আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-২৯+৩০

0
243

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২৯

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বাবা মাকে দেখে আরেকপ্রস্ত সারপ্রাইজ হলো শোভা। বাবা মা তার জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চলে এসেছে আজ। রাতে সবাই মিলে বেশ খাওয়া দাওয়া হলো। বাবা মা ভাই বোনেরা মিলে জমিয়ে আড্ডা হলো। আজমল শেখ বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বেশ ফুরফুরে। ছেলেমেয়েদের সামনে বসিয়ে তিনি জানালেন-“বিভার ইন্টার পাশ করে কোথাও চান্স পাওয়া পর্যন্ত ঢাকায় থাকব আমরা। সাদাতও ততদিনে কোন একটা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে যাবে। তখন আমরা দুই বুড়োবুড়ি বাড়িতে চলে গেলেও তোদের সমস্যা হবে না। বরং ছুটিছাটায় গ্রামে গেলে তোদেরও ভালো লাগবে।”
“ঠিক আছে বাবা। আমাদের কোন সমস্যা নেই। কি রে সাদাত, তোর কি মত?”
সাদাত ঘাড় হেলিয়ে সায় দেয়-“বাবার যেমন ইচ্ছে। তাছাড়া আমরা সবাই ইউনিভার্সিটি গেলে বাবা মায়ের একাই থাকতে হবে। সে হিসেবে তারা যেভাবে থেকে কমফোর্ট ফিল করবে সেখানেই থাকবে।”
“বাবা, আমি একটা কথা বলতে চাই।”
বিভা মুখ খুললো।
“হ্যা বল না কি বলবি।”
“বলছিলাম কি, তোমরা এখনই ফাইনাল কোন ডিসিশন নিও না। এতদিন পরে গ্রামে গেছ। আবার যাও, দেখো সেখানে থাকতে পারবে কিনা। যদি পারো তাহলে ভালো ন হলে আমার মনেহয় কিছু জমি বিক্রি করে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে থাকতে পারি আমরা।”
বিভার কথা শুনে কিছুটা চিন্তিত দেখায় আজমল শেখকে। শোভা মাথা দোলায়-
“বাবা, আমারও মনেহয় বিভা ঠিক বলেছে। আগে ওখানে গিয়ে দেখ থাকতে পারবে কিনা।”
“তোমাদের কথা শুনে খুশি হলাম। যা বললে সেটা যাচাই করতে আমরা আপাতত কিছুদিন যাওয়া আসার উপর থাকবো। তোমার চাচার সাথে জমিজমা ভিটে মাটি ভাগ করার কথা বলেছি। ভাগাভাগি হলে ভেবে দেখবো কি করা যায়।”
শোভা বিভা সাদাত কেউই আসলে চায় না তাদের বাবা মা তাদের ছেড়ে অতো দূরে চলে যাক। কিন্তু ওরা সরাসরি বললে তারা দুঃখ পেতে পারে ভেবেই ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলা। তাছাড়া ওদের ধারণা বাবা মা নিজেরাও ওদের ছাড়া ভালো থাকবে না। হয়তো এখন বুঝতে পারছে না কিন্তু একেবারে চলে গেলে তখন ফিরে আসাটা কষ্টকর হবে। তার আগে যদি কোন ভাবে রিয়েলাইজ করে তাহলে সবার জন্য ভালো হবে।

পরদিন বিকেলে রেজাল্টের কথা শুনে ক্যাম্পাসে ফিরে গেলো শোভা। ডিপার্টমেন্টে সর্বত্র ওর জয়জয়কার। সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়ে প্রথম হয়েছে শোভা। টিচাররা ওকে পার্সোনালি ডেকে নিয়ে এসব কথা জানিয়েছে। খুশিতে আত্মহারা শোভা প্রথম ফোনটা দিলো বাবা মাকে। তারপর রিফাতকে। কিন্তু অবাক ব্যাপার রিফাতের ফোন বন্ধ পাওয়া গেলো। পরপর কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরও একই কথা শোন যাচ্ছে-দুঃখিত আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।
শোভার ভ্রু কুঁচকে গেল। রিফাতের হলোটা কি? ওর ফোন কেন বন্ধ থাকবে? গতকাল বাবা মা আসাতে রিফাতকে আর ফোন করা হয়নি। আজ সারাদিন ও ফোন করেনি। এমনকি রিফাতও ফোন করেনি ওকে। হঠাৎ কি হলো রিফাতের? অসুস্থ হয়ে গেলো নাকি? চিন্তার ভাজ পড়ে কপালে। কিন্তু বেশীক্ষণ স্হায়ী হয় না। ক্লাসের বন্ধুরা ওকে ঘিরে ধরে হইচই করছে। ভালো রেজাল্ট উপলক্ষে সবাইকে নাকি খাওয়াতে হবে। শোভাকে নিয়ে ওরা চললো ক্যান্টিনে। রিফাতের ভাবনা মাথায় রাখার সুযোগ হলো না শোভার।

★★★

তিনদিন ধরে পাগলপারা হয়ে রিফাতকে ফোন করে চলেছে শোভা। দিন নেই রাত নেই, চোখে ঘুম নেই কেবল ফোনটা হাতে নিয়ে অনবরত ডায়াল করছে। কার কাছ থেকে খবর পাবে তাও জানে না। রিফাতের কোন বন্ধুর নাম্বার নেই তার কাছে। লজ্জার মাথা খেয়ে বিভাকে ফোন করে জানতে চেয়েছে কিন্তু বিভা বললো কিছুই জানে না। অনেকদিন কথা হয়নি রিফাতের সাথে। এমনকি গালিবের ম্যাসেন্জারেও নক দিয়েছে, কল করেছে কিন্তু নো রেসপন্স।

ভারী অস্থিরতায় পড়েছে শোভা। সারাদিন ফোন দিয়ে খোঁজ নেওয়া মানুষটা হঠাৎ করে ফোন কেন বন্ধ করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোন সমস্যায় পড়লো কিনা নাকি অসুস্থ হলো ভেবে ভেবে সারা হচ্ছে। মাঝে মাঝে আদৃতার কথা ভেবে ভয়ও পাচ্ছে। আদৃতা যেমন মেয়ে তার এতো সহজে চুপ থাকার কথা না। শোভার কেমন যেন পাগল পাগল লাগে। ভালো রেজাল্ট করে যে আনন্দ হয়েছিল এখন ঠিক ততটাই কষ্ট হচ্ছে। ক্লাস শুরু হয়েছে কিন্তু ক্লাস করতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তায় কান্না করছে শোভা। কি হলো মানুষটার? ইচ্ছে করছে ওদের বাসায় ছুটে যেতে। যদিও শোভা বাসা চেনে না কিন্তু বাবা মা তো চেনে? মাকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই বলবে? কিন্তু এমন কাজ করা কি উচিত হবে? নিজের মুখে বিয়ের ব্যাপারে মানা করেছে শোভা। এখন রিফাতের কথা জানতে চাইবে কোন মুখে? নিজের সিদ্ধান্তে নিজেই পস্তাচ্ছে শোভা। মনেহচ্ছে বিয়ে কথা মানা করে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। নয়তো রিফাতের খবর নিতে আজ এতো দ্বিধায় ভুলতো না।

রাতের না খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে শোভা। এখন দুশ্চিন্তার বদলে রাগ হচ্ছে ওর। শোভাকে এভাবে চিন্তায় ফেলে মজা নেওয়া হচ্ছে? ঠিক আছে শোভাও দেখে নেবে কতদিন ফোন বন্ধ করে রাখে রিফাত। খুব তো ভালোবাসি ভালোবাসি বলে গলা ফাটিয়ে ফেলেছিল। এই বুঝি ভালোবাসার নমুনা? ভালোবাসলে বুঝি এরকম টেনশনে রাখতে পারতো? অভিমানের জলে নয়ন ভিজে যায় বারবার। এতটা সন্মান আর ভালোবাসা দেখানোটা কি তাহলে মেকি ছিলো? এই যে জীবনে প্রথমবার শোভার জন্মদিন এতোটা সুন্দর আর আলাদা করে পালন করা, শোভাকে বিশেষ কিছু ফিল করানো এসবই মিথ্যে ভান ছিলো? এই যে এতোগুলো স্বর্নালী সন্ধ্যা উপহার দিয়েছে শোভাকে কেন? এভাবেই ফেলে চলে যাবে বলে?

ক্ষোভে দুঃখে ঘুমের মাঝেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো শোভা। বিরবির করে চলেছে-“কোথাও হারিয়ে গেলেন? একবার কি বলে যাওয়া যেত না? আমি না হয় আপনাকে চাইনি কিন্তু আপনি তো চেয়েছেন। তাহলে কেন এই অবহেলা?”
ঠিক সেই মুহূর্তে শোভার ফোনটা বেজে উঠলো কর্কশ শব্দে। হতচকিত শোভা লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। মোবাইলে চোখ পড়তেই শ্বাস আঁটকে এলো। রিফাতের নামটা জ্বলজ্বল করছে স্ক্রীনে। সত্যি কি রিফাত নাকি চোখের ভুল? ভালো মতো চোখ রগড়ে নিলো শোভা। নাহ রিফাতই তো। অভিমান জাকিয়ে ধরলো ওকে। হুম, তিনদিন কষ্ট দিয়ে আজ ফোন করেছে তাও এই গভীর রাতে। এখন আমিও ফোন রিসিভ করবো না।

অভিমান নিয়ে বসে থাকলেও মনটা আনচান করছে রিফাতের ফোন ধরার জন্য। রিফাতও অসীম ধৈর্য্য নিয়ে ফোন দিয়েই যাচ্ছে দিয়েই যাচ্ছে। শেষ মেষ না পারতে শোভা ফোন রিসিভ করে-“তিনদিন পরে মনে পড়লো আমার কথা? কোথায় ছিলেন আপনি? জানেন কতশত বার ফোন দিয়েছি আপনাকে? কিন্তু আপনাকে কেন এসব বলছি? আপনার কি কেয়ার আছে আমার প্রতি? থাকলে ফোন বন্ধ করার আগে একবার ভাবতেন আমি কি করবো? আমার টেনশন হতে পারে। কত বাজে চিন্তা মাথায় আসছে। ঘুমাতে পারছি না একফোঁটা। কেন করলেন এমন? জানেন চিন্তা করতে করতে আমার কি হাল হয়েছে?”
বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় শোভা। ওপাশ একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে। চুপচাপ শোভার কান্না শুনছে আর দীর্ঘ শ্বাস ফেলছে। কিছুক্ষণ বাদে রিফাতের গলা শোনা গেল-“আর কতোক্ষণ কাঁদবে পাগলী? কান্না শোনার জন্য বুঝি সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড় থেকে এই সাত সকালে এতো আয়োজন করে ফোন করেছি?”
শোভার ফোপাঁনি বন্ধ হয়ে গেলো। চমকিত কন্ঠে প্রশ্ন তুললো-“মানে কি? কি বলছেন এসব?”
“তুমি আমাকে এতো মিস করবে জানলে ফোনটা বহু আগেই বন্ধ করে দিতাম।”
রিফাত কথা ঘুরিয়ে নেয়। শোভা নাছোড়বান্দার মতো মাথা নাড়ে-“কথা ঘুরিয়ে নেবেন না। কি যেন বলছিলেন? সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড় মানে কি? কোথায় আপনি?”
রিফাত হাসলো-“তা জেনে তোমার কি লাভ? তুমি তো এমনিতেই আমাকে সহ্য করতে পারো না। কাছে থেকে কেবল তোমায় বিরক্ত করা ছাড়া আমার আর কি কাজ? আর আমি কাছে থাকি কিবা দূরে। তোমার তাতে কিছু যায় আসে কি? বরং আমি দূরে থাকলেই তো তুমি খুশি।”
শোভা কড়া গলায় বললো-“যা জানতে চেয়েছি তাই বলুন। কোথায় আপনি?”
রিফাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হতাশ গলায় বললো-“যতটা দূরে থাকলে আমি আর তোমায় বিরক্ত করবো না ঠিক ততটা দূরে আছি তোমার থেকে।”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-৩০

“প্লিজ ভাববাচ্যে কথা না বলে পরিস্কার করে বলুন কি বলতে চাইছেন। কোথায় আছেন আপনি?”
দূরালাপনির অপর প্রান্তে দীর্ঘ শ্বাস পড়লো-“বাবা অনেকদিন ধরে চান তার বিজনেসে বসি কিন্তু আমি রাজি না। এদিকে আরেকজন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো না। ছেঁচড়ার মতো তার পিছনে পড়ে থেকেও তাকে গলানো গেল না। তো দেশে বসে থেকে করবোটা কি? কার জন্য দেশে থাকবো? কেউ তো চাইছে না আমায়। তাই ভাবলাম বসে না থেকে সময়টা কাজে লাগাই। তাছাড়া একটা বিজনেস ডিগ্রি থাকলে ব্যবসা বুঝতে সুবিধা হবে তাই লন্ডনে চলে এলাম। ভালো করেছি না? এখন তোমাকেও আর বিরক্ত করবো না। নিশ্চিতে পড়ালেখা করতে পারবে তুমি।”
শোভা বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। রিফাত তাকে না জানিয়ে এরকম ডিসিশন নিয়ে নিল! যদি দূরেই যাবে তবে কাছে আসার এতো চেষ্টা কেন করলো? শোভা নির্বাক হয়ে বসে রইলো। রিফাত হ্যালো হ্যালো করে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। শোভা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে-“এরকম লুকিয়ে চুরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মানে কি রিফাত? দূরেই যদি যাবেন তবে আমার সাথে এ কেমন খেলা খেললেন বলুন তো?”
শোভার শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেল ছেলেটা। কি প্রতিউত্তর দেবে ভেবে কিছু সময় চুপ রইলো। তারপর মৃদু হেসে বললো-“খেলা! খেলা কেন হবে শোভা? এসব বলে আমাদের বন্ধুত্বটা ছোট না করলেও পারতে। তাছাড়া প্রত্যাখ্যান তো আমি সয়েছি শোভা তুমি কেন অভিযোগের আঙুন তুলছো আমার দিকে? বারে বারে তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছ আমি না। কাজেই এসব বলাটা একদম অর্থহীন লাগছে।”
রিফাতের কড়া কথায় শোভা থমকে গেলো। আসলেই তো, সে কেন রিফাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে? রিফাত তো তার মন জয় করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে তবুও ওকে অপরাধী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কতটা যুক্তি্যুক্ত? শোভার মাথাটা কেমন যেন ভার ভার লাগে। রিফাত দেশে নেই কথাটা মনে এলেই মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হৃদয় জুড়ে আন্দোলন হচ্ছে। বিদ্রোহ করতে মন চাইছে। অভিমানে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। রিফাতের শান্ত ধীরস্থির কন্ঠ শোনা গেল-“তুমি চাইলে এই দূরত্ব কমিয়ে ফেলা যাবে শোভা। আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও। আমি দেশে ফিরে আসবো। আর তা না হলে এই অনিচ্ছাকৃত দূরত্ব মেনে নিতে হবে।”
“আমি চাইলে? আমি চাইলেই সব হবে রিফাত? এই প্রশ্নটা আগে করলেন না কেন? চলে যাওয়ার আগে জানাতে পারতেন?”
রিফাতের খরখরে হাসি শোনা গেল-“জানালে কি হত শোভা? তোমার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত পাল্টে যেত? জানি কিছুই হতো না। কারণ তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না। ভালোবাসলে হয়তো কাছে রাখার চেষ্টা করতে।”
শোভা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এতো স্পষ্ট শব্দের বিপরীতে কি বলবে সে? রিফাত আজ এতো কঠোর কেন তার প্রতি? এরকম কঠোরতা মেনে নিতে পারছেনা সে।
“আমার কথায় হয়তো অবাক হচ্ছ তুমি। কিন্তু কি করবো বলো। তোমাকে বহুবার বহুভাবে বলেও বোঝাতে পারিনি, আম ইন লাভ উইদ ইউ। যা কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল সেটা আদৃতার কারণে। কিন্তু ও চলে গিয়েই বা কি লাভ হলো? তুমি তো তোমার সিদ্ধান্তে অটল। আচ্ছা বাদ দাও এসব আলোচনা। এখন তো আমি নেই, তোমার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটানোর কেউ রইলোনা। মন দিয়ে পড়ালেখা কর। কেমন?”
কতকিছু বলার ছিলো রিফাতকে। নিজের রেজাল্টের খবর, বাবা মায়ের কথা কিন্তু কিছুই বলতে মন চাইলো না। শোভা টুক করে ফোনটা কেটে দিলো। মাথা কাজ করছে না। তিনদিন তিনরাত সে ঘুমায় না। রিফাতের ফোন পেয়ে শরীর সিথিল হয়ে গেছে। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ সত্বেও শোভার চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। ফোনটা দূরে সরিয়ে সে বালিশে মাথা দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

★★★

আজকাল শোভার দিনগুলো খুব নিরানন্দে কাটছে। সকাল থেকে ক্লাস, প্রজেক্ট, এসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ততা। তারপর ক্লাস শেষে ক্লান্ত হয়ে রুমে ফেরা। খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুম। ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা। না কোথাও বেড়াতে যাওয়া না অন্য কিছু। রুমমেট দু’জন, ক্লাসের বন্ধুরা ওকে বহুবার বহু জায়গায় ঘোরাতে নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু ওদের সাথে কোথাও যেতে শোভার মন টানে না। ওর তো রিফাতের সাথে বেড়ানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষটা ওর সব সুখ সুবিধার দিকে নজর রেখে ওকে বেড়াতে নিত। কখনো কোন অসুবিধা অনুভব করেনি ও। সেই যে বিকেলে নদীর ধারে বসে থাকা, চা খাওয়া এসব কি অন্য কারো সাথে করে মজা পাবে? শোভা তাই কোথাও যায় না। চুপচাপ রুমে বসে থাকে। এমনকি ঢাকায় গেলেও আজকাল আগের মতো চুপচাপ থাকতে শুরু করেছে। মা কয়েকবার জানতে চেয়েছে কি হয়েছে। শোভা কিছু না বলে এড়িয়ে গেছে।

ওদিকে রিফাত শোভাকে ফোন দিতে দিকে পাগল হওয়ার দশা। সেদিনের পর না শোভা তার ফোন ধরছে না নিজ থেকে ফোন করছে। অধৈর্য্য হয়ে প্রায়ই হাতের ফোনটাকে আছাড় দিতে দিতে থেমে যায়। সপ্তাহ খানেক পরে টের পেলো শোভার নাম্বারে আর ফোনই ঢুকছে। বুঝলো শোভা তাকে ব্লক দিয়েছে। তার সাথে আর কথা বলতে চায় না শোভা এটা বুঝতে পেরেই মনটা কেমন যেন দমে গেল। এমনিতেই শোভার মনের তল খুঁজে পায় না। এখন দূরে এসে যদি ওকে পুরো পুরো হারায় তাহলে বেঁচে থাকা মুশকিল হবে। পরের ক’দিনে রিফাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো। দুই সপ্তাহের বেশি কথা হয় না শোভার সাথে। নতুন নতুন ক্লাসে জয়েন করেছে। শোভার ভাবনা ভাবতে গিয়ে ক্লাসে মন দিতে পারছে না। ফলাফল একটা লেকচারও মগজে ঢুকছে না। বাধ্য নতুন একটা সিম কিনলো রিফাত। অপরিচিত নাম্বার হলে ফোন ধরবে হয়তো।

মন খারাপ করে বসে ছিল শোভা। আজ ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে জানালায় বসে বৃষ্টি দেখছিলো। ভাবছে রিফাত যাওয়ার পর তার দিনগুলো একদম সাদাকালো হয়ে গেছে। কতভাবে মন ভোলানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। মন সেই রিফাতের সাথে কাটানো সন্ধ্যাগুলোতে আঁটকে আছে। কতভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখে তবুও দিনগুলো থমকে গেছে যেন। কোন কিছু ভালো লাগে না। এমনকি পড়তে বসেও ক্ষনে ক্ষনে কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর টের পায় অকারণ কান্নায় গাল ভিজে গেছে। নিজের উপর বিরক্ত শোভা। এসব কি হচ্ছে তার? আর কেনই বা হচ্ছে? রিফাতকে এতো তীব্র ভাবে মিস করছে কেন সে? কেন মনে হচ্ছে ওই বিরক্তিকর মানুষ বাদে আর কারো সাথে বেড়াতে ভালো লাগবে না তার? এসব ভেবেই কান্নার তীব্রতা বাড়লো। এরমাঝেই ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। বিরক্ত শোভা না দেখেই ফোনটা রিসিভ করলো। কান্না ভেজা কন্ঠে বললো-“হ্যালো।”
ওপাশ নিশ্চুপ। শোভা বিরক্ত হয়ে ‘ধ্যাৎ’ বলে ফোন রাখবে এমন সময় শোনা গেলো-“মেঘা, তুমি কাঁদছো? কি হয়েছে মেঘা? কাঁদছো কেন তুমি?”
রিফাতের গলা শুনে শোভার মেজাজ খারাপ হলো। সে ধীমে স্বরে গর্জন করে উঠলো-“আপনি! আপনি কেন ফোন করেছেন?”
“মেঘা প্লিজ ফোন কাঁটবে না। যদি আজ ফোন কাটো তবে আমি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ব্যাক করবো। তারপর তোমার সোজা তোমার বাবার কাছে যাব। যেয়ে তাকে তার মেয়ের কীর্তি বলবো।”
মোবাইল ছুড়তে যেয়েও পারে না শোভা। সে হিসহিসিয়ে জানতে চাইলো-“কি বলবেন বাবাকে?”
“বলবো তার মেয়ে আমাকে তার থেকে দূরে থাকতে দিলো না। তার মেয়ে চায় আমি সারাজীবন তার পেছনে ঘুরি কিন্তু সে আমাকে বিয়ে করবে না। এবার বিচার সে করুক।”
শোভা অবাক গলায় বললো-“এসব আমি কখন চাইলাম? এভাবে মিথ্যে বলতে বাঁধে না আপনার?”
রিফাত হাসলো-“কোনটা মিথ্যে মেঘা? দিনের পর দিন ফোন রিসিভ না করে তারপর ফোন বন্ধ রেখে আমাকে অস্থির করে তোলনি তুমি? কেন কথা বলছো না আমার সাথে? আমার অপরাধ কি? যখন কাছে থেকেছি তখনও এমন করেছ আবার এখন দূরে চলে এসেছি এখনও এমন করছো। তুমি আসলে কি চাও বলবে আমাকে?”
“আমি জানি না আমি কি চাই। আমি সত্যিই জানি না। আমার একদম ভালো লাগছে না একা একা। খুব কষ্ট হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে মরে যাই। আপনি কেন আমাকে না জানিয়ে চলে গেলেন? কেন? কেন?”
শোভা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। রিফাত পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। এমন কিছু ঘটবে সে সত্যিই আশা করেনি। শোভা তো তাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিচ্ছিল। তাহলে এখন এসব কি বলছে? তবে কি শোভা ওকে..?
“মেঘা মেঘা, প্লিজ কাঁদে না। এই মেয়ে, কেন কাঁদছো বলো তো? ওখানে তুমি একা কিভাবে? তোমার বাবা মা ভাই বোন বন্ধু বান্ধব সবাই তো আছে। তাহলে একা হলে কি করে?”
রিফাত ব্যাকুল গলায় শোভাকে বোঝাতে লাগলো। শোভা নাক টানে-“সবাই থাকলেও আপনি তো নেই। আমার ভীষণ লোনলি ফিল হচ্ছে। আপনাকে মিস করছি খুব। আপনার সাথে বেড়ানো মিস করছি।”
“ওহহহ তাই বলে। বেড়ানোটা মিস করছো।”
রিফাতের কথায় শোভা বিচলিত বোধ করে-“ঠিক তা না। আসলে আপনার সাথে কাটানো সময়গুলো মিস করছি। একসাথে বেড়াতে যাওয়া, নদীর ধার, চা আর সন্ধ্যাগুলো ভীষণ মনে পড়ে।”
রিফাত খানিকটা মন খারাপ করে জবাব দেয়-“এ আর এমনকি ব্যাপার। বন্ধুদের নিয়েও নদীর পাড়ে যেতে পারবে, চা খেতে পারবে। আর সন্ধ্যা তো প্রতিদিনের শেষেই আসছে।”
“আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। এসবই আমি বন্ধুদের সাথে করেছি কিন্তু আপনার সাথে মনে যতটা আনন্দ পেয়েছি ওদের সাথে পাইনি।”
“তো? তাতে কি হয়েছে? আমার সাথে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছিল তাই হয়তো এমন লাগছে।”
রিফাত না বোঝার ভান করে শোভাকে আরেকটু খোঁচায়। শোভা তাতে দমে গেলো না। আরেকটু মনমরা হয়ে উত্তর দিলো-“বড্ড বাজে অভ্যাস হয়েছে। মনটা সারাক্ষণ আপনাকে খোঁজে। আমি মনেহয় আপনাকে…। কেন এমন করলেন বলুন তো?”
শোভার কন্ঠ ভীষণ অসহায় শোনায়। রিফাতের চেহারায় যুদ্ধ জয়ের আনন্দ যেন। সে আনন্দ অবশ্য গলায় ফুটালো না-“তুমি কি বলছো বুঝতে পারছি না মেঘা। আমি কি করেছি? তুমি আমাকে কি? পরিস্কার করে কথা বলো?”
শোভা এবার রেগে গেলো-“আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন না তাই তো? কিছুই করেননি আপনি এটাই বলতে চাইছেন? তাহলে আমার সারাদিন কান্না পায় কেন? পড়ালেখায় মন নেই কেন? আর এসব কিছুর জন্য আপনি দায়ী। জোর করে আমার সাথে সময় কাটিয়ে আমার অভ্যাস খারাপ করেছেন।”
“এ জন্যই তো দূরে চলে এসেছি। আর কোন জোরাজোরি করবো না, জ্বালাবো না।”
রিফাতের অভিমানী কন্ঠ শুনে চুপসে গেলো শোভা। অপরাধী গলায় বললো-“আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারছেন না কিছু?”
“কি বুঝবো বলো তো? ওখানে সবার সাথে থেকে বলছো তুমি একা। তাহলে এখনে আমার কি হাল ভাবো? একাই রান্না করতে হচ্ছে আবার ক্লাস করতে হচ্ছে। তার মধ্যে আবার তুমিও কথা বলছো না। তাহলে বোঝ আমার কেমন লাগছে?”
“আমি ওসব বলছি না।”
“তাহলে কি বলছো?”
“আমি আমি আআ মিই না আপনাকে ভালোবাসি রিফাত। আপনাকে ভীষণ মিস করছি। আপনাকে ছাড়া থাকা যাচ্ছে না। দিনগুলো ভীষণ কষ্টে যাচ্ছে।”
ওপাশ নিশ্চুপ। এমনকি নিঃশ্বাসের আওয়াজও নেই। শোভা ভাবলো ফোন কেটে গেছে বোধহয়। চোখের সামনে মোবাইল মেলে দেখলো না কানেকশন কাটেনি। আবার হ্যালো হ্যালো করলো শোভা। অনেকটা সময় পর রিফাতের পুরুষালী গলা ভেসে এলো-“নিঃশ্বাস আঁটকে গেছিল মেঘা। এইমাত্র সেটা ফিরে পেলাম। গায়ে চিমটি কেটে পরীক্ষা করলাম আমি বেঁচে আছি কিনা। যা শুনলাম সেটা সত্যি কিনা?”
শোভা যেন হুশ ফিরে পেলো। ওর গাল দুটো যেন পাকা চেরি এমনই লালচে হয়ে গেলো। বোকা মেয়েটা চোখ বুঁজে ভাবছে, একি বলে ফেললো সে?

চলবে—
©Farhana_Yesmin