#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নুপূর_ইসলাম
#পর্ব- ০৯
আয়েশা খাটে হেলান দিয়ে বসলো। মাথাটা আজকাল প্রায় সময়ই টিপটিপ করে। শরীরের অবস্থাও বেঠিক। স্কুল থেকে ফিরলেই ছেড়ে দেয়। কিছুই আর ভালো লাগে না। প্রেশারও থাকে সব সময় হাই। আগে গ্যাস্ট্রিক ছিলো, এখন আলসারের দিকে গেছে। হালকা পাতলা খেলেও বুক জ্বালাপুড়া করে। অবশ্য তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই। রোগ ভিতরে ধরেছে বাহিরটা ঝলমলে।
সে খাটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। তখনি দরজায় টোকা পড়লো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে চোখে মুখে বিরক্তি নিয়েই বললো, — দরজা খোলাই! এসো।
বলেই মাথা তুললো। তুলে অবাক ই হলো। রিমি দাঁড়িয়ে আছে। বাবাহ্! সূর্য আজকে কোন দিকে উঠেছে।
সে উঠে বসলো। সে ঠিক জানে। তার মেজাজের পারদ এখন আকাশ ছুঁবে।
রিমি সোজা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সোজা আসলেও তবে দাঁড়ালো বাঁকিয়ে! শরীর আর নজর দুটোই অন্য দিকে। যেন এই দিকে তাকালে অন্ধ টন্ধ হয়ে যাওয়ার চান্স আছে। সে অন্য দিকে তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে ধরলো।
আয়েশা হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, —- এসব কি?
— টাকা।
— সেটা তো আমিও দেখছি।
— তাহলে তো ভালোই।
— ফাজলামি করছো?
রিমি এবার ফিরে তাকালো!
— ফাজলামি করবো কেন? আপনার সাথে কি আমার ফাজলামির সম্পর্ক?
— সেটাই জানতে চাচ্ছি। যেহেতু সেরকম সম্পর্ক নেই। এসবের মানে কি?
— আমি এখানে থাকছি, খাচ্ছি একটা খরচ তো অবশ্যই আছে। যেহেতু চাকরি করছি। তাই আমি চাচ্ছি কিছুটা হলেও দিতে।
— কেন?
— যাতে আপনার বোঝা মনে না হয়।
— টাকা দিলেই যে মনে হবে না, এটা ভাবছো কেন?
রিমি চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার চোখে পানি এসেছে। সে ভেতরে ভেতরে চেষ্টা করলো পানি ফেরানোর। এটা অবশ্য সে খুব ভালো পারে। লাস্ট বার কবে তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়েছে তার মনে পরে না।
সে ঠিক করেছে সে কাঁদবে না। যারা তাকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য অবশ্যই না। তার কাছে তার চোখের পানি মূল্যবান। তার যখন কোন প্রিয় মানুষ হবে, সে একমাত্র তার জন্যই কাঁদবে।
সে আবার তাকালো! এবার আর চোখে পানি নেই। শুষ্ক, প্রাণহীন। তাকিয়েই তেজের সাথে বললো, — আপনার কিছু মনে হওয়া না হওয়াতে আমার কিছু আসে যায় না । বলেই এগিয়ে বেডটেবিলের উপরে টাকা ঠাস করে রাখলো। রেখে যেতে নিলো।
আয়েশা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ডাকলো — রিমি…
রিমি ফিরে তাকালো।
— এগুলো নিয়ে যাও।
রিমিও তার মতোই কঠিন ভাবে বললে — না।
— তুমি কি জানো? তুমি রাগি, জেদি আর অসম্ভব বেয়াদব একটা মেয়ে।
— জানি। মা, বাবা ছাড়া এতিম সন্তান। এরকম হবো এটাই তো স্বাভাবিক। বাবা, মার ছায়ায় থাকলে অবশ্যই আপনার মতো সভ্য, ভদ্র, নম্র হতাম।
আয়েশা মনে মনে রাগ দমানোর চেষ্টা করলো। সে ভালো করেই জানে এই মেয়েকে কিছু বলে লাভ নেই। একবার যেহেতু বলেছে টাকা দেবে, সে দেবেই।
তার বাবাও মাসে মাসে তার জন্য টাকা পাঠায়। প্রথম প্রথম নাম মাত্র দিলেও এখন ভালোই দেয়। এই মেয়ে যখন থেকে বুঝেছে তখন থেকে আর ঔ টাকায় হাত দেয় না। এমনকি কাউকে দিতেও দেয় না। ব্যাংকে জমা হতে হতে এখন বিশাল একটা এমাউন্ট হয়েছে।
তবুও এই মেয়ে নির্বিকার। মা একবার জোর করেই কিছু টাকা তুলল। এই মেয়ে গায়েব। গায়েব তো গায়েব। তিন দিন পরে তাকে পাওয়া গেলো আমাদের দু- তিন গ্রাম পরে এক মসজিদের পাশে। এক ভিক্ষুকের সাথে। এলোমেলে চুল, ধুলো বালিতে ফ্রক মাখামাখি।
সে আসবে না, আসবে না মানে আসবে না। ভিক্ষুকের পা ধরে এই চিৎকার, সে মরে গেলেও ঐ বাসায় আর যাবে না। কি যে একটা অবস্থা। এর পরে কেউ আর ভুলেও ঐ টাকায় হাত দেয়নি। বাবা জীবিত থাকতেই এমন ভাবে ব্যবস্থা করে রেখেছেন, যেন রিমি ছাড়া ঐ টাকা আর কেউ তুলতেও না পারে।
আর এখন আবার এই টাকার লোভেই তার মা, ভাবিরা যেই মেয়ের দিকে কখনো ফিরেও তাকায়নি, তাকেই ছেলের বউ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এখন তো আর রিমি ছোট না। যে রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে যাবে। তাই লেখাপড়া বাদ দিয়ে এমন এক চাকরি নিয়েছে। যে অনায়াসেই সে ওই বাসায় থেকে বের হতে পারে। কারণ সে ভালো করেই জানতো। লেখাপড়া শেষ হোক আর না হোক। জোর করে হলেও তাকে বিয়ে দেওয়া হতো।
তবে ভাগ্য এই মেয়ের বরাবরি খারাপ। বের হয়েও হতে পারেনি। পোষ্টিং পড়েছে তো পড়েছে, এখানে। তাই না চাইতেও তাকে এখানে থাকতে হচ্ছে।
আর সে ভালো করেই জানে। সুযোগ পেলেই যে কোন সময় এই মেয়ে তার পোষ্টিং অবশ্যই চেঞ্জ করবে।
আয়েশা আবার চোখ বন্ধ করলো । করে খাটে মাথা রেখে আস্তে করে বললো, —- তোমার ভাগ্য ভালো তুমি আমার মেয়ে না। আমার মেয়ে হলে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মেরে তোমার সব ঠং আমি বের করে ফেলতাম।
রিমিও নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো —- সে ভাবে বলতে গেলে আপনার ভাগ্যও ভালো।
আয়েশা আর কিছু বললো না। আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
রিমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এই স্নিগ্ধ, কোমল মুখটা তাকে টানে। খুব টানে। এই যে এখন ইচ্ছে করছে, এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। অথচো এই পাষাণ মহিলার তাকে দেখে কখনো এরকম ইচ্ছে হয়নি, মায়া হয়নি। তার তো কোন দোষ ছিলো না। তবুও পুরো দুনিয়া মিলে তাকেই শাস্তি দিয়েছে।
রিমি আর দাড়ালো না। হনহনিয়ে বেড়িয়ে এলো। তার চোখে আবার পানি আসছে। ধুর, এতো কিছু আবিষ্কার হচ্ছে। এই চোখের পানি নিয়ে কেউ কিছু করছে না কেন? অনন্ত একটা সুইচ তো আবিষ্কার করাই দরকার। ইচ্ছ হলো না অফ, আবার ইচ্ছে হলো অন।
রিমি ব্যাংকের ভিতরে এসে ছোট খাটো একটা ধাক্কা খেলো। ওলীদ আশফাক বসে আছে। দক্ষ হাতে টাকা দিচ্ছে, নিচ্ছে। সে এই ব্যাংকে চাকরি করে নাকি?
ওই দিনের পরে আর কথা হয়নি। না লোকটা তাকে ফোন দিয়েছে, না সে। রিমি ভেবেছিলো ফোন দিয়ে দিয়ে বিরক্ত করবে। তবে এমন হয়নি। আর পার্সটাও নেওয়া হয়নি। এখনও এই লোকের কাছে। কিছু টাকা ছাড়া ব্যাগে অবশ্য তেমন কিছু ছিলো না। তাই রিমির ওতো আগ্রহও নেই।
ওলীদও রিমিকে দেখলো। দেখে হালকা হাসলো! রিমি ধাক্কা খাওয়াটা সে বুঝেছে। অবশ্য খাওয়ারই কথা।
রিমি অন্য দিকে তাকালো। সে এসেছে একটা একাউন্ট খুলতে। বেতন টেতন পাচ্ছে। রাখার ও তো একটা জায়গা চাই। খরচ করার মতো তো তার কেউ নেই।
সাথে এসেছে নাদু মামা। রিমি অবশ্য নিজেই বলেছে। নাদু মামা খুশি মনে চলে এসেছে। এসে নিজে থেকেই সব করছে। রিমি দাঁড়িয়ে আছে এক সাইডে। আজ রবিবার তাই একটু ভীর বেশি। মুহুয়া আন্টি অবশ্য সাব্বির ভাইয়ের কথা বলেছিলো।
সে শুনেও শুনেনি। পরের কথা আর কি বলবে সে। তার নিজেরই হাব ভাব ভালো না। কোন সময় আবার অঘটন উঘটন ঘটিয়ে ফেলে কে জানে। তাই তো লোকে বলে আগুন আর ঘি এক ঘরে রাখতেই নেই। কখন না জানি ধপ করে জ্বলে উঠে। তাদের দুজনেরও জ্বলার সম্ভবনা আছে।
সাব্বির ভাই অবশ্য স্বাভাবিক। সে আগের মতোই আছে। মাঝে মাঝে ফিরতে রাত হলে নির্বিকার ভাবে দরজা খুলছে। টুকটাক কথা বলছে। পরিষ্কারগির পরিষ্কারের এডভাইসও দিচ্ছে।
সেই দিন যে পা দিয়ে ঠোকাঠুকি হলো। পা দিয়ে চেপে ধরে আরামছে বিরিয়ানি খেলো। সে ব্যাপার নিয়ে তার মধ্যে কোন হেলদোল দেখা গেলো না। অবশ্য না দেখাই স্বাভাবিক। দেখতে হ্নিতিক রোশান। কতো মেয়ের সাথে ঠোকাঠুকি করেছে কে জানে।
কিন্তু রিমি। সে তো উথাল পাথাল। সে কি জীবনে কারো সাথে ঠোকাঠুকি করেছে? এমন না সে প্রেমের প্রোপজাল পায়নি। কিন্তু মন সায় দেয়নি। এখনো যে দিচ্ছে তা না, তবে এই বিশ্বসুন্দরা সামনে আসলে ই কেমন জানি সে ঘোরের মধ্যে চলে যায়।
সবই রুপের খেল বাবু ভাইয়া, সবই রুপের খেল। হুহ্! তা না হলে সেই প্রথম থেকে এমন হচ্ছে কেন? এই যে সে ভাইয়া বলে। এই বাবা পরিষ্কারগির কি জানে? তখন রিমির গলা কাঁপে, বুক ফাটে । আহারে! অথচো এগুলো হওয়ার কথাই নেই। সমীকরণ হওয়ার কথা সোজা। একদম সোজা।
তখনি নাদু মামা বিরক্ত মুখে তার সামনে আসলো। এসে বললো —- আজকে আসাই ভুল হয়েছে বুঝেছো। দুনিয়ায় ভীর। কতোটাকা যে মাইনষের হইছে। একাউন্ট খোলার জন্যও লাইন ধরা লাগে।
রিমি হালকা হাসলো। হেসে ওলীদের দিকে তাকালো। সে তার জায়গা থেকে উঠেছে। যেই স্যার একাউন্ট খুলছে। তার পাশে গিয়ে কিছু বললো। বলে আবার নিজের জায়গায় গেলো। আজকে দুনিয়ায় কাস্টমার। কোন অফিসারেই দম ফেলার সময় নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ডাক পড়লো। তারা দু-জনেই এগিয়ে গেলো। তারা যেতেই স্যার বিনয়ের সাথে বসতে বললো। তারপর হেসে বললো, — আপনারা ওলীদ ভাইয়ের রিলেটিভ, আগে বলবেন না। বলেই পিয়নকে চা দিতে বললো ।
নাদু মামা হা হয়ে গেলো। বলে কি? সে রিমির দিকে চেপে চাপা সুরে বললো, — ওলীদ কে?
রিমি স্বাভাবিক ভাবেই বললো —- আমি জানি না মামা।
— তাও কথা, জানবে কি করে। আসলেই তো দু- দিন। মনে হয় অন্য কাউকে মনে করেছে।
রিমি কিছু বললো না। ওলীদের দিকে তাকালো । তাকাতেই চোখাচোখি হলো।
— থাক কিছু বলার দরকার নেই। যা মনে হয় করুক। আমাদের কি? আমরা তো আর সেধে আসিনি।
রিমি মাথা দোলালো! পিয়ন চা নিয়ে আসলো। নাদু মামা এক গাল হেসে চা এগিয়ে নিলো। সেধে কপালে এসেছে ফেলবে কেন?
ব্যাংক থেকে রিমি সোজা থানায় আসলো। এসে অবাক হলে। থানায় দুনিয়ার লোকের ভীর। সে ডানে বামে তাকালো না। সোজা ভিতরে চলে এলো। কোন নেতাকে নাকি মাদক মামলায় আটক করা হয়েছে। তার চাঙ পাঙরা থানা ঘিরে রেখেছে। এই সব আর নতুন কি। কোর্টে চালান না করা পর্যন্ত এই সব চলতেই থাকবে। সে তার জায়গায় গিয়ে বসলো। বসতেই তার মোবাইলে মেসেজ আসলো।
— কেমন আছেন রিমি?
রিমি মেসেজ সিন করলো না । এখন হাতে দুনিয়ার কাজ। সিন করলো রাতে বাসায় ফেরার পথে।
— ভালো। আপনি?
সাথে সাথেই সিন হলো।
— এতোক্ষণ ছিলাম না। তবে এখন মনে হচ্ছে খুব ভালো আছি।
রিমি কেন লিখতে গিয়েও লিখলো না। উত্তর কি আসবে সে জানে। সে লিখলো, — থ্যাংকস।
— কেন?
— রিলেটিভ হয়ে গেলাম। সেই রিলেটিভের অধিকার নিয়ে সুবিধা ভোগ করলাম তাই।
— হা.. হা.. হাসি এলো। সাথে লেখা, মোস্ট ওয়েলকাম ম্যাডাম।
রিমিও হালকা হাসলো।
— আমার পার্স।
— সেটা আর পাচ্ছেন না।
— কেন?
— আমাদের এক সাথে এখনও লাটে টেষ্ট করা বাকি রিমি । আর বিলিভ মি আমি সে সময়টার জন্য খুব আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছি।
রিমি আর উত্তর দিলো না। মোবাইল অফ করে রেখে দিলো। আজকে সারাদিন সূর্য উঠেনি। হঠাৎ করেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। রাতের রাস্তা, ঘাট, আকাশ সবকিছু অন্য রকম অন্ধকারে ঘিরে আছে । ঘন কুয়াশা চারিদিকে। এই ঘন কুয়াশাকে তার কাছে বিষন্নতা মনে হলো। যেন চাদরের মতো গায়ে লেপটে আছে। সে সেই লেপটে থাকা চাদরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
চলবে…….