আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব-২৬+২৭

0
439

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২৬
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

বিকেল তিনটে। পশ্চিমাকাশে ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে অংশুমালী। সুজানা আজ দুপুরে একটুও ঘুমায়নি। ক্লাসের নোটগুলো পুনরায় করতে গিয়ে বেলা তিনটে বেজে গিয়েছে। সাজিয়া বেগম নাশতা বানিয়ে রেখেছে যাতে মেয়ে কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়তে পারে।
সুজানা ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে রান্নাঘরে গরম নাশতা তাড়াহুড়ো করে মুখে দিল বিসমিল্লাহ বলে। তা দেখে মা ধমকের স্বরে বললেন,

তাড়াহুড়ো করে খাবার খেতে নেই সুজানা। একটু ধীরেসুস্থে খেতে হয়।

সুজানা ধীরেসুস্থে খেতে খেতে বলল

ভাইয়ের কলেজের ফর্ম ফিলাপের টাকা দিয়ে দিয়েছ?

কোথায় থাকিস তুই? কালই দিয়ে দিয়েছি। এখন কলেজ থেকে এসে খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছে। বাইরে বের হওয়ার অনেক চল-চাতুরী করছিল। অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি। এই ছেলে আর বড় হবেনা। তোর মত এত বোধবুদ্ধি ওর নেই। বুঝলি? আমার কষ্টের শেষও হবেনা তাই।

সুজানা হাসলো। বলল

এভাবে বলছ কেন আম্মা? আমাকে তো বললো তোকে কিছুদিন পর চাকরি বাকরি কিছু করতে দেব না আপা। আমি করব সব।

হ্যা, তার সাথে কথাই পারে কে?

সুজানা আবারও হাসলো। বলল

এখনও ছোট তাই। বড় হলে দেখবে সবকিছু নিয়ে ভাববে। তাছাড়া ওর মতো ছন্নছাড়ারাই জীবনটা ভালো উপলব্ধি করতে পারে।

আমি তোকে খুব কষ্টে রেখেছি। আমি বুঝি।

সুজানা বলল

আম্মা কি বলো? আমার বসে খেতে ভালো লাগেনা। তাছাড়া চেপেচিপে খরচ করতেও ভালো লাগেনা আমার।

বিয়ের পরও চাকরি করবি? তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ি যদি চাকরি করতে না দেয়?

সুজানা গম্ভীর হলো কিছুটা।

কেন? করতে দেবেনা কেন?

অনেকেই পছন্দ করেনা বাড়ির বউরা চাকরি করুক।

মা যুগ পাল্টেছে।

পাল্টালেও। সন্তানসন্ততি হলে মায়েদের প্রথম কাজ থাকে তাদের লালন পালন করা। অনেকেই পছন্দ করেনা বাচ্চা রেখে মা চাকরি করুক। যাদের টাকা পয়সা থাকে তারা একদমই চায় না।

হুমম, আমাকে যদি মাসে মাসে বেতন দেয় তাহলে করব না।

হেয়ালী করে কথা বলছিস সুজানা।

আচ্ছা আমি চুপ থাকলাম।

এখন তো চুপই করবি। নিজের ভালোটা আর কখন বুঝবি তুই?

সুজানা উত্তর করলো না। কিছুপরেই বলল

চাকরি কেন করতে হবে আম্মা? চাকরি ছাড়াও আরও অনেক উপায় আছে যাতে সাবলম্বী হওয়া যায়। আমাদের নীলা ম্যামকে দেখো। উনি কত বড় বিজনেস ওম্যান। সাথে মডেল এবং ফ্যাশন ডিজাইনার। আর কতবড় একটা এজেন্সী উনার। সবকিছু একহাতে সামলায়। উনার বাবার যে ছেলে নেই ওটা উনি বুঝতেই দেননি। বাবার পাশে একদম ছেলের মতো ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উনি উনার বাবার খুঁটি হতে পারলে আমি আমার মায়ের খুঁটি হতে পারব না কেন?

সাজিয়া বেগম কাজের ব্যস্ততা দেখালেন। জানতে চাইলেন

বিয়ে হয়েছে?

সুজানা চুপ হয়ে গেল। মিনমিন করে বলল

জীবনে বিয়েটা সবকিছু না আম্মা। উনি তো এভাবেই ভালো আছেন।

বিয়েটা সবকিছু না ঠিক। কিন্তু টাকাপয়সা, খ্যাতি, যশ-প্রতিপত্তিও সব না। জীবন সবকিছু নিয়ে হয়। সবকিছুর প্রয়োজন আছে সুজানা। তুই সবকিছু বুঝিস কিন্তু এটা বুঝতে তোর এত কষ্ট হয় কেন?

তুমিও আমার কথাটা বুঝতে চাওনা আম্মা। তুমি বিয়ে করে কি করেছ? যাকে বিয়ে করেছ সে তোমাকে আর দুটো বাচ্চা রেখে পরপারে চলে গিয়েছে। তুমি যদি নিজে সাবলম্বী হতে আজ তাহলে এত কষ্ট করতে হতো না তোমাকে। সেলাই মেশিন চালিয়ে পা ফোলা আর কোমর ব্যাথা বাড়াতে হতো না। চাচা, ফুপীরা তো অনেকে আছে কই তারা তো একবারও খোঁজ নেয় না আমাদের। ভাইপো ভাইঝি দুটো মরলো কি বাঁচলো। তাদের অবস্থা তো যথেষ্ট ভালো। তাদেরও তো যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে আম্মা। তাদের ভাই মারা গিয়েছে তাই তুমি আমরা পর হয়ে গেলাম? তুমি দোষী হয়ে গেলে? সব দায় তোমার?
আমার সাথেও যদি এমন হয়? আমার ওসব ভয় করে আম্মা। আমি এত কঠিন জীবন চাই না। আমি তোমার মতো হতে পারব না কখনো। আমার সামনে বিয়ে বিয়ে করোনা প্লিজ।

কেঁদে উঠে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুজানা। মা তার যাওয়ার পানে টলমলে চোখে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটা কি বলে গেল? এজন্যই সে বিয়ে শব্দটা শুনতে চায় না?
পেটে ধরেছে বলে মেয়ের জীবনটাও মায়ের মতো হবে? নিজেকে এতটা অভিশপ্ত মনে করে সে?

________________________

বাচ্চাদের শোরগোল আর কান্নাকাটির শব্দে পুরো বাড়ির মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছে। মেঝেতে বসে দুজনেই খেলা করছিল। সে সময় টিচার চলে আসায় দুজন খেলা ছেড়ে পড়ার ঘরে একদম যেতে চাইলো না । আনিকা দুটো চড় দিতেই তখন থেকে কান্নাকাটি করেই চলেছে দুজন। অভিক ওদিকে যায়নি। গতকাল থেকে গলা ব্যাথা ছিল। আজ বিকেলেই শনাক্ত হলো গলায় টনসিল। ঠান্ডাজনিত সমস্যা ওর ছোটবেলা থেকেই।

ছেলের অসুস্থতা নিয়ে সালমা বেগমের চিন্তার শেষ নেই। দিনদুনিয়া বিষাক্ত লাগে ছেলের অসুখ হলে। এত নিয়মে নিয়মে চলে তারপরেও ম*রার অসুখ ছেলেটাকে ছাড়েনা।

কিছুক্ষণ পরপরই উনি ছেলের কাছে ছুটছেন গরম কফির মগ নিয়ে। ছেলেটাকে গরম পানি খাওয়ানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। ছেলেটা হা ও করেনা। বাপের মতোই বজ্জাত হয়েছে। বাপের না হয় কপাল ভালো ছিল। উনার মতো ভালো বউ পেয়েছে। কিন্তু ছেলের কি হবে? ভালো বউ পাবে কোথায়? সব তো জুটে নিমকহারাম।

বাচ্চাদের কান্নার কথা শুনেও অভিক ওদিকে গেল না। ওদের প্রশয় বেড়ে যাবে। মমতাজ বেগমের বিপরীত পাশের সোফায় গিয়ে বসলো। টিভির রিমোট চেপে চেপে ডিসকভারি চ্যানেল পাল্টালো। সালমা বেগমের চোখ টিভির দিকে পড়ায় উনি নাকমুখ কুঁচকে বললেন

ছেলের রুচি দেখো। এই বেডা যে সাপ,কু**ত্তা খায় এসব দেখতে তোর ভালো লাগে অভি?

অভিক মায়ের কথায় মৃদু হাসলো। কলিং বেল বেজে উঠায় সবাই সদর দরজার দিকে তাকালো। মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দরজা খুলতে এগিয়ে গেলেন সালমা বেগম। দেখলেন অফিসিয়াল স্যুটবুট পড়া একজন লোক। উনি সালাম দিয়ে জানতে চাইলেন

অভিক সাহেব আছেন ম্যাডাম?

হ্যা। কিন্তু অভিকে কি দরকার? ও অসুস্থ। কোনো কাজটাজ পারবেনা। বুঝলেন?

লোকটা ভ্যাঁবাছ্যাকা খেল অমন কাঠকাঠ কথা শুনে।

অভিক নিজেই এগিয়ে গেল। বলল

ম্যানাজার সাহেব! কি অবস্থা? ভেতরে আসুন। বাবা জেঠু পাঠিয়েছে নিশ্চয়ই।

হ্যা।

আসুন।

সালমা বেগমকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে ম্যানাজারকে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো অভিক। ম্যানাজার মমতাজ বেগমের সাথে কথা বলা শেষ করে বললেন

এদিকে একটা কাজেই আসছিলাম স্যার আমাকে বললো আমাদের নিউ কোম্পানির জন্য যে লোগো সিলেক্ট করা হয়েছে তা আপনার বাবা আর জেঠু নাকি আপনাকে দেখিয়েছেন কিন্তু আপনার পছন্দ হয়নি।

জ্বি, ওগুলোর কালার কম্বিনেশন ভালো ছিল না। আমি চাই লোগোটা খুবই মর্ডান এন্ড ক্লিন হোক। এন্ড আইকনটা যাতে আইক্যাচিং হয়। লোগোর জন্য একবারই ইনভেস্ট করতে হয়।

ম্যানাজার ল্যাপটপ ওপেন করে বললেন

আমাদের কাছে নতুন কিছু ডিজাইন আছে আপনি যদি দেখতেন।

অভিক ল্যাপটপ তার দিকে ঘুরিয়ে একের পর এক ডিজাইনগুলো দেখতে দেখতে বলল

হুমম, বেটার দেন বিফোর। বাট নিড টু ইমপ্রুভ। আই থিংক আরও একটু বেটার করতে বললে ডিজাইনার আরও ভালো করবেন।

হ্যা। এসব জাস্ট আগের কাজ। আমরা তাহলে এই ডিজাইনারের সাথে কথা বলি? বড় স্যার বললেন যে, রিকোয়ারমেন্টগুলো যাতে আপনিই বলে দেন। উনাদের আইডিয়া নেই তাই। আপনি যেহেতু ওয়েবসাইট নিয়ে বুঝেন তাই আপনাকে,,

আমি বুঝেছি। উনাদের ফোন দিন। আমি বুঝিয়ে বলব।

ওকে।

সালমা বেগম চায়ের ট্র এনে রাখলেন। বললেন

ওর গলায় ব্যাথা ওটা আপনাকে বলেনি ওর বাবা? বাপ হয়ে ছেলের কষ্ট বুঝেনা। আজব মানুষ! চা খেয়ে নিন ম্যানাজার।

বলেই চলে গেলেন উনি। অভিক বলল

মায়ের কথায় কিছু মনে করবেন না। মায়েরা এমনি হয়।

ম্যানাজার সাহেব কানে ফোন ধরে বললেন

না না আমাকে আপনার বাবা বলেই দিয়েছেন আসার সময় যে এখানে এলেই ম্যাডামের বকুনি খেতে হবে।

অভিক হাসলো। বলল

মাকে বাবার চাইতে কে বেশি কে চেনে?

পাশ থেকে মমতাজ বেগম বললেন

তোমার বাবাই তোমার মায়ের দিওয়ানা ছিল দাদুভাই। সে এক বিশাল প্রেমকাহিনী।

অভিক আর ম্যানাজার সাহেব হেসে উঠলো। মমতাজ বেগম ফিসফিস করে বলে উঠলেন

থামো থামো। কানে গেলে বলবে বুড়ো বয়সে শয়তানে ধরেছে।

অভিক আবারও হাসলো। বলল

বাবা বেস্ট এজ এ সান, ফাদার এন্ড হাজবেন্ড।

তুমিও তেমন হও দাদু ভাই।

অভিকের ভাবনায় একজনের মুখশ্রী ভেসে উঠলো তক্ষুণি । অবশ্য উঠবে না কেন?
সে তো দিনের ৮৬,৪০০ সেকেন্ড সময় জুড়ে থাকে।

ম্যানাজার সাহেব ওপাশ থেকে নারী কন্ঠের আওয়াজ শুনতে পেল।

আসসালামু আলাইকুম। নীলা মজুমদার। কে বলছেন?

সরি ম্যাডাম সরাসরি আপনাকে ফোন করেছি বলে। আপনাদের ডিজাইনগুলো বেশ পছন্দ হয়েছে আমাদের। তবে আমাদের আরও কিছু রিকোয়ারমেন্ট আছে। যদি আপনাদের ডিজাইনারের সাথে কথা বলা যেত।

হোল্ড অন প্লিজ । ফোনটা উনার কাছে পাঠানো হচ্ছে।

ঠিক আছে।

সুজানার কাছে ফোনটা নিয়ে গেল নীলা। বলল

আমাদের ক্লায়েন্ট। উনার সাথে কথা বলুন। ডিজাইন নিয়ে কিছু কথা বলতে চান।

সুজানা ইতস্তত বোধ করলো। নীলা বলল

সুজানা বি কনফিডেন্ট।

সুজানা ফোনটা হাতে নিল। কানে দিয়ে বলল

আসসালামু আলাইকুম। সুজানা আফরিদা ফ্রম এনটমটি।

ওপাশের জন্য হালকা কেশে উঠলো। সবার কাছ কিছুটা দূরে গিয়ে বলে উঠলো

মিটিংটা সামনাসামনি হোক?

সুজানা শুকনো ঢোক গিলে বলল

কে?

আপনার ক্লায়েন্ট। ষোলশহর দু নম্বর গেইট, নবকুঠিরে চলে আসুন কাল।

সুজানা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।

নাকি আমাদের অফিসে? কোথায় আসতে চান?

সুজানা মিনমিন করে জবাব দিল।

বাড়িতে।

গুড। বাই ফর নাউ।

নীলা বলল

কি বললেন উনি?

সুজানা ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

মিটিং।

গুগল মিট?

না।

ফেস টু ফেস? ওকে নো প্রবলেম। আমাদের লং-টার্ম কাজ করতে হবে উনাদের সাথে। ফেস টু ফেস করলে আপনি উনাদের কোম্পানি সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবেন। রাজন যাবে আপনার সাথে। উনাদের অফিস,,

উনি এড্রেস দিয়েছেন।

কোথায়?

উনাদের বাড়িতে।

উনাদের বাড়ি আপনি চিনবেন কি করে? আচ্ছা রাজনকে বলে দেখি।

দরকার পড়বেনা তার। আমি ওই বাড়িতে টিউশনি করেছি।

ওয়াও তাহলে তো খুব ভালো। অল দ্য বেস্ট সুজানা।

সুজানা মাথা নাড়ালো। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে কাজে পুনরায় মনোযোগ দিল। পরিস্থিতি বারবার তাকে “তার” মুখোমুখি দাঁড় করায়।

ডিউটি শেষে সুজানা বেরিয়ে পড়বে তখনি নীলা ফোন নিয়ে আবারও ছুটে এল। বলল

সুজানা ক্লায়েন্ট আবারও কথা বলতে চাচ্ছেন।

সুজানা ফোনটা নিয়ে নিল। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে অভিক বলল,

আপনার বিকাশটা চেক করবেন। ওইদিনের কেকের পেমেন্ট করে দিয়েছি এন্ড আরও একটা কেকের অর্ডার। ওই কেকের উপরে “Abhi” লেখা থাকবে। ঠিক আছে?

জ্বি।

কি নাম?

আপনার।

আমার নাম কি?

অ……ভি।

সুজানা ফোন রেখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে জিভের আগায় কামড় বসালো। ওপাশের জন হাসলো।

সুজানার হাত থেকে ফোন নিয়ে কানে দিল নীরা। বলল

নো প্রবলেম। আমাদের ডিজাইন কাল আপনাদের ঠিকানায় যাবেন…

কথাটা ওপাশে অভিকের কাছে পৌঁছানোর আগেই সালমা বেগম ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিলেন। অনেকক্ষণ ছেলের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। ছেলের খেয়ালই নেই । কার সাথে এত হেসেহেসে কথা বলছে?

রুক্ষ গলায় বললেন

এতক্ষণ কিসের কথা অভি? দুপুরে ভাতও খেলিনা গলা ব্যাথার কারণে। কথা বলতেও পারছিলি না। আর এখন ভালো হয়ে গেলি? এত বকবকানি কার সাথে করছিস? আবারও হাসছিস ও?

ওপাশে কাশলো নীলা। হ্যালো, বলতেই সালমা বেগম ফোনটা কানে লাগালেন। বললেন,

হ্যালো! কে তুমি?

অভিক বলল

মা মা ফোনটা দাও।

চুপ অভি। আমি কথা বলছি। হ্যা আবার বলো কে তুমি?

নীলা গলা ঝেড়ে কেশে বলল

আমি এনএমটি থেকে নীলা বলছি। নীলা মজুমদার।

সালমা বেগম অভিকের দিকে বড় বড় চোখে তাকালেন। মিনমিন করে বললেন

নীলা! ওহহ তাহলে এটা সেই মেয়েটা?

অভিক ফোনটা নিয়ে কেটে দিয়ে বলল

মা জরুরি কথা হচ্ছিল।

আচ্ছা আমি আর কখনো ডিস্টার্ব করব না তোদের।

মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেলেন উনি। অভিক মায়ের যাওয়ার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালো। তার মা আর সুজানা এ দুই মহিলা আজব! দুজনেই তাকে জ্বালিয়ে মারে।

চলবে

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২৭
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

কেকের উপর নাম লেখা শেষ হতেই সুজানা হাঁফ ছাড়লো। কেকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকবার দেখে ফোনে কয়েকটা ছবি নিল। মাকে ডাকতেই মা এসে হাজির। বললেন

শেষ হয়েছে?

হ্যা আম্মা। সুন্দর হয়েছে?

হুম।

সুজানা মায়ের মুখের দিকে তাকালো। কালকের জন্য আমার উপর রেগে আছ আম্মা? আমার মাঝেমাঝে কি যে হয়। মাথাটা একদম ঠিক থাকেনা আম্মা।

সন্তানের উপর মা কখনো রাগ করে থাকতে পারেনা। তবে সাবধান, বাইরের কারো সাথে যেন এমন না হয়। মুখের কথা কখনো ফিরিয়ে নেয়া যায় না।

মনে থাকবে আম্মা। আর কখনো এমন হবেনা।

বক্স করে নে। আর কাপড়গুলোও নিয়ে যাস মনে করে। আইরন করে ব্যাগ ভরে দিয়েছি।

আচ্ছা।

উনি যেতে গিয়ে আবারও ফিরে তাকালেন কেকের দিকে। নামটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাতেই সুজানা হেসে বলল

এটা স্যার লিখে দিতে বলেছেন।

নাম অভি?

উনাকে বাড়িতে সবাই এই নামেই ডাকে।

ক্লাবে দেখেছি। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল সায়েমকে।

সুজানা মাথা দুলিয়ে মিনমিন করে বলল,

হুমম। এমনি ডেকেছিল।

_______________

সুজানাকে দেখে বাচ্চাদের হৈহৈ রব পড়ে গেল পুরো বাড়িতে। বাচ্চাদুটোর আনন্দের শেষ নেই তাকে দেখে। সুজানা এক কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। একহাতে কেকের বাক্স,অপর হাতে কাপড়ের ব্যাগ। সুজানাকে দেখে আনিকা ছুটে এল।

এমা সুজানা যে! হঠাৎ কি মনে করে? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।

ওর হাত থেকে ব্যাগ টা নিতেই সুজানা কেকের বাক্সটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

এখানে ভ্যানিলা কেক আছে। স্যার অর্ডার দিয়েছেন।

অনা আবিদ বলল

সুজান কেক?

সুজানা তাদের সাথে মিষ্টি হাসলো। তারা দুজনেই সুজানার হাঁটু জড়িয়ে ধরে আছে। সুজানা ঝুঁকে নীচু হয়ে তাদের আদর করলো। অনাকে কোলে নিয়ে গালে আদর দিয়ে বললেন

সুজানের জন্য মন পুড়েছে?

অনা ঘনঘন মাথা দুলিয়ে বলল

সুজান আবার এ বি চি পড়াবে?

সুজানা হেসে আবারও আদর দিয়ে বলল

অবশ্যই পড়াবে।

আবিদ বলল

সুজান আবিকে কুলে নাওনা কেন?

সুজানা অনাকে নামিয়ে দিয়ে তাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল

খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আবিসোনা ভালো আছে?

আবি সুজানির সাথে লাগ কচচে।

কেন রাগ কচচে?

সুজানা আসেনা কেন?

এইযে এসেছি।

আজীম সাহেব এসে সুজানাকে দেখে বলল

আরেহ সুজানা আসামাত্র বাড়িটা তো মেতে উঠেছে। কি ব্যাপার সুজানা! এই তাহলে আমাদের ডিজাইনার!

সুজানা মৃদু হাসলো।

তাহলে ঠিক ধরেছি। অল দ্য বেস্ট।

থ্যাংকস আঙ্কেল। সুজানার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি।

আনজুমা বেগম আর মমতাজ বেগমও সুজানাকে দেখে ভারী খুশি হলেন। সালমা বেগম দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন সুজানাকে। আচ্ছা অভি এই মেয়ের কথা বলেছিল তাহলে।

আনজুমা বেগম বললেন

বৌমা অভি তাহলে দুপুরে এটাই সারপ্রাইজ বলেছিল?

হ্যা, আমারও সেটা মনে হচ্ছে। দেখুন সুজানাকে সেই আপনাকে এই বাড়িতে আসতেই হলো।

সুজানা হাসলো।

আমাদের কাছ থেকে যত পালাতে চাইবেন তত এখানে আসতে হবে কিন্তু হুমম।

সুজানা হেসে দোতলায় রেলিঙের দিকে তাকাতেই রেলিঙ ধরে ঝুঁকে মানুষটাকে দেখে ঠোঁটের হাসি মিইয়ে এল। তার সাথে চোখাচোখি হতেই অভিক ভুরু নাচালো।

এটা আবার কেমন ভাষা?
সুজানা লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিল।

মর্জিনা কেকটা নিয়ে চলে যাবে তখনি সুজানা কেকটা নিয়ে নিল। মর্জিনা কপাল কুঁচকে তাকাতেই সুজানা আরও একবার উপরে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলল

এটা স্যারকে দেখাতে হবে। উনি অর্ডার করেছেন তো তাই।

মর্জিনা মুখ মোচড়ে বলল

মাগোমা স্যারের জন্য যা দরদ!

সুজানা কেকটা নিয়ে পা বাড়াবে তখনি সালমা বেগম বলে উঠলেন

শোনো মেয়ে!

সুজানা ফিরে চাইলো।

জ্বি।

অভির গলায় টনসিল, গায়ে জ্বর। ওকে কম কথা বলাবে। প্রশ্ন করবেনা বেশি। বুঝেছ?

জ্বি।

সুজানা পা বাড়ালো। অভিককে আর দেখা গেল না। ওখানেই তো ছিল! গেল কই?

অনা আবিদ সুজানার পেছন পেছন ছুটলো। তারা আজ মহাখুশি।

সুজানা অভিকের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। অনা আবিদ দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল

অভি অভি দজজা খুলো। সুজান আসিছে। অভি দজজা খুলো।

খট করে দরজা খুলে গেল। সৌম্যদর্শন মুখটি দরজার ফাঁকে বেরিয়ে এসে জানতে চাইলো

আমার প্রথম প্রশ্ন, কেকের উপর নাম লিখেছেন?

হুমম।

আমার নাম?

হুম।

গুড।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, আজকে আপনি সময় নিয়ে এসেছেন?

হুম।

গুড।

আজকে আপনি ডিনার করেই যাবেন। ঠিক আছে?

আমি?

হুম, রাজী না হলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকুন বিশ মিনিট। এটা শাস্তি।

কিন্তু আম্মা খুব বকাঝকা করবে দেরীতে ফিরলে।

ফোন করে বলে দেবেন। ঠিক আছে? বলুন বলুন রাজী।

সুজানা মাথা নেড়ে বলল,

হুমম।

হুম বললে হবে না। বলুন, রাজী।

সুজানা মিনমিন করে বলল

হুম রাজী।

ওকে, এখন ভেতরে আসতে পারেন।

সুজানা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই অভিক বেরিয়ে গেল। বলল

আপনি চেয়ারে গিয়ে বসুন। আমি এক্ষুণি আসছি।

সুজানা কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো। অনা আবিদকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল

কেক খাবেন? খুব মজা।

সুজান কেক খুব মোজা।

সুজানা হাসলো।

হুম খুব মোজা।

অভিক তিনটে প্লেট আর দুটো কফির মগ নিয়ে ট্রে হাতে প্রবেশ করলো । ট্রে টেবিলে রেখে একটা মগ সুজানার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

এটা আপনার।

সুজানা কিছু বলতে চাইলো,অভিকের চোখের ইশারায় আর কিছু বলে উঠতে পারলো না। অভিক মগে চুমুক দিতে দিতে বলল

বাক্সটা খুলুন। কেক খাবো।

এখন?

না। আগে কফির শেষ করুন।

সুজানা কফির মগে শেষ চুমুক দিল। পাশে রেখে বাক্সটা খুলতে খুলতে বলল

তিন প্লেটে নেব?

হুমম।

কেকটা বের করতেই নামটা দেখলো অভিক। ভুরু উঁচিয়ে বলল

আমার নাম তাই বাঁকা করে লিখেছেন।

সুজানা বিস্মিত চোখে তাকালো।

এমন বাঁকা হয় সবসময়ই। আপনার সাথে আমার কিসের শত্রুতা যে বাঁকা করে লিখবো।

আপনি তো আমার বন্ধুও নন। শত্রুতা নেই কি করে বুঝলাম?

অনা ডেকে বলল

অভি অভি তুমি সুজানের বুন্ধু হবে?

সুজানের এত্তগুলা বন্ধু আছে। সে কেন আমার বন্ধু হবে?

সুজানা কপাল কুঁচকে কেক কেটে দুই প্লেটে নিল। বলল

এখন?

অভিক একটা প্লেট অনাকে আরেকটা আবিদকে দিল। বলল

খান দু’জন। ওইদিনের মতো যদি নষ্ট করেন খুব মার দেব।

অভিকে মার দেব।

অভিক হেসে উঠলো।

ওকে। মারপিঠ পড়ে। এখন খান চুপচাপ। ঠিক আছে?

ঠিকাচে।

সুজানা অন্য প্লেটটা দেখিয়ে বলল

এসব কে খাবে?

আপনি খাবেন। আমি খাব।

সুজানা গোলগোল চোখে চাইলো।

অভিক শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে বলল

আমার ছোঁয়াছে রোগ নেই। কিন্তু গলা ব্যাথা আছে সেটা নিয়ে অন্য কারো মাথা ব্যাথা হলে মন্দ হয়না।

সুজানা অভিককে আড়াল করে হাসলো। এত প্যাঁচিয়ে কথা বলতে কি করে পারে!

অনা আর আবিদ সুজানার দিকে কেক বাড়িয়ে দিল। বলল,

সুজান কেক খুউউভ মোজা। খাও।

সুজানা ওদের দুজনের হাতে খেল।

অভিক বলল,

কপাল করে এমন স্টুডেন্ট পেতে হয়। আফসোস।

সুজানা ভুরু কুঁচকে তাকালো। প্লেট থেকে এক পিস কেক তুলে নিয়ে বলল

আমার হাতে খাবেন?

অভিক চোখ বড়বড় করে চাইলো।

সিরিয়াসলি!

এত আফসোস রাখতে নেই।

তাহলে খেতেই হচ্ছে।

কেকের কাছে মুখ নিয়ে থেমে গেল সে। কপাল কুঁচকে বলল

আপনার আবার ছোঁয়াচে রোগ নেই তো?

সুজানা হেসে বলল,

আমার আছে।

কি আছে?

মাথাব্যাথা।

মাথা ব্যাথার ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। আপনি অলরেডি আমার মাথা ব্যাথার কারণ।

সুজানা ভুরু কুঁচকে তাকাতেই অভিক কেক খেয়ে নিয়ে বলল

হুমম।

আঙুলে ভেজা চঞ্চুর স্পর্শ টের পেতেই চট করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল সুজানা । ভেতরটা ধুকপুক করে কেঁপে উঠেছে। জানতে চাইলো,

খেতে ভালো হয়েছে?

অভিক কপালে ভাঁজ ফেলে গাল নাড়তে নাড়তে বলল,

হুমম, খানিকটা সুজানার মতো।

আমি কেমন?

ভয়ংকর।

সুজানা হেসে উঠে বাকি কেকটা নিয়ে বলল

আচ্ছা, আমি এটা দিয়ে আসি। আন্টিরা সবাই খাবেন।

সুজানা বেরিয়ে পড়তেই অভিক বাচ্চাদের কাছে ঝুঁকে বলল

সুজানকে খাইয়ে দিয়েছেন কিন্তু আমারটা কই।

অভিকে সুজান খায়ি দিচে। তাই আন নাই।

অভিক হেসে উঠলো তাদের কথায়।

_____________

সুজানা কেক কেটে মমতাজ বেগমকে দিল প্লেটে করে। বৃদ্ধা বললেন

রান্নাঘরে গিয়ে বাকিটা রেখে আসো বোন। বাকিটা ওরা খাবে।

সুজানা মাথা নেড়ে বলল

আচ্ছা দাদু।

বৃদ্ধা হেসে বললেন

মিষ্টি মেয়ে।

সুজানা মিষ্টি করে হাসলো। বাকি কেকটা রান্নাঘরে রেখে আসতে যেতেই দেখলো সালমা বেগম রান্নাঘরে একা। সুজানা কেকটা রেখে চলে আসবে তখনি সালমা বেগম ডাকলেন

দাঁড়াও মেয়ে।

সুজানা দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘাড় ফিরিয়ে বলল,

জ্বি।

সালমা বেগম উনার ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

নীলা নামে মেয়েটার নান্বার তোমার কাছে থাকলে দাও তো। ও তো তোমার বান্ধবী হয়, নাম্বার তো থাকার কথা।

না উনি আমার ম্যাডাম।

সে যেই হোক নাম্বার আছে?

জ্বি।

আমাকে দাও। তোমার স্যার আমাকে অনেকদিন নাচিয়েছে। মেয়েটার কোনো খোঁজখবর আমাকে দিচ্ছেনা। তাকে এসব আবার বলোনা যেন। নইলে আমার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেবে। বুঝতে পেরেছ?

সুজানা মাথা নাড়লো।

তুমি তো দেখেছ নীলাকে। দেখতে শুনতে ভালো তো?

জ্বি।

জ্বি জ্বি করা ছাড়া আর কিছু শেখোনি? নাকি আমার সামনে এলেই সাধু হয়ে যাও। তোমার হবু জামাইয়ের সাথে কথা বলোনা কেন? তুমি শর্ত দিয়েছ তাও তারা মেনেছে। তারপরও তোমার এত জেদ কিসের? হ্যা?

সুজানা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

শোনো যতটুকু পেয়েছ ততটুকু নিয়ে খুশি থাকো। তোমার কপাল ভালো এত ভালো পরিবার তোমার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে গিয়েছে। এখন যাও। আর শোনো ব্লাউজ সেলাইয়ের টাকা অভিকে বলব দিয়ে দেয়ার জন্য। ও তোমার বিকাশে পাঠিয়ে দেবে। ঠিক আছে?

সুজানা মাথা নাড়ালো।

আর শোনো আমাকে নাম্বার দিয়েছ একথা অভি নয় কেউ যেন জানতে না পারে।

সুজানা সাহস করে জিজ্ঞেস করলো

ফোন নাম্বার কেন নিয়েছেন?

ওর বাবার সাথে কথা বলবো তাই। তুমি ওকে অভির সাথে কখনো কথা বলতে দেখেছ?

সুজানা দুপাশে মাথা নাড়ালো।

মিথ্যে বলছ কেন? আমি তো কাল দেখেছি অভিকে কথা বলতে।

আমি বোধহয় জানিনা।

হ্যা জানোনা। এখন যাও।

অভিক রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল

এতক্ষণ লাগে আসতে? কাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসুন।

সুজানা মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল অভিকের পিছু পিছু। সালমা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইলেন তাদের যাওয়ার দিকে। ছেলেটার কোনো হাবভাব আজকাল তিনি ধরতে পারছেন না।

ফোনে সেভ করা নাম্বারটার দিকে তাকালেন। কল দিতেই দু’বার রিং হওয়ার পর মেয়েলী কন্ঠস্বর ভেসে এল।

আসসালামু আলাইকুম। নীলা বলছি। কে বলছেন?

ওয়ালাইকুমুস সালাম। তোমার বাবার নাম্বারটা পাওয়া যাবে?

জ্বি। কিন্তু আপনি কে?

তুমি আমাকে চিনবেনা। তোমার বাবার ফোন নাম্বারটা দরকার ছিল।

আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?

আজব ব্যাপার তো। তুমি এত প্রশ্ন করছ কেন? তোমার বাবার ফোন নাম্বারটা দাও।

নীলার ভুরু কুঁচকে এল ।

আপনি পরিচয় না দিলে বাবার ফোন নাম্বার দেয়া যাবেনা। আপনার গলার স্বর পরিচিত মনে হচ্ছে।

তোমার বাবার নাম্বারটা দাও মেয়ে। আরেকবার যদি বলতে হয় খুব খারাপ হবে কিন্তু।

খারাপ হলে হবে। পরিচয় দিন। তাহলে নাম্বার দেব। নইলে ফোন রাখুন। এটা অফিসিয়াল নাম্বার। অযথা কল দেবেন না।

তারমানে তোমার বাবার নাম্বারটা দেবেনা?

আপনি কি পাগল? নাকি কানে কম শোনেন? কি বলেছি শুনতে পাননি? আজাইরা মানুষের আর কাজকাম নেই মনে হয়।

সালমা বেগম রাগে অপমানে ফোনটা জোরে টিপে ধরলেন। একেবারে সুইচঅফ হয়ে গেল সেটি। রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠতেই আনিকা এসে বলল

ছোটমা কি হলো? কি হলো ছোটমা?

উনি ঘেমে উঠলেন তরতরিয়ে । কান্না আটকে বললেন

অভির পছন্দ এত খারাপ কি করে হলো বৌমা? মেয়েটা একটুও ভালো না। একটুও ভালো না। মুখে মুখে তর্ক করে। আমাকে অপমান করেছে। আমাকে।

আনিকা উনাকে ধরে বললেন

ছোটমা শরীর খারাপ লাগছে? কিসব বলছ? অভি এই অভি? মা তাড়াতাড়ি এসো।

সালমা বেগমের দাঁতে দাঁত লেগে গেল। কিছু সময়ের ব্যবধানে হুলস্থুল পড়ে গেল পুরো বাড়িতে।

অভিক ছুটে এসে দেখলো মা জ্ঞান হারিয়ে আনিকার কোলে পড়ে আছে। সে স্তব্ধ হয়ে গেল। সুজানও বিস্ময়ের চরম পর্যায় । আন্টি এখন তার সাথে কথা বললো না। হঠাৎ কি হলো?

অভিক মায়ের মাথা কোলে তুলে নিয়ে বলল

মায়ের এ অবস্থা কি করে হলো?

আনিকা কান্না আটকে রেখে বলল

আমি জানিনা অভি। এসে দেখলাম ছোটমা হাঁপাচ্ছে, ঘাম দিয়েছে। পরে দেখি দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যা।

অভিক মায়ের নিথর শরীর কোলে নিয়ে ছুটে গেল। আহনাফ এসে বলল

অভি ডাক্তার রওনা দিয়েছে। হসপিটালে নিয়ে যেতে হবেনা। ছোটমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দে। আনু হাত পা মালিশ করতে থাকো।

অভিক বলল

মায়ের কিছু হবে না তো।

আহনাফ বলল,

কিছু হবেনা ভাই।
আচ্ছা বাড়ি ভর্তি মানুষ আর কেউ দেখলো না একটা মানুষের এই অবস্থা কেন হলো?

আজীম সাহেব আর আজাদ সাহেব ডাক্তার নিয়ে এল। সুজানা আর আনিকা সালমা বেগমের হাতের তালু মালিশ করছে। ডাক্তার বলল

উনি কি অসুস্থ ছিলেন?

না। পুরো সুস্থ সবল মানুষ।

সুজানা বলল

আন্টি কয়েক মিনিট আগেই আমার সাথে কথা বলেছে। তখনও ঠিক ছিল।

ডাক্তার পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বলল

উনি রাগে নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছেন। তাছাড়া ফ্রেশার লো ছিল। তেমন চিন্তার কিছু নেই তবে এভাবে হাইপার হওয়াটা উনার শরীরের পক্ষে খুব ক্ষতিকর।

অভিক হাঁটুভেঙে মায়ের মাথার কাছে বসে কপালে চুমু খেয়ে বলল

মা, মা উঠে যাও।

মমতাজ বেগম কপাল চাপড়ে বললেন

এই মেয়ের রাগ কমার নয়। কভু নয়। বউ করে এনেছি পর্যন্ত কোনো উলটপালট কিছু শুনলেই তার এই অবস্থা। ছোট খোকা তোর বউকে মাথাটা ঠান্ডা করতে বলবি এবার। ঘরে ছেলের বউ আসলে অনেক কিছু তার অপছন্দের হবে তখন কি হবে?

আজাদ সাহেব বললেন

মা এখন এসব বলো না তো। সালমার জ্ঞান ফিরুক। জানা যাবে কি হয়েছে।

সুজানা হাত মালিশ করার এক পর্যায়ে সাজিয়া বেগমের ফোন এল। সুজানা ফোন তুলে ঘরের বাইরে গিয়ে বলল

আম্মা ছোট আন্টি অজ্ঞান হয়ে গেছে। খুব খারাপ অবস্থা এই বাড়িতে। আমি এখন এইভাবে চলে যেতে পারিনা। আমি আসব। চিন্তা করো না।

কি হলো উনার?

জানিনা। তোমাকে পরে ফোন দিচ্ছি।

আচ্ছা জানাস।

ডাক্তার ইনজেকশন পুশ করে দু চোখের মাঝখানে সন্তর্পণে চেপে ধরার কিছুপরেই সালমা বেগমের জ্ঞান ফিরে এল। চোখের কিনারায় জল গড়িয়ে পড়লো কান বেয়ে। অভিক দ্রুত মুছে দিয়ে বলল

মা মা আমি তোমার অভি। দেখো।

সালমা বেগম ধীরেধীরে চোখ মেলে তাকালেন। শিয়রে ছেলের মুখখানা দেখলেন। অপর পাশে উনার হাতের তালু মালিশে মত্ত মেয়েটাকে দেখলেন। কিছু পূর্বের ঘটনা মনে পড়তেই বুকে ফেটে কান্না পেল। এভাবে অপমান করে কেউ কখনো কথা বলেনি উনার সাথে।

জ্ঞান ফেরায় সবাই শান্ত হলো। আনিকা অভিকের হাত ধরে বাইরে টেনে আনলো। বলল

ছোটমা ওইসময় বলছিল তোর পছন্দ নাকি খারাপ। মেয়েটা মুখে মুখে তর্ক করে। ছোটমাকে অপমান করেছে। কেন বলেছে এসব? মেয়েটা কে? আমরা কিছু জানিনা কেন অভি?

অভিক চিন্তিত বদনে তাকালো। আনিকা বলল

দেখ অভি কিছু লুকোবিনা। এসব নিয়ে পরে কথা হবে ছোটমা সুস্থ হয়ে উঠুক। তোকে দেখছি।

অভিক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ভেজা রুমাল ভিজিয়ে সালমা বেগমের কপালের ঘাম মুছে দেয়া সুজানার দিকে অপলক তাকালো। ডেকে বলল

জরুরি কথা আছে। বাইরে আসুন সুজানা।

সবাই তাকালো অভিকের দিকে।

সুজানাও ভড়কে গেল। তাকে এভাবে ডাকলো কেন?

সালমা বেগমকে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসানোর পর সুজানা অভিকের খোঁজে গেল। সে ভেবেছে অভিক তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য ডেকেছে তাই ব্যাগ নিয়ে আসলো অভিকের ঘর থেকে। নীচে চলে আসতেই মর্জিনা বলল

বাবু বাইরে আছে।

সুজানা সদর দরজা পার হতেই দেখলো অভিক উত্তরমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গম্ভীর হয়ে। সুজানা ধীরপায়ে হেঁটে পেছনে গিয়ে বলল

কেন ডেকেছিলেন?

অভিক ফিরলো। মায়ের আকস্মিক অসুস্থতা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। সুজানা কখনোই এমন না
কিন্তু এত এত প্রশ্ন তাকে স্বস্তি দিচ্ছেনা। তাই প্রশ্নটা করলো

আপু বলেছে মা জ্ঞান হারানোর আগে কিছু বলছিল।

কি বলছিল?

বলছিল যে আপনি মায়ের মুখে মুখে তর্ক করেছেন। অপমান করেছেন। আমাকে এসব বিশ্বাস করতে বলবেন না। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি কিন্তু,

সুজানার দুচোখ জলে টলমল হয়ে এল। আবছা আঁধারে গড়িয়ে পড়লো বৈকি।

এই মানুষটাই তাকে চিরকুটে লিখেছিল আমি আপনাকে বিশ্বাস করি সুজানা?

সুজানা দুপা পিছু হেঁটে নিজেকে সামলালো। অভিক দু পা এগিয়ে গিয়ে বলল

সুজানা আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি,

সুজানা শুনতে চাইলো না আর কিছু। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। যে চোখে সে তার জন্য মায়া দেখেছে সেই চোখে সে অবিশ্বাস কি করে সহ্য করবে? বিশ্বাস শব্দটা এতটা ঠুনকো?

চলবে….