আবেগময় সম্পর্ক পর্ব-২৩+২৪

0
228

#আবেগময়_সম্পর্ক
#২৩তম_পর্ব
#লেখিনীতে_মৃদু_সুপ্রিয়া

মেহুল ঘুমন্ত রায়ানের পাশে বসে আছে। অন্তরার আগমনের পরপরই তার মনে ভয় তৈরি হয়ে রায়ানকে নিয়ে। তার ভয় একটাই রায়ান তার থেকে দূরে চলে যাবে না তো? মেহুল এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছিল এমন সময় আমিনা আক্তারের আগমন ঘটে তার রুমে। আমিনা আক্তার মেহুলের কাছে বসে বলে, “আমি জানি তোমার উপর দিয়ে এখন কি যাচ্ছে। রায়ান আর তোমার বন্ধন আমাকে অনেক বেশি মুগ্ধ করেছে। নিজের মা না হয়েও যেখানে তুমি রায়ানের জন্য এত ভালোবাসা দেখিয়েছ তা সত্যিই অনেক প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু সত্য কি জানো? এক গাছের ছাল কখনো আরেক গাছে লাগে না৷ হাজার হোক, রায়ান তো অন্তরারই সন্তান। তাই অন্তরার প্রতিই ওর টানটা বেশি থাকবে।”

মেহুল অসহায় গলায় বলে, “সেটা জানি আমি। কিন্তু কি করবো? আমি যে রায়ানকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারছি না। ও আমার নিজের ছেলে না হলেও ওকে আমি নিজের সন্তানের মতোই দেখি। আচ্ছা জন্ম না দিলে কি মা হওয়া যায়না?”

মেহুলের এমন প্রশ্নের জবাবে কি বলবেন সেটা ভেবে পান না আমিনা আক্তার। তিনি রায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “তুমি তো জানো আমি রায়ানের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলি। কারণ ওকে দেখলেই আমার অন্তরার বিশ্বাস ঘাতকরা করার কথা গুলো মনে পড়ে যায়। কিন্তু সত্য বলতে বিশ্বাস করো, রায়ানকে দেখলে কেন জানি আমার মনে হয় ও আমার আপনজন। ওর চেহারার সাথে আকাশের চেহারার অনেক মিল আছে, তাছাড়া ওর অনেক স্বভাবও আকাশের সাথে মিলে যায়। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় রায়ান আকাশরই সন্তান। কিন্তু সত্য হলো…”

মেহুল আমিনা আক্তারের বলা কথাগুলো ভালো করে ভাবতে থাকে। তার মনেও কিছু সন্দেহের সৃষ্টি হয়। মেহুল আমিনা আক্তারকে বলে, “যদি সত্যি এমন হয় যে, রায়ান আকাশেরই সন্তান তাহলে তো রায়ানকে অন্তরা এভাবে নিয়ে যেতে পারবে না তাই না?”

আমিনা আক্তার উত্তরে বলেন, “সেটা তো পারবে নাই। আমাদের বংশের সন্তানকে আমার থোরাই এমনি নিয়ে যেতে দিবো। কিন্তু সত্য হলো যে রায়ান আমাদের কেউ নয়।”

মেহুল বলে, “আমার অজানা অনেক কিছুই থাকতে পারে। আমাদের সেই অজানা সত্যই জানতে হবে।”

_______________
ল্যাবের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মেহুল। মূলত সে একটি সত্য জানার জন্য ল্যাবে এসেছে। মেহুলের এক কাজিন ল্যাবে কাজ করে। মেহুল রায়ান ও আকাশের চুল সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করতে দিয়েছে। মূলত এর মাধ্যমে জানা সম্ভব রায়ান আকাশের নিজের সন্তান কিনা।

মেহুল বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল এমন সময় তার কাজিনের আগমন ঘটে। মেহুলকে দেখামাত্র সে বলে,“তোর কাজ হয়ে গেছে মেহুল। আমি টেস্ট করে দেখেছি।”

মেহুল উত্তেজিত হয়ে জানতে চায়,“টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে? টেস্টের রেজাল্ট কি?”

মেহুলের কাজিন বলে, “তোর সন্দেহই ঠিক। ডিএনএ তে প্রায় ৯৯% মিল পাওয়া গেছে। তার মানে রায়ান তোর স্বামীরই সন্তান।”

মেহুলের চোখ চিকচিক করে ওঠে। সে বাকা হেসে বলে, “রায়ানকে নিজের কাছে রাখার উপায় আমি পেয়ে গেছি। এবার অন্তরা আমাদের কাছ থেকে আর মেহুলকে কেড়ে নিতে পারবে না। তবে সবার আগে আমার অন্তরার মুখোমুখি হওয়া জরুরি। ওর থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইব। কেন করল ও আমাদের সাথে সেই উত্তর ওকে দিতেই হবে। মিথ্যা বলার কারণ উদঘাটন করতে হবে।”

~~~~~~~~~~~~
মেহুল অনেক খোঁজ খবর নিয়ে অন্তরার ঠিকানা পেয়েছে। মূলত তার ফেসবুক আইডিতে অন্তরার সাথে যোগাযোগ করেছে। তারপর সেখান থেকেই অন্তরাকে বলেছে তার সাথে দেখা করতে চায় অনেক জরুরি কথা আছে।

অন্তরা দেখা করতে রাজি হয়ে গেছিল। তাই সে মেহুলকে নিজের ঠিকানা দেয়। মেহুল এসব কথা ভেবে তারপর কলিং বেল বাজায়। কিছু মুহুর্ত যাবার পর, অন্তরা এসে গেইট খুলে দেয়। গেইট খুলে বলে, “ভেতরে এসো।”

মেহুল ভেতরে গেলে অন্তরা বলে, “কি বলতে চাও বলো।”

মেহুল ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট অন্তরার হাতে দিয়ে বলে, “এটা খুলে দেখুন।”

অন্তরা প্রশ্ন করে, “কি এটা?”

মেহুল উত্তর দেয়, “এটা আকাশ ও রায়ানের ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট। ওদের ডিএনএতে ৯৯% মিল পাওয়া গেছে। এটা থেকেই প্রমাণিত যে…”

অন্তরা মুখ গম্ভীর করে নেয়। মেহুলের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “সত্য উদঘাটন করে নিজের সংসার ভাঙার কারণ তুমি কেন হতে চাও মেহুল? আমি শুধু নিজের ছেলের অধিকার চেয়েছি আর কিছু তো চাই নি। তুমি কেন এমন করছ?”

মেহুল কড়া গলায় বলে, “আপনি সবাইকে এভাবে অন্ধাকারে রাখতে পারেন না। রায়ানের তার আসল পরিচয় জানার অধিকার আছে। আকাশেরও এটা জানার অধিকার আছে যে রায়ান তার সন্তান।”

অন্তরা মুচকি হেসে বলে, “তুমি যদি চাও সবাইকে সব সত্য জানাতে পারো কিন্তু এর ফলে কিন্তু তোমার নিজের সংসারটাই নষ্ট হয়ে যাবে। আকাশ কিন্তু আমাকে ভালোবাসত। শুধুমাত্র ভুল বোঝাবুঝির কারণে ও আমাকে ভুলে তোমাকে নিয়ে সংসার করেছে। এখন যদি ওর সামনে সব সত্যি আসে তাহলে ও আমাকে নিজের জীবনে ফেরত চাইতে পারে। তখন তোমার কি হবে এক বার ভেবে দেখেছ?”

মেহুলের মুখটা ছোট হয়ে আসে। অন্তরার কথায় সে যুক্তি খুঁজে পায়। মেহুলের মনোভাব বুঝতে পেরে অন্তরা বলে, “বেশি কিছু চাই না আমি। এমনিতেও জীবনে আমার আর বেশি সময় হাতে নেই। আজ আমি আমার জীবনের সব ঘটনা তোমাকে বলতে চাই। তুমি কি শুনবে?”

মেহুল মাথা নেড়ে জানায় সে শুনতে চায়। অন্তরা তখন বলতে শুরু করে,“আমি নিজের মা-বাবার অতি আদরের সন্তান ছিলাম। আমার জন্মের দুই বছর পর অন্তরের জন্ম হয়৷ আমরা দুই ভাইবোন ছোটবেলা থেকে মিলেমিশে বড় হয়েছি। কিন্তু আমি প্রথম সন্তান হওয়ায় মা-বাবাকে একটু বেশি আদর কর‍ত। এই নিয়ে অন্তর একটু হিংসা করত। কিন্তু এই হিংসা যে এত ভয়াবহ রূপ নেবে তা আমি ভাবতে পারিনি। স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ভার্সিটিতে উঠতেই আমার সাথে আকাশের পরিচয় হয়। সে আমার থেকে সিনিয়র ছিল। পরে আমি জানতে পারি সে আবার বাবার বন্ধুর ছেলে। ছোটবেলায় আমাদের কয়েকবার দেখাও হয়েছে। আমি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করায় হয়তো পরে আর দেখা হয়নি। ভার্সিটিতে আকাশ আমার জন্য পাগল ছিল। আমাকে সবসময় পটানোর চেষ্টা কর‍ত। আমি প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও পড়ে তাকে ভালোবেসে ফেলি। কিন্তু সে বেকার থাকায় আমার বাবা তার হাতে তুলে দিবে না এটা আমি শিওর ছিলাম। তাই তাকে বলি একটা চাকরি যোগাড় করতে। ভার্সিটিতে আমার আদিত্য নামে একজন ফ্রেন্ড ছিল। তার সাথে অনেক গভীর বন্ধুত্ব আমার। কিন্তু আমি জানতেই পারিনি সে আমায় গোপনে ভালোবাসতো। আকাশ চাকরি পাওয়ার পর যখন আমাদের বিয়ে ঠিক হয় তখন আদিত্য আমায় প্রপোজ করে। কিন্তু আমি ওকে ফিরিয়ে দেই। আকাশও আমার আর আদিত্যের বন্ধুত্ব নিয়ে সংকোচে ছিল। অন্তর ঠিক এই সংকোচটাকেই ব্যবহার করে। অন্তর আমার জীবনে সর্বনাশ করার জন্য আদিত্যের সাথে আমার এডিট করা ছবি পাঠায় আকাশকে৷ সেই থেকে আকাশের আর আমার সুখের সংসারে অশান্তি নেমে আসে। এরপর যখন আমি সন্তান জন্ম দেই তখন অন্তর আরো বড় চাল চালে। আমাকে অপহরণ করে নিয়ে এসে মিথ্যা রটায় যে আমি আদিত্যের সাথে পালিয়ে গেছি। সবকিছু ও করেছিল সম্পত্তির জন্য। কিন্তু পরে যখন জানতে পারে আব্বু সম্পত্তি আমার ছেলের নামে লিখে দিয়েছে তখন অন্তর আমাকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করে। আমি সৌভাগ্যক্রমে পালিয়ে আসতে পারি কিন্তু…পালাতে গিয়ে আমার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। পরে ডাক্তারের সাথে চেকআপ করে জানতে পারি আমার মাথায় আঘাতটা অনেক গুরুতর…..আর এই আঘাতের কারণে যেকোন সময় আমার…আমার মৃত্যু হতে পারে।”

অন্তরার কথা শুনে থমকে যায় মেহুল। তার চোখে জল চলে আসে। অন্তরা মেহুলের কাছে হাত জোর করে বলে,“আমি আর কিছু চাই না। শুধু নিজের শেষ সময়ে নিজের ছেলেকে পাশে চাই। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি এসব সত্য এখনই কারো সামনে এনো না। আমার মৃত্যুর পর সবাইকে সব সত্য জানিও। আর আমার রায়ানকে প্লিজ শেষ কয়টা দিন আমার সাথে থাকতে দাও।”

#চলবে

#আবেগময়_সম্পর্ক
#২৪তম_পর্ব
#লেখিনীতে_মৃদু_সুপ্রিয়া

মেহুল অন্তরার হাতে হাত রেখে বলে,“আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ। আপনার জীবনে যে এত কিছু হয়ে গেছে সেই সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, রায়ানকে আমি আপনার কাছে এনে দেব। শুধু তাই নয়, আপনাকে আপনার পুরো পরিবার…”

মেহুলের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই অন্তরা বলে, “আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছ। কিন্তু সেটা হবার নয়।এমনিতেও এই পৃথিবীতে আমি আর মাত্র কয়দিনের অতিথি। এই দুদিনের জন্য এসে আমি তোমার জীবন তোলপাড় করে দিতে চাই না। তাই আমি তোমাকে অনুরোধ করব, আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন সত্য কারো সামনে না আসে। এতেই সব কিছু ঠিক থাকবে।”

মেহুল বলে, “আপনি এমন কেন করছেন বলুন তো? আপনার শেষ সময়ে তো নিজের পরিবারের সান্নিধ্য পাওয়া প্রয়োজন।”

অন্তরা নাছোড়বান্দা। সে বলে, “আমি এক জন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যাক্তি। আশা করি আমার অনুরোধ তুমি ফেলবে না। ধরো, এটাই আমার শেষ ইচ্ছা যে আমার মৃত্যুর আগে যেন আকাশ ও ওরা আমার সম্পর্কে কিছু না জানে। তারা যেন সেটাই ভাবে যেটা আমি তাদের বলেছি। যে আমি আসলে সবাইকে ঠকিয়েছি।”

এপর্যায়ে মেহুল আর নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে অশ্র ভেজা চোখে বলে,“এমন একটা শর্ত দিয়ে আপনি ঠিক করলেন না। শুধু মাত্র আমার কথা ভেবে আপনি নিজের শেষ সময়ে নিজের ভালোবাসার মানুষদের থেকে দূরে থাকবেন! এটা কি ঠিক?”

অন্তরা তখন মৃদু হেসে বলে, “আমার সারা জীবন অনেক কষ্টের সাথে অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমি এই শেষ সময়ে একটু শান্তিতে থাকতে চাই। আমি জানি তুমি অন্যরকম। কিন্তু একজন মেয়ে কখনো তার স্বামীর পাশে অন্য কারো উপস্থিতি মেনে নিতে পারে না। সেখানে আমি তো এখনো তোমার স্বামীর প্রথম স্ত্রী। আমাদের ডিভোর্সও হয়নি। এই মুহুর্তে যদি আমি ফিরি তাহলে তুমি একটু হলেও জেলাস হবে। আর তোমার বিন্দুমাত্র কষ্টের কারণ হয়তো শেষ সময়ে আমাকে কষ্ট দেবে। তাই আমি চাই না, কেউ সত্যটা জানুক। তুমি শুধু রায়ানকে আমার কাছে এনে দাও। শেষ কয়টা দিন নিজের ছেলেকে আকড়েই বাঁচতে চাই আমি।”
___________°°°_
মেহুল বাড়িতে এসে রায়ানকে তৈরি করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আকাশ তার সামনে এসে বলে, “এই সময় তুমি রায়ানকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”

মেহুল কোন ভনিতা ছাড়াই বলে, “আমি ওকে ওর মায়ের কাছে দিতে যাচ্ছি।”

মেহুলের কথা শুনে আকাশ অবাক হয়ে যায়। আকাশ রেগে গিয়ে বলে,“এমনটা তুমি কিভাবে করতে পারো? তুমি তো বলেছিলে রায়ানকে দূরে যেতে দেবে না তাহলে এখন এমন করছ কেন?”

মেহুল শান্ত ভাবে বলে, “কারণ তুমি তো রায়ানের নিজের বাবা নও। আমিও রায়ানের নিজের মা নই। তাই ওর উপর আমাদের কোন অধিকার নেই। ওর আসল মা যখন ওকে ফেরত চাইছে তখন নিয়ে নিক অসুবিধা কি।”

আকাশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহুলের দিকে। এরপর তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,“মানুষ ঠিকই বলে, সৎ মা কখনো আপন হয়না। রায়ান তোমার নিজের সন্তান নয় জন্যই ওকে এত সহজে অন্তরার হাতে তুলে দিতে চাইছ। তার মানে এত দিন তুমি রায়ানের মা হওয়ার নাটক করছিলে তাই তো?”

আমিনা আক্তার দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। আকাশের মুখে এমন কথা শুনে তিনি রেগে যান। এগিয়ে এসে আকাশের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,“তুই কিন্তু এসব ঠিক বলছিস না আকাশ। আমি জানি মেহুল রায়ানকে কতটা ভালোবাসে। আর জানি জন্যই বলছি মেহুলের সিদ্ধান্ত একদম সঠিক। একটা বাচ্চা তার মায়ের কাছেই সবথেকে ভালো থাকে। রায়ানের সাথে তোর তো কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। তাহলে তুই কেন ওকে যেতে দিতে চাইছিস না?”

আকাশ আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। তাই সে চুপ করে থাকে। আমিনা আক্তার চোখমুখ শক্ত করে বলেন,“মেহুল তুমি যাও রায়ানকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে এসো।”

মেহুল বেরিয়ে যায়।
_________________
অন্তরার বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজায় মেহুল। কিন্তু কেউ দরজা খোলে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে ধৈর্যহারা হয়ে অন্তরাকে কল দিতে থাকে। কিছু সময় পরেই অহনা এসে দরজা খুলে দেয়। তাকে খুব বিধ্বস্ত লাগছিল। দরজা খুলে দিয়েই অন্তরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর তার কান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। মেহুল ভয়ে চিৎকার করে ওঠে।

❤️
অন্তরার জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করে। তার বেডের পাশেই বসে ছিল আকাশ। আকাশ অন্তরার হাত ধরে কান্না করছিল।

অন্তরা সামনে তাকাতেই দেখতে পায় মেহুল রায়ানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহুল অন্তরাকে বলে,“আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি আপনাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি। আকাশকে আমি সব বলে দিয়েছি আপনার ব্যাপারে। কারণ আমি চেয়েছি এই শেষ সময়ে আপনি তার সঙ্গ পান।”

এদিকে আকাশ অন্তরার হাত ধরে কান্না করে বলে, “ভাগ্যের কাছে আমরা এত অসহায় কেন অন্তরা? জানো আমি একসময় তোমার জন্য কতটা পাগল ছিলাম। তোমাকে পাওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কত কান্নাকাটি করেছি। ফলশ্রুতিতে তোমাকে পেয়ে তো গিয়েছিলাম কিন্তু আগলে রাখতে পারিনি। আর আজ দেখ তোমাকে চিরকালের মতো হারাতে চলেছি।”

অন্তরার মাথায় অনেক যন্ত্রণা হচ্ছিল। তবুও সে অনেক কষ্টে বলে, “ভাগ্য নিয়ে কখনো আফসোস করো না। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। আমাদের একসাথে পথ চলা হয়তো ওটুকুই ছিল।”

আকাশ ডুকরে কেঁদে ওঠে। অন্তরা আকাশের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, “শেষবেলায় তোমাকে কাঁদতে দেখতে চাই না। আমি চাই তুমি হাসি মুখে আমাকে বিদায় দাও।”

আকাশ অসহায়ের মতো বলে,“তোমার সারাটা জীবন দুঃখেই কে*টে গেল। সুখের দেখা তুমি পেলে না।”

অন্তরা ইশারা করে মেহুলকে কাছে ডাকে। মেহুল কাছে আসে। রায়ানকে অন্তরার বেডে বসিয়ে দেয়। অন্তরা রায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,“এই তো আমার সুখ। আমার সন্তান।”

এরপর মেহুল আর আকাশের হাতে হাত মিলিয়ে দিয়ে অন্তরা বলে,“তোমরা দুজন সবসময় এভাবে একসাথেই থেকো। আর আমার রায়ানকে দেখে রেখো। আমার আর কিছু চাওয়া নেই।”

এটুকু কথা বলেই অন্তরার অবস্থার অনেক বেশি অবনতি ঘটে। দ্রুত তার নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। হার্টবিটও দ্রুত কমছিল। নাক, কান দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে৷ এভাবেই একসময় অন্তরার জীবন থেমে যায়।
ডাক্তার অন্তরার মৃত্যু নিশ্চিত করার সাথে সাথেই ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে আকাশ, রায়ান ও মেহুল৷ রায়ান অন্তরার নিথর শরীর আকরে ধরে মা মা করে কাঁদতে থাকে। মেহুলও কষ্ট পায় অন্তরার জন্য। কারণ মেয়েটা নিজের কথা না ভেবে মেহুলের কথা ভেবেছিল সবসময়।

আকাশ অন্তরার হাত ধরে বলে,“পৃথিবীতে অনেক কষ্ট পেয়েছ তুমি। আশা করছি পরকালে অনেক ভালো থাকবে।”

অন্তরার মৃত্যুর পর তার দেহ নিয়ে আকাশ বাড়িতে নিয়ে আসে। আজ আমিনা আক্তারও অন্তরার জন্য কাঁদেন। মেয়েটাকে কত ভুল বুঝেছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়েটা তো নির্দোষ ছিল। বরঞ্চ সে সারাটা জীবন কষ্টেই পার করে দিল।

আশিক, পিহু সবারই মন খারাপ। অন্যান্য মানুষেরাও সবাই হা হুতাশ করছে অন্তরার মৃত্যুতে। মেহুল অন্তরার উদ্দ্যেশ্যে শেষবারের মতো বলে, “উনি সত্যিই অনেক অভাগী ছিলেন। নিজের সন্তানকে শেষ ক’টাদিন নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আফসোস সুযোগই পান নি।”

#চলবে