আজও_তোমারই_অপেক্ষায় পর্ব-১৮+১৯

0
184

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
১৮.

“ আমাদের সম্পর্কে এভাবে অপমান করিস না, হিমালয়! সঠিক কারণ জানতে পারলে পরে তুই খুব পস্তাবি।”

“ আমি মানতে পরছি না, মীর ভাই! রাদিফ ভাইয়ের এই অবস্থা আমাদের জন্যই। আমরা যদি সম্পর্কে না জড়াতাম তাহলে রাদিফ ভাই চলে যেতোনা।”

মীরের চোখ জোড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে। রাগে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। হিমা ছাড়া অন্য কেউ হলে হয়তো মীর এতক্ষণে তাকে মে’রে ফেলতো। মীর ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। হিমা কী এই সম্পর্ক রাখতে চাইছে না ভেবেই অন্তর ডুকরে উঠছে। মীর নিজেকে শান্ত রেখে হিমার হাত ধরে আবারও বলতে শুরু করে,“ এমন করিস না, হিমালয়! আমি সব ঠিক করে দিব সোনা! মীরের উপর ভরসা রাখ, সব ঠিক করে দিব।”

হিমা মীরের হাত ঝাটকা দিয়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে,“ তুমি চলে যাও, মীর ভাই! আমাকে একা থাকতে দাও। কেন যেন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।”

মীর ধপ করে নিচে বসে পড়ে। যাকে সে পাগলের মতো ভালবাসে সেই আজ তাকে চলে যেতে বলছে! মীর উপস্থিতি উপলব্ধি করে হিমা আবারও বলে,“ আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেয়া উচিত, মীর ভাই। সারাজীবন এই ক্ষত নিয়ে তুমিও সুখী হতে পারবে না, আমিও না।”

মীর এবার নিজের রাগকে কনট্রোল করে পারেনি। হিমার কাছে এসে দুগাল চেপে ধরে বলতে শুরু করে,“ এতো জিদ তোর, এতো! বলেছিলাম রাদিফের কিছু হয়নি। বিশ্বাস করলি না তো! ঠিক আছে, তোর কথাই রইলো। ভেঙে দিলাম আমাদের সম্পর্ক। আমার জন্য তোর মনে একটুও ভালোবাসা রাখিস না, হিমালয়! নয়তো সারাজীবন অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে ম’র’বি। তোকে মুক্তি দিলাম হিমালয়! এই মীর তোর জীবনে দাখিলাদি করবে না।”

মীর হিমার গাল ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। মীরের চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে। আজকের পর থেকে হিমাকে সে দেখতে পাবে না। হিমার কথাও শুনতে পারবে না। যাওয়ার আগে সে হিমার কাছে আবদার করে বসে,“ তোকে একটু জড়িয়ে ধরতে দিবি, হিমা? আজকেই শেষ, আর কখনো এই মীর তোর সামনে আসবে না। ”

হিমার কান্না করছে। কষ্টগুলো একসাথে দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। মীর তাকে হিমা ডাকছে! তারমানে সে খুব কষ্ট পেয়েছে! হিমা কথা বলতে পারছে না। দেখা গেল মীর নিজেই হিমাকে পেছন দিকে জড়িয়ে ধরে। হিমার মাথায় চুমু এঁকে বলে, “ আমাদের পথচলা এখানেই শেষ। আমি আজও তোর অপেক্ষায় ছিলাম, হিমালয়! এই অপেক্ষা আজ থেকে তুই করবি। কিন্তু আমাকে খুঁজে পাবি না, হিমালয়! খুঁজে পাবি না!”

মীর এক মুহূর্তও থামেনি। এতক্ষণ সে হিমাকে নিয়ে তার ঘরে ছিল। নিচে নেমে আশার ছলছল চোখ দেখে বলে,“ আমি তোমার মনের আশা পূরণ করতে পারিনি, ফুফু! তোমার মেয়ে আমাকে চায় না। চাক্ষুষ না দেখে সে আমাদের সম্পর্ককে অসম্মান করেছে। আমি চলে যাচ্ছি, ফুফু। আমার খোঁজ নিও না। তোমরা ভালো থেকো। রাদিফকে আমি খুঁজে বের করবোই। আমি জানি, আমার ভাইয়ের কিছু হয়নি, সে সুস্থ আছে। চললাম।”

মীর পিছনে ফিরে তাকায়নি। আশা মাথায় হাত রেখে জমিনে বসে কান্না করতে থাকে। তার সুন্দর সংসার আজ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সে কিছু করতে পারছে না।
হিমা ছাঁদে দৌড়ে চলে আসে। মীরকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় পাশে এসে দাঁড়ায়। ঐ যে মীর চলে যাচ্ছে।হিমা চেয়েও তাকে আটকাতে পারছে না। সে হাত বাড়িয়ে মীরকে ডেকে উঠে,“ আমাকে ক্ষমা করে দিও,মীর ভাই! আমার ভেতরকার যন্ত্রণা কাউকে দেখাতে পারছি না। যদি তুমি বুঝতে, তাহলে আমাকে ভুল বুঝতে না। ”

——————————-

“ তোমার পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে না, মিলি?”
“ করে তো! কিন্তু শ্রীপুর থেকে সদরে যেতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া একা মেয়ে মানুষের যাতায়াতেরও ব্যাপার আছে!”

রাদিফ সবসময়ের মতো চুপচাপ কথাগুলো শুনে। তারা বসে আছে পাহারের বেষ্টনী ধরে একটি নালার পাশে। পাথর ও ঝর্নার পানির সংমিশ্রণে নালার নাম দেওয়া হয়েছে রাঙাপানি। মিলি পা ভিজিয়ে নালায় পা নাচাচ্ছে। যেন সে এই কাজ করে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। রাদিফ বাঁধা দিচ্ছে না। এখানে সে এসেছে আজ দশদিন। এতোদিনে সে মিলির আগা গোড়া সব চিনেছে। একাকী বড়ো হয়েছে সে। পথ, গাট, মাঠ নদী সবখানেই তার বিচরণ। প্রকৃতির সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে সে। প্রকৃতির সাথে মিশে নিজেকে গড়ে তুলেছে প্রকৃত কন্যা হিসেবে। রাদিফের মাথার আঘাত প্রায় সেড়ে গিয়েছে মিলির গাছন্ত ঔষধীর ফলে।

“ আপনি কীভাবে আঘাত পেলেন, বললেন না তো! নাকি প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে যাচ্ছিলেন?”

মিলির কথার মর্মার্থ বুঝতে রাদিফের সমস্যা হয়নি। সে ভ্রু যুগল কুঁচকে উত্তর দেয়, “ তুমি কি ডিরিক্টলি আমার প্রেম জনিত ব্যাপার জানতে চাইছো?”

মিলি পা নাচানো বন্ধ করে দেয়। মাথা নাড়িয়ে না বোধক ইশারা করে বলে,“ না না না, এমনিই কৌতূহল জাগলো। না বললে নাই। আপনার কথা জানা ছাড়া আমার অনেক কাজ বাকী আছে।”

মিলি উঠে চলে যেতে নিলে রাদিফ তার হাত ধরে বাঁধা প্রদান করে। মিলিকে জোর করে পাশে বসিয়ে বলতে শুরু করে,“ হিমা, আমার ফুফাতো বোন। ছোট বেলা থেকেই তার জন্য আলাদা টান ছিল। সেবার আমাদের বাসায় আসার পর হিমাকে ভালভাবে দেখি। বোকাসোকা মেয়েকে দেখে ভালোও বেসে ফেলি; কিন্তু মীর! আমার বাবার ছোটকালের বন্ধুর ছেলে। ছোলবেলায়ই তার বাবা মারা যায়। মাও কয়েক বছর পর গত হোন। তারপর থেকে বাবাই তার দায়িত্ব নেন। আমাদের বাসায়ই আসা যাওয়া করে। আমার মতো হিমাকে সেও ভালোবাসে। খেয়াল করলাম আমার থেকে বেশিই ভালোবাসে। আমাদের পরিবার অনেক আগে থেকেই তাদের বিয়েও ঠিক করে রেখেছিল।আমরা তিনজনই তা জানতাম না। হিমা যদি মীরকে ভালো না বাসতো তাহলে এতোটাও ধাক্কা খেতাম না।সব সামলে ভাবলাম কিছুদিন ব্রেক নেই। দূরে কোথাও ঘুরে এলে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হবে। সিলেটে পা ফেলতেই সি এন জি করে জৈন্তাপুর সদরে আসি। সেখানে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় সিএনজি ড্রাইভারের কথা মনে পড়ে। একসাথে খাবারও খাই। কিন্তু আমি তো তার মবে খবর জানতাম না! কিছুক্ষণ পর সে কোঁকা কোলার বোতল আমার হাতে ধরিয়ে বলে, ‘ভাইজান, আমাকে খাওয়াইছেন তার বদলে আমিও আপনাকে খাওয়াইতে চাই।’ আমিও সাদামনে গ্রহন করি। কোঁকা কোলা খেয়ে আবারও সিএনজিতে উঠি। তারপর কিছু মনে নেই। তবে মাঝে অনুভব করি কয়েকজন মিলে আমার মাথা পাথরের সাথে আঘাত করে। হয়তো আমার ব্যাগে দামী ফোন পায়নি বলে রেগে আমাকেই মে’রে ফেলতে চেয়েছিল। এরপরই তুমি কীভাবে যেন এলে, আর আমাকে উদ্ধার করলে।”

রাদিফ চলে আসার সময় হিমাকে যা যা বলেছিল তাও বলে মিলিকে। একটি করুণ ঘটনা শুনে আমরা সাধারণত আফসোস করি অথবা কষ্ট পাই। অথচ মিলি হু হা করে হাসছে। হাসতে হাসতে পেটের নাড়িভুড়ি উল্টিয়ে ফেলছে। শেষে হাসতে হাসতে রাদিফের হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে। এতে রাদিফ বরাবরের মতোই বিরক্ত হয়। মিলিকে তার ইচ্ছে করে, রাঙাপানিতে মিলিকে ডুবাতে। এতো কঠিন কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয় তাই স্বভাবগত কাজই করলো। মিলিকে ধমকে বলল,“ মাথায় কী সমস্যা আছে? এতো হাসছো কেন?”

মিলি হাসি থামিয়ে নেয়! পেটে হাসি চেপে উত্তর দেয়,“ মনে হচ্ছে বাংলা সিনেমার কাহিনী বলছেন।আপনি এতো বোকা কীভাবে? লোকে বলল খেতে আপনুও খেয়ে ফেললেন? আমি তো জানি ঢাকার ছেলেরা চালাক ও স্মার্ট হয়। কিন্তু আপনি তো,,,,!
“ আমি কী স্মার্ট নই?”

মিলি কথা ঘুরিয়ে নেয়। সে রাদিফের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করে,“ একপাক্ষিক ভালোবাসা বড্ড যন্ত্রণাদায়ক। আমি যখন স্কুলে পড়তাম বান্ধবীদের দেখেছি। চোখের সামনে একপাক্ষিক ভালোবাসার যন্ত্রণা কতোটুকু অনুভব করেছি। তবে তারা যেহেতু দুজন দুজনকে ভালোবাসে আপনার এত বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়নি। আপনার সেই কথার জন্য যদি তাদের সম্পর্ক ফাটল ধরে তো কি করবেন? নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন?”

রাদিফ চিন্তায় পড়প যায়। এতো গভীরভাবে তো সে ভাবেনি! সে মিলির উদ্দেশ্যে বলে,“ আমার কথা এতো ভাবছো কেন?”

রাদিফের কথায় মিলি থতমত খেয়ে যায়। সে তো এভাবে বুঝাতে চায়নি? কথা ঘোরানোর জন্য বলে,“ বাড়ি ফিরতে হবে, আব্বার কাজ মনে হয় শেষ!”

মিলি কথা শেষ হতেই হাঁটা শুরু করে। পিছন থেকে রাদিফ আবারো বলে উঠে, “ আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে?আগামীকাল ঢাকায় চলে যাবো। আমার পরিবার আছে, তারা চিন্তা করছে।”

মিলির কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে মাথা সায় করে হ্যাঁ বোধক ইশারা করে হাঁটা শুরু করে।
—————————–

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মিলি তার বাবা ছাড়াও অন্য পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মিলির পিছনে রাদিফও শুনতে পায়! ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই রাদিফ অবাক হয়ে যায়। আগন্তুক পুরুষটি রাদিফকে এসে জড়িয়ে ধরে। তার চোখে পানি। মিলি শুধু দেখছে, বাবাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করছে কিন্তু তিনি কিছু বলছেন না। অবশেষে রাদিফ ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলে,“ মীর!”

চলবে ইনশাআল্লাহ……………

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
১৯.

প্রিয় ভালোবাসা,
অভিমান করেছিস তো! যাহ, আজ তোর অভিমান ভেঙে দিব আমার আবেগ জড়ানো পত্রের মাধ্যমে। তোর কি মনে আছে, কবে তোর মনে ভালোবাসার বীজ বুনা শুরু হয়েছিল? কবে তোর মনের ঘাঁটিতে মীরের নৌকা বাঁধা হয়েছিল? আমাকে যদি জিজ্ঞেস করিস তো বলব, একজন সুন্দরীর প্রেমে পড়েছি। তার জন্য প্রথম অনুভূতি ছিলো, একরাশ যন্ত্রণার মতো! এই যন্ত্রণার উৎপত্তি যদি তোর মনে হতো! তাহলে আমাকে বলতি, মীর ভাই আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তুমি আমাকে মে’রে ফেলো। জানিস! আমার প্রতিটি সকাল তোকে নিয়ে শুরু করতে ইচ্ছে করে। গভীর রজনীতে তোকে নিয়ে চন্দ্র বিলাস করতে ইচ্ছে করে। তোকে নিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড় হতেও ইচ্ছে করে। আমার সকল নিশ্বাসে তোকে চাই। তোর মনের সুপ্ত বাসনা জানতে চাই, জানতে চাই তোর মুখের জাদুকরী কথা! ভালেবাসি। তোর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি আছি। দেখি তোর অভিমান কবে ভাঙে। তোর একটা নতুন নাম রাখলাম, হিমালয়! আমার অভিমানিনী। পছন্দ হয়েছে? আমার প্রতি তোর এতো অভিমান দেখে এই নামই মনে এসেছে। আজ এই পর্যন্তই, তোকে নিয়ে লেখলে সময় পাড় হবে কিন্তু আমার কলম বন্ধ হবে না। আমি তোর অপেক্ষায় আছি, হিমালয়।

ইতি
তোর মীর

বিচ্ছেদ, বিষাদ, তিক্ততার মধ্যে নিজেকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করে। অনেক সময় সু’ই’সা’ই’ডে’র চিন্তাও মাথায় আসা। অনেক জীবন তো অকালেই ঝড়ে যায়। আবার অনেকেই জীবন্ত লা’শ হয়ে বেঁচে থাকে। হিমা আজ চারপাশে অন্ধকার দেখছে। মীরের চিঠি পাওয়ার পর থেকে মীর ভাই মীর ভাই বলে বার কয়েকবার চিৎকার করে ডাকছে। আশা মেয়ের উপর নারাজ। মীর চলে যাওয়ার পর থেকে একবারও কথা বলেনি। এমনকি হিমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। কেনই বা কথা বলবে! হিমা কী বুঝে না! এতোটাই বোকা? মীর তো বলেছিল, রাদিফকে খুঁজে আনবে কিন্তু হিমা! সে মীরকে বিশ্বাস করেনি। সে তার মনের অবাস্তব ঘটনা সাজিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেছে। আশা তো তার মেয়ে এমন হোক চায়নি। সে যেমন সাহসী, নিজের মেয়েকেও চেয়েছিল তেমন হোক কিন্তু! আাশা হিমা চিৎকার শুনেও যায়নি। সে জানে মীর রাদিফকে নিয়ে আসবে এবং হিমাকে বুঝিয়ে দিবে, আমরা দূর থেকে যা দেখি তা সত্য হয়না।

বেলা তখন দুপুর এগারোটা। হিমাদের বাড়ির সামনে একটি প্রাইভেট কার এসে দাঁড়ায়। দুইজোড়া পা গাড়ি থেকে নেমে আসে। হাঁটি হাঁটি পা পা ফেলে পা জোড়ার মালিক দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কলিং বেল চেপে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিতেই একজোড়া পায়ের মালিক ঝাঁপিয়ে পড়ে। আশার বিশ্বাস ছিল রাদিফ সুস্থ আছে। হলোও তাই! রাদিফকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বিলাপ করতে থাকে,“ এতোদিন কই ছিলি বাপ! একটা খবর তো দিতে পারতি! তোর চিন্তায় ভাইয়া অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

রাদিফ আশাকে ছেড়ে দুর্বল স্বরে উত্তর দেয়, “ যেখানে ছিলাম সেখানে আধুনিকতার ছোয়া পড়েনি,ফুফু! তাছাড়া এতোদিন চলে আসার মতো অবস্থায় ছিলাম না। বাবা কোথায়?”
আশা প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলবে তার পূর্বেই চোখ যায় পিছনে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের উপর। আশা রাদিফকে ছেড়ে মেয়েটির কাছে যায়। মেয়েটির পা থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলিয়ে মনে মনে ভাবে কে এই মেয়ে? দেখা গেল আশার মুখে কিছু বলতে হয়নি তার আগেই রাদিফ বলে ওঠে,“ ও মিলি, আমার হবু বউ। তোমার কাছে থাকবে। ওকে পড়িয়ে শিখিয়ে মানুষ করো, ফুফু। ও আমার জন্য যা করেছে তা কেউ করবে না।”

রাদিফ এভাবে কথা বলছে! ব্যাপারটা আশার হজম হচ্ছে না। এদিকে মিলিও আশার মতো অবাক। সে বিড়বিড় করে বলে,“ মাথায় আঘাত পেয়ে মনে হয় পাগল হয়ে গেছে।শালা নিজে তো ম’র’বে’ই সাথে আমাকেও মা’র’বে। আমি জীবনেও এমন মিচকে শ’য়’তা’ন’কে বিয়ে করব না।”

মিলির বিড়বিড় বলে কথা বলা আর একজন বৃদ্ধ লোক উচ্চস্বরে কথা বলা একই। আশা মিলির কথা সবটা শুনতে পায়। সে ভ্রু যুগল কুঁচকে মিলির উদ্দেশ্যে বলে, “ কি বললে?”

মিলি ভয়ার্ত চোখে আশার দিকে তাকায়। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মাথা নেড়ে বলে,“ কিছু বলিনি।”

আশা মিলির দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে রাদিফের কাছে এগিয়ে আসে। রাদিফের হাত ধরে বলতে শুরু করে,“ মাথা ঠিক আছে তোর? নিজের বিয়ের কথা নিজে কীভাবে বলছিস?”

রাদিফ মুখ খুলে কিছু বলবে তার আগেই হিমার দুর্বল কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায়,“ রাদিফ ভাই!”

হিমা মীরের চিঠিটা পড়ছিল। তখনই কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পায়। সে ভেবেছিল, হয়তো মীর এসেছে কিন্তু রাদিফের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে সে তাড়াহুড়ো করে নামতে নিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়।

“ আরে পড়ে গেলো রে!” বলে মিলি চিৎকার করে উঠলেও রাদিফ এগিয়ে যায়। হিমাকে ধরে সোফায় এনে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ে। রাদিফ হাঁপাচ্ছে, তার শরীরের দুর্বলতা এখনো কমেনি। সোফায় হেলান দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। মিলি দৌড়ে এসে রাদিফের পাশে এসে দাঁড়ায়। ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে অস্বস্তিকর কণ্ঠে বলে,“ উনাকে একটু খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে ভালে হতো! আসলে দুইটা ঔষধ আছে, যেগুলো খুবই জরুরী।আমাদের জৈন্তাপুরের বড়ো ডাক্তার দিয়েছেন।উনার চিকিৎসা যা ভালো! ম’রা রুগীর বাপ,,,,,!

“ তুমি থামবে?”

মিলির কথার রেলগাড়ী চলতে শুরু করলে আর থামার স্টেশন খুঁজে পায় না। রাদিফের ধমকানোতেই থামে। রাদিফ মিলিকে চোখ রাঙিয়ে হিমার উদ্দেশ্যে বলে,“ বেশি ব্যাথা পেয়েছিস?”

“ নাহ! এতদিন কোথায় ছিলে? আমি তো ভেবেছি তোমার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। এমনকি প্রমাণও পেয়েছি। তাহলে ঐসব কি মিথ্যা ছিল?”

রাদিফ সবাইকে সব ঘটনা খুলে বলে। এমনকি এতোদিন মিলি ও রহিম মিয়ার কাছে যেই সাহায্য পেয়েছে সেটাও বলে। আশা সবটা শুনে হিমার দিকে তাকায়। হিমা যেন ঘোরের মধ্যে অবস্থান করছে। চোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে। সে ভাবছে মীরের কথা। কাঁপা স্বরে রাদিফকে জিজ্ঞেস করে,“ মীর ভাই তোমার খোঁজ পেয়েছে, তাই না রাদিফ ভাই? ”

রাদিফ হ্যাঁ বোধক মাথা ইশারা করে। আশার দিকে তাকিয়ে বলে,“ ঢাকায় ঢোকা পর্যন্ত মীর সাথেই ছিল। হঠাৎ বলল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি। সে আর ফিরেনি। কিছুক্ষণ পর একজন পত্রিকা বিক্রেতা দুইটা কাগজের খাম আমার হাতে তে দেয় এবং বলে, মীর ভাই দিয়েছে। কাগজ বিক্রেতা চলে গেলে দেখতে পাই, একটার উপর হিমার নাম লেখা আরেকটার উপর আমার নাম লেখা।”
রাদিফ কথাগুলো বলে দুইটা চিঠি এগিয়ে দেয়। আশা রাদিফের নামের চিঠি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে,“ আমার দায়িত্ব শেষ। সবধানে বাসায় ফিরিস। প্রতিষ্ঠিত হয়ে মিলিকে বিয়ে করিস আমি তার চোখে তোর জন্য ভালোবাসা দেখেছি। আমাকে খুঁজিস না। হিমাকে দেখে রাখিস।”

আশা চিঠিখানা পড়ে মীর বলে চিৎকার করে ওঠে। বিলাপ করে রাদিফকে সবটা জানায়। রাদিফ হিমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ এটা কি করলি,হিমা। মীরের প্রতি তোর বিশ্বাস ছিলো না! আমি তোকে পছন্দ করতাম কিন্তু মীর তোকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। আমার পছন্দের কাছে মীরের পাগলামো কিছুই না। তুই এটা কী করলি হিমা?”

হিমা রাদিফের হাত থেকে চিঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে নিলে পড়ে যেতে নেয়। মিলি বেগতিক অবস্থা বুঝে হিমাকে ধরতে নিতেই সে বলে,“ আমাকে ধরতে হবে না। আমি যা করেছি তার শাস্তি পেতে দাও। মীর ভাই আমার জন্য কষ্ট পেয়েছে। যাকে ভালোবেসেছি তাকে কষ্ট দিয়েছি। যন্ত্রণা আমাকেও অনুভব করতে দাও। আমার মীর ভাই আসবে, আমি অপেক্ষা করব। সারা জীবন অপেক্ষায় থাকবো। আমি তারই অপেক্ষায় থাকবো। ”

হিমা চলে যেতেই আশা ঘরের দিকে হাঁটা ধরে। মিলি নির্বাক চেয়ে রয়! রাদিফ অসহায়ের সুরে বলে,“ আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না, হিমা!”

চলবে ইনশাআল্লাহ………….