন্তু এখন নেই।’

অপূর্বের এবারের কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললো প্রিয়তা,

‘ মানে,

উত্তরে একটু কেমন যেন নীরব আর শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো অপূর্ব,

‘ মানেটা আজ থাক অন্য আরেকদিন বলবো মেয়ে।’

প্রিয়তা কি জবাব দিবে ভাবতে ভাবতে বললো,

‘ কেন আজ বললে কি হবে?’

‘ আজ শনিবার আর একজন সুন্দর ভদ্রশদ্র জ্ঞানীগুনী মানুষ বলে গেছে শনিবার কোনো মানের উত্তর দিতে নেই।’

প্রিয়তা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,

‘ কে বলে গেছে?’

উত্তরে হাসতে হাসতে জবাব দেয় অপূর্ব,

‘ মিস্টার তাহসান আহমেদ অপূর্ব।’

এবার না চাইতেও উচ্চস্বরে হেঁসে ফেলে প্রিয়তা প্রান খোলা দাঁত খিলখিল শব্দ করে হেঁসে ফেলে সে। আর প্রিয়তার হাসির শব্দ শুনে ফোনের অপর প্রান্তের থাকা অপূর্ব। বুকে হাত রেখে খুবই ধীর স্বরে বললো,

‘ এভাবে হেঁসো না মেয়ে তোমার হাসিতে আমার বুকটা কেন যেন ব্যাথা করছে আমি নিতে পারছি না।’

কিন্তু অপূর্বের এই অসহায়ত্বের কথাটা প্রিয়তা শুনলো কি, শুনলো না তো উল্টো আরো উচ্চ স্বরেই হাসতে লাগলো সে। সাথে অপূর্বের বুক ব্যাথা বাড়াতে লাগলো।’

শহর জুড়ে অন্ধকারের বিষন্নতা। গাছের বৃষ্টিতে ভেজা পাতাগুলোও বেশ চুপচাপ। পাখিরা তেমন ডাকছে না হয়তো বৃষ্টির ভয়ে লুকিয়েছে কোথাও। পরিবেশ ছুয়ে ঠান্ডা বাতাস বইছে, দরজা সামনে ঝুলে থাকা ধূসর রঙের পর্দাটা নড়ছে। কেমন চুপচাপ পরিবেশ। আর এই চুপচাপের ভিড়েই মুঠো ফোনের ভিড়ে কথোপকথন করছে প্রিয়তা আর অপূর্ব। একজন হাসছে আর একজন বুক ব্যাথায় নড়ছে। ইস!’
____

আজ প্রিয়তাকে ভার্সিটি দিয়ে যেতে আয়মান এসেছে। প্রিয়তা আনতে চায় নি কিন্তু তাও আয়মান এসেছে। বলেছে একা একা বাসায় ভালো লাগছে না তাই এসেছে সে। ভিতরে ঢুকবে না শুধু ভার্সিটির সামনে দিয়েই চলে যাবে। রিকশা করেই এসেছে দুজন। অতঃপর ভার্সিটি আসতেই প্রিয়তা রিকশা থেকে নামলো তারপর বললো,

‘ এবার তবে আপনি বাড়ি যান আয়মান?’

আয়মানও শোনে। রিকশা থেকে নেমে মুচকি হেঁসে বলে,

‘ হুম যাচ্ছি তুমি আগে যাও,

প্রিয়তাও আর ভাবে নি আশেপাশে তাকিয়ে চলে যায় সে ভিতরে। আর আয়মানও কিছুক্ষন প্রিয়তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বলে,

‘ আমার কি তোমায় ভালো লাগতে শুরু করেছে প্রিয়তা?’

আয়মান একা মনে কথাটা আওড়িয়ে চোখের কালো চশমাটা পড়ে রিকশায় চড়ে চললো আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে।’

অন্যদিকে ভার্সিটির পাশ দিয়েই থাকা একটা বড় বটগাছের পিছনে লুকিয়ে থাকা একটা ছেলে বললো,

‘ মেয়েটা কালও কি এই ছেলেটা সাথে ছিল কে জানে। এই বস কখন আসবে কে জানে। লোকটা অলওয়েজ লেট করে।’
____

খুলনাতে নিজের বাড়ির উঠানে বসে আছে প্রিয়তার চাচি শিউলি বেগম। কুলোর মাঝে চাল রেখে বাজছেন তিনি। চোখে মুখে প্রখর রাগ তার। আজ থেকে ঠিক দু’দিন আগে প্রিয়তার সাথে বিয়ে ঠিক করা সেই বুড়োর ছোট ভাই এসে প্রচুর শাসিয়ে গেছে শিউলি বেগমকে। কারন তাদের বলে যাওয়া একসপ্তাহ মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার কথাটা রাখতে পারে নি প্রিয়তার চাঁচি অর্ধেক দিয়েছেন আর বাকি অর্ধেক দিয়ে গয়না গাটি বানানোর কারনে দিতে পারে নি। এর জন্য অনেক কথাও শুনিয়ে গেছে তাকে। শিউলি বেগম শুধু রাগে ফুঁসেছে একবার যদি প্রিয়তাকে হাতের কাছে পেত তাহলে ওখানেই কেটে ফালা ফালা করতেন উনি। বাব-মা মরা মেয়ের এতো তেজ আর সাহস আসে কোথা থেকে?’

হঠাৎই প্রিয়তার চাঁচির ফোনটা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে ফোনটা তুললেন তিনি মতলেব ফোন করেছে। শিউলি বেগম কয়েকটা কড়াকড়া কথা শোনার জন্য ফোনটা তুলতেই অপর প্রান্তে মতলেব বললো,

‘ প্রিয়তার খোঁজ পেয়েছি ম্যাডাম?’

শিউলি বেগমের রিয়েকশনটা ঠিক বোঝা গেল না। এই কথাটা আরো দু’দিন আগে শুনলে বোধহয় বেশি খুশি হতেন তিনি। শিউলি বেগম নিজেকে সামলে বললেন,

‘ কোথায় আছে নবাবের বেটি?’

‘ জ্বী ম্যাডাম ঢাকাতে এখানের একটা ভার্সিটিতে ভর্তিও হয়েছে। সঙ্গে একটা ছেলেও আসে ভার্সিটি দিতে আসতে।’

শিউলি বেগম মতলেবের কথা শুনে রাগী রাগী কন্ঠে বললো,

‘ তার মানে নবাবের বেটি প্রেমিকের জন্য বিয়ের আসর ছেড়ে পলাইছে।’

‘ হতে পারে ম্যাডাম?’

‘ শোন ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রিয়তাকে আমার সামনে এই খুলনাতে চাই।’

উত্তরে মতলবেও বলে,

‘ ঠিক আছে ম্যাডাম।’

মতলেবের কথা শুনে প্রিয়তার চাঁচিও আর কিছু না বলে ফোন কাটলেন। তারপর একা একা আওড়ালেন,

‘ তাহলে এই কারনেই বাড়ি ছেড়ে পালানো হয়েছে প্রিয়তা, একবার সামনে পাই তোকে। তোর ঠ্যাং আমি ভাংবো। তোর জন্য আমার মান সম্মান সব গেছে। আমি এখানে অপমানিত হবো আর তুই বাহিরে পাখনা মেলে উড়ে বেড়াবি তাও নাগরকে সঙ্গে নিয়ে এটা আমি হতে দিবো নাকি।’
___

ভার্সিটি শেষে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। অপেক্ষা করছে সে অপূর্বের জন্য। কিন্তু অপূর্বের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। তবে কি অপূর্ব আসবে না আজ? কিন্তু উনি তো কাল বললো আসবে এখানে তার কোটটা নিতে?’

প্রিয়তার কেন যেন মন খারাপ হলো। মনে মনে বললো,

‘ আপনি কি সত্যি আসবেন না অপূর্ব?’

#চলবে…..

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৪
_________________

বেশ হতাশা ভরা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা অপূর্বের কোটটা আঁকড়ে ধরে। মন বেজায় খারাপ তার কারন অপূর্ব আসে নি। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা কিন্তু অপূর্ব আসছে না। হয়তো আসবেও না। প্রিয়তা আশেপাশে দেখলো তারপর ভাবলো আর দাঁড়ানো ঠিক হবে না তাকে যেতে হবে। প্রিয়তা অপূর্বের কোটটা পুনরায় ব্যাগে ভরে এগিয়ে চললো বাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে মনে মনে আওড়ালো খুব,

‘ আপনি কেন আসলেন না অপূর্ব আমি অপেক্ষায় ছিলাম তো।’

ভেবেই জোরে নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে চলতে লাগলো প্রিয়তা।’

অন্যদিকে বটগাছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মতলবের দলে থাকা একটা ছেলে দেখছিল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা চলে যাচ্ছে অথচ তার মতলেব বসের কোনো খবর নেই। এই লোকটা অলওয়েজ লেট করে। দেখা যাবে বস আসতে আসতে মেয়েটা চলে যাবে। এরই মাঝে সেখানে এগিয়ে আসলো মতলেব সাথে দুটো ছেলে শিহাব আর করিম। মতলেব এগিয়ে এসে বললো সামনের ছেলেটিকে,

‘ মেয়েটা কই আলী?’

ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ঘাবড়ে গিয়ে পিছনে থাকালো খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। আলী মতলেবকে দেখেই উত্তেজিত কন্ঠে বললো,

‘ এতক্ষণে আপনার আসার সময় হলো বস ওই দেখুন মেয়েটা চলে যাচ্ছে।’

বলেই প্রিয়তার যাওয়ার পানে আঙুল দিয়ে দেখালো আলী। আলীর কথা শুনে মতলেবও তাকালো প্রিয়তার দিকে। তারপর আলীর গালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বললো,

‘ মেয়েটা চলে যাচ্ছে আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস হারামজাদা জলদি ধর গিয়ে,

বলেই শিহাব করিমকেও উদ্দেশ্য করে প্রিয়তাকে ধরার কথা বললো মতলেব। মতলেবের কথা শুনে শিহাব ওরাও এগিয়ে চললো প্রিয়তাকে ধরতে। প্রিয়তা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে গেছে।’

এদিকে,

ভার্সিটির কর্নার দিয়ে লুকিয়ে থাকা আরেকটা ছেলে নাম তাহের এগিয়ে গিয়েও যেতে পারলো না। এরা কারা মেয়েটির পিছন পিছন যাচ্ছে কেন। ছেলেটিও কি ভেবে এগিয়ে চললো আস্তে আস্তে ওদের থেকে খানিকটা দূরত্ব নিয়ে বিষয়টা দেখতে হবে তাকে।’

বেশ মন মরা ভঙ্গিতেই এগিয়ে চলছিল প্রিয়তা। এই অপূর্ব ছেলেটা এমন কেন যদি নাই আসার ছিল তাহলে কাল বললো কেন কোট নিতে আসবে আজ? অদ্ভুত ছেলে একটা।’

প্রিয়তা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তেই তার সামনে এসে থামলো একটা গাড়ি। প্রিয়তা বেশি না ভেবেই গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। এরই মাঝে হুট করেই পিছন থেকে প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাকে রুমাল ধরে অজ্ঞান করে ফেললো তাকে। সাথে গাড়িতে তুলে দ্রুত গাড়িতে বসে কোথাও একটা নিয়ে যেতে লাগলো তাকে।’

ঘটনাটা এতটাই দ্রুত ঘটলো যে মতলেবের লোকসহ তাহেরও চমকে উঠলো বিষয়টা কি ঘটলো। মেয়েটাকে কে তুলে নিয়ে গেল?’ তাহের গাড়িটা খেয়াল করেছে গাড়িটা যেন চেনা চেনা লাগলো তার। কতক্ষণ ভাবতেই বলে উঠল সে,

‘ এটা তো অপূর্বের গাড়ি। তার মানে,

ভাবতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল তাহেরের।’

গাড়ি ছুটছে তার আপন গতিতে। সামনেই গাড়ি ড্রাইভ করছে আকিব। আজ সে কতটা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে একটা জ্বলজ্যান্ত হেঁটে চলা মেয়েকে অজ্ঞান করে গাড়ি নিয়ে ছুটছে সে। প্রিয়তা এলিয়ে আছে কারো বুকে। প্রিয়তার জ্ঞানশূন্য চোখ দুটো দেখে বাঁকা হাসলো সে। তারপর আকিবকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘ ওয়েল ডান মাই ফ্রেন্ড। তোমার সাহসীকতা আজ আমায় মুগ্ধ করেছে আকিব।’

আকিব মুচকি হাসলো লুকিং গ্লাসে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ আপনিও না ভাই।’

হাল্কা হাসে অপূর্ব। অপূর্বের হাসি দেখে বললো আকিব,

‘ এবার কোথায় যাবেন ভাই?’

উওরে বেশি না ভেবেই বললো অপূর্ব,

‘ তুমি জানো এখন আমি কোথায় যাবো।’

আকিব হাসে। বলে,

‘ তাহলে যাওয়া যাক ভাই।’

‘ হুম কেন নয়।’

আর কিছু বলে না আকিব ছুটে চলে তাদের গন্তব্যের দিকে।’

প্রিয়তা লেপ্টে আছে, তার পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে আছে অপূর্বের বাহুডোরে। অপূর্ব জানতো আজ প্রিয়তাকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে আর এই তুলে নেওয়া লোকটা যে সেই বাসের লোকটা এটাও বুঝেছিল অপূর্ব। তাই তো এভাবে করে নিয়ে যাওয়া প্রিয়তাকে। যাতে কনফিউশান ওদের মাঝেও থাকবে। অপূর্ব কি ভেবে যেন প্রিয়তার হাতটা ধরলো শক্ত করে। তারপর নিশ্চুপ স্বরে বললো,

‘ আই এম সরি।’
____

বটগাছটার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মতলেবের দলের তিনটা ছেলে শিহাব,আলী আর করিম। মতলেব এদের তিনজনের চেয়েই খাটো তাই বললো,

‘ টুল নিয়ে আয়।’

সঙ্গে সঙ্গে করিম তার ব্যাগে করে আনা টুলটা বের করে দ্রুত রাখলো মতলেবের পায়ের কাছে। তারপর আবারও আগের ন্যায় শিহাবের পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।’

মতলেব চটজলদি টুলটার উপর উঠে সবার থেকে উঁচু হয়ে দাঁড়ালো। তারপর তিনটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘ বিষয়টা কি হলো মেয়েটাকে আমরা ছাড়া আর কে কিডন্যাপ করতে চাইবে।’

উত্তরে শিহাব বললো,

‘ আমরা কেমনে কমু বস?’

শিহাবের কথা শুনে মতলেব চোখ রাঙানো ভাব নিয়ে কাট কাট গলায় বললো,

‘ আর একটু দ্রুত হাঁটতে পারলি না হতছ্যাড়াগুলো।’

এবার করিম মুখ খুললো,

‘ আমরা কি করে বুঝবো বস মেয়েটাকে আমরা ছাড়া অন্যকেউ কিডন্যাস করতে চাইবে।’

‘ এবার ওই মেয়ের চাঁচিরে কি কমু কবি তোরা?’

মতলেবের এবারের কথা শুনে আলী বললো,

‘ এইসব আপনাদের জন্য হইছে বস আর একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারলেন না।’

এবার শিহাব করিম দুজনেই একসাথে বললো,

‘ জ্বী বস সব আপনার জন্য আপনি যদি সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম দিয়া উঠতেন তাহলে আমরাও তাড়াতাড়ি এখানে আসতাম।’

এই বলে করিম, শিহাব, আলী তিনজনই কথা শুনাতে লাগলো মতলেবকে। আর এদের কথা শুনে মতলেব নিজেও হতভম্ব হলো। হয়তো এরা সত্যিই বলছে। আজ সকালে রোকেয়ারে নিয়ে সুইমিংপুলে সাতার কাটছে মতলেব এমনটা স্বপ্ন দেখতে ছিল যার মতলেব দরুন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে তার। রোকেয়া হলো মতলেবে পাশের বাড়ির মোকলেসের ছোট বোইন। সেই ছোডো কাল হইতে মতলেব তারে ভালোবাসে খুব শীঘ্রই বিয়াটাও করবে নিবে। মতলেব এসব ভেবে আফসোসের স্বরে বললো,

‘ ধুরু এবার প্রিয়তর চাঁচিরে কি বলবে মতলেব।’

মতলেবের কথা শেষ হতেই শিহাব বললো আবার,

‘ বস এই রোকেয়া মানে পাশের বাড়ির রোকেয়া আন্টির চাপ্টারটা ক্লোজ করুন নয়তো ওই মাইয়ারে খুইজ্জা পাওয়া লাগবে না।’

এবার মতলেব রেগে গেছে তার রোকেয়ারে ভুলতে বলছে শিহাব। আজকে শিহাব গেছে। মতলেব তার চোখ মুখের ভাব পাল্টালো রাগী গলায় বললো,

‘ তুই কি বললি আমি রোকেয়ারে ভুইলা যামু।’

শিহাব ঘাবড়ে গেল। আয় হায় মুখ ফসকে কি বলে ফেললো সে। কিন্তু সে তো ভুলতে বলে নি জাস্ট চাপ্টার ক্লোজ করতে বলেছে তাও বিয়ে করে। রোজ রোজ ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখার চেয়ে বিয়া করা উচিত না। কিন্তু এই বিয়ার বিষয়টা বসরে কে বুঝাবে।’

শিহাব কিছু না বলেই লাগালো ছুট কারন সে জানে এখন তার মতলেব বস কিছু বুঝতে চাইবে না শিহাব দৌড়াতেই তার পিছন পিছন লাঠি হাতে ছুটলোনমতলেব। তা দশটা না পাঁচটা একটা মাত্র রোকেয়া তাকেও নাকি ভুলতে বলছে শিহাব। আজকে তো শিহাব শেষ।’

‘ তোরে খাইছি শিহাব?’

বলেই ভো দৌড় দিল মতলেব। ওদের দৌড়াতে দেখে আলী করিমও ছুটলো ওদের পিছন পিছন।’

অন্যদিকে,

তাহের ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে মতলেব আর তার সাঙ্গো পাঙ্গোর দিকে। বিড় বিড় করে বললেও সে,

‘ আশ্চর্য! এরা কারা কোত থেকে এলো এরা, এরা নাকি কিডন্যাপার।’

তাহেরের কথা শেষ হতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো ফোনের ওপর লেখা ছিল SA Boss! তাহের উপরের নামটা দেখেই ফোনটা তুললো তক্ষৎনাত। তারপর বললো,

‘ জ্বী বস,

উওরে অপরপ্রান্তে থাকা সাদা পাঞ্জাবি পরিধিত সুদর্শন যুবকটি গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

‘ কাজটা কি হয়েছে তাহের?’

‘ বস আমি কাজটা করতেই আসছিলাম কিন্তু তখন,,

বলতে বলতে এগিয়ে চললো তাহের কতক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সব বললো ফোনের ওপাশে থাকা যুবকটিকে। তাহেরের সব কথা শুনে এস এ নামে সেইভ করা সুদর্শন যুবকটি বললো,

‘ খোঁজ লাগাও তাহের মেয়েটা অপূর্বের কি হয়?’

উওরে তাহেরও বললো,

‘ ঠিক আছে বস।’

ফোন কাটলো এস এ। দুপুরের শেষ ভাগের হাল্কা রোদ্দুরের প্রখর তেজ ছিল তখন। জানালার ধারে থাকা পর্দাদুটো নড়ছিল খুব। এরই মাঝে টেবিলের ওপর থাকা কাঁচের বোতলটা ধরেই দেয়ালে ছুড়ে মারলো এস এ। তারপর কাট কাট কন্ঠে বললো,

‘ কাজটা তুই একদম ঠিক করিস নি অপূর্ব। এর ফল একদমই ভালো হবে না। একদমই না।’
____

আকাশটায় হুট করেই মেঘ জমেছে। অন্ধকারে ভেসে গেছে চারপাশ বাড়ির ছোট্ট উঠান পেরিয়ে সারি সারি গাছের পাতাগুলো নড়ছে খুব, ধুলোতে ভরছে চারপাশ। অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশ দিয়ে। আর দরজার ভিতরেই বিছানায় শুয়ে আছে প্রিয়তা এখনো জ্ঞান ফেরেনি তার। হয়তো আকিব ঔষধের ডোজটা একটুু বেশি দিয়ে ফেলেছে। এই আকিবও না। অপূর্বের বুকের ভিতর দুরুদুরু করছে কাজটা কি ঠিক হলো? কিন্তু না করলেও তো হতো না। প্রিয়তার সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন জাগছে অপূর্বের মনে। প্রিয়তা কে? খুলনার কোথায় থাকে? তার বাবা মা কোথায়? প্রিয়তার চাঁচি যে প্রিয়তার সাথে অন্যায় করছে এটা কি তারা দেখছে না তারা কি বেঁচে নেই? নাকি আছে?’

অপূর্ব যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ঠিক তখনই আকাশ পথ বেয়ে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। অপূর্ব তার ভাবনা থেকে বের হলো। তারপর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে খুব শান্ত গলায় শীতল ভেজা কন্ঠে বললো,

‘ তুমিও না বড্ড বেখেয়ালি,
হুট করে আসো আবার হুট করে চলে যাও।’
বৃষ্টিতে যে আমার ব্যাথা হয় কিছু স্মৃতি মনকে নাড়িয়ে দেয় বোঝো না তুমি। কেন বোঝো না অপূর্ব কাউকে ভালোবেসে তার বিপদ বাড়াতে পারে না। নিজের লাইফ রিস্কের ভিড়ে অন্য কাউকে জড়াতে পারে না। একটা জিনিস কেন বুঝতে চাও না মানুষ নিজের ক্ষতি মেনে নিতে পারে, নিজের আঘাত সামলে উঠতে পারে কিন্তু প্রিয় মানুষের গায়ে একটু আঘাতও বিশাল ঘায়ের যন্ত্রনায় দেয়। ভোগায় অনেকদিন যা সহ্য করা আরও বেশি কষ্টকর। মেনে নেওয়া যায় না।’

অপূর্ব একমনে কথাগুলো বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এমন সময় হুট করেই তার পিছনে এসে দাঁড়ালো প্রিয়তা। মাথাটা চেপে ধরে বললো,

‘ আমায় এভাবে এখানে কেন নিয়ে এনেছেন অপূর্ব?’

#চলবে…..

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৫
_________________

আচমকাই প্রিয়তার ভয়েসটা কানে আসতেই পিছন ঘুরে তাকালো অপূর্ব। তার বিড় বিড় করা কথাগুলো প্রিয়তা শুনে নিল নাকি। যদিও সে বৃষ্টি নিয়ে কথা বলছিল। কিন্তু ভালোবাসা, প্রিয় মানুষ নিয়েও তো কথা বলেছিল। প্রিয়তা কি সেগুলো শুনে নিয়েছে। অপূর্ব তাকিয়ে আছে প্রিয়তার মুখের দিকে, মেয়েটা বোরকা খুলেই বেরিয়েছে বাহিরে পরবে বেগুনি কালারের থ্রি-পিচ, চুলগুলো এলেমেলো ভাবে একপাশে বিনুনি করা, মুখে তেমন সাজ নেই।’

অপূর্বের ভিতর থেকে একটু চিন্তিত ভাব থাকলেও বাহিরে মটেও প্রকাশ করছে না অপূর্ব।’

অন্যদিকে,

অপূর্বকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তা এগিয়ে গেল অপূর্বের দিকে। তারপর আবারও প্রশ্ন ছুড়লো অপূর্বকে,

‘ কি হলো আপনি কথা বলছেন না কেন? আমায় এভাবে এখানে এনেছেন কেন?’

অপূর্ব কয়েক মুহূর্ত প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

‘ তুমি কি জানো প্রিয়তা তোমায় ধরে নিতে তোমার চাঁচি লোক পাঠিয়ে ছিল?’

অপূর্বের আকস্মিক এমন কথা শুনে প্রিয়তার চোখ মুখ যেন বিস্ময়ের ছোঁয়া বয়ে গেল। চোখ দুটো হলো বড় বড়। প্রিয়তা অদ্ভুত এক শব্দ করে বললো,

‘ কি?’

অপূর্ব স্বাভাবিক হলো নিজের ভাবনা থেকে বের হলো নিজেকে সামলালো মুহুর্তেই তারপর শান্ত স্বরে বললো,

‘ বেশি কি কি করবে না খুব টেনশনে আছি।’

অপূর্বের কথায় আরো চমকালো প্রিয়তা। বললো,

‘ মানে?’

‘ মানে কিছুই না শোনো আগামী সাতদিন তুমি বাড়ি থেকে একদম বের হবে না। ভার্সিটি তো একদমই যাবে না। তোমার বোরকার কালার পাল্টাতে হবে, আর চোখে চশমা পড়বে কেমন?’

‘ আপনার কি মাথা গেছে অপূর্ব কি সব ভুলভাল বকছেন।’

হুট করেই অপূর্ব যেন রেগে গেল খানিকটা কড়া কন্ঠে বললো,

‘ যা বলেছি তাই শুনবে মেয়ে, আমার মুখের ওপর কারো কথা বলা আমি পছন্দ করি না।’

প্রিয়তা যেন থমকে গেল এই প্রথম যেন অপূর্বের রাগী লুকিংয়ের সম্মুখীন হলো সে। প্রিয়তা থমকানো স্বরে বললো,

‘ আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন অপূর্ব?’

অপূর্ব নিজেকে সামলালো হুট করেই প্রিয়তার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,

‘ তুমি কেন বুঝতে পারছো না মেয়ে বর্তমানে তুমি সেইভ নও।’

প্রিয়তা থেমে গেল। উত্তরে কিছুই বলতে পারলো না। এই অপূর্ব এমন করছে কেন? হুট করে রেগে যাচ্ছে আবার হুট করেই শীতল হচ্ছে। প্রিয়তা কয়েক মুহূর্ত অপূর্বের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

‘ আপনি কি করে জানলেন অপূর্ব যে চাঁচি আমায় ধরতে লোক পাঠিয়েছে আর আমি তো বোরকা পড়ে থাকি তাহলে ওরা আমায় চিনবে কেমন করে?’

খানিকটা অসহায় ফিল করলো অপূর্ব। প্রিয়তাকে কি করে বোঝাবে কাল বৃষ্টির ভিড়ে যখন তার মুখের নিকাব সরে গিয়েছিল তখনই দূর থেকে একটা ছেলেকে কথা বলতে দেখেছে সে। কেন যেন সন্দেহজনক লেগেছে। পরে ছেলেটার পিছনে লোক লাগাতেই জানতে পারে অপূর্ব ছেলেটি প্রিয়তাকেই ধরতে এসেছে। অপূর্বকে ভাবতে দেখে আবার প্রশ্ন করলো প্রিয়তা,

‘ কি হলো আপনি কথা কেন বলছেন না অপূর্ব?’

প্রিয়তার কথা শুনে অপূর্ব তাকালো প্রিয়তার দিকে, চোখে রাখলো চোখ, চোখের দৃষ্টি করলো শান্ত আর নিস্তব্ধ যেন চোখ দিয়েই কিছু বুঝাতে চাইছে সে। এরই মাঝে হুট করেই বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি বেয়ে গর্জন হলো, অপূর্ব প্রিয়তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো বৃষ্টির পানে। সে তো ভুলেই গিয়েছিল বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে।

অপূর্বের হাবভাব কেন যেন ঠিক লাগছে না প্রিয়তার, সোজাসাপ্টা কথাগুলোর উওর কেন দিচ্ছে না। প্রিয়তা আবারও কিছু বলতে নিবে এরই মাঝে হুট করেই প্রিয়তার ঠোঁটে আঙুল দিল অপূর্ব। তারপর খুবই শান্ত স্বরে বললো,

‘ পাশাপাশি বসে বৃষ্টি দেখবে মেয়ে, আমার না বৃষ্টি খুব পছন্দ চলো একসাথে বসে বৃষ্টি দেখি।’

অপূর্বের কাজ আর কথা শুনে ওখানেই থমকে গেল প্রিয়তা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না সে। আর অপূর্ব প্রিয়তার কোনো জবাব না নিয়েই হুট করেই সামনের সিঁড়ির ওপর বসে পড়লো তারপর প্রিয়তাকেও ইশারায় বললো পাশে বসতে। প্রিয়তাও কোনো কথা ছাড়াই নির্ভয়ে বসলো অপূর্বের পাশে। তাকালো সামনের দিকে, বৃষ্টির তুমুল রেশ তখন, মাটিতে গড়া উঠোনটা বৃষ্টিতে ভিজে হচ্ছছিল টুইটুম্বর। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে এমন। আশপাশের গাছগাছালি সব বৃষ্টির ছোঁয়ায় হচ্ছে ভেজালো। অপূর্বের গুপ্তস্থানের বারান্দাটার সরু রাস্তায় সেজে আছে চারপাঁচটা পাখি হয়তো বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। প্রিয়তা পুরো জায়গাটায় চোখ বুলাতে লাগলো পরিশেষে অপূর্বের দিকে দৃষ্টি রাখতেই অপূর্ব বলে উঠল,

‘ কাল যখন তুমি বৃষ্টির ভিড়ে পড়ে যেতে নিয়েছিলে তখনই একটা ছেলেকে খেয়াল করি আমি, কেন যেন সন্দেহ লেগেছিল ছেলেটিকে কেন লেগেছিল তাও জানি না। তারপর সন্দেহের বসেই ছেলেটাকে ফলো করি দেন জানতে ও সেই বাসে বসে তোমায় ধরতে আসা লোকটার লোক। ব্যস আজ যে তুমি কিডন্যাপ হবে এটা আমি জানতাম তাই তোমায় ওইভাবে নিয়ে আসা। যাতে ওরা কনফিউশানে থাকে, আর মুখটা হয়তো কালই দেখেছিল ওরা। তাই বলছি মিনিমাম আগামী সাতদিন তুমি বাসা থেকে বের হবে না প্রিয়তা, তন্দ্রাবিলাসেই থাকবে চুপচাপ আমার মনে হয় না ওরা তোমার গ্র্যান্ডমার বাড়ি চিনে।’

প্রিয়তা এতক্ষণে বুঝলো বিষয়টা। কিন্তু এবার কি করবে প্রিয়তা তার সেইভটি কিভাবে করবে। চাঁচি যখন জেনেছে সে এখানে আছে তাহলে তো কোনো না কোনো ভাবে তাকে ধরে নিয়ে যাবেই। আর ধরে নিয়ে যদি আবার ওই বুড়ো লোকটার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় না না হুট করেই প্রিয়তা উত্তেজিত হয়ে জোরে শব্দ করে বলে উঠল,

‘ না,

আচমকাই প্রিয়তার মুখে না শব্দটা শুনতেই অপূর্ব বিস্ময়ের স্বরে বললো,

‘ কি না।’

প্রিয়তা থমকে উঠলো। বললো,

‘ আমায় চাঁচি ধরতে পারবে না তো অপূর্ব?’

প্রিয়তার এবারের কথা শুনে অপূর্ব বুঝলো প্রিয়তা ঘাবড়ে গেছে। অপূর্ব প্রিয়তাকে সান্ত্বনা দিতে বলে উঠল,

‘ এত ঘাবড়াচ্ছো কেন মেয়ে, আমি আছি তো। তোমার চাঁচি তোমায় কোথাও নিতে পারবে না।’

প্রিয়তা যেন একটু সাহস পেল, বিশ্বাস করলো মুহূর্তেই। অপূর্ব নামক এই ছেলেটাকে শুরু থেকেই বিশ্বাসের এক উঁচু জায়গায় রেখেছে প্রিয়তা। অপূর্বের কথায় কিছু একটা আছে যা বরাবরই প্রিয়তার মনকে শান্ত করে, নিস্তব্ধ করে, ভালো লাগার এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি জাগায়। প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই অপূর্ব বললো আবার,

‘ আমায় কিছু প্রশ্নের উত্তর দিবে প্রিয়তা?’

প্রিয়তা শান্ত দৃষ্টিতে থাকায় অপূর্বের চোখের দিকে তারপর বলে,

‘ জ্বি বলুন?’

‘ তুমি কিছু মনে না করলে তোমার এই বিষয় সম্পর্কে আমায় কিছু বলো তোমার চাঁচি কেন এমনটা করছে আর তোমার বাবা মাই বা কেন এসব হতে দিচ্ছে ওনারা কিছু বলছে না কেন তোমার চাঁচিকে?’

অপূর্বের কথা শুনতেই নিরদ্বিধায় বলে উঠল প্রিয়তা,

‘ কি করে বলবে ওনারা তো নেই অপূর্ব?’

অপূর্ব চরম বিস্ময়কর কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ নেই মানে?’

প্রিয়তা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো, দৃষ্টি রাখলো বৃষ্টির পানে। তারপর বললো,

‘ ওনারা মারা গেছেন আজ অনেকদিন অনেক বছর হয়ে গেছে। বাবা একদিন হুট করেই এক্সিডেন্ট করে মারা যান বাবার চলে যাওয়াটা মা মানতে না পেরে কয়েকমাসের মধ্যে সেও মারা যান। ব্যস তারপরই থেকে আমি আর আমার বুবু এতিম হয়ে যাই। আর সেই এতিমদের সঙ্গ দিতে আসেন আমাদের চাচা আর চাঁচি। শুরুর দিক থেকে ভালোই চলছিল কিন্তু হুট করেই চাঁচির ব্যবহার পাল্টালো। খুলনা শহরে থাকা আমার বাবার তৈরি বাড়িটা বিক্রি করে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। চাঁচির খুব লোভ আছে টাকার ওপর,টাকার জন্য আমার বুবুটাকে তার থেকে বয়সে অনেক বড় একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমাকেও দিতে চেয়েছিল টাকার এমাউন্টটা ঠিক জানা নেই আমার কিন্তু অনেকগুলো টাকার বিনিময়ে এক ৬০ বছরের বুড়োর সাথে আমায় বিয়ে দিতে চেয়েছিল চাঁচি। আমার ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল আমি নিজের পায়ে দাঁড়াবো বাবার সাহায্য ব্যতীত নিজে কিছু করবো। কিন্তু হুট করে বাবা মা চলে যাওয়ায় আমার সব স্বপ্ন শেষ হতে চলছিল প্রায়। কিন্তু পরে নিজেকে সামলালাম, আমি আমার স্বপ্নে হলাম অটুট টিনশন পড়িয়ে চাঁচিকে লুকিয়ে কলেজ পাস করে এখানের ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিলাম তাই ওইদিন বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছিলাম আমি। কিন্তু দেখুন চাঁচি পিছুন এখনো ছাড়ছে না আমায় খোঁজার জন্য এখনও লোক লাগিয়ে রেখেছে। আমি জানি আমায় ধরতে পারলে আবারও জোর করে বিয়ে দিতে চাইবে। আমায় বাঁচাবেন তো অপূর্ব?’

শেষের কথাটা খুব অসহায় নিয়েই বললো প্রিয়তা। চোখ বেয়ে কখন পানি গড়িয়ে পড়লো বুঝতেও পারে নি সে। অপূর্ব দেখলো সেটা বুকের ভিতর কেমন যেন ছ্যাত করে উঠলো তার। প্রিয়তার চোখের পানি যে একদমই সহ্য হয় না অপূর্বের।

অপূর্ব প্রিয়তার কথা সবই শুনলো মন দিয়ে। মেয়েটার সাথে যা হয়েছে তা একদমই ঠিক হয় নি। অপূর্ব কিছু একটা ভাবলো তারপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ওর দু’গাল চেপে ধরে চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে বললো,

‘ এভাবে কাঁদতে নেই মেয়ে, আমি আছি তোমার পাশে। কেউ কোনো অন্যায় করতে পারবে না তোমার সাথে আর তোমার চাঁচিকে তো আমি দেখে নিবো।’

প্রিয়তা অপূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ কি করবেন আপনি?’

‘ কি করবো দেখি কি করা যায়।’

অতঃপর দুজনের মাঝে আসলো নীরবতা।
দেখতে দেখতে বৃষ্টির বেগ একটু কমলো। সন্ধ্যা হলো, মাগরিবের আযান দিলো,পাখিরা উড়ে গেল, প্রকৃতিরা হলো খানিকটানশান্ত প্রিয়তা অপূর্ব ওখানেই বসে ছিল চুপচাপ। হঠাৎই প্রিয়তা বললো,

‘ আপনি নামাজ আদায় করেন অপূর্ব?’

অপূর্ব জবাবে বললো,

‘ সত্যি বলবো না মিথ্যে?’

‘ সত্যিই বলুন।’

‘ মাঝে মধ্যে পড়ি।’

‘ মাঝে মধ্যে পড়েন কেন রোজ পড়বেন?’

‘ তুমি যখন বলেছো তখন কাল থেকে নিশ্চয়ই পড়বো।’

অপূর্বের জবাবে প্রিয়তা যেন খুশি হলো। বললো,

‘ ঠিক আছে।’

সময় গড়াতে লাগলো, প্রিয়তার খিদে পেয়েছে খুব আজ কি এখানেই থাকবে সে। বাড়ি ফিরবে না। অপূর্বকে কি একবার জিজ্ঞেস করবে সে। প্রিয়তা অনেক ভেবে জিজ্ঞেস করতে নিলো অপূর্বকে। বলতে নিলো,

‘ আমরা কি আজ বা..

আর কিছু বলার আগেই প্রিয়তার কথার মাঝখানে বলে উঠল অপূর্ব,

‘ তোমার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে তাই না প্রিয়তা?’

#চলবে….