#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_পনেরো
-‘ ক্ষণিকের জন্য নয়। সারাজীবন যত্ন করার দায়িত্ব কেউ নিতে চাইলে নিতে পারে। বারণ করব না।’
কর্ণকুহুরে একথা পৌঁছানো মাত্রই কুহু থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বিষ্ময় নিয়ে ঘুরে তাকাল চোখের উপর হাত ফেলে শুয়ে থাকা মানুষটির দিকে। সে
আরেকদফা হতবাক হলো যখন রিদওয়ান তার দিকে তাকিয়ে পুনরায়
বলল, ‘ ক্ষণিকের জন্য নয়! সারাজীবন! সারাজীবনের দায়িত্ব! অর্থাৎ জীবনসঙ্গী হওয়ার আহ্বান। এবার সুস্পষ্টভাবে আমার জবাব চাই।’
রিদওয়ানের স্পষ্টভাবে বলা কথার মানে বুঝতে সময় লাগল না কুহুর।
সে হতভম্ব। জ্বরে কি মাথা আউলে গেছে? নাকি মাথায় আঘাত পেয়ে দু’চারটা নাট বল্টু খুলে কোথাও পড়ে গেছে? সে রিদওয়ানের দিকে এক এগিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল,
-‘আপনার বাবা মায়ের নাম মনে আছে? বলুন তো আপনার বাবার নাম কি?’
-‘গত পরশুদিনের স্কেলের বারিটার কথা মনে আছে তোমার? টেস্টটা আরেকবার মনে করিয়ে দেই?’
-‘না থাক।’
-‘উত্তর দাও।’
-‘কিসের উত্তর?’
-‘যে কথাটা বললাম সে কথার।’
-‘জ্বরের ঘোরে মানুষ ভুলভাল কত কি বকে। আপনিও বকছেন। সুস্থ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আসছি। ‘
-‘ আমি দুইদিন সময় দিলাম। ভাবো! তবে উত্তরটা পজেটিভ হওয়া চাই।’
-‘ জবাব এখনই দিচ্ছি ‘না।’ আমি এসবের মধ্যে নেই।’
-‘ঠিক আছে। আমি পরশুদিন সন্ধ্যায় দেশ ছাড়ছি। দেশ ছাড়ার আগে তোমাকে জানানো উচিত মনে হয়েছিল তাই জানালাম। এবার যেতে পারো।’
-‘চলে যাবেন? কিন্তু কেন?’
-‘সারাজীবন পড়ে থাকার জন্য আসি নি নিশ্চয়ই!’
-‘কিন্তু..। ‘
-‘যাও। আমি ঘুমাব।’
-‘না, ঘুমাবেন না। আমি খাবার নিয়ে আসছি। খেয়ে, মেডিসিন নিয়ে, তারপর ঘুমাবেন।’
-‘বাইরের লোকদের বাড়াবাড়ি একদমই পছন্দ না আমার।’
-‘আমি বাইরের লোক?’
-‘আমার কেউ তো নও।’
-‘এভাবে কথা বলছেন কেন?’ আশ্চর্য তো!’
-‘আমি এভাবেই কথা বলি। আর তুমি আমার রুমে এলে যেতে চাও না কেন? এতবার করে কেন বলা লাগে? দুটো দিন সময় দাও রুম ছেড়ে দেবো৷ তখন এখানেই থেকো।’
কুহু উত্তর দিলো না। কথার প্রেক্ষিতে কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। উপকার করলে অপকারীর উপকার স্বীকার করা ন্যায়বান লোকের কাজ। কিন্তু এই লোক তার মনের, সুখ, শান্তি আশা, ভরসা, বিশ্বাস, এমনকি ভালবাসাটুকু ডাকাতি করার পায়তারা করছে। ভাবা যায়! না বলাতে ক্ষণিকের মধ্যে রুপ বদলে ফেলল। যা ইচ্ছে করুক এভাবের ধাঁরে কাছেও নেই সে। ভাইকে সে ভীষণ ভালোবা সে। ভাইকে কষ্ট দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। রিদওয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো মানে ভাইকে কষ্ট দেওয়া। যা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
কুহুকে নিঃশব্দে চলে যেতে দেখে রিদওয়ানের মনের জেদটা যেন আজ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। জ্বর। মাথাব্যথা। এসব নিয়ে এমনিতে মেজাজে
চিড় ধরে আছে। সামান্য কথাও ভালো লাগছে না৷ তার উপরে এই মেয়ে অভদ্রের মতো কোনো জবাব না দিয়েই গেল। তবে কি অপমান করল? নাকি রিজেক্ট করল? এত বড় স্পৃহা! রাগ হচ্ছে ভীষণ রাগ হচ্ছে। মনে চাচ্ছে মেয়েটার গালে দু’থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে, ‘ এই মেয়ে এই, ভালোবাসবে কি না বলো! হয় বিয়ের আগে ভালোবাসবো নয়তো ভালোবেসে বিয়ে করো।’
এ দুটো অপশনের মধ্যে একটা চুজ করতে হবে। বাড়তি কোনো অপশন
দেওয়া যাবে না। রিদওয়ান উঠে বসল। বড্ড অশান্তি লাগছে। তখন তার ফোন বেজে উঠল। বালিশের পাশে থাকা ফোন হাতে নিয়ে দেখে রুপক কল করছে। তবে কি কুহু বলে দিলো? দিলে দিক। রুপক যদি কিছু বলে সেও সোজাসুজি ইউত্তর দেবে। গাঁইগুঁই করবে না। মেনিমুখী স্বভাব ছিল না তার। আজও নেই। এসব ভেবে কল রিসিভ করতেই রুপক ক্ষ্যাপাটে সুরে বলল,
-‘ওই শালা, আমার বোনকে কি বলেছিস তুই?’
-‘কি বলেছি?’
-‘খুন হতে না চাইলে নিজেকে শুধরে নে। নয়তো কপালে দুঃখ আছে।’
-‘খুন টা করবে কে?’
-‘আমি।’
-‘খুন করতে আসার সময় এক প্যাকেট সিগারেট আনিস। মাথা ধরেছে। দুটো টান দিলে ভালো লাগত।’
-‘এত বাড়াবাড়ি ভালো না রিদওয়ান। পৃথিবীতে লিমিট বলে একটা শব্দ আছে।’
-‘ জানি। জানি বলেই আমি লিমিট মেনে চলি। যদি লিমিট ক্রস হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাওয়ার রেশ।’
-‘জ্বর এসেছে বলিস নি কেন? মাথায় ব্যান্ডেজ কেন? কোথায় গিয়েছিলি তুই? কার সঙ্গে লাগালাগি করে এসেছিস?’
-‘আমি যার তার সঙ্গে লাগালাগি করি না তুই ভালো করেই জানিস। আর যার সঙ্গে লাগালাগি করি তাকে সুস্থ থাকা অবধি ছাড়ি না।’
-‘ঝেশে কাশ ভাই!’
-‘গতকাল ভোরে পাড়ার মোড়ের স্বপন হিরোকে আদর যত্ন করলাম। সে আমাকে মারতে লোক পাঠিয়েছিল। চিনি না, জানি না, এসেই কলার চেপে ধরে বলে আমি নাকি গাছের খাচ্ছি তলারও কুড়াচ্ছি। এটা মানবে না সে। তারপর তোর ভাষাতে একটু ‘লাগালাগি’ করলাম। ভালো লাগল।
অনেকদিন পর এজন্য ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করলাম।কিন্তু ছেলেটার এত বড় সর্বনাশ করতে চাই নি আমি। তাও হয়ে গেল। বললাম এত চাপ নিতে পারবি না, রয়ে সয়ে। সেও ছাড়ছে না আমিও থামতে পারছিলাম
তারপর এক্সিডেন্টটা হয়ে ই গেল।’
-‘এই ভাই আমি তো ‘লাগালাগি’ মানে মারামারির কথা বোঝাচ্ছি। তুই এ কোন লাগালাগির কথা বলছিস? কি করেছিস তুই? প্রেগনেন্ট কেস হয়ে যাবে না তো?’
-‘মন কে ফ্রেশ কর। নেগেটিভ ভাবা বন্ধ কর। আমি মারামারির কথায় বলছি।
একথা বলে রুপককে বিশ্রী একটা গালি দিলো। গালি শুনে রুপক রাগ করা তো দূর হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বসে পড়েছে সে।
রিদওয়ান যে কী চিজ ভাই রে ভাই যে ওকে চেনে সে খুব ভালো জানে, ভদ্রবেশী রিদওয়ান কতটা ডেঞ্জারাস। আর সেটা কথায় এবং কাজে।
তখন রিদওয়ান হেয়াল করল দরজার পর্দা একটু একটু নড়ছে। অর্থাৎ কেউ সেখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। তাদের কথা শুনছে। বিড়াল স্বভাবের মানুষ এবাসায় একপিচই আছে। তখন রুপক বলল,
-‘বুঝেছি কাহিনি। ওদের কথায় কান দিস না। বখাটে পোলাপান সব।
আমি ফিরে এর একটা ব্যবস্থা করব। মেডিসিন নে। আর শুন কুহুকে রাগাস না নয়তো কখন তোর মাথা ফাটিয়ে দেয়। একা আছিস সাবধানে থাকিস।’
-‘কুহু কিছু বলেছে তোকে?’
-‘হ্যাঁ! বেশ কিছুক্ষণ আগে অনেকগুলো কল দিয়েছিল। আমায় কলে না পেয়ে মেসেজ করেছে,, ‘ভাইয়া তোমার বন্ধু সকাল থেকে রুমের দরজা খুলে নি। ফোন করে দেখো তো মরে টরে গেছে নাকি? ডাকলেও শুনছে না। আমি বাসায় একা আছি কি করব বুঝছি না। ‘ কেবল তার মেসেজ আর কল দেখে কল ব্যাক করে শুনলাম তোর জ্বর এসেছে জানাস নি। মেডিসিনও নাকি খাস নি। খেতে বলায় ধমক দিয়েছিন।’
-‘বেশ করেছি।’
-‘এজন্যই বললাম আমার হাতে খুন হবি বেয়াদব।’
-‘ তোর বোন যেন আর আমার রুমে না আসে। বকবক করে মাথার ব্যথা বাড়িয়ে দিয়েছে। ধমক খেয়ে এখন রুমের দরজা আঁটকে বসে আছে।’
-‘হা, হা, বেশ করেছে। আচ্ছা শুন আমার রুমের ড্রয়ারে মেডিসিন বক্স আছে। খেয়ে নে। ওর কথায় কান দিস না। ছোটো মানুষ। ওর মন ফ্রেশ ভেবে বুঝে কথা বলে না।’
-‘ফিরব কখন?’
-‘আগামীকাল সকালে।’
-‘সাবধানে আসিস। রাখছি।’
-‘হুম।’
এই কথোপকথন শেষ করে তারা কল কাটল। আসলে রুপকের কথায় তাল মিলিয়ে রিদওয়ান বোঝার চেষ্টা করছিল রুপকের মেজাজ। এবং
বর্তমান পরিস্থিতি। রুপকের রাগান্বিত স্বর শুনলে বুঝত কুহু পুরো কথা বলে দিয়েছে। রুপক ফান করছে এর মানে কুহু এখনো কিছু বলে নি। শুধু তার নামে অভিযোগ জানিয়েছে। মেডিসিন না খাওয়ার অভিযোগ।
রিদওয়ান ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। ভাবছে। তখন দরজা ঠেলে কুহু প্রবেশ করল। হাতে পাস্তার প্লেট। প্লেটটা নামিয়ে রেখে অন্য হাতের মুঠো থেকে দু’টো মেডিসিন রাখল প্লেটের সামনে। তারপর বলল,
-‘খেয়ে নিন। আম্মুর ফিরতে দেরি হবে। আপাতত এটাই খান।’
রিদওয়ান কথা বলল না। নড়ল না। সরল না। নিজে খেলো না। খেতেও বলল না। সেভাবেই বসে রইল কুহু। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এবার রেগে গজগজ করে বলল,
-‘কথা কানে যাচ্ছে না? বাসায় আমরা একা। আপনার জ্বরটা আরো বেড়ে গেলে একা আমি কি করব চিন্তা করুন একবার। মেডিসিন নিন।
অসময়ে জেদ করবেন না।’
রিদওয়ান তাও নিশ্চুপ। কুহুর আর সহ্য হলো না সে সেখান থেকে চলে এলো। রান্নাঘরে গেল। নিজের জন্য পাস্তা নিয়ে রুমে এলো। রাগে দুঃখে গজগজ করতে করতে খোলো। পানি খোলো। তারপর শুয়ে পড়ল। এত তেলাতে পারবে না কাউকে। খেলে খাক। না খেলে না খাক।ভদ্রতা থেকে
যতটুকু করার দরকার করেছে। আর পারবে না৷ যথেষ্ট হয়েছে। তার জ্বর বাড়ুক। ব্যথা বাড়ুক। যা ইচ্ছে করুক। এসব বলে গজগজ করতে করতে সে ঘুমিয়ে গেল। ঘন্টা খানিক ঘুমিয়ে আচমকা ধড়ফড় করে উঠে দেখে একপ্রকার দৌড়ে বের হলো। গেস্ট রুমে গেল। খাবার সেভাবেই রয়েছে।
মেডিসিনও তাই। রিদওয়ান রুমে নেই। সে খুঁজতে খুঁঁজতে এবার কাউচ পেরিয়ে রান্নাঘরে এলো। রিদওয়ান রান্না করছে। রান্নাঘরে এসে দাঁড়াতে তার খেয়াল হয় রাইস কুকারে ভাত বসেছিল। তরকারি নেই, তাই পাস্তা বানিয়ে রিদওয়ানকে দিয়েছে যাতে সেটুকু খেয়ে মেডিসিন টা খায়। এই বান্দা তো কিছুই খায় নি। রাগ দেখাচ্ছে, রাগ। সে রান্নাঘরে এসে রাইস কুকারের ঢাকনা তুলে ভাত দেখে খুশি হলো। ভাতটা অনন্ত সে রেঁধেছে। মেয়ে হয়ে রান্না করতে পারে না এমন খোঁটা দিতে পারবে না রিদওয়ান। কিন্তু সে হয়তো জানে না চাল ধুয়ে ঠিকঠাক পানি দিয়ে রাইস কুকারে ভাত বসিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সে সুইচটাই চাপে নি। রিদওয়ান এনে সুইচ দেওয়ার পর ভাত হয়েছে। কুহু রিদওয়ান পাশে দাঁড়িয়ে দেখল কি রান্না হচ্ছে। তারপর বলল,
-‘জ্বর কমেছে?’
রিদওয়ান নিশ্চুপ! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কুহু। এই লোক মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে৷ তখন রান্নাঘরের জানালা দিয়ে হুরহুর করে বাতাস ঢুকল। ধূলো উড়ছে। ঝড় উঠেছে। আকাশ কালো মেঘ ঢাকা। বৃষ্টিও নামবে বোধহয়। কুহু তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের জানালা আঁটকে দৌড়ে গেল রুমের জানালা আঁটকাতে। দৌড়ে দৌড়ে সব রুমের জানালা আঁটকে ধপ করে সোফায় এসে বসল। তখন তার মনে হলো ছাদে কাপড় আছে। সকালের ভেজা কাপড় তার মা ছাদে দিয়ে এসেছে। এবার সে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল,
-‘রিদ ভাইয়া আমি ছাদে গেলাম। শুকনো কাপড়গুলো আনতে।’
তারপর ধপধপ শব্দ তুলে কুহু চলে গেল। রিদওয়ানও শুনল। তারপর সে চুলা অফ করে রান্নাঘরে পরিষ্কার করে রুমে গেল। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে গোসল দিলো। জ্বর গায়ে ঠান্ডা পানি শরীরে লাগতেই শরীর কেঁপে উঠল। তবুও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। এরপর গা মাথা মুছে রুমের এসে আগে দরজা আঁটকাল। নয়তো দেখা যাবে প্যান্ট পরার আগেই একজন রিদ ভাইয়া! এই রিদ ভাইয়া! করতে করতে নক না করে রুমে ঢুকে পড়বে।
এই মেয়ের আশা ভরসা নেই৷ রিদওয়ান প্যান্ট পরে আগে গায়ে টি শার্ট জড়ালো। তারপর কপালে ব্যান্ডেজ লাগাল। চুলগুলো ধীরে ধীরে মুছল। ভীষণ শরীর খারাপ করছে। মাথার মধ্যে চক্কর দিচ্ছে। দুপুরে মেডিসিন নেওয়ার পর জ্বর ছেড়েছিল দেখে রান্নার কাজ করতে পেরেছে৷ নয়তো
সম্ভব হতো না। রান্না না করলে আরেকজনকে আবার না খেয়ে থাকতে হলো। সে আবার ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। তার জন্যই রান্না করল সে।
হঠাৎ তার খেয়াল হলো কুহু ছাদে গেছে অনেকক্ষণ হলো এখনো আসে নি। মাগরিবের আজান দিয়েছে যখন গোসলে ঢুকেছিল। তারও আগে ছাদে গেছে কুহু। বাইরে এখন তুমুল বৃষ্টি। এই মেয়ে এমন ঝড় তুফানের মধ্যে কোথায় গেল? নাকি ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে কোথাও? সে আর না ভেবে শোয়া থেকে উঠে দ্রুত ছাদের দিকে গেল। সিঁড়ি বেয়ে
উঠার সময় দু’ দুবার রেলিং ধরে পড়া থেকে বাঁচল। মাথা চক্কর দিচ্ছে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দেখে কুহু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। রিদওয়ান দাঁড়িয়ে গেল। হালকা গোলাপি ড্রেস পরিহিত কুহু আকাশে পানে মুখ করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। রিদওয়ান নড়ল না। ভেজা গায়ের কুহুকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকল। সে কোথাও শুনেছিল বৃষ্টি উপভোগ করা যাযরদুইভাবে, এক, বৃষ্টিতে ভিজে আর দুই, কাউকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে। আর সে যদি হয় একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ তাহলে তো কথায় নেই। রিদওয়ান হঠাৎ তার বুকে হাত দিলো। হার্ট দ্রুত চলছে।
নিঃশ্বাসের গতি বাড়ছে। সে দ্রুত চলতে থাকা হার্টের উপর হাত রেখে বিরবির করে বলল,
-‘মন কেড়ে, মায়ায় জড়িয়ে, আমার আমিকে এভাবে না কেড়ে নিলেও পারতে। কেড়েই যখন নিলে এখন আমার না হওয়ার এত বাহানা কেন? কেনই বা এত কপটতা, পালিয়ে যাওয়ার ছলচাতুরতা।’
To be continue…………!!
#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_ষোলো
তুমুল বৃষ্টি। ভেজা ছাদ। ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক বেখেয়ালী মেয়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ। শান্ত মন। ভেজা শরীর। আর তাকে অবলীলায় দেখে যাচ্ছে বুকে উত্তাল ঝড় তোলা এক বেপরোয়া প্রেমিক পুরুষ। বুকে দুই হাত গুঁজে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে রা শব্দ নেই। নড়চড় নেই। আছে শুধু চোখ জুড়ে একরাশ মুগ্ধতা। মায়া।
হঠাৎ মেঘ গর্জন করে উঠল। বজ্রধ্বণিতে কেঁপে উঠল মাটি। থেমে গেল
কোলাহল। গাছের ডালে আশ্রয় নেওয়া এক ঝাক পাখি উড়ে গেল প্রাণ হাতে নিয়ে। বৃষ্টি বাড়ছে। বাড়ছে সময়ের গতি। কুহু ঝপ করে চোখ খুলে তাকাল। সে ছাড়া কেউ নেই। ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। সে দৌড়ে এলো দরজার দিকে তখনই জ্বলে উঠল ছাদের লাইট৷ সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে বোকা বোকা হাসল। মনে মনে প্রস্তুত হলো রাম ধমক খাওয়ার। কিন্তু তাকে অবাক করে রিদওয়ান হাতে থাকা ফোনে সময়
বলল,
-‘ মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিট হয়েছে এত তাড়াতাড়ি বৃষ্টি বিলাস শেষ? আপনি চাইলে আরো পয়তাল্লিশ মিনিট ভিজতে পারেন। আমি আছি আপনাকে পাহারা দিতে।’
রিদওয়ানের খোঁচা মারা কথা শুনে কুহু কিছু বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তবে মনে মনে তার গুষ্টি উদ্ধার করতেও কম করল না।
রিদওয়ান চেয়ে কুহুর ভেজা ঠোঁটের দিকে। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে তা গলা বেয়ে মিশে যাচ্ছে পরনের ড্রেসের সঙ্গে। সে ঢোক গিলল। নিজেকে সামলানো প্রায়স চালালো। বাতাস বইছে। বাতাসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে কুহুর ভেজা শরীর। কুহু আচমকা এগিয়ে এলো। দাঁড়াল মুখোমুখি। রিদওয়ান তাকে এগোতে দেখে অবাক হলেও নড়লো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল তার পথ আঁটকে। কুহু যাবে রিদওয়ান সাইড দিচ্ছে না। ইচ্ছে করেই করছে
তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। কুহু আড়চোখে রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে ওর মতি গতি বোঝার চেষ্টা করল। তারপর অপরাধীর সুরে বলল,
-‘সাইড দিন। আমি যাব।’
-‘যাও নিষেধ করেছে কে?’
-‘না সরলে যাব কিভাবে?’
-‘কেন ধাক্কা মেরে সরিয়ে চলে যাও।’
-‘ধাক্কা মারব?’
-‘হুম। ক্ষণে ক্ষণে কম ধাক্কা তো দিচ্ছো না।’
-‘আমি আবার ধাক্কা দিলাম কখন? কিসব ভুলভাল বকছেন আপনি?’
-‘ভুলভাল কাজ করতে পারবে আর আমি বললেই দোষ?’
-‘আমি আবার কি করলাম?’
-‘কি করতে বাকি রেখেছ?’
-‘রিদ ভাইয়া আপনি দ্রুত ডাক্তার দেখান। আপনার অবস্থা সুবিধার ঠেঁকছে না।’
-‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। এবার বাসায় চলুন। বাকি কথা বাসায় গিয়ে বলি?’
-‘হুম! হুম! শীত লাগছে আমার। তাড়াতাড়ি চলুন।’
একথা শুনে রিদওয়ান সাইড দিলো না নিজেই সামনে হাঁটতে লাগল। আর কুহু একগাদা ভেজা কাপড় নিয়ে তার পেছন পেছন আসল। তারা দু’জন বাসায় ঢুকল। রিদওয়ান দরজা আঁটকে দিলো। কুহু ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে রুমে চলে গেল। গোসল করল। পরনে আকাশি রঙা লেডিস টিশার্ট আর আকাশি ও সাদা সংমিশ্রনে লং স্কার্ট। বাসায় লং স্কার্ট বেশি পরে সে। তারপর ভেজাচুল ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিয়ে বের এলো। তার ক্ষুধা লেগেছে। গোসলের পর ক্ষুধাটা মাথা চাড়া উঠেছে। এখন না খেলে হাত পা কাঁপতে শুরু করবে। সে গুনগুন করতে করতে খেতে গিয়ে বেশ খুশি হলো। রিদওয়ান খাবার বেড়ে বসে আছে। তা দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-‘আমাদের ভাবি খুব লাকি।’
-‘কোন ভাবি?’
-‘আপনার বউ আর আমার ভাবি!’
-‘লাকি? কেমন লাকি?’
-‘এই যে ভদ্র মানুষের মতো খাবার বেড়ে টেড়ে বসে আছেন। এমন কাজ কি সব স্বামীরা করে? করে না।’
-‘ওহ। আমি তো তোমার জন্য করলাম তাহলে কি আমার তোমার স্বামী। স্বামী রুপে মানছো আমাকে?’
-‘ না, না, আমি তা বলি নি।’
-‘কি বললে শুনলামই তো।’
কুহু জবাব না পেয়ে মুখ লটকে বসে রইল। কি বোঝাতে চাইল আর কি বুঝে বসে রইল এই লোক। মাথা মোটা। কুহুর শরীর থেকে সদ্য গোসল করা আসায় সাবান শ্যাম্পুর সুগন্ধ ভেসে আসছে। নাকে বারি খাচ্ছে তা।
সঙ্গে রিদওয়ানের মতো যুবকের সর্বাঙ্গেও একটু একটু নিষিদ্ধ অনুভূতি এসে জড়ো হচ্ছে। মন দুলছে দোলা চালে। বিবেক আর মস্তিষ্কের মাঝে
চলছে নীরব দ্বন্দ। একজন সাবধানী সুরে বলছে রিদওয়ান তোমার ভুল সিদ্ধান্ত তোমাকে চরম ভোগাবে। সে তোমার বন্ধুর বোন। বন্ধুর বিশ্বাস ভেঙ্গো না। সাবধান হও। নিজেকে সামলাও।আর আরেকজন বিশ্রীভাবে
উস্কে দিচ্ছে, যাকে ভালোবাসো তাকে জানাতে বাঁধা নেই। তাকে ছুঁয়ে দাও। স্পর্শ দিয়ে বোঝাও তুমি তাকে পছন্দ করো। মেয়ে মানুষকে কাবু করতে পুরুষের জোরালো স্পর্শই যথেষ্ট। বাইরে বৃষ্টি। ফাঁকা বাসা। এই সুযোগ মনের কথা খুলে বলার।
রিদওয়ান চুপ করে আছে। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। কিসব ভাবছে।
কুহু আর বসে না থেকে ভাত বেড়ে খেতে লাগল। পাবদা মাছের ঝোল নিয়ে একটু একটু করে খেতে লাগল। রান্নাটা এত মজা৷ হয়েছে। ভীষণ
ক্ষুধা লাগায় ভদ্রতা দেখাতে পারল না। ঝটপট খেতে লাগল। যেন কত দিনের অভুক্ত সে। এমনিতে সে মাছ খায় না। কিন্তু পেটে ক্ষুধা থাকায় সব অমৃত মনে হচ্ছে। তাকে এভাবে খেতে দেখে রিদওয়ান মৃদু হাসল।
সে রান্না না করলে কি হতো? এমনিতেই এই মেয়ের মাথা গরম খেতে না পেয়ে কী করতো। সেও এবার খাওয়া শুরু করল। ঝাল করে আলু ভর্তা দিয়ে মুখে ভাত দিলো। তেঁতো হয়ে আছে পুরো মুখ। জ্বরটা বাড়ছে তা অনুভব করছে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। একজন তৃপ্তি করে খাচ্ছে আর আরেকজন হাত উড়িয়ে বসে আছে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে। তবে গতি কিছুটা কমে এসেছে। আজ বৃষ্টি থামবে কি না কে জানে। তখন কুহু মুখ খুলল,
-‘রান্নাটা খুব মজা হয়েছে?’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘আপনি কি এখনো রেগে আছেন?’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘রিদ ভাইয়া!’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘আপনি অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলতাম। বলি?’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘ আপনি নিশ্চুপ থাকলে কিভাবে বলব?’
-‘(নিশ্চুপ)’
-‘তখন ‘না’ বলাতে কি আপনি রেগে আছেন? ভাবছেন আপনাকে রিজেক্ট করেছি? আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি মানে, আমি কিছু কারণে না করছি। ভেবে দেখলাম যে..!’
আবারও সেই কথা উঠানোয় রিদওয়ানের রাগটা তরতর করে বাড়ল।
চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল কুহুর দিকে। মুখে উপর না বলে এখন সাফার গাওয়া হচ্ছে। কে শুনতে চেয়েছে তার সস্তা সাফায়? রিদওয়ান এবার বেশ হেয়ালি সুরে জবাব দিলো,
-‘তুমি ভাবো? ভাবতে পারো? ভাবনা বলে কিছু তোমার মধ্যে আছে? তা কি ভাবলে? বলো শুনি। আমিও দেখি তোমার ভাবনা দৌড় কতদূর।’
-‘এভাবে কথা বলছেন কেন?’
-‘আমি এভাবেই কথা বলি। না পোষালে বলিও না আমার সঙ্গে কথা।’
-‘না মানে..! ‘
-‘মানে, আসলে, বাদে কথা থাকলে বলো নয়তো উঠলাম আমি।’
-‘আমার উপর রাগ করে সত্যিই চলে যাবেন আপনি?’
-‘এর কৌফিয়ত তোমাকে দিতে বাধ্য নই।’
-‘আপনি আমার স্যার। ভাইয়ার বন্ধু। আমি কিভাবে…!’
-‘তারপর?’
-‘রাগ না করে আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি আপনার যোগ্য না। তাছাড়া আমি ভাইয়াকে কষ্ট দিতে পারব না।’
-‘এই তোমার ভাবনা?’
-‘হুম। এজন্যই আমি না করছি। এছাড়া কিছু না। ঝড় আসবে জেনে যদি সাবধান না হই তাহলে নিঃশেষ হতে সময় লাগবে না।’
একথা শুনে রিদওয়ান রেগে চট করে দাঁড়িয়ে কুহুর হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। কুহুর হাত পিছ মোড়া করে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘তোমাকে নিঃশেষ এমনিও হতে হবে। আমি করব নিঃশ্বাস। আমার সব শান্তিটুকু কেড়ে নিয়ে এখন মিঠা মিঠা সাফায় গাওয়া হচ্ছে? কি ভেবেছ এসব শুনে মেনে নেবো? তোমার ভাইকে আমি ভয় পাই? ওর ভয়ে মুখ লুকিয়ে পালাব আমি? আমাকে কাপুরষ মনে হয়?’
-‘লাগছে আমার। হাত টা ছাড়ুন। ভালো না বাসলে জোর করে বাসাবেন নাকি? জোর করে ভালোবাসা হয়?’
-‘ধরে নাও তাই। ‘
-‘আপনি পাগল হয়েছে গেছেন। জ্বর আপনার মাথা আউলে দিয়েছে। যান রুমে গিয়ে ঘুম দিন। নয়তো আমি ভাইয়াকে বলে দেবো আপনি কিসব বলছেন।’
একথা শুনে রিদওয়ান তাকে ছেড়ে দিলো। হাত ধুয়ে হনহন করে রুমে চলে গেল। কুহুও রেগে সব ঠিকঠাক করে রুমে চলে গেল। রিদওয়ানের হাবভাব ভালো লাগছে না তার কাছে। এখন রুমে ঢুকে আর বেরই হবে না সে। যতই হোক সে ভাইয়ের বন্ধু। ভাই নয়। তাছাড়া নিজের সেফটি নিজের কাছে। রিদওয়ান যা পাগলামি শুরু করেছে তাকে সায় দেওয়ার মানে হয় না। বরং সায় দিলে এর বিপরীত কিছু ঘটতে পারে। মনে মনে এসব ভেবে সে রুমের দরজা আঁটকে হাত মুখ ধুয়ে চুলে বিনুনি গাঁথলো।
তারপর ড্রিম লাইট অন করে পেছনে ঘুরতেই ধাক্কা খেলো কারো বুকের
সঙ্গে। সে ভয়ে চিৎকার করার আগে তাকে চেপে ধরা হলো দেওয়ালের সাথে। চেপে ধরা হলো মুখ। দুরত্ব কমাতে সে এগিয়ে এলো আরেক পা। তখনই পুরুষালি শক্ত বুকে ঠেঁকল তার বক্ষভিজাজন। চমকে উঠল সে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল রিদওয়ানের দিকে। চোখে চোখ। ঠোঁট ছুঁইছুঁই অবস্থা। তার দৃষ্টি অদ্ভুত। সে ছটফট করে উঠল। শক্তি খাঁটিয়েও লাভ হলো না। তখন রিদওয়ান দুই হাতে মুখটা উঁচু করে ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুল
বুলাতে বুলাতে বলল,
-‘খারাপ যখন হতেই হবে কিছু না করে খারাপ হবো কেন? বরং খারাপ কিছু ঘটিয়ে খারাপ হই। এতে নিজের কাছে লয়্যাল থাকতে পারব।’
To be continue…….!!