আবার প্রেম হোক ২ পর্ব-১৮+১৯

0
627

#আবার_প্রেম_হোক (২য় খন্ড)
#নুসরাত_জাহান_মিম

১৮.
“আমি তোমার ভাইকে পছন্দ করি ভাবি”

আচানক রুবার মৌনতা ভাঙতেই অবিশ্বাস্যনীয় দৃষ্টি সহিত তার পানে চাইতে বাধ্য হয় চাঁদ।অতঃপর কপাল কুচকে রেখেই প্রশ্ন করে,

“কার কথা বললে?”

খানিক কেশে চাঁদ হতে দৃষ্টি সরিয়ে ইতস্তত করতে করতে রুবা জবাব দেয়,

“তোমার ভাইয়ের কথা বলেছি।মিস্টার চৈত্রের”

এবারে কপাল মাত্রাতিরিক্ত কুচকে কিয়ৎক্ষণ রুবার পানে চেয়ে থাকে চাঁদ।অতঃপর দৃষ্টি অন্যদিকে করে বেশ গম্ভীরকন্ঠে শুধায়,

“তুমি কার সামনে কী কথা বলছো জানো?”

বেশ সাবলীল জবাব রুবার,

“হ্যা জানিতো।আমার ভাবির সামনে আমার পছন্দের বিষয় তাকে জানাচ্ছি”

“তবে কার কথা বলছো সে খবর আছে?”

“অবশ্যই আছে।আমি আমার ভাবির ভাইয়ের কথা বলছি।অর্থাৎ আমার বেয়াই”

“দেখো রুবা,তুমি বিষয়টাকে যতটা সহজভাবে দেখছো ততটা সহজ কিন্তু তা না”

“তোমার ভাই যে বেশ জটিল তা আমি জানি”

“কিন্তু ভাই তোমায় পছন্দ করেনা।ছোট বোনের ননদ ছাড়া অন্য কোনো দৃষ্টিতে ভাই তোমায় আদোতে দেখেছে বলে আমার মনে হয়না”

“তাও জানি”

ফের কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকে চাঁদ।অতঃপর গম্ভীরকন্ঠে বলে,

“ভালোবাসা ততটা সহজভাবে হয়না রুবা”

“সেজন্যইতো আমি তোমার ভাইকে পছন্দ করি বলেছি।একবারও কিন্তু ভালোবাসার কথা বলিনি ভাবি”

আকস্মিক মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠতেই ধ্যান ভাঙে চাঁদের।এতক্ষণ যাবৎ বিছানার উপর বসে গত তিনদিন পূর্বে রুবার সহিত তার কিছু অদ্ভুত আলাপন নিয়েই চিন্তা করছিলো চাঁদ।বিষয়টা তার কাছে বেশ জটিলই মনে হয়।একদিকে তার ননদ অপরদিকে বড়বোনের চেয়েও বেশি ভালোবাসার মানুষ।দু’জনের অনুভূতি সম্পর্কেই সে অবগত।মাঝেমধ্যে ভাইয়ের অগোছালো জীবনটা সে গোছাতে চাইলেও রূপার ন্যায় কোনো মেয়ে তার ভাইয়ের জীবনে ফের আসুক বলে চাঁদ চায়না।আর রুবা অথবা রিহা দু’জনের একজনও তার ভাইকে ভালোবাসে বলেও মনে হয়না চাঁদের।তাই সে এই বিষয়ে নিশ্চিত তার ভাই এ দু’জনের একজনকে নিয়েও কিছু কস্মিনকালেও ভাববেনা।মোবাইলের রিংটোন বেজে বেজে কেটে গিয়ে ফের বাজতেই তা রিসিভ করে কানে লাগায় চাঁদ।অতঃপর অপর পাশ থেকে ভেসে আসে পূর্ণতার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর,

“হ্যালো চাঁদ?রিহাকে খুঁজে পেয়েছি।ওর অবস্থা তেমন একটা ভালো না চোট পেয়েছে।তুমি বরং জলদি আসো।তোমার কথা বারবার বলছে।প্রেগন্যান্সি নিয়েই কিছু বলছে।তবে শুধু তোমাকেই বলতে চাচ্ছে।তুমি উজানকে নিয়ে বরং এখনই বের হয়ে যাও।এড্রেস আমি মেসেজ করে দিচ্ছি।হারি চাঁদ।দেরি করো না”

নিজ বক্তব্য পেশ করে কল কাটে পূর্ণতা।

বিগত পাঁচদিন ধরে রিহাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।রিহাকে শেষবারের ন্যায় চাঁদের সাথেই দেখা গিয়েছিলো।এরপর যে মোবাইল কানে দিয়ে সে বের হলো আর তার দেখা মেলেনি।হঠাৎ পূর্ণতার রিহাকে খুঁজে পাওয়া তার উপর আবার প্রেগন্যান্সি নিয়ে রিহা কিছু বলতে চাচ্ছে,জিনিসগুলো স্বাভাবিক মনে হয়না চাঁদের।সেদিনও রিহা তাড়াহুড়োয় এলো।আকস্মিক তার আল্ট্রাসনোগ্রাফিও করলো।রিপোর্ট নিয়ে কোথাও চলে গিয়ে গায়েবই হয়ে গেলো একধরনের।আর তার খোঁজ পাওয়া গেলোনা।না চাঁদকে সে রিপোর্টের ব্যাপারে কিছু বলেছে।চাঁদের মনে সন্দেহ তখনই বেঁধেছে যখন সে রিহাকে বিচলিত দেখেছে।তবে কি সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্সিতে জটিলতা আছে তার?বাচ্চার কিছু হয়ে যাবেনা তো?শেষ সময়ে এসে বাচ্চার ক্ষ*তি হলে চাঁদ সেটা মানতে পারবেনা।জীবনেতো বহু কিছু খুইয়েছে এবারে বাচ্চাটাকে খোয়ানো তার পক্ষে সম্ভব না।আর গতবার প্রণয়ও এভাবেই উধাও হয়ে আকস্মিক এমনকিছু কাজ করে ফেলেছে যার জন্য এখনো তার মাশুল দিতে হচ্ছে।রিহার সাথে এমন খারাপ কিছু হোক চাঁদ তা কখনোই চায়না।অতএব তাকে যেতেই হবে।রিহা আর তার বাচ্চার জন্য তাকে অবশ্যই যেতে হবে।সে যাবে,কারো কোনো ক্ষ*তি সে হতে দেবেনা।সিদ্ধান্তে অটল থেকে মিরের ফোনে রিহার খবর সম্পর্কে মেসেজ পাঠায় চাঁদ।তাকে দ্রুত সেই স্থানে যেতেও নির্দেশনা দেয়।মিরকে পাঠানো মেসেজটা একে একে রিহার সকল বন্ধুবান্ধবদের মাঝে ফরওয়ার্ড করে নিজে উজানের সহিত রওয়ানা হয় পূর্ণতার পাঠানো এড্রেসে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
“দেখ পূর্ণ কাজগুলো তুই মোটেও ঠিক করছিস না।তুই চাঁদকে এ অবস্থায় কেনো মিথ্যা বলে আনাচ্ছিস?তুই চাচ্ছিস টা কী বলবি?”

বেশ বিরক্ত হয়েই গাড়ি চালাতে চালাতে পূর্ণতা বলে,

“দেখ রিহু তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড,তো তোর সাথে খারাপ কিছু করার কোনোপ্রকারের ইচ্ছাই আমার নেই।আমি করবোও না।তবে এই চাঁদের ওকালতি বন্ধ কর।তোর মুখে ওর চিন্তা আমি টলারেট করতে পারছিনা”

“চাঁদের সাথে সমস্যা টা কোথায়?”

গাড়ি ডান দিকে বাকিয়ে পূর্ণতা সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিহাকে বলে,

“সমস্যা তো সেই শুরু থেকেই‌!এই মেয়ে আমার প্রণয়ের জীবনে আসলো কেন?আমার প্রণয়কে ও পুরোপুরি এলোমেলো করে দিয়েছে।বা*স্টার্ডটার জন্য জেলে পর্যন্ত গিয়ে আছে।স্টিল ওরা হ্যাপি কাপল।বাট হোয়াই?”

হকচকিয়ে রিহা পূর্ণতার পানে চেয়ে প্রশ্ন করে,

“তু….তুই প্রণয়কে পছন্দ করিস?”

“ভালোবাসি আমি ওকে”

“কিন্তু কখনোতো……”

রিহাকে মাঝপথে থামিয়ে নিজেই বলে পূর্ণতা,

“কখনো বুঝতে পারিস নি তাইতো?কীভাবে বুঝবি?ঐ চাঁদকে বোন বলে বলে তো মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছিস।ঐ মেয়ে তোদের সবার উপর কী জাদু করেছে বলবি?তোরা কেনো ওকে ছাড়া কিছুই বুঝিস না?তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড?তুইও কেনো আমায় বুঝলিনা রিহু?আমি প্রণয়কে ভালোবাসি এটা তুই কখনোই বুঝিস নি।অথচ মিরু সেই শুরু থেকে জানতো আমি প্রণয়কে ভালোবাসি।এমনকি অরণ আর মিরও।জানতিনা শুধু তুই,রবিন আর প্রণয় নিজেই।প্রণয়তো কখনো বোঝার চেষ্টাই করেনি।শেষমেশ ঐ চারচোখা মেয়ের প্রেমেই ওকে পড়তে হলো?পড়লো তো পড়লো ওর জন্য কেন এতগুলা খু*ন করে ফা!সিতে ঝুলেও ও অতটা খুশি?ঐ মেয়ে!ঐ মেয়েকে আমি সর্বোচ্চ ঘৃণা করি”

“দা….দেখ….দেখ পূর্ণ।আমি বুঝতে পারছি তুই প্রণয়ের জন্য ডেসপারেট।কিন্তু ওরা তো এক হয়েই গেছে।তাছাড়া প্রণয় কোনোদিনই আমাদের তিনজনের কাউকেই বন্ধু আর বোন ব্যতীত অন্য নজরে দেখেনি”

হুংকার ছাড়ে পূর্ণতা,

“ওর বোনের নজরের কোনো প্রয়োজন আমার নেই!”

“পূর্ণ তুই বোঝার চেষ্টা কর।তুই নাহয় চাঁদকেই ঘৃণা করিস।কিন্তু বাচ্চাটা?বাচ্চাটা তোর কী ক্ষ*তি করেছে?তুই বাচ্চাকে কেনো পয়জন দিয়েছিস?তোর কোনো আইডিয়াও আছে বাচ্চাটার কত বড় ক্ষ*তি তুই করেছিস?এক কথায় তুই বাচ্চাটাকে তিলে তিলে খু*ন করছিস পূর্ণ”

ঠোট খানিক বাকিয়ে রিহার পানে আড়চোখে চেয়ে গাড়ির স্পিড বাড়াতে বাড়াতে পূর্ণতা বলে,

“অবশ্যই আইডিয়া আছে রিহু বেইবি।আমিতো এটাই চেয়েছি।চাঁদ আর প্রণয়ের শেষাংশ নষ্ট হোক আমি তাই চেয়েছি।ওদের কোনো অংশই আমি এই পৃথিবীতে থাকতে দেবোনা।আমি চাঁদজড়িত সমস্ত কিছু ঘৃণা করি।ইচ অ্যান্ড এভ্রিথিং রিহু!আই জাস্ট হেইট দ্যাট গার্ল ফ্রম দ্যা ভেরি বিগেনিং অফ আওয়ার ফার্স্ট মিটিং।যেদিন প্রণয় অপরিচিত এক মেয়েকে প্রথমবারের ন্যায় চুমু খেয়েছিলো,ঠিক সেদিন থেকেই ঐ মেয়েকে আমার অপছন্দ।চাঁদের অংশতো থাকবেনা ই।ঐ চাঁদও থাকবেনা।আমি চাঁদ আর প্রণয়কে এক হতে দেবোনা,একসাথে থাকার সুযোগটুকু পর্যন্ত তাদের দেবোনা”

“পূর্ণ তোর মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে!তুই একজন ডাক্তার হয়ে মানুষ খু*ন করার কথা বলছিস?”
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
“প্রণয় ভাইয়াকে রিহা আপুর ব্যাপারে কিছু জানান নি?”

ফায়ানের প্রশ্নের জবাবে অরণ তাকে জানায়,

“না বলিনি কিছু”

“কেনো?”

“আমরা ওকে আর টেনশন দিতে চাচ্ছিনা”

“আপনার কী মনে হয়?হঠাৎ আপু কোথায় যেতে পারে?অরিন ইনভেস্টিগেট করছে এখনো?”

“কোনোকিছুরই আইডিয়া করতে পারছিনা।কারণ কলেজ লাইফে ওদের সাথেই বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হতো।যার বিন্দু পরিমাণও এখন হয়না।আর রিহা সেদিন আমাদের সাথেই ছিলো।আমি ওকে বলেছিলামও আমি তোকে দিয়ে আসি।কিন্তু ও একাই গেলো।পরে নাকি চাঁদের কাছে গেছে।ওর আল্ট্রাসনো করতে।কিন্তু এত রাতে মেশিন টেশিন নিয়ে গিয়ে এসব কেনো করবে?চাঁদ রিলেটেড কিছু একটা তো হবেই।তবে আমি বুঝতে পারছিনা সেটা।চাঁদের সাথে কথা বলাটা জরুরী।তোমার কথা হয়েছিলো?”

“বাচ্চা রিলেটেড কিছু একটা হয়তো হতে পারে।চাঁদের সাথে কথা হয়না অনেকদিনই”

অরণ ফায়ানকে কিছু বলতে নিলেই অরণের ফোনে কল আসে মিরের।কপাল কুচকে অরণ তা রিসিভ করে মিরের কথা শুনে হকচকিয়ে ফোনে থেকেই বলে,

“হা?হ্যা……যা….যা তোরা আমি আসছি।আচ্ছা দ্রুত যা,চাঁদকে একা এভাবে ঠিক হয়নি।একটু জলদি যা।হ্যা আমি ঐ পথেই,আসছি”

অরণের মুখভঙ্গি হঠাৎ পরিবর্তনে ভড়কায় ফায়ান।সে দ্রুত প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে ভাইয়া?চাঁদের কী বললেন?”

ফায়ানের কাধে হাত রেখে অরণ বলে,

“তাড়াতাড়ি চলো”

অতঃপর দু’জনই পা বাড়ায় কলেজ ক্যান্টিনের বাইরে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
চাঁদ আর উজান পূর্ণতার পাঠানো এড্রেসে এসে দাড়াতেই দেখতে পায় সেখানে আগে থেকেই মির,মিরা আর রবিন দাঁড়িয়ে আছে।চাঁদ আর উজানকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে তাদের নিকট এগিয়ে যায় মিরা।অতঃপর চাঁদকে ধরে গাড়ির দিকে হেলান দিয়ে দাড় করিয়ে বলে,

“এখানেই দাড়াও”

রবিন চাঁদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলে,

“পূর্ণ বা রিহুতো এখনো আসেনি চাঁদ”

মিরা অস্থির ভঙ্গিমায় বলে,

“আমার মন কখন যাবৎ বেশ অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।আই জাস্ট হোপ…….”

মিরার কথা সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই অরণ তাদের নিকট এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

“বাজে বকিস না”

অরণের সাথে ফায়ানও এগোয় তাদের পানে তবে তার দৃষ্টি চাঁদেতে নিবদ্ধ।মেয়েটা এখনো তেমনই আছে যেমনটা পূর্বে ছিলো।বর্তমানে কেবল পেটটুকুই ফুলেছে।তবে বেশ ক্লান্ত,অবিশ্রান্ত লাগছে।মায়া হয় ফায়ানের।বুকে ব্যথা অনুভূত হয়।নিজের অনুভূতিকে সামলে সে মিরের পানে এগিয়ে এসে তার পাশেই দাঁড়ায়।অতঃপর চাঁদের পানে চেয়ে প্রশ্ন করে,

“এই অবস্থায় এত তাড়াহুড়ো করে আসাটা খুব জরুরী ছিলো?আমরা সবাই আসলেইতো হতো না?”

“রিহাপু আমার প্রেগন্যান্সি নিয়ে কিছু বলতে চেয়েছে ফায়ান”

মিরার প্রশ্ন,

“প্রেগন্যান্সি?”

চাঁদ জবাব দেয়,

“হ্যা আপু।সেদিন রিহাপু আমার আলট্রা করে গিয়েছিলো।তোমাদের জানিয়েছিলাম তো”

মিরা খানিক চিন্তিত হয়ে বলে,

“হ্যা বলেছিলে।তবে সত্যি সত্যিই কি কোনো প্রবলেম আছে?”

লম্বা শ্বাস টেনে চাঁদ বলে,

“আপাতত তাই মনে হচ্ছে।সেদিনও রিহাপু চিন্তিত ছিলো”

রবিন চাঁদকে বলে,

“রিহা তোমার কিছু রিপোর্ট আনতেই আমাদের রেখে চলে এসেছিলো চাঁদ।আই থিংক রিপোর্টে এমন কিছু ছিলো যার জন্য তোমার আলট্রা করাটা জরুরী ছিলো”

গম্ভীরস্বরে মুখ খোলে মির,

“তবে প্রশ্ন এখনো থেকেই যায়”

উজান জিজ্ঞেস করে,

“কীসের প্রশ্ন ভাইয়া?”

জবাব আসে অরণের কাছ হতে,

“এটাই যে সেদিন রিহা আলট্রা স্ক্যানে কী এমন দেখেছিলো”
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
ধানমণ্ডির রাস্তাগুলো পার হতে নিলে আকস্মিক গাড়ির দরজা খুলে রাস্তার পাশের গাছের আড়ালে ঝোপের মাঝে লাফ দিয়েই পড়ে রিহা।হাত তার বাধা।স্পিডে চলা গাড়ি হতে লাফ দেওয়া চারটেখানি কথা না।বেশ জখম প্রাপ্ত হয় সে।তবুও ছুটে চলেছে প্রাণপনে।গাড়ির স্পিড বেশি থাকায় অনেকখানি পথ যাওয়ার পর পূর্ণতার মনে হয় সে কোনোকিছু পড়ার শব্দ পেয়েছে।অতঃপর কপাল কুচকে পাশে তাকাতেই রিহাকে দেখতে না পেয়ে গাড়ির গতি কমিয়ে ইউ টার্ন নেয়।এত বড় রাস্তার কোন ভাগে মেয়েটা পড়েছে?অথবা পালালোই কোথায়?ভাবতে ভাবতে আশপাশের সবজায়গায় রিহাকে খুঁজে কোথাও না পেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চোখজোড়া বন্ধ করে গর্জায় পূর্ণতা,

“ইউ!”

অতঃপর ফের গাড়িতে উঠে স্পিড আরও বাড়ায়।উদ্দেশ্য ধাণমন্ডির পুকুরপাড়।

অনেকখানি পথ দৌড়ে এসে অবশেষে রবীন্দ্র সরবোরের গেইটের কাছে নিজ বন্ধুমহলসহ চাঁদকে দেখে আত্মা জুড়ায় রিহার।মুখে হাসি ফোটে।আরও জোরে দৌড়ায় সে তাদের নিকট যাওয়ার উদ্দেশ্যে।মেয়েটাকে যে করেই হোক বিপদমুক্ত কর‍তে হবে।পথিমধ্যে দৌড়াতে দৌড়াতেই হাতের বাঁধন খুলতে সক্ষম হয়েছিলো রিহা।কেনোনা হাত শক্ত করে বাঁধলেও সম্মুখ দিয়েই বেঁধেছিলো পূর্ণতা।রিহা চাঁদের নিকট চেয়ে থেকে হাতের ইশারা কর‍তে করতেই চেচায় উচ্চস্বরে,

“চাঁদ?এই চাঁদ?চাঁদ?”

আকস্মিক পরিচিত কোনো কন্ঠস্বর পেতেই সকলে আওয়াজ মোতাবেক সে পানে চাইতেই নজরে আসে র*ক্তাক্ত রিহার দৌড়ে তাদের নিকট ছুটে আসার দৃশ্য।কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রিহার পানেই তাকিয়ে থাকে সকলে।চাঁদ দৌড়ানোর চেষ্টা করে এগোয় রিহার পানে।রিহা হাতের ইশারায় বারণ কর‍তে কর‍তে বলে,

“না না!ঐখানেই,ঐখানেই ওদের সাথে দাড়াও চাঁদ”

রিহার কথায় থেমে যায় চাঁদের চরণ যুগল।রাস্তার পাশে এসে পড়েছে বলে চাঁদকে পেছনে নিতে তার নিকট এগোয় ফায়ান।কিন্তু মুহুর্তের মাঝেই অতিরিক্ত গতিতে চলন্ত এক প্রাইভেট কার তাদের দিকে ধেয়ে আসছে দেখে ফায়ানকে টান দেয় মির।চোখের পলকে রাস্তার মাঝে ছিটকে গড়াগড়ি খেতে দেখা যায় এক মেয়েলি র*ক্তাক্ত দেহখানা।ছটফটায় সে কিয়ৎক্ষণ।র*ক্তে রঞ্জিত হয় পাকা সড়ক।চোখ খুলেই ‘চাঁদ’ বলে চেচায় মিরা।উচ্চস্বরে চাঁদের নাম ধরে ডাকে ফায়ানও।অতঃপর আকস্মিক শোনা যায় এক মেয়েলি গগণবিদারী আ!র্ত!নাদ,

“রিহাপু!”

কি যে করুন শোনালো সেই কন্ঠধ্বনি!ঠিক যেনো সেইদিন যেদিন চাঁদ তার সর্বস্ব খুইয়েছিলো।অতঃপর ভারী পেট নিয়েই ছুটে চলে চাঁদ রিহার র*ক্তাক্ত দেহের পানে।এখনো মেয়েটা ছটফটাচ্ছে।ঘাড় বেকে আছে চাঁদের বিপরীত পাশে।অতঃপর চাঁদসহ বন্ধুমহল সকলের আ!র্তনাদই কানে ভাসে রিহার।শেষবারের ন্যায় তাদের দেখার জন্য হৃদয় ব্যাকুল হয়।ঘাড় বহু কষ্টে ঘোরায় সে।অতঃপর চোখ খুলে সে পানে চাইতেই দেখে দৌড়ে চাঁদই প্রথম তার শায়রে বসেছে।রিহার পানে চেয়ে ক্রন্দনরতবস্থায়ই তার গালে আলতো থাপড়িয়ে তাকে ডাকছে বারংবার।পিছু আসছে তার বন্ধুমহল।সকলের মাঝে প্রণয় আর পূর্ণতার আবছা ঝলকও দেখতে পায় রিহা।পূর্ণ হলো রিহার বন্ধুমহল।হৃদয় শীতল হলো তার,চোখ জুড়ালো।রিহা জানে প্রণয় আর পূর্ণতা তার হ্যালুসিনেশন তারপরেও সে প্রশান্তির হাসি হাসে।মৃদু বাকে তার ঠোট।পরিশেষে চাঁদের পানে চেয়ে নিজ হাসি গাঢ় করে রিহা।র*ক্তসমূহ চোখের ভেতর প্রবেশ করতেই দৃষ্টি ঘোলাটে হয় তার।অতঃপর ফের চোখ খোলার চেষ্টা করে হাসে রিহা।বহু কষ্টে বাম হাত উঁচিয়ে চাঁদের গাল বরাবর রেখে কোনোকিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারেনা রিহা।চেয়ে থাকে চাঁদের পানে নির্নিমেষ।অবশেষে হাত তার শব্দ করেই পড়ে যায় চাঁদের কোলজুড়ে।সঙ্গে সঙ্গে ধরণী কাপানো আ!র্তনাদ করে মিরা।রিহার কাছে বসে জড়িয়ে নেয় বুকের মাঝে প্রাণের চেয়েও অত্যাধিক প্রিয় তার বান্ধবীকে।এরূপই এক দৃশ্য পূর্বেও সে দেখেছে,ঠিক বছর সাতেক পূর্বে।তার কোল জুড়েই হাতখানা পড়েছিলো অরণের।ভয়ংকর হৃদয় কাপে মিরার।রিহাকে দু’হাতে শক্ত করে বুকে চেপে ফের আর্তনাদ করে সে,

“রিহা?এই রিহারে!”

To be continued……

[বিঃদ্রঃগল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক]

#আবার_প্রেম_হোক (২য় খন্ড)
#নুসরাত_জাহান_মিম

১৯.
“পা….পূর..পূর্ণ!পূর্ণ…”

অতঃপর চাঁদের হাত ধরে রাখাবস্থায়ই রিহার পলক থামে,স্তব্ধ হয় শ্বাস।বুকের ওঠানামাও বন্ধ হয়েছে ইতোমধ্যেই।চাঁদের পানেই দৃষ্টি তার এখনো স্থির।হৃদয় থমকায় সকলের।দৃষ্টি হয় ঘোলাটে।রিহার হাত ধরে রেখেই অপরহাতে তার বাহু ঝাকিয়ে ভাঙা কন্ঠে চাঁদ আওড়ায়,

“আপ….আপু?এই আপু?আপু?থা…থামলে কেনো?ও আপু?কথা বলো।আপু?এই আপু?”

তৎক্ষনাৎ কাছে এসে রিহার হিম হওয়া শরীর আলতো ঝাকিয়ে মিরাও ডাকে কিয়ৎক্ষণ অথচ মেয়েটা আর সাড়া দেয়না।স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে তার প্রাণহীন দেহখানা।চোখ ফেটে কান্নারা যখন উপচে পড়তে আরম্ভ করে তখনই অপরপাশে এসে দাঁড়ায় মির।অতঃপর রিহার দিকে ঝুঁকে বরফের ন্যায় হিমশীতল গালে আলতো থাপড়িয়ে অবুঝের ন্যায় ডাকে সেও,

“রি….রিহু।এই রিহু?এদিকে তাকা।আমার দিকে তাকা।কীরে রিহু?”

বলতে বলতেই বারিধারা গড়ায় টপটপিয়ে।ভিজে যায় রিহার কপাল,গাল,সমস্ত মুখশ্রী।থামেনা সেই অশ্রুবর্ষণ।ফের আওড়ায় মির,

“রি….রিহু রিহু?এই রিহা?দা….দেখ কথা বল।মজা করিস কেন?রিহু?এ….এই?কথ……”

আর কিছু বলতে নিলেই মিরের কানে ভাসে ফায়ানের গম্ভীর,মূর্ছাস্বর,

“আপুর সময় শেষ ভাইয়া।শি ইজেন্ট এনিমোর”

অতঃপর রিহার পানে নজর যেতেই দৃষ্টি ভাঙে ফায়ানের।এতক্ষণের তীক্ষ্ণ নজর মলিন হয়।আঁখিজোড়া তারও জ্বলে।মিরের পানে দৃষ্টি যেতেই হৃদয় থমকায় তার।এলোমেলো লাগছে ছেলেটাকে।পরিস্থিতি সামলাতে জানা ছেলেটাও এই পরিস্থিতিতে এসে নিজেই নিজেকে হারাচ্ছে,হারাচ্ছে নিজ দৃঢ় সত্তাকে।শেষবার রিহার গালে আলতো থাপড়িয়ে ধীরকন্ঠে মির বলে,

“রিহা?”

অতঃপর চট করেই বাচ্চাসুলভ আচরণ করে বসে মির।ফুপিয়ে রিহার বুকের কাছে মাথা চেপে তার উপরই দেহের ভার ছেড়ে দুই হাতে দুই বাহু ঝাকিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠে,

“রিহারে!ওঠনা”

মিরের ধীরস্বরের আ!র্তনাদেও যেনো হৃদয় চে*ড়ে সেখানে উপস্থিত প্রতিটা মানবসত্তার।ভার হয় মন,আঁখিজোড়া ভিজে।বুকে জ্বলন সৃষ্টি হয়।প্রিয় ব্যক্তি হারানোর যন্ত্রণা সহ্যসীমার এতটা বাইরে কেনো?
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
বিছানার উপর সোজা হয়ে সিলিংফ্যানের দিকে একধ্যানে চেয়ে আছে চাঁদ।পলক তার পড়ছেনা।হৃদয় ভার,অসহ যন্ত্রণা সেথায়।চোখের দুই পাশ হতে অশ্রু গড়ায় অবিরাম।ভিজে চাঁদের কান হতে কেশরাজি সহ বালিশের দুইপাশও।ঠোটের চামড়া শুকিয়ে ফেটে আছে ওষ্ঠদ্বয়।ঘন্টার পর ঘন্টা একইভাবে অশ্রু বিসর্জনে তৃষ্ণা কি তার পেয়েছে?হৃদয়ের ব্যথা উপশমের চিন্তাও কি মস্তিষ্কে হানা দিয়েছে কিয়ৎক্ষণের?সমস্ত ভাবনাকে উপেক্ষিত করে পলকহীনই সে ব্যস্ত হয় কিছু স্মৃতিচারণে,

নিজের শেষ সময়ে সর্বাধিক প্রিয় বন্ধুকে মনে পড়ে রিহার।প্রণয় যদি জানতো সে আর কিয়ৎক্ষণের অতিথি ধরণীতে তখন ছেলেটার প্রতিক্রিয়া কী হতো?আর যখন সে সর্ব তিক্ত সত্যটা জানবে?তখনই বা প্রণয়ের অনুভূতি হবে কীরূপ?জানেনা রিহা।অতঃপর পূর্ণতার কথা স্মরণে আসতেই ঘেমে উঠে রিহা।মাথায় চাপ বাড়ে তার।স্মরণে আসে পূর্ণতার সাথে কাটানো কিছু বিদঘুটে স্মৃতি।অতঃপর নিজেকে সামলে ঘনঘন শ্বাস নিতে আরম্ভ করে।চোখজোড়া বড় বড় হয় তার।দম বন্ধকর অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে।শরীরে ঘাম ছুটে গিয়েছে।সবেই রিহাকে চেক করতে এসেছিলো ফায়ান।তৎক্ষনাৎ রিহাকে ছটফটাতে দেখে ছুটে আসে তার পানে।অতঃপর রিহাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে নজরে আসে রিহার হাতের আঙুলসমূহ নীলচে বর্ণ ধারণ করছে।বরফের ন্যায় হিমশীতল মেয়েটার শরীর।শরীরে পানি ছেড়ে দিয়েছে,ঘেমে ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে সমস্ত শরীর।আর যে তার হাতে সময় নেই ফায়ানের অবচেতন মনে স্মরণে আসতেই ধ্যান ভাঙে তার রিহার অস্থির কন্ঠের অস্ফুট বাক্যে,

“ফা..ফায়ান…ফায়ান প্লিজ চাঁদকে…চাঁ……আদ…”

“ডাকছি আপু”

অতঃপর চাঁদসহ বাকিদের ভীড় জমে রিহার কেবিনে।নিজ বন্ধুবান্ধবদের শেষবারের ন্যায় দেখে সিক্ত হয় রিহার আঁখিজোড়া।ফের তার শ্বাস আটকায়।হৃদস্পন্দন ঊর্ধ্বগতিতে বেড়েছে।মাথা বারকয়েক তার ঘুরে উঠছে।তবুও সে চাঁদের পানে চেয়ে চাঁদকে হাতের ইশারায় ডাকে,

“চাঁ…..চাঁদ….”

রিহার কথায় তৎক্ষণাৎ তার পানে এগিয়ে রিহার হাতজোড়া নিজ হাতের মুঠোয় নিয়ে চাঁদ বলে,

“কী হয়েছে আপু?হঠাৎ কী হলো?তুমিতো ঠিক ছিলে!”

ঊর্ধ্ব মাত্রায় শ্বাস বাড়ে রিহার।অশ্রু গড়ায় বিরামহীন।সেভাবে থেকেই চাঁদপানে চেয়ে ঘনঘন শ্বাস মুখ দ্বারা নিক্ষেপ করতে করতেই সে আওড়ায় তার সর্বশেষ বাক্য,

“হাতে সম….অয় নেই চাঁ…..আদ।পা….পূর..পূর্ণ!পূর্ণ…”

শেষ কথোপকথনে বুলি ফুরোয় রিহার,দৃষ্টি হয় স্থির।অতঃপর ধ্যান ভাঙতেই স্মৃতির পাতা সশব্দে বন্ধ হয় চাঁদের।সেও নিজ স্থির পলক ঝাপটায় অবশেষে।আঁখি জোড়া জ্বলে তার।বুকে অসহনীয় যাতনা নিয়েই দাঁত দ্বারা ঠোট চেপে মনে মনে সে আওড়ায়,

“কেন তোমার জীবনটা আমায় দিয়ে গেলে আপু?এই ঋণের বোঝা আমি টানি কী করে?প্রণয়কেই বা কী বলবো?তার বউ,বাচ্চা বাঁচাতে তুমি প্রাণ হারালে?কেনো করলে আপু?এই বোঝার ভার তো আমি সইতে পারি না আপু।সত্যিই পারি না গো!তুমি ফেরত আসো না প্লিজ!ও আপু?আপুগো!”

তৎক্ষণাৎ বারিধারা গড়ায় চাঁদের নেত্র হতে।হৃদয় ফের তার ভাঙে,শ্বাস বাড়ে।অতঃপর ফোনের রিংটোনে বন্ধ চোখ খোলে চাঁদ।সে পানে তাকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোন হাতে নিতেই নজরে আসে এক অপরিচিত নাম্বার।তবুও ফোন কানে লাগায় সে।অতঃপর ভেসে আসে গম্ভীর এক পুরুষালি কন্ঠস্বর,

“হ্যালো?আপনি কি চাঁদ?আসলে ডাক্তার পূর্ণতা দুইদিন যাবৎ সেন্সলেস,তার এক্সিডেন্ট হয়েছে।লাস্ট নম্বর আপনার ছিলো বিধায় আপনাকেই কল দেওয়া”
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
রিহার জানাযা পড়িয়ে তাকে মাটি দিয়ে আসতে না আসতেই খবর আসে পূর্ণতার এক্সিডেন্টের।তৎক্ষনাৎ সে অবস্থায়ই মির,রবিন আর অরণ ছুটে যায় পূর্ণতাকে ভর্তি করানো হাসপাতালে।সাথে তাদের চৈত্রও।সেখানে গিয়ে জানতে পারে রিহার যেদিন এক্সিডেন্ট হলো সেদিনই পূর্ণতারও বেশ মা*রাত্মক এক্সিডেন্ট হয়েছে।ইতোপূর্বে একজনকে হারিয়ে নতুন করে আবার আরেকজনকে হারানোর মতো সাহস বা ইচ্ছে শক্তি কোনোটাই কারো মাঝে নেই।সকলের দোয়া কেবল এটাই অন্তত পূর্ণতার কিছু না হোক!পূর্ণতার খবর শোনার পর থেকেই নিজের মধ্যেই কেমন এক অপরাধবোধ কাজ করে চৈত্রের।সেও প্রার্থনা করে পূর্ণতা অন্তত সুস্থ হোক।রিহার ন্যায় পরিণতি তার না হোক!রিহার কথা স্মরণে আসতেই রিহার সাথে অতিবাহিত করা শেষ মুহুর্ত এবং শেষ কথোপকথন স্মৃতিপটে ভাসে চৈত্রের,

চৈত্রকে নিজের পাশে দেখে খানিক হাসার চেষ্টা করলে চৈত্র বলে,

“হাসতে হবেনা।আপনি না হাসলেও আমি জানি আপনি বিনয়ী”

চৈত্রের কথায় বেশ অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার পানে রিহা।অতঃপর অস্থির ভঙ্গিমায় বলে,

“শা….শেষ একটা প্রশ্ন করবো চৈত্র”

“জ্বি”

অতঃপর রিহা কিছু বলতে চাইলে তার চোখ বরাবর নজর যায় চৈত্রের।অতঃপর সে উপলব্ধি করে সেথাকার কিছু অব্যক্ত অনুভূতি।তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি এলোমেলো হয় চৈত্রের।সে রিহাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

“কষ্ট করার প্রয়োজন নেই।আমি জানি আপনি কী বলবেন অথবা ভাবছেন।তবে আমার পক্ষে সত্যিই তা সম্ভব না।আমি আপনার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।এখন রেস্টের প্রয়োজন।একটু ঘুমান।বাইরে সবাই আছে,আমিও আছি।প্রয়োজন হলে ডাকবেন।রেস্ট করুন।আসি”

অতঃপর বাস্তবে ফিরতেই বুক চি!ড়ে বেরিয়ে আসে এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস!নিজের প্রতিই নিজের বিরক্তি আসে চৈত্রের।বিরক্ত হয় সে তার খিটখিটে স্বভাবের প্রতিও।কপাল কুচকে রেখেই মনে মনে ভাবে হয়তো শেষবার মেয়েটাকে কথা বলার সুযোগ দিলে মন টা হালকা হতো।মেয়েটা কি তার জন্য এক বুক কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছে?তবে সে তো সুস্থ ছিলো।অপারেশনও সাকসেসফুল হলো।হঠাৎ কী এমন হলো যার দরুন আকস্মিক মেয়েটার জীবন নামক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো?সে পাঁচদিনের জন্য নিখোঁজই বা কোথায় ছিলো?ফেরতই বা কী করে এলো?পূর্ণতাই বা তাকে পেলো কোথায়?তারও কেনো এক্সিডেন্ট হলো?এত এত প্রশ্ন মনে অথচ জবাব দেয়ার মতো কেউ নেই।মাথা চেপে চোখজোড়া বন্ধ করে হাসপাতালের চেয়ারেই বসে থাকে চৈত্র।সবকিছু এলোমেলো লাগছে।তার বোনের জীবনে এইটুকু পরিমাণ সুখ কেনো আসেনা?কী দোষ করেছিলো মেয়েটা?এত এত দুঃখ তার বোনের কপালেই কেনো?ভাবতে ভাবতেই মেজাজ তার ধৈর্যসীমা হারায় চৈত্রের।উঠে গিয়ে তৎক্ষণাৎ প্রস্থান নেয় সে জায়গা।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
পরপর দু’বার অরণের মাথায় মাঝারী আকারের ইট দ্বারা আ!ঘা!ত করে প্রাণপণে ছুটে চলেছে চাঁদ।অরণের কপাল ফেটে র*ক্তের ধারা গাল বেয়ে গড়িয়ে গলার কাছে আসতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।তৎক্ষনাৎ অরণের পানে দৌড়ে আসে প্রণয়।পিছু আসে প্রণয়ের বন্ধুমহলের সকলেই।প্রণয় অরণের র*ক্তে রঞ্জিত দেহ উরুর উপর তুলতেই অরণকে ঘেড়াও করে বসে তারা।আর অরণকে ধরে রেখেই প্রণয় চেয়ে থাকে নির্নিমেষ চাঁদের দৌড়ে দূর হতে দূরান্তের দৃশ্যে।তবে বেশিক্ষণ সে পানে চেয়ে থাকতে পারেনা।হৃদয় তার ভাঙে,বিড়ালাক্ষীদ্বয় ঘোলাটে হয়।দহন যন্ত্রণা সে অনুভব করে তার অন্তরমহলে।কপোল বেয়ে অশ্রু গড়াবার পূর্বেই চিৎকার ভাসে মিরার।সে নিজ ওড়নার একপাশ অরণের মাথায় চেপে ধরেই ডাকে অরণকে,

“এ….এই অরণ তোর মাথায় চাঁদ মা*রলো কেন রে?কী করেছিস তুই?তো….. তোকে…”

বাকিটুকু সম্পূর্ণ করে ক্রন্দনরত রিহা,

“দোস্ত?এই দোস্ত?তোর গায়ে এত কা*টাছেড়া কেন?”

নিজ গায়ের এপ্রোণ খুলে অরণের মাথায় পেচাতে পেচাতে মির বলে,

“অরণকে হাসপাতালে নিতে হবে।এসব ব্যাপার পরেও জানা যাবে।রবিন,প্রণয় ধর”

পাশ হতে রবিন অরণের বাহুতে ধরতে নিলেই ‘আহ’ শব্দ উচ্চারিত করে ভাঙা গলায় অরণ বলে,

“আমার হাতে বেশি সম….সময় নেই।তোরা প্লিজ চাঁ……”

তৎক্ষণাৎ তাকে থামায় প্রণয়।অতঃপর কিছু বলতে নিলেই পূর্ণতা অরণের ফেটে যাওয়া কপাল হতে র*ক্ত গড়াতে দেখে সেখানে চেপে ধরে দাঁত দ্বারা ঠোট কামড়ে নিজের ফোপানো থামায়।অতঃপর অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে বলে,

“প্লি….প্লিজ কিছু বলিস না অরণ।তোরা একটু জলদি কর।আমি আর র*ক্ত দেখতে পারছিনা।মির,রবিন…..”

পূর্ণতার কান্নাভেজা কন্ঠ কর্ণকুহর হতেই ডান পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে কিয়ৎক্ষণ তার পানে চায় অরণ।অতঃপর ফের দৃষ্টি ঘোরায় মিরার পানে।চেয়ে থাকে সেথায় নির্নিমেষ।তখনই প্রণয় নিজ উরু হতে মিরার কোলের কাছে অরণকে রেখে উঠে দাঁড়ায়।অতঃপর মিরকে সেখানে রেখেই রবিনের সহিত গাড়ি আনতে উদ্যত হয়।তৎক্ষনাৎ পূর্ণতা রিহাকে ধরে বলে,

“রি….রিহু?ওরা এই নীরব রাস্তায় গাড়ি পাবে?আয় রিক….রিক্সা দেখি”

জলে টইটম্বুর আঁখিসহিতই রিহা বলে,

“তু……তুই যা।আমি অরণকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা”

রিহার বুকে হামলে পড়ে পূর্ণতা কাদতে কাদতেই বলে,

“আমিতো অরণকে এভাবে দেখতে পারছিনা রে!বুকে যে কি জ্বলন হচ্ছে!তুই ভাবিস আমি এভাবে ওকে ছেড়ে যাবো?না রে,ও তো ডাফার!ডাফারটাকে হাসপাতালে না নিতে পারলে ও…..ও……”

বলতে বলতেই কথা আটকায় পূর্ণতার।রিহা নিজেকে আর পূর্ণতাকে সামলে দাড়াতে দাড়াতে বলে,

“চল”

মিরও উদ্যত হয় পূর্ণতা আর রিহার সাথে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।তারা যেতেই কান্না আটকে মিরা বলে,

“তো….তোর কিছু হবেনা তাইনা?দা……দেখ প্রণ….প্রণয়,রিহুরা তোর জন্য গাড়ি ঠিক করতে গেছে।আমরা তাড়াতাড়িই হাসপাতালে যাবো।তু……তুই টেনশন করিস না।দা….দেখ মামা আমি আমি আছিতো।ঘাবড়াস না।তোর…..তোর কিছু হবেনা ট্রাস্ট মি!তোর কিছু হলে আমায় ডাকিনী কে ডাকবে?আমি তোর কিছু হতে দেবোনা।তুই শুধু চোখ খুলে রাখ”

মিরার পানে পলকহীন চেয়ে মৃদু হাসে অরণ।অতঃপর র*ক্তে আবৃত হাত মিরার গালে ছুইয়ে আস্তে আস্তেই বলে,

“চোখের সামনে এক সমুদ্র ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও অন্ধের ন্যায় এক ফোটা ভালোবাসার আশায় সারাটা জীবন বৃথা করে দিলাম রে ডাকিনী!আমার বোধহয় এ জী…জীবনে আর ভালোবাসা পাওয়াটা হবেনা।ভালোবাসাহীনই ম*রতে হবে।প্রেমটা যে আমার হয়েও হলোনা বাঘিনী।বলা হলোনা আমি…..”

আর বলতে পারলোনা অরণ।মিরার কোলেই মাথাটা শব্দ করে পড়ে গেলো।হাতটা হয়ে গেলো অসাড়!বুলি তার এলো ফুরিয়ে।অতঃপর শব্দ করেই ছিটকে পড়লো অরণের হাতখানা মিরার কোল ছুয়ে মাটিতে।র!ক্তে মাখোমাখো হয়ে গেলো মিরার সারা বদন!বুকে সেই অসহ যন্ত্রণা সহ্য হলোনা মিরার।দিন দুনিয়া ভুলে গিয়ে অরণের সারামুখে হাত বুলিয়ে সে বললো,

“অরণ?এই অরণ?ওঠনা।অরণ?অরণরে?”

“অরনের বাচ্চা!ওঠ বলছি।ওঠনারে!”

আরও অনেক্ক্ষণ ডাকার পরেও যখন অরণ উঠেনা তখন কান্নায় ভে!ঙে পড়ে মিরা বলে,

“অরণ?এই অরণ!শোননা।আমি না তোকে ভালোবাসি রে।অনেক ভালোবাসি অরণ!কেনো আমায় ভালোবাসলিনা?কেনো তোকে অন্য কাউকে ভালোবাসতে হলো?কেনো তুই আমার হলিনা?”

অতঃপর দু’হাতে জাপটে বুকের মাঝে আলিঙ্গন করে সে অরণকে।অরণকে জড়িয়ে ধরতেই আকস্মিক সমস্ত কিছু ঘোলাটে হয় সম্মুখে।পরপরই মিরার নজরে আসে রিহার র*ক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে আছে পাকা সড়কে।তৎক্ষনাৎ রিহাকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে উচ্চস্বরে ডাকে মিরা,

“রিহা!

“রিহারে!”

“এই রিহা?”

“রিহা?রিহা,বোন?”

“ও রিহা!”

“রিহা!রিহা!রিহারে!”

অতঃপর রিহাকে জাপটে ধরে নিজেও জ্ঞান হারায় মিরা।সঙ্গে সঙ্গে তাকে জাপটে ধরে পাকা সড়কে গা এলিয়ে দেয় সে নিজের।

পরপর দু’টো তিক্ত দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ঘাম ছুটে যায় মিরার।বিছানা থেকে ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে সে।অতঃপর পাশেই বসে থাকা মলিন মুখশ্রীর রিদিকে দেখে মিরা বলে,

“রি…রিহু কোথায় রিদু?”

লম্বা শ্বাস টেনে অতি কষ্টে রিদি আওড়ায়,

“আপুকে জানাযা দিতে নেওয়া হয়েছিলো আপু!”

কপাল কুচকে অস্থির হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে মিরা বলে,

“ইম….রিহু রিহুকে ওরা নিয়ে গেছে?কেনো নিয়েছে?আমার রিহুর তো কিছু হয়নি।দেখি সরো,ওরা কি পাগল?”

মিরার দিকে ঘুরে তাকে ধরে শান্ত করার চেষ্টায় রিদি বলে,

“শান্ত হও আপু,তুমি শান্ত হও”

তৎক্ষনাৎ রিদির ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই পাশে রাখা ফোন হাতে নেয় সে।অতঃপর নজরে আসে ফায়ানের নাম্বার।রিদি তা রিসিভ করতেই অপরপাশের কথা শুনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,

“জ্ঞান ফিরেছে আপুর?”

রিদিকে অস্থির দেখে কপাল কুচকে তার পানে চেয়ে থাকে মিরা।অতঃপর রিদির অস্থির মুখশ্রী হঠাৎ মলিন হতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

“কী হয়েছে রিদি?কার ফোন?”

লম্বা শ্বাস ফেলে রিদি বলে,

“আগে বলো হাইপার হবেনা প্লিজ!”

“কী হয়েছে?”

“প্লিজ তুমি নিজেই উইক আপু।অস্থির হবেনা প্লিজ”

বিরক্তিকর দৃষ্টি রিদির পানে নিক্ষেপ করে মিরা প্রশ্ন করে,

“বলবে তুমি?”

দৃষ্টি নত রেখে মিরার প্রশ্নের জবাব দেয় রিদি,

“পূর্ণ আপুর এক্সিডেন্ট হয়েছে।আপু হাসপাতালে,দুইদিন ধরে সেন্সলেস”

To be continued……

#আবার_প্রেম_হোক (২য় খন্ড)
#নুসরাত_জাহান_মিম

১৯.(বর্ধিতাংশ)
পেরিয়েছে মাস খানেক।আজ কার্তিকের অন্তিম দিন।সময় স্রোতের ন্যায় বহমান।কারো জন্য,কোনো কিছুর বিনিময়েও তা থেমে থাকেনা।রিহার মৃত্যুর আজ পয়ত্রিশতম দিন।সময়ের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দুঃখকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজ জীবনে ফিরতে হয়েছে সকলকে।যদিও বা খানিকের জন্য কিছু স্মৃতির পাতা ভেসে ওঠে আঁখি সম্মুখে।অতঃপর দুঃখে জর্জরিত হয় হৃদমহল।সেই এক বুক দুঃখ নিয়েই চলতে হয় জীবনের বাকি পথটুকু।বাঁচতে হয় আপনজনদের,ভালোবাসার,পরিশেষে নিজের জন্য।এমনই এক রৌদ্রময় উজ্জ্বল দিনে সুখবর তার দুয়ারে এসে হানা দিয়েছিলো চাঁদের।চাঁদের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে এক টুকরো আলো হয়ে ধরা দিয়েছিলো তার সুখপাখি।সেই সুখপাখির জন্যই এত দুঃখ,এত কষ্টের মাঝেও বিন্দু পরিমাণ হলেও সুখের দেখা তার মেলে।মা হওয়ার অনুভূতি হয়তো এরূপই।আর মাত্র মাস খানেক।অতঃপর দিনের পর দিন,মাসের পর মাস নিজ ভালোবাসার বিনিময়ে পাওয়া অংশ,অতি যত্নে,সংগোপনে যাকে সর্বদা অনুভব করেছে চাঁদ অবশেষে তাকে ছোয়ার সাধ্যি সে পাবে।একটুখানি ছুয়ে দিয়ে উষ্ণ হৃদয় শীতল করবে।এত এত দুঃখের মাঝে এইটুকুনি সুখের জন্য কতশত অপেক্ষা চাঁদের।আজ শেষবারের ন্যায় সে চেকাপ করাতে যাবে।তার বাচ্চা কতটুকু সুস্থ সেটাই জানতে হবে মূলত।যার দরুন নিজেকে তৈরি করছে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব পরতে পরতেই ফোলা পেটে হাত রাখে চাঁদ।অতঃপর বিছানার ঠিক উপর দিকে দেয়ালে টানানো বড় ফ্রেমের দিকে তাকাতেই নজরে আসে তার অতি প্রিয় এবং তারই হৃদমানব,তার প্রেমিক পুরুষ তথা একমাত্র অর্ধাঙ্গ প্রণয়ের সহিত নিজের এক হাস্যোজ্জ্বল ফ্রেমবন্দী ছবি।অতঃপর মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়েই সে মনে মনে বলে,

“প্রহর গুনছি মি.বিড়ালাক্ষী মানব!কবে এসে হানা দেবেন ফের লালগোলাপের বাগানে?”
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
হাজতের পাকার উপর এক পা মেলে অপর পা ভাজ করে মাথার নিচে ডান বাহু রেখে চোখজোড়া বন্ধবস্থায় শুয়েছিলো প্রণয়।তার সাথে একই হাজতে আরও তিনজন ব্যক্তি রয়েছে।তারা সকলেই দুপুরের খাবারে ব্যস্ত।তন্মধ্যে একজন প্রণয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলে,

“ভাত খাইবেনা প্রণয়?”

অতঃপর চট করেই আবারও সে বলে,

“তোমার তো জ্বর আইসছে”

প্রণয় তার চোখজোড়া খুলে শোয়া থেকে উঠতে উঠতে বলে,

“তেমন কিছু না মামা।ঠিক আছি আমি”

কপাল কুচকে লোকটা বলে,

“জ্বরে শরীর পুইড়ে যাইচ্ছে আর তুমি বইলছো ঠিক আছো?”

তৎক্ষনাৎ প্রণয়ের পূর্বে ভাত চিবুতে চিবুতেই পাশে বসা আরেক লোক বলে,

“ডাক্তারদের ওসব জ্বর টর কাবু করেনা মামা”

লোকটার কথায় মৃদু ঠোট বাকায় প্রণয়।অতঃপর শান্ত এবং গম্ভীরস্বরে বলে,

“তবে এখন তো আর ডাক্তার নই।একজন খু*নী আসামি”

“দ্রুতই ডাক্তার পদবী ফের পাচ্ছো তুমি প্রণয়।আর আসামির জীবনও শেষই প্রায়”

হাজতের বাইরে থেকে আসা আওয়াজে সে পানে তাকায় সকলে।অতঃপর সেখানে কমিশনারকে দেখে কপাল খানিক কুচকায় প্রণয়ের।সে উঠে এসে হাজতের শিক হাত দ্বারা ধরে কমিশনারকে প্রশ্ন করে,

“বুঝিনি স্যার?”

অতঃপর কমিশনার তার পাশে দাঁড়ানো হাবিলদারকে ইশারা করতেই তালাবদ্ধ হাজত খোলে সে।আর কমিশনার ভেতরে ঢুকে হাসিমুখে প্রণয়ের সামনে কয়েকটা কাগজ এগিয়ে বলেন,

“তোমার কারাগারী জীবন শেষ প্রণয়।আজই তোমাকে ছাড়ার উপরমহল থেকে অর্ডার এসেছে”

“কিন্তু আরও মাসখানেক বাকি স্যার।হঠাৎ?”

“পুলিশসহ,আসামিরা পর্যন্ত তোমার শাস্তি মওকুফ আবেদন করেছে।তারা চায় তুমি দ্রুত বাড়ি এবং ডাক্তারী জীবনে ফিরে যাও।এভাবে হাজতে তোমায় তারা দেখতে পারছেনা”

কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে কমিশনারের হাতে থাকা কাগজগুলো নিয়ে দেখতে আরম্ভ করে প্রণয়।অতঃপর হৃদয়ে শীতলতা অনুভব করে সে,খানিক সুখকর অনুভূতি হয় সেথায়।আঁখিজোড়া সিক্ত হতেই নিজেকে সামলে সামনের দিকে তাকাতেই কমিশনার হাসিমুখে বলেন,

“তুমিতো বাবা হবে না?”

মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে দ্রুত প্রণয় শুধায়,

“জা…..জ্বি জ্বি স্যার!”

প্রণয়ের কর্মে খানিক শব্দ করেই হেসে দেন কমিশনার।অতঃপর বলেন,

“বাবা হওয়ার অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম।বাচ্চাকে নিজের মতোই প্রতিবাদী বানাবে বুঝেছো?তবে ভুল পথে না।সঠিকভাবে,সঠিক পথে প্রতিবাদ শেখাবে”

“ইনশাআল্লাহ স্যার‌!”
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
পাঁচ মাস অষ্টম দিন পর হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছে প্রণয়।সকলের থেকে বিদায় নিয়ে পরণের কাপড়েই বের হয়েছে সে।বুকের ধুকপুকানি ক্রমশই তার বাড়ছে।যত সামনের দিকে নিজ গন্তব্য পানে এগোচ্ছে অদ্ভুত এক শিহরণ কাজ করছে তার অন্তরমহলে।কোনো এক অজানা আশংকা,ভয়েরা এসে হানা দিচ্ছে তার সত্তা জুড়ে।ঠিক কতগুলো দিন পর ফের নিজ নীড়ে ফিরছে সে?হাজারহাজার অনুভূতিরা হৃদয়ে হানা দিচ্ছে।তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই হেটে চলেছে প্রণয়।তাকে দেখে কে কতটা চমকাবে সে জানেনা।তবে তার প্রাণেশ্বরীর হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী দেখার লোভ সে কোনোমতেই সামলাতে পারছেনা।মেয়েটার অনুভূতি কীরূপ হবে?শেষবারের মতো লাজলজ্জা ভুলে সকলের সামনেই কি তাকে ফের আলিঙ্গন করবে চাঁদ?সকল খুশিরা কি তার উপচে পড়বে হৃদয় হতে?লজ্জায় পরিপূর্ণ চাঁদকে অবলোকন করতে হৃদয় ব্যাকুল হচ্ছে প্রণয়ের।

প্রণয় যখন চৌধুরী বাড়ির সদর দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায় তার মস্তিষ্কে স্মৃতিরা হানা দেয় বছর খানেক পূর্বের।তার আর চাঁদের সমস্ত মনোমালিন্যের পরিসমাপ্তির পর তারা যখন একইসঙ্গে একে অপরের হাতে হাত রেখে ফের পা দিয়েছিলো নিজ ভবনে।অতঃপর বিড়ালাক্ষীজোড়া হাসে প্রণয়ের,ঠোটের কোন কিঞ্চিৎ বাকা হয়।হৃদস্পন্দন তীব্র হয় তার।সে কি কোনোভাবে লজ্জা পাচ্ছে?ছেলেরাও কি লজ্জা পায়?ছেলেদের লজ্জা পাওয়াটাও যেনো বেশ আশ্চর্যমূলক লজ্জাকর ঘটনা।অতঃপর লম্বা শ্বাস টেনে কলিংবেল চাপতেই কিয়ৎক্ষণের মাঝেই হকচকিয়ে দরজা খুলে প্রশ্ন করে তাদের বাড়ির পরিচারিকা,

“চাঁদ ভাবি ঠিক আছ……”

অতঃপর হাপাতে হাপাতেই চট করে সে বলে,

“প্রণয় ভাই আপ….আপনি?এত জলদি?”

কপাল কুচকে ভেতরে আসতে আসতে প্রণয় প্রশ্ন করে,

“চাঁদের কথা কী বললেন?”

“আপ…..আপনি বসুন আমি পানি নিয়ে আস….আসছি ভাইয়া”

প্রণয়ের গম্ভীরস্বর,

“এটা আমার প্রশ্নের উত্তর না”

ঢোক গিলে লম্বা শ্বাস নিয়ে মেয়েটা বলে,

“আসলে ভাইয়া আপ….আপনি আপনি হাসপাতালে যান।সব…সবাই সেখ….”

মেয়েটাকে থামিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রণয় প্রশ্ন করে,

“চাঁদ….চাঁদের কি লেবার পেইন উঠেছে?”

“না…..না ভাইয়া”

“কথা না ঘুরিয়ে ডিরেক্ট বলুন”

“ভাব…..ভাবি ভাবি সিড়ি থেকে পড়ে গেছে ভাইয়া”

কথাখানা শুনতেই শ্বাস বাড়ে প্রণয়ের,হৃদমহলে যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়।গলার কাছে শ্বাস আটকে আসতেই নিজেকে সামলে কপাল মাত্রাতিরিক্ত কুচকে প্রণয় বলে,

“আপ….আপনি মজা করছেন আমার সাথে?”

অতঃপর খানিক উচ্চস্বরেই বলে,

“আমি আপনার মশকরার মানুষ?”

“না….না ভাইয়া,সত্যি।ভাবি পা পিছলে উপর থেকে নিচে পড়ে গেছে”

“কেউ তার সাথে ছিলোনা?হ্যা ছিলোনা?”

প্রণয়ের আকস্মিক গর্জে উঠায় মেয়েটা কেপে উঠে খানিক।অতঃপর কাপা কন্ঠেই বলে,

“ভাইয়া ভাব…ভাবি চেকাপ করাতে যাচ্ছিল…..ও”

“চুপ থাকুন!সরুন”

বলেই দ্রুত পা চালায় প্রণয়।অতঃপর পিছু ঘুরে প্রশ্ন করে,

“কোনটায় নিয়েছে?”

“ঢাকা মেড….মেডিকেলে”

পায়ের গতি দ্রুত করে কপাল কুঞ্চিত রেখেই ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্মুখ পানে নিক্ষেপ করে মনে মনে প্রণয় শুধায়,

“আমার চাঁদ বা বাচ্চার কিছু হলে কাউকে ছেড়ে কথা বলবোনা আমি।অ্যান্ড আই মিন ইট!”

To be continued….