#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-৩২ ও শেষ
সূর্য ডুবি ডুবি, আকাশ লালে লাল। বহুদিন পরে মুগ্ধতা নিয়ে সূর্যের পানির মধ্যে লুকিয়ে পড়া উপভোগ করছিল শোভা। গত এক বছরের বেশি সময় এই মুহূর্তটা ভীষণ মিস করেছে সে। প্রিয় মানুষের সাথে বসে চা পান করতে করতে প্রিয় সময়টা উপভোগ করা। অন্যরকম একটা আনন্দ মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। শোভা বিভোর হয়ে ছিলো সময়টাতে। আচমকা হাতে পুরুষালী স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকাল। রিফাত ওর হাতটা ধরে আছে এক হাত দিয়ে। শোভা দেখলো অপর হাতে একটা হীরের আংটি জ্বলজ্বল করছে। শোভা মোহগ্রস্তের মত আংটির দিকে তাকিয়ে রইলো। সাতরঙা পাথরের আংটিটা দেখতে এতোটাই সুন্দর লাগছে যে শোভা বেহায়ার মতো ওটাকেই দেখছে। বুকের ভেতর দুরুদুরু কাঁপন ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কি করবে রিফাত আংটি দিয়ে?
“মেঘা, এই আংটিটা আমি অড জব করে কিনেছি। যদিও অড জবের প্রয়োজন ছিল না কোন এমনিতেই কিনতে পারতাম। কিন্তু কেন যেন একদিন ইউনি যাওয়ার পথে জুয়েলারি শপের মধ্যে এই আংটিটা নজরে আসে। তারপর ঠিক করলাম এটা বিশেষ একজনার জন্য কিনবো এবং ওখানেই কোন কাজ করে টাকা কামিয়ে কিনবো এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করি। দীর্ঘ একমাস অড জব করে এটা কিনেছি। জিনিসটা সুন্দর না?”
শোভা ধ্যানেগ্রস্থের মতন মাথা দুলায়।
“তোমার পছন্দ হয়েছে?”
শোভা থমকে গেল। চোখদুটোতে রাজ্যের আনন্দ।
“ইউ নো মেঘা, অনেকদিন এই সময়টা কল্পনা করেছি মনে মনে। আমাদের বিশেষ মুহূর্ত হবে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় সময়ে। প্রিয় জায়গায় হলে তো আরও কথা নেই। সব ভেবেই এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তোমার কাছে। তারপর এই যে আমাদের প্রথম আউটিং এর জায়গায় এলাম।”
রিফাত থামলো কিছু সময়। বসা থেকে উঠে হাঁটু মুড়ে শোভার সামনে বসলো। শোভা বোকার মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ও আসলে বুঝতে পারছে না কি বলবে বা কি করবে। রিফাত শোভার বাম হাত ধরে কাছে টানে। রিফাতের চোখে ক্লান্তি অথচ মুগ্ধতা ছেয়ে আছে। সে আকুল কন্ঠে শোভার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“মেঘা, উইল ইউ ম্যারি মি?”
হতবিহ্বল শোভার ঘোর লাগা নয়ন রিফাতে স্থির। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। গত একবছরের লুকোচুরি খেলা অবশেষে শেষ হলো। তবুও বুকের ভেতর দামামা বাজছে যেন। হার্ট এতো দ্রুতলয়ে বিট করছে যেন শোভার হার্ট অ্যাটাক হবে। ওর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে চোখের কোলে জল। রিফাত আগ্রহী নয়নে শোভার দিকে তাকিয়ে জবাবের আশায়। শোভা মাথা দুলিয়ে হাসলো।
“মুখে বলো প্লিজ। উইল ইউ ম্যারি মি মেঘা?”
“ইয়েস। আই উইল ম্যারি ইউ।”
“তাহলে এই যে আমার নামের মোহর পড়িয়ে দিলাম তোমার হাতে।”
শোভার বাম হাতের অনামিকায় এখন হীরের আংটি জ্বলজ্বল করছে। রিফাত হাতটা টেনে মুখের কাছে নিয়ে তাতে উষ্ণ অধরের স্পর্শ দিলো। শোভার শরীর কেঁপে উঠলো তাতে। তা বুঝেই মুচকি হাসলো রিফাত। ওকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে ওর পেছনে যেয়ে দাঁড়ালো শোভাকে নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে নিয়ে দু’হাতে ওর দু’হাত বেঁধে পেটের উপর হাত রেখে জড়িয়ে ধরে সামনে ইশারা করে কানে ফিসফিস করলো-“ওই যে সূর্য ডুবছে। এই ডুবন্ত সূর্যকে সাক্ষী করে তোমাকে নিজের করে নিলাম। আজকের পর আর কোন কিছু আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। আর কোন দূরত্ব আমাদের দূরে ঠেলে দিতে পারবেনা। ঠিক তিনদিন পরে তুমি বউ হয়ে আমার জীবনে আসবে। এরপর প্রতিটা সন্ধ্যায় তুমি আমার সাথে থাকবে কাছে থাকবে।”
এমনিতেই আংটি পরে মনটা কেমন যেন আকুপাকু করছে। তার উপর রিফাতের এমন কথা শোভার হৃদয় আন্দোলিত করছে। শরীর জুড়ে শিরশিরে অনুভব। কেমন একটা অনুভুতি সেটা কেবলমাত্র শোভাই জানে।
“গত এক বছরে তোমার কাছ থেকে দূরে থেকে যতটা কষ্ট পেয়েছি তোমাকে কাছে পেয়ে তার দ্বিগুণ উসুল করবো। বউ তোমাকে ভীষণ জ্বালাব মেঘা। বিরহে যে রকম কাঁদিয়েছ মিলনে তার চাইতে বেশি কাঁদাবো তোমায়। টু শব্দ না করেই সইতে হবে এই আমাকে।”
রিফাতের ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো শোভাকে লাজুকলতা করে তুলছে। কানদুটো দিয়ে গরম হলকা বের হচ্ছে। শরমে মুখ নামিয়ে নিলো শোভা। তা দেখে রিফাত হাসলো-“এটুকুতেই এই অবস্থা? এখনো অনেক লজ্জা পাওয়া বাকী আছে তোমার। বিয়ের পরের রাতগুলোর কথা ভাবো।”
শোভা আচমকা রিফাতের দিকে ফিরে ওর মুখ চেপে ধরে-“পঁচা কথা বলা বন্ধ করুন।”
রিফাত শোভার হাত সরিয়ে নিলো। ওর চোখ মুখ জুড়ে দুষ্ট হাসি। শোভাকে দেখছে মন দিয়ে আর মুচকি হাসছে-“করবো না। আরও বেশি করে বলবো। এটাই তোমার শাস্তি আমাকে একবছরের বিরহ দেওয়ার জন্য।”
অভিমানে ঠোঁট ফোলায় শোভা-“তাহলে তো দেখছি আপনাকে বিয়ে করা যাবে না। আপনি শুধু কষ্ট দেবেন আমাকে।”
কথাটা শোনা মাত্রই শোভার হাত মুচড়ে ধরে রিফাত। শোভা আহ শব্দ করতেই হাত ছেড়ে দিলো। রিফাত গম্ভীর মুখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো-“আর যাই বলো বা করো এমন কিছু ভুলেও আর মাথায় এনো না। একবার মেনে নিয়েছি বলে বারবার মানবো এমন ভুলের মাঝে থেকোনা।”
শোভা হাত ডলতে ডলতে মিনমিন করলো-“আমি কি সিরিয়াস ভাবে বলেছি নাকি?”
রিফাত ওকে বুকে টানলো-“ফান করেও আর এমন কিছু বলো না। বুকে লাগে।”
রিফাতের বুকে মাথা রেখে শোভা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। রিফাতের বুকের টিপটিপ শব্দ শুনছে। কি দারুণ ছন্দ এটা? শোভা বিভোর হয়ে ভাবে, প্রিয়জনের বুকে মাথা রেখেও এতো সুখ সেটা আজকের আগে জানা হয়নি।
★★★
মাত্র সাতদিনের নোটিশে বিয়ে হলো শোভা আর রিফাতের। যে অনুষ্ঠানগুলো না করলেই নয় সেগুলোই করেছে দু’পক্ষ। কোনরকমে বিয়ে পর্ব শেষ করে পরদিনই ওরা চলে এসেছে কক্সবাজার হানিমুন সারতে। প্রাইভেট কটেজ ভাড়া নিয়েছে রিফাত। একদম সাগরের কাছাকাছি কটেজ, ব্যালকনিতে বসে সাগরের বিস্তীর্ন জলরাশি দেখা যায়, শোনা যায় ঢেউয়ের শব্দ।
শোভা রুমে ঢুকতেই আনন্দে চেচিয়ে উঠলো। ছুটে ব্যালকনিতে যেতে চায়। রিফাত ওর হাত ধরে-“এখন না। পরে যেয়।”
শোভা অধৈর্য্য হয়ে জানতে চাইলো-“কেন? এখন গেলে কি সমস্যা?”
রিফাত হ্যাচকা টানে শোভাকে বুকে আনে-“কোন সমস্যা নেই। তবে এখন তুমি ব্যস্ত থাকবে কিনা।”
শোভা আকাশ থেকে পড়ে-“ব্যস্ত? কিসের ব্যস্ত? এখানে এসেছি হানিমুনে এখানে কিসের ব্যস্ততা?”
রিফাত দুষ্ট হাসি দিয়ে শোভাকে আরও একটু আগলে ধরে। আচমকা ওর নাকে মুখে চুমু দিয়ে বললো-“হানিমুনে এসেছ অথচ হানিমুন করবে না? আর বলছো কিসের ব্যস্ততা?”
শোভা যেন বুঝে গেলো রিফাত কি বলতে চাইছে। সে নিজেকে ছাড়াতে মোচড়া মুচড়ি শুরু করতেই রিফাত তাকে কোলে তুলে নিলো-“বলেছিলাম না জ্বালাব।”
শোভা মিনমিন করলো-“কি করছেন কি? ছাড়ুন প্লিজ।”
“ছাড়বো বলে ধরেছি বুঝি? বিয়ের পরদিন হানিমুনে এলাম কি করতে সেটা এখন বুঝিয়ে দেব।”
“একদম ভালো হবে না কিন্তু?”
শোভা হুশিয়ারি উচ্চারণ করতেই রিফাত সে কথা না শোনার ভান করে শোভাকে বিছানায় ছুড়ে দিলো। তারপর গায়ের শার্ট খুলে ওর উপর ঝাপিয়ে পড়লো। শোভার দু’হাত বিছানার সাথে আঁটকে রেখে চুমুতে চুমুতে অস্থির করে তুললো শোভাকে। শোভা কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু সুযোগ পেল না। তার আগেই রিফাত তার অধর দখল করে নিলো। অনেকটা সময় পরে শোভাও ডুবে গেছে রিফাতের মাঝে।
এরপর পুরো রুম জুড়ে কেবল দু’জনার ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ। একে অপরকে আঁকড়ে ধরে পুরো ধরাধাম ভুলে একে অপরের মাঝে বিলিন হচ্ছে ওরা। তুমুল ভালোবাসাবাসির মাঝে রিফাত শোভাকে ডাকে-“লাভ ইউ মেঘা।”
প্রতিউত্তরে শোভা হাসলো। মনে মনে উচ্চারণ করলো-“লাভ ইউ টু।”
রিফাত যেন ওর বলা কথাটুকু বুঝে গেলো। নতুন করে শোভাতে মেতে উঠলো।
বিকেলের সোনাঝরা রোদে দু’জন হাঁটতে হাঁটতে সাগরের কাছাকাছি এসেছে। হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সাগরের জলে সূর্যের একটু একটু করে তলিয়ে যাওয়া দেখছে। শোভার পরনে আকাশি রঙা শাড়ী আর রিফাতের পরনে নীল রঙা পাঞ্জাবি। দু’জনারই চোখেমুখে আহ্লাদের প্রকট প্রকাশ।
“আমি চাই আমাদের জীবনের প্রতিটা সন্ধ্যা এরকম হোক। ওই যে সূর্যের মতো। ডুবে যেতে যেতে লাল কমলার মিশেলে অদ্ভুত একটা রঙে ভুবন ভরিয়ে দিলো পরদিন আবার আসবে বলে। আপনার ভালোবাসা আমার জীবনে ওই ডুবন্ত সূর্যের মতো হোক। প্রতিদিন নতুন করে আলো নিয়ে আসবেন বলে সন্ধ্যাটা আধারে না ডুবে হোক অদ্ভুত আলোয় আলোকিত।”
রিফাত এগিয়ে এসে শোভাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে-“আর আমি চাই আমাদের জীবনে এরকম সন্ধ্যা প্রতিদিন আসুক। প্রতিটা সন্ধ্যায় তোমার হাত ধরে অজানা পথে হাঁটতে চাই শোভা।”
“মি টু। ওই যে দেখুন সূর্যটা ডুবছে।”
শোভা হাত দিয়ে ইশারা করলো। রিফাত মৃদু হেসে সেদিকে তাকায়। হঠাৎ শোভার মৃদু গুনগুন শোনা গেল-“আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দু’জনে।”
রিফাত এবার গলা মেলায়-“চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।”
সমাপ্ত।
©Farhana_Yesmin