#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৬
_________________
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব। উদ্দেশ্য প্রিয়তার জন্য কিছু রান্না করা মেয়েটা যেন সেই কখন থেকে না খাওয়া। অপূর্ব আকিবকে পাঠিয়েছিল প্রিয়তার জন্য কিছু খাবার কিনে আনার জন্য কিন্তু মাঝখানে শুরু এই বৃষ্টি তাই হয়তো আকিব আসতে পারছে না। আকিবের মেঘের গর্জনে ভীষণ ভয়, নির্ঘাত নিরাপদ কোনো জায়গায় গাড়ি থামিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে বসে আছে।’
সন্ধ্যা ছাড়িয়ে গেছে কখন, তাদের এখান থেকে বের হতে হবে। এভাবে তো একটা ছেলে একটা মেয়ে এখানে থাকতে পারে না। তাই অপূর্ব ভেবে নিয়েছে প্রিয়তাকে কিছু খাইয়েই এখান থেকে বের হবে, যদি আকিবটা তার মধ্যে আসে কারন গাড়ি তো আকিবের কাছেই। বাহিরে এখনও অল্প সল্প বৃষ্টি হচ্ছে, পাতা নড়ছে, বাতাস বইছে মন ছুঁয়ে দিচ্ছে বিষয়টা খারাপ না। অপূর্ব তার পুরো রান্নাঘরটায় চোখ বুলালো পরিশেষে ভাবলো ডিমের অমলেট করবে, যেই ভাবা সেই কাজ। অপূর্ব তার গায়ে জড়ানো খয়েরী রঙের শার্টটার হাতাটা কবজির উপরে উঠিয়ে, গ্যাসটা অন করলো কড়াই চাপালো মুহূর্তেই। কাল রাতের দিকে এখানে একবার এসেছিল অপূর্ব আকিব। অনেকটা সময় কাটিয়েছে দুজন। প্রিয়তার কিডন্যাপিংয়ের বিষয়টা নিয়েই ডিসকাস করছিল তারা। কাল আকিব রান্না করছিল। ডিমের অমলেট বানিয়েছিল সাথে পাউরুটি। আর আজ অপূর্ব বানাবে,
অপূর্ব আশেপাশে একবার তাকিয়ে তেলের বোতলটা খুঁজে বার করলো। এরই মাঝে সেখানে হাজির হলো প্রিয়তা। কৌতুহলী এগিয়ে আসলো সে কারন কিছুক্ষন আগে অপূর্ব হুট করেই বসা থেকে উঠে এখানে আসে। প্রিয়তা সামনে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
‘ আপনি এখানে কি করছেন অপূর্ব?’
উওরে অপূর্ব প্রথমে কিছু না বলে তেলের বোতলটার মুখটা খুলে কোড়াইতে তেল দিয়ে পরে বললো,
‘ কিছুই করছি না আচ্ছা তুমি অমলেট খাওয়া পছন্দ করো তো প্রিয়তা?’
প্রিয়তা যেন অবাক হলো, অপূর্বের কাছাকাছি এগিয়ে এসে বললো,
‘ আপনি কি এখন অমলেট বানাচ্ছেন অপূর্ব?’
উওরে অপূর্ব ডিম ফাটিয়ে কড়াইতে দিতে দিতে বললো,
‘ তেমনটাই। তোমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে তাই না?’
অপূর্বের কথা শুনে খানিকটা দ্বিধা সরিয়ে বললো প্রিয়তা,
‘ তা একটু পেয়েছে কিন্তু আপনি, আপনি অমলেট বানাতে পারেন অপূর্ব?’
‘ আমি অনেককিছুই পারি কিন্তু কাউকে বলি না। তুমি চুপ করে বসো আমি তোমার জন্য অমলেট বানিয়ে আনছি।’
অপূর্ব কথাটা শুনলো ঠিকই কিন্তু প্রিয়তা গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো অপূর্বের পাশ দিয়ে এই অপূর্ব তার জন্য অমলেট বানাবে এটা যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
…
ওই সময়ের প্রায় মিনিট পাঁচেক পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে গুপ্তচরের রুমটায় ঢুকতে নিলো আকিব। কিন্তু সেখানেও খেল হোটচ। এই গুপ্তচরের দরজাটা চরম বেয়াদব আকিব যতবার আসে ততবারই হোঁচট খায়। আকিব বেশি না ভেবেই এগিয়ে গেল ভিতরে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে তার এই সব হয়েছে এই বজ্জাত বৃষ্টি আর মেঘের গর্জনের জন্য। আকিব পাউরুটি আর কলা কিনে এনেছে সাথে খাঁটি গরুর দুধ। আকিব এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে আশেপাশে কাউকে দেখছে না কেন?’
আকিব রান্নাঘরের সামনে এসেই আঁটকে পড়লো কারন তার অপূর্ব ভাই একটা মেয়ের জন্য ডিমের অমলেট বানাচ্ছে এটা যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না। আকিব এগিয়ে যেতে লাগলো সামনে,
অন্যদিকে,
ডিমের অমলেট বানানো শেষ হতেই একটা প্লেটে অমলেট রেখে বললো অপূর্ব প্রিয়তাকে,
‘ নেও খাও?’
প্রিয়তা পর পর কয়েকবার পলক ফেলে হাতে নিলো প্লেটটা। কি সাংঘাতিক ব্যাপার অপূর্ব প্রিয়তাকে রান্না করে খাওয়াচ্ছে। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। এরই মাঝে আকিব বলে উঠল,
‘ ভাই?’
চমকে উঠলো অপূর্ব প্রিয়তা দুজনেই। তারা কেউই আকিবকে খেয়াল করে নি। অপূর্ব তাকালো আকিবের দিকে বললো,
‘ তোমার এতক্ষণে আসার সময় হলো আকিব?’
কিঞ্চিত হাসলো আকিব। বললো,
‘ আর বলবেন না ভাই ওই বৃষ্টির জ,,
আকিবের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই বললো অপূর্ব,
‘ হুম বৃষ্টির দোষ দিও না আকিব দোষ তো ওই গর্জনের,,
অপূর্বের কথা শুনে মাথা চুলকে হাসে আকিব। অপূর্বও হাসে। আর প্রিয়তা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে।’
ঘড়ির কাটায় সাড়ে সাতটা ছাড়িয়ে গেছে। গুপ্তচরের আশেপাশের জায়গাটা একটু জঙ্গল জঙ্গল হওয়ায় পুরো রাত নেমে গেছে এমনটা দেখাচ্ছে। কিছুটা ছমছমে পরিবেশ। খাটে বসে খাবার খাচ্ছে প্রিয়তা আর তার সামনেই চেয়ারে বসে আছে অপূর্ব আর খাটের কর্নার দিয়ে আকিব দু’জনের হাতে কফির মগ যেটা আকিব বানিয়েছে।’
খাওয়াদাওয়ার পর্বটা শেষ হলেই এখনই তারা বের হবে এখানে থেকে। বাহিরে বৃষ্টি থেমে গেছে। প্রিয়তা তার খাওয়াটা শেষ করে বললো,
‘ আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে আজ বাঁচানোর জন্য।’
উওরে অপূর্ব কিছু বলে না। তবে আকিব বলে,
‘ ধন্যবাদের কি আছে বোন আমরা আমরাই তো।’
হেঁসে ফেলে প্রিয়তা। বলে,
‘ আপনি খুবই ভালো ভাইয়া।’
প্রিয়তার কথা শুনে শুধু মুচকি হাসে আকিব তবে কিছু বলে না।’
____
রাতের জোৎসা ভরা আলো। আকাশটায় মেঘের ছোঁয়া নেই তাঁরা উঠেছে অনেক। কতক্ষণ আগেও আকাশ পথ বেয়ে যে বৃষ্টি নেমেছিল তা বোঝা যাচ্ছে না। আর এসবের মাঝে গাড়ি করে যাচ্ছে অপূর্ব, আকিব আর প্রিয়তা। আকিব ড্রাইভ করছে, আর পিছনে পাশাপাশি অপূর্ব আর প্রিয়তা বসে। প্রিয়তা জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। খানিকটা চিন্তিত সে, আজ না হয় অপূর্ব ছিল বলে সে বেঁচে গেল কিন্তু রোজ রোজ তো আর অপূর্ব থাকবে না তখন কি করবে প্রিয়তা। এতদূর এসেও শান্তি দিচ্ছে না চাঁচি। আজ খুব করে বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে প্রিয়তা। সেদিন যদি বাবার খুনটা না হতো তাহলে হয়তো আজ তার ভবিষ্যৎটা অন্যরকম হতো বুবুটার কপালেও ওইরকম স্বামী মিলতো না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রিয়তা কোথাও গিয়ে খুব খারাপ লাগা কাজ করছে তার মাঝে।’
প্রিয়তার অবস্থাটা যেন বুঝতে পারলো অপূর্ব। মেয়েটা যে ভালো নেই সেটাও বুঝেছে অপূর্ব। অপূর্বও খারাপ লাগছে। অপূর্ব কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
‘ কিছু কিছু জিনিস নিয়ে বেশি ভাবতে নেই মেয়ে, কেননা বেশি ভাবলে মাথা ঘুরাবে, মাথার তার ছিঁড়ে যাবে তাও ভাবা শেষ হবে না। আর এত ভাবার কি আছে যা ভাগ্যে আছে তাই হবে। সো ডোন্ট ওয়ারি।’
অপূর্বের কথা শুনে প্রিয়তা ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো অপূর্বের দিকে। অপূর্ব তাকালো প্রিয়তার চোখের দিকে। এরই মাঝে প্রিয়তা শীতল ভেজা কন্ঠে বলে উঠল,
‘ ভাবতে কোথায় চাইছে বলুন, ভাবনা তো এমনি চলে আসছে।’
অপূর্ব বেশিক্ষন তাকাতে পারলো না প্রিয়তার চোখের দিকে চটজলদি চোখ নামিয়ে নিলো। তারপর বিড় বিড় করে বললো,
‘ এভাবে হুটহাট তাকিও না মেয়ে, আমার ভিতরটা কেমন যেন করে ওঠে। আমি নিতে পারি না।’
‘ আপনি কি কিছু বললেন অপূর্ব?’
অপূর্ব তার বিড় বিড় করা থামালো। তারপর মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো,
‘ না কি বলবো কিছুই বলার নেই আপাতত।’
অপূর্বের কথা শুনে প্রিয়তাও চুপ হয়ে যায় আর কিছু বলে না। প্রিয়তা পুনরায় বাহিরের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে,
‘ আজ আমি আপনার চোখে কিছু দেখেছি অপূর্ব, কিন্তু সেই কিছুর মাঝে ঠিক কতটুকু সত্য আছে সেটা আপনি ছাড়া কেউ জানে না। আপনি কি আমায় নিয়ে খুব ভাবেন অপূর্ব? ভাবেনই হয়তো নয়তো এভাবে হেল্প করতেন নাকি। কিন্তু আমায় নিয়ে কেন ভাবেন অাপনি? তবে কি আপনার মনে আমার জন্য কিছু আছে অপূর্ব, যেমনটা আমি আপনাতে ফিল করি।’
প্রিয়তা ভাবলো না, মাঝে মাঝে কিছু অনুভূতি গোপনে রাখাই উত্তম। যেখানে সে অসহায় ধরতে গেলে।’
আনমনেই কথাগুলো ভাবলো প্রিয়তা।’
আর এদিকে অপূর্ব,
‘ তুমি হয়তো জানো না মেয়ে আমি নিজ অজান্তে তোমায় মন দিয়ে বসে আছি। ভালোবাসি তোমায়, তোমার ক্ষতি হলে আমি যে সেটা নিতে পারবো না। বর্তমানে এমনই একটা পর্যায় চলছে যে আমি চাইলেও তোমায় আমার বানাতে পারবো না। কারন আমার জীবনটা যে অনিশ্চিত। আর আমি চাই না আমার এই অনিশ্চিত জীবনে তোমায় জড়িয়ে তোমার জীবনটা নষ্ট করতে। কিন্তু ধীরে ধীরে কেমন যেন তোমায় ছাড়া থাকতেও আমার খারাপ লাগছে, তোমার প্রতি জড়ানো অনুভূতিগুলো বার বার আঘাত করছে। আমার কি করা উচিত একটু বলতে পারো?’ আমি তোমায় চাই আবার চাই না। তোমায় ভালোবাসি আবার হয়তো বাসি না।’
অপূর্ব নিজেকে সামলালো সে কি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে, মটেও না অপূর্বকে ইমোশনাল করা এত সহজ নাকি। তাও আবার একটা মেয়ে নিয়ে, অপূর্ব বার বার কয়েকবার নিশ্বাস ফেলে নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখতে লাগলো। এভাবে বসে থাকলে প্রিয়তা নামক রমনী প্রচুর জ্বালাবে তাকে।’
অপূর্ব ফেসবুক নিউজফিড ঘুরতে ঘুরতে একজন এড ফ্রেন্ডের নাম দেখলো। নামটা ছিল এমন,
‘ আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি’
অপূর্ব দেখলো নামটা পরক্ষণেই পাশ কাটিয়ে চলে গেল আবার। একজন সুদর্শন যুবকের ছবি ছিল সেখানে, সাদা পাঞ্জাবি, মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চোখে চশমা আর গলায় একটা চেইন।’
____
তন্দ্রাবিলাস থেকে খানিকটা দূরত্বে গাড়ি থামালো আকিব। গাড়ি থামতেই প্রিয়তা নেমে পড়লো। প্রিয়তা নামতেই অপূর্বও নামলো। এখানে বেশ অন্ধকার, সাথে মানুষের আনাগোনাও খুব কম। প্রিয়তা অপূর্ব আর আকিবকে আবার ধন্যবাদ জানালো। বললো,
‘ আমাকে এত সাহায্য করার জন্য আবারও ধন্যবাদ দিচ্ছি আপনাদের।’
অপূর্ব মুখোমুখি দাঁড়ালো প্রিয়তার বললো,
‘ ধন্যবাদ শব্দটা দূরে রাখো মেয়ে আর আমার কথা শোনো আগামী একসপ্তাহ এখান থেকে বের হবে না প্রিয়তা যদি দেখি বেরিয়েছো তাহলে তো বোঝোই আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। তোমার হয়তো আমার খারাপ হওয়ার বিষয়টা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা নেই। তাই সাবধান!’
অপূর্বের কথা শুনে প্রিয়তা অবাক হলো। বিলম্বিত কন্ঠে বললো,
‘ এভাবে থ্রেট দিচ্ছেন কেন, ঠিক আছে বের হবো না।’
অপূর্ব খুশি হয় প্রিয়তার কথা শুনে। বলে,
‘ দাট’স লাইকে গুড গার্ল।’
হাল্কা হাসে প্রিয়তা তারপর একটু চিন্তিত স্বরেই বলে,
‘ এক সপ্তাহ পর সব ঠিক হয়ে যাবে তো অপূর্ব?’
অপূর্ব অনেকক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবে তারপর বলে,
‘ বেশি ভেবো না আমি আছি তো সঙ্গে ইনশাআল্লাহ সব ঠিক করে দিবো। তবে কথা কিন্তু একটাই আগামী একসপ্তাহ কোথাও বেরিও না প্রিয়তা।’
প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ ঠিক আছে।’
‘ হুম এখন যাও, ভিতরে গিয়ে আমায় একটা মেসেজ করো।’
উওরে মুচকি হেঁসে বলে প্রিয়তা,
‘ আচ্ছা।’
অতঃপর প্রিয়তা চলে যায়। প্রিয়তা চোখের আড়াল হতেই অপূর্বও আর না দাঁড়িয়ে গিয়ে বসে গাড়িতে তারপর আকিবকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ চলো আকিব,
আকিবও আর কিছু না বলে গাড়ি স্ট্যার্ট দিয়ে ছুটে চলে দূরে। হঠাৎই আকিব প্রশ্ন করে,
‘ ভাই কথা তো দিলেন প্রিয়তাকে বাঁচাবেন কিন্তু রোজ রোজ কিভাবে বাঁচাবেন?’
উওরে স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব অপূর্বের,
‘ যাতে রোজ রোজ বাঁচাবো না লাগে তার ব্যবস্থা করবো আকিব?’
অপূর্বের কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে বললো আকিব,
‘ মানে?’
‘ আজ বাড়ি যাবো না আকিব অন্য কোথাও যাবো।’
আকিব অবাক হয়, চরম অবাক হয়। অবাক হয়েই বলে,
‘ অন্য কোথাও কোথায় ভাই?’
উওরে জবাব দেয় না অপূর্ব। নিজের ফোনের লকটা খুলে একটা ফোন করে। কলটা অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটি ধরতেই শান্ত স্বরে বলে,
‘ বাবা আজ আমি বাড়ি যাবো না, আমার কিছু জরুরি কাজ আছে। কাজ সেরে কাল ফিরছি বাড়ি তাই আমি না ফেরা পর্যন্ত নিজের বউকে সামলে রেখো কেমন?’
#চলবে….
#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৭
_________________
ঘড়ির কাঁটায় সকাল নয়টার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। উঠানের মাঝ বরাবর চেয়ার পেতে বসে আছে প্রিয়তার চাঁচি। চোখে মুখে অশেষ বিস্ময়ের ছাঁপ। কারন তার সামনে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে অপূর্ব। ভাবটা এমন যেন এ বাড়িতে এর আগেও বহুবার এসেছে সে। অপূর্বের একদিকে দাঁড়িয়ে আছে আকিব। আর অন্যদিকে দাঁড়িয়ে মতলেব। চোখে মুখে তারও বিস্ময়ের ছোঁয়া। আর এদের সবার থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে মতলবের সাথে থাকা তিনটা ছেলে। যার একটা ঢাকা থেকে এসেছে। অপূর্ব আসার পথে এদেরকে ধরে নিয়ে এসেছে যতই হোক প্রিয়তাদের বাড়ি আর এদের সাবধান দুটোই করতে হবে তো।’
প্রিয়তার চাঁচি নড়ে চড়ে বসলেন খুব গম্ভীর স্বরে বললেন,
‘ আপনারা কারা এখানে কি চাই?’
অপূর্ব তার চোখের কালো চশমাটা খুলে আকিবের হাতে দিলো। আকিবও নিলো সেটা। অপূর্ব তার মাথার সিল্কি চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়িয়ে প্রিয়তার চাঁচির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছি ম্যাডাম?’
প্রিয়তার চাঁচি যেন অবাক হলেন চরম। অপূর্বকে এর আগে কখনো দেখেছিল বলে তার মনে পড়ছে না। অচেনা লাগছে পুরো দমে। প্রিয়তার চাঁচি চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
‘ আমার কাছে কি কাজ আপনার?’
অপূর্ব নিশ্চুপ থাকে তারপর বলে,
‘ পাঁচ কাপ চা নিয়ে আসেন ম্যাডাম খেতে খেতে কথা বলা যাবে। আমার আবার চা ছাড়া কথাটা ঠিক জমে না।’
প্রিয়তার চাঁচি যেন থমকে গেলেন মুহূর্তেই এ কি বললো ছেলেটা। অচেনা একটা ছেলে কিভাবে এভাবে বলতে পারে। প্রিয়তার চাঁচি কিছু বলতে নিবে এরই মাঝে তার সামনে এগিয়ে আসলো মতলেব। প্রিয়তার চাঁচিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ ম্যাডাম ভিতরে চলুন আমি আপনায় সব বুঝিয়ে বলছি,
বলেই প্রিয়তার চাঁচিকে নিয়ে গেল মতলেব। আর অপূর্ব আয়েশ করে বসলো। আকিবকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
‘ তুমি বসবে আকিব পা ব্যাথা করবে তো?’
উওরে আকিব শুঁকনো হেঁসে বললো,
‘ না ভাই আমি এখানেই ঠিক আছি।’
আকিবের কথা শুনে মুচকি হেঁসে বলে অপূর্ব,
‘ ঠিক আছে।’
___
রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তার চাঁচি রাগে তার গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। এ কেমন ছেলে বাড়ি বয়ে এসে তার ওপর হুকুম চালায়। প্রিয়তার চাঁচি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মতলেবকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ তুমি আমায় এভাবে কেন টেনে আনলে মতলেব?’
উওরে মতলেব হতভম্ব হয়ে বললো,
‘ এনেছি কি আর সাধে ম্যাডাম আপনি জানেন ইনি কে?’
মতলেবের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো প্রিয়তার চাঁচি,
‘ কে ছেলেটা?’
‘ ওনার নাম তাহসান আহমেদ অপূর্ব। ঢাকা শহরের একজন শক্তিশালী রাজনীতিবিদ। আর সবচেয়ে বড় কথা এ কিন্তু অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না ম্যাডাম। আমি কি বুঝাতে চাইছে বুঝচ্ছেন তো। তাই ভালো ভালোই বলছি উনি যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে সেটা পালন করার চেষ্টা করুন ম্যাডাম নয়তো আপনার কারবার,
বলেও থেমে গেল মতলেব। আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
‘ বেশি ঘাঁটতে যাবেন না ম্যাডাম এতে বিপদ কিন্তু আপনারই হবে।’
প্রিয়তার চাঁচির কি ঘাবড়ালো মতলেবের কথা শুনে ঠিক বোঝা গেল না। তবে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলেন তিনি। বললেন,
‘ এর উদ্দেশ্য কি মতলেব?”
উওরে শুধু এতটুকুই বলে মতলেব,
‘ প্রিয়তা।’
____
বাড়ির উঠানের কর্নারের পাশে থাকা ছোট ছোট ফুলগাছে পানি দিচ্ছে প্রিয়তা। খানিকটা টেনশন খানিকটা হতাশা আর অপূর্বের ভাবনা নিয়েই গাছে পানি দিচ্ছে সে। প্রিয়তা অপূর্বের কথা রাখবে তাই আর আজ ভার্সিটি যায় নি। আগামী সাতদিন কোথাও যাবে না এটাও ভেবে রেখেছে। গ্র্যান্ডমাকে সবটা বলার ইচ্ছে থাকলেও আবার কেন যেন বলে নি সে।’
‘ তুমি কাল সারাদিন ভার্সিটির পরে কোথায় ছিলে প্রিয়তা?’
হুট করেই এক পুরুষালির কন্ঠ কানে আসতেই চমকে উঠলো প্রিয়তা। নিজের ভাবনা থেকে বের হলো মুহুর্তেই। প্রিয়তা পিছন ফিরে তাকানোর আগেই তার সামনে এগিয়ে আসলো আয়মান। আবারও বললো,
‘ কি হলো তুমি কথা বলছো না কেন প্রিয়তা?’
প্রিয়তা ফের চমকালো খানিকটা কিন্তু কিন্তু স্বরে বললো,
‘ সেটা তো কাল রাতেই বলেছি আয়মান, যে আমি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম নোটস আনতে।’
প্রিয়তার কথা শুনে আয়মান এক গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ সে তো আমি শুনেছি প্রিয়তা। কাল রাতে তুমি বাড়ি ফিরে গ্র্যান্ডমাকে এটাই বলেছো। কিন্তু তাই বলে ওত রাত অবদি তুমি বন্ধুর বাড়িতে ছিলে প্রিয়তা?’
‘ আপনি হয়তো ভুলে গেছেন কাল বৃষ্টি হয়েছিল খুব তাই আমি আটকা পড়েছিলাম।’
‘ কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে তুমি মিথ্যে কথা বলছো।’
প্রিয়তা থমকে গেল অনেকটা, খানিকটা ঘাবড়িয়েছেও কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললো,
‘ আপনার মন যা ইচ্ছে মনে করতেই পারেন কিন্তু আমি যেটা হয়েছে সেটাই বলেছি। এখন আপনার বিশ্বাস না হলে আমার কিছু করার নেই। আমায় রুমে যেতে হবে কিছু কাজ আছে।’
বলেই আয়মানকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো প্রিয়তা। এরই মাঝে আয়মান বললো আবার,
‘ আজ ভার্সিটি কেন যাও নি প্রিয়তা।’
আয়মানের কথাটা শুনে দুই সেকেন্ড মতো দাঁড়িয়ে বললো প্রিয়তা,
‘ আজ ভালো লাগছে না ভার্সিটি যেতে তাই যায় নি।’
বলেই আর না দাঁড়িয়ে হন হন করে চলে গেল প্রিয়তা। এক মুহুর্তের জন্য হলেও আয়মানের এই একের পর একের প্রশ্নে বিরক্ত ফিল করছিল প্রিয়তা।’
___
ট্রে হাতে গুনে গুনে পাঁচ কাপ দুধ চা বানিয়ে এগিয়ে আসছে প্রিয়তার চাঁচি। চোখে মুখে এক গম্ভীরতার ছোঁয়া। প্রিয়তার জন্য এত বড় রাজনীতিবিদ তাদের বাড়িতে এসেছে বিষয়টা যেন হজম হচ্ছে না প্রিয়তার চাঁচির। তবে কি এই ছেলের সাথেই প্রিয়তা বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে ছিল নাকি। কিন্তু ঢাকার একজন রাজনীতিবিদের সাথে প্রিয়তার পরিচয় হলো কি করে, মেয়েটাকে তো সেইভাবে কখনো দূরে যেতে দেয় নি। প্রিয়তার চাঁচি নানা কিছু ভাবতে ভাবতে এগিয়ে আসলো সামনে তারপর টেবিলের উপর চায়ের ট্রেটা রেখে বললো,
‘ এবার বলো এখানে কি কারনে এসেছো?’
উওরে ট্রে থেকে এক কাপ চা উঠিয়ে বললো অপূর্ব,
‘ কেন মতলেব মশাই আপনায় কিছু বলে নি ম্যাডাম?’
প্রিয়তার চাঁচি যেন থমকে গেলেন সঙ্গে থমকালেন মতলেবও। মতলেব থর থর করে এগিয়ে এসে বললো,
‘ ভাই আমি সত্যি কিছু বলে নি।’
অপূর্ব চায়ের কাপে চুমুক দেয়। চায়ের স্বাদটা মুখে লাগতেই প্রিয়তার চাঁচিকে উদ্দেশ্য করে বললো অপূর্ব,
‘ আপনি মনে হয় চায়ে একটু চিনি বেশি খান।’
জবাব দেয় না প্রিয়তার চাঁচি। খানিকটা রাগান্বিত গলায় বলে,
‘ এতকিছু শুনতে চাই নি আমি উদ্দেশ্য কি সেটা বলুন?’
‘ আরে আরে এত রেগে যাচ্ছেন কেন ম্যাডাম উদ্দেশ্য তো একটা আছেই উদ্দেশ্য না থাকলে অপূর্ব এখানে আসে। তবে উদ্দেশ্যের কথা বলা আগে একটা কাজ করুন, আপনার বানানো চায়ের কাপগুলো একে একে সবার হাতে তুলে দিন। যতই হোক কতটা জার্নি করে এসেছে এরা।”
প্রিয়তার চাঁচি রাগে ফুসলেন কিছু বলতে নিলেও মতলেবের ইশারায় থেমে গেলেন। তারপর বাধ্য মেয়ের মতো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতেই একে একে সবাইকে চা এগিয়ে দিলেন। আকিবকে দিলেন সবার আগে। সবাইকে চা দেওয়া শেষ হতেই অপূর্ব খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ প্রিয়তার চাচা কোথায় ম্যাডাম?’
উওরে প্রিয়তার চাঁচি কিছু বলার আগেই মতলেব বললো,
‘ ভাই উনি তো কাজে গেছেন। সকাল সকাল দোকান খুলতে হয় কি না।’
অপূর্ব আর কিছু বলে না। এবার খুব সিরিয়াজভাবে বলে,
‘ এবার তবে কাজের কথায় আসা যাক ম্যাডাম।’
প্রিয়তার চাঁচি যেন খুশি হলেন। এটা শোনার জন্যই তো এতক্ষন অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। প্রিয়তার চাঁচির ভাবনার মাঝেই বলে উঠল অপূর্ব,
‘ দেখুন ম্যাডাম আমি কে সেটা হয়তো মতলেব মশাই আপনায় বলেছে। আমি অন্যায়ের সাথে একদমই আপোষ করা পছন্দ করি না। আর আপনি যা করছেন সেটা একদমই অন্যায়।’
‘ কি অন্যায় করেছি আমি?’
‘ কি অন্যায় করেছেন তা আবার প্রশ্ন করছেন।’
‘ দেখো ছেলে, প্রিয়তা আমার বাড়ির মেয়ে ওর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার।’
‘ ভালো,
বলেই শুঁকনো হাসে অপূর্ব। তারপর বলে,
‘ একটা ৬০ বছরের বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে কি ভালো করছেন আপনি আপনার বাড়ির মেয়ের সাথে।’
প্রিয়তার চাঁচি থেমে গেলেন। কি বলবেন বুঝতে পারছে না। প্রিয়তার চাঁচি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
‘ এখন তোমার কি চাই? সেটা বলো।’
প্রিয়তার চাঁচির কথা শুনে হাসে অপূর্ব, উচ্চ স্বরে হাসলো সে। বললো,
‘ আমার তো অনেক কিছু চাই ম্যাডাম যার সবকিছু আপনি দিতে না পারলেও কিছু কিছু আমায় দিতে বাধ্য।’
____
গুনতে গুনতে কেটে গেল পুরো এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে অপূর্বের সাথে প্রিয়তার কোনোভাবেই যোগাযোগ হয় নি। প্রিয়তা যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও পারে নি কারন অপূর্বের ফোন বন্ধ। প্রিয়তার টেনশন হয় খুব, হুট করে অপূর্ব এমন গায়েব হয়ে গেল কেন?’
রৌদ্রময়ের দুপুর। ভার্সিটির শেষ করে একটা পার্কের বেঞ্চে বসে আছে প্রিয়তা। আজ অনেকটা ভয় ভয় নিয়ে ভার্সিটি আসলেও তেমন সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ে নি তার। প্রিয়তা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। আজ অপূর্বকে দেখতে খুব মন চাইছে তার। অপূর্ব এমন কেন একটা বার কি তার সাথে দেখা করা যায় না আচ্ছা দেখা না হয় বাদ দিলাম একটাবার ফোন করেও তো কথা বলা যায় নাকি। প্রিয়তা সেদিন রাতের অপূর্বকে মনে করলো। অপূর্বের আচরণ, শীতল ভেজা কন্ঠ, বৃষ্টি দেখার অনুরোধ। এই সবকিছুর মাঝেই কিছু একটা তো দেখেছে প্রিয়তা সেদিন অপূর্বের মাঝে কিছু একটা ফিল করেছে প্রিয়তা। প্রিয়তা একা মনে বিড় বিড় করে উঠলো,
‘ আমি আপনার চোখের মাঝে কিছু একটা দেখেছি অপূর্ব গোপনে ফিল করেছি অনেক কিছু। কিন্তু আবার কেন যেন ভয় লাগে যদি না হয় তখন।’
প্রিয়তা নিশ্চুপে বসে রইলো চুপচাপ। এমন সময় হঠাৎই তার পাশে এসে বসলো কেউ। নিশ্চুপে বলে উঠল সে,
‘ এই রোদ্দের ভীড়ে, নিশ্চুপ পরিবেশে একা একা বসে কি করছেন মেয়ে?’ ভয় লাগছে না বুঝি।’
‘মেয়ে’ হুট করেই মেয়ে শব্দটা শুনতেই প্রিয়তা যেন থমকে গেল অপূর্ব এসেছে নাকি। প্রিয়তা অধিআগ্রহের সঙ্গে পাশ ফিরে তাকালো। সামনের ব্যক্তিকে দেখে এক অদ্ভুত শব্দ করে বললো,
‘ কে আপনি?’
#চলবে….
#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৮
_________________
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা সামনের ব্যক্তিটির দিকে এর আগে এই যুবকটিকে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না তার। ছেলেটিকে দেখছে, গায়ের রঙ ফর্সা,গোল ফেস চোখে চশমা, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, পারফেক্ট বডিফিগার একদম অপূর্বের মতো। গায়ে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি জড়ানো সাথে আকাশী রঙের কটি। প্রিয়তা ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলো একে সে চেনে না কোনোদিন দেখেও নি। প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই আবারও বলে উঠল ছেলেটি,
‘ কি হলো কথা বলছেন না কেন এই ভরদুপুরে একা একা এখানে কি করছেন মেয়ে?’
প্রিয়তা কিছুক্ষন চুপ থেকে জবাব দিলো,
‘ এমনি বসে আছি।’
‘ এমনি এমনি কেউ বসে থাকে নাকি?’
খানিকটা বিরক্ত ফিল করলো প্রিয়তা। ফটাফট জবাব দিলো,
‘ বসে থাকতেও কারন লাগে এটা জানতাম না তো।’
হাসে ছেলেটি। হাসতে হাসতেই বলে,
‘ আসলেই তো বসে থাকতে কারন লাগে নাকি।’
‘ আপনি কি আমার সাথে ফ্লাট করছেন?’
প্রিয়তার কথা শুনে হাসি থামায় ছেলেটি বলে,
‘ না না ফ্লাট করতে যাবো কেন।’
‘ আপনি কি আমায় চেনেন?’
‘ না তো।’
‘ তাহলে এত কথা বলছেন কেন?’
‘ কেন চেনা না থাকলে কথা বলা যায় না বুঝি। আর এছাড়া চিনতে হলে তো আগে কথা বলতে হবে তাই না মেয়ে?’
‘মেয়ে’ শব্দটা– এই ছেলের মুখে একদমই শুনতে চাইছে না প্রিয়তা। কেমন যেন বড্ড বেমানান লাগছে তার। তাই বেশি না ভেবেই বললো,
‘ মেয়ে শব্দটা উচ্চারণ করবেন না প্লিজ। এই মেয়ে নামে আমায় একজনই ডাকে আর তার মুখেই শুনতে ভালো লাগে। তাই মেয়েটা শব্দটা বাদ দিন।’
প্রিয়তার কথা শুনে সামনের ছেলেটি নিশ্চুপ রইলো কতক্ষণ। তারপর বললো,
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। মেয়ে বলবো না আর আপনার নামটা তো বলুন তাহলে সেই নামেই ডাকবো না হয়।’
প্রিয়তা সামনের ছেলেটির দিকে তাকালো কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে ছেলেটাকে। চেনা নেই জানা নেই এভাবে হুট করে এসে এত কথা বলা কি ঠিক হচ্ছে। প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই আবারও বললো ছেলেটি,
‘ কি হলো কিছু বলছেন না কেন?’
ছেলেটির এবারের কথা শুনে প্রিয়তা না চাইতেও বলে উঠল,
‘ আমার নাম প্রিয়তা।’
প্রিয়তার কথা শুনে সামনের ছেলেটি যেন খুশি হলো। বললো,
‘ ওহ প্রিয়তা নাইস নেইম। আর আমার নাম আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি। আপনাদের ভার্সিটির নিউ ইংরেজি টিচার।’
সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো প্রিয়তা। বললো,
‘ কি?’
উওরে আব্রাহামও বললো,
‘ জ্বী। নতুনই ঢুকেছি আজ এক সপ্তাহ হয়েছে বোধহয়।’
প্রিয়তা এবার বেশ বিব্রত হলো। তাদের ভার্সিটি টিচার উনি অথচ না চিনে প্রিয়তা কিসব ভাবছিল এতক্ষণ। প্রিয়তা অপরাধীর স্বরে বললো,
‘ আই এক্সট্রিমলি সরি স্যার আমি আপনায় চিনতে পারে নি আসলে আমি এতদিন ভার্সিটি আসি নি তো তাই আর কি।’
‘ ইট’স ওকে আমি বুঝতে পেরেছি। তা এতদিন আসছিলে না কেন?’
উওরে ফট করেই মুখ ফসকে বলে ফেললো প্রিয়তা,
‘ ওই অপূর্ব আসতে বারন করেছিল তাই আর কি।’
‘ অপূর্ব কে?’
প্রিয়তার হুস আসলো এটা কি বলে ফেললো সে। প্রিয়তা আমতা আমতা করে বললো,
‘ না মানে কিছু না।’
‘ তাহলে কি এই অপূর্বই তোমায় ‘মেয়ে’ শব্দটা উচ্চারন করে ডাকে প্রিয়তা।’
প্রিয়তা যেন চমকালো, ভড়কালো, অবাক হয়ে বললো,
‘ আপনি কি করে বুঝলেন?’
হাসে আব্রাহাম। বলে,
‘ আমি তো অনেক কিছুই বুঝি যেটা তুমি বুঝো না।’
আব্রাহামের কথা শুনে বেশ বিস্মিত স্বরে বললো প্রিয়তা,
‘ মানে?’
‘ মানে কিছুই না। আচ্ছা অপূর্ব কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
‘ এ মা না না তা হবে কেন।’
‘ তাহলে কি হয় তোমার অপূর্ব?’
প্রিয়তা আঁটকে গেল আব্রাহামের প্রশ্নের ভিড়ে সত্যি তো অপূর্ব কি হয় প্রিয়তার। এই প্রশ্নটা এর আগে প্রিয়তার মাথাতেই আসে নি। কিন্তু প্রিয়তা এতটুকু তো জানে অপূর্ব তার অপরিচিত বা অপ্রিয় কেউ নয় প্রিয়ই খুব। ভালো লাগে তার অপূর্বকে না শুধু ভালো লাগে না এর থেকেও বেশি কিছু। প্রিয়তার ভাবনার মাঝে আবারও বললো আব্রাহাম,
‘ কি হলো আবার আঁটকে পড়লে নাকি?’
প্রিয়তা এক বিব্রতকর চোখ নিয়ে তাকায় আব্রাহামের দিকে। বলে,
‘ আমি সত্যি জানি না অপূর্ব আমার কি হয়? কিন্তু উনি আমার অপ্রিয় কেউ না প্রিয়ই খুব।’
প্রিয়তার কথা শুনে আব্রাহাম কিছু বলে না। উল্টো মুচকি হাসে। বলে,
‘ আর তার কাছে আইমিন অপূর্ব কি তোমায় প্রিয় ভাবে প্রিয়তা?’
না এবার যেন বাড়াবাড়ি হচ্ছে এসব কি প্রশ্ন করছে স্যার। প্রিয়তা খানিকটা বিব্রত ফিল করে বললো,
‘ আমায় এবার যেতে হবে স্যার? অনেকক্ষণ হয়েছে এখানে বসে আছি তো বাড়ির সবাই হয়তো চিন্তা করছে।’
‘ আমার কথায় তুমি বিব্রত ফিল করেছো তাই না প্রিয়তা আমি জাস্ট এমনি জিজ্ঞেস করেছি যাইহোক ভালো থাকো নেক্সট ক্লাসে দেখা হবে কেমন।’
বলেই আব্রাহাম উঠে দাঁড়ালো নিজের চোখের চশমাটা ঠিক করে বললো,
‘ এভাবে ভরদুপুরে একা একা নির্জন জায়গায় বসে থাকবে না কেউ ধরে নিয়ে গেলে তখন।’
হাসে প্রিয়তা। বলে,
‘ আপনিও না কিসব বলছেন স্যার?’
উওরে আব্রাহাম তার চোখের চশমাটা ঠিক করে খুব সিরিয়াসভাবেই বললো,
‘ কিছু কিছু জিনিস হেঁসে উড়িয়ে দিতে নেই প্রিয়তা।’
বলেই আর না দাঁড়িয়ে চলে যায় আব্রাহাম। সে বুঝেছে প্রথম আলাপেই এতকিছু জানা সম্ভব নয়। আব্রাহাম এক শুঁকনো হাসলো। বললো,
‘ মেয়ে তুমি বড্ড অবহেলার,
নীল দুয়ারে ধমকানো হাওয়া
রঙিন উপন্যাসের কঠিন উপসংহারের..
বলতে চেয়েও আর বললো না আব্রাহাম। রহস্যময়ী হাসতে হাসতে চলে গেল সে। থাক কিছু অজানা সময় তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে আব্রাহাম চলে গেল দৃষ্টি সীমানার বাহিরে।’
প্রিয়তা বসে আছে, এই হুট করে আব্রাহাম স্যারের আগমনটা ঠিক নিতে পারে নি সে। আর অপূর্বের প্রসঙ্গ বিষয়টাও কেমন যেন একটু নড়বড়ে লাগলো প্রিয়তার কাছে। প্রিয়তা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো তারপর আর বেশি না ভেবেই বসা থেকে উঠে চললো সে বাড়ির গন্তব্যের দিকে। এই অপূর্বের সাথে আজও দেখা হলো না তার। প্রিয়তা বেশ মন খারাপের সুর টেনে বললো,
‘ আমাদের কি আর যোগাযোগ হবে না অপূর্ব?’
____
পরন্ত বিকেলবেলা। নিজের রুমের ইজি চেয়ারে বসে আছে প্রিয়তার চাঁচি। হাতে নতুন টাকার বান্ডিল। ঠোঁটে রয়েছে তার রহস্যময়ী হাসি। এই প্রিয়তা মেয়েটা সত্যি যেন তার জন্য লাকি ছেলেটা কতগুলো টাকা দিয়ে গেল তাকে। প্রিয়তার চাঁচি ভাবতেও পারি না প্রিয়তাকে কিডন্যাপ না করানোর জন্যও টাকা পেতে পারে। তাও আবার এক রাজনীতিবিদের কাছ থেকে। প্রিয়তা চাঁচি হাসতে হাসতে বললো,
‘ নিকুচি করেছে প্রিয়তার বিয়ের।’
বলেই নতুন টাকার ঘ্রাণ নিতে লাগলেন তিনি। এমন সময় ওনার ফোনটা বেজে উঠল। প্রেমার স্বামী রহিম মির্জা ফোন করেছে। প্রিয়তার চাঁচি বেশি না ভেবেই ফোনটা তুলে বললো,
‘ কি হয়েছে?’
উওরে অপরপ্রান্তে থাকা রহিম মির্জা বললো,
‘ কি হয়েছে মানে আপনি কি আর ব্যবসা করতে চাইছেন না ম্যাডাম বিদেশি পার্টিগুলো বেশ তাড়া দিচ্ছে ওনারা পন্য পাচ্ছেন না বলে,
‘ তাড়া দেয় দিক আপাতত কিছুদিন সব ধান্দা বন্ধ থাকবে রহিম। ঢাকার এক রাজনীতিবিদ আমাদের নজর রাখছে তাই আপাতত কিছুদিন রেস্ট নেও।’
‘ কিন্তু ম্যাডাম।’
‘ কোনো কিন্তু নয় যা বলছি তাই করো। আগে ওই রাজনীতিবিদের একটু খবরাখবর রেখে নেই তারপর আমাদের ধান্দা নিয়ে ভাবছি।’
বলেই ফোন কাটলো প্রিয়তার চাঁচি। তারপর হাসলেন আবার। টাকার গন্ধ নিলেন মুহূর্তেই।’
অন্যদিকে,
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়তার চাচা বউয়ের কথা সবই শুনেছেন তিনি। প্রিয়তার চাঁচি স্বামীর অগোচরে ব্যবসা করেন কিন্তু কি ব্যবসা করেন এটা আজও অজানা প্রিয়তার চাচার কাছে।’
____
রাত প্রায় ১০টা। অন্ধকারে টুইটুম্বর চারপাশ। খানিকটা গা ছমছমে পরিবেশ, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে হয়তো বৃষ্টি নামবে। আজ আয়মান নেই এখানে ফেসবুকে আলাপ হওয়া এক বাংলাদেশী বন্ধুর বাড়িতে গেছে সে রাতে নাকি সেখানেই থাকবে। গ্র্যান্ডমা আর প্রিয়তা রাতের খাবার সেরে যে যার রুমে চলে গেছে অনেক্ক্ষণ হলো। গ্র্যান্ডমা এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে হয়তো।’
আর প্রিয়তা চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায় হাতে তার অপূর্বের দেওয়া মোবাইলটা। অপূর্বের নাম্বারটায় বার বার চোখ বুলাচ্ছে সে। অপূর্বের এই নাম্বারটা সেই কবে থেকে বন্ধ বলছে আর খুলছে না। প্রিয়তার ভীষণ জোরে কান্না পাচ্ছে এই অপূর্ব এমন কেন একবার কি ফোন করা যায় না তাকে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অপূর্ব আর প্রেমাকে একরকম লাগছে প্রিয়তার কাছে, কিন্তু প্রেমার দোষ দিলেও ভুল হবে প্রিয়তা প্রেমার যে নাম্বারটা এনেছে সেটা ওর দুলাভাইর লাস্ট দু’দিন আগে ফোন করার সময় প্রিয়তার দুলাভাই রহিম মির্জা ধরেছিল ‘হ্যালো’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে দেয় প্রিয়তা। খানিকটা ঘাবড়ে যাওয়ার কারনে আর ফোন করে নি।’
প্রিয়তা জোরে এক নিশ্বাস ফেললো। অনেক ঘেটেঘুটে চারদিন আগে একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলেছিল প্রিয়তা। মাত্রই সেটাতে ঢুকে ঘাটাঘাটি করছে। হঠাৎই একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট আসলো প্রিয়তার কাছে নামটা হলো আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি। প্রিয়তা নাম আর প্রোফাইল পিকচারটা দেখেই চমকে উঠলো এ তো দুপুরে আলাপ হওয়া টিচারটা। প্রিয়তা ভেবে পেল না রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করবে কি করবে না। এরই মাঝে আকাশে ভয়ংকর ভাবে বিদ্যুৎ চমকালো, সঙ্গে কারেন্ট চলে গিয়ে রুম করলো পুরোদমে অন্ধকার। হুট করে এমন ঘটনায় প্রিয়তা ভয়ে কেঁপে উঠলো এক মুহূর্তের জন্য। প্রিয়তা দ্রুত মোবাইলে লাইট অন করলো, মোমবাতি খুঁজতে হবে তাকে। প্রিয়তা আশেপাশে খুজে টেবিলের ড্রয়ার থেকে মোমবাতিটা বের করে মোমবাতিটা জ্বালালো। এরই মধ্যে আকাশ পথ বেয়ে শুরু হয়ে গেল মুষলধারে বর্ষণ। প্রিয়তা প্রকৃতির এই হুট করে গর্জে ওঠার বিষয়টায় পুরোই থমকে গেল।
খানিকটা ভয়ও যেন লাগলো। হঠাৎ এই ভয়ের ভিড়েই তার রুমের দরজাটার খটখট শব্দ হলো এতে যেন আরোই চমকে উঠলো প্রিয়তা। এই সময় কে আসলো আয়মান না তো। ওদিকে দরজা তো তালা বন্ধ এখন। প্রিয়তা বেশি না ভেবেই মোবাইলের লাইট নিয়েই এগিয়ে গেল সামনে। মাত্রই অফ করেছিল সেটা। প্রিয়তার ফেসবুকের একটিভ থাকায় আচমকাই প্রিয়তা নিজ অজান্তেই আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফির পাঠানো রিকুয়েষ্টটা হাতের টাচে একসেপ্ট হয়ে গেল। প্রিয়তা দেখতেও পায় নি।’
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘ কে?’
কিন্তু অপরপ্রান্তের কোনো জবাব এলো না। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে ভয়ংকর শব্দ করে। প্রিয়তা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই সামনে সশরীরে অপূর্বকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তা যেন আরো চমকালো। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
‘ অপূর্ব আপনি এখানে?’
উওরে নিজের ক্লান্ত মাখা শরীরটা নিয়ে এগিয়ে আসলো অপূর্ব। তাকে স্বাভাবিক লাগছে না চুলগুলো এলেমেলো গায়ে জড়ানো কালো রঙের শার্টও কেমন যেন অগোছালো। অপূর্ব প্রিয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুবই অসহায় কন্ঠে বললো,
‘ আমায় একটু মানসিক শান্তি দিবে মেয়ে, আমার কেন যেন খুব যন্ত্রনা হচ্ছে আমি নিতে পারছি না। সামলাতে পারছি না নিজেকে আমায় একটু সামলাবে প্লিজ?’ বেশি না অল্প কিছুক্ষণ!’
ব্যাস এতটুকু বলেই এলিয়ে পড়লো অপূর্ব প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা চমকে উঠলো মুহূর্তেই সামনে এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো অপূর্বকে। চিন্তিত স্বরে বললো,
‘ আপনার কি হয়েছে অপূর্ব?’
অপূর্ব জবাব দেয় না। অপূর্বের জবাব না পেতে প্রিয়তা আরো দু’বার ডাকে অপূর্বকে। কিন্তু অপূর্ব তখনও জবাব দেয় না। প্রিয়তার যেন সন্দেহ হলো অপূর্ব অজ্ঞান হয়ে গেছে। হঠাৎই অপূর্বের পিঠে ভেজালো কিছু বাজলো প্রিয়তার হাতে বিষয়টাকে প্রথমে বৃষ্টির পানি মনে হলেও এখন কেন যেন তেমনটা মনে হচ্ছে না প্রিয়তার। প্রিয়তা তার মোবাইলের লাইটটা দিয়ে দেখলো তার হাতটা সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আঁতকে উঠলো কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
‘ ররর…রক্ত!’
প্রিয়তার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো অপূর্বের কিছু হলো না তো। প্রিয়তা অদ্ভুত স্বরে বললো,
‘ অপূর্ব।’
#চলবে…..