আমার নিঠুর মনোহর পর্ব-১৭

0
150

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সতেরো[প্রথমাংশ]

হসপিটালের করিডোরে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে তারিন। হাটুতে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বিয়ের পর থেকে শাশুড়ী নামক মানুষটা মায়ের মতো আগলে রেখেছিলো। মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। শাশুড়ীও মায়ের মতো ভালোবাসতে পারে__কথাটা তারিন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে প্রমাণ পেয়েছে। আজ সেই শাশুড়ী নামক মা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তাকে বাঁচানোর জন্য কত দৌঁড় ঝাপ। আজকে তারিন কাঁদছে। শব্দ করেই কাঁদছে। এই অল্প কয়েকদিনে মানুষটা কে ও বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলো। এই তো কালকে রাগে, ক্ষোভে বর্ষা বেগমের সাথে কঠিন স্বরে কথা বলেছিলো। তখন বর্ষা বেগম হাসছিলেন। আর তারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছিলেন,
“আমার ছোট্ট মনির আজ মাথা গরম কেনো? আমার ছেলেটা আবার কি অকাজ করেছে? বাইরে ঘুরতে নিয়ে আমার মেয়েটার মন ভালো করার বদলে আরো খারাপ করে দিয়েছে। আসুক আজকে ও বাড়িতে ওকে ইচ্ছে মতো বকে দিবো। সাথে দুই একটা থা’প্পড় ও বসিয়ে দিবো৷ তুই কাঁদিস না। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগেনা৷ কাঁদিস না।”
যত্ন করে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়েছিলো। আর সেই মানুষটা এক রাতের ব্যবধানে এখন মৃত্যু সজ্জায়। নাহ! মানতে পারছেনা তারিন। কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মানুষটা কি শেষ বার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিবে না? তার ভুল ধারণা ভাঙানোর সুযোগ দিবে না৷ তিনটা মানুষের অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলে যাবে? তারিন আকাশ কুসুম ভেবে মুখ হাতে চেপে শব্দ করে কান্না করে উঠল। এর মধ্যেই তামজিদ হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে প্রবেশ করলো। তামজিদকে দেখেই তারিন উঠে দাঁড়ালো। তারিনের সামনে এসে তামজিদ ভাঙা ভাঙা স্বরে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল,
“মা! মা! মা, কেমন আছে?”
তারিন কাঁদছে। তারিনকে কাঁদতে দেখে তামজিদ আরো ঘাবড়ে গেলো। এই তো কয়েক ঘন্টা আগেই তো মাকে ভালো রেখে গেলো। হঠাৎ কি হয়ে গেলো? তামজিদ আবারো প্রশ্ন করলো,
“বলো? মা, কোথায়? বাবা! বাবা, কোথায়?”
এর মধ্যেই আমজাদ সাহেব সেখানে উপস্থিত হলেন। হসপিটালেই ভর্তি সংক্রান্ত কিছু কাজ ছিলো। আমজাদ সাহেবকে দেখেই তামজিদ উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“মা! মা, কোথায় বাবা? হঠাৎ কি হয়ে গেলো?”
তিনি নিশ্চুপ। তারিন মুখ খুলল। কান্নারত স্বরে ব্যাখা করতে লাগল,
“আপনি চলে যাওয়ার পর, মা আর আমি মিলে টুকটাক কাজ করছিলাম। হুট করেই বলল, ‘শরীরটা ভালো লাগছে না’। তাই আমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বললাম। আমি এদিকেই কাজ করছিলাম। প্রায় আধ ঘন্টা পর কিছু পরে যাওয়ার শব্দ শুনে আমি আর জাহেলা আপা দৌড়ে মায়ের রুমে গিয়ে দেখি, মা ওয়াশরুমের দরজায় পড়ে আছেন। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। রক্তে সারা ওয়াশরুম একাকার অবস্থা। আর মা নিচে পড়ে ছটফট করছিলেন।”
বলেই তারিন আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো। তামজিদ দুই পা পিছিয়ে গেলো। চোখের বাঁধ ভেঙে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অসহায় স্বরে ‘বাবা’ বলে ডেকে উঠল। প্রশ্ন করল,
“মা! এখন কি অবস্থা মায়ের?”
আমজাদ সাহেব শান্ত স্বরেই বললেন,
“জানিনা। ডাক্তার দেখছেন।”
তামজিদ দুই হাতে মুখ চেপে ধপ করে পেছনের চেয়ারটায় বসে পড়লো। তারিন ঠিক বুঝতে পারলো তামজিদ কাঁদছে। আমজাদ সাহেব তামজিদের পাশে বসতেই তামজিদ দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তারিন ও আজ কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“আপা কে খবর দেওয়া হয় নি।”
আমজাদ সাহেবের হুঁশ ফিরে আসলো। মেয়েটার এই অবস্থায় মেয়েটাকে এমন খবর দিবে কি করে? তবুও মনকে শান্ত করল। মেয়েকে ফোন দেওয়াএ জন্য অন্য পাশে চলে গেলো। কিছু মুহূর্ত পর ডাক্তার বেরিয়ে বর্ষা বেগমের বাড়ির লোকের খোঁজ করতেই তারিন আর তামজিদ এগিয়ে গেলো। আমজাদ সাহেব ও ডাক্তারকে লক্ষ্যে করে এগিয়ে আসলেন। আমজাদ সাহেব মন শক্ত করে নিলেন। শান্ত স্বরেই প্রশ্ন করে বসলেন,
“আমার স্ত্রী, কেমন আছেন?”
ডাক্তার খুবই ব্যথিত স্বরে জবাব দিলেন,
“স্যরি! সে আর বেঁচে নেই।”
বলেই তিনি পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। তার আর কিছু বলার সাহস হলো না। এই পরিবারের মানুষদের সামনে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই তার। ডাক্তারের উচ্চারিত বাক্যটি তারিন, তামজিদ আর আমজাদ সাহেবের কানে পৌঁছাতেই তারা তিনজনে যেন পাথর রুপে পরিনত হলো। তারিন মুখে হাত চেপেই উচ্চ স্বরে কান্না করে উঠল। আমজাদ সাহেব পা ভেঙে পড়ে যেতে নিলেই তারিন তাকে দুই হাতে ধরে চেয়ারে বসে দিলো। তামজিদ ধীর পায়ে কেবিনে প্রবেশ করলো। বর্ষা বেগমের দেহটা কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে। নার্স দুটো তামজিদকে দেখেই সাইডে সরে গেলো। তামজিদ ধীর পায়ে বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁপা-কাঁপি হাতে মায়ের মুখ থেকে কাপড়টা সরাতেই ওর বুকটা ধক করে উঠল। সন্তানের সামনে মায়ের লাশ___পৃথিবীর সবথেকে জঘন্য দৃশ্য বোধহয় এটাই। তামজিদ আলতো করে বর্ষা বেগমের মাথায় হাত রাখলো। নাহ! কাঁদছে না তামজিদ। শুধু চোখের অবাধ্য নোনাজল গুলো গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। তামজিদ পাশে থাকা টুলে বসলো। বর্ষা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে করুন স্বরে ডেকে উঠল,
“মা! ও মা! মা! মা গো!”
কণ্ঠস্বর রোধ পাচ্ছে ওর। শব্দ বের হচ্ছে না। ভেতরটা ভেঙে চূড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই তারিন এসে দাঁড়ালো দরজায়। তামজিদকে এভাবে ভেঙে যেতে দেখে দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছে ওর। নিঃশব্দে তামজিদের পাশে এসে দাঁড়ালো। তামজিদ পুনরায় করুন স্বরে বলে উঠল,
“মা! ও মা! শুনো, আজ থেকে আমি কাকে মা ডাকবো? আমি বাসায় ফিরে আসতে দেরি হলে কে আমাকে বার বার ফোন দিবে? আমার বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে কে বসে থাকবে? কে বলবে? বাবা, আমার এই ঢাকা শহরে ভালো লাগে না৷ চল গ্রামে চলে যাই। মা, ও মা! আমি অসুস্থ হলে কে আমার পাশে এসে বসে থাকবে? আমার মাথায় কে হাত বুলিয়ে দিবে? মা! তোমার জন্য আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর এখন সেই তুমিই আমাকে ছেড়ে চলে গেলে! কেনো মা? এত স্বার্থপর কেনো হলে তুমি? একজন কে হারিয়ে তো আমি নিজেকে শক্ত করে তুলছিলাম। এখন তুমি আমাকে দ্বিতীয় বার ভেঙে দিয়ে চলে গেলে, মা? মা, ও মা! একবার তাজ বলে ডাকবে, মা?”
তারিনের বুকটা ফেটে যাচ্ছে৷ মাকে হারানোর যন্ত্রণা বোধহয় দুনিয়ার সবথেকে বেশি কষ্টের। মায়ের মতো দ্বিতীয় কেউ হয় না। মা হারিয়ে গেলে কখনোই দ্বিতীয় কাউকে মায়ের রুপে পাওয়া যায় না। তারিন ভাবছে শাশুড়ী নামক মাকে হারানো কষ্ট যদি এতটা হয়, তাহলে নিজের মাকে হারানোর কষ্ট কিভাবে সইবে? ভেবেই বুকটা কেঁপে উঠল তারিনের। নিজেকে অসহায় লাগছে খুব৷ আজকে তারিন কাঁদছে, কই শাশুড়ী নামক মানুষটা তো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না? বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে না। তামজিদ চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলতে লাগলো,
“মা! মা! মা! একবার উত্তর দাও না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, মা। তোমার তাজের বুক ফেটে যাচ্ছে, মা। তোমার শক্ত ছেলেটা ভেঙে গেছে, মা। তুমি এভাবে কেনো চলে গেলে, মা? আমি তো কয়েকঘন্টা আগেও তোমাকে ভালো দেখে গেলাম, মা। হঠাৎ কি হয়ে গেলো, মা? আমাকে শেষ বার কিছু বলে যেতে পারতে, মা? একবার তাজ বলে ডাকতে পারতে মা? আমি নিজেকে কিভাবে বুঝাবো, মা? আমার মাকে আমি শেষ বারের মতো একটু দেখতে পারলাম না,মা। এই যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করবো, মা? তুমি তো আমাকে একা করে দিয়ে গেলে, মা।”
তারিন আর সহ্য করতে পারলো না। তামজিদের কাঁধে হাত রাখলো আলতো করে। তামজিদ এবার চোখ তুলে তাকালো তারিনের দিকে। তামজিদ মুখে হাসি টানলো। বলল,
“তারিন, তোমাকে আমার মা ভুল ভাঙানোর সুযোগ দিলো না। অভিযোগ কাঁধে নিয়েই চলে গেলো।”

#চলবে

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সতেরো[শেষাংশ]

নিজের স্বামীকে তার প্রাক্তন জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে___দৃশ্যটা ঠিক সহ্য হলো না, তারিনের। তামজিদ বার বার দিশাকে সরিয়ে দিচ্ছে দুই হাতে৷ তারিন অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যটা চুপচাপ দেখছিলো। বর্ষা বেগমকে দাফন করার জন্য গ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে। সবাই এসেছে শুধু তামজিদের বোনকে তানহাকে আনা হয় নি। তানহার ডেলিভারি ডেট মাত্র সপ্তাহ খানেক পর। এই অবস্থাতে এতটা প্রেশার নিতে পারবে না, সে। তাই তাকে ঢাকা থেকেই একবার শেষ দেখা দেখিয়ে আনা হয়েছে। তারিন গ্রামে আসার পর থেকে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। এক মুহূর্তের জন্যেও ছাড়ে নি। দিশা কোথা থেকে খবর পেয়ে এখানে এসেছে কে জানে? এসে থেকেই তামজিদের পাশের থেকে উঠে নি৷ ভদ্রতার খাতিরে শোকের বাড়িতে কোনো ধরনের ঝামেলা করতে চাচ্ছিলো না, তারিন। তাই এতক্ষণ কিছু বলেনি। কিন্তু এবার আর সহ্য করতে পারলো না। উঠে গিয়ে তামজিদের কাঁধে হাত রাখলো। তামজিদ তারিনকে দেখেই শান্ত স্বরে বলল,
“আমার পাশে বসো। কোথাও যেও না।”
তারিন এবার যেনো মনে শক্তি পেলো। দিশার উদ্দেশ্যে শান্ত স্বরে বলল,
“দিশা আপু, আপনার না আজকে ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার কথা?”
দিশা শান্ত বাক্যে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ। চলে যাবো। আমার একটু সমস্যা ছিলো তাই যাওয়ার ডেট একদিন পিছিয়ে দিয়েছি।”
তারিন সে বিষয় আর কথা বাড়ালো না। সরাসরি বলে উঠল,
“দেখুন দিশা আপু, আমাদের শোকের মাঝে আজকে কোনোরকম সিনক্রিয়েট করবেন না, প্লিজ। কালকে থেকে আমি আপনাকে যথেষ্ট সুন্দর ব্যক্তিত্বের মানুষ হিসেবে জেনে আসছি। তাই এমন কোনো কাজ করবেন না যেটা আপনার ব্যক্তিত্বকে খারাপ বানিয়ে দিবে। আপনি আমাদের এই শোকের দিনে আমাদের পাশে থাকতে এসেছেন আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু বার বার আমার স্বামীকে এভাবে স্পর্শ করবেন না। আমার সেটা ভালো লাগেনা।”
দিশা প্রতিউত্তরে বেশ শান্ত গলায় জবাব দিয়ে উঠল,
“তাজ, আমার বেস্টফ্রেন্ড। তাই আমি ওর সাথে ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ার করছি।”
তারিনও বেশ শক্তপোক্ত স্বরে বলল,
“আপনি, আমি এই ব্যবহারকে বন্ধুত্বপূর্ণ মনে করলেও, গ্রামের সবাই সেটা করবে না। বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগে বেশ! দয়া করে একটু সরে বসুন।”
দিশা কোনো কথা না বলে চুপচাপ সরে বসলো। কিন্তু তামজিদ আর সেখানে বসতে চাইলো না৷ তারিনের উদ্দেশ্যে বলল,
“বাবা কোথায়?”
তারিন ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“বাবা রুমে আছেন। বাবার প্রেশার লো হয়ে গেছে।”
“বাবার, কাছে চলো।”
বলেই তারিনের হাত ধরে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। দিশা তৎক্ষনাৎ আর বসে থাকলো না। নিজেও নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। তামজিদ ঘরে আসতেই আমজাদ সাহেবকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কেঁপে উঠল। আমজাদ সাহেবের পাশে গিয়ে বসলো। ছেলেকে দেখেই তিনি কঠিন শোকে মুষড়ে পড়লেন। ছেলের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন। তামজিদ অশ্রুসিক্ত স্বরে বাবাকে স্বান্তনা দিতে বলে উঠল ,
“তুমি এতোটা ভেঙে পড়ো না, বাবা। তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে আমাদের কি হবে? এখন তুমিই আমাদের মাথার উপর ছাদ, বাবা৷ তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা কি নিয়ে বাঁচবো?”
এবার তারিনও আমজাদ সাহেবের পাশে বসল। আমজাদ সাহেবের হাত ধরে বলল,
“সেই বিয়ের দিন থেকে আপনি আর মা আমাকে আগলে রেখেছেন। নিজের পরিবারের অভাব, বাবা মায়ের অভাব বোধ করতে দেন নি। মা, তো আমাকে সংসার বুঝিয়ে না দিয়েই চলে গেলো। এখন আপনিই আমাদের সম্বল, বাবা৷ আপনি না থাকলে আমরা কি নিয়ে থাকবো? আপনাকে নিয়েই মায়ের সব থেকে বেশি চিন্তা ছিলো। আপনাকে আমি দেখে রাখবো, বাবা। আপনার কোনো অযত্ন হতে দিবো না। আমি আছি তো। আপনি, আমি, আমরা সবাই মিলে মায়ের সংসার খুব যত্নে আগলে রাখবো।”
আমজাদ সাহেবের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটলো। মানুষ বেঁচে থাকতেই কত আদর যত্ন। ম’রে গেলে কতক্ষণে মাটিতে রাখবে সেই আয়োজন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে গেলো। তামজিদেও এবার মাকে শেষ বিদায় দেওয়ার সময় এসে পড়ল। লাশটাকে কবরে নামানোর জন্য ধরতেই ওর হাত কাঁপছিলো। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। কি নির্মম এ দৃশ্য! সন্তান নিজের হাতে মাকে কবরে রাখছে। নিয়তি বড্ড নিষ্ঠুর! মাটি দেওয়ার পালা শেষ হতেই একে একে সবাই বিদায় নিলো। আমজাদ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন সবাই ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে রইলো তামজিদ একা। সবাই চলে যেতেই ধপ করে বসে পড়লো কবরের পাশে। কবরটাকে জড়িয়ে ধরল দুই হাতে৷ এবার গলা ফাটিয়ে ‘মা’ বলে চিৎকার করে উঠল। শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। কান্নারত স্বরেই বলতে লাগলো,
“মা, কেনো আমাকে একা রেখে গেলে? আমাকে এতিম করে কেনো গেলে? আর কয়েকটা বছর আমার সাথে কি এমন ক্ষতি হতো? তোমাকে আমি একটুও সুখ দিতে পারলাম না, মা। তোমার সুখের জন্যই তো নিজের ভালোবাসাকে বির্সজন দিয়েছিলাম। তোমার পছন্দের মেয়েকে বউ করে এনেছিলাম। তোমার সাজানো গুছানো সংসার ফেলে কোথায় চলে গেলা, মা?”
তামজিদ কাঁদছে। নিজের মাকে হারিয়ে ফেলার শোক সহ্য করতে পারছে না। তানহার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নিজের বোনের পাশেও থাকতে পারছে না। সবদিকের শোক সহ্য করে কি করে মানুষ? তামজিদ ও আর পারছে না। হাঁপিয়ে গেছে। এশারের আযান হচ্ছে চারদিকে৷ তারিন আর তারিনের মা এসেছে তামজিদের কাছে। তারিন আসতেই তামজিদ তারিনকে ঝাপটে ধরল।তারিনকে বুকের মধ্যে আগলে নিয়ে কাঁদতে লাগলো। তারিনও কাঁদছে। ছেলেটাকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা ওর জানা নেই। সুস্থ হয়ে উঠা মানুষটা আজ মাটির নিচে। ভাবতেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে তারিনের। কি ভেবেছিলো? আর কি হয়ে গেলো! এই দুনিয়াতে আজকে থাকতে কালকের আশা নেই। কালকে ভোর আমাদের জীবনে আসবে নাকি তার কোনো গ্যারান্টি নেই। অথচ আমরা এই মিছে দুনিয়ার কতশত স্বপ্নে বিভোর থাকি সারাক্ষণ। তামজিদ অনেকক্ষণ যাবৎ কাঁদছে। এবার তারিনের মা সালেহা খাতুন এগিয়ে আসলেন। তামজিদের মাথায় হাত রাখলেন। আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“বাজান, কান্দো ক্যান? আমি আছি না? তোমার আরেক মা। তোমার মায়ের মতোন অতো আদর, যত্ন করতে পারুম কিনা জানি না। কিন্তু আমার পোলা, মাইয়া যেমন আদর যত্নে থাকবো। তুমিও থাকবা। আমারে মা কইবা। আমার আরেক পোলা তুমি। আমার বড় পোলা। কান্দে না, বাজান। লও ঘরে লও। কানলে আফার কবরে আযাব হইবো, বাজান। আহো, আমার লগে লও। নামাজ পড়ো গিয়া। দুইডা হাত তুইলা আল্লাহ রে কও, আফারে যেনো আল্লাহ বেহেশত নসিব করে।”
তামজিদ একটু শান্ত হলো। অন্তত কেউ একজন মায়ের মতো আগলে তো নিচ্ছে। স্বান্তনা তো দিচ্ছে। তারিন আর তামজিদকে নিয়ে রুমে চলে আসলো। তামজিদ ফ্রেশ হয়ে সোজা মসজিদে চলে গেলো নামাজ পড়ে। নামাজ পড়ে এসে মায়ের কবরটা একবার ঘুরে আসলো। রাত বাড়লো। বাড়ি আস্তে আস্তে নিস্তব্ধ হতে শুরু করলো৷ তামজিদ মায়ের ঘরে একবার ঘুরে আসলো। কই মা নেই তো! ঘর ভর্তি মানুষ৷ কিন্থ মা নামক মানুষটা নেই তো! কষ্টে আবারো বুক ভারী হয়ে উঠল। নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়৷ চোখের উপর হাত রেখে সটান হয়ে আছে। কিছুসময় পর রুমে তারিনের উপস্থিত টের পেতেই, তামজিদ শান্ত বাক্যে বলল,
“লাইটটা একটু অফ করে দাও, তারিন। মাথা যন্ত্রণা করছে।”
তারিন শুনলো না। তামজিদের পাশে গিয়ে বসলো। তামজিদের হাতটা সরালো। শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“উঠুন। একটু কিছু খেয়ে নিন। সেই সকাল থেকে না খাওয়া। এবার না খেলে শরীর খারাপ করবে।”
“খাবো না।”
“দেখুন, আপনি তো মায়ের বড় ছেলে। মায়ের ভরসার জায়গা। আপনার উপরেই এখন বাবার দায়িত্ব। আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে, বাবাকে সামলাবে কে? একটু নিজেকে শক্ত করুন। আমি আছি তো আপনার পাশে। আপনার এত চিন্তা কিসের? আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, মায়ের সাজানো সংসার আমি এলোমেলো হতে দিবো না। মায়ের মতো করে পারবো কিনা জানিনা, তবে দুইহাতে মায়ের সংসার সাজিয়ে রাখবো। বাবার খেয়াল রাখবো। নিজের স্বপ্নও পূরণ করবো।”
তামজিদ অবাক চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। এইটুকু একটা মেয়ে কি সুন্দর করে সবাইকে সামলে রাখছে? কে বলবে মেয়েটা সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে? কথা শুনে কারো সে কথা বোঝার সাধ্য নেই ? তারিন তামজিদকে টেনে উঠে বসালো। ভাত মেখে তামজিদের মুখে তুলে ধরে বলল,
“হা করুন।”
তামজিদ চেয়ে আছে তারিনের দিকে। মেয়েটাকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। তারিন খুব যত্ন করে তামজিদকে খাইয়ে দিলো। সাথে একটা পেইনকিলার খাইয়ে দিলো। তারপর বলে উঠল,
“এবার একটু ঘুমান। আমি আছি এখানেই।”
তামজিদও কোনো প্রতিক্রিয়া না করে শুয়ে পড়লো। তারিন লাইটটা বন্ধ করে এসে তামজিদের মাথার পাশে বসলো। আলতো হাতে তামজিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
“বয়সের সাথে ম্যাচুরিটি আসে___কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। শুধু বয়স না। সময় ও পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে করতে একটা মানুষের মধ্যে ম্যাচুরিটি আসে।”
তারিন মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“কাল থেকে এক নতুন সংগ্রাম শুরু হবে৷ সংসার নামক শক্ত সুঁতোয় বাধা পড়ে যাবে সারাজীবনের জন্য। এই ভেঙে পড়া সংসার ও মানুষগুলোকে সাজিয়ে তুলতে হবে নিজের হাতে। নিজের স্বপ্নও পূরণ করতে হবে। সবটা একা হাতে সামলাতে পারবো তো?”

#চলবে