আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব-৫১+৫২

0
533

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫১
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

অভিক চট করে কোলে তুলে নিতেই সুজানা কেঁপে উঠলো তরতরিয়ে। বিস্মিত নয়নে তাকাতেই অভিক ঠোঁট উল্টে বলল

শাড়িটার ভার বেশি। মানুষটার নয়।

সবাই হাসলো একসাথে।

আহ বউয়ের প্রশংসা!

সুজানা তখনও তারদিকে অপলক তাকানো।

অভিক নিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে ডাকল..

সু–জা–না!

সুজানা কোনো কথাই বলতে পারলো না। যাকে সে দূর থেকে দেখে অভ্যস্ত, দূর থেকে অনুভবে অভ্যস্ত। তার ছোঁয়ায় আর কাছ থেকে দেখায় সে অপ্রস্তুত ।

অভিক তার অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। বলল..

এটাই আমি। আপনার মাস্টারমশাই।

সুজানা বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলো।

গাঁদা আর গোলাপের পাঁপড়ি অভিকের মাথা বেয়ে টুপটাপ পড়লো সুজানার মুখের উপর। এত মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ আর মিষ্টি অনুভূতি সাথে একটা মিষ্টি মানুষ।

___

ঘরের পথটা ফুলেল পরিশোভিত। ফুলের গন্ধে সুজানার নাক পুরোপুরি বন্ধ। তার নাকের মতো চোখজোড়াও বন্ধ। বউ বরের পেছন পেছন সবাই লাইন ধরে আসছে। বাচ্চাগুলোও তাদের পিছু নিয়েছে।

ঘরের পথটাতে পা দিতেই আনিকা বলল

এখানে নামা।

অভিক বলল

কেন?

বাপরে বাপ। সারাক্ষণ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি? সুজানা হেঁটে ঘরে যাবে এবার।

ফাইন।

সুজানাকে নামিয়ে দিল অভিক। সুজানা এতক্ষণ পর চোখ খুললো। এবার নাক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে। এত অস্বস্তি, জড়তা কেন? তাও এই মানুষের ছোঁয়ায়। ভাবতে তো প্রশান্তি লাগতো। যদি বুঝতে পারে কি ভাববে?

পায়ের তলায় ফুলের পাঁপড়ি টের পেল সে। জুতো জোড়া সোফায় বসার সময় খুলে রেখেছিল সে। এত উঁচু জুতো পড়ার অভ্যাস নেই তার। সে মেঝেতে চোখ রাখতেই দেখলো ফুল দিয়ে সাজানো পথটার অভিকের ঘরের দিকেই গিয়েছে। মানুষগুলোর পাগলামি দেখে তার হাসি পেল সাথে অদ্ভুত এক আনন্দ হলো। মেঝে থেকে চোখ তুলতেই অভিকের চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসলো। অভিক মাথা দুলিয়ে বলল

যাওয়া যাক।

অনা আবিদ এসে সুজানার আঙুল ধরলো।

সুজান আমার ঘরে আসো।

সবাই একসাথে হাসলো। আনিকা এসে বলল

সুজান অভির ঘরে যাবে। আপনাদের ঘরে কি করবে?

তারা সুজানার দিকে তাকালো। সুজানা মৃদু হাসলো।

সুজান বউ?

হ্যা, অভির বউ। আপনাদের ছোট মা।

ছুটু মা?

হ্যা। এবার সুজানকে ঘরে নিয়ে যান তো।

অনা ঘাড় ঘুরিয়ে অভিককে বলল

অভি সুজানকে কুলে নাও।

আবার?

আবার কুলে নাও।

সুজানা বলে উঠলো।

না, এখন যেতে পারব।

অভিক বলল

আমি আর কোলে নিচ্ছি না।

সবাই আবার একসাথে হেসে উঠলো।

ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে সুজানা ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজাটা কত সুন্দর করে সাজানো। ঘরের ভেতরেও। আনিকা বলল

এটা আপনার ঘর। পুরোটা চেঞ্জ। ছোটমা দারুণ করে সাজিয়েছে। সুন্দর না?

সুজানা মাথা দুলালো।

খুব।

ভেতরে প্রবেশ করুন।

সুজানা পা দিল ঘরে। আজ থেকে এই ঘরটা তার! একান্তই নিজের। এই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে ভালোবাসারা লেপ্টে থাকবে। বুক শেলফের বইগুলোর ভাঁজে ভাঁজে তার হাতের স্পর্শ লেগে থাকবে , ফুল টবের ফুলগুলোতে, ঝাড়বাতি আর ঘরের পর্দাগুলো তার ছোঁয়া পাবে।

ঠান্ডা ফ্লোরে পা পড়তেই গায়ে শিহরণ জাগলো। পেছনে ফিরে অভিকের দেখা পেতে চাইলো সে। দেখে শান্ত হলো মনটা। অভিক চোখ নিভিয়ে ভরসা দিল।
সে পেছনে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখছিল নিজের মানুষকে নিজের ঘরে। হায় আজ থেকে এই ঘরেও মেয়েটা আধিপত্য বিস্তার করবে ঠিক মনের ঘরে যেমন।

আনিকা তার তার দুকাঁধ ধরে পশ্চিম দিকে ফিরিয়ে বলল

দুপুর দুটো থেকে এই ঘর সাজানোর কাজ চলছিল। দেখুন তো কেমন হয়েছে? ভাগ্যিস এরকম ভালো জা পেয়েছেন নাহলে এসব আইডিয়া কে দিত? আমার সময় তো শুধু বেডটা সাজিয়ে এরা সবাই দামে উঠে গিয়েছিল। দেখুন।

সুজানা চোখ না তুলেই বলল

ভালো হয়েছে।

আরেহ আরেহ বেডটা দেখুন।

ননদিনীরা মিটিমিটি হাসা শুরু করলো। সুজানার কান গরম হলো লজ্জায়। সে পেছনে ফিরে অভিককে দেখার চেষ্টা করলো। এবার সে নেই। কোথায় গেল?

জিনিয়া বলল,

এই দেখো বরকে খুঁজছে। আরেহ বরকে অনেক সময় পাবেন নতুন ভাবি। এবার তো দেখুন ঘরটা।

সুজানা চোখ তুললো না।

আনিকা হেসে উঠে বলল

মেয়েটার এত লজ্জা কই থেকে যে আসে। ঠিক আছে। আপনার ঘর আপনি দেখুন, আমরা আসছি কিছুপরেই। মুরব্বিরা বোধহয় দেখতে আসবে। তারপরে শাড়ি গয়না চেঞ্জ করিয়ে দেব।

বাচ্চারা সুজানার সাথে থেকে গেল। বাকিরা হাসতে হাসতে চলে গেল।

অনেকটা সময় পর সুজানা চোখ তুললো। গোলগাল খাটটা যেন মনে হলো কোনো ফুলের রাজ্য। অনা আবিদ ঝুলানো দোলনায় উঠে পড়েছে মোড়ার সাহায্যে। সুজানা তাদের দেখে হাসলো। দোলনার কাছে গিয়ে হালকা দোল দিতেই দুজনেই খিকখিক করে হেসে উঠলো।

সুজানা পুরো ঘরে গুটিগুটি পায়ে হাঁটলো। হাতের স্পর্শ দিল ঘরের দেয়ালে, বুক শেল্ফে, ফুল ছড়ানো চাদরে, আর ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়।

কানদুুটোতে ব্যাথা মনে হলো। কানের দুল খোলায় মনোযোগী হতে গিয়ে ঘরে ঢুকে ফোনে চার্জিং দেয়া মানুষটাকে দেখতে পেল না সে। তবে অনুভবে যখন বুঝতে পারলো তখন সটান হয়ে দাঁড়ালো। আয়নায় হাসিমাখা মুখটা একবার দেখা গেল তারপর হুট করে আবারও উদাও হয়ে গেল। সুজানার হৃদকম্পন তখন আকাশছোঁয়া। এমন কেন হচ্ছে?

———

মুরব্বিরা বউ দেখতে এল যারা তাড়াতাড়ি ক্লাব থেকে চলে এসেছিল। নতুন বউকে অনেক জ্ঞান দিল। সুজানা মাঝখানে বসে থেকে বিরক্ত হচ্ছিল। এতসব ডিটেইলসে বলতে হয়? সে কি খুকী যে কিছু জানেনা?

মুরব্বিরা যাওয়ার পর সালমা বেগম এসে বললেন ভারী শাড়িটা খুলে যাতে একটা নরম কাপড়ের শাড়ি পড়িয়ে দেয়। আর ভারী গয়নাগুলো খুলো যেন চেইন আর দুটো চিকন চুড়ি পড়িয়ে দেয়। সবাই মিলে তাই করলো। নতুন বউয়ের সাথে তাদের সময়গুলো দারুণ কাটলো। জুতোর কারণে সুজানার গায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে। সে কাউকে তা দেখায়নি। যন্ত্রণা হচ্ছে সেখানে।

ওর চাচা মামা খালুরা এসেছে সবাই নীচে। ক্লাবে কিছু সমস্যা হয়েছিল সেসব নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কিছু কথা কাটাকাটি লেগেছিল যা মেয়েদের কানে আসেনি। অভিক আর আহনাফ ভুল বুঝাবুঝির ইতি টেনে দিল সেখানে। নতুন আত্মীয়দের মাঝে এসব মানায় না। যেখানে তারা সবাই বাঁধা পড়েছে এক সুঁতোয়। তখন সবাইকে সবার পাশে লাগবে। ওই মুহূর্তগুলো ভুলে যাওয়ায় শ্রেয়।

তাছাড়া আনিকার মামার বাড়ি থেকে বিয়েতে কেউ আসেনি বলে তা নিয়ে একপ্রকার মাতামাতি লেগে গিয়েছিল। অভিক সেসব শুনতে মোটেও রাজী নয়। তার বন্ধুরা আছে পাশাপাশি পুরো বাড়িটা আত্মীয় স্বজনে ভরা। নতুন বউ এনে বাড়িতে এসব কথা তোলার কোনো মানে হয় না। সে কাউকে দমাতে না পেরে বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। সুজানার কানে এসব গেলে সে কষ্ট পাবে না? মনে করবে সে দায়ী সবকিছুর জন্য। সবকিছুতে তার সুজানার জন্য চিন্তা হয়। সুজানা সেনসিটিভ বিষয়ে অল্পতেই কষ্ট পেয়ে যায়। সুজানা দেখায় না কিন্তু সে খুব বুঝে সেটা। সে মেয়েটাকে ভালোবাসে তো।

_____________

সুজানার মামা খালুরা চলে গিয়েছে খাওয়াদাওয়ার পরে। সবাই বিয়ের রান্না নিয়ে এসেছিল। তারা যাওয়ার পর সুজানার মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল। মায়ের কথা ভাইয়ের কথা বেশি করে মনে পড়তে লাগলো। মনে হচ্ছে কতদিন দেখেনা তাদের!

কিছু খাবেনা বলে জেদ ধরায় সালমা বেগম ধমক দিয়ে বলেছেন, আসামাত্রই এসব শুরু করে দিয়েছ? লোকে শুনলে কি বলবে, তোমার বাপের বাড়িতে শুনলে কি বলবে? বলবে প্রথমদিনই কেউ ভাত দেয়নি। সুজানা চুপটি করে ছিল তখন। আনজুমা বেগম ভাত নিয়ে এসে খাইয়ে দিয়েছিল তারপর।
শোয়ার আগে দাদু এসে কিছু নিয়মকানুন বলে গেল। যদিও আজকালকার ছেলেমেয়েরা ওসব কানে তুলে না। কিন্তু উনি মনে করেন উনার ছোট নাতবউ ভালো মেয়ে, কথা শুনবে। সুজানা দাদুর কথা শুনে মিটিমিটি হাসলো। উনি বললেন

আরেকটা কথা উপহার না দিলে কিন্তু আমাকে বলবে। অন্যকিছু যা দেয়ার দিক উপহার কিন্তু বাধ্যতামূলক।

সুজানা হাসলো। বলল

আপনি আর কিছুক্ষণ বসুন। আমার ভালো লাগছে। বাবুরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

হ্যা ওদের মা ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আমার আর বসা যাবেনা তোমার বর আসবে। সে তো মা বাপের সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।

কেন রেগেছে কেন?

ওই তেমন কিছু না। ওসব তোমার না জানলেও চলবে।

সব ঠিকঠাক আছে দাদু?

সব ঠিক আছে। চিন্তা করো না। যেটা জেনে তোমার কোনো লাভ নেই সেটা জানার দরকার নেই। তোমার বর চলে আসবে। আজ ফিরতেই হবে। বেশী দেরী হলে ফোন দিও একটা। ঠিক আছে?

সুজানা মাথা নাড়ালো। দাদু চলে গেল।

সে ফোন দেবে কি দেবেনা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো না দেয়াটাই ঠিক হবে। উনি সহজে রাগ করেন না। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে যা সবাই লুকোচ্ছে তার কাছ থেকে।

___________

অভিক বাইরে থেকে এসে দেখলো মা আর জেম্মা সোফায় বসে রয়েছে। তারা পান সুপোরি আর মিষ্টির কাটুন গুলো ভাঁজ করে করে রাখছে। সকাল সকাল উঠে অত কাজ করার সময় নেই। এখন করে রাখলে কাজ কমলো। মর্জিনাও আছে সাথে। অভিককে দেখে বলল

ছোট বাবু আইছে ভাবি।

অভিক বলল

কি হচ্ছে এখানে?

তুই গিয়েছিলি কোথায় অভি?

মায়ের প্রশ্নে সে স্বাভাবিক উত্তর দিল।

কালকের রিসিপশনের কিছু কাজ ছিল ওগুলো সেড়ে এলাম।

যেভাবে বেরিয়ে গেলি মনে হলো রাগটাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিস। আজকে পরের মেয়ে ঘরে এনেছিস আর আজকে তোর রাগ দেখাতে হলো।

অভিক চুপ থাকলো। আনজুমা বেগম বললেন

ওসব আমাদের বড়দের কথা। সব কথায় কি রাগ করতে আছে?

আমি রাগ করেছি? আমি বলেছি টপিকগুলো জাস্ট স্টপ রাখতে। সুজানা শুনতে পেলে কি মনে করবে নিজেকে?

সালমা বেগম চোখ বড় বড় করে বললেন

আজব! সুজানা কেন শুনবে? সুজানাকে কে বলতে যাচ্ছে? আমরা কি পাগল এসব সুজানাকে বলতে যাব?

আনজুমা বেগম হাসলেন। বললেন

তোর ছেলে বউয়ের কথা চিন্তা করে রাগ দেখিয়েছে। বাপের মতো না?

তুমি আর কথা পাওনা। এই যাহ ঘরে যাহ। বিয়ে হয়েছে বলে বড় হয়ে গিয়েছিস? আর কিছুক্ষণ হলে কান ধরে নিয়ে আসতাম আমি।

অভিক মাথার চুল ঝেড়ে মৃদু হাসলো।

__________

রাত বেড়েছে তাই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজিনদের ইচ্ছে ছিল তারা অভিককে ঘরে ঢুকতে দেবেনা টাকা ছাড়া কিন্তু বাড়িতে হট্রগোল লাগায় সবাই আপাতত সেই প্ল্যানটা স্কিপ করেছে তবে কাল ঠিক উসুল করে নেবে।
অভিক ঘরে ঢুকেই দেখলো ঘরে লাইটগুলো বন্ধ শুধু গোলাপি রঙা ডিমলাইট ছাড়া। সে হাসলো। এই ঘরের সাথে মেয়েটা পূর্ব পরিচিত তাই ভূত ভয় নেই তার।

কিন্তু সে ভড়কে গেল সুজানাকে কোথাও না দেখে। বিছানায় নেই। চেয়ার টেবিল খালি। পুরো ঘর খালি। গেল কোথায়? সে লাইট জ্বালিয়ে দিল। না কোথাও নেই। আবার লাইট বন্ধ করে দিয়ে বেরুতে যাবে তখনি চোখ পড়লো দোলনায়। দোলনার নীচে দোল খাচ্ছে কয়েক গাছি চুল। যা মেঝে স্পর্শ করেছে। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে দোলনাটা তার দিকে ঘুরাতেই সেখানে ঘুমন্ত দেখলো সুজানাকে। সে কপালে হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

চিন্তামুক্ত হয়ে হাতমুখ ধুয়ে এল সে। বাহির থেকে ফিরে এটা তার রোজকার অভ্যাস। তারপর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দোলনার কাছে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটা ভারী ঘুমে তলিয়ে গেছে হয়ত।

হাঁটুভেঙে বসলো সে মেঝেতে। দু’হাতের কনুই ঠেকালো দোলনায় সুজানার মাথার দু’পাশে। গালে হাত রেখে কয়েক মূহুর্ত কেটে গেল মুখটার দিকে তাকিয়ে।
তার এত এত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, তাকে এতগুলো রাত নির্ঘুম রেখে আরামে ঘুমানো হচ্ছে? মুখটা ছোঁয়ার অদ্ভুত মনোবাসনায় হাসি পেল তার। সুজানা তো লজ্জায় মরে যাবে।

অনেকটা সময় পর সুজানার ফোনটা বেজে উঠলো। অভিক খেয়াল করলো সুজানা এলার্ম দিয়ে রেখেছে। সে এলার্ম বন্ধ করে সুজানার দিকে চোখ রাখতেই দেখলো সুজানা ড্যাবড্যাব করে চোখ উল্টে তাকিয়ে আছে। মাথার উপর এত নিকটে কার মুখ সেটা বুঝতে দেরী হয়নি তবে কখন এসব হলো, কি করে হলো তা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল হলো হৃদৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যাচ্ছে। সে পায়ের আঙুল গুটিয়ে নিল। অভিক গাল থেকে হাত সরিয়ে হাতের মুঠোয় থাকা ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে দিল তার মুখে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল সে দ্রুত। পুনরায় খুলতেই দেখতে পেল অভিক গোলাপ ফুলের ডাঁটা কামড়ে ধরে আছে ঠোঁটের চাপে দাঁতের দংশনে। সুজানা কাঁপা-কাঁপা হাত তুলে ফুলের ডাঁটাটা ধরলো। নিয়ে মিনমিন করে বলল

কাঁটা আছে।

থাকুক।

নিঃশ্বাস তার মুখের উপর পড়ায় কথাগুলো আটকে আটকে বেরুলো সুজানার।

কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

বেশি দূরে না। আপনাকে রেখে কোথায় যাব?

সুজানার চোখে লাজ নেমে এল। গাল দুটো রক্তিম।

আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে না দেখে।

এখানে খুব আরাম।

তাহলে দোল দেই?

নাহহ। এভাবে ভালো লাগছে।

অভিক নিকটে গিয়ে বলল

এভাবে?

সুজানা মৃদু হাসলো। তার দমটা বুঝি বেরিয়ে যাবে!

অভিক সন্তর্পণে ভীষণ যত্নে ঠোঁট দুটো সুজানার কপালে ছোঁয়ালো। এমন যত্নে করা প্রথম স্পর্শে সারা শরীরে অদ্ভুত কম্পন ধরলো সুজানার। পুরো দেহ শীতল হয়ে গেল তার। শক্তি নেই নূন্যতম।

অভিক কপালটা ছেড়ে বলল

এভাবে ঘুমালে হবে? আজকে কত কথা বলার আছে।

সুজানা কিছু বলল না। অভিক উঠে দাঁড়ালো। দোলনায় সুজানার পাশাপাশি গিয়ে বসলো। বললো

মা দোলনাটা বউকে ঘুমানোর জন্য দিয়েছিল। বুঝেছি এবার।

সুজানা উঠে বসার শক্তিটুকু জোগাড় করতে পারলো না। অভিক আধশোয়া হয়ে হাসলো তার সাথে। সুজানা দু’হাতে মুখ ঢাকলো।

অভিক হেসে উঠে বললো

এতে আপনাকে আরও বেশি দেখতে পাচ্ছি।

সুজানা হাত চট করে নামিয়ে নিল। বলল

কিভাবে?

অভিক হাসলো। বলল

আমি তো চোখ বন্ধ করলেই আপনাকে দেখি।

সুজানা কোথায় পালাবে, কোথায় মুখ লুকোবে বুঝে পেল না।

তার ছটফটানি দেখে অভিক বলল

আমি সরে যাই। আপনি উঠুন।

সুজানা বলে উঠলো।

নাহহ।

অভিক হাসলো। তার পিঠের নীচে হাত গলিয়ে কোলে তুলে নিয়ে বলল

ফুলগুলোর আয়োজন বৃথা যাবে আপনি ওখানে গেলে।

সুজানা আগের বারের মতো গুটিয়ে যায়নি তেমন। চোখের দিকে চেয়ে রইলো। অভিক তাকে বেডে বসিয়ে বলল

আপনার জন্য স্পেশাল কিছু সারপ্রাইজ আছে। নিয়ে আসছি। বসুন।

সুজানা নেমে গেল সাথে সাথে। শাড়িটা ভালো করে গুছিয়ে নিয়ে বলল

উপহার?

অভিক ঘাড় ফিরিয়ে বলল

হয়ত।

সুজানা আগাপাশতলা না ভেবে তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। খুব নিবিড়ভাবে। শক্ত বাঁধনে।

অভিক বাকহারা হয়ে গেল। কিছু আগেই না চটপট করছিল ছাড়া পাওয়ার আশায়। সে দু’হাত বেঁধে নিয়ে মাথাটা চেপে ধরে থুতনি ঠেকালো মাথায়। বলল

উপহার গুলো খুব দূরে নয়।

সুজানা আরও চেপে গিয়ে মিনমিন করে জবাব দিল

আপনি আমার পাওয়া শ্রেষ্ট উপহার। আমার আর কিচ্ছু চাই না।

অভিক হেসে চুলে ঠোঁট ছোঁয়ালো। বলল

ঠিক আছে। কাল।

সুজানা মাথা তুললো। অভিক তার মুখের একটা পাশ সুজানার মুখে লাগিয়ে বলল

আপনাকে দূর থেকে দেখায় শান্তি। আর কাছে থেকে, দু বাহুর মধ্যিখানে রেখে তৃপ্তি। ভালোবাসা মানে বুঝেন?

সুজানার উত্তর এল।

হুমম।

কি?

ভালোবাসা মানে আমি আর আমার আপনি।

অভিক মুখের পাশটা মুখের সাথে চেপে ধরলো আরও নিবিড়ভাবে। কিয়ৎক্ষণ পর ভিজিয়ে দিল সুজানার সিক্ত রক্তিম মুখখানা।

সুজানার অস্বস্তি, জড়তাগুলো উবে গেল আর মনে হলো ছেড়ে দিলেই বুঝি হারিয়ে যাবে।

দুজনের দুজনের দিকে তাকিয়ে নির্মল হাসলো তারপর। কপাল কপাল মিলিয়ে নেয়ার পর অভিক বলল

অনেককক গল্প বাকি।

সুজানা হেসে মুখ লুকিয়ে নিল। তার কি কভু কখনো মাস্টারমশাইয়ের মুখ থেকে গল্প শোনার ব্যাপারে আপত্তি ছিল, বিরক্তি ছিল? কভু নয়।

এই ফুলের ঘরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভালোবেসে গল্পে গল্পে কেটে গেল তাদের রাত।

আজকে তাদের গল্পগুলোতে শুধু ভালোবাসারা ছিল।

চলবে…

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৫২
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

বাইরে রোদ উঠেছে। বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙেছে সেই কাক ডাকা ভোরে। নামাজ কালাম শেষে সবাই কাজে লেগে পড়েছিল । আজকে সুজানার বাপের বাড়ির সবাই আসবে। বাড়িতে মেহমান নেহাত কম নয়।

সকাল সকাল বাড়ি পরিষ্কারের লোকজনও চলে এসেছে। গত দুদিনে বাড়িটা ফুলের পাঁপড়ি আর ধুলোবালিতে যা অবস্থা হয়ে গিয়েছে।

নতুন বউ ঘুম থেকে উঠেছে কিনা তা দেখার জন্য আনিকা বাচ্চা দুটোকে বলেছে ডেকে দিতে। তাদের বলতে দেরী ওই ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে তাদের দেরী নেই।

দুজনেই সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাধাক্কি করতে করতে ডাকলো

সুজান দজজা খুলো। অভি দজজা খুলো। তাতারি খুলো।

তাদের ডাকাডাকির চোটে অভিকের চোখ ছুটে গেল। চোখ ঢলে হাত ঝেড়ে দুচোখ খুলতেই ব্যালকণির ওপাশের মিষ্টি রোদের উপস্থিতি টের পেল সে। দুজনেই ফজরের নামাজ শেষ করে শুয়েছে। তারমধ্যে বেলা গড়িয়ে গেছে। সে ঘড়ি দেখলো। সোয়া আটটা বাজে।

দরজা অনবরত ধাক্কাধাক্কি চলছে।

অভিক উঠে বসবে তখনি টের পেল তার বুকের কাছের শার্ট হাতের মুঠোয় নিয়ে সেখানটায় মুখ গুঁজে চুপচাপ ঘুমোচ্ছে সুজানা।

সে ঘুমন্ত নারীটিকে দেখে হাসলো। এই নারী আগে তার ঘুমের রাজ্যে থাকতো আর আজ বুকের সাথে লেগে ঘুমিয়ে আছে। সে মৃদু হেসে সুজানার হাত থেকে শার্ট ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। দেখলো এভাবে সম্ভব না। এমনি ধরতে চায় না, আর ধরলে ছাড়তে চায় না।

ওদিকে বাচ্চাদের চেঁচামেচিতে অবস্থা তখন তুঙ্গে। এখন দরজা না খুললে পুরো বাড়ির লোকজন জড়ো করতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না।

অনেক্ষণ পর সুজানার নড়েচড়ে উঠলো। অভিক ডাকলো

সু-জা-না।

সুজানা হু শব্দ করলো।

অভিক হেসে বলল

আপনার স্টুডেন্টরা যা তা শুরু করে দিয়েছে। পাজি দুটোকে ঘরে আনি।

হুমম।

অভিক তাকে ব্যঙ্গ করে বলল

হুমম।

ওদিকে আবিদ চেঁচিয়ে বলল

অভি সুজানকে ঘরে বাঁধি রাখছো কেন? তাতাড়ি দজজা খুলো।

অভিক হেসে উঠলো।

কি আজব কথা! আমি সুজানকে বেঁধে রেখেছি? আমার ইজ্জৎ সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে সুজানা।

সুজানা বলল

হু।

অভিক উপায়ান্তর না দেখে নিজে পাশ ফিরে সুজানার উপর ঝুঁকে নাকে নাক মিলিয়ে বলল

ম্যাডাম।

সুজানা নড়েচড়ে উঠে নাক ঘষা দিয়ে হাত পা টানা দিয়ে বলল

উম ।

তারপর চোখ খোলার সাথে সাথে অভিককে এত কাছে দেখে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। অভিক শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে মিচকে হেসে বলল

আমি নির্দোষ।

সুজানার ঘুম ঘুম চোখে মুখে লাজুক ভাব। সে খামচে ধরা অভিকের শার্টের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল। অভিক সেখানটাই তাকিয়ে বলল

ওভাবে না ধরলেও কোথাও ছেড়ে যাব না।

সুজানা একটুখানি হেসে কথা ঘুরিয়ে নীচু স্বরে বলল

বাচ্চারা চেঁচামেচি করছে কেন?

অভিক বলল

মনোযোগ দিয়ে শুনুন।

সুজানা মনোযোগ দিতেই শুনতে পেল দুজনের গলা।

অভি সুজানকে বাঁধি রাখছ কেন? দজজা খুলো।

সুজানা খিক করে হেসে উঠলো। অভিকও হাসলো।
পিঠের নীচে হাত গলিয়ে সুজানার বাম গালের সাথে তার ডান পাশটা মিলিয়ে কানে কানে বলল

আজ আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই চাই।

তারপর মুখ তুলে সুজানার উত্তরের অপেক্ষায় রইলো কপাল কুঁচকে। দু তিন ইঞ্চির দূরত্বে থাকা মায়াবী মুখটা তখনও কিছু ভাবনায় মত্ত।

ভাবা শেষ হতেই মিষ্টি হাসলো সুজানা । বলল

আজ দেব।

সত্যি?

তিনটা।

দুজনেই একসাথে হাসলো।
নরম গালে ছোট ছোট ধারালো দাঁড়িগুলো আরও একবার আঁচড় কাটলো সাথে ঠোঁটের বলিষ্ঠ দংশনে সুজানা শাড়ির আঁচলে মুখ লুকোলো।

অভি উঠে গিয়ে দরজা খুললো।
দরজা খুলতেই দেখলো অনা আবিদ কোমড়ে হাত রেখে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনা ঘরে ঢুকেই সুজানার কাছে ছুটলো। আবিদ শুরুতেই অভিকের পায়ে কামড় দেয়ার চেষ্টা করে বলল

সুজানকে বাধি রাখছো কেন?

অভিক হো হো শব্দে হেসে উঠে দৌড় দিল। চাচা ভাইপোর ছোটাছুটি দেখে কে।

অভিক সুজানার পাশে এসে বসে বললো

সুজানা দেখুন আপনার ছাত্র আমাকে কামড় দিতে চাচ্ছে।

আবিদ বিছানায় উঠে অভিকের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার আগেই সুজানা টেনে এনে কোলে বসালো। বলল

দুষ্টুমি হচ্ছে?

অনা বলল

সুজান সুজান চা খেতে আসো। দাদু ডাকে।

অভিক বলল

নতুন বউয়ের জন্য চা নিয়ে আসুন । যান।

সুজান যাবে।

না যাবে না। সুজান তো নতুন বউ। নতুন বউ ওখানে যায় না। যান।

যাবেনা কেন? সুজান আসো। অভি তুমিও আসো।

নো ওয়ে আম্মিজান। চলুন আমরা যাই। সুজানের জন্য চা নিয়ে আসি।

সুজানা বলল

আমি যাই। না গেলে খারাপ দেখাবে না?

এখন না। জিনিদের পাঠাচ্ছি। ওরা রেডি করে দিক।

সুজানা মাথা নাড়ালো। অভিক বেরিয়েই যাচ্ছিলো দুজনকে নিয়ে। সুজানা ডেকে বলল

আমার ফোনটা দেখি বন্ধ হয়ে আছে। আপনার ফোনটা দেবেন? আম্মাকে ফোন দেব।

বালিশের উপরেই আছে।

সুজানা ওদিকে তাকালো।

খুশিমনে বলল

আনলকড?

হুমম।

সব দেখে নেব আজ।

অভিক হেসে মাথা চুলকে বলল

আমি যে জনেতে আসক্ত সে ছাড়া আর কিচ্ছু নেই ওখানে।

সুজানা মিষ্টি হাসলো।

___

অভিক নীচে এসে দেখলো নাশতার টেবিল সাজানো। তাকে দেখে সবাই চোখ তুলে তাকালো। প্রশ্ন ছুটে এল

বউ উঠেছে?

অভিক মাথা দুলালো। বলল

এদের পাঠিয়েছ? আহ অবস্থা বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। কার মতো এত পাজি হয়েছে?

সবাই হাসলো। মামী বললেন

কিন্তু তুমি বউ ছাড়া এলে কেন? ও কি নাশতা পানি খাবে না। বউ খাবে বলেই তো এত আয়োজন।

জিনি নিয়ে এসো তো।

ফুপী বলে উঠলেন

আরেহ তুই গিয়ে নিয়ে আয়। বউ সাথে নিয়ে খেতে আসবি এটা শিখিয়ে দিতে হয়? আজব ছেলে হয়েছিস তুই।

তাহলে যেতেই হচ্ছে।

__________

সুজানা চুলে তিনবার চিরুনি চালালো। তখনি ফোনটা তুললো ওপাশে কেউ একজন। সাথে সাথেই মায়ের গলা ভেসে এল

ভালো আছিস আমার সোনা? ওদিকে সবকিছু ঠিক আছে? চা নাশতা খেয়েছিস? আমি তোর ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।

সুজানার গলা বুঁজে এল। মিনমিন সুরে জানতে চাইলো

তুমি ভালো আছ আম্মা?

ওপাশ থেকে তৎক্ষনাৎ উত্তর এল না। এল তার কিয়ৎক্ষণ পর।

আছি।

মায়ের গলা কেমন যেন শোনালো। সুজানা জানে এই সামান্য দূরত্বটাও কত দূরত্ব তাদের মা মেয়ের জন্য। তার এই অল্প সময়ের শূণ্যতায় মায়ের কতখানি পুড়ছে।
সে বুঁজে আসা গলায় জানতে চাইলো।

কবে আসবে আম্মা? তাড়াতাড়ি চলে এসো।

হ্যা আসব। জামাই কোথায়?

উনি নীচে। সবাইকে নিয়ে এসো কেমন।

আচ্ছা। কিছু খাসনি এখনো?

খাব এখন। মাত্রই উঠেছি। তুমি খেয়েছ?

হ্যা খেয়েছি। আচ্ছা রাখি এখন। অনেক কাজ পড়ে আছে।

আচ্ছা।

ফোনটা কেটে গেল টুট টুট শব্দে।

ফোনটা রেখে থম মেরে বসে রইলো সে। অভিক দরজা ঠেলে ঘরে পা রাখতেই সুজানাকে ওভাবে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখে ভড়কালো।

ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে হেয়ার ড্রায়ারটা খুঁজে নিয়ে সুজানার চুলে দিতেই চুল সব উড়ে মুখের উপর জটলা পাকালো। সে দাঁড়িয়ে পড়ে অভিকের দিকে ফিরলো। অভিক তাকে আয়নার দিকে ফিরিয়ে বলল

এখন দেখি আপনাকে সাজিয়েগুছিয়ে দেয়ার দায়িত্বও আমার।

সুজানা চুল শুকিয়ে আসতেই সে নিজের চুলে শুকোলো। সুজানা এলোমেলো চুলগুলো গুছাতে গুছাতে অভিকের কান্ড দেখে হাসলো।

অভিক ড্রায়ারটা রেখে তার চুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলল

এখন শুকিয়ে গেছে। পারফেক্ট। বেঁধে দেব?

সুজানা মাথা দুলালো। অভিক খোপা বাঁধার চেষ্টা করলো। হতাশ হয়ে বলল

আমার দ্বারা হবে না মনে হচ্ছে।

সুজানা আয়নায় তাকে দেখে হাসছে।

তখন মুখ গোমড়া করে বসেছিলেন! শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন নিশ্চয়ই।

সুজানার ঠোঁট থেকে হাসি সরলো। সামনে ফিরে বলল

হ্যা।

তাই বলে মুখ গোমড়া করতে হবে ম্যাডাম? আপনাকে মুখ গোমড়া করলে একদম মানায় না। একদম আমার বউয়ের মতো লাগে না।

সুজানা দুষ্টু গলায় বলল,

আচ্ছা! কার বউয়ের মতো লাগে?

অভিক প্রশ্নটা ভালো করে বুঝার চেষ্টা করলো। তারপর চোখ বড় বড় করে তাকাতেই সুজানা হেসে উঠে তার বুকে মাথা ঠেকালো। অভিক মাথাটা টেনে নিয়ে হেসে উঠে বলল

ওহ নো। শুধু এবং শুধুই আমার বউয়ের মতো লাগে।

________________

সুজানা নীচে যেতেই সবাই তার দিকে তাকালো। সে হালকা সেজেছে। সাজগোছ করে খাওয়াদাওয়া করতে আগ্রহ লাগেনা তার। সালমা বেগম, আনজুমা বেগম এসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। দাদু ফিসফিস করে জানতে চাইলো

কি দিল?

সুজানা লজ্জিত হেসে মাথা নামিয়ে নিল।

এমা কিছুই দেয়নি? কত করে বললাম তাকে। দাঁড়াও একা পাই তাকে।

সুজানা নীচু গলায় বলল,

উনি দিতে চেয়েছিলেন আমি বারণ করেছি।

বারণ করেছ কেন?

আর কত উপহার নেব আমি? বেশি পেলে আবার হারিয়ে ফেলার ভয় হয়।

দাদু হাসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

আরেহ ওসব বর বউকে ভালোবেসে আদর করে দেয় ওই রাতে। আমার ভাইটা একদম বেকুব। যাইহোক আমার মিষ্টি নাতবৌ, মুখটা দেখলেই শান্তি লাগে আমার। চলো খেতে বসি।

সুজানা উনাকে ধরলো। বলল

আমি নিয়ে যাই আপনাকে।

সবাই একে একে চেয়ারে বসলো। জিনিয়া বলল

নতুন ভাবি ভাইয়াকে বলবেন আমাদের টাকা নিয়ে দিয়ে দিতে। কালকে ভয়ের চোটে আমরা চুপ ছিলাম। ওইতো এসেছে। বলেন।

সবাই অভিকের দিকে তাকালো। অভিক এসে চেয়ার টেনে বসলো।

কিসের টাকা? এত টাকা নিয়ে নেশা করবে নাকি?

জিনিয়া বলল

মামী দেখেছ?

সালমা বেগম বললেন

এসব কেমন কথা অভি? টাকা চায়ছে দিয়ে দিবি। ওরা পাঁচ ছয়জন। সবাইকে হিসেব করে টাকা দিয়ে দিবি। তোর বিয়েতে অনেক কাজ করেছে ওরা।

তরী সুজানাকে বলল

আপু তুমি তো কিছু বলো।

সুজানা কি বলবে বুঝে পেল না। অভিক আহনাফকে বলল

ভাই সবার জন্য ওই বুড়ো মতিন সাহেবকে ধরে আনলে হয় না? এদের শক্তি আছে। আছাড় মারলেই টাকা ঝড়বে।

আহনাফ বলল

একদম।

সিজানও সমর্থন জানালো।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

জিনিয়া বলল

ছিঃ ছিঃ ওই বুড়ো মতিনের কথা বলছ?

হ্যা। সমস্যা কি? প্রচুর টাকা আছে। একসাথে সবাইকে পেলে খুশি হয়ে যাবে ও। ও বউ পাচ্ছে আর তোমরা টাকার গাছ। ভালো না?

সবাই আরেকদফা হেসে উঠলো।

দাদু বললেন

তোমরা রাগ করোনা তো বোন। আমার ভাই মজা করছে।

ওরা সবাই রেগেমেগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। সুজানা অভিকের কথা শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। ইশশ প্রথম দিন কত বেকুব না ভেবেছিল সে এই লোকটাকে।

অভিকও তাকাতেই সুজানা লজ্জা পেল। অভিক ভুরু নাচাতেই সুজানা দু’পাশে মাথা দুলালো।

কিছু না।

আজীম সাহেব বললেন

কি আজব ব্যাপার। সবাই মজা করছে। আর নতুন বউ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এত আয়োজন তার জন্যই তো নাকি?

আনিকা তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে অভিকের পাশে বসিয়ে দিল। বলল

নতুন বউ ঠিক আছে। এই বাড়িতে তো নতুন না। এত লজ্জা পান কেন বুঝিনা।

আজাদ সাহেব বললেন

তোরা কথা বলছিস। আর ও একা দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ভাবা উচিত নতুন মানুষ আছে আমাদের সাথে। এখন পুরো মনোযোগ তার উপর হওয়া উচিত না।

আনজুমা বেগম সুজানার প্লেটে নাশতা তুলে দিতে দিতে বললেন

ও কিছু মনে করবে না। ও চেনে জানে বুঝে এই বাড়ির সবাইকে। তাই না বৌমা?

সুজানা মাথা দুলালো। সে এই বাড়ির মেলবন্ধনগুলো দূরে দাঁড়িয়ে দেখতো তখন। এখন কাছে বসে দেখছে । এখন সেও তাদের একজন। এই মানুষগুলোর আপন হতে না পারলে অনেক বড় একটা অপূর্ণতা থেকে যেত তার জীবনে। আর পাশে বসা মানুষটাকে পেত না কথাটা ভাবতেও এখন দম বন্ধ বন্ধ লাগে। সব শান্তি যেন তার কাছে। সে আশেপাশে থাকলেই আনন্দগুলো ঘিরে ধরে রাখে তাকে।

এত হাসিখুশীর মাঝে মা ভাইকে মনে পড়লো তার। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো। মাকে এখন সব কাজ নিজের হাতে করে খেতে হবে। এক কাপ চা করে খাওয়ানোর জন্যও মেয়েকে পাবে না।

তার খাবার উঠলো না মুখে।
যাও তুুললো চোখের টলমল জলগুলো নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা। ওপাশ থেকে দ্রুত পায়ে ছুটে আসলেন আনজুমা বেগম। কন্যাস্নেহে সুজানার মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন

আহা মেয়ে খাওয়ার সময় এরকম করে কেউ ?

সুজানার ফোঁপানি দেখে সালমা বেগমও উৎসুক হয়ে তাকালেন। বাকি সবাইও নীরব হয়ে গেল।

দাদু বললেন

এমা কি হলো?

আনজুমা বেগম সুজানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন

আর কি হবে? মা ভাইয়ের জন্য হয়ত মন কেমন করছে। অভি তোর শ্বাশুড়িকে ফোন দে দ্রুত। বল তার মেয়ে এখানে খেতে বসতে কান্নাকাটি করছে।

অভিক বলল

অলরেডি বলে দিয়েছি সুজানার চোখের পানিতে নবকুঠিরে বন্যা নেমেছে।

সবাই তার কথায় হেসে উঠলো। আনজুমা বেগম কান টেনে দিয়ে বললেন

ওর বউ কাঁদছে। আর ও মজা নিচ্ছে। পাজি ছেলে।

কাঁদার সুযোগ দেয়া যাবে না জেম্মা। নইলে তো বন্যার পানিতে ভাসতে হবে।

সবাই তার কথায় হাসছে। আর সুজানা অনুভব করলো তার ডান পা’টা নিজের দু পায়ের দখলে নিয়ে দোল খাচ্ছে অভিক। পুরো শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠলো তার। সুজানা অদ্ভুত চোখে তাকালো। অভিক চুপচাপ খেতে খেতে মিচকে হাসলো।
সুজানার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়াটা তার জন্য দু সেকেন্ডের ব্যাপার। সে মেয়েটাকে গত এক বছর ধরে আগাগোড়া চিনে নিয়েছে। এতটা চিনেছে যতটা চিনলে মেয়েটা দুঃখ পেলে তার মন কেমন করে। এই মন কেমন করাটাকে প্রথম দিকে সে স্নেহ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিল তারপর বুঝেছিল এটা শুধু ছাত্রীর প্রতি স্নেহ নয় বরং এটা খুব ভয়ংকর মায়া। যে মায়ায় আঁটকে গিয়েছিল সে। তারপর আর কভু মনে হয়নি এই মায়ার জাল থেকে তার নিস্তার পাওয়া উচিত। সে আঁটকে থেকেছে এবং আঁটকেছে সুজানাকেও।

____

বারোটার দিকে সুজানাদের বাড়ির সবাই এল। ওর চাচীরা চাচাতো ভাইবোন, ফুপু, আর ফুপাতো ভাইবোন, খালাতো ভাইবোন। দাদুও এল। যদিও উনি তেমন হাঁটাচলা করতে পারেন না। সরিষাবাড়ি থেকে নবকুঠির বেশিদূর নয় তাই উনাকেও নিয়ে এসেছেন সাজিয়া বেগম। সুজানা তখন ওর ঘরে ছিল। পার্লারের মেয়েগুলো তখন তার চুল বাঁধছিল। মা এসেছে শুনে তার ছটফটানি বেড়ে গিয়েছিল। পরে আনিকা সাজিয়া বেগমকে ওর ঘরে নিয়ে এসেছে। মা মেয়ের এক আবেগঘন মুহূর্ত কাটলো সেখানে। মেয়ের ঘর, নতুন সংসার দেখে মন ভরে গেল মায়ের। যাক এবার মরেও যেন শান্তি। অন্তত তিনি শান্তিতে থাকবেন এই ভেবে যে, এই বাড়িতে কোনোদিন ভাতের অভাব হলেও শান্তির অভাব হবেনা। উনার মেয়েকে ভালোবেসে আগলে রাখার মানুষের অভাব হবে না।

সাজিয়া বেগমের ডাক পড়ায় উনি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পথে অভিকের সাথে দেখা মিললো। অভিক উনার সাথে দেখা করার জন্য ছুটে আসছিল। দেখা হয়ে যাওয়ায় সালাম করে বলল

মেয়েকে দেখার পর মন নিশ্চয়ই ভালো?

খুব। আমার জামাইরাজাটা ভালো আছে তো?

বন্যার পানি সেঁচে সেঁচে বেঁচে আছি।

আহারে আমি জানলে কলার ভেলা দিয়ে নৌকা বানিয়ে আনতাম। কত কষ্ট মাস্টারমশাইয়ের!

অভিক হাসলো মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে। বলল

মেয়ের কুঁড়েঘরটা দেখা হয়েছে?

দেখে নিয়েছি। সোনা ছেলের হাতে মেয়ে দিয়েছি না, তার কুঁড়েঘরটাও সোনার ঘর। সোনাই বাঁধা।

অভিক চমৎকার হাসলো। বলল

শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে আমার অদ্ভুত একটা কানেকশন আছে। এত ভাবের মিল হয় কি করে?

একদম। ওই যে বললাম আমার বাবা। করিমুল্লাহ সর্দার। আমি যেন আমার বাবাকেই দেখছি। যাকে আমি দুচোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারি। আস্থা রাখতে পারি। আমি জানি আমার পর সুজানা একদম সঠিক একজন অভিভাবক পেয়েছে। যে তাকে আগলে রাখবে।

এমন নিখাঁদ মনের মাতৃসম মানুষটার বিশ্বস্ত আর ভরসাস্থল হতে পেরে অভিকের গর্ব হলো। আনন্দ হলো।

সাজিয়া বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন।

আমার জামাই-রাজার হাজার বছর আয়ু হোক। নাতির ঘরে পুতি, আর পুতির ঘরের নাতি দেখার সৌভাগ্য হোক।

অভিক সশব্দে হেসে উঠলো। সাজিয়া বেগমও হাসলেন।

চলবে..