আমার নিঠুর মনোহর ২ পর্ব-০৪

0
144

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_চার

দৌড়ে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠার সময় কারোর একজনের সাথে ধাক্কায় সোজা নিচে পড়ে যায় নিহা। ৪/৫টা সিড়ি বেয়ে নিচে পড়ায় বেশ ব্যাথা পেয়েছে কোমরে, মাথায়। তবে বড় কোনো ব্যাথা লাগেনি। নিচে পড়েই নিহা ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে,
“আল্লাহ, গো! আমার কোমড়ডা শেষ। তারুউউ, ম’রে গেলাম।”
নিহার চিৎকার কানে যেতেই তারিন, তামজিদ সহ বাকিরা হন্তদন্ত হয়ে সিড়ির গোড়ায় আসতেই দেখলো নিচে সিড়ির নিচে পড়ে আছে। পাশেই নেওয়াজ বেশ শান্ত হয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে৷ তামজিদ দৌড়ে নিচে আসলো। নিহাকে টেনে উঠাতে উঠাতে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এভাবে পড়ে গেলে কিভাবে? দেখে হাঁটবে তো?”
নেওয়াজ এবার মুখ খুললো। গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“অন্ধ মানুষ আবার দেখবে কিভাবে?”
নিহা রেগে ফুলে উঠলো। বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,
“এক ঘুষি দিয়ে থুতমা ভস্কায় দিমু। আমি কানা আপনার ক…।”
এবার মানুষটার মুখের দিকে তাকাইতেই ‘মা-গো’ বলে চিৎকার করে তামজিদের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো৷ নিজেই নিজেই বলা শুরু করলো,
“এ বেডা এহানে কেন? হায় হায় এহন আমি তারে যেখানে খুশি সেখানেই কল্পনায় দেহা শুরু করছি? নাহ! আজকে যাইয়াই মায় এ কমু, আমারে একটু ঝাড়াপোঁছা দিয়ে আনতে। মাথায় ওই বেডার ভূত ঢুকছে।”
নিহা এবার তামজিদের উদ্দেশ্যে বললো,
“আচ্ছা দুলাভাই, আমি যা দেহি আপনিও তাই দেহেন?”
তামজিদ জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি দেখো?”
নিহা উত্তরে বললো,
“আমি দেখতাছি পেঁচার মুখ করে দাঁড়াইয়া থাকা এক খব্বিশ বেডারে।”
তামজিদ থতমত খেয়ে গেলো। এ মেয়ে বলে কি? কার উদ্দেশ্যে বলে? তারিন উপর থেকে নিহার অবস্থা দেখে হাসছে। নেওয়াজ আর তামজিদ দুজনে পরিক্ষার কয়েকদিনে ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে। বাসায় আজ যেহেতু সবাই মিলে একটা ছোট খাটো পার্টির আয়োজন করেছে, সেহেতু তারিনের কথায় তামজিদ নেওয়াজকেও ইনভাইট করেছে৷ এদিকে নিহাকেও তারিন ইনভাইট করেছে। এখন নিহার অবস্থা দেখে ওর পেট ফেটে হাসি আসছে। নেওয়াজ নিহার হাত ধরে টেনে বের করে সামনে আনলো। তারপর গম্ভীর স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“নাও, দেখো। ভালো করে দেখো। আমি কোন গাছের পেঁচা? আমাকে কোন গাছে ভালো মানাবে? বলো?”
নিহা অতিরিক্ত শকে চুপ মেরে আছে। কথা বলতে পারছে না। তারমানে সত্যি নেওয়াজ এখানে এসেছে। কিন্তু কেনো? এ বাসায় তার কি কাজ? আগে তো কখনো দেখেনি। তাহলে আজ কিভাবে আসলো? নেওয়াজের মুখের ভয়ংকর অবস্থা দেখে নিহা আর এই প্রশ্নগুলো করায় সাহস পেলো না। কোনোরকমে মেঁকি হেসে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার। আল্লাহ হাফেজ, স্যার।”
বলেই এক দৌড়ে তারিনের কাছে এসে দাঁড়ালো। ধুম করে তারিনের পিঠে কিল মেরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“তুই ইচ্ছা কইরা আমারে এমন বলদ বানাইলি। দেহিস তোর পোলাপাইনের হাগা মুতা আমি পরিষ্কার করুম না।”
নিহার কথা শুনে উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তা দেখে নিহা লজ্জা পেয়ে ছাদের এক কোনে গিয়ে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।



সন্ধ্যা হয়ে আসতেই সবাই ছাদে চলে আসলো। রান্না করার জন্য গ্যাসের চুলাটা অব্দি ছাদে নিয়ে এসেছে। তামজিদের বন্ধুরা মিলে পুরো ছাদে লাল, নীল, নানারকম লাইট দিয়ে সাজিয়েছে। পুরো ছাদ আলোতে ঝলমলে করছে। জুঁই, খুশবা, নিহা, তারিন মিলে বসে গল্প করছে। নিহা একেকটা মজার কথা বলছে আর সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠছে। নেওয়াজ, তামজিদ বাজারে গিয়েছে। বাকিরা সবাই রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ তানহা একটু নিচে আছে নিজের কাজে ব্যস্ত৷ আর মাইশা তামজিদের বন্ধুদের সাথে হাত হাত মিলিয়ে কাজ করছে। গল্প করছে। টুকটাক হাঁটছে। খুশিতে এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করা হবে। রান্নার দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে মুজাহিদের উপর বাকিরা সবাই সাহায্য করবে। তামজিদ আর নেওয়াজ হাতে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেট, কোল্ড ড্রিংস নিয়ে এসে রাখলো৷ তামজিদ বেশ ঘেমে গেছে তাই সোজা এসে তারিনের সামনে বসে পড়লো। বলল,
“ঘামগুলো একটু মুছে দাও তো, সোনা।”
কথাটা শুনে তারিন একটু লজ্জা পেলেও ঠোঁট চেপে হাসলো। দুইহাতে যত্ন সহকারে তামজিদের ঘাম মুছে দিতে লাগলো। তা দেখে রিহাব বেশ অসহায় স্বরে বলল,
“আজ আমার কেউ নেই বলে।”
খুশির কানে কথাটা যেতেই খুশি গর্জে উঠে বললো,
“তুই একটু সাইডে আয় তো।”
ওমনি রিহাবেফ মুখখানা চুপসে গেলো। আমতা আমতা করে বললো,
“আরে বেবি, আদর দেওয়ার হলে সবার সামনেই দাও। সাইডে যাওয়ার কি দরকার? আমার বুঝি লজ্জা লাগে না, দুষ্টু।”
বলেই রাফির শার্ট দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করলো।
লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাসলো। তা দেখে মুজাহিদ বলল,
“হিজলা গো মতো শুরু করছে, শালায়।”
রাফিও তাল মিলিয়ে বললো,
“হিজলা গো মতো না, ওয় হিজলাই।”
আরো একবার হাসির রোল পড়ে গেলো। রিহাব গর্জে উঠে বললো,
”আমি হিজলা নাকি পুরুষ দেখাবো?”
রিহাব কথাটা বলতে দেরি সবার একসাথে বলতে দেরি হলো না,
“দেখা।”
রিহাব বেচারা এবার সত্যি সত্যি লজ্জা পেয়ে গেলো। আস্তে করে সাইড কেটে দূরে সরে গেলো। মনে মনে ভাবলো,
“এই মুহূর্তে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এখানে থাকা মোটেও সেফ না৷ আমি যেই আধ পাগল গো বসবাস করি। না জানি ধরে বেঁধে আমার লজ্জা হরণ করে নিয়ে যাবে।”
ভেবেই নিজের প্যান্টটা শক্ত করে দুই হাত দিয়ে ধরে উল্টো দিকে দৌড় মা’রলো।
তা দেখে সবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। একমাত্র তামজিদ বিরক্ত হচ্ছে। বিরক্তি ভরা স্বরে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“এই তোদের আজকে এখানে আসতে কে বলেছে? আমরা হবু বাবা-মা হচ্ছি। কোথায় আমাদের একটু প্রাইভেট টাইম কাটাতে দিবি, তা না করে ডিস্টার্ব করতে চলে এসেছিস।”
তা শুনে রাহিম মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“এতবছর যখন যৌবনে তালা লাগিয়ে ঘুরছিলা তখন এত প্রেম কই ছিলো, মামু?”
কথা শুনেই নিহা ভেটকি মাছের মতো হাহা করে হেসে উঠলো। তামজিদ লজ্জা পেয়ে উঠে বসলো। ধমক দিয়ে বলে উঠল,
“আর একবার বাজে কথা বললে তোর কপালে কি শনি আসবো নিজেও জানোস না। নিজের ভালো চাস তো, চুপ থাক।”
রাহিম চুপ করলো না৷ বরং দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
“জনগণ আমার মাথায় একটা গান আসছে। গাইবো?”
নেওয়াজ সবার আগে বললো,
“শুরু করো, ভাই।”
রাফি মিনমিনিয়ে বললো,
“আপনি তো আর জানেন না ভাই, ও কি গান গাইবো? আজকে ওর দুঃখ কেউ ঠেকাইতে পারবো না।”
অয়ন রাহিমকে সাবধান করে বললো,
“থাক আর গান গাইতে হবে না। সবাই কাজে যাও।”
রাহিম কি আর শোনার পাত্র। অবাধ্য ছেলের মতো বললো,
“আরে একটু গাই৷ দুই লাইন বেশিনা। গানটা পেটের মতো গুঁতাগুঁতি করতাছে। না গাইলে পায়খানায় যাইয়াও শান্তি পাবো না।”
অয়ন ওমিনমিনিয়ে বলল,
“শুরু কর ভাই। আজকে তোর চল্লিশা খেয়েই এখান থেকে যাবো।”
রাহিম সে কথায় পাত্তা দিলো না। বেসুরা গলায় শুরু করলো,
“এত বছর ঘুরছি আমি যৌবনে তালা ঝুলাইয়া,
আজ কেন তবে যৌবন দেয় লাড়াচাড়া,
বুড়া বয়সে গেলো যৌবনের তালা খুলিয়া,
এখন বন্ধু মানাইতে পারিনা পিরিতের জ্বালা।
আহা সে কি এক যন্ত্রণা! প্রাণে যে সয় না।”
রাহিমের গান শেষ হতেই সবাই মুখ চেপে হাসছে। তামজিদের ভয়ে কেউ জোরে হাসার সাহস পাচ্ছেনা। আর তারিন নিজের দম ফাটা হাসি আটকানোর জন্য মাইশাকে কোলে তুলে অন্য দিকে সরে গেলো। নিহা তো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নেওয়াজ বেচারা আহাম্মকের মতো বসে আছে। গান শেষ হতেই বুকের বা পাশে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজে নিজেই বলল,
“জীবনে এমন একটা গান হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”
রাহিম গানটা শেষ করেই ভাব সাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন বানিয়েছি বল গানটা?”
তামজিদ এবার উঠে দাঁড়ালো। বাঁকা হেসে বললো,
“আমি বলছিস, দোস্ত।”
রাহিম হাসলো। বলল,
“আরে তুই তো বলবি।”
তামজিদ এসে রাহিমের সামনে দাঁড়ালে। হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,
“খুব গান গাওয়ার শখ তাইনা, দোস্ত?”
রাহিম হাসলো। তামজিদের মতিগতি দেখে আমতা আমতা করে বলল,
“আরে না একটু-আধটু।”
তামজিদ এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তাহলে চল আমরা একটু গান গেয়ে আসি।”
বলেই রাহিমের কাঁধে হাত রেখে দুজনে মিলে সিড়ির দিকে অন্ধকারে নিয়ে গেলো। মুজাহিদ রাহিমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলল,
“আজ বেচারার জীবন যৌবন সব শেষ হয়ে যাবে রে।”
বলতে না বলতেই রাহিমের ‘আ আ আ আ আ’ চিৎকার ভেসে আসলো। সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। কি হয়েছে? ঘটনা অনুসন্ধান করার জন্য নেওয়াজ সেদিকে পা বাড়াতেই তামজিদ বেরিয়ে আসলো৷ নেওয়াজকে আটকে দিয়ে বলল,
“আরে কিছু হয় নি৷ শুধু এমন অবস্থা করে দিয়ে এসেছি যে এখন আধা ঘন্টার মধ্যে ওর গান গাওয়া থামবে না। যখনি মুখ খুলবে তখনি গান বেরোবে।”
কেউ তামজিদের কথা বুঝলো না। মুজাহিদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি করেছিস তুই?”
তামজিদ শয়তানি হাসি হাসলো। বললো,
“বেশি কিছু না। ওর ভবিষ্যতে প্যান্টের চেইন আটকে দিয়ে এসেছি।”
কথাটা বলেই তামজিদ পুনরায় মেঁকি হেসে তারিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“বউ তুমি কোথায়? আসো তো তোমাকে একটু আদর করি। আমি তোমার আদরের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছি।”
বলেই তামজিদ সেদিকে চলে গেলো। আর রাহিম ওখান থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“তোর যৌবনে আবার ঝং পড়বো, শালা। আমার বন্ধু হয়ে তুই এই বেঈমানীটা করতে পারকি কি করে?”
রাহিমের কথায় সবাই আবার হাসা শুরু করলো। রাহিম প্যান্টের চেইন ঠিক করে, এবার তেড়ে এসে বললো,
“তোরা তো হাসবিই। তোরা কি করে বুঝবি এই কষ্ট? তোগো উপরে ঠাডা পড়বো, ঠাডা।”
বলেই বাইরে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু সবার হাসাহাসি বন্ধ হলো না।



নাচ গানে আড্ডায় সবাই মিলে মেতে উঠেছে। রান্নাও অর্ধেক হয়ে এসেছে৷ তাড়াতাড়ি খেয়ে সবাই ছাদ থেকে নেমে পড়বে। তারিনের এই শরীরে ছাদে থাকা ঠিক হবে না ভেবে তানহা বারণ করেছে। বলে গেছে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসতে৷ মাইশা ঘুমিয়ে গেছে বলে তানহাও চলে গেলে। এতক্ষণে নেওয়াজ আর নিহার মধ্যেও বেশ ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবাই তারিনের কথা চিন্তা করে রান্না শেষ হতেই খাবার নিয়ে নিচে নেমে আসলো। ড্রয়িং রুমে পাটি বিছিয়ে সবাই খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ হতেই সবার বিদায় নেওয়ার পালা। একে একে সবাই বিদায় নিলো। নেওয়াজ নিহাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিলো৷ রাহিম বেচারা যতক্ষণ ছিলো ততক্ষণ সবাই ওকে নিয়ে মজা নিয়েছে। সবাই চলে যেতেই তামজিদ দরজা আটকে হাঁফ ছেড়ে বললো,
“ঝড়-তুফান বয়ে গেলো সেই বিকেল থেকে।”
তারিন মুচকি মুচকি হাসছে দেখে রেগে প্রশ্ন করলো,
“এমন বলদের মতো হাসছো কেনো?”
তারিন বলল,
“একটা প্রশ্ন করি?”
তামজিদ কপাল কুঁচকে বললো,
“কবের থেকে আবার পারমিশন নেওয়া শুরু করলে?”
তারিন ভেংচি কাটলো। পুনরায় হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো,
“আপনি কি সত্যিই এত বছর যৌবনে তালা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন?”
তামজিদ বোকাবনে বলে গেলো। ওর বউ ওকে এত বড় একটা অপমান করতে পারলো? তারিন পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আস্তে করে সাইড কেটে রুমে চলে গেলো। তা দেখে তামজিদ কপাল চাপড়ে বলে উঠল,
“ও খোদা, আমার বউটারেও ওরা পাঁকায় দিয়া গেছে। এ জীবন যৌবন রেখে কী লাভ? শুধুমাত্র ক্রিকেট টিম বানানোর আশায় যৌবন রেখে দিছি। নয়তো কবেই কচু গাছের সাথে লটকায় থাকতাম।”

#চলবে