#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৪
রিমিকে দেখেই মিথিলা আঁতকে উঠলো। অবাক হয়ে বললো, আল্লাহ! মুখে কি হয়েছে রিমি?
রিমি বসতে বসতে স্বাভাবিক ভাবে বললো,
— এলার্জি।
— ওমা তাই নাকি? দেখতো, একদম লাল জখম হয়ে আছে। ইচ্ছেমতো চুলকেছো নাকি?
— হুম ।
— ভালো করে ডাক্তার দেখাও। মুখতো শেষ। ভাগ্যিস বিয়ে টিয়ে হয়নি তোমার। তা না হলে ভাবতাম মুখে তোমার জামাই তবলা বাজিয়ে দিয়েছে।
রিমি হেসে ফেললো! যাক বিয়ে না করার অনন্ত একটা ফয়দা হলো। তারপর মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললো, — ওলীদ, তার কি খবর ম্যাডাম?
— থানায় ই আছে? বহাল তাবিয়াত। সকালে স্পেশাল নাস্তা দেওয়া হয়েছে।
রিমি ভ্রু কুঁচকে বললো, — মানে ?
মিথিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, — পৃথিবীতে নিয়ম, কানুন, আইন সব দূর্বলদের জন্য বুঝেছো রিমি। এরা রাঘব বোয়াল। এরা জাল কেটে অনায়াসেই বেরিয়ে যায়।
রিমি বুঝতে পারলো না। তাকিয়ে রইলো। মিথিলা নিজে থেকেই বললো, — কালকে বিকেলে এমপির কল এসেছিলো। শামীম স্যার দৌড়ে গেলেন। এখনো খবর নেই। সকালে শুধু ফোন করে বললেন। “ওই লোকটার যেন কোন সমস্যা না হয়। তাকে নাস্তা, যা যা দরকার দাও।”
আমাদের কি? দিলাম। সবই টাকার খেল বুঝেছো । দেখো আজকের মধ্যে ছাড়াও পেয়ে যাবে হয়তো।
— ছেড়েই যদি দেবে এতো নাটকের কি কোন প্রয়োজন ছিলো ম্যাডাম?
মিথিলা হাসলো!
— আমরা আমাদের কাজ করি রিমি। মাঝে মাঝে কেঁচো খুঁজতে গিয়ে সাপ বেড়িয়ে যায়। সেই সাপকে ধরে রাখা আমাদের সাধ্যের বাইরে। তাই কি আর করার। কাজের কষ্ট পয়সা দিয়ে উসুল। তোমার টাও তুমি পেয়ে যাবে। এতো টেনশন করো না। এই দুনিয়া এতো সোজা না। স্রোতের তালে তালে চলতে শেখো। বিপরীতে গেলেই সমস্যা।
— উনি ডেঞ্জারাস ম্যাডাম।
— জানি! কিন্তু তার চেয়েও ডেঞ্জারাস যারা এর উপরে। সে তো আর এমনিই এমনিই খুন করে না। তুমি একে শাস্তি দেবে । তারা এর মতো হাজার তৈরি করে ফেলবে। একটা পুলিশের আর কি ক্ষমতা। উপরের কথা শুনবে না। শোনার মতো অন্য ইন্সপেক্টর নিয়ে আসবে। তাই কি দরকার ঝামেলা করার। পকেট ভর্তি ডু ফুর্তি।
রিমি আর কিছু বললো না। বলে অবশ্য কোন লাভও নেই। সামান্য কনস্টেবল সে। উপর থেকে যেই দিকে যাবে সেই দিকে যেতে বাধ্য সে।
রিমি উঠে দাঁড়ালো। ওলীদ যেখানে আছে সেখানে গেলো। সে ভেবেছিলো ওলীদের সামনে সে আর যাবে না। কিন্তু যাচ্ছে। তার মন বলছে এটাই শেষ না। আরো হবে, ভালো ভাবেই হবে।
রিমিকে দেখে ওলীদ এগিয়ে এলো। ঠিক সামনে দাঁড়ালো। মাথা কাত করে মুখের দিকে তাকিয়ে খুব স্বাবাবিক ভাবে বললো, — মুখে কি হয়েছে রিমি?
রিমি কিছু বললো না! পকেট থেকে ঔষুধ বের করলো। সামনে বাড়িয়ে ধরলো! লোকটা কালকে অসুস্থ ছিলো।
ওলীদ হালকা হাসলো! হেসে বললো, — যা চেয়েছো সেটা তো হয়েছেই। আবার নাটক কেন?
— এমনিই।
ওলীদ হো হো করে হেসে ফেললো! এই জন্যই এই মেয়েটা তার এতো পছন্দ। ভান টানের ধারের কাছে নেই। সে হাত বাড়িয়ে ঔষুধ নিলো। নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো, — মুখে কি হয়েছে?
— থাপ্পড় খেয়েছি।
— আমি ছাড়াও তোমার শত্রু আছে নাকি?
— আপনি আমার শত্রু?
— হ্যাঁ! প্রিয় শত্রু, বন্ধু শত্রু, ভালোবাসার শত্রু, মরণ শত্রু।
— এটা আমার কাজ ছিলো। আমি না করলে অন্য কেউ করতো। সেও আপনার ইত্যাদি, ইত্যাদি শত্রু হতো?
— না! রিমিতো একটাই! তাইতো ফেঁসে গেছি। অন্য কেউ হলে ওলীদ এখানে থাকতো না।
— থাকছেন কোথায়, সেই তো বেরিয়েই যাচ্ছেন।
— তা যাচ্ছি।
— জানতে পারি কিভাবে?
— হ্যাঁ পারো! একমাত্র তুমিই আমার ব্যাপারে সব জানতে পারো।
— ধরা না পড়লে দেখা যেতো কতো জানতে পারি।
ওলীদ আবারো হাসলো! হেসে বললে — জানার মতো কিছু নেই। যে কোন প্রফেশনেই নিজের সিকিউরিটি আগে। আমিও তাই করেছি। সাধারণ মানুষ কি আর এসব করে? করে বড় বড় মানুষেরা । ব্যস কিছু প্রমাণ শুধু আমার হাতে থাকে। কাজ শেষ হলে মনে রাখে কে? তাই এই ব্যবস্থা। সামনে নির্বাচন। কিছু লিক হলেই শেষ। তাই তারা নিজেদের প্রয়োজনে আমাকে সেইভ রাখবে।
— দ্বিতীয় মোবাইলটা কারণ এটাই।
— হ্যাঁ।
— ভালো।
— খুব নিরাশ হলে মনে হয়।
— তা হলাম।
— তুমি কি চাও? আমি এখানেই থাকি। কোর্টে চালান হোক। শাস্তি হোক?
রিমি কঠিন করে বললো, — আমি কিছুই চাই না। কাজ ছিলো করেছি। আমার দায়িত্ব শেষ।
— শুধু দায়িত্ব?
— হ্যাঁ।
— ভেবে বলছো?
— অবশ্যই।
ওলীদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো! তারপর আগের মতোই বলল, — ভালো।
রিমিও তাকালো! সে তার মতোই বললো, — আপনার কাজ আপনি করেছেন। আমারটা আমি। এখানে বিশেষ কিছু নেই। আসি! আশা করছি এটাই আমাদের শেষ দেখা।
ওলীদ এবার হাসলো না। তবে আরেকটু এগুলো! দাঁড়ালো লোহার শিকের একদম কাছাকাছি। রিমি আর তার মাঝের দূরুত্ব এখন কয়েক ইঞ্চির।
সে চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিশ্বাস নিলো। নিয়ে বললো, —- তুমি কখনো পারফিউম ইউজ করো না তাই না রিমি।
রিমির চোয়াল শক্ত হলো! ওলীদ তা দেখে হাসলো। হেসে কৌতুক মাখা সুরে প্রায় ফিসফিস করে বললো, — আই অ্যাম স্যরি রিমি! রিয়েলি স্যরি। তোমার এই আশাটা আমি পূরণ করতে পারছি না। কেননা তোমার শাস্তি বাকি। ভালোবাসা নিয়ে খেলার শাস্তি। তুমি যেমন খুব যত্ন করে অভিনয় করেছো। আমিও খুব যত্ন করে শাস্তিটা দেবো।
রিমি মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেললো। তবে চেহেরায় কোন হেলদোল হলো না। সে চলে যেতে নিলো। ওলীদ ডাকলো, — রিমি…
রিমি থামলো! ফিরে তাকালো। তখনি ওলীদ ঔষুধ ছুঁড়ে ফেললো। সেটা রিমির পায়ের সামনে এসে পড়লো। রিমি দেখলো, তবে কিছু বললো না।
ওলীদ পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরালো। লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললো — আমি তোমাকে ভালোবাসি।
রিমির কোন ভাবান্তর হলো না। সে নির্বিকার ভাবে বললো, — আর কিছু?
— আরো অনেক কিছুই রিমি। সেটা সময় এলেই জানবে।
রিমি হালকা হাসলো! হেসে বললো,
— মানুষের মতো দেখতে অমানুষ আজ আমি প্রথম দেখছি না । দেখছি সেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকে। তাই তাদের কোন আচরণ দেখে এখন আর আমি অবাক হই না, ভয় পাই না। বলতে গেলে কোন প্রকার অনুভূতিই হয় না। তাই আমিও দুঃখিত। আপনার আচরণেও হচ্ছি না। ভালো থাকবেন।
বলেই রিমি চলে এলো। আসতেই দেখলো মিথিলা ম্যাডাম দাঁড়ানো। পুরো থানার কোনা কাঞ্চিতে এ ঘুরে বেড়ায়। তাকে দেখেই বললো,— এই বেটা তো তোমার জন্য দেওয়ানা হয়ে গেছে। মালদার পাটি, বিয়ে করলে করে ফেলতে পারো। লাইফ জনমকার জন্য সেট! পুলিশ আর এদের মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই বুঝেছো। এরা খুন করে, পুলিশ ধামাচাপা দেয়, এই যা।
রিমি হালকা হাসলো! হেসে বললো, — একটু সাহায্য দরকার ম্যাডাম।
— কিসের ?
— একটা থাকার জায়গা দরকার। হোস্টেল বা ফ্ল্যাট শেয়ার হলেও চলবে।
মিথিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রিমি ভেবেছে এক্ষুণি জিজ্ঞেস করবে কেন? তবে তাকে অবাক করে দিয়ে মিথিলা সে সবের কিছুই বললো না। স্বাভাবিক ভাবে বললো, — হঠাৎ করে পাওয়া মুশকিল। তবে ইমার্জেন্সি লাগলে আমার ওখানে চলে আসতে পারো। আমার একরুম খালিই থাকে। তিনজন মানুষ মাত্র। আমি, হাসবেন্ড আর ছোট্ট একটা লেদা। এক রুমেই কাজ কাম খালাস।
— আপনার বা স্যারের সমস্যা হবে না?
— হবে বুঝোইতো, বলেই মিথিলা দুষ্টুমি করে চোখ মারলো। মেরে বললো, — সারা জীবনের জন্যতো আর আসছো না। কিছুদিনের ব্যাপার, ভালো জায়গা একটা না পাওয়া পর্যন্ত ম্যানেজ করে নেবো। তাছাড়া ঢাকা শহরে ছু মন্তর করে সব পাওয়া গেলেও, থাকার জায়গার বরই অভাব।
রিমি হাসলো! হেসে বললো, — বিকেলেই যদি আসি সমস্যা হবে?
মিথিলাও হাসলো, হেসে বললো, — চলে এসো। কোন সমস্যা নেই। তারপর গালে হাত রেখে কোমল সুরে বললো, — আমার চাকরির বয়স কতো রিমি জানো?
রিমি উত্তর দিলো না, শুধু তাকিয়ে রইলো।
— যদি এলার্জিই না চিনি তাহলে এতো দিনে আর কি অভিজ্ঞতা হলো। বুঝতে পারছি বলতে চাচ্ছো না। তবুও বলছি, কোন প্রকার হেল্প লাগলে নিঃসংকোচে বলবে ঠিক আছে।
রিমি এবারো শুধু হাসলো! তবে কিছু বললো না।
মহুয়া বিরক্ত মুখে বললো, —- আর কতোক্ষণ আমার রুমে ঘাপটি মেরে বসে থাকবি। এবার যা। নাঈম সারাদিন একা। বেচারার এমনিই শরীর ভালো না। তার মধ্যে আবার তোর ঢং। বার বার জিজ্ঞেস করছে। কতোবার কথা ঘুরানো যায়।
— ঢং কি সাধে করছি। কি করেছে তোমার ছেলে। একবার চেয়ে দেখেছো?
— দেখে আর কি হবে। দোষ তো তোর। তুই কোন দুঃখে না জেনে পুরো বাড়ি মাথায় নিলি।
— হ্যাঁ! দোষ তো হবেই। যখন ওই রাস্তার মেয়েকে বউ করে নিয়ে আসবে তখন বুঝবে। তখন ঠিক নিসার কথা মনে হবে। গরির তো বাসি না হলে কথা ফলবে না।
— নিয়ে আসলে আসবে। তোর ওই বল্টু মার্কা ননদের চেয়েতো ভালো।
নিসা হা হয়ে গেলো। হা করে বললো, — আমার ননদকে তোমার বল্টু মনে হয়?
— মনে হওয়ার কি? বল্টুই তো। হিল না পরলে মাটিয়ে গড়াগড়ি খাবে।
নিসা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ দমালো। দমিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো । তার পিছু পিছু মহুয়াও বের হলো। বের হতেই রিমির রুমের দিকে নজর পড়লো। দরজা চাপনো। রিমি এসেছে নাকি? রাত ভরে জার্নি, তার মধ্যে এই সব নাটক। কখন যে বেরিয়ে গেছে খেয়াল ই করেনি। এতো কিছু হলো, সকাল থেকে কিছু খেয়েছে কি না কে জানে।
শুধু এ না, সাব্বির টাও না খেয়ে বেরিয়েছে। এখনও খবর নেই। আয়েশা সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। রেজাউলের খবর নেই। নাদু রাগ করে চলে গেছে তার আরেক বোনের বাসায়। তারা দিচ্ছ ফোনের উপরে ফোন। কি যে যন্ত্রনায় সে আছে, একমাত্র আল্লাহ ই জানে।
আর এই সব, এই নিসা ফাজিলের জন্য। কোন কুক্ষণে একে পেটে ধরে ছিলো কে জানে? এমন বার নেই যে কোন না কোন ঝামেলা না লাগায় ।ধুর! আগে জানলে কোন পুলাপান ই নিতো না। থইলা ঝরঝরা জীবন ফুরফুরা। সে এগিয়ে গেলো। রিমিকে নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই। তবে ভয় আছে। যে তার ছেলে বাবা রে বাবা। বিয়ের পর ঊনিশ বিশ হলেই চৌদ্দ গুষ্টি জেলে।
রিমি নিজের সব জিনিসের দিকে তাকালো। কাপড় আর কিছু বই। খুব একটা না। তবুও একা নিতে কষ্ট হবে।
এই আশিক ভাই কই? এগুলো মিথিলা ম্যাডামের বাসায় রেখে আবার থানায় যেতে হবে । সে আশিক কে মেসেজ করলো। তাকে আগে পৌঁছে দিক। তারপর যেখানে খুশি বাবা সেখানে যাও।
সে হাত লাগাতেই মুহুয়া রুমে আসলো। অবাক হয়ে বললো, — ওমা কি করছো?
রিমি তাকালো! মৃদু হাসলো। হেসে বললো, — তেমন কিছু না আন্টি । থানার সাথেই থাকার একটা ভালো জায়গা পেলাম। তাই ভাবলাম, অযথা আর এখানে অশান্তি বাড়ানোর দরকার কি?
মুহুয়া হা হয়ে গেলো। তার তাৎক্ষণিক বুদ্ধি কম। সে বুঝতে পারলো না কি বলবে। তবে এইটুকু বুঝলো। এই মেয়ে এভাবে চলে গেলে। আয়েশা, রেজাউল মনে কষ্ট পাবে। অনেক অনেক কষ্ট। এতো বছর ধরে তার ভাই এ বাড়িতে পড়ে আছে। কেউ কখনো কিছু বলে নি। আর প্রথম বার আয়েশার তরফ থেকে কেউ এসেছে। আর তার মেয়ে লাগিয়ে দিয়েছে আগুন। দেখেতো! আর সাব্বির? তার হাত পা ঘামতে লাগলো।
রিমি এগিয়ে এলো। মুহুয়া কে ধরে বললো, — কি হয়েছে আন্টি?
— অস্তির লাগছে ? মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো।
রিমি অবাক হয়ে বললো — আল্লাহ! তাই নাকি? বলেই সে তাড়াতাড়ি ধরে মুহুয়াকে খাটে বসালো। শীত তাও ফ্যান ছাড়লো। নেয়ে ঘেমে একাকার। আশ্চর্য! এই মাত্রই না সুস্থ সবল মানুষটা এলো।
চলবে……