আমার একলা আকাশ তোমায় জুড়ে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0
483

#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#অন্তিম_পর্ব

রাতে তীব্র যন্ত্রণা উঠলো অর্জুনের। ব্যাথায় নীল হয়ে উঠলো সে। নার্সরা ছোটাছুটি শুরু করলো। সিপিআর দেওয়া হলো লাগাতর। ডাক্তার চলে আসলো। তখন ই একজন ডাক্তার বলে উঠলো,
“ওটি রেডি করো। ডোনার পাওয়া গেছে। এখন ই অপারেশন হবে। তোমরা রক্ত জোগাড় করো”
“কে ডোনার স্যার?”

নার্সের কথায় ডাক্তার বললো,
“পোস্ট অপারেটিভ রুমের এক্সিডেন্ট কেস। তার সাথে উনার সব কিছু ম্যাচ করেছে। তার ফ্যামিলিও এগ্রি করেছে। তাই সময় নষ্ট করবেন না। আমাদের হাতে একেবারেই সময় নেই। উনাকে ইঞ্জেকশন দিন”

নার্স সময় নষ্ট করলো না। অর্জুনকে নেওয়া হলো অপারেশন থিয়েটরে। শুরু হলো জীবন মরনের যুদ্ধ। কি অদ্ভুত, একটি প্রাণ পৃথিবীর মোহ ছাড়লো তো অন্য একটি প্রাণ সেই মোহে জড়াতে আকুল হয়ে উঠলো______

****

ফিনাইলের তীক্ষ্ণ গন্ধে কপাল কুচকে আছে অর্জুনের। গন্ধটি অতীব অপছন্দ। কিন্তু সহ্য করতে হচ্ছে। বিগত দুমাস ধরেই এই বিরক্তিকর গন্ধটি সহ্য করতে হচ্ছে। কিছুই করার নেই, বাধ্য সে। সাদা বিছানাটা আর ভালো লাগে না। অবশ্য বড় একটি জানালা আছে কিন্তু তা দিয়ে শুধু যানের কোলাহল ই দেখতে পায় সে। এতোদিন এই হাসপাতালের কেবিন টি ছিলো অর্জুনদের বাসস্থল। কাকলী দেবী ব্যাগ প্যাটরা নিয়ে এখানেই ছিলেন। তবে আজ মুক্তি। আজকে অর্জুনের ডিসচার্জ। এতে সব চেয়ে বেশি আনন্দিত অর্জুন। হাতে থাকা চিঠিখানা টেবিলের উপর রেখে মায়ের আনা ইস্ত্রী করা পাঞ্জাবী টা গায়ে তুললো সে৷ অনেক কাজ বাকি, বাড়ি ফিরতে হবে। এই পাঁচ মাস সে সবার থেকে আলাদা। হিমুলেনের মোড়ের দোকানে আর আড্ডাগৃহে কি ধোঁয়ার কুন্ডলি উড়ছে কে জানে। আচ্ছা, রবিন ভাই কেমন আছে? তানি আপুর সাথে কি তার বিয়ে হলো? দেবের কি হাল? কৃষ্ণা কি সব মানিয়ে নিচ্ছে? সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকে ভুলে গেলে তো হবে না। অন্নপূর্ণা, তার হেমনলিনী। কি করছে এখন সে? মেয়েটিকে ভরসা নেই, না জানি হিমুলেনে আবার কি রটনা রটিয়েছে। আর রবিন ভাই সেই তালে নাচছে। ভাবতেই হেসে উঠলো অর্জুন। আনমনে আওড়ালো,
❝শ্যামলাবতী!
তুই লুকিয়েছিলি হৃদ গহীনে,
সুপ্ত সে ভুবনে।
অনুভবে পাই খুঁজে তোকে,
বুকের বা পাশে।
পরশ জাগানো প্রেমের সখী, প্রেম তুই আমার,
বোকারানী, অল্পতেই মুখভার।
আসর সাজে হৃদতলে,
ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে
দেরি কেন তবে?
আয় শূণ্য প্রাচীরে।
তৃষ্ণা মেটাই, গোলাপ ডালায়,
তুই শিউলি ফুলের শুভ্রতা।
শুভ্র তোর প্রেমানুভূতি,
তোকে যে বড্ড ভালোবাসি❞ (জান্নাতুল মিতু)

কাকলী দেবী এবং দীপংকর বাবু বাহিরে অপেক্ষা করছেন। অর্জুনের প্রতিটি রিপোর্ট ভালো। সে এখন হাটাচলাও করতে পারছে। ডা. মুহাইমিন অর্জুনকে শেষ চেকাপ করতে কড়া নাড়লো দরজায়। তার সাথে নার্সরাও রয়েছে। অর্জুন তাদের দেখে ঠোঁট প্রসারিত করলো। ডাক্তার তাকে চেকাপ শেষে বললো,
“যাবার খুব তাড়া নাকি অর্জুনবাবু?”
“আর যে তর সইছে না। বাড়ি যাবো”
“বাড়ি যাবার এতো তাড়া?”
“কেউ যে প্রতীক্ষায় আছে”
“প্রেমিকা?”
“উহু, সে আমার প্রেমিকা নয়। আমার একলা আকাশের এক ফালি চাঁদ”

ডাক্তার কি বুঝলো জানা নেই তবে তার ঠোঁটখানা প্রশস্থ হলো।

*******

হিমুলেনের মুখে থামলো গাড়ি। এখানে রাস্তা খুড়ে বাজে হাল। গাড়ি ভেতরে যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে নামতে হলো তাদের। অর্জুন তার কাধের ব্যাগটা নিতে গেলে দীপংকর বাবু বাধা দিলেন। তখন ই দেখা মিললো রবিন ভাইয়ের। বাজার করে বাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি। অর্জুনকে দেখতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। হাসিখানায় মিশে ছিলো হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর ফিরে আসার আনন্দ। অর্জুন তাকে শুধালো,
“কি অবস্থা রবিন ভাই?”
“তুমি কেমন আছো অর্জুন ভায়া। কত মাস পর ফিরলে। শুকিয়ে গেছো যে”
“সে অনেক কথা রবিন ভাই। তোমার কি হাল? এতো বাজার?”
“তানির আবদার গো। মানুষটা যে একা নই”
“বিয়ে করলে?”
“করলাম আর কি”
“জানতেও পারলাম না। কি অদ্ভুত?”
“অত ধুমধাম হয় নি। পাড়াতত ভাইরা ছিলো। তোমাকে যে জানাবো সুযোগ হলো না”
“এবার তো এলাম, তানি আপুর হাতে না হয় কষা মাংস আর পরোটা খাবো। তুমি বরং বাড়ি যাও। আমার একটা কাজ বাকি সেটা শেষ করে মোড়ে আসবো বিকেলে”
“কোথায় যাবে?”
“দেবদাসের পারোর কাছে। এবার আর শি’র কাটা যাবে না”

কথাটা শুনতেই মিয়ে গেলো রবিন ভাই এর মুখ। অর্জুনের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখে কিছু বলার সাহস হলো না। শুধু গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।

******

সদরে কড়া পড়তেই দরজা খুললেন রীতাদেবী। দরজা খুলতেই চমকে উঠলেন, হাসি মুখে বললেন,
“অর্জুন তুমি এসেছো? দিদিরাও এসেছে কি?”
“হ্যা আসছে কাকীমা। কেমন আছেন?”
“ভালো, ভেতরে এসো”

রীতাদেবী ম্লান স্বরে বললো কথাটা। অর্জুন ভেতরে ঢুকতেই কৃষ্ণার সাথে দেখা হলো। মেয়েটি শুকিয়ে গেছে। অর্জুনকে দেখেই বললো,
“অর্জুনদা তুমি ফিরে এসেছো?”
“ফিরতে যে হতোই কৃষ্ণা। দেব কোথায়?”
“ও ঘরে। ডাকছি”
“আর তোমার ননদিনী?”

ননদিনীর কথাখানা শুনতেই থমকে গেলো কৃষ্ণা। পেছনে ফিরে তাকালো অর্জুনের দিকে। ম্লান স্বরে বললো,
“ননদিনী নেই অর্জুনদা”
“কোথায় গেছে?”

কৃষ্ণার কথা অবাক কন্ঠে শুধালো অর্জুন। রীতাদেবী আঁচল মুখে গুজে অশ্রু ছেড়ে দিলেন। অর্জুনের উত্তেজনা বাড়লো। কৃষ্ণা তখন বললো,
“সে যে আর নেই”
“নেই মানে?”

অর্জুনের কন্ঠ কঠিন হলো। ততসময়ে দেব এলো বসার ঘরে। বন্ধুকে দেখে তার আনন্দ হলো। কিন্তু তার মুখশ্রীতে ভেসে উঠলো বিষাদের ছাপ। কৃষ্ণা ম্লান স্বরে বলল,
“আমাদের অভিমানিনী অভিমান করে চলে গেছে। না ফেরার দেশে। সে বেঁচে নেই অর্জুনদা”

কথাখানা শুনতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অর্জুন। তার মনে হলো কেউ তার কানে গরম লোহার শিক ঢু’কিয়ে দিয়েছে। দূর্বল হৃদয়খানা কেঁপে উঠলো। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে গেলো মূহুর্তেই। চোখ থেকে অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। বিড়বিড়িয়ে বললো,
“মিথ্যে বলছো?”
“এই বিষয়টা নিশ্চয় রসিকতার নয়”

দেবব্রতের কথা শুনে কাতর দৃষ্টিতে তাকালো অর্জুন। বিষাদময় কন্ঠে বললো,
“কিভাবে হলো?”
“ঢাকায় গিয়েছিলাম। তার একজন প্রিয় মানুষকে দেখতে। ভেবেছিলাম বোনটার হাওয়া বদল ও হবে। কিন্তু সব কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। যাকে খুজতে গেলাম তাকে পেলাম না। তাদের ঠিকানায় তালা দেওয়া ছিলো। ফোন ও বন্ধ। যোগাযোগের উপায় নেই। সারাদিন যাযাবরের মতো ঘুরলো মেয়েটি। যখন আশাহত হলো তখন আমাকে বললো, “দাদা ফিরে চলো। দম বন্ধ লাগছে”। ফেরার ব্যাবস্থাটিও হলো। তাকে বসিয়ে রাস্তা পার হয়ে টিকেট কাটতে গেলাম আমি। টিকিট কাটতে কাটতে শুনলাম লোকের চিৎকার। একটা লোকাল বাস নাকি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কাউকে পি’ষে ফেলেছে। কৌতহল বশত পিছনে ফিরতেই দেখলাম আমার বোনের র’ক্তস্নাত দেহ পিচের রাস্তায় পড়ে আছে। বুড়িকে ডাকলাম। বহুবার ডাকলাম। সাড়া দিলো ঠিক ই। কিন্তু তা ক্ষণিকের। আমার বোনের অসাড় দেহ আমার হাতের উপর পড়েছিলো জানিস। পাগলের মতো কাঁদছিলাম আমি। মাথা কাজ করছিলো না। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে গেলো ওকে হাসপাতালে। সবাই বলছিলো ও নাকি রাস্তায় কাউকে দেখে ছুটছিলো। গাড়ি যে কাছে এসে পড়েছে সে জানেও না। কি পাগল মেয়ে! ডাক্তাররা অপারেশন থিয়েটারে ঢুকালো কিন্তু লাভ হলো না রে। বুড়িটা এতোই অস্থির যে সবাইকে ফাকি দিয়ে পালিয়ে গেলো”

অর্জুনের চোখ ভিজে আসছে। কেনো যেনো সব কিছু মিথ্যে লাগছে। বুকে ব্যাথা করছে। চিনচিনে বিশ্রী ব্যাথা। তার হেমনলিনী নেই। নেই সে। আর কখনো তার শানিত বাক্যযুদ্ধে কুপোকাত হবে না অর্জুন, আর কখনো তাকে ফুল চুরি করতে দেখবে না অর্জুন। আর কখনো অযাচিত ভাবে অর্জুনের জিনিসে হাত দিবে না সে। আর কখনো বিরক্ত করবে না সে। অর্জুন উঠে দাঁড়ালো। টলমলে পায়ে বেরিয়ে গেলো সে। ভেতরটা যে পুড়ছে। সহ্য হচ্ছে না কিছুই। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে। তখন পিছন থেকে দেবের কন্ঠ এলো। অর্জুনের মুখোমুখি হয়ে একটা খাম এগিয়ে দিলো। শক্ত মুখে বললো,
“আমার বোনের প্রিয়জনকে লেখা শেষ চিঠি। নিবি না?”

অর্জুন চুপ করে রইলো। তখন দেব বললো,
“আমি ভেবেছিলাম তুই জানিস অন্নার কথা। কে তোকে হৃদয় দিলো এটা তো জানবার কথা ছিলো তাই না?”

কথাশুনতে আরোও একবার থমকে গেলো অর্জুন। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো দেবের দিকে। দেব তখন বললো,
“কাকাবাবু জানায় নি তবে!”
“মানে?”
“ভাগ্যের ফের দেখ অন্না তোকে ভ্রম ভেবে রাস্তায় ছুটে মৃত্যুর সাথে লড়তে বসলো। সেই তুই কিনা ওই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলি যেখানে তাকে ভর্তি করানো হলো। যখন অন্নাকে মৃত ঘোষনা করা হলো তখন ডাক্তার এলেন আমার কাছে, অন্নার হৃদয় নাকি একজনের সাথে মিলে গেছে। তাকে ডোনেট না করলে তার বাঁচার সম্ভাবনাও নেই। অবাক হলাম যখন জানতে পারলাম সে তুই। আরোও অবাক হলাম যখন কাকাবাবু আমার হাতে পায়ে ধরলেন। বললেন, তার ছেলের প্রাণ ভিক্ষা দিতে। প্রথমে তোর উপর আমার প্রচন্ড রাগ ছিলো। কারণ আমার বোন আর তোর কারণেই নেই। কিন্তু যখন তোকে ব্যাথায় কাতরাতে দেখেছি তখন আর রাগ রাখতে পারলাম না। বোনটা তো নেই, বন্ধুটা থাক। তাই রাজী হলাম। আমার বোন আমার থেকে প্রতীজ্ঞা নিয়েছিলো সে যা চাইবে আমি দিবো। রাস্তায় কাতরাতে কাতরাতে সে আমাকে কি বলেছিলো জানিস? অস্পষ্টস্বরে বলেছিলো, “অর্জুনদার কাছে যাব”। তাই আমার বোনের হৃদয় তোকে দান করলাম। জীবিত অন্নাকে তো ভালো লাগতো না তোর, এখন তার পিছু ছাড়াবি কি করে অর্জুন?”

দেবব্রতের কথাগুলো বিষাক্ত ছু’রির আঘাতের মতো লাগছে। ভেতরটা যেন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। নিঃস্ব লাগছে নিজেকে। সত্যি যে পাষন্ড! তাই তো হেমনলিনী তাকে ছেড়ে চলে গেলো। বিনিময়ে তাকে দিয়ে গেলো একরাশ অশ্রু, আফসোস, বিষাদ, শুন্যতা

******
অর্জুনের পা চলতে চাইছে না। পা জোড়া ক্লান্ত তার। তার চেয়েও ক্লান্ত হৃদয়টা। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। যে তৃষ্ণা মিটাতে ফিরে আসা সেই তৃষ্ণাটি ই মিটলো না। সে নেই, অভিমানিনী চলে গেছে। রেখে গেছে কিছু স্মৃতি, যে স্মৃতিতে শুধু তার বিচরণ। অর্জুনের হাতে অন্নার শেষ চিঠিটি। চিঠিটিতে আরোও একবার আবেগের সম্মুখীন হলো অভিমানী কিশোরীর,

“নিষ্ঠুর অর্জুনদা,
হ্যা, তুমি নিষ্ঠুর। প্রচন্ড পাষন্ড। বিশ্রী মানুষ তুমি। আমার কোমল হৃদয়টাকে নিজ হাতে তুমি হ’ত্যা করেছো। আমি আজ নিঃস্ব হয়েছি তোমার জন্য। রমেশরা মোটেই ভালো নয়। তারা শুধু হেমনলিনীদের হৃদয়কে ভাঙ্গতেই পারে। তবুও কেনো হেমনলিনী তার জন্য অপেক্ষা করবে বলতো। কি দাম সেই প্রতীক্ষার? আমি হেমনলিনী নই অর্জুনদা, তবুও বেহায়া আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারছি না। চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছি। কেনো করছি নিজেও জানি না। জানো, আমি না এখন আর ছোটাছুটি করি না। এখন আর মিথ্যে বলি না। তোমার ফুল গাছের সাড়ে সর্বনাশ ও করি না। আমি ধিঙ্গিপনা ছেড়ে দিয়েছি। আমি আর এখন খোঁপা করি না অর্জুনদা। কারণ তোমার যে এগুলো বড্ড অপছন্দের। খালি খোঁপা দেখলেই বকবে। তাই কেশগুলো অবাধ্য ই ছেড়ে দেই। অন্তত তারা তো উড়ুক। তবে আমি না এখনো অন্যমনস্ক ই থেকে গেছি। কারণ আমার ভাবনায় শুধু তোমার ই বিচরণ। কি করে মন লাগাবো কিছুতে। তুমি আমাকে বলেছিলে “অপেক্ষা করিস”, আমি অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। আর পারছি না যে। আমার প্রণয় ফুলটা মরতে বসেছে অর্জুনদা। তুমি কি ফিরবে না অর্জুনদা? আমি কি তবে হেমনলিনীর মতো অপেক্ষাই করে যাবো?

ইতি
তোমার মহাবিরক্তিকর অন্না”

অর্জুনের বুকে যেনো কেউ ভোঁতা ছু’রি চালিয়ে দিয়েছে। অসহনীয় বিশ্রী যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখখানা বারবার ভিজে আসছে। পুরুষদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু আজ অর্জুন কাঁদছে। বুকখানা চেঁপে হু হু করে কাঁদছে। তখন মনে হলো একটি চিকন কন্ঠে তার কানে এলো। মিষ্টি কিশোরী কন্ঠ। হাটু গেড়ে তার সামনে বসে রয়েছে কিশোরী। পরণে সাদা জামদানী, কাজলকালো নয়ন, অবাধ্য কেশ খোঁপা করা, তাতে শিউলি ফুলের মালা। কি মিষ্টি গন্ধ ফুলের। মুখে হাত দিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি কাঁদছো অর্জুনদা?”

বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অর্জুন। তার চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। বুকে তীব্র যন্ত্রণা। সে অন্নাকে দেখছে। কি সুন্দর লাগছে অন্নাকে। অন্না তখন ঠোঁট প্রসারিত করে বললো,
“তুমি কেঁদো না, তোমার প্রগাঢ় নয়নে নোনাজল বড্ড বেমানান”
“তুমি অপেক্ষা কেনো করলে না অন্নপূর্ণা? আমি যে ফিরে এসেছি। তোমার জন্য আমি ফিরে এসেছি”
“আমি অপেক্ষা করলে যে তোমার ফেরা হতো না। তা কি করে সহ্য করতাম! তুমি কেঁদো না অর্জুন দা! ভালোই হয়েছে ধিঙ্গি মেয়েটা আর জ্বালাবে না তোমাকে। তোমার বিরক্তির কারণ শেষ। কেউ এখন বলবে না তুমি অন্নার প্রেমিক। উহু, প্রেমিক নয় দেবদাস। তবে কি জানো অর্জুনদা, মা আমার সাধটা পূরণ করেছে। আমার যে বড় সাধ ছিলো, তোমার মাঝে বাঁচা। দেখো, আমি তোমার মাঝেই বেঁচে আছি। এই ধিঙ্গি, মহাবিরক্তিকর, চঞ্চল, অকালকুষ্মাণ্ড মেয়েটার হৃদয় তোমার জন্য স্পন্দিত হবে, প্রতিক্ষণ, প্রতিমূহুর্ত। তুমি চাইলেও তার পিছু ছাড়াতে পারবে না যে অর্জুনদা। তোমার একলা আকাশ জুড়ে কেবল আমার ই বিস্তার”

অর্জুনের বক্ষস্থলে হাত রেখে কথাখানা বললো অন্না, বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো সে। অর্জুনের স্বর দলা পাকাচ্ছে। ভাঙ্গা স্বরে বললো,
“আমি তোমাকে কখনোই এড়াতে চাই নি অন্না, বেক্ষাপ্পা মনটা স্বীকার করুক বা না করুক আমার মনের একলা আকাশ সর্বদাই তোমায় জুড়ে ছিলো, তোমার দুষ্টুমিমাখা হাসি, তোমার নুপুরের নিক্কনের ন্যায় কন্ঠ, তোমার রাগে লেপ্টে থাকা রক্তিম মুখশ্রী, তোমার দীঘির জলের ন্যায় অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া সব ই যে আমার বড্ড প্রিয়। তুমি সাধারণ, তবুও তুমি আমার কাছে অনন্যা। একটিবার ফিরে আসো অন্না, তোমার সব অভিমান আমি ভাঙ্গিয়ে দিবো। একটিবার ফিরে আসো, একটি বার। শুধু একটিবার ফিরে আসো”

অন্না কিছু বললো না, শুধু হাসলো। স্নিগ্ধ সেই হাসি। তারপর অর্জুনের বক্ষস্থলে মাথা এলিয়ে দিলো। ধীর স্বরে বললো,
“আমি নেই কিন্তু আমি আছি, এই যে তোমার মাঝে স্পন্দিত হচ্ছি। আমরণ তোমায় মাঝেই আমার বিস্তার থাকবে। আমাদের গল্পটা হয়তো এমন ই ছিলো অর্জুনদা। ঝগড়া, খুনসুটি আর অব্যক্ত প্রণয়। অনেক তো হলো হেমনলিনীর প্রতীক্ষা, এবার নাহয় প্রতীক্ষার প্রহরখানা রমেশ গুনলো। কি অর্জুনদা পারবে না সেদিনের অপেক্ষা করতে! যেদিন মহাকাল মিশে একাকার হয়ে যাবে, যেদিন সকল অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে যাবে! পারবে না?”
“পারবো। আমার হেমনলিনীর অপেক্ষায় প্রহর গুনবো। আমার একলা আকাশ যে তোমায় জুড়ে হেমনলিনী”

অন্নার চিঠিখানা বুকের ভেতরে আঁকড়ে ধরে দৃঢ় কন্ঠে কথাখানা বললো অর্জুন। তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো দিগন্তের দিকে। সূর্যটা ডুবতে পড়েছে। একলা আকাশে নামবে নিগূঢ় তমশা। অর্জুনের হৃদয় আকাশেও আজ নেমেছে নিগূঢ় তমসা। তবে সেই আকাশ জুড়ে জ্বলজ্বল করছে এক ফালি চাঁদ, যার নাম অন্নপূর্ণা_______

||সমাপ্ত||