#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৭
রিমির আজ ভাগ্য ভালো। বাড়ি থেকে বের হতেই সে রিকশা পেলো। যাক আর হাঁটতে হবে না। সে খুশি মনে উঠে বসলো। সে বসতেই তার সাথে সাব্বিরও হুট করে উঠে বসলো। বসে রিকশাওলাকে তাড়া দিয়ে বললো,— ভাই পারলে উড়িয়ে নিয়ে যান। তবে দশ মিনিটের মধ্যে ভার্সিটির সামনে থাকা চাই। বলেই রিমির দিকে কঠিন চোখে তাকালো।
আজকে টিচার্স মিটিং আছে। ডাবল ডাবল গোসল আর ডাবল ডাবল রেডি হতে দেরি হয়ে গেছে। তার এই কয়েক বছরের চাকরি জীবনে সব কিছুই ছিলো পারফেক্ট। কখনো কোন ক্লাস মিস বা লেট হয়নি। কিন্তু এই ফাজিল মেয়ে তার জীবনে এসেছে পর থেকে সব এলোমেলো।
রিকশা চলতেই রিমি সাইডে চাপতে চাপতে বললো, — যাবেন ভালো কথা, বললেই তো হয়। এভাবে ঠেলে ধাক্কিয়ে উঠার মানে হয়? উঠেছেন তো উঠেছেন আবার ড্রাকুলামার্কা লুকও দিচ্ছেন। সমস্যা কি?
সাব্বির উত্তর দিলো না। বিরক্তমুখে বসে রইলো। কব্জি উলটিয়ে একবার সময় দেখলো।
রিমি মুখ বাঁকালো। না বললে নেই। ঢং.. তখনি সাব্বির শান্ত কন্ঠে বললো, —
— আশিকের সাথে কাহিনী কি?
— কাহিনী তো কতো কিছুই, কোনটা জানতে চাইছেন?
— বিয়ে নাকি ঠিক?
— আমিও সে রকমই শুনছি, তবে শিওর ভাবে বলতে পারছি না।
সাব্বির রিমির দিকে ফিরলো। তার চোখে মুখে রাগ।
— আরে রাগ দেখাচ্ছেন কেন? নাকি বিশ্বসুন্দরা হয়েছেন বলে শুধু আপনিই বিয়ে করবেন। মানছি দেখতে আপনাদের মতো সুন্দর না। তাই বলে আমাদের বিয়ের অধিকার নেই?
সাব্বির উত্তর দিলো না। সে অন্য পাশে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ ধমালো। এই মেয়েটাকে সে শিক্ষা দেবে। উচিত শিক্ষা। সব জেনে বুঝে যে যে টর্চার তার সাথে করছে, হিসেব করে কড়ায় গন্ডায় সব শোধ করবে। এখন শুধু সঠিক সময়ের বাকি।
রিমিও আর কিছু বললো না। আজকাল তার সময় খুবই ভালো যাচ্ছে। এই যে নায়ক সাহেবের সাথে এক রিকশায় যাচ্ছে। এটা কি সে কখনও ভেবেছে? ইশ! ভাবার কথা মনে হতেই তার কালকে রাতের কথা মনে পড়লো। ওটা কি ছিলো? সারা রাত গেছে তার নির্ঘুম, ছটফট করতে করতে । আর এনাকে দেখো কোন হেলদোলই নেই। যেন রোজ রাতে আমার এটো করা খাবার খেয়েই সে ঘুমোতে যায়।
তখনি তার মোবাইলে কল আসলো। ওলীদের ফোন! সে জানতো সকাল হলেই আসবে। সে রিসিভ করতে যাবে, তখন সাব্বির নিরুউত্তাপ কন্ঠে বললো, — ফোন রিসিভ করলে ধাক্কা মেরে রিকশা থেকে ফেলে দেবো।
রিমি রিসিভ করলো না। ঠোঁট টিপে হেসে বললো, — অন ডিউটি অফিসার কে রিকশা থেকে ধাক্কা, এটেম টু মার্ডারারের কেস খেয়ে যাবেন।
— অন ডিউটিতে থেকে প্রেম করে বেড়াচ্ছো, তাতে দোষ নেই?
রিমি হাসলো! কিছু বললো না।
সাব্বির ঘুরে রিমির দিকে আবার তাকালো। মেয়েটা হাসলে তার সাথে চোখও হাসে। কেমন ঝিলমিল করে। সেই ওই ঝিলমিল করা চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, — তোমার সাথে আমার কথা আছে।
— থাকলে বলুন! আমি কি বলেছি কথা বলতে গেলে আলাদা ভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।
— আমার সাথে একদম হেঁয়ালি না রিমি। তুলে আছাড় মারবো।
— আমাকে কি অবলা নারী টাইপ মনে হয় নাকি?
— না! সেটা আমি ভুলেও মনে করতে পারি না। যা যা করছো তুমি।
— কি করেছি আমি?
সাব্বির এবার হাসলো! হেসে বললো,— নেক্সট টাইম যদি আমার উপরে কিছু ছুঁড়েছো। গোসল আমি একা করবো না, মনে রেখো।
রিমি ঢোক গিললো! গিলে কিছুই বুঝেনি এমন ভাবে বললো, —ভালো তো! পুরো গুষ্টিতে নিয়ে করেন। আমাকে বলছেন কেন?
— যাকে নিয়ে করবো তাকেই তো বলবো।
— আচ্ছা! আপনি বললেন, ওমনি আমি নেচে নেচে যাবো। এতো সোজা?
— না! যেই মেয়ে জিন্সের উপরে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়। সে আর যাই হোক সোজা না।
— কেন? লিখিত কোন সংবিধান আছে নাকি, যে পেটিকোটের সাথেই শাড়ি পরতে হবে?
— না! সে রকম লিখিত নেই। তবে জিন্স কেন পরো আর পকেটে কি নিয়ে ঘুরো সেটা আমি জানি বলেই বলছি।
— সেই দিন আমি একটা মিশনে ছিলাম।
সাব্বির আবারো হাসলো! রিমির মুখের দিকে একটু ঝুকলো। তারপর বললো, —- আর এখন? পকেটে হাত দেবো?
রিমি উত্তর দিলো না। শুধু তাকিয়ে রইলো।
সাব্বির চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে সোজা হয়ে বসলো। এক নাম্বারের ফাজিল! এর আশে পাশে থাকলে সে নিজেও কেন জানি ফালিজের কাতারে অনায়াসেই দাঁড়িয়ে যায়।
ভার্সিটির সামনে আসতেই সাব্বির রিকশা থেকে নামলো। নেমে শান্ত ভাবে বললো, —- সব পুরুষ মানুষই অমানুষ না রিমি। এখন তুমি বড় হয়েছে। দুনিয়া বুঝতে শিখেছো। আশা করি এতোটুকু অন্তত তুমি বুঝবে।
রিমি সে কথার ধারের কাছেও গেলো না। সে মুখ ফুলিয়ে বললো, — ভাড়া কে দেবে? শেয়ারে এসেছেন হাফ হলেও দিয়ে যাবেন।
সাব্বির ও সমান তালে বললো — সেই দিন হসপিটালে তোমার প্রাণ প্রিয় ব্যাংকুকে কে দেখতে গিয়েছিলে। দিয়েছিলে ভাড়া?
রিমি ভেংচি কাটলো! কেটে রিকশাওলাকে যেতে বললো। সাব্বির হাসলো। তার দেরি হচ্ছে তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। রিকশাটা যতোক্ষণ দেখা যায় সে তাকিয়ে রইলো।
রিমি থানায় এসেই শামীম স্যারের খোঁজ করলো। আজকে নাকি সকালেই এসেছে। অবশ্য খোঁজ করে লাভ হলো না। তিনি এসে আবার চলেও গেছেন। মিথিলা শুনে ভ্রু নাচিয়ে বললো, —- কি ব্যাপার রিমি? ইদিনিং শামীম স্যার, শামীর স্যার বেশি করছো। ব্যাপার কি? আবার দেখি সেও তোমার খোঁজ খবর নিচ্ছে।
রিমি হাসলো! সে কিছু ফাইল চেক করছিলো, পুরোনো। বড় স্যার খুঁজতে বলেছে। কি করবে কে জানে। সেখানে চোখ রেখেই বললো, — স্যার এতো সকালে থানায়, আবার চলেও গেছে। কোন সমস্যা ম্যাডাম?
— আরে না, কি সমস্যা? তবে শুনলাম আরেকটা নাকি বডি পাওয়া গেছে। অবশ্য আমাদের থানার এরিয়াতে না। সেম বেসিককে ম্যার্ডার। কোন হাতা পায়ের চিহ্ন নেই। শুধু গলাটা গভীর ভাবে কাটা। তাই স্যার একটু জানতে গেছেন কোন যোগসূত্র আছে কি না।
রিমি থেমে গেছে। তার চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ। সে বিষন্ন মুখে বললো — একটা মানুষেকে খুন করা হবে। কোন হাত বাঁধা নেই, পা বাঁধা নেই। তার মধ্যে একটু ভয়, একটু চঞ্চ্যলতা নেই। যেন নিজেই এসেছে। এটা কিভাবে সম্ভব ম্যাডাম?
মিথিলা হাসলো! হেসে বললো, কেইস সলভ না হওয়া পর্যন্ত সবই সম্ভব। একেক টা কেস একেটা মিস্ট্রি বক্স। আর পুলিশ হচ্ছে সেই মিস্ট্রি বক্স খোলার হাতিয়ার। সো ওয়েট এন্ড ওয়াচ। এই পৃথিবী সব হজম করা গেলেও খুন করে কেউ হজম করতে পারেনি। আজকাল শাস্তি হয়না ঠিক আছে, তবে হজম কেউই করতে পারে না। যতোই পর্দা ফেলো একদিন না একদিন সেটা উঠবেই।
রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো । এই থানার এরিয়াটা বড়। আশে পাশে গাছগাছালিতে ভরা। সেই গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে সকালের সোনালি রোদ ঝিকিমিকি করছে।
সে উঠে দাঁড়ালো! সেখান থেকে বের হয়ে একটু সাইডে আসলো। এই প্রথম বার সে ওলীদকে নিজেই ফোন দিলো।
ওলীদ ফোন ধরেই গলায় খুশির আমেজ নিয়ে বললো, — বোরিং এই সকালটা হঠাৎ করেই এতো মিষ্টি করার জন্য ধন্যবাদ রিমি।
রিমির মধ্যে অবশ্য কোন আমেজ দেখা গেলো না। সে স্বাভাবিক ভাবে বললো — কি করছেন?
— যা সব সময় করি?
— ডিস্টার্ব করলাম নাতো?
— এরকম ডিসস্টার্ব মাঝে মাঝে করতেও তো পারো।
— আমি বিকেলে ফ্রি থাকবো।
ওলীদ হাসলো! মেয়েটা একটু ভান টানও পারে না নাকি? সব সময় কাট কাট করে কথা। তবুও এই ভানহীন, ঢংহীন মেয়েটার সাথে কথা বলেতে এখন তার মনের যতো অস্থিরতা।
সে হেসেই বললো, — যেখানে আমাদের প্রথম দেখা সেখানেই আমি অপেক্ষায় থাকবো মিষ্টি মেয়ে রিমি।
রিমি এবার হাসলো! হেসে বললো, — বাথরুমে ?
ওলীদের ভ্রু কুঁচকে গেলো —- মানে?
— উহু! আপনাকে না। রুমেল স্যার জিজ্ঞেস করছিলো, মিথিলা ম্যাডাম কোথায়?
— ও আমিতো ভাবলাম না জানি কি?
— কি আর হবে। যাক রাখছি। তাহলে বিকেলে দেখা হচ্ছে।
— হুম।
রিমি ফোন রাখলো। রেখে আবার আসলো। মিথিলা ম্যাডাম তার জায়গায় বসেই আয়েশ করে সিঙ্গারা খাচ্ছে। তাকে দেখে একগাল হেসে বললো, — খাবে নাকি রিমি?
রিমি হালকা হাসলো। হেসে না বোধক মাথা নাড়ালো। নাস্তার পরে এক দু- ঘন্টার মধ্যে তার কিছু খেতে ভালো লাগে না।
রিমি কফি হাউজের ভেতরে আসতেই ওলীদকে চোখে পড়লো। সেম টেবিল, সেম চেয়ারে সে বসে আসে। গায়ে সাদা টির্শাট, উপরে জ্যাকেট। সে বসে আছে আনমনে। রিমিকে এখনো দেখেনি, দৃষ্টি বাহিরে। সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। রিমি এগিয়ে গেলো। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, — স্যরি দেরি হয়ে গেলো।
ওলীদ রিমির দিকে ফিরে তাকালো। তাকিয়ে রিতিমতো ঝটকা খেলো। এতোদিনের চেনা রিমির সাথে আজকের রিমির কোন মিল সে খুঁজে পেলো না। গায়ে তার হালকা বেগুনি রংয়ের থ্রিপিস। চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, আর সবচেয়ে বড় কথা রিমির চুল। ” মাই গড! রিমির চুল এতো লম্বা নাকি? “প্রায় কোমর ছুঁয়ে আছে।
এই মেয়ে সব সময় থাকে শীতে প্যাকিং হয়ে । মেয়েদের মতো ওতো হাবভাব ও নেই। তবে আজ কি হলো? ওড়না কাঁধে গুছিয়ে রাখা, তার উপরে সুন্দর মার্জিত হালকা কারুকাজের একটা চাদর। সেটাও পরিপাটি সুন্দর করে নেওয়া ।
ওলীদের মুখ আপনা আপনি হা হয়ে গেলো। রিমি কি নিজেকে আজ আয়নায় দেখেছে?
রিমি হাসলো! হেসে বললো, —- একা একা খাচ্ছেন। আমার লাটে কই?
ওলীদও হাসলো! সে আছে একটা ঘোরের মধ্যে। এটা স্বপ্ন না বাস্তব সে বুঝতে পারছে না। আচ্ছা সে কি রিমিকে একবার বলবে, ” একটা চিমটি কাটো তো প্লিজ। অবশ্য সাহস হলো না। সে ঢোক গিলে ঘোর নিয়েই বললো,
— সেটা আমি তোমাকে টেষ্ট করাবো না।
— কেন?
— থাকুক না কিছু একটা বাকি।
— তাহলে আর আপনার আশায় থাকা যাবে না।
— তুমি হাজার বার কিনে খেতে পারবে, তবে আমারটা আমারই থাকবে।
— আচ্ছা….
— হ্যাঁ।
— আর আমার ব্যাগ।
— সেটাও থাকুক।
— সেখানে আমার তিনহাজার চারশ পঁয়ষট্টি টাকা আছে যখন দেবেন সুদ সহকারে ডাবল করে দেবেন।
ওলীদ হো হো করে হাসলো। হেসে বললো, — আমি ব্যাংকে চাকরি করি, ব্যাংক তো না।
— আমি কি জানি। রেখেছেন যখন ভরপাইতো করতেই হবে।
— আর আমারটা?
— কি আপনারটা ?
— ধ্যান, জ্ঞান, শান্তি, ঘুম, হ্নদয় সব ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছো। সেগুলো কি আমি ডাবল করে ফেরত পাবো?
রিমি সোজা ওলীদের চোখের দিকে তাকালো। তার মধ্যে কোন অস্বিস্তি বা জড়তা দেখা গেলো না। তার ঠোঁটের কোণে মুঁচকি হাসি। সে সেই হাসি নিয়ে রহস্য মাখা কন্ঠে বললো, —- আমিতো নিচ্ছি না। আপনি নিজে নিজেই সেঁধে দিচ্ছেন। তাই এখানে আমার কোন দায় নেই। যা হচ্ছে, যা হবে এর সব দায় আপনার ।
চলবে…….
#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৮
রিমি বাসায় ফিরতেই দেখলো ড্রয়িংরুমে সবাই গোল মিটিং করছে। গোল মিটিংয়ের ওয়ান এন্ড ওনলি রিজেন, কালকে আয়াশের জন্মদিন। মোটামুটি ভালোই আয়োজন হবে। সেই আয়োজন নিয়েই সবাই আনন্দে আটখানা হয়ে আছে।
আর তাদের আটখানা আনন্দের মধ্যে একমাত্র আশিক ভাই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। হাতে তার পাস্তার প্লেট। পাশেই নিপা! সে বসে বসে যত্ন সহকারে আঙ্গুলে ওড়না পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রোল বানাচ্ছে। বেচারা আশিক ভাই, সিঙ্গেল আর ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে?
সে ঠোঁট চেপে হাসলো! হাসতেই আশিক তার দিকে কটমট করে তাকালো। আজবতো এখানে তার দোষ কি? সে বলেছে? আসো! এসে নিজ দায়িত্বে হালাল হও। ঢং বলেই সে আর সেই দিকে গেলো না। সোজা উপরে চলে এলো। চেইঞ্জ করে আবার থানায় যেতে হবে।
সে রুমে যেতে গিয়েও থেমে গেলো। সাব্বির ভাই বারান্দায় দাঁড়ানো। তার হাতে মোবাইল। সে ঘুরে সেই দিকে গেলো। এতো কষ্ট করে সুন্দর করে সাজলো। সৈয়দ বাড়ির বড় পুত্রকে একটু দেখাবে না তা কি করে হয়।
রিমি পাশে দাঁড়াতেই সাব্বির বুঝলো, তবে চোখ তুলে তাকালো না। মোবাইলে চোখ রেখেই বললো, — কোন দরকার?
— উঁহু।
— তাহলে?
— একটু দেখাতে আসলাম।
— কি?
— রিমিকে।
সাব্বির হালকা হাসলো! রিমি যে সেজেগুজে বের হয়েছে সে জানে। বাসায় আসতেই হাসি খালা তার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছে। প্রথমে তার এতো রাগ হলো। পরক্ষণেই মনে হয়েছে, সে এমন বাচ্চামো করছে কেন? এখন কি তার এমন বাচ্চামোর বয়স?
সেই দিন হসপিটালে লোকটার সাথে স্বাভাবিক আচরণের প্রয়োজন ছিলো। অথচো সে হয়েছে জেলাস। জেলাস হয়ে মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে। রিমিকে তার ভালো লাগছে। কেন লাগছে সে জানে। সেই ঘটনার পর থেকে রিমির প্রতি তার একটা সফট কর্নার ছিলো। এতোদিন পরে এভাবে সামনে আসায়, সেটা ধীরে ধীরে অন্য দিকে বাঁক নিয়েছে।
রিমি আর তার মধ্যে কোন কমন টাইপ ব্যাপার নেই। তার স্বাভাবের উল্টো এই মেয়ে। তবুও এই মেয়ে তাকে টানছে, বলতে গেলে ভালোভাবেই টানছে। বিপরীত আর্কষণ বলে একটা কথা আছে। তার ক্ষেএে হয়ত তাই’ই হয়েছে।
ওই যে প্রথম দরজা খুললো। ঘুম ঘুম চোখের এক রমনীকে দেখলো। কিছু একটা হলো। ম্যাজিকাল! বিনা কারণে অনেক দিন পরে তার নির্ঘুম রাত কাটলো। অথচো এরকম হওয়ার কোন কারণ ছিলো না।
তার আর আনিকার সম্পর্ক ছিলো স্কুল থেকে। তবে সেটা ছিলো বন্ধুত্ব। তাকে আনিকায়’ই প্রপোজ করেছিলো। রিজেক্ট করার কারণ ছিলা না। আনিকা আর তার স্বভাব বলতে গেলে একই। তার মধ্যে ছোট বেলার বন্ধুত্ব। আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও ভালো।তবে সব ভালোর মধ্যেও কিছু একটা মিছিং ছিলো। হয়তো দু- জনের তরফ থেকেই। এটা আনিকা বুঝেছিলো। হয়তো সেও! তবে সে সম্পর্ক টা শেষ করতে চায়নি, তবে আনিকা চেয়েছিলো।
অবশ্য অন্য সব মেয়েদের মতো সম্পর্কটা তিক্ততায় শেষ করেনি। তার দু- টো হাত ধরে বলেছিলো,
” এই সম্পর্কটা আগালে সম্পর্কতো শেষ হবেই সাথে আমাদের বন্ধুত্বটাও। এটা আমি হারাতে চাই না সাব্বির। দু- জন ভালোবাসার মানুষের মাঝে সব থাকতে হয় ভালোলাগা, ভালোবাসা, রাগ, অভিমাণ, জেদ, জেলাস, কম্প্রোমাইজ সব। আমরা দু- জন দু- জনকে তো পেয়েছি। তবে আমার মনে হয় এর মধ্যে অনেক কিছুই পাইনি।
তখন সাব্বির কিছু বলে নি। অবশ্য বলার মতো কোন শব্দ তার কাছে ছিলোও না।
আনিকা হেসেছিলো। তার গালে হাত রেখে বলেছিলো, — ভালোবাসার সবচেয়ে সুন্দর সাইড কি জানো? এলোমেলো হওয়া। নিজের স্বভাবের বাইয়ে যাওয়া। যা কখনো করোনি, ভালোবাসার মানুষটার জন্য হুট হাট সেগুলো করে ফেলা। আমি দোয়া করি তোমার জীবনে সেই এলোমেলো হওয়াটা আসুক। আমাদের জীবনতো একটা। যদি একটু নিয়মের বাইরে গিয়ে ভালোই না বাসলাম তো কি করলাম। আমার আর তোমার বিয়ে হলে আমরা রোবট হয়ে যাবো সাব্বির। লোকে দেখবে পারফেক্ট কাপল, পারফেক্ট লাইফ। বছরের পর বছর এক ছাদের নিচে এভাবেই কেটে যাবে। তবে ভেতর থেকে আমরা হবো শূণ্য। সেই জীবনে আনন্দ থাকবে না, সুখ থাকবে না। শুধু নিয়ম মাফিক চলে যাবো। সম্পর্ক টা থাকবে শুধু নামের। আমি জানি! তুমি আর আমি যে একই।
তবে ঐ যে বললাম, এলোমেলো হওয়া। আমরা দু-জনই কারো জন্য এলোমেলো হয়নি, আর হবোও না, যদি হওয়ার হতো এতোদিনে অবশ্যই হয়ে যেতাম। এটা নিজ ইচ্ছায় বা প্ল্যান মাফিক হয় না সাব্বির। ব্যস হয়ে যায়। ঐ যে ছু মন্তর ম্যাজিকের মতো।
সাব্বির মনে মনে হাসলো! সত্যিই ম্যাজিকের মতো! এই যে বিনা নোটিশে সে নিজেই হয়ে গেছে।
সে বোরিং টাইপ মানুষ। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের ফলে সব জায়গায়ই এটেনশন পেয়েছে। প্রচুর বন্ধু বান্ধব ছিলো। তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাও কম নয়। সবাই তার জন্য সব ছাড়তে চেয়েছে। তাকে পাবার আঙ্কাখা করেছে। এখনও করে। এমনকি ভার্সিটির সব মেয়েদের আড্ডায় তার নাম একবার হলেও উচ্চারিত হয়। তবে সে কি কখনও কাউকে সে ভাবে চেয়েছে?
সে জানে না। তবে আনিকার ধারণা ঠিক ছিলো। তার আর আনিকার সম্পর্কে মধ্যে অনেক কিছুই ছিলো না। এই যে রিমি আর তার মধ্যে এখনও কিছুই নেই। তবুও সে এলোমেলো হয়ে গেছে। শুধু কি এলোমেলো? যখন থেকে শুনেছে এই মেয়ে সেজেগুজে আগুন হয়ে বেড়িয়েছে । তার ভেতর জ্বলেছে, নিশ্বাস গলায় আটকে ছিলো। রুমে ছটফট করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আবার যখন দেখলো মহারাণী এসেছে, রিকশা থেকে নামছে। সব ঠিক! এই যে ভেতরে এখন ফুরফুরে শান্তির বাতাস ।
তার এই জ্বলা পুড়ায় সে, নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হলো। এই বয়সে এই বাচ্চামোর কোন মানে হয়?
— কি হয়েছে? মোবাইলে এমন কি রাজ্য। যে এভাবে ঢুকে আছেন?
সাব্বির মোবাইল টাউজারের পকেটে রাখলো। রেখে রিমির দিকে তাকালো। স্বাভাবিক ভাবলেশহীন ভাবে।
— ডেটে গিয়েছিলাম।
— গুড!
— কফি খেলাম। ঘুরাঘুরি করলাম।
— ভেরি গুড।
— কেমন লাগছে আমাকে বলুন তো। প্রথমবার তো, একটু কনফিউজড ছিলাম।
— ভালো।
— শুধু ভালো?
— আর কি শুনতে চাও?
— একটু দিলখোলা করে বলুল। প্রফেসর মানুষ এভাবে এক শব্দে বললে হবে?
সাব্বির কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো। তারপর রিমির চোখে চোখ রেখে শান্ত ভাবে বললো, — যার জন্য সেজেছো সে মুগ্ধ হলেই হবে। আমার টা ইম্পোর্টেন্ট না। আর তাকে যদি সত্যিই পছন্দ করো। তাহলে মন থেকে বলছি, ” ভালো থেকো। বলেই সে চলে যেতে নিলো। কিন্তু আবার ফিরে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আগের মতোই বললো,
” যেই মুগ্ধতা আমার চোখে দেখতে চাইছো। সেটা রিমিকে দেখে হয়। যখন সে এলোমেলো চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন হয়। যখন হাতে পায়ে মোজা, মাথায় বাচ্চাদের মতো টুপি আর শীতে কাঁপতে কাঁপতে গুটিগুটি করে হাঁটে তখন হয়। যখন দিন দুনিয়া ভুলে পুরো হাতের কব্জি মাখিয়ে খাওয়া, দাওয়া করে তখন হয়। যখন পুলিশের পোশাক গায়ে দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে এখানে ওখানে ঢলে পড়ে তখনো হয়।
কিন্তু যেই সৌন্দর্য এখন দেখাতে এসেছো। এই সৌন্দর্য সাব্বিরকে টানে না। যদি টানতো তাহলে সাব্বির এখানে দাঁড়িয়ে থাকতো না। কখনো না। বলেই সাব্বির চলে এলো। তার ভেতরটা আবার জ্বলছে। কি যন্ত্রনা দেখোতো …
রিমি ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে সাব্বিরের যাওয়া দেখলো। যাচ্ছে বুকে হাত ঘষতে ঘষতে। গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম হচ্ছে নাকি? হতেও পারে, যে মেপে মেপে খাওয়া দাওয়া করে। জোয়ান বলবান মানুষ, খাবার খাবে রাজ্য ডুবিয়ে তা না। খাবে গুণে গুণে। হুহ্!
বলেই সে নিজেও আর দাঁড়ালো না। চলে এলো। শীতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এতো ফ্যাশন ফুশন মেয়েরা যে কিভাবে করে কে জানে। তারতো এইটুকু করতে গিয়েই বারোটা বেজে যাচ্ছে। কাজলে চোখ ভারী হয়ে আছে, চুলে পিট কুটকুট করছে। আর লিপস্টিক! সেটার কথা আর কি বলবে। এতোক্ষণে পেটে গিয়ে হজম হওয়ার রাস্তায়। ধুর! তার নানুই ঠিক। মেয়ে নামের কলঙ্কই সে।
রিমির ঘুম ভাঙলো ধুম ধড়ক্কা বিটের শব্দে। সে কাছিমের মতো কম্বলের ভিতরে ঢুকে গেলো। ভাগ্যিস সে চাকরি করে। আর দিনভরে এই অত্যাচার সহ্য করতে হবে না। মুহুয়া আন্টি অবশ্য রাতে মাথা ধরিয়ে ফেলেছে। সন্ধ্যায় মধ্যে তাকে যেন বাসায় পায়। সেই নিয়ে অবশ্য রিমির কোন মাথা ব্যথা নেই।
সে কোন কালেই গুড মার্কা মেয়ে ছিলো না। না হওয়ার ইচ্ছে আছে। তাই বললেই সময় মতো চলে আসবে, এমন কোন কারণ নেই। আর তাছাড়া কোন প্রকার অনুষ্ঠান, আয়োজন তার ভালোও লাগে না। তাই তাড়াতাড়ি ফেরার চান্স’ ই নেই।
সে আরেকটু আরাম করে শুলো। ঘুমটা আরো ঘন্টা খানিকের জন্য জোড়াতালি দেওয়া যায় কি না দেখা যাক। তখনি তার মোবাইল বাজলো। সে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কে ফোন দিয়েছে সে জানে। বেটা তোর বউ নেই, সংসার নেই, বাচ্চা নেই। কোন রাজ্যের কাজের জন্য এতো সকালে উঠে ডিগবাজি করতে থাকিস?
সে হাত বাড়িয়ে মোবাইল কম্বলের ভিতরে নিয়ে এলো। রিসিভ করে কানে রেখে বললো,— হুম।
ওলীদ হাসলো! সে জানতো রিমি এখন ঘুমে। মেয়েটা ঘুমোতে এতো পছন্দ করে। আর সে পছন্দ করে রিমির এই ঘুম জড়ানো কন্ঠটা। সে হেসেই বললো,
— গুড মরনিং।
রিমি মুখ বাঁকালো। মনে মনে বললো, — ছাইয়ের মরনিং।
— বিরক্ত করলাম?
— হ্যাঁ।
— স্যরি।
— আপনার সরি এক্সসেপ্ট করা হলো।
— সেটা যে করা হবে আমি জানি, তাইতো বিরক্ত করার দুঃসাহস টা বারবার করি।
রিমি হাসলো!
— কি খবর, এতো সকালে?
— কোন খবর নেই। ভাবলাম বসে আছি তোমাকে বিরক্ত করা যাক।
— বসে কেন, কাজে যাবেন না?
— না।
রিমি চোখ খুললো।
— কেন?
— ছুটি নিয়েছি।
— কেন?
— সেটাতো বলছি না।
রিমি আবাক হয়ে আবার বললো, —- কেন?
— এমনিই।
— আপনার এমনিইর আমি খেতা কম্বল পুড়িয়ে ফেলবো। অসহ্য একটা শব্দ।
ওলীদ হো হো করে হেসে ফেললো। হাসতে গিয়ে দু- বার কাশলো।
— আপনি অসুস্থ?
— যদি বলি হ্যাঁ, তো কি করবে?
— আপনি চান আমি কিছু করি?
— হ্যাঁ!
রিমি আবারো হাসলো!
— নাস্তা করেছেন?
— না, এখনো করিনি।
— আপনার ফ্ল্যাটে মেয়ে আসলে প্রবলেম হবে ?
ওলীদ হাসলো!হেসে বললো,
— যে বাসায় আপনি আসলে প্রবলেম হবে, দরকার হলে সেই বাসায় আমি থাকবোই না।
রিমি ও হাসলো! হেসে ফোন রাখলো। সাথে সাথেই শামীম স্যারকে টেক্স করলো। করে কিছুক্ষণ বসে আবার টেক্স করলো সাব্বির কে। সেখানে অবশ্য সে কিছুই লিখলো না। লিখলো শুধু কয়েকটা সংখ্যা।
সাব্বির সাথে সাথেই মেসেজ সিন করলো। করে ভ্রু কুঁচকালো! তবে কোন এন্সার করলো না, মাথাও ঘামালো না। যে ফাজিলের ফাজিল! নিশ্চয়ই তাকে কনফিউজড করার জন্য এমনি টাইপ করে পাঠিয়েছে।
চলবে……