আমার চন্দ্রাবতী পর্ব-১৮

0
785

#আমার_চন্দ্রাবতী
লেখিকা- সালসাবিল সারা

১৮.
স্বপ্ন!স্বপ্ন!স্বপ্ন!গতরাতে বলা প্রেমিক পুরুষটার সকল স্বীকারোক্তি যেনো স্বপ্ন!লোকটার বলা সকল উক্তি এখনো দুআর কানে সুর তুলছে।হিম হয়ে আসা অনুভূতিটা এখনো তনুতে কম্পন সৃষ্টি করছে নিভৃতে। মানবটার গতরাতের প্রেম নিবেদন কি আসলেই স্বপ্ন ছিল নাকি পার্থিব জগতের এক চিরন্তন সত্য!মাথায় চাপ পড়লো কিঞ্চিৎ।সত্যতা আর স্বপ্নের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করছে দুআ। আঁখি জোড়া নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ডান দিকের আলমারি খানায়।

ফোনালাপের পর, রাতভর এমনকি এই প্রভাতক্ষণে কি চলছে কিছুতেই দুআর জ্ঞান নেই।নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো তার ছোট্ট তনু।ঘনঘন শ্বাস নেওয়ার পাশাপাশি ইয়াদের বলা প্রত্যেকটা কথা তার মস্তিষ্কে সিডি প্লেয়ারের মতো বাজছে।অত্র ঘটনা যদি একান্তই দুআর স্বপ্ন হয়,তাহলে দুআ হয়তো আর কোনো দিনই সেই লোকের সামনে যেতে পারবে না।
গতরাতের কাহিনী একান্তই দুআর মনোভাব,এমনটা দুআ বিশ্বাস করতে নারাজ।দুআর মনোভাবনা বুঝি এমন?নাহ তো!সে একান্তই একজন সহজ সরল মানবী।শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভেজালো।দৃষ্টি সরিয়ে বিছানায় বিদ্যমান মুঠোফোনের পানে তাকালো সে।মস্তিষ্ক বলছে,মোবাইলটা একবার চেক করতে।অচেনা সেই নাম্বার দেখলেই ভ্রম নাকি বাস্তবতা সবটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।সন্তপর্নে উঠলো মেয়েটা।গলায় জমে থাকা ঘাম মুছলো সুতির ওড়নার সাহায্যে।ধীর গতিতে মুঠোফোন নিজের আয়ত্বে নিলো।হাত কাঁপছে মানবীর।বুকে চিনচিন করছে।ভয় হচ্ছে তার,সবটা যদি ভ্রম বা স্বপ্ন হয়?দুই অধর চেপে গালের ভেতরে পুরলো।নেত্র যুগল বন্ধ করলো কিঞ্চিৎ দুর্ভাবনায়।মিনিট এক পরে বুকে সাহসের মাত্রা বাড়িয়ে সোজা চলে গেলো কল লিস্টে।বিস্ফোরিত নজরে চেয়ে আছে সেই কাঙ্খিত নাম্বারে।সময়টাও গতরাতের দেখাচ্ছে।অর্থাৎ,সবটা সত্যি।না ভ্রম,না কোনো স্বপ্ন।ইয়াদ সত্যি তার স্বচ্ছ প্রেমের স্বীকারোক্তি করেছে দুআর নিকট।পুনরায় বৃদ্ধি পেলো হৃদস্পন্দন।মানবীর গালে লাল আভার দেখা মিললো।অতি সুখে এবং কাঙ্খিত প্রেমিক পুরুষের সন্ধায় পেয়ে রমণী যেনো হাতে পেলো ইদের চাঁদ।লাল আভা ছড়ানো গাল থেকে উত্তাপ বেরুচ্ছে একটু, চাপা অনুভূতিতে।হঠাৎ করেই প্রেমিক পুরুষের অবয়ব ভেসে উঠলো আঁখি জোড়ায়।সুদর্শন পুরুষ যখন প্রেম নিবেদন করছিলেন তখন তার ভাবভঙ্গি কেমন ছিলো?খুবই উত্তেজিত?নাকি গম্ভীর!জানা নেই দুআর।সে জানতে চাইছে না।আপাতত ইয়াদের দৈহিক অবয়ব নিয়েই সন্তুষ্ট সে।ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো তার সম্পূর্ণ সত্তায়।এইবার বুঝি সত্যিই রমণীর জীবনে তার লম্বা মানব রুপী প্রেমিক পুরুষের আগমন হলো!
.
–“কিছু বলবি?নাকি এইভাবেই নখ কামড়াবি?কলেজেই যেতে দিসনি।এইখানে এসে বসিয়ে রেখেছিস!”
রামিসা বিরক্ত।
–“সিরিয়াস কিছু হবে হয়তো।ওকে কথা গোছাতে দে,আজব!”
মাহি পরোটা চিবুতে ব্যস্ত।
দুআ অস্থির।কিঞ্চিৎ পেরেশান।তার ভেতরকার ঝড়ের খবর দেওয়ার জন্যেই এই দুই মানবীকে ডাকিয়েছে সে।সঞ্জয়কে বলতে চেয়েছিল আসতে,কিন্তু আগে ব্যাপারটা রামিসা এবং মাহিকে জানানো উত্তম মনে করলো।দু হাতের তালু ভিজে।কারণ,অতিরিক্ত মানসিক চাপ!কথা কিভাবে শুরু করবে এটাই বুঝছে না।অতঃপর মেয়েটা চেষ্টা করছে জড়তা কাটানোর,
–“কিছু বলার ছিলো।”
রামিসা চিন্তিত,মাহি খেতে ব্যস্ত এখনো।

দুআ পুনরায় নিশ্চুপ।আগ্রহটা এখন বিরক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে সেই দুই সইয়ের। রামিসা চোখ গরম করে দৃষ্টি মেলতেই দুআ ফট করে মুখ খুললো,
–“তোর ভাই.. মানে ইয়াদ,আমাকে ফোন দিয়েছিল রাতে।”
রামিসা এবং মাহির অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো না।যেনো তারা এই বিষয়ে পূর্ব থেকে অবগত।দুআর ঘামমাখা হাত জোড়া কাপড়ে মুছলো,
–“তোরা অবাক হচ্ছিস না কেনো?”
–“অবাক হওয়ার কি?এরপর বল,আজব!”
মাহি নির্দ্বিধায় বললো।
–“উনি আমাকে ফোন দিবেন,এই কথাটা কি তোদের উনি বলেছেন?কিন্তু, কবে!কখন?”
দুআর ভীত প্রশ্ন।
–“তোদের ব্যক্তিগত তথ্য আমাদের কেনো বলবে উনি?আজব!”
মাহির উল্টো প্রশ্ন দুআর প্রতি।

–“এই দুআ,নাটক করবি না।তুই কথা না ঘুরিয়ে বল কি হয়েছে?তোর চোখ মুখ দেখে অন্যরকম লাগছে কেনো!”
দুআ পড়লো বিপাকে।এই মেয়েদের কাছে নিজের কিছু গোপন করা বড় দায়।অবশ্য এদের না বললেও অন্তরে শান্তি মিলবে না দুআর।সে আমতা আমতা করে বলতে আরম্ভ করলো,
–“আসলে,ইয়াদ আমাকে গতরাতে প্র..প্রপোজ করেছে।”
হালকা ভেঙ্গে কথাটা শেষ করলো মেয়েটা।

–“কী?এতো জলদি?”
রামিসা এবং মাহি দুইজনই চিল্লিয়ে উঠলো।
কোনো বাক্য ব্যয় করলো না দুআ।লাজুক চোখে তাকিয়ে রইলো কোলে বিদ্যমান মোবাইলের দিকে।রামিসা,মাহি চড়ে বসলো দুআর উপর।
–“কয়দিন কথা বলে ইয়াদ ভাই তোকে ভালোবাসি বলেছে?বল না,বল না।”
রামিসা দুআর হাত জড়িয়ে বলে উঠলো।
–“হ্যাঁ রে আজব।বলে ফেল তো কাহিনী কি?”
মাহির দৃষ্টি সন্দেহভাজন।
দুআ দুইজনের কান্ড উপলব্ধি করে স্ফীত কণ্ঠে আওড়ালো,
–“উন..উনি গতরাতেই ফোন দিয়ে এইসব বলেছেন।এর আগে ফোন দেননি।”
–“কি!আমার ভাইয়ের বুঝি তর সইছে না আর।উফ দুআ,আমার ভাই তোকে কি যে ভালোবাসে!তোর জন্যে ইয়াদ ভাই কতো পাগল, জানিস তুই?”
দুআ মাথা নাড়ালো।অর্থাৎ, সে জানেনা।

–“”জানার প্রয়োজন নেই।আপাতত উনাকে নিয়ে চিন্তা কর তুই,আজব।”
মাহি হেসে বললো।
–“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।উনি আমাকে এইভাবে হুট করে!”
দুআর কণ্ঠ বিচলিত।
–“এইভাবে হুট করেই ভালোবাসা নামক অনুভূতির আগমন হয়। ঢোল পিটিয়ে আসে না,আজব।”
মাহি বলে উঠলো।

–“তা তুই উনাকে ভালোবাসিস?”
রামিসার সহজ প্রশ্ন।
কুঁকড়ে উঠলো মানবী।
এই কেমন প্রশ্ন?এই কেমন উত্তেজনা!আশ্চর্য তো!এই প্রশ্নে দুআর হাত বরফে রূপান্তরিত হচ্ছে।এতো লজ্জা,এতো সংশয় কেনো অনুভব করছে মেয়েটা?
–“এইসব আমি ভাবিনি এখনো।তবে উনি ভালো মানুষ।উনার মধ্যে মেয়েদের সম্মান করার ব্যাপারটা ব্যাপক লক্ষণীয়।”
নেচে উঠলো দুই রমণী।সইয়ের কথাটা যেনো তাদের পছন্দ হলো।রামিসা দুআর লাল আভাযুক্ত গালে হাত রেখে বলে উঠলো,
–“হলে হলে হো জায়েগা পেয়ার,বেহনা।”
–“অবশ্যই, উনাকেই তো তোর ভালোবাসতে হবে,আজব!ইয়াদ যে তোর জন্যে এখন থেকেই দিওয়ানা।তুই না চাইলেই উনি তোকে চাই।ইয়াদ কি জিনিস দেশবাসী জানে।তুই ভাগ্যবতী এমন ছেলের ভালোবাসা হতে পেরেছিস!অবশ্য উনি নিজেও অনেক বড় ভাগ্য নিয়ে এসেছেন দুনিয়ায়।আমাদের চাঁদ এর মতো মেয়ে হয় নাকি?চাঁদ হলো সবচেয়ে সেরা।”
মাহি শব্দ করে চুমু খেলো দুআর গালে।
রমণীর অবস্থা লাজে মরি মরি প্রকারের।কিন্তু; আজ তার মনে শুধুই লাজের বিচরণ।দাগ নিয়ে সংশয় আজ তার মনে একটিবার এলো না।এই বুঝি সেই লম্বা মানবের প্রতি তার ভালোলাগার লক্ষণ!হয়তোবা।

অন্য সময় ভালোবাসা/ভালোলাগার কথা এলে দুআর প্রথম সংশয় ছিলো তার দাগ নিয়েই।তবে আজ এই সংশয়ের আবির্ভাব নেই।দুআর মন আজ সকল দাগমুক্ত।শরীরের দাগের চেয়েও মনের দাগ যেনো বিরাট কষ্টদায়ক।আজ সে কষ্ট দুআর মন উপলব্ধি করছে না।এই যেনো শুধুই এক সুপ্ত অনুভূতি। খেলোয়াড় মানবের জন্যে মনে সৃষ্ট অন্যরকম এক ভালোলাগা!
—————————-
কলেজ ছুটি।চারিদিকে মানুষের ব্যস্ততা।দুআর গাড়ি আসবে না আজ।রামিসার সাথে ফিরবে সে।তার বাড়ির দুইটি গাড়িই শহরে।রিজোয়ানের বিয়ে উপলক্ষে কেনাকাটার ধুম বাড়ছে।সরু রাস্তায় তিন তরুণী আর এক তরুণ হাঁটছে উচ্ছ্বাসের সাথে।তাদের মূল আলোচনা কলজের পর তারা কোন ভার্সিটিতে ভর্তি হবে এই নিয়ে।অবশ্য কলেজের গন্ডি পার করতে তাদের এখনো ঢের দেরী।তবে মানুষ কল্পনায় বেশি খুশি।তাই কল্পনার জোরে তারা নানান আলোচনায় ব্যস্ত।হেঁটে যাওয়ার মূল কারণ “আবির মার্কেট”।কলেজ থেকে আট মিনিটের পথ।মাইশা আছে সেথায়।সকলে একসাথে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যেই মার্কেটের দিকে এগুচ্ছে তারা।হাস্যোজ্বল দুআর মুখভঙ্গি দিনদিন পাল্টে যেনো মনোরম থেকে মনোরম হচ্ছে!অতি সুখে মানুষের মুখের নকশা পরিবর্তন হওয়াটাই যেনো প্রকৃতির নিয়ম।

এক জোড়া পা নিভৃতে চলছে তাদের পিছু পিছু।চোখ জোড়া আটকে আছে দুআর ঝুলন্ত বেণীর দুলিয়ে চলাতে।এই রমণীর পিছে কতো ঘুরেছে এই লোক।কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছে না।সেইবার রেস্টুরেন্টের কাহিনীর পর আড়ালেই দেখে সে দুআকে।দুআর প্রতি অনুভূতির পরিবর্তন লক্ষ্য করতে বেগ পেতে হলো না ইশফাকের।দুআ এবং বাকি সবাই মার্কেটে ঢুকে পড়লে ইশফাক উল্টো দিকে ফিরে আসে।গন্তব্য তার কলেজের সামনে পার্ক করা গাড়ি। মেয়েটাকে দেখলেই যেনো তার যতো স্বস্থি!
সিটে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবনায় ডুব দিল ইশফাক।দুআকে যে তার চাই!আগে এমনটা চায়নি সে।তবে দুআকে হুমকি দিতে গিয়ে নিজেই তার মোহে আবদ্ধ হলো।ঘোলা দৃষ্টিতে বাবার নাম্বার বের করে ফোন লাগালো ইশফাক।যে কথাটা বলতে যাবে তার জন্যে কণ্ঠস্বর কাঁপছে তার।কিন্তু,দুআর প্রতি সৃষ্ট অনুভূতির পরিপূর্ণ নাম দিতে চাই সে।দুআর মোহে নিজেকে বারবার হারাতে চাই ইশফাক নামের তরুণ।

আগামী মাসে বিদ্যমান সিরিজের জন্যে কনট্র্যাক্ট সাইন করে এলো ইয়াদ।সাথে কিছুদিনের ছুটি নিলো অনুশীলন থেকে।সবটা সামলিয়ে পুনরায় তাকে চট্টগ্রামে যেতে হবে।একে তো মাইশার বিয়ে,আর দ্বিতীয়ত তার প্রিয়তমার দেখা পাওয়া।মেয়েটার সেদিনকার অবস্থা আন্দাজ করে আর ফোন দেয়নি ইয়াদ।তার লজ্জায় রাঙা মুখশ্রী দেখার তীব্র ইচ্ছা জেগেছিল সেদিন মনে। আপাতত সে স্থির করলো,
প্রেয়সীর সামনে উপস্থিত হয়ে সরাসরি লজ্জায় রাঙা মনবীর মুখশ্রী উপভোগ করবে।
কেমন লাগবে তখন মেয়েটাকে?অতিরিক্ত শুভ্র?অতিরিক্ত মনোরম! মেয়েটার লাজুক চাহনী, লাজুক মুখশ্রী দৃষ্টিতে আবদ্ধ করলে ইয়াদ সামলাতে পারবে তো নিজেকে?নাকি টুপ করেই ছুঁয়ে দিবে স্নেহ ভালোবাসায় সিক্ত স্পর্শে!জানা নেই তার।কল্পনার দুনিয়া আজ ভীষণ রঙিন।প্রেয়সীর দেখা পাওয়ার জন্যে মনটা আজ বড্ড উদাসীন।শুধুই যেনো সময় আর দিনক্ষণ তাদের দেখা হওয়ার মাঝে দেওয়াল।শীগ্রই এই দেয়াল ভেঙে হবে চুরমাচুর।ইয়াদের অধর জুড়ে প্রসারিত হলো প্রশান্তির হাসি।

তবে; এই হাসি স্থায়ী হলো না,বাড়িতে প্রবেশের পর।বসার ঘর জুড়ে চিল্লাচিল্লির আমেজ।সেদিকে পা ফেলতেই বাড়ির সদস্যদের নজরে এলো তার।বাবা উচ্চস্বরে কথা বলছে।মায়ের চেহারা কাঁদো কাঁদো।জিয়া বসে আছে মূর্তির মতো।রুম থেকে ছাড়া পেয়েছে সে মাইশার বিয়ের তারিখ নির্ধারণের পর।মেয়েটা হঠাৎই স্বাভাবিক আচরণ করছে সবার সাথে।বাড়ির লোক তার পরিবর্তন দেখে আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না।এমনকি ইয়াদ নিজেও জিয়ার পরিবর্তনে অতীত নিয়ে ঘটনা আর টানলো না।তার বোন নিজেকে সামলে নিয়েছে এটাই ঢের।
ইয়াদকে দেখে থামলেন সাজ্জাদ।
–“থামলে কেনো?আরো চিল্লাও উচ্চস্বরে।”
ইয়াদের তেজী কণ্ঠ।
–“দেখ না ইয়াদ,বাবা মায়ের সাথে হুদাই যুদ্ধ করছে।”
জিয়া চিন্তিত।
–“হুদাই মানে?আমি যাবো না কোনো গ্রামে।আগে গিয়েছি,গিয়েছি।কিন্তু এখন আমি যাবো না।অসহ্যকর।শহরের ক্লাবে বিয়ে হবে।সেখানেই যাবো।এখন কোনো কথা না।”
–“মীরা কষ্ট পাবে না?বলো?তুমি ওর ভাই না?”
ডালিয়ার আঁখি ত্যাগ করলো এক ফোঁটা জল।
–“পাক কষ্ট।আমার কি?তুমি আর একটা শব্দ করবে না।নাহলে আমার হাত উঠতে সময় লাগবে না একদন্ড।”
সাজ্জাদ ব্যাপক চিল্লিয়ে উঠলো।
–“বাবা?মাথা ঠিক আছে তোমার?আমাকে কি দেখছো না তুমি? আম্মি,তুমি কিছু বলো না উনাকে।যার বোনের জন্যে দরদ নেই তাকে এইসব বলে কি লাভ?আর এইসব যান্ত্রিক মানুষকে গ্রামের ভালো দিক কে বুঝাবে?আজকাল গ্রাম শহর কিছুরই ভেদাভেদ নেই।অযথা দাম্ভিকতা দেখাচ্ছো তুমি, বাবা।”
ইয়াদের স্বর গম্ভীর।
–“তুমি কেনো গ্রামের এতো গুণগান করছো?মেয়ে জনিত কোনো ব্যাপার..”
ইয়াদ হাত দেখিয়ে থামালো সাজ্জাদকে।
–“এইখানে তোমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে।নিজেরটা নিয়ে ভাবো।বারবার বলছি আমাকে নিয়ে কিছু বলো না।আমি আদৌ তোমার কথা শুনবো? আম্মি,এইসব বন্ধ করো।আমি যাচ্ছি তোমার সাথে।এটা কি কম?”
–“নাহ,আব্বা।”
ডালিয়া চোখ মুছলো।
–“সময় বলে দিও।আমরা রওনা দিবো নির্ধারিত দিনে।নো মোর আর্গুইং।”
ইয়াদের উক্তিতে উত্তপ্ত বসার ঘর হিমঘরে পরিণত হলো।

–“ইয়াদ ভাইয়া,দুআ আপু আমার জন্যে একটা ড্রেস কিনেছে।”
মারিয়া হেসে বললো ইয়াদকে।
রুমের সোফায় বিদ্যমান ইয়াদ অল্প হাসলো।এই মেয়েটা সারাদিন দুআর ব্যাপার নিয়েই থাকে।ইয়াদ শুনলো,রামিসা,দুআ এবং মারিয়ার একটা আলাদা গ্রুপও আছে হুয়াটস অ্যাপে।দুআ আবার এই অ্যাপ ছাড়া আর কোনো অ্যাপ ব্যবহার করে না।এটাও এক প্রকার স্বস্তি ইয়াদের জন্যে।তবে আজও সেথায় ইয়াদ মেয়েটাকে একটা মেসেজ দেয়নি।ঐযে নিজের মনের কথায় সে স্থায়ী আছে এখনো। সরাসরি চন্দ্রাবতীকে দেখার ইচ্ছায় সে সব মনের ইচ্ছা সয়ে নিচ্ছে।
ম্লান হাসে সে মারিয়াকে বলে উঠলো,
–“আরে বাহ!তুমি কিছু কিনোনি তোমার আপুর জন্যে?”
–“তুমি নিয়ে যাবে আমাকে মার্কেটে?আম্মুও যাবে বললো।”
–“নাহ।তুমি কিনে নিও।ভাইয়া তো আছেই টাকা দেওয়ার মেশিন।”
ইয়াদের কথায় খিলখিল করে হাসলো মারিয়া।ইয়াদ সেইদিকে একনজর বুলিয়ে খুশিমনে ল্যাপটপের দিকে মন দিলো।
———————–
ব্যস্ত সময় চলছে জমিদার বাড়িতে।জিনিসপত্রের উথাল পাথাল অবস্থা।কাজ করতে করতে হয়রান বাড়ির চাকর-বাকর।দম ফেলানোর জো নেই যেনো।জমিদার বাড়ির প্রথম পুত্রের বাগদানের অনুষ্ঠানের জন্যেই যতো আয়োজন। বাগদানেই এমন এলাহী কান্ড; না জানি,বিয়েতে এই আয়োজনের মাত্রা কেমন হয়!
নিচ থেকে মা,কাকীর সাথে মিলে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে আসলো দুআ।পিঠের মাঝে চিনচিন করছে এতক্ষণ যাবত বসে থাকার দরুণ।বিছানার নরম গদি যেনো তার পিঠকে আকর্ষণ করছে তীব্র।লোভী দুআ তাদের দুইজনকে মিলতে সাহায্য করলো।বিছানায় পিঠ ঠেকতেই অনুভব করলো চিরকালীন পার্থিব সুখ।ক্লান্ত অবস্থায় বিশ্রাম নেওয়াটা তীব্র সুখের কাতারে পড়ে।সর্বকালের মতো আখিজোড়ায় বিচরণ করছে খেলোয়াড়ের মুখশ্রী।
তীব্র আওয়াজে মোবাইল বাজলে রমণীর কল্পনায় ব্যাঘাত ঘটলো।মোবাইলে দৃশ্যমান নাম্বার দেখে মনটা ধ্বক করে উঠলো তার।নাম্বার সেইভ করা না থাকলেও,প্রিয় মানবটার নাম্বার চিনতে ভুল করলো না সে।কতরাত শুধু এই নাম্বার দেখে মানবের কল্পনায় রাত পার করেছে এটা শুধু তারই জানা আছে।শেষ মুহূর্তে কল রিসিভ করলো দুআ। অপর পাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর চিন্তিত কণ্ঠস্বর,
–“”তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।”
দুআ কিছু বললো না।জমে বরফ হয়ে আছে মেয়েটা।
–“দুআ? ইউ দেয়ার?”
এইবার দুআর টনক নড়লো,
–“জ… জ্বী।”
দুআর শব্দ শুনে মনটা প্রশান্তিতে ভরপুর হলো ইয়াদের।
–“আমার অতীত সম্পর্কে কিছু বলার আছে তোমাকে।যদিও ভেবেছিলাম আর ফোন দিবো না,সরাসরি দেখা দিয়ে চমকে দিবো।তবে এই কথাটা না বললে আমি সত্যি শান্তি পাবো না।”
ইয়াদের কণ্ঠে অস্থিরতা স্পষ্ট।দুআর মনটা গলে যাচ্ছে বরফের ন্যায়।এই বুঝি কোনো দুঃসংবাদ শুনবে সে?

–“বলুন।”
থেমে জবাব দিলো মেয়েটা।
–“আসলে,আমি বিশ বছরের পর থেকে বড্ড বেপরোয়া ছিলাম।একসময় অনেক খারাপ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে ফেলেছিলাম।অবশ্য আমাদের ঢাকায় এইসব একদম স্বাভাবিক, এখনের যুগ হিসেবে।তবে বিষয়টা সত্যি খারাপ।আমি নিজেই এখন ব্যাপারটা বুঝতে পারি।কিন্তু বয়সের দোষ বলে একটা কথা আছে।এই ঝোঁকেই অনেক খারাপ কাজ করেছি।তবে যখন বুঝেছি,এইসব খারাপ জিনিস,আমার সব স্পর্শ শুধু আমার প্রেয়সীর জন্যে বিদ্যমান থাকবে,তখন থেকেই সব ছেড়েছি আমি।এতদিন সন্ধানে ছিলাম এক পবিত্র সত্তার।সেই সত্তাকে আমি খুজে পেয়েছি।আমার সেই সত্তা হলে একমাত্র তুমি।আমার দুআ,আমার চন্দ্রাবতী।আশা করি আমার অতীতের জন্যে আমাকে ভুল বুঝবে না।ভুল বুঝলেও নিজেকে সমালিয়ে নাও।ইয়াদের উপর বিশ্বাস করতে শুরু করো।ইয়াদ কখনো তোমার বিশ্বাস ভাঙবে না।”

দুআর আঁখি অশ্রুতে ছলছল।লোকটা তাকে সব সত্যি বলছে!অতীত তো সবারই থাকে।খারাপ অতীত থাকে চিরকালই লুকায়িত।আর এই লোক নিজের খারাপ অতীত কি সাবলীলভাবে করে ব্যক্ত করেছে।সে চাইলে সবটাই লুকায়িত থাকতো।কিন্তু দুআর বিশ্বাস অর্জনের জন্যে এইভাবেই সবটা বলে দিলো লম্বা মানবটা!
দুআ ফোঁপাচ্ছে।ইয়াদের কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক বিন্দু ঘাম।তার চন্দ্রাবতী কি তার অতীতের শুনেই কান্না করছে?
–“এই দুআ, আইম রিয়েলি সরি।আমার অতীতের জন্যে আমি সরি ফিল করছি।কেঁদো না প্লিজ।বিশ্বাস করো, সেইসবের প্রভাব আমার উপর থেকে অনেক বছর আগেই বিদায় হয়েছে।আমার সারা সত্তায় এখন তোমার প্রভাব।অতীত পরিবর্তন করতে পারলে সেই কালো অধ্যায় আমি ছিঁড়ে দূরে ফেলে দিতাম। আমার শুধু তোমাকে চাই,মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।বিশ্বাস করো আমায়,প্লিজ। আই লাভ ইউ,দুআ।”
দুআ শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো। এতো বড় মাপের মানুষটার কণ্ঠে তাকে পাওয়ার আকুতি,অতীত নিয়ে অনুতাপ সবটাই দুআর মস্তিষ্কে সুপ্তভাবে ধারণ হচ্ছে।এমন স্বচ্ছ ব্যক্তিক্তের মানুষটাকে দুআ কিভাবেই বা ভুল বুঝবে?
খারাপ অতীতেকে পেছনে ফেলে কয়জনই বা সামনে অগ্রসর হয়,বা কয়জনই সেই অতীতের জন্যে অনুতপ্ত হয়?দুআ গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুজল মুছলো।বেশ কষ্টে আওড়ালো,
–“বুঝেছি।সবারই অতীত থাকে।খারাপ অতীত পিছে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা বড্ড দুঃসাহসিক কাজ।আমি আপনাকে ভুল বুঝিনি।”
ইয়াদের মনে প্রশান্তির পবন ছুঁয়ে গেলো নিমিষেই। হাওয়ায় বিদ্যমান মেঘমালা ভাবছে সে নিজেকে।বুকের উপর থেকে বড় এক পাথর সরলো যেনো,
–“তুমি জানোনা দুআ,তুমি ঠিক কি পরিমাণ শান্তি দিয়েছো আমাকে।আমি আসছি দুআ, খুব শীগ্রই।তোমাকে দেখার আশায় আমার চোখ,মন সবই তৃষ্ণার্ত!”
দুআ হকচকিয়ে উঠলো।তার বাম হাতের মুঠোয় খু’ন হচ্ছে অসহায় ওড়না।ইয়াদের কথার প্রতিত্যুরে কি উত্তর দিবে জানা নেই তার।
–“এই এই,তুমি আবার আমাকে খারাপ ছেলে ভাববে না প্লিজ।সেই অতীতের পর আমি আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের সংস্পর্শে আসিনি।আমার মনের পবিত্র সত্তা তুমি।তাই আমার সকল মান,অভিমান,ভালোবাসা,স্পর্শ সবই তোমার জন্যে বিদ্যমান।এতে তোমার লজ্জা পাওয়ার না বরং গর্ব করার ব্যাপার।কারণ,একটা ছেলে তোমার জন্যে পাগল হচ্ছে সর্বক্ষণ।অন্য মেয়েতে তার আসক্তি নেই।তার সর্ব আসক্তি শুধু তোমায় ঘিরেই।”

কিছু সময় নিরবতায় কাটলো।প্রেয়সী তার প্রেমিক পুরুষের কথায় হয়ে রইলো বুদ।রামিসার বলা সেদিনকার,”তোর জন্যে ইয়াদ ভাই কতো পাগল জানিস?” কথাটার যথার্থতা পেলো আজ দুআ।
লাজুক প্রেমিকার উত্তর মনে মনে নির্ধারণ করলো সে।সশব্দে হেসে সে দুআর উদ্দেশ্য বলে উঠলো,
–“কিছু বলতে হবে না তোমার।তোমার নীরবতায় আমি সবটা বুঝে নিচ্ছি।সামনাসামনি দেখার অপেক্ষায় রইলাম।লজ্জায় রাঙা লাল আভাযুক্ত মুখশ্রীর জন্যে বড্ড ব্যাকুল হয়ে আছে মন।ভালোবাসি চন্দ্রাবতী।শীঘ্রই দেখা হচ্ছে আমাদের।”
ইয়াদের এমন আবেগ মাখা বুলিতে দুআর থমথমে মনে সৃষ্টি হলো কালবৈশাখী ঝড়।

চলবে…..