#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২২
বিশাল বড় এক রচনার সাথে আদৃতার ভিডিও জুড়ে দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছে শোভা। পোস্ট করার ঘন্টাখানেকের মধ্যে পোস্ট ভাইরাল হয়ে গেলো। হুহু করে ভিউ বাড়ছে আর শেয়ারের ছড়াছড়ি। দু’দিনে ভিডিওর ভিউ পাঁচ লাখের বেশি আর দুই তিন হাজার শেয়ার। আদৃতা টক অফ দি ক্যাম্পাসে পরিনত হয়েছে। শোনা যাচ্ছে ওকে ইউনিভার্সিটি থেকে বহিস্কার করা হতে পারে। মনিরার কাছে শুনেছে আদৃতা ক্যাম্পাসে নেই। সেদিন রাতের আঁধারেই পালিয়েছে। শুনে কিছুটা প্রশান্তি লাগে শোভার। মনে মনে ভাবে কেবল তো শাস্তি শুরু আদৃতার। এখনো অনেক পথ বাকী।
শোভার কষ্টের সমান কষ্ট না তারচাইতে বেশি পাবে আদৃতা। ওকে পেতে হবে।
এরমধ্যেই ছোট বোন বিভার ফোন-“আপু, তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
অজানা আশঙ্কায় শোভার অন্তর্আত্মা কেঁপে উঠলো। উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো-“কি হয়েছে বাবার?”
“এতো কথা বলার সময় নেই। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো বাসায় এসো।”
আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিভা ফোন রাখে। ভয়ে শোভার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। বাবার হঠাৎ কি হলো? এই তো কেবল জীবনের সবকিছু ঠিকঠাক হতে শুরু করেছিল। শোভা ভেবেছিল পরীক্ষা শেষে বাবাকে নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবে মাথা উঁচু করে। সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলবে, দেখো সেবার তোমরা আমার কথা মানতে চাউনি। নির্দোষ আমাকে দোষী ঠাউরেছিলে। এবার বুঝলে তো কে আসল দোষী? সে সুযোগ কি পাবে না শোভা? বাবার লাজে নিচু মাথা কি গর্বে উঁচু করে দেওয়ার সুযোগ সে পাবে না? বুকের ধরাস ধরাস শব্দে শরীরে কাঁপন তুলছে। চোখের সামনে ছোট বেলায় দেখা বাবার ছবিটা ভেসে উঠছে বারবার। শোভার চোখ দুটো অকারণে ভিজে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে শোভা হন্তদন্ত হয়ে তৈরি হয়ে বাসে ওঠে।
মাকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হলো শোভা। ঘরে ঢুকেই অস্থির শোভা ইতিউতি উঁকি দেয়। সুনসান নীরব হয়ে আছে পুরো বাড়ি। প্রশ্ন নিয়ে মাকে দেখলো। সাজেদা ধীর স্বরে বললো-“তোমার বাবা ঘুমাচ্ছেন। উঠলে ডাকবো। তুমি ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
এতোক্ষণের টেনশন খানিকটা কমলো মায়ের কথা শুনে। সে জানতে চাইলো-“বাবা ঠিক আছে তো?”
সাজেদা মাথা দুলায়-“পরে কথা বলছি তুমি ঘরে যাও।”
শোভা আর কথা বাড়ালো না। রুমে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বিভা আর সাদাত কাউকেই বাসায় পেলো না দেখে বিস্ময় কম না ওর। তবুও ক্লান্ত থাকার কারণে হাজারো ভাবনার মাঝেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
মায়ের মোলায়েম কন্ঠের ডাক শুনে ঘুম ভাঙে শোভার। ধরফর করে উঠে বসে
উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলো-“কি হয়েছে মা? বাবা কোথায়?”
সাজেদা মেয়ের দিকে চেয়ে আদূরে হাসি দেয়-“বাবা ঠিক আছে। তুই হাতমুখ ধুয়ে ড্রইংরুমে আয়। বাবা তোর সাথে কথা বলবে।”
‘বাবা কথা বলবে’ সগতোক্তি করে শোভা। চিন্তিত হলো, সে কি আবার কোন ভুল করেছে? কি বলবে বাবা তাকে?
“বসো এখানে।”
আজমল শেখ নিজের পাশের জায়গাটা দেখিয়ে দিতেই শোভার চোখ দুটো গোল হয়ে গেল। যেন এখনি কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসবে। বাবা তাকে নিজের পাশে বসতে বলছে? শোভার বিশ্বাস হলো না যেন। সে মায়ের দিকে তাকালে মা আশ্বস্ত করলো। শোভা ধীর পায়ে বাবার কাছে এসে বসলো। আজমল শেখ মেয়ের মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারছে। খুব আফসোস হচ্ছে তার। গত তিনটে বছর মেয়েটার সাথে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছেন। নির্দোষ মেয়েটাকে দোষী বানিয়ে যা নয় তা বলেছেন। একা একাই নিজের দুঃখে কেঁদেছে মেয়েটা। তিনি বাবা হয়ে পাশে তো থাকেনইনি উল্টো কথা শুনিয়ে কষ্ট দিয়েছেন। তিনি আজ বড় শরমিন্দা নিজের কাছে। তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয় নোনাজলে-“আম্মু, আমাকে কি তুমি মাফ করতে পারবে?”
“এসব কি বলছো বাবা?” শোভাকে হতবিহ্বল দেখায়।
“তুমি বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবী করার পরও তোমাকে কথা শোনাতে ছাড়িনি। বাবা হিসেবে তোমার সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য ছিল আমার কিন্তু সেই কর্তব্য আমি পালন করিনি। সবচেয়ে বড় কথা তুমি আমার সন্তান। তবুও তোমার কথার উপর বিশ্বাস রাখিনি এরচেয়ে বড় লজ্জা আর কি আছে? গত তিনটে বছর তুমি কতবার বলেছ তুমি নির্দোষ অথচ আমি মানিনী। আম্মু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ হয়েছি।”
শোভা হু হু করে কেঁদে দেয়। আজমল শেখ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়। শোভা এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। গত তিন বছরে কতবার বাবার বুকে মাথা রাখতে চেয়েছে অথচ পারেনি। অবশেষে সে আবার তার বাবাকে ফিরে পেলো।
আজ হঠাৎ সেই সুযোগ পেয়ে শোভা আনন্দ ধরে রাখতে পারে না। আনন্দে চোখের জল যেন ফুরাচ্ছে না।
“বিভা আমাকে ভিডিওটা দেখিয়েছে। অন্য সময় হলে বলতাম কাজটা করা তোমার ঠিক হয়নি। তবে আজ সে কথা বলবো না। নিজের সন্মান ফিরে পেতে তুমি যা করেছ তাতে বরং আমি গর্ববোধ করি।”
শোভা জলে ভেজা চোখ তুলে তাকায়। ঘরের মাঝে বিভা আর সাদাত এসে ঢুকলো। বোনের কাছে এগিয়ে এলো-“উই আর সরি আপা। বিনা দোষে তোমাকে কতকিছু শুনতে হয়েছে। কত কথা বলেছি তোমাকে। মাফ করে দাও আপা।”
শোভা উদ্ভাসিত মুখে হাসি দিলো-“ধুর বোকা, মাফ চাইছিস কেন? আমার জন্য তোরা কত কষ্ট করেছিস। আমি কিছু মনে রাখিনি রে।”
আজমল শেখ স্নেহময় দৃষ্টিতে শোভাকে দেখলো-“এবার আমরা বাড়ি ফিরবো শোভা। মাথা উঁচু করে ফিরবো। আর কোন লুকিয়ে থাকা নয়, কোন ভয় নয়। আমরা এবার আপন নীড়ে ফিরবো।”
শোভা দেখলো কথাগুলো বলতে বলতে তার বাবার মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। অদ্ভুত দীপ্তিময় আভা ছড়িয়ে পড়লো তার চেহারায়।
★★★
শোভার ভিডিওটা বাড়ির সবাইকে দেখানোর গুরুদায়িত্বটা রিফাত পালন করেছে। এবং অতি অবশ্যই ভিডিওটা তার কাছে পাঠিয়েছে তার খবরি লাল বন্ধু মিনহাজ। ভিডিও দেখতে বসে রিফাত অবাকের চাইতেও অবাক হলো। লেখাগুলো পড়ে মোবাইলের দিকে অবিশ্বাস নিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর গলা ফাটিয়ে হাসলো উচ্চস্বরে। যদিও হাসাটা অনুচিত হচ্ছে তবুও হাসি আঁটকাতে পারলোনা কিছুতেই। মনে হচ্ছে আজ একটা স্বর্নালী দিন তার জন্য। শোভা করেছেটা কি? আর কিভাবে করলো এই অসাধ্য সাধন?
সে মোবাইল হাতে নিয়ে প্রায় ছুটে বেড়িয়ে গেল। বাবা মায়ের রুমে উঁকি দিলো-“বাবা মা তোমরা কি ঘুমিয়ে গেছ?”
গোলাম রসুল শুয়ে ছিলেন আর রোকেয়া কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত ছিল। দু’জনেই ছেলের দিকে তাকালেন। গোলাম রসুল উঠে বসলেন-“কি হয়েছে?”
“তোমাদের কিছু দেখাতে চাই। টিভিটা কি অন করতে পারি বাবা?”
রোকেয়া উৎসাহি হয়ে কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখলো। গোলাম রসুল মাথা দুলালেন। রিফাত টিভিতে ভিডিওটা চালিয়ে সরে দাঁড়াল। বাবা মায়ের প্রতিক্রিয়া বিশেষ করে মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখার লোভ সামলাতে পারছে না সে। দশ মিনিট পরেই গোলাম রসুল শিরদাড়া খাড়া করে উঠে বসলেন আর রোকেয়া একদম স্থির হয়ে গেলেন। দু’জনেই কয়েকবার করে একে অপরকে দেখলেন।
“আরে! এটা কি আমাদের আদৃতা?”
রিফাতের বুক ধুকপুক করছে। সে মাথা নাড়ে-“হ্যা বাবা।”
“সাথের ছেলেটা কে? খুব চেনা চেনা লাগছে যে।”
রোকেয়া পালাক্রমে রিফাতকে আর স্বামীকে দেখছে। তার কপালে ঘামের রেখা। রিফাত ভাবছে নামটা বলবে কিনা।
“ছেলেটা কি আমাদের গালিব না? ও আদৃতার ভার্সিটিতে কেন গিয়েছে? কি করছে ওখানে?”
গোলাম রসুল হতবাক হয়ে গেলেন। রিফাত হাফ ছেড়ে বাঁচে। বাবা নিজ মুখে বলে তাকে বিড়াট সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে দিলো। রিফাতের নিঃশ্বাস বুঁজে আসে তবুও-“হ্যা বাবা৷ আমাদের গালিব। আদৃতার সাথে নাকি অনেকদিন যাবত ওর সম্পর্ক। পুরোটা দেখ বুঝতে পারবে সব।”
রোকেয়া হতবুদ্ধি হয়ে গেলো-“এটা কিভাবে সম্ভব! আমাদের গালিব আর আদৃতা!”
রিফাত কিছু না বলে কেমন ঢোক গিললো। ভাবছে, সেদিন তাহলে এই কারনেই গালিব তার কাছে এসেছিল? তার মনের ভাব জানতে? গালিবও আর মেয়ে পায়নি। একেবারে পঁচা শামুকে পা কেটে ফেলেছে। বেদম হাসি পাচ্ছে তার।
বাবা মায়ের মুখ চেয়ে হাসতে পারছে না। রিফাত ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অপেক্ষা করছে বাবা মায়ের রেসপন্সের। সে দেখতে চায় এরপর বাবা মা কি করে তাদের গুণবতী মেয়ে আদৃতাকে।
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২৩
গোলাম রসুল জরুরি মিটিং ডেকেছে ঘরের মধ্যে। গতকাল আদৃতার বাবা মা ঢাকায় চলে এসেছে। মিটিং এর আগে গালিব ওরফে ইশারাককে খবর দিয়েছে রিফাত। মিটিং এ তার উপস্থিতি জরুরি।
রিফাত এসে বসেছে পেছনে।
গালিবকে হেঁটে আসতে দেখে উপস্থিত মানুষগুলো আঁতকে উঠলো। প্রায় সপ্তাহ খানেক পরেও যেমন অবস্থা তাতে ভালো মার খেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। ডান চোখ ফুলে একাকার। বাম চোয়াল ছিলে গেছে, নাক ভচকে আছে। রোকেয়া ছেলেকে দেখে আঁতকে উঠলেন। অবস্থা এত ভয়াবহ তার জানা ছিল না। গালিব ক’দিন তার রুম থেকে বের হয়নি। সে প্রায় ছুটে এসে ছেলেকে ধরলো-“একি অবস্থা তোর?”
গালিব সংকোচ নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়-“তেমন কিছু না মা। ঠিক হয়ে যাবে।”
গোলাম রসুল শক্ত হয়ে রইলেন। এখন আবেগ দেখানোর সময় না। শক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। কাজেই নরম ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না।
“বসো তোমরা। আমি খুব জরুরি কথা বলবো বলে তোমাদের ডেকেছি। মিজান আর কানিজ ও আছে। কাজেই মন দিয়ে কথাগুলো শোন।”
মিজান নড়েচড়ে বসলো-“জ্বি ভাইজান। কি বলবেন বলেন।”
“কথাগুলো তোর মেয়েকে নিয়ে মিজান। আমার মনেহয় এই কয়দিনে তোরা দু’জনও জেনে গেছিস কি বলতে পারি।”
মিজান মাথা নিচু করলো। কানিজ আদৃতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো-“ভাইজান, ছোট মানুষ ভুল করে ফেলছে। মাফ করে দেন।”
গোলাম রসুল হুঙ্কার দিলেন-“ছোট মানুষ! তুমি কি বুঝে কথা বলছো কানিজ? নাকি মেয়েকে বাঁচাতে এখনো চোখে পট্টি বেঁধে রেখেছ। তুমি দেখেছ ও কি করেছে? সবচেয়ে বড় কথা ও আমার ছেলের গায়ে হাত তুলেছে। এমন কাজ করার সাহস কি করে হলো?”
কানিজ কেঁপে উঠে মুখে কলুপ আটে। গোলাম রসুলের এমন রুপ আগে দেখেনি সে।
“পড়ালেখায় ভালো বলে ওকে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম। এখন দেখছি দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষেছি। আমার খেয়ে আমাকেই দংশানোর চেষ্টা। ওর কি ধারণা ছিলো, ওকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতাম আমি? এতো সহজ?”
মিজান বা কানিজের প্রতিউত্তর দেওয়ার সাহস হলো না।
“আর গালিব, তোমার কাছ থেকে এমন কাজ আশা করিনি। বলা যায় আদৃতা তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তা না হলে আমি আগে এমন কিছু টের পেলে খুব খারাপ হতো। বাবা হিসেবে তোমাদের যথেষ্ট ছাড় দিয়েছি তার মানে এই না যে খুশি করবে আর আমি মেনে নেব। জীবনসঙ্গী হিসেবে ভুল মানুষকে বেছেছিলে। তোমার পছন্দ যে ভুল ছিল সেটা তো এখন দেখতেই পাচ্ছ।”
গালিব মাথা নিচু করলো। অপমানে ওর মুখচোখ অরুন রঙে রঙ্গিন। দাঁতে দাঁত চেপে হজম করা ছাড়া গতি নেই।
“আমি ভাবতেও পারি না আদৃতা এমন করতে পারে। ওকে এতো আদর ভালোবাসা দিয়েছি সবই ওয়েস্ট হয়েছে মনে হচ্ছে। ওর চাইতে একটা কুকুরকে ভালোবাসলে বরং সে আমাদের প্রতি বেশি কৃতজ্ঞ থাকতো। ও আমাদের পেছনে আমাদেরই ছেলের ক্ষতি করতে চেয়েছে। ছিহ, নিজের উপরই রাগ লাগছে। নিজের সন্তানের চাইতে বেশি বিশ্বাস করেছি ওকে।”
রোকেয়া নিজের রাগ ঝারলেন। গোলাম রসুল প্রশ্ন করলেন-“আদৃতা কোথায় আছে এখন? ওকে আসতে বল।”
প্রশ্নটা শুনে মিজান আর কানিজ চোখাচোখি করলো। মেয়ে পালিয়ে আছে কোথাও। ওরা কি উত্তর দেবে বুঝে পাচ্ছে না।
“মিথ্যে বলে লাভ নেই মিজান। তোর মেয়েকে এখানে আসতে বল। কথা বলবো ওর সাথে। যদি না আসে তবে ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে কার্পন্য করবোনা।”
কানিজ চিৎকার করে উঠলো-“এমন বইলেন না ভাইজান। তাহলে মেয়েটার জীবনই শেষ। ও ভয়ে আপনাদের এইখানে আসে না। গালিব যদি ওকে কিছু করে?”
“গালিব কিছু করবে? আর আমি? আমি ওকে কি করবো? ওকে ডাকো কানিজ। কথা বলি ওর সাথে। নাও ফোন দাও।”
গোলাম রসুলের বাড়িয়ে দেওয়া ফোন হাতে নিয়ে কানিজ ভয়ে ভয়ে মেয়েকে ফোন দেয়। আধাঘন্টার মধ্যে বোরকা পরা আদৃতাকে দেখা গেল ঘরে। ওকে দেখেই রিফাত এগিয়ে এলো মারতে। আদৃতা ভয় পেয়ে গোলাম রসুলের পায়ে পড়ে-“চাচ্চু আমাকে মাফ করে দাও। সেদিন ভয় পেয়ে এমন করেছি। এমন ভুল আর হবে না।”
“সরে দাঁড়াও দিতি। ওইখানটায় বসো।”
গোলাম রসুলের গম্ভীর কন্ঠে কিছু ছিলো। আদৃতার সাহস হলো না তার কাছাকাছি থাকার। ভদ্র মেয়ের মতো সামনের চেয়ারে বসলো। রিফাতকে ইশারা দিলেন টিভিতে ভিডিও চালাতে। গালিবকে মারার জন্য ইশারা করছে আদৃতা এমন জায়গায় পজ করে রিফাত। গোলাম রসুল হাত ওঠালেন-“কি ভেবে তুমি গালিবকে মার খাওয়ালে? তুমি কি ভেবেছিলে আমরা কেউ কিছু জানবোনা?”
আদৃতা নিশ্চুপ বসে রইলো। গোলাম রসুলের হুঙ্কারে আদৃতা কেন গোটা ঘর কেঁপে উঠলো-“চুপ করে আছো কেন? আনসার মি।”
“নিজেকে বাঁচাতে তখন যা মনে হয়েছে তাই করেছি চাচ্চু।”
মিনমিন করে উত্তর দিলো আদৃতা।
“আচ্ছা! নিজেকে বাঁচাতে তাই তো? নিজেকে বাঁচাতে আর কত নিচে নামতে পারো তুমি? অন্য কাউকে আদৃতা সাজাতে পার, তাই না?”
আদৃতা ভয়ে কেঁপে উঠলো। চাচার কাছে এলে তার ব্রেন এমনিতেই কাজ করে না। আজ যেন আরও বেশি স্থুল হয়ে গেছে।
“যে মেয়েটা ভিডিও ছেড়েছে সে অভিযোগ দিয়েছে, তিন বছর আগে তুমি একই কাজ করেছিলে তার সাথে। পাঁচজন ছেলের সাথে প্রেম করা তারপর নিজেকে বাঁচাতে তাকে নিজের জায়গায় ঠেলে দিয়েছিলে। কথাগুলো কি সত্যি?”
আদৃতার মুখে রা নেই। কি বলবে? স্বীকার না করলে কি হবে? করলে হয়তো চাচার রাগ কমবে। আদৃতা মাথা দুলায়।
“মুখে বলো।”
“হ্যা সত্যি। আমি সেবারও নিজেকে বাঁচাতে শোভাকে মিথ্যে বলে আমার জায়গায় ওকে পাঠিয়েছিলাম।”
“এবার তেমন কাউকে পাউনি বলে আমার ছেলেকে মেরে ফেলতে চেয়েছ, তাই না?”
আদৃতা আঁতকে উঠলো-“একদম না চাচ্চু। আমি কেবল ওকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। সত্যি বলছি আমার অন্য কোন ইনটেনশন ছিল না।”
কথা শেষ হওয়া মাত্রই কেঁদে দিলো আদৃতা। হঠাৎ ওর গালে ঠাস করে আওয়াজ। রোকেয়া উঠে এসে আদৃতার গালে চড় কষিয়েছে-“বেয়াদব মেয়ে। আমাকে তবে মিথ্যে বলেছিলি কেন? তোর চুরি ধরা পড়বে এই ভয়ে?”
আদৃতা গালে হাত দিয়ে ভেউ ভেউ কাঁদে। কানিজ এগিয়ে এসে আরও কয়েকটা চড় দিলেন মেয়েকে। রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন-“আরও মারেন ভাবি৷ ওর জ্বালায় বাড়িতে টিকতে পারছি না আমরা। কি কুক্ষণে এই মেয়ে পেটে ধরেছিলাম।”
কানিজও কাঁদে মেয়েকে ধরে। এসব দেখেও গোলাম রসুল দমলেন না। গম্ভীর কন্ঠে বললেন-“এসব নাটক বাদ দাও কানিজ। তোমার কারণে মেয়েটা নষ্ট হয়েছে। তুমি জানতে ও কেমন। শোভার বাবা যখন ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিল তখন তুমি তা আমলে না নিয়ে উল্টো ওকে সাপোর্ট করেছ। শোভার বাবাকে অপমান করেছ। তারপর মেয়েকে বাঁচাতে আমার এখানে পাঠিয়েছ। ওকে বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছ যেন কোন ভাবে আমার এখানেই যেন থেকে যায়। কিন্তু কখনো এমন কথা বলোনি যেন ও এমন কাজ আর না করে। আজ তার ফলাফল তো দেখতেই পাচ্ছ।”
কানিজ মনে মনে প্রমোদ গুনলো। এই লোক সব জানে কি করে? দিতির বাপ কি সব বলে দিলো? সে স্বামীর দিকে তাকায়। মিজান তখনও মাথা নিচু করে বসে। ভাইয়ের কাছে মাথা উঁচু করার সাহস তার নেই। তার উপর আজ তার মেয়ে সেই মাথা আরও হেট করে ফেলেছে।
“শোন আদৃতা, যে পরিস্থিতি করেছ এরপর না তুমি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারবে আর না আমার বাসায় তোমার জায়গা হবে। মিজান আমি বলি কি, মেয়েকে নিয়ে এবার বাড়ি ফিরে যা। গ্রামের এক কলেজে ভর্তি করিয়ে দে। মোটামুটি পাত্র পেলে বিয়ে দিয়ে দিস।”
কানিজ আঁতকে উঠলো-“গ্রামে কিভাবে থাকব ভাইজান? মানুষ কথা শুনিয়ে মেরে ফেলবে তো।”
“সেসব আগে ভাবা উচিত ছিল তোমাদের। তাছাড়া লোকে কথা শুনালে শুনাবে। নিরপরাধ আজমলের পরিবারকে যখন কথা শুনাতো তখন কি ভেবেছিলে একবারও? আমি মনে করি এটাই তোমাদের উপযুক্ত সাজা। যত অন্যায় করেছে আদৃতা তার শাস্তি পেতে হবে। বাড়িতেই ফিরতে হবে তোমাদের। আর নয়তো পুলিশি ঝামেলা হবে। জেলেও যেতে হতে পারে আদৃতাকে। আর যেহেতু আমার ছেলেকে মেরেছে তাই আমি ওর শাস্তি হোক এটাই চাইব। তোমাদের কাছে দু’টো অফার আছে। এক গ্রামে ফিরে যাওয়া আর দুই জেলে যাওয়া। আমাকে এখানে আজই শেষ দিন তোমাদের। আমি আর জীবনেও তোমাদের মুখ দেখতে চাই না। কথা বুঝা গেছে?”
কানিজ কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু মিজান বাঁধা দিলো-“ভাইজান, আমরা বাড়ি ফিরে যাব। আপনি ঠিকই বলছেন প্রায়শ্চিত্ব করতে হবে আমাদের। মেয়েকে তো মানুষ বানাইতে পারি নাই। তাই তার কাজের দায়ভার আমার উপরও আসে। আমি এই সাজা মেনে নিলাম। ওদেরকে নিয়ে গ্রামে থাকবো, লোকের কথা শুনব এটাই প্রায়শ্চিত্ব আমাদের।”
“তুমি কি বলো এইগুলা? তুমি জানো না গ্রামে মানুষ কেমন? আমি থাকতে পারবোনা।”
“না পারলে জেলে যাও। যেমন মা তেমন তার বেটি। এতদিন আমার কথার দাম দেও নাই। অনেক অত্যাচার সহ্য করছি। এখন যদি না শুনো তাহলে জাহান্নামে যাও ফিরে দেখবো না। ছেলেকে নিয়ে চলে যাব। যাও তাড়াতাড়ি কাপড় গুছায়ে তৈরি হও। রাতের বাসে ফিরে যাব আমরা।”
জোকের মুখে লবন পড়ার মতো কানিজ চুপসে গেল। আর আদৃতা তো এখান থেকে সরতে পারলে বাঁচে। দু’জনই দ্রুত পায়ে পালালো।
“ভাইজান, ছোটভাইয়ের ভুল হিসেবে মেয়ের সব কাজে মাফ চাই। আমি খুবই শরমিন্দা। কি বলবো জানি না। কিন্তু সত্য বলি, আপনাদের কারো কোন ক্ষতি করার কথা আমি ভাবতেও পারি না। মেয়েটা কেন এমন করলো?”
“বাদ দে মিজান। সব কথা শেষ। আর তোর উপর আমার কোন রাগ নাই। খালি একটাই অনুরোধ, ওদের এইবার কোন ছাড় দিবি না। না হলে মেয়ে ভবিষ্যতে বড় অঘটন ঘটাবে। অবশ্য এখনও কম কিছু করে নাই। যা হইছে তাতে তোদের বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে। তবুও এটা দরকার আছে।”
★★★
আদৃতারা বিদায় হওয়ার পর রিফাত বাবার কাছে এলো-“আরেকটা কথা ছিল বাবা।”
“কি কথা?”
“মা খুব খারাপ একটা কাজ করেছে।”
গোলাম রসুলের ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো-“সে আবার কি করেছে?”
রোকেয়া ভয়ে ভয়ে স্বামীকে দেখলো। রিফাতের উপর রাগ লাগছে ভীষণ। ছেলেটা আচ্ছা বউ পাগল হবে তো? রিফাতের দিকে অগ্নি দৃষ্টি বর্ষন করলো। রিফাত গা করলে না মায়ের বারন।
“আদৃতার উস্কানিতে মা শোভাদের বাড়ি যেয়ে ওর বাবাকে উল্টো পাল্টা কথা বলে বিয়ে ভেঙে দিয়ে এসেছে।”
“এ্যএ্যাহ! কবে?”
“তুমি ক’দিন অফিস নিয়ে বিজি ছিলে সেই সময়।”
গোলাম রসুলের চোখ মুখে বিরক্তি-“তোমাকে নিষেধ করেছিলাম রোকেয়া। আজমলের মতো ভালো মানুষের সাথে এমন কিছু করো না। তুমি শুনলে না। আমার মান সন্মান সব ডুবিয়ে দিলে।”
রোকেয়া নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হলো-“আমার কি দোষ? আদৃতাই তো বললো।”
“আর তুমি মেনে নিলে। কচি খুকি তুমি? কিছুই বোঝো না?”
রেগে গেলেন গোলাম রসুল। কপালে হাত দিয়ে চেপে ধরেন-“এখন কি করবো? আজমলকে মুখ দেখাব কি করে?”
রোকেয়া বিরবির করে-“আমি সব নষ্ট করেছি আমি সব টাকা করবো। তুমি ভেব না প্লিজ।”
“আর আজমল তোমার কথা মেনে নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বিয়ে দিয়ে দেবে। তাই না? তোমার সাথে কেউ এমন করলে মানতে?”
রোকেয়া চুপ করে রইলো। রিফাতের মনটা খারাপ হলো বাপের কথা শুনে। এমনিতেই শোভা মেয়েটা ভীষণ জেদি। এতদিনে একবারও কথা বলেনি ওর সাথে। এখন ওর বাপ যদি বেঁকে বসে তাহলেই হয়েছে। গোলাম রসুল যেন ছেলের মনোভাব বুঝলেন-“তুই টেনশন করিস না রিফাত। আমি দেখছি কি করা যায়।”
রিফাত শুকনো হাসি দিলো। বাবা কি করবে জানে না কিন্তু ও পাগল হয়ে যাবে শোভাকে না পেলে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin