#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২০
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
হাতটা ঝেড়ে ঝেড়ে কিছুদূর এগিয়ে গেল সুজানা। হাতের তালু ছিঁড়ে গিয়েছে। জ্বালা করছে। মেহুল আর শান্তা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল। বলল
আহির আর জায়িনের কান্ড দেখেছিস? ফাজিলের দল। তোর হাতে আবার কি হলো?
সুজানা হাতের তালু মেলতেই ওরা দু’জন খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকালো।
এমা কি করে হলো?
পড়ে গিয়েছিলাম। তাও স্যারের সামনে। কত লজ্জায় পড়েছিলাম ভাবতে পারছিস? কোনো দরকার ছিল আমার পেছনে দৌড়ানোর?
শান্তা কপালে হাত দিয়ে বলল
আরেহ হ্যা আমিও দেখলাম স্যারকে। নাহিদ ভাইয়ের বন্ধু।
সুজানা হাতের ফুঁ দিতে দিতে ভাবলো তাই তো। অনা আর আবিদের বার্থডে’র দিন নাহিদ ভাইকে দেখেছিল না। বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। ওই বাড়ি থেকে কেউ কি আসেনি তাহলে? আসার কথা। একা একা বিয়ে খেতে আসার মানুষ স্যার নন। যদি ওনার মা আসেন তাহলে তো সুজানা শেষ। এত ভয় লাগে ওই মহিলাকে।
সুজানা মেহুল আর শান্তার সাথে ঘরের দিকে চলে গেল। হাতটা আসলেই জ্বালা করছে। কিছুক্ষণ পর নিখিল এল। বলল, কি রে তোরা এখানে বসে আছিস কেন? বসে বসে আঙুল চোষার জন্য এখানে এনেছি? আয়।
মেহুল বলল
সুজুর হাত নাকি ছিঁলে গেছে।
কি বলিস? আরেহ কখন হলো এসব? বেশি লেগেছে?
সুজানা বলল
তেমন কিছু না। মলম লাগিয়ে নেব আন্টির কাছ থেকে। তুই তোর কাজে যাহ।
না না আমার সাথে আয়। আয় তো। স্যার এসেছে দেখেছিস। দেখা হয়েছে?
শান্তা বলল,
সামনাসামনি আমাদের সাথে দেখা হয়নি। সুজুর সাথে হয়েছে।
ওহ আচ্ছা এখন আয় আমার সাথে।
ওরা নিখিলের জোরাজুরিতে উঠে পড়লো। নিখিল বলল
তোদের একটা জায়গায় নিয়ে যাব। দাঁড়া তার আগে মায়ের কাছ থেকে মলম নেই।
তারা নীচে যেতে যেতে নিখিল তার ভাইকে দেখামাত্র ডাক দিল। বলল
ভাই ওরা এখানে । রুমে গিয়ে বসেছিল। নিয়ে এলাম।
নাহিদের সাথে সাথে ওর বন্ধু আর সাথে থাকা মা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। অভিককে কিছুটা কাছাকাছি ফোনে কথা বলতে দেখে সুজানা শান্তার পেছনে, আর সুজানার পেছনে মেহুল দাঁড়ালো। নাহিদ তাদের দেখে হেসে বলল
এই যে তোমাদেরকেই তো খুঁজছি। কেমন আছ আপুরা ?
শান্তা মিষ্টি হেসে বলল
ভালো আছি ভাইয়া । আমরাও বরকে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম।
সুজানা আর মেহুলও কথা বললো ছোট্ট করে। রাহাত হেসে বলল
তোর বান্ধবীরা তো লজ্জা পাচ্ছে নিখিল।
নিখিল মাথার পেছনে হাত বুলালো। বলল
এদের লজ্জা শরম বেশি।
নাজমা বেগম বলল
লজ্জা পাবেনা এখানে ওদের স্যার আছে তাই। আর ওর মিনিমাম লজ্জা শরম আছে? অভি তোমাকে বলছি একে কয়েকটা পিটুনি দিও। আমার কথা একদম শুনতে চায় না।
অভিক পকেটে ফোন পুরে বলল
কাকে আন্টি?
এইতো নিখিলের কথা বলছি।
অভিক হাসলো। বলল
কেন ও তো ভালো স্টুডেন্ট। পেছনের গুলো ফাঁকিবাজ।
শান্তা মেহুল আর সুজানা লজ্জায়। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো ।
নিখিল গর্ব করে হাসলো। বলল
আমি জানতামই না ভাইয়ের বন্ধু আমাদের স্যার। বলেনি কখনো। আমি তো প্রথমে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি।
নাহিদ তার মাথায় চাপড় দিয়ে বলল
তুই আমার সাথে বসে দুটো কথা কবে বলেছিস মনে আছে? তাছাড়া অভির সাথে আমার আজকের পরিচয় না। বহুদিনের বন্ধুত্ব। এই ছয় বছর পর এই বাড়িতে দ্বিতীয় বার এল।
নিখিল আবারও মাথার পেছনে হাত বুলালো। বলল
ভালোই হলো। সারপ্রাইজ তো পেলাম। না? আচ্ছা আমরা এখন এক জায়গায় যাব। আম্মা আগে মলমটা দাও তো। সুজুর নাকি হাত ছিঁলে গিয়েছে।
নাজমা বেগম বলে উঠলেন
হাত ছিঁলে গেল কিভাবে? এটা কোনো কথা?
নাহিদ বলল
মলম লাগিয়ে নাও সুজানা। কিভাবে ব্যাথা পেলে?
সুজানা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল
তেমন কিছু না।
অভিক এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। পেছন থেকে সাফিন অভিককে ডাক দিল।
ব্রো ওরা এসে গেছে। জলদি আয়।
অভিক দ্রুতপায়ে সেদিকে চলে গেল। নাহিদ মাকে বলল
আন্টিকে নিয়ে এসো মা।
নাজমা বেগম ওদিকে পা বাড়ালেন। সুজানা বলল
স্যারের মা এল নাকি?
নিখিল মাথা দুলালো। বলল
হুমম।
মেহুল বলল
বাবারে আমি আর নেই। আমাকে দেখলে চিনে ফেলবেন উনি।
নিখিল সন্দিহান হয়ে তাকাতেই মেহুল আমতাআমতা করে বলল
কোথায় নিয়ে যাবি বলছিলি না? চল চল।
নিখিল বলল
আয়।
নিখিলের পেছন পেছন যেতেই সুজানার পা থেমে গেল ছোট্ট বাচ্চাদের ডাকে।
সুজান সুজান আমরা ইদিকে।
সুজানা থমকে গেল। মেহুল বলল
ওরেবাবা আমি আর নেই। নিখিল চল। সুজু থাকুক।
শান্তাকে টেনে নিয়ে চলে গেল মেহুল। সুজানা অনা আর আবিদের দিকে এগিয়ে গেল। বলল
বিয়েতে এসেছেন? বাবাহ কি সুন্দর লাগছে।
অনা হেসে বলল
সুজান কি সুন্দুল লাচচে।
থ্যাংকিউ সোনামণি। আর কে কে এসেছে?
ওরা সুজানার আঙুল ধরে টেনে নিয়ে গেল। অভিককে দেখে ওদিকে আর যেতে চাইলোনা সুজানা। সালমা বেগমকে গাড়ি থেকে হাত ধরে নামাচ্ছে অভিক। সালমা বেগম এদিকওদিক তাকিয়ে নাহিদের সাথে হেসেখেলে কথা বলে কুশলাদি বিনিময় করলেন নাজমা বেগমের সাথে। সুজানা সরে পড়ার আগেই সালমা বেগমের চোখ পড়লো তার দিকে। আর সরতে পারলো না সুজানা। দাঁড়িয়ে রইলো অনা আর আবিদের সাথে। সালমা বেগম তাকে আগাগোড়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চোখ সরিয়ে নিলেন।
সুজানা আর কাউকে দেখলো না। তারমানে আর কেউ আসেনি।
দাদু দাদু দিখো সুজান ইখানে।
সবাই ফিরে তাকালো এবার। অনা আর আবিদ মুখ তুলে সুজানার মুখ দেখার চেষ্টা করলো। সুজানা হেসে ফেলল তাদের কান্ড দেখে। সালমা বেগম ধীরেধীরে হেঁটে এলেন। সবুজ রঙা শাড়িতে উনাকে অনেক স্নিগ্ধ লাগছে। নাজমা বেগমের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলেন তিনি। সুজানার সামনে এসে দাঁড়ালেন । বললেন
বিয়েতে আসবে এজন্যই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলে আজ?
জ্বি। আমার বন্ধুরা এসে বসেছিল তো।
ভালোই। আমি ভেবেছিলাম তুমি কিছুই জানোনা। এখন দেখছি সুন্দর করে শাড়িও পড়তে জানো।
সুজানা মৃদু হাসার চেষ্টা করে মাথা নামিয়ে নিল। নাজমা বেগম বললেন
ওহ সুজানাকে চেনেন বুঝি।
হ্যা নাতি নাতনি দুটোকে পড়ায়।
ওহ আচ্ছা আচ্ছা খুব ভালো।
উনারা চলে যেতেই গাড়ি থেকে অনা আর আবিদের কাপড়চোপড়ের ব্যাগ, মিষ্টি নাশতার কার্টুন গুলো নিয়ে যাওয়ার সময় অভিক সুজানার খানিকটা পেছনে থেমে গিয়ে বলল
আপনি কিছুই জানেনা নাকি? মাকে বলব আমি বিয়ে ভাঙতে জানেন।
সুজানা আহত চোখে তাকালো।
অভিক হাসলো। বলল
উহু বলব না। আপনার হাতে না জানি কি হয়েছে। দ্রুত ওই ঘরে আসুন।
কোন ঘর?
যেখানে মা আর বেবিরা আছে।
কেন?
বলেছি তাই আসবেন।
কিন্তু।
আপনার বান্ধবী মেহুল এসেছে না?
সুজানা শাড়ির আঁচলের কোণা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে জবাব দিল।
হুমম ।
তাহলে উনাকে পাঠিয়ে দিন।
সুজানা চমকে উঠলো। অভিক ততক্ষণে চলে গিয়েছে। হুমম মেহুকে পাঠাবে কেন? পাঠাবে না।
______________
বন্ধুদের আর দেখা পেল না সুজানা। কোথায় চলে গেল তা ভাবতে ইতোমধ্যে প্রকান্ড উঠোনটা আর ব্যাকইয়ার্ড ঘুরে নিল সে। কারো দেখা নেই।ফাজিলের দলের সাথে কোথাও গেলে এই সমস্যা। না বলে না কয়ে কোথায় চলে যায়। সায়েম তো পুরাই বাদশা। কলেজের বন্ধুটন্ধু পেয়ে যাওয়ায় একেবারে রাজা হয়ে গেছে। বোনের কথা মনেই নেই। পেলে জোরে আজ কানটা মলে দেবে।
পায়চারি করার সময় নিখিলের ছোট ফুপীর মেয়েটা এসে বলল
আপু তোমাকে মেঝ মামি মানে নিখিল ভাইয়ার আম্মু ডাকছে। এখনি যেতে বলছে।
কোন ঘরটা?
মামির ঘরে গেলেই হবে।
সুজানা মাথা নাড়ালো। গুটিগুটি পায়ে সেদিকে হেঁটে গেল। ওই ঘরে যদি স্যারের মা থাকেন। সুজানার গলা শুকোতে লাগলো। এক পা এক পা ফেলে ওই ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে নাজমা বেগমের সাথে দেখা হলো। উনার হাতে মলমের কৌটো। সুজানাকে টেনে ঘরে ভেতর নিয়ে গিয়ে বলল
মলম না লাগিয়ে ঘুরছ কেন মেয়ে? বেড়াতে এসে হাত ছিঁড়ছ এসব কোনো কথা? তোমার মা কি বলবে?এই ঘরে বসে মলমটা লাগিয়ে নাও। লাগিয়ে নিতে পারবে তো?
সুজানা মাথা দুলালো। ঘরের ভেতরে অনেক মানুষ। নীচে ফ্লোরে অনেকে বসেছে। পালঙ্কে সালমা বেগম, রাহান আর সাফিনের মা। আরও অনেক মুরব্বি একসাথে বসে গল্পগুজব করছে। সুজানাকে দেখে সালমা বেগম ডাক দিলেন। বললেন
কি হয়েছে?
কোথায়? কিছু হয়নি আন্টি।
না তোমার হাতে কি হয়েছে বললো না?
সামান্য ছিঁলে গিয়েছে ।
ওহহ। সাবধানে চলতে পারো না? এতবড় মেয়ে যদি পড়ে গিয়ে হাত পা ছিঁড়ে লোকে কি বলবে? আজব মেয়েরে বাবা!
রাহাতের মা জানতে চাইলো।
মেয়েটা কে আপা?
ওই, বড় বউয়ের মামুর ছেলের সাথে সম্বন্ধ চলছে। ওদের পড়ায় এই খাতিরে চিনি। নাম সুজানা।
ওহ আচ্ছা। আমি ভাবলাম আপনার কেউ হবে?
সেটা কেন মনে হলো?
আপনি বকছেন তাই মনে হলো। মেয়েও তো চুপচাপ আছে।
আমি ভুলত্রুটি দেখলে সবাইকে বকি । কাউকে বাদ রাখিনা। আর এই মেয়ে তো পুরো ভুলে ভরা। হাঁটতে বসতে ভুল করে।
বিয়েশাদি হলে ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের আগে সব মেয়েরাই ওরকম থাকে।
সুজানা মলমের কৌটোটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েই রইলো।
হুহ, কোথাকার বিয়ে টিয়ে! বললেই হলো নাকি।
তুমি হাতে মলমের কৌটায় নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছ? আজব ব্যাপার! দেখি কৌটোটা দাও তো দেখি।
সুজানা কৌটো দিতেই সালমা বেগম কৌটো খুলে মলম নিয়ে বলল
এদিকে এসে বসো। হা করো কি দেখছ? এসো।
সুজানা উনার পাশে গিয়ে বসে হাতের তালু মেললো। চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছে। এতে মলম লাগালে আরও জ্বলবে কিন্তু পরিস্থিতি ওর হাতে নেই। হাতটা সালমা বেগমের হাতে। উনি আলতোভাবে মলম লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন
আহা দেখো তো কতখানি ছিঁড়ছে। মাংস দেখা যায়। কেমন মেয়ে তুমি? তোমার শ্বাশুড়িকে বদনাম শুনিয়ে তাহলে ভুল কিছু করিনি।
সুজানা চোখ তুলে উনার দিকে তাকালো। উনিও তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। চোখ নামিয়ে নিয়ে সুজানা বলল
বদনাম?
হ্যা।
কি বলেছেন?
বলেছি তুমি বোকা, আদবকায়দা জানোনা, কিছু জানো না। তুমি কি আসলেই কিছু জানো?
আপনি শেখাবেন।
আমি?
হুমম। আপনার কাছ থেকে তো অনেক কিছু শিখেছি।
আমি কেন শেখাবো? ওই বাড়ির যোগ্য বউ হতে?
হুমম।
মলম লাগানো শেষ করে কৌটো ধরিয়ে দিলেন উনি সুজানাকে। বললেন
তোমাক শেখানো পড়ানের সময় নেই আমার হাতে। যাদের বাড়ি যাচ্ছ ওরা দেখে নেবে। আর তোমার মতো মেয়েকে আমার শেখানো পড়ানোর কোনো ইচ্ছা নেই।
সুজানা মলমের কৌটো নিয়ে হেসে বেরিয়ে এল। ক্ষণে ক্ষণে মুড পাল্টায় মহিলা।
ও বেরুতেই পাশের জন্য বলে উঠলেন
আমাদের অভির জন্য এরকম একটা পেলেই হতো আপা। তাই না?
থাক। যে মেয়ে আমার ছেলের কপালে আছে ওই মেয়ে এমনিতেই আসবে। ছেলেটা সহজসরল তাই আমি ভয়ে থাকি। একটা ভালো মেয়ের সাথে দেখা করিয়ে দাও খোদা। আমার আর তর সইছেনা।
তখনি অভিক ঘরে ঢুকে এল ফোন কানে । ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল
বাবা কথা বলতে চায়। বাইরে চলো।
মা ছেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সালমা বেগম কথা বলা শেষ করে ছেলের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিলেন। অভিক মায়ের পান্ডুর মুখখানা দেখে হেসে বলল
কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? বিয়ে বাড়িতে এসেছ না? এরকম মুখ করে রাখলে ভালো লাগে?
হ্যা সবার বিয়ে খাই আমি। তোর বিয়ে আমার আর দেখাও হবেনা, খাওয়াও হবেনা। তুই কি বিয়ে নিয়ে একটুও সিরিয়াস হবিনা অভি? আর কত! আমি তোর জন্য আর কোনো মেয়ে দেখব না ঠিক করেছি। যাকে মনে ধরে রাখি তার বিয়েশাদি ঠিকঠাক। এইবার তুই একটা পছন্দ কর। তোর কি কোনো মেয়েটেয়ে পছন্দ নেই? থাকলে বল আমি বাকিটা দেখে নেব।
মা মা আমার কথা শোনো। এতটা হাইপার হলে চলে? ধৈর্য ধরো।
বাপের মতো হয়েছে একদম। কথায় কথায় আমাকে ধৈর্য শেখাতে আসে। আচ্ছা সুদূর বিদেশ ঘুরে এলি তারপরও একটা মেয়েও তোর পছন্দের নেই? এরকম হলে তো চলেনা অভি।
আই হ্যাভ।
অ্যাহহ!
হুম।
সালমা বেগম দুহাত মুখের উপর চেপে রাখলেন। তারপর ছেলের মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলেন চুপচাপ। খুশিতে চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে।
মিহি স্বরে জানতে চাইলো
কে সে?
সময় হলে বলব।
নাহহ অভি। এখন বলবি। মায়ের কাছ থেকে লুকোবি?
অভিক হেসে ফেলল মায়ের কথা শুনে।
তুমি একদম বাচ্চাদের মতো করো মা।
তুই আমার বাপ তাই।
অভিক আবারও হাসলো। বলল
লাইসেন্স পেয়ে গেলে তোমাকে সবার আগে বলব।
লাইসেন্স? কিসের লাইসেন্স। ধুর আমাকে বল আমি এখন গিয়ে কথা বলব। মেয়েটা কোথায় থাকে? দেখতে কেমন?
ওই মেয়ে আমার মনের মতো হবে তো অভি? আমার একটামাত্র ছেলের বউ? আনিকার মতো হবে তো?
ওসব অনেক দূরের কথা মা। একটা ছেলে একটা মেয়েকে পছন্দ করে বিধায় মেয়েটারও ছেলেটাকে পছন্দ করতে হবে এমন কোনো কথা আছে? মা আমার সময় দরকার। বাড়িতে গিয়ে ওটা বাবা আর জেঠুকে বলে দেবে। ভাইকেও। যাতে কোনো মেয়ের কথা না বলে। ঠিক আছে?
সালমা বেগম ভুরু কুঁচকে চাইলেন।
আমি অতকিছু বুঝিনা অভি। বিয়ে এ বছরেই করতে হবে।
না। এটা সম্ভব না মা।
কেন সম্ভব না? তুই আমাকে ওই মেয়ের ছবি ঠিকানা দে। আমি আজই কথা বলব।
উফফ মা ওসব অনেক দূরের কথা।
কি দূরের কথা দূরের কথা লাগিয়েছিস? আচ্ছা আমাকে ছবিও দেখাবি না? আমি তোর মা তো।
তুমি মা বলেই তো তোমাকে সবটা বললাম।
আচ্ছা আচ্ছা মেয়েটা তোর মতোই মিষ্টি না? ওমা আমার তো ভাবতেই কেমন লাগছে অভি। আমার ছেলেটা তাহলে শেষমেশ বড় হলো। কি খুশির খবর! মেয়েটাকে দেখতে পেলে আরও ভালো হতো। কখন দেখাবি অভি?
লাইসেন্স পেলে।
ধুররর। লাইসেন্স পাইসেন্স। ছেলে আমাকে নতুন নতুন কথা শেখায়।
বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন উনি।
তন্মধ্যে সুজানার উপস্থিতি দুরকমের আবহে ভাসলো কয়েকটা নিস্তব্ধ মুহূর্ত। সালমা বেগম উত্তেজিত হয়ে বললেন
কি? কি চাও?
অনা আবিদকে নিয়ে যেতে পারব আমাদের সাথে? কাছেই যাচ্ছি বন্ধুদের সাথে।
যেখানে ইচ্ছে যাও। আমার নাতি নাতনিগুলোকে সামলে রাখলেই হবে।
আচ্ছা।
অভিক বলল
কোথায় যাচ্ছেন?
আমি সিউর জানিনা। নিখিল বলল কাছেই নাকি। কেক কাটার পূর্বেই চলে আসব।
ওকে। সাবধানে।
সুজানা অনুমতি নিয়ে চলে গেল।
সালমা বেগম বিড়বিড়িয়ে বললেন
তুমি এবার শ্বশুরবাড়ি যাও আর উচ্ছন্নে যাও, তোমাকে আর দরকার নেই আমার।
মা কি ভাবছ?
সালমা বেগম চমকে উঠলেন। বললেন
আমি?
হুমম।
এই মেয়েটার কথা ভাবছি।
মেয়েটার কথা কি ভাবছ?
আচ্ছা অভি এই মেয়েটা ওই মেয়েটাকে চেনে তো? মানে এই মেয়েটার বড় হবে নাকি ছোট হবে?
সমান সমান।
ও আল্লাহ কি বলিস? এই মেয়ে চেনে?
হুহ।
তাহলে আমি ওর কাছ থেকে জেনে নেব। পারব?
সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারবে না। অন্যভাবে পারো।
সালমা বেগম উত্তেজিত হয়ে উঠে বললেন
এইতো আমার ভালো ছেলে। তাহলে আমি যাই।
কোথায়?
সুজানার কাছে।
সুজানার কাছে কি?
ওই মেয়েটার ব্যাপারে জানতে চাইবো। আচ্ছা নামটা তো বল।
সুজানা কিছু জানেনা মা।
অভি খুব মারব কিন্তু। মশকরা করিস মায়ের সাথে?
মা আমি সুজানার টিচার। আমার প্রেস্টিজ নষ্ট হবে।
হ্যা তাই তো। এই মেয়ে যদি আবার সবাইকে বলে দেয় তখন? থাক বলব না। আচ্ছা অভি আমি ওর কাছ থেকে ইনিয়েবিনিয়ে তো জিজ্ঞেস করতে পারি। তাই না? তুই আমাকে কিছু বল তো এই মেয়ের নামে। মানে ক্লু দিবি আর কি?
উনার নাম সুজানা আফরিদা। সরিষাবাড়ির রাস্তার মোড়ে তিন তলায় থাকে। একটা ভাই আর মা নিয়ে ওনাদের পরিবার। সিইউ থার্ড ইয়ার, ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট।
সালমা বেগমের চোখ পাকানো দেখে অভিক থেমে গেল। উনি গালে হাত দিতেই অভিক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল
তো? কোন মেয়ের কথা বললে সেটাই তো বুঝলাম না। এই মেয়ে বলতে আপাতত সুজানাকেই চিনি।
মেরে তক্তা বানাবো অভি। ওই মেয়ের কথা বলছি অভি। সুজানা নয়।
তাহলে আজ থেকে এই মেয়ে ওই মেয়ে নয়। সুজানাকে সুজানাই বলবে। ওকে? নইলে দেখা যাবে ওই মেয়ের বদলে এই মেয়ে মানে সুজানাই সব জায়গায় চলে আসছে।
হ্যা বুঝেছি। সুজানাই বলব। কিন্তু যে আমার ছেলের বউ হবে তার নাম জানিনা এটা কেমন না? আমি ওই মেয়ে বলতে থাকব?
তুমি আপাতত এই মেয়ে ওই মেয়ে বলে চালিয়ে যাও মা। টা টা।
মাকে দ্বিধাদ্বন্দে ফেলে চলে গেল অভিক। সালমা বেগমের কাছে হিসাব স্পষ্ট নয়। ওই মেয়ে মানে তো ওই মেয়ে। আর এই মেয়ে মানে সুজানা। তাহলে ওই মেয়েকে এই মেয়ে কি করে বলবে? ধুরর ছেলেটাকে বাপের রোগে ধরেছে। আজকাল মশকরা শুরু করেছে। ফাজিল ছেলে কোথাকার!
চলবে…..
#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২১
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
কিছু আগেই খাওয়াদাওয়ার পর্ব পুরোপুরি চুকে গিয়েছে। দেশী গরুর মাংস দিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি, নলার ঝোল ভালোই জমেছে। রাত এগারোটা ঘরে। কেক কাটার পর্ব শুরু হবে। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিখিলের জেঠাতো বোনের মেয়ে আর আরও কয়েকটা বাচ্চা মেয়েকে শাড়ি পড়তে দেখে মুখ গোমড়া করে বসেছিল অনা। কান্নাকাটিও সেড়ে ফেলেছে অভিকের কাছে। পরবর্তীতে বাড়িতে ফোন করলে ড্রাইভার এসে তার জন্য ওই বার্থডের দিন পড়া শাড়িটা দিয়ে গেল। শাড়িটা পেয়ে সে ভীষণ খুশি এবং সুজানের হাতে শাড়ি ও সাজতে পেরে আরও খুশি। সালমা বেগম কড়া অর্ডার দিয়ে গেছে। উনার নাতনিকে যেন সুজানার মতো করেই সাজায়। নিজের এমন পরোক্ষ প্রশংসায় মনে মনে খুশি হলো সুজানা। তবে তা বেশিক্ষণ রইলো অনার আদেশ পালন করতে গিয়ে। তার আদেশ সুজানির মোতো করি সাজবে। শান্তা আর মেহুলও তাকে সাজাতে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দুজনেই বলল
এটা স্যারের মা হয় কি করে? এত বজ্জাত!
অনা আঙুল দেখিয়ে বলল
চোপ চোপ আমি অভির আম্মুচান।
শান্তা ভেঙচি দিয়ে বলল
কচুজান।
অভি তুমাকে গাল ছিঁড়ি দিবে।
শান্তা গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সুজানা হেসে বলল
ওকে আহির পেয়েছিস?
মেহুল ফিক করে হেসে উঠে বলল
সুজানা তুই এই দুটোকে পড়াস কি করে? কি পন্ডিত!
অনা দুঠোঁট একে অপরের সাথে লাগিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে এপাশওপাশ দুলতে দুলতে বলল
সুজানির মোতো লাচচে। ওআও।
তারা তিনজন একসাথে হেসে উঠলো।
——–
স্টেজের বিপরীত পাশেই আরও একটি বড়সড় স্টেজ বানানো হয়েছে। তবে ওটাতে সাজানো হয়নি। আপাতত বন্ধুমহল আর কাজিনদের আড্ডা বসেছে। তাদের মাঝখানে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে আবিদও আছে। সায়েমের সাথে মজা করছে, হাসাহাসি করছে। অল্পসময়ের মধ্যেই বেশ ভাব জমে গেছে সায়েমের সাথে। সায়েমকে এখন চায়িম ভিইয়া বলে ডাকা শুরু করেছে। সায়েম ইনজয় করছে সম্বোধনটা। বাচ্চাটাও ভীষণ আদুরে। আপা এত কিউট বাচ্চা গুলোকে পড়ায় কি করে। সে হলে সারাক্ষণ গাল চটকাতো।
বর আর বরের বন্ধুমহলকে দেখে আড্ডামহলে খানিকটা নীরবতা তারপরপরই হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠলো সবাই। জায়গা খালি করে উঠে দাঁড়ালো নিখিল আহির আর জায়িন। শ্রদ্ধাভাজন স্যারের দিকে চেয়ার ঠেলে দিতেই অভিক চেয়ারে টেনে বসে বলল
তোমরা বসতে পারো। গান শোনার রাইট আমাদেরও তো আছে।
আহির হেসে বলল
কাকের গলায় আর কি গান।
নিখিল চোখ লাল করে তাকালো। নাহিদ আর বাকি বন্ধুরা চেয়ারে বসলো। নাহিদ গা এলিয়ে দিয়ে বলল
তোরা ভাই কেক কাটবি কখন? নাকি আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বো?
জুনিয়ররা থাকায় রাহাত ফিসফিসিয়ে বলল
যাহ কাল রাইতে ঘুমাইতে পারবি না। আইজ গিয়া ঘুমা। কেক আমরা কাটি।
নাহিদ ঠোঁট কামড়ে তাকাতেই অভিক হেসে উঠলো। বলল
এখানে সবাই স্টুডেন্ট। সামলে।
যথাস্তু। কিন্তু তার বউ কেক কেটে অলরেডি ছবি এদিকে পাচার করে দিছে আর সে এখনো মশা তাড়াই। ভাইরে ভাই কেকটেক কাট। আমরা যাই।
নিখিল এসে বলল
আরেহ রাহাত ভাই এত তাড়া কিসের? এখনো তো সবে শুরু। মেয়েরা রেডি হচ্ছে। তাই বসে থাকতে হচ্ছে।
সাফিন বলল
আচ্ছা তোর গিটারটার অবস্থা তো কাহিল। সমস্যা কি? ফকিরের ছদ্মবেশ ধরছোস কেন? তোর ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়ের কিপ্টামি গিরি নাকি এখনো বহাল আছে?
নিখিলের মন খারাপ হয়ে এল। নাহিদ বলল
ধুরর বাবার উপর রাগ করে আর কিনছেনা। আমি কিনেছি ওটা নিচ্ছে না। কি আর করার?
অভিক বলল
ওটা নিয়ে আয়। নিখিলের নেওয়া দরকার।
নিখিল মাথা নাড়ালো।
নাহিদ কালো চকচকে কালো রঙের গিটারটি এনে অভিকের হাতে দিল। অভিক সেটি নেড়েচেড়ে দেখলো। নিখিল বলল
স্যার আপনি পারেন?
অভিক গিটারটি বামপাশে করে নিয়ে বলল
পারি। বাট প্র্যাকটিসে নেই। ব্রো মনে আছে মিললে পেট্রোজার সাথে ছবি তুলে দিয়েছিলাম তোদের। ওয়ান অফ দ্য বেস্ট গিটারিস্ট। এন্ড দারুণ পার্সোনালিটি। মাই ফেইভরিট পার্সন।
আহির ফোন বের করে ততক্ষণে ছবিটা খুঁজে বের করে নিল। বলল
স্যার এইটা? আমি ইন্সটাগ্রাম থেকে নিয়েছি। ভিডিওটাও অনেক দেখেছি।
অভিক ঠোঁট বাঁকিয়ে সাবাশ উপাধি দিয়ে বলল
হ্যা এটাই মিল পেট্রোজা। আমি ওদের সাথে অনেকগুলো পার্টিতে এটেন্ড করেছি।
নাহিদ বলল
হ্যা হ্যা আমিও দেখেছি। ভিডিওটাও দেখেছি। ওখানে সুন্দুরী লাল চুলওয়ালা মহিলাটা কে যেন?
অভিক থামিয়ে দিয়ে বলল
স্টুপিড, তোর মুখে সবসময় বাজে কথা ওটা পেট্রোজার ওয়াইফ।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। নাহিদ বলল
হ্যা আলাভিউ এভি কাকে বলেছিল যেন। কি সুন্দর করে ডাকলো মাইরি! এভি ফার্দেন।
সিরিয়াসলি! ওখানে ওটা নর্মাল। তুই অফ যাহ। আমি গিটার বাজাবো। নিখিল এসিস্ট মি।
ওকে স্যার।
আবিদ লাফ মেরে এসে অভিকের কোলে এসে বসলো। গিটারের তারে আঙুল ঘষা মেরে বলল
অভি অভি আমিও বাছাবো।
অভিক তার গালে আদর দিয়ে বলল
আপনিও বাছাবেন? বনু কোথায়?
বুনু সুজানের কাছে লিপিচটিক দিচচে।
সবাই আরেকদফা হেসে উঠলো। নাহিদ আবিদকে কোলে নিয়ে বলল
পুরো বাপকা বেটা। অভি এইটা তোর কার্বনকপি হবে দেখিস।
অভিক গর্বে হাসলো।
নিখিল বলল
ভাই এখন চুপ যাও। স্যার আপনি গিটার বাজান।
অভিক একটা দুটো আঙুল নেড়েচেড়ে টুংটাং এলোমেলো সুর তুললো। নিখিলের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো হচ্ছে কিনা।
নিখিল বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সমর্থন জানাতেই অভিক চমৎকার হেসে বলল
আমার খুব প্রিয় একটা টিউন আছে। ওটা ট্রাই করছি, হচ্ছেনা।
নাহিদ বলল
হাহ তুই বরং মাস্টারি বাদ দে। তোর বাপের বিজনেস সামলা আর গিটার বাজা। এটাই ভালো হবে।
বাবার বিজনেসের টেক কেয়ার অলরেডি করছি। বিয়ে করলে মানুষ পাগল হয়ে যায় সেটা তোকে দেখে বুঝে গেছি আমি।
তুই আমার চাইতেও বেশি হবি।
সবকিছুর স্বাদ নেয়া দরকার। জীবন তো একটাই।
সবাই সমর্থন করলো।
ইয়েস ইয়েস জীবন একটাই।
অভিক বলল
বাট….
তুই হাটট। গিটার বাজা।
ইয়াহ সিউর।
তরঙ্গ হতে সৃষ্ট শব্দসুর উঠলো ধীরেধীরে সবার কৌতূহলকে চাপিয়ে। সেই টুংটাং সুরের সাথে খোলা গলায় গান ধরলো সবাই
ভেঙে চুড়ে যায় আমাদের ঘরবাড়ি
জং ধরে যায় আমাদের তরবারি
যত ভাবি আলগোছে জল খেতে পাবো
জামা ভিজে যায় আর কত দূর যাবো
যত দূরে যায় আমাদের হাতছানি
তারও দূরে দেখি নাবিকের মস্তানি
দিক ভুল হয়ে যায় খুঁজে পাওয়া যায় না
আমাদের বাড়ি
আহির তার ক্যামরায় টুকটাক ক্লিক নিয়ে নিল সেই ফাঁকে।
গান শেষ হওয়ার আগেই অভিক ভুল আঙুল চালানোতে গিটার থেমে গেল। সবাই রুষ্ট চোখে তাকালো। অভিক আঙুল ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়িয়ে পড়লো। গালে আঙুল রেখে বলল
লেগেছে। আমি আসছি।
নিখিল বলল
স্যার কিভাবে হলো এটা? বেশি কেটেছে?
আঙুল ঝেড়ে অভিককে আসতে দেখে সুজানা একপাশে সেটে গেল। অভিক সেদিকে যেতেই সুজানা অন্যপাশে গেল, অভিক সেদিকে যেতেই সুজানা থেমে গেল। অভিককে যেতে দিল।
অভিক আঙুল কামড়ে বলল
আমার আঙুল কেটে গেল।
কেন?
আপনার জন্য।
সুজানা চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল
আমি কি করেছি?
আপনি ভুল সময়ে এসেছেন।
অনা তাড়া দিচ্ছিল। তাই এসেছি।
আমি এত কৈফিয়ত চেয়েছি?
না।
তাহলে দিচ্ছেন কেন?
আপনি বললেন ভুল সময়ে এসেছি তাই বললাম।
অভি চলেই যাচ্ছিল। সুজানা ডেকে বলল
স্যার, একটা কথা।
বলুন।
অনা আপনাকে খুঁজতে ওদিকে গিয়েছে।
অভি সেদিকে তাকিয়ে বলল
সাফিন সামলাবে।
সুজানা মাথা নেড়ে বলল
আচ্ছা।
অভিক যেতে গিয়ে আবার পিছু হেঁটে সুজানার সামনে এল।
আরেকটা কথা।
কি?
আমাকে যেখানে সেখানে স্যার ডাকবেন না। ওটা আপনার মুখে মানায় না।
সুজানা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকালো।
আমি তো কিছু করিনি।
অভিক যেতে যেতে উঁচু গলায় বলল
আপনি যেখানে যান সেখানেই সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এটাই আপনার দোষ।
সুজানা বিড়বিড়িয়ে বলল
এ্যাহ কচু।
_________________
কেক কাটা পর্ব শেষ হলো। অনেক হৈহুল্লোড় মজামাস্তি শেষে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে এল ভোররাতে। পরদিন সন্ধ্যায় আবারও সবার যাত্রা ব্লুমিং পার্ক ক্লাবে। ক্লাবে সবাই পরিবারের সাথে। শান্তা তার বাবা আর দাদু, মেহুল তার মা বাবা, সুজানা তার মা ভাই আর রোজা, আহিরের বাড়ি থেকে শুধু মা বাবা আর ছোট বোন আর চার বছরের ছয় বছর বয়সী ভাইটা, জায়িনের পরিবার থেকে নিহাত আর বাবা। সবার একসাথে দেখা সাক্ষাতে সবাই আনন্দিত। নিহাতকে দেখে প্রথমে বেশ চমকেছে নিখিল। তবে পাত্তা দিল না বেশ । নিহাতের ভাবসাব দেখেও মনে হলো না সে তার পরম বন্ধুভাবাপন্ন শত্রুর ভাইয়ের বিয়েতে এসেছে। যেন তার কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র বিয়েতে এসেছে এবং খুবই পরিচিত সবার সাথে।
নবকুঠির থেকে সালমা বেগমের সাথে আনজুমা বেগম, আনিকা আর অভিক এসেছে। বাড়িতে মমতাজ বেগম একা বিধায় আজাদ সাহেব আর আহনাফ খেয়েদেয়ে চলে গিয়েছেন। অনা আর আবিদ ক্লাবে পৌঁছেই সুজানাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অভিক তাদের এত খোঁজাখুঁজি করতে দেখে বলল
আপনাদের টিচারকে এখনো খুঁজে পাননি?
অভি সুজান কুথাও নাই।
নো নো সুজান আছে। আমি খুঁজে নিয়ে আসছি। ওয়েট।
অভিক সুজানাকে খুঁজতে বেরুলো। কিছুদূর এগোতেই সায়েমকে দেখলো। সায়েমের চোখ অভিকের দিকে পড়তেই সে চুইংগাম চিবোনো বন্ধ করে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। চাহনি খানিকটা ভীতিকর। অভিক কাছাকাছি এসেই ভুরু নাচিয়ে জানতে চাইলো
আপু কোথায়?
সায়েম সিঁড়ির দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল
নীচে গিয়েছে।
অভিক যাওয়ার সময় তার সামনের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল
গুড বয়।
অভিক চলে যেতেই সায়েম পেছনের চেয়ারে বসা সাজিয়া বেগমের দিকে তাকালো। উনি অভিকের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছেন।
কে ছেলেটা?
উনি আপাদের ডিপার্টমেন্টেরই স্যার। অনা আবিদের চাচ্চু।
ওহহ।
উনি চোখ সরালেন না যতদূর অভিককে দেখা গেল।
__________
আনিকার সাথে গল্পে মত্ত ছিল সুজানা। দুজনেই কথা বলে সিঁড়িপথ পেরোচ্ছিল। অভিককে দেখে দুজনের কথা থেমে গেল।
আমি আপনাকে খুঁজছিলাম সুজানা।
আনিকা ভুরু কুঁচকালো।
কেন রে?
সরি আমি না, বেবিরা।
ওদের আর কোনো কাজ আছে? সারাক্ষণ সুজান আর সুজান।
সুজানা বলল
আচ্ছা যাচ্ছি।
আনিকার সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেল সুুজানা। অভিক বলল
ধ্যাত, কথা তো আমারও ছিল।
সে অন্যপথে পা বাড়াবে তার আগেই সালমা বেগম এলেন। বললেন
এই অভি মেয়েটাকে দেখেছিস?
সুজানা?
হ্যা হ্যা।
কেন?
উনি রুক্ষ চোখে তাকালেন ছেলের দিকে।
সব কথা তোকে বলতে হবে কেন? তুই কি সব কথা আমাকে বলিস?
আচ্ছা, উনি মাত্রই ওদিকে গেলেন। আপুর সাথে আছে। যাও।
আচ্ছা।
সালমা বেগম ওদিকে যেতেই অভিক ফুঁস করে শ্বাস ফেললো। সুজানাকে খুঁজে দেওয়া, এবং সুজানার খোঁজ দেওয়া তার প্রধান ও মূখ্য কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবটা আজব!
_________
সাজিয়া বেগমকে দেখে আনিকা এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে জড়িয়ে বলল
ভালো আছেন আন্টি? আপনি এসেছেন শুনে আমি আপনার কাছেই আসছিলাম।
ভালো আছি মা। তুমি ভালো আছ? তোমার বাচ্চারা কোথায়?
ওরা আছে মেবি সাফিনের সাথে।
তোমার শ্বাশুড়ির সাথে গল্প করছিলাম এতক্ষণ। তোমার চাচী শ্বাশুড়ির সাথে তো দেখা হলো না।
আনজুমা বেগম বললেন
ও আবার কোথায় গেল কে জানে?
সুজানা বলল
হ্যা আমিও ছোট আন্টিকে দেখিনি।
সালমা বেগম এলেন তখন। চশমার নিচে উনার চোখদুটো বেশ তীক্ষ্ণ । সুজানাকে বলল
কি ব্যাপার মেয়ে? তোমাকে সেই তখন থেকেই খুঁজে যাচ্ছি। এক জায়গায় থাকতে পারোনা। আমার পা ব্যাথা হয়ে এল। বাবারে।
সুজানা একবার মা আরেকবার সালমা বেগমের দিকে তাকালেন। সাজিয়া বেগম কপাল কুঁচকে সালমা বেগমের দিকে চেয়ে আছেন। মা ছেলের এত সুজানাকে কি দরকার?
সুজানাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে গিয়ে আরও একবার পিছু ফিরলো সালমা বেগম। সাজিয়া বেগমকে বলল
ওহ আপনি তার মা?
জ্বি।
দেখেছেন আপনার মেয়ে একবারও বলেছে সেটা? পরিচয় করিয়ে দিয়েছে?
সাজিয়া বেগম মৃদু হেসে ফেললেন।
তো ভালো আছেন তো?
জ্বি। আপনি ভালো আছেন?
আছি কোথায়? আপনার মেয়েই তো আমাকে হয়রান বানিয়ে দিল। চলো তোমার সাথে খুব জরুরি কথা আছে আমার। হুটহাট হারিয়ে যাবেনা।
সুজানাকে টেনে নিয়ে গেলেন উনি। সুজানা যেতে যেতে বলল
কোথায় যাচ্ছি আন্টি।
উনি এদিকওদিক তাকিয়ে বললেন
দাঁড়াও দাঁড়াও আশেপাশে অভি আছে কিনা দেখি। ছেলেটা আমাকে নজরে রাখছে।
কেন?
কেন কেন করোনা তো। তোমাকে যেটা বলতে এনেছি সেটা শুনো। তোমাদের ওই কলেজে ধুর না বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন মেয়ের সাথে অভি বেশি কথা বলে সেটা আমাকে বলো।
সুজানা বলল
এ্যাহ? স্যার?
হ্যা হ্যা তোমাদের স্যার।
আমি তো জানিনা।
তো কি কচু জানো? আমি তো জানি না। এটা কোনো কথা হলো?
সুজানা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বিড়বিড় করলো, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও।
শোনো মেয়ে, অভি ওখানে কার সাথে বেশি কথা বলে ওটা তুমি লক্ষ রাখবে। ঠিক আছে? যখনি দেখবে কোনো মেয়ের সাথে বেশি কথা বলছে, হাসি তামাশা করছে কিংবা আলাদা কথা বলছে তখনি তুমি আমাকে এসে বলবে।
তখনি?
আরেহ না, যখন বাবুদের পড়াতে আসবা তখন।
আচ্ছা।
মনে থাকবে তো?
আচ্ছা।
এসব কিন্তু আবার অভিকে বলোনা যেন।
আচ্ছা।
পরক্ষণে অভিককে দেখে সালমা বেগন একদম সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
এখানে কি হচ্ছে?
সুজানা সালমা বেগমের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
সালমা বেগম বললেন
কোথায় কি হচ্ছে? আমি ওর সাথে কথা বলছিলাম।
আচ্ছা। ভালো।
হ্যা। ভালো হবেনা কেন?
কেন’র উত্তর আমার কাছে নেই। তোমার কাছে আছে।
অভি মশকরা করবি না।
সুজানা ঠোঁট টিপে হাসলো। এরা মা ছেলে দুটোই পাগল।
আজীম সাহেব মা ছেলে আর সুজানাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন
কি চলছে এখানে?
অভিক পেছনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বলল
বাবা মা সুজানার সাথে কিছু শলাপরামর্শ করছিল। শুনতে এলাম।
বললেই হলো নাকি?
আজীম সাহেব হাসলেন। বললেন
সুজানা আন্টি তোমাকে প্রচুর জ্বালাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।
সুজানা মৃদু হেসে বলল
না তেমন কিছু না।
তুমি একদম কথা বলবে না। ছেলেটাকে নিজের মত বানিয়েছ না? আমার থেকে কথা লুকায়।
অভিক চোখের ইশারায় চুপ করতে বললো।
ছেলে কি লুকিয়েছে সালমা?
অনেক কিছু লুকচ্ছে সে ইদানীং। তুমি সব জানো। শুধু আমি জানিনা। শোনো ছেলেকে নিজের মত করেছ সে ভালো কথা, কিন্তু ছেলের বউ একদম আমার মনের মতো হবে। বুঝেছ?
হ্যা হ্যা বুঝেছি। তুমি নিজ হাতে গড়ে নিও। কোনো সমস্যা না। ঠিক আছে?
হ্যা।
উনাদের সাথে সাথে সুজানাও ঠোঁট টিপে হাসলো।সালমা বেগম তার দিকে ফিরে বলল
তুমি হাসছ কেন? তুমি যাও তোমার ইয়ের কাছে।
কার কাছে?
মাগোমা সব বলে দিতে হয় কিছুদিন পর শ্বশুরবাড়ি যাবে। আপাতত তোমার মায়ের কাছে যাও বাছা।
সুজানা মাথা নেড়ে চলে গেল। সালমা বেগমও বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলেন।
উনি চলে যেতেই বাবা ছেলের কানের পাশে গিয়ে বলল
অভিক ফারদিন, তোমার বউয়ের কপালে দুঃখ আছে। আমার মতো ধৈর্যশালী হলে তো ভালোই।
অভিক ঠোঁট উল্টে বলল
কনফিউজড।
কে?
তারা দুজনেই।
বাবা এবার ভুরু কুঁচকে তাকালেন ছেলের দিকে।
কিয়ৎক্ষণ পর হেসে উঠলো দুজনেই।
চলবে………