#আমাদের_ছোট_পৃথিবী (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
ছয় মাসের গর্ভাবস্থায় হাতে ত্রিশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে আমার স্বামী হাসপাতাল থেকে চলে গেল। হাতের বিশ টাকা এবং দশ টাকার নোটের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম৷ কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি মাথার মাঝে এখনো গেঁথে রয়েছে।
ডাক্তার দেখানোর জন্য আমরা দুজন একসাথে হাসপাতালে আসলেও আমার স্বামীর কাছে যখনই তার ভাবীর ফোন আসে। তখনই সে ফোনটা ধরে বলে,“আমি এখনই আসছি।” কথাটি কোনরকম শেষ করে আমার হাতে ত্রিশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে,“ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি চলে যেও। পরীর অসুস্থ আমি সেখানে যাচ্ছি।”
এই কথা বলে রায়ান চলে যায়। আমি তাকে কোনকিছু বলার সুযোগই পেলাম না। পরী তার ভাইয়ের মেয়ে, তার অসুস্থতায় রায়ানের ছুটে যাওয়া আমার একদম স্বাভাবিক লাগলো না। স্বাভাবিক লাগতো যদি পরীকে সেখানে দেখার মতো কেউ না থাকতো। সেখানে পরীর মা ছিলো, বাবা ছিলো এবং আমার শাশুড়ী সেখানেও থাকে। তাও তার ছুটে যাওয়া লাগলো। বিয়ের পর থেকেই আমি রায়ানের মাঝে তার ভাবী এবং ভাইয়ের সন্তানদের প্রতি অতিরিক্ত মায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। সে তাদের এতটা পরিমান ভালোবাসে যে তাদের সম্পর্কে আমি দুটো লাইন যদি নেগেটিভ বলি তবেই সে আমার গায়ে হাত তোলে। বিবাহিত জীবনের দেড় বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অনেকবার হয়েছে। এই দেড় বছরে যতবার রায়ান আমার গায়ে হাত তুলেছে সব তার ভাবী বা ভাইয়ের বাচ্চাদের কারণে। সেজন্য রায়ানের এই ছুটে যাওয়া আমার একদমই স্বাভাবিক লাগে না। তাছাড়া সে যাবার সময় আমার হাতে মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়ে গেছে। শুধুমাত্র গাড়ি ভাড়া। এখানে ডাক্তার যে ঔষধ দিতে পারে, টেস্ট দিতে পারে সেটা যেন সে জানিই না। যদি এটা হতো যে তার কাছে টাকা নেই তাহলে আমি মেনে নিতাম। কিন্তু এমন নয়। তার কাছে যথেষ্ট টাকা রয়েছে। কিন্তু সে বরাবরই আমার প্রতি উদাসীন। এসব ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তার না দেখিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। রাস্তার পাশে ফুচকার দোকান দেখে খেতে খুব ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু খেতে পারলাম না। কারণ এখন ফুচকা খেলে হেঁটে যেতে হবে। এই অবস্থায় হাঁটতে চাচ্ছিলাম না। তাই নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে বাড়ি চলে আসলাম।
★
রাত বারোটার দিকে রায়ান বাড়ি ফেরে। সে বাড়ি ফিরতে আমি শান্ত গলায় বললাম,“বাড়ি ফিরলে যে? পরী এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেল? তাকে রেখে আসলে কষ্ট হচ্ছে না?”
আমার এই কথা শুনে রায়ান বিরক্ত হয়। সে বিরক্তি নিয়ে বলে,“বাজে কথা বলো না। সবসময় ওদের হিংসা করো না তো। যখনই দেখি তখনই ওদের নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা ভাবতে থাকো।”
“আমি উল্টাপাল্টা কথা ভাবছি নাকি তুমি ভাবতে বাধ্য করছো?”
আমার এই কথা শুনে রায়ান আমার দিকে রাগী চোখে তাকায়। অতঃপর বলে,“এই মাঝরাতে শুরু করো না।”
এটা বলে রায়ান ফ্রেশ হতে চলে যায়। আমি প্রচন্ডরকম মনকষ্ট নিয়ে বিছানার উপর বসে রইলাম। হাসপাতালে ওভাবে রায়ান আমাকে রেখে চলে যাওয়ায় আমি যতটা না কষ্ট পেয়েছিলাম তারচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি তখন যখন শুনলাম পরীর সামান্য একটু আঙুল কেটেছে। ব্লেটের সাথে লেগে খুবই সামান্য একটি আঙুল কেটেছে। শুধু তাই নয়। আঘাত এত সামান্য ছিলো যে কয়েক ফোঁটা র ক্ত শুধু ঝরেছে। আর যেটা একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে বেঁধে দেওয়ায় ঠিক হয়ে গেছে। এই সামান্য কারণে রায়ান আমাকে রেখে চলে গেল। আমার সন্তানের কথাও ভাবলো না।
রায়ান ফ্রেশ হয়ে বের হতে আমি শান্ত গলায় বললাম,“তোমার অনাগত সন্তানের প্রতি তোমার কোন টান রয়েছে রায়ান?”
“তুমি আজকাল একটু বেশি বাজে কথা চিন্তা করছো। আমার কাছে তোমার বাজে কথার জবাব দেওয়ার মতো সময় নেই।”
“হ্যাঁ আমার জন্য তোমার কাছে সময় থাকবে কেন? তোমার সব সময় তো তোমার ভাবী, তোমার ভাবীর আদরের সন্তানের জন্য রয়েছে। তোমার ভাই তো অক্ষম, তার জন্য তোমাকেই তো তাদের সব কাজে থাকতে হয়।”
আমার এই কথা শুনে রায়ান রাগী গলায় বলে,“আর একটা বাজে কথা বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
“কী বাজে কথা বললাম? তোমার কোনটা বাজে মনে হলো? তোমার ভাবীর প্রতি তোমার ভাইয়ের থেকে তোমার বেশি মায়া নয় বুঝি? আমার তো মনে হয় বিয়ে করতে হবে তাই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছো আমাকে। সুযোগ পেলে তো তুমি তোমার ভাবীকেই বিয়ে করতে।”
আমার কথা শুনে রায়ান আমার গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। এটা নিয়ে আমাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে আমি বললাম,“তোমার তো ঐ গায়ে পড়া মহিলাকেই ভালো লাগবে। আমি তো আর গায়ে পড়া না তাই তোমার ভালো লাগে না।”
“চুপ। একদম বাজে কথা নয়।
তুই কাকে গায়ে পড়া বলছিস, ভাবী তোর মতো নয় বলেই তোর তাকে দেখে হিংসা হয়। তাই তো সারাক্ষণ তাকে নিয়ে জ্বলতে থাকিস।”
“আমি ওর মতো খারাপ মহিলাকে….।”
আমি কথাটি শেষ করতে পারিনি। তার মাঝে রায়ান আমাকে আরও কয়েকটি লাগিয়ে দেয়। আমি যে ছয় মাসের গর্ভবতী সেটাও সে তোয়াক্কা করলো না। এইসব বিষয়ে যখনই কথা ওঠে তখনই এভাবেই গায়ে হাত তোলা দিয়ে শেষ হয়। যদিও প্রথম দিকে আমি সব ভালোভাবেই জানতে চাইতাম। তার ভাবীকে সে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে কি-না। তাদের এত ভালো সম্পর্ক কিভাবে হলো? তখন তার থেকে তেমন সঠিক জবাব পাইনি। প্রথমদিকে আমিও ভাবতাম এসব বোধহয় স্বাভাবিক। ভাইয়ের ছেলে, মেয়েকে ভালোবাসবে এটা তো স্বাভাবিকই। ভাবীকে হয়তো ভাবী হিসাবে অনেক সম্মান করে। কিন্তু দিনের পর দিন রায়ানের আচরণ আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো। এই মানুষটি আমার স্বামী অথচ সে আমাকে কোনকিছু উপহার দেয় না। দেড় বছরে দুইটি জামা ছাড়া কিছুই কিনে দেয়নি। সেই মানুষটি প্রতি মাসে ভাবী, ভাতিজা, ভাতিজির জন্য উপহার কিনে। এত এত টাকা খরচ করে। এসব স্বাভাবিক হতে পারে? শুধু কী তাই! রাত নাই দিন নাই যখন তার ভাবী ফোন দিবে তখনই তার কাছে চলে যাবে রায়ান। যখন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, আমি এসব নিয়ে প্রশ্ন করি তখন থেকেই তার গায়ে হাত তোলা শুরু। অনাথ হওয়ার সুবাদে এই কথা কাউকে শেয়ার করার মতো আপন মানুষও আমার ছিলো না। আর শাশুড়ীকে বললে সে বলতো একটু মানিয়ে নাও। বড় বউ ভাইয়ের মতো আদর যত্ন করে তাই বোনের মতোই ভালোবাসে। একটা সময় শাশুড়ী বলে,“একটা বাচ্চা নিয়ে নাও৷ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তার কথায় আমারও মনে হলো একটা বাচ্চা হলে হয়তো সব ঠিক হবে। তখন নিজের সন্তানের প্রতি মায়া বাড়বে, সংসারে মনও বসবে। কিন্তু কই। সেই তো একইরকম উদাসীন আমার প্রতি।
___
পুরনো দিনের এসব স্মৃতি ভাবতে চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নিচে পড়লো। আমার মেয়ে মিমি এটা দেখে বলে,“মাম্মা তুমি কাঁদছো? আমি আর পাপার কথা জিজ্ঞেস করবো না। তুমি কেঁদো না। পাপার কথা মনে পড়লে তোমার কষ্ট হয়? আমি আর জিজ্ঞেস করবো না।”
আমার সাত বছরের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে মূহুর্তে আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। এই মেয়েটা না থাকলে আমার যে কী হতো? এতটুকু বয়সে সে আমার কষ্ট হচ্ছে বুঝে আমাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। তার সাধ্যমতো সে চেষ্টা করছে। এটা ভাবতেই আমার খুশি লাগছে। আমি তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বললাম,“মাম্মা কাঁদছে না।”
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)