আমার ললিতা পর্ব-১২+১৩+১৪

0
756

#আমার_ললিতা
#পর্ব:১২
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“সৃষ্টিকর্তা বোধহয় কারো দোয়া ফিরিয়ে দেননা।দীর্ঘ কয়েক বছর সন্তানহীনতায় ভুগতে থাকা রহমতের ঘরে আলো করে এসেছিল দুটো জমজ কন্যা।এলাকার সকলে অবাক হয়ে দেখেছিল দুটো পদ্ম দেহের শিশু কন্যাকে।দীর্ঘকাল শুষ্ক হয়ে থাকা রহমতের অন্তর পিতৃস্নেহের পরশে সিক্ত হয়ে উঠলো।দুটো মেয়ের পর একটি পুত্রেরও বাসনা করলো সে।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এবার সহায় ছিলেন না তার।কহনা ও অহনা নামের মেয়ে দুটোকে আগলে বড় করতে লাগলো।রহমত সেকেলে মানুষ হলেও বেশ সৌখিন ছিলেন।মেয়েরা বড় হলে তাদের জন্য স্বামী নির্বচনের ক্ষেত্রে চিন্তা ও ভাবনায় সেই শৈল্পিকতা বজায় রাখলেন।কিন্তু সময় অতিক্রম হতে হতে সে বুঝতে পারলো তার মেয়ে কহনার স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না।ঠান্ডা মেজাজ বা নীরব যুদ্ধ খেলা করে তাদের মধ্যে।চিন্তিত হলো রহমত।সৃষ্টিকর্তার নিকট আবার প্রার্থনা করতে লাগলো।এবারও কবুল হলো।কহনা নামক সুন্দরীর গর্ভে জন্ম নিলো এক রাজপুত্র।যে আগুনের দেশের রাজা।সব অনুভূতিকে কাঠের মতোন জ্বা’লি’য়ে পু’ড়ি’য়ে ফেলতে পারে।এজন্য তার নাম হলো অনল।অনল মীর।যে জন্ম নিয়েছে নিজের বাবাকে নাস্তানাবুদ করতে করতে।আর তুমি ললিতা!সাধারণ বাইশ বছরের তরুণী হয়ে কীনা তাকে অগ্রাহ্য করছো?ভীষণ খারাপ বিষয়।নানা থাকলে তোমার সুবুদ্ধির জন্য এখুনি হাত তুলে দোয়া করতো।”

মুখের অনুভূতি পরিবর্তন না করে কেউ কথা বলতে পারে?যেখানে সে নিজের জন্ম ইতিহাস শুনিয়ে চলেছে।বেলী অদ্ভূত ভঙিমায় অনলকে দেখছে।আত্ম প্রশংসায় ডুবে গিয়ে লোকটা বোধহয় সমস্ত তাল গুলিয়ে ফেলেছে।মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিলো কোনো জবাব দিবেনা।গাড়ীর কাঁচ গলিয়ে পিচ ঢালা রাস্তার পানে তাঁকালো।রাতের ঢাকা যেন সবথেকে প্রাণবন্ত।যদিও এখন রাত বলা চলেনা।সন্ধ্যা এক্ষেত্রে মানানসই শব্দ।বেলী প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বলল,

“আমার জীবনে আপনি যেদিন থেকে এসেছেন সেদিন থেকে ঝামেলা শুরু করে দিয়েছেন।সত্যি করে বলুন তো সেই বিশেষ চিঠিদাতা আপনি কীনা?”

“এটা উহ্য বিষয় ললিতা।খুঁজে বের করতে হবে।জানো তো বের করতে পারলে তোমার জন্য উপহার আছে।”

“সেটি কী?আপনার লাইব্রেরির বইগুলো?”

অনল অদ্ভূতভাবে বেলীর দিকে তাঁকালো।যেন তার হৃদপিন্ডের বিশেষ অংশ সে চেয়ে বসেছে।মুখটা গম্ভীর করে বলল,

“বইয়ের সঙ্গে কারো সম্পর্ক নেই ললিতা।তুমি চাইলে আমি কিনে দিতে পারি।”

“ইশ!আপনার টাকায় বই কেন কিনবো আমি?”

“ধরে নাও গিফট।”

“কী উপলক্ষে?এখনও আমি বিষয়টি খুঁজে বের করতে পারিনি।”

“মন থেকে মেনে নিলে উপলক্ষ হতে কোনো কারণ লাগেনা।প্রথমবার আমরা ডেইটে এসেছি।বিশেষ কিছু চাইতে পারো।”

“একদম না।আপনি আমাকে বাসা অবধি লিফট দিয়েছেন।ডেইট শব্দ দ্বারা অসহ্যকর পরিস্থিতি তৈরী করবেন না।আমার ইচ্ছা নেই আপনাকে ডেইট করার।”

বেলীর কথাগুলোর বিনিময়ে অনল শুধু হাসলো।গাড়ী চলছে এখন দ্রুত গতিতে।এজন্য বাড়ীর সামনে পৌঁছাতে খুব বেশী সময় লাগলো না।

“কালকে আমার পরীক্ষা আছে।তাই যথা সময়ে আসতে পারবো না।খুব খারাপ এমপ্লয় আমি।বাদ দিয়ে দেন অনল।”

“যদি না দেই?এক মিনিট গত কয়েকদিন ধরে আমার লাইব্রেরি গুছানোর কাজে তোমাকে দেখা যাচ্ছে না।কেন ললিতা?বিচার দিতে পারি কিন্তু।”

“নিজে ডিসাইড করে নেন অনল।আমাকে দিয়ে ঠিক কী কী করাবেন।”

“সবই।অনলের সবকিছু তে তার ললিতা থাকবে।”

দীর্ঘ শ্বাস ফেললো বেলী।কথাগুলোর মর্মাথ যেন খুব বোঝা যায়না।গাড়ীর দরজা খুলে চলে যেতে নিলে চুল টেনে তাকে আঁটকে দিলো অনল।দ্রুততার সঙ্গে কাছাকাছি এসে বলল,

“এইযে যন্ত্রণা গুলো,প্রেমের বাক্যগুলো বুঝতে অক্ষম কেন তুমি ললিতা?”

“কারণ এ কথা যে সবাইকে অনল বলেনা সেই গ্যারান্টি কী?”

বেলীর নাকের ডগায় আঙুল ঠেকালো অনল।মৃদু ঘষে বলল,

“এক আছে জন্মগত অন্ধ।আরেকটা আছে স্বভাবগত অন্ধ।দুজনে রোগী।কিন্তু সমস্যা হলো জন্মগত যে সে দিব্যি সুখে থাকতে পারে।কিন্তু স্বভাবগত অন্ধ সুখগুলোর আসার সময় চোখ বন্ধ করে আজীবন দুঃখের জীবন পালন করে।যেমন তুমি।”

(***)

রাহিমা পা টিপে টিপে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো।এখন বাজে রাত তিনটে।চারিদিকে সুনসান নীরবতা।পুরোটা দুনিয়াটা যখন ঘুমে মগ্ন।তখন সে চলছে প্রেমের নতুন এক দ্বার জীবনে উন্মোচন করতে।পাশের বাড়ীর প্রেম।বেলীর ভাই সিয়ামকে ইদানীং সে অনেক পছন্দ করে।লোকটা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় মন্ত্রমুগ্ধের মতোন তাঁকিয়ে থাকে।শুনেছে বিসিএসের প্রিপারেশন নিচ্ছে।ইনিয়েবিনিয়ে তাইতো রাহিমা পড়ার বাহানা করেছে তার সঙ্গে।কিন্তু পুরুষটি কাঠখোট্টা।পাত্তা দিতে নারাজ।ছাদ থেকে দেখেছে সিয়াম বাগানের দোলনায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছে।ব্যস রাহিমার মনে হলো সে তার সঙ্গ চাচ্ছে।এজন্য চলেছে এতো রাতে সেখানে।ভাগ্য সহায় ছিলনা।অন্ধকারে দরজা খুলতে গিয়ে বেশ বিরক্তিকর একটি শব্দ হলো।অনল তখন নিজের ঘরে ছিল।সবার আগে তার কান অবধি গিয়েছে।দ্রুত নিচে নেমে আসতে লাগলো।ভাইকে দেখে বুদ্ধির উদয় হলো মেয়েটির।লুকিয়ে গেলো।দরজা এভাবে খোলা থাকতে দেখতে অনল সন্দেহ নিয়ে বাহিরে এসে দেখলো কেউ নেই।গেইটে দারোয়ান টুলে বসে ঝিমুচ্ছে।কোনোকিছু না পেয়ে সে ফিরে যেতে নিবে এমন সময় দেখলো বেলীদের বাসার ছাদের কার্নিশ ঘেষে একটি মেয়ে বসে বসে কাঁদছে।অবয়ব দেখে অনল অনুমান করতে পারলো সে তার ললিতা।বিতৃষ্ণাতে মন ভরে গেলো তার।দরজার সামনে বসে পড়লো।দূর থেকে পুরুষটিকে কেউ দেখলে এখন নিশ্চিত সুগঠিত শরীরের ইংরেজ ভেবে নিবে।অনলের অন্ত:করণে ঝড় বইছে এখন।বেলী যখন জানতে পারবে তার প্রেমিকের বিয়ের পিছনে অনল নিজে দায়ী ছিল।তখন?ঘৃণা করবে?সেটি কী করার কথা নয়?ভেতর থেকে একটি কণ্ঠ বলে উঠলো।কিন্তু অনলের আগ্রাসী মন জানে কীভাবে নিজের জিনিস নিজের করে রাখতে হয়।বেলী একান্ত তার নিজের।

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:১৩
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“এতো রাতে ছাঁদে কেন বেলী?কী হয়েছে কাঁদছো কেন?”

রেবেকা মাতৃস্নেহে আগলে নিলো বেলীকে।সে জানে তার এই ছোট মেয়েটি কতো বড় ভার বুকে বহন করে চলে রোজ।রামীমের ঘটনার সম্পর্কে একমাত্র সে ও বেলীর ফুপু বিস্তারিত জানেন।প্রেমিকের বিয়ে হোক বা মৃ’ত্যুর শোক কোনোটা ভুলতে পারেনা বেলী।কতো রাত রেবেকার এই আশংকায় কেঁটেছে যে তার মেয়ে নিজের কোনো ক্ষ”তি করবে না তো?আজও বিছানাতে না দেখতে পেয়ে অন্ত:করণে তীব্র বেদনা অনুভব করেছিলো।

“বেলী শান্ত হও।কষ্ট লাগছে?তুমি একা কেন ছাঁদে আসতে গেলে?”

“সত্যি মা অনেক কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে দমবন্ধ হয়ে আসবে।”

“ঘটনাটির বছর বছর অতিক্রম হয়ে গিয়েছে।নিজেকে সামলে নাও।ভবিষ্যতের আশায় স্বপ্নের জাল বুঁনো।”

“সত্যি কী মা এতো সহজ?”

বেলী মুখ উঁচু করে অবাক হয়ে শুধায়।যেন সে ছোট্ট একটি বালিকা।মায়ের কাছে রুপকথার সত্যতা জানতে চাচ্ছে।রেবেকা তার গালে হাতের স্পর্শ করে বলল,

“খুব কঠিনও নয়।তুমি যেদিন থেকে ডিসিশন নিবে রামীমকে মনে করে কাঁদবেনা সেদিন থেকে দেখবে কষ্ট কমে আসবে।তোমার মন সত্যিকার অর্থে কখনো ভুলতে চায়নি।দেখো তো সেই পুরোনো দোতালা বাড়ীটা ভেঙে কী রাজপ্রাসাদ গড়ে উঠেছে।পূর্বের স্মৃতি কোথায়?প্রকৃতি কিন্তু অতীতকে সহজে শেষ করে দিতে পারে।”

“মা সে যদি জীবিত থাকতো তবে সত্যি আমার কষ্ট কম হতো।যেখানে মানুষটার দেহ এতোদিনে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে সেখানে কষ্ট হওয়া কী স্বাভাবিক নয়?”

“যদি বেঁচে থাকতো তখন চিন্তা করতে যে কেন রামীম তোমাকে বিয়ে না করে বান্ধুবীকে করলো?মনে হতো নিশ্চয়।”

“মনে হতো।”

ভাবলেশহীন জবাব বেলীর।কান্নার দরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলছে এখন।

“বিশ্বাস করো সেটা বেশী য”ন্ত্র” ণার হতো।এখনও হওয়ার কথা।কিন্তু বেঁচে থাকলে সংসার করতে দেখতে বেশী খারাপ লাগতো।আমি কতো চেয়েছি ও ম’রে যাক।আমার মেয়েটা অন্তত শান্তি পাবে।অবশ্য ভালোই করেছে বান্ধুবীকে বিয়ে করে।তোমার জীবনটা নষ্ট হয়নি।”

রামীমের প্রতি রেবেকার মনে থাকা ঘৃণাগুলো স্পষ্টত টের পাচ্ছে বেলী।সে জানে কারণটা।অবশ্য সবাই জানে।তটিনীর বাবা মেয়ের খায়েশ মেটানোর জন্য রামীমের মতোন অসুস্থ ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিল।বেলী খুব বেশী গভীরে ভাবলো না।চোখ মুছে মায়ের কাঁধে মাথা রাখলো।হঠাৎ খেয়াল হলো সামনের বাড়ীর প্রবেশ পথে কেউ বসে আছে।গাছপালার আঁড়ালে ছায়াটিকে যে কেউ ভূত বলে বিবেচিত করে নিতো যদি না লাইট লাগানো থাকতো।স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছেলেটা বসে বসে সিগার টানছে।হঠাৎ বেলীর মনে হলো এ রাতে সবাই জেগে আছে।যার যার দুঃখ নিয়ে।

(***)

সিয়াম ভীষণ বিরক্তবোধ করছে এখন।কারণ অবশ্য রাহিমা নামক মেয়েটি।শুধু শুধু তার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে।বিশেষ পরিচিত হওয়ার লোভ যে মেয়েটির মধ্যে আছে সেটা স্পষ্ট প্রতীয়মান।অবশ্য সিয়াম জানে নারী সঙ্গ পেলে ভেতরে অনুভূতির সঞ্চারণ ঘটবে।আর ঠিক এটা হলে একজন পুরুষের সমস্যা।জীবনে আবেগ, অনুভূতিকে জায়গা দিলে ঠিক মহাপুরুষ হওয়া যায়না।রাহিমা হাসি হাসি মুখ করে সিয়ামের পাশাপাশি হাঁটছে।হঠাৎ বলে উঠলো,

“আপনার কী মনে হয়?এবার বিসিএস এ টিকবেন?”

“হ্যাঁ।”

“এতো ওভার কনফিডেন্স?যেখানে পরীক্ষা এখন অবধি হয়নি।”

“আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে।পড়াশোনা ঠিকঠাক আছে।তবে অবশ্যই টিকবো।”

“এইযে সিয়াম কোনো ঘুষের ব্যবস্থা করে রেখেছেন নাকী?”

সিয়াম ভয়ংকর ভাবে রাহিমার পানে তাঁকালো।নেহাৎ অপরিচিত মেয়ে মানুষ দেখে কিছু বলল না।

“তুমি কোথায় যাবে রাহিমা?”

“আপনি যেখানে যাবেন।”

“এক মিনিট!তুমি আমার সাথে যাবে বলে একসাথে বের হয়েছো?আশ্চর্য বিষয় তো।”

প্রশ্নের বিনিময়ে রাহিমা মিষ্টি করে হাসলো।কিছু প্রতিক্রিয়া দিবে এর পূর্বে কোথা থেকে একটা বাইক এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলো।এমন নয় সে মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছিল।তড়িঘড়ি করে সিয়াম তাকে উঠিয়ে শুধালো,

“ব্যাথা পেয়েছো?”

“ইশ,অনেক পেয়েছি।ওদের মায়ের নাম আজকে মনে করিয়ে দিবো।”

এবার তেড়ে গেলো বাইকের দিকে রাহিমা।ছেলেগুলো যতোবার মাফ চাচ্ছে ততোবার চিল্লিয়ে ধমক দিচ্ছে রাহিমা।ছোট একটা মেয়ের শাসনকে সহজে চড়ুই পাখির মৃদু ডাকের সঙ্গে তুলনা করা যাচ্ছে।অবশ্য যতো গর্জে ততো বর্ষে না।মিনিট খানেক বাদে ছেলেদের যেতে দিলো সে।সিয়ামের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বিরস মুখে বলল,

“আপনি শুধু জিম করেন না দেখে ছেলেগুলোকে যেতে দিলাম।তা নয় আজ খবর ছিল।”

“মানে?”

“আমার শরীর দেখেছেন?উল্টো আমি হলাম গিয়ে মেয়ে।ওদের সাথে দুহাত এক করলে জেতা সম্ভব হতো।শুনেন আজকে থেকে আপনি জিমে যাবেন।শুধু বুদ্ধি থাকলে হয়না।শক্তিও লাগে।”

“আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা মেয়ে।ইডিয়ট ব্যাথা পেয়েও মুখ কমেনি।”

রাহিমাকে কিছু বলতে না দিয়ে এগিয়ে গেলো সিয়াম।বিরক্তিতে মুখটা তেঁতো হয়ে এসেছে তার।রাহিমা পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তায়।

(***)

সিটি শেষ করার পর নিজেকে বেশ হালকা লাগছে বেলীর।এদিকে পেটে বেশ খুদা অনুভব করছে।সকালে খুব একটা খেয়ে আসেনি।আবার এখন অফিসে যেতে হবে।ভার্সিটি থেকে বের হয়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে রইলো বেলী।এহেন সময় চেনা পরিচিত একটি গাড়ী এসে থামলো তার সামনে।ভেতরে অনলকে আশা করেছিলো সে।একজন অচেনা মধ্যবয়স্ক লোক মাথা বের করে বলল,

“স্যার গাড়ী পাঠিয়েছে আপনার জন্য।”

“আমার জন্য?একটু বেশী অনুগ্রহ করছে সে।”

চালক লোকটি চুপ করে বেলীর গাড়ীতে উঠে আসার অপেক্ষা করলো।অবস্থার গম্ভীরতা বুঝতে পেরে বেলী গাড়ীতে উঠে এলো।খুব বেশী সময় লাগেনি অফিসে পৌঁছাতে।এদিকে বেলীর পেটে খুদাও বেড়েছে।অফিসের সবাই তাকে অবাক হয়ে দেখে।যেন তাদের জন্য বেলী এক প্রহেলিকা।অনলের কেবিনে পৌঁছে দেখলো সেটা খালি।কেউ নেই।কিন্তু টেবিলের উপর সুন্দর করে খাবার সাজানো।ছোট করে কাগজে লেখা “খেয়ে নিও ললিতা”। আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে বিষয়টি ভীষণ রোমান্টিক,কেয়ারিং।অথচ বেলীর হঠাৎ ভয় হওয়া শুরু করলো।পুনরায় কেউ কী সব ভেঙেচুরে তার জীবনে প্রবেশ করতে চাচ্ছে?আর তাও আবার আগুনের রাজা অনল!

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:১৪
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“ফোন করলে রিসিভ কেন করো না?আমি সত্যি বলছি তোমার সাথে চিট করিনি।”

ফোনের ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠের আকুলতা শুনে মটেও অনলের মন বদলালো না।কিন্তু জানে যাকে উদ্দেশ্য করে বলছে সে গলে যাবে।অনল ভেবে পায়না তার ভাই হয়েও অনিম কীভাবে এতো সহজ সরল হয়?নারীর মন অতি সুন্দর প্রহেলিকাকে ধরতে পারেনা।সে গম্ভীর সুরে বলল,

“অনিম ছাদে গিয়েছে।আমি ওর বড় ভাই বলছি।”

“ইশ!”

সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেঁটে দিলো মেয়েটি।ভুরু জোড়া কুঁচকালো অনল।নাম্বারটি কোনো নামে সেইভ করা নেই।পরবর্তীতে পুনরায় কল ব্যাক করলে রিসিভ করলো না।অনল ফিরে এলো মিনিট খানেক বাদে।ভাই কে ফোন হাতে বিমূঢ় হয়ে থাকতে দেখে শুধালো,

“কী হয়েছে ভাই?”

“তোর জিএফ কল করেছিলো।সে তোর সাথে চিট করেছে?”

“আমার জিএফ?মানে আমি রিলেশন কবে করলাম?নিশ্চয় সেই শয়তান অচেনা মেয়েটা কল করেছিলো।”

“কাহিনী খুলে বল তো।”

“বিশেষ কিছু না।তোমার মনে আছে কয়দিন আগে আমি স্কুল থেকে একটা ডিবেট প্রতিযোগীতা অংশগ্রহণ করেছিলাম?”

“মনে আছে।সেখানে জিততে না পেরে মায়ের কাছে এসে কান্না অবধি করেছিলি।”

অনিম ভীষণ ভয়ংকর ভাবে অনলের দিকে তাঁকালো।সে যে কান্না করছে তা তার মা নিজের বড় ছেলেকে বলে দিয়েছে?ছোট হওয়ার সত্যি তার কদর নেই বলে মনে করলো।বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে পুনরায় বলল,

“সেখানে নিজের নাম্বার দিয়ে ছিলাম আমি।সেখান থেকে একটা মেয়ে রোজ কল করে এমন এডাম টিজিং করে।”

“এডাম টিজিং?ঠিক কী কী বলে?”

“উদ্ভট সব কথাবার্তা।আজকে তোমাকে নিশ্চয় তেমন কিছু বলেছে।”

“ওরকম কিছুটা।এজন্য নিজের পরিচয় দেওয়ার পর ওমন ইশ করে উঠেছে।এতে বোঝা যায় বয়স কম।ব্লক করে দিতে পারিস।”

“করেছিলাম।পরে দেখি ফেইক আইডি খুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে কমেন্ট করে।এতো যন্ত্রণা দিচ্ছে।এমন নয় মেয়েটা রিলেশন করতে চাচ্ছে।জানো সেদিন আমাকে বলেছে আমার চুলগুলো দেখতে খুবই সুন্দর নাকী।কবে যেন কেঁ” টে নিজের ঘরে সাজিয়ে রাখবে।শো পিচ হিসেবে।”

“যেই হোক সে চঞ্চল।এবং রিলেশন নয় সত্যিভাবে তোর এটেনশন চাচ্ছে।যদিও এই চাওয়া হয় রিলেশনের পূর্ববর্তী ধাপ।তোর ক্লাসের কেউ হতে পারে?”

“না ওদের সবাইকে বোন বানিয়েছি আমি।”

“ছি:!আমার ভাই হয়ে দুই চারটে ক্লাসমেইটের সঙ্গে ডেইট করিসনি?ললিতার বাবা ঠিক বলেছিল। Moron ছেলে।”

“ললিতা?ইউ মিন বেলী আপু?”

“ইয়েস।”

“তুমি শয়তান।আর সে পবিত্র দেখতে কন্যা।পিছে গেলে মা” র খাবে।”

“আর সেটা কে দিবে?”

“আমি।”

অনল হেসে উঠলো।সে জানে অনিম নিজ ভাইয়ের সবগুণ আয়ত্ত্বে করলেও মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার গুণটা নিতে পারেনি।বরং খুবই ভদ্র।যদিও খুবই অনলের ভক্ত।

“আগে জিম জয়েন কর।এরপর দেখা যাবে কে কাকে হারায়।তোর সেই বিড়ালটা কোথায়?”

“এক ফ্রেন্ড নিয়েছে এডপশনে।ভালো আছে।”

“হুম গুড।মিস করিস না?”

বারান্দায় এখনও বিড়ালের জন্য কেনা বাবুইপাখির ঘরটা রয়ে গিয়েছে।তবে তা শূন্য।এবং নির্জনতায় ঘেরা।অনীম যে প্রাণিটাকে অল্প দিনে বেশ ভালোবেসে ফেলেছিল তা বোঝা যাচ্ছে।

“করি মিস।কিন্ত আমি ঠিকঠাক ওর দেখাশোনা করার মতোন সামর্থ্য রাখিনা।”

“এজন্য দূর করে দিলি নিজের থেকে?”

“যেখানে সে ভালো থাকবে সেখানে রাখা উচিত।আমি হয়তো সেটির দায়িত্ব পুরোপুরি নিতে অক্ষম ছিলাম।কারো ভালোর জন্য একটু কষ্ট দেওয়া বা সহ্য করা যায়।”

অনল নির্লিপ্ত ভঙিমায় কথাগুলোতে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়।মনের কোথাও আশা জেগে ওঠে।সকল মানুষ ভালো থাকতে চায় কিংবা প্রিয় জিনিসকে ভালো রাখতে চায়।সেখানে অনল নিজেও তো ব্যতিক্রম নয়।

(***)

বইগুলো সুবিন্যস্ত করে উঠে দাঁড়ালো বেলী।আজকে শুক্রবার বিধায় অফিস নেই।এই কারণে অনলের লাইব্রেরি গুছাতে চলে এসেছে।সত্যি বলতে এই কাজটাকে এখন সে নিজেও উপভোগ করে।বিশেষ কারণ হলো বইগুলো।গুছানোর ফাঁকে ফাঁকে একটা দুটো বই পড়েও শেষ করে ফেলেছে।আজ হাতে নিলো শরৎচন্দ্রের পরিণীতা।এই একটি উপন্যাস যে কতোবার পড়ে ফেলেছে সেটি বোধহয় বেলী নিজেও জানেনা।খুলে একটি দুটো পেইজ পড়ছিলো।হুট করে পুরুষালি কণ্ঠতে শুনতে পেলো,

“এই উপন্যাস মটেও তোমার মুখে হাসি আনার মতোন নয় ললিতা।অথচ একটি প্রশান্তমূলক হাসি তোমার ঠোঁটে লেপ্টে আছে।কেন?আমি তোমাকে ললিতা বলে ডাকি তাই?”

“কেন থাকবেনা?দেখেছেন কতো সুন্দর অনুভূতি শেখর ও ললিতার মধ্যে অনুভূতি প্রশান্ত ঢেঁউয়ের মতোন বয়ে যায়?আর আমি অনলের ললিতা হওয়াতে মটেও খুশি নই।এর থেকে বরং শেখরের ললিতা হলে ভালো হতো।আফসোস!”

বেলীর চোখেমুখে উপহাস।সে নেহাৎ মজা করে বিষয়টি বলেছে।দেখতে চাচ্ছে অনলের প্রতিক্রিয়া কেমন।অবশ্য সে প্রতিক্রিয়ার আশাও কেন করছে?চারপাশে দীর্ঘ নিরবতা উপলব্ধি করে বইয়ের পাতাতে মুখ ডুবিয়ে রাখলো বেলী।হঠাৎ করে তার ও অনলের মধ্যকার দূরত্ব কমছে।বেলী চোখের কিনারা দিকে তাঁকিয়ে বুঝতে পারছে।মাথা তুলে কিছু বলবে এর পূর্বে বইটা হাত থেকে নিয়ে দূরে ফেলে দিলো অনল।পুরুষটির দৈহিক গঠণের থেকে নারীটি ভীষণ ছোট।নিজের দিকে ঘুরিয়ে বেশ উষ্ণ সুরে অনল বলল,

“চোখ থাকতে অন্ধের অভিনয় কীভাবে করতে পারো মাই ললিতা?তুমি জানো না আমার সত্যিকারের রুপ কেমন।
I don’t mercy.তুমি শুধু অনলের ললিতা।হোক না শেখর ফিকশনাল।তবুও যেন আর কখনো না শুনি।”

“বলবো একশবার।কী করবেন?এইযে দেখেন আবারও বলছি আমি শেখরের ললিতা।শুধু শেখরের ললিতা ”

চলবে।