আমার ললিতা পর্ব-৪৮ এবং শেষ পর্ব

0
1322

#আমার_ললিতা
#পর্ব:শেষ পর্ব(প্রথম অংশ)
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

বেলী দীর্ঘ সময় যাবত অনলের পানে তাঁকিয়ে আছে।সে অবাক হচ্ছে।পৃথিবীতে তাকে কেউ এতো ভালোবাসে!সেটা সে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা।অনল ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বেলীর সামনে দাঁড়ালো। তার চোখে অদ্ভুত কোমলতা যেন সে বেলীর প্রতিটি ভাবনা বুঝতে পারছে।কাছে এসে তার ললিতার গালে হাত ঠেকিয়ে বলল,

“এভাবে তাকিয়ে রয়েছে কেন ললিতা?”

বেলী কিছু বলে না। তার বুকের ভেতর কেমন যেন অজানা এক অনুভূতি কাজ করছে—অবিশ্বাস, বিস্ময়, আর গভীর প্রশান্তি। সে কি সত্যিই এতটা ভালোবাসার যোগ্য?যার জীবন ঠিক নেই তাকে ভালোবাসার জন্য এতো সুন্দর পুরুষ দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করেছে।অনল হাত বাড়িয়ে তার কপালের একপাশ থেকে উড়ে আসা চুল সরিয়ে দেয়।বেলী মৃদুসুরে বলে,

“আমি যদি সারাজীবন এভাবেই আপনার দিকে তাকিয়ে থাকি অনল?”

অনল হালকা হেসে বেলীর গাল ছুঁয়ে বলল,

“আমি তাতেই খুশি থাকবো ললিতা। যদি তুমি শুধু আমার দিকেই তাকিয়ে থাকো তবে আমি কোনো কিছু চাইবো না।এখন চলো।দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

অনলের তাড়া শুনেও বেলী থমকায়।ক্ষণবাদে সূর্য পূর্ণভাবে আলো ছড়ানো শুরু করবে।এখন বের না হলে ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক বেশী দেরী হয়ে যাবে।বেলী এসে মাহিয়ার পাশে দাঁড়ালো।তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“তোর বাচ্চা হলে আমি আবার আসবো।ঠিক আছে?”

“অবশ্যই আসবি।বরং এবার তোর বাড়ীতেই আমি যাবো।”

বেলী বিরস মুখে বলল,

“কিন্তু আমার তো কোনো বাড়ী নেই।তাহলে কী করবো?”

মাহিয়া হেসে অনলের দিকে ইশারায় বলল,

“কে বলে তোর বাড়ী নেই?অবশ্যই আছে।দেখ তোর ব্যাড বয় তোর জন্য অপেক্ষা করে চলেছে।আর দেরী করিস না।জীবন গুছিয়ে নে।রামীমের জন্য সবটা তো শেষ হয়ে গেছিলো।”

“দেখি।”

“তোর এই গা ছাড়া ভাবটা আমার মনে হয় অনল শুনবে না।যা এখন না গেলে দেরী হবে।”

বেলী বান্ধুবীর থেকে বিদায় নিলেও নিজের ছাত্রের থেকে নিতে পারলো না।বাচ্চা ছেলেটা যখন জানবে তার মিস চলে গেছে তখন নিশ্চয় খুব কাঁদবে।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বেলী গাড়ীতে এসে বসলো।অনল সারারাত ঘুমায়নি।কিন্তু তা যেন তার চেহারা দেখে অনুমান করার উপায়টুকু নেই।গাড়ী চলতে আরম্ভ করলো।বেলী নিজের জীবনের একটা অধ্যায়কে পিছনে ফেলে চলছে।হয়তো কিছু শিক্ষা নিয়েছে যা তাকে পরবর্তী জীবনে গভীরভাবে সহায়তা করবে।

“আমরা এখন কোথায় যাবো?আপনার বাড়ীতে উঠলে লোকে কী বলবে?অথবা পরিচয়টা কী থাকবে?”

“আমি কোথায় বললাম যে তোমাকে আমার বাড়ীতে নিবো?যদিও নিলে সিকান্দার সাহেব তেমন কিছু বলতো না।কিন্তু তোমাকে আমি আমার বাড়ী নয়।বরং তোমার মায়ের বাড়ী নিয়ে যাবো।”

বেলী উশখুশ করে উঠলো।অনল তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

“শান্ত হও।আমি তোমার মায়ের বাড়ী বলেছি।বাবার নয়।”

“মানে?”

“পৌঁছালে বুঝতে পারবে।এখন নিশ্চুপ হয়ে ঘুমাও।”

গাড়ির ইঞ্জিনের নরম গুঞ্জন একঘেয়ে শব্দ তুলছে। অনল জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো। শীতল বাতাস এসে মুখে লাগলো। বেলী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলো।ঘুম আসছে তার।যেন সে ভীষণ ক্লান্ত।

দীর্ঘ সময় পর গাড়ী থামতেই বেলীর বুক ধক করে উঠল। সে জানে না সামনে কী অপেক্ষা করছে। অনল তার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল,

“নামো, ললিতা।”

বেলী ধীর পায়ে নামল। সামনে ছোট্ট একতলা একটা বাড়ি। উঠোন জুড়ে রোদ পড়েছে। ঘরের বারান্দায় একটা চেয়ার রাখা, পাশে কয়েকটা গাছের টব। জায়গাটা অদ্ভুত শান্ত, যেন সময় এখানে থমকে আছে।অনল তার হাত ধরে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো।ভেতর থেকে সিয়াম ও রেবেকার গলা শোনা যাচ্ছে।অনল গলা পরিষ্কার করে ডাকলো,

“রেবেকা!”

“আশ্চর্য অনল।আপনি আমার মা কে নাম ধরে কেন ডাকছেন?”

“তাতে তোমার কী ললিতা?”

রেবেকা উচ্ছাসিত হয়ে দরজা খুলে দিলো।বেলীকে দেখে কিছুটা থমকে গেলো।চোখমুখ শূন্য হয়ে আছে তার।যেন তার মধ্যে কোনো অভিব্যক্তি নেই।সে বোধহয় বিশ্বাসই করতে পারছে না তার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে।মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল যেন আগুন জ্বলছে সেখানে।হঠাৎ করেই সে হাত তুললো। ঠাস! শব্দে বাতাস কেঁপে উঠলো।বেলীর গালটা জ্বলে উঠলো যেন কেউ আগুন ছুঁড়ে দিয়েছে। সে হতবাক হয়ে রেবেকার দিকে তাকাল।

“আম্মু।”

“চুপ বেয়াদব মেয়ে।অনল একে যেখান থেকে এনেছো সেখানে।ফেরত রেখে এসো।”

“শান্ত হোন রেবেকা।”

“না, আমি শান্ত হবো না।এতদিন পর ফিরে এসে কী প্রমাণ করতে চায়? যে বেঁচে আছো সে?অসভ্য মেয়ে।”

রেবেকা ভেতরে চলে গেলো।বেলী কান্নারত দৃষ্টিতে অনলের পানে তাঁকালে পুরুষটি ছোট করে তার গালে চুমো খেলো।

“রেগে আছে তোমার মা।ভেতরে গিয়ে জড়িয়ে ধরো।দেখবে সব রাগ কমে যাবে।”

বেলী সাহস নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।ছোটখাটো বাড়ীটা।সিয়াম ডায়নিং টেবিলে বসে আছে।একবার বেলীর পানে তাঁকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।যেন তার আগমনে কোনো কিছু হচ্ছে না।রেবেকা সোফায় বসে আছে।বেলী তার কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আম্মু মাফ করো।প্লিজ।”

“চলে যাও এখান থেকে।”

“না আমি কোথাও যাবো না।”

অনল চিল্লিয়ে বলল,

“ভুল ললিতা।আগামীকালই আমরা বিয়ে করছি।এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে আপনি ভিজে যাবেন না রেবেকা।দ্রুত আমার কাছে আপনার মেয়েকে পাঠিয়ে দেন।”

“আপনি চুপ থাকেন অনল।মা একটু তো কথা শুনো।”

“আমাকে না বলে বের হলে কেন তুমি?”

“সেদিন পরিস্থিতি এমন ছিল।”

“তো?এখন কী আমি তালাক দিয়ে সেই বাড়ী থেকে চলে আসিনি?পঁয়ত্রিশ বছরের সংসার রেখে এসেছি বেলী।তার অনেকটা কারণ হলে তুমি।তোমাকে ভালোবেসে।আমার নিজের মেয়ে তার আপন বাবার নিকট জন্মপরিচয় নিয়ে শুনবে তা আমি কীভাবে হতে দেই?অথচ আমাকে একা রেখে চলে গেলে?”

“বাবা তুমি তাও ডিভোর্স দিলে?সে মেনে নিলো?”

“মেনেছে।আমি জানো বেলী নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছিলাম সেই কবে।এটা করো না।ওটা করো না।রাবিশ কোধাকার। এসব শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে গেছিলাম।আজ আমি মুক্ত।যাক বসো।অনল বলেছিল রান্না করে রাখতে।ফ্রেশ হয়ে এসো।খাবার দিচ্ছি।”

বেলী আস্তে করে মাথা নাড়ালো।এক দুবার সিয়ামকে ডাকলেও কোনো উত্তর পেলো না।অগত্যা সে উপরের রুমে চলে এলো।এটা তার পরিচিত ঘর নয়।যেখানে সে বড় হয়েছে।এখনও কতো প্রশ্নের উত্তর তার জানা বাকী।ব্যাগ থেকে একটা ড্রেস নিয়ে ফ্রেশ হতে যাবে কিন্তু সেই মুহুর্তে অনল তার রুমে এলো।মুহুর্তে মেয়েটিকে শূন্যতে তুলে বিছানা তে এনে শুইয়ে দিলো।নাক নাক ঘষে ফিসফিস করে বলল,

“কাল সত্যি আমাদের বিয়ে ললিতা।”

“সবসময় মজা তাইনা?কেউ এসে পড়বে।”

“তুমি বিশ্বাস করো।”

“না।”

অনলের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তার গাঢ় চোখে গভীর কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে। যা বেলী বোঝার আগেই সে নিচু হয়ে মেয়েটির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল।

“আমি মজা করছি না, ললিতা। আমি তোমাকে সত্যিই চাই।এবং তা কালকের মধ্যে।”

বেলীর বুক ধক করে উঠলো। অনলের চোখের ভাষা মিথ্যা বলছে না। সে সত্যিই চাইছে তাকে, তার সমস্তটা নিয়ে, ভালোবাসার গাঢ় বন্ধনে জড়িয়ে।ভয় ভয়ে সে শুধালো,

“সত্যি আমাদের কাল বিয়ে?”

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:শেষ পর্ব(সমাপ্ত অংশ)
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

প্রেম কী?কিংবা ভালোবাসা কী?একটা নিছক অনুভূতি যা শুধু দুঃখ দিতে জানে।যে ব্যক্তি এই অনুভূতির চক্রে একবার আবদ্ধ হয় সে জীবনের প্রতিটি ক্ষণে শূন্য হতে বাধ্য।অনলের ললিতার দিন কাটতো অতীতের স্মৃতির সন্নিবেশে।যেখানে প্রেম শুধুই কষ্ট আর বিচ্ছেদের নাম ছিল।কিন্তু হঠাৎই অনলের আগমন ঘটে যেন শীতল অন্ধকারে এক উজ্জ্বল প্রভাতের ছোঁয়া। অনলের হাসিমুখ, তার কোমল কণ্ঠস্বর আর নিরবচ্ছিন্ন স্নেহের স্পর্শে ললিতার জীবনের ধারে ধীরে ধীরে নতুন রঙ ফুটে ওঠে। প্রথমদিকে ছিল একটু অবিশ্বাস, একটু সন্ত্রাস কিন্তু অনলের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তে ললিতা বুঝতে শুরু করে ভালোবাসা শুধু অতীতের ব্যথাই নয় বরং নতুন আশার সুর, জীবনের পুনর্জাগরণের এক অনন্য অভিজ্ঞান।নিজেকে যতো আয়নায় দেখছে ততো যেন অবাক হচ্ছে বেলী।লাল রঙের বেনারসি ও হালকা সাজে তাকে অনন্য লাগছে।সে কী কখনো ভেবেছিলো যে একদিন সে অনলের ললিতা সত্যিই হয়ে উঠবে?না কখনো ভাবেনি।

“এতো আয়নায় কী দেখছিস?নিজের রুপ এতো দেখে লাভ নেই।আজকে অনল দেখুক।এরপর বুঝবি তোকে কেমন লাগছে।”

শশীর কথায় তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখালো না বেলী।সে ধীরভাবে বোনের পাশে এসে বসে বলল,

“তোমার ও কী বিয়ের দিন এমন অনুভূতি হয়েছিল?”

“উমম!হয়েছিল।কিন্তু এতো না।অনেকগুলো মানুষ ছিল নানান অনুষ্ঠান হয়েছে।আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম।তাই এমন কাব্যিক অনুভূতি ভাবার মতোন সময় আমার ছিলনা।”

শশীর উত্তর শুনে হালকা হাসল বেলী। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সন্ধ্যার নরম আলো ঘরটাকে যেন স্বপ্নের মতো সাজিয়ে তুলেছে। কোথাও একটা বাঁশির সুর ভেসে আসছে, বাতাসে মিশে আছে বিয়ের দিনের ব্যস্ততার গন্ধ।নরম স্বরে বলল বেলী,

“তোর কি মনে আছে ছোটবেলায় বলতাম একদিন নাকি তোকে রাজকন্যার মতো সাজিয়ে বিয়ের আসরে বসাবো?বাবা সবসময় আমার বিয়ে নিয়ে বললেও কখনো তোর বিয়ে নিয়ে বলেনি।আমি সকালে কল করেছিলাম।কিন্তু…।”

“থাক।”

“পাশাপাশি দুটো বাড়ী যেহেতু দুজনের দেখা হবে।তুই কথা বলার চেষ্টা করবি।”

“আমার মনে হয়না অনল তা করতে দিবে।সে বাবাকে দেখতে পারেনা।”

“তবে বাবার হার মানতেই হবে।কারণ রাহিমার সাথে সিয়াম ভাইয়ার অতি শীঘ্রই বিয়ে হতে চলেছে।তখন কী করবে?”

“কী করবে সেটা নিছক তার ব্যাপার আপু।আমি শুধু মা কে খুশি দেখতে চাচ্ছি।”

“রামীমের বাবা তোর জন্য একটা উপহার পাঠিয়েছে অনলের কাছে।”

বেলী চমকে গেলো।রামীম!শব্দটা কীভাবে যেন তার জীবন থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলো।আর কখনো ফিরে আসবেনা।বেলী নিজেও চায় তা যেন কখনো না ফিরে আসে।

“কী দিয়েছে?”

“সম্ভবত একটা জোড়া বালা।তুই রামীমকে ভুলতে পেরেছিস তো?”

“হ্যাঁ।জানো আপু মনে হচ্ছে আমি যেন নতুন করে বাঁচতে শিখছি। এতদিন শুধু ভয় ছিল, কষ্ট ছিল।ভাবতাম ভালোবাসা বুঝি হারিয়ে গেছে আমার জন্য। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অনল আসলেই আমার জীবনের নতুন শুরু।”

শশী আদর করে বেলীর গাল ছুঁয়ে বলল,

“সবাই তো এমন কাউকে পায় না যে জীবনটাকে নতুন করে চিনিয়ে দেয়। তুই পেয়েছিস। অনল তোকে ঠিক আগলে রাখবে। আমার ছোট বোনটা অবশেষে ভালোবাসার মতো আশ্রয় পেয়েছে এটুকুই তো চেয়েছিলাম সবসময়।”

বাইরের গাড়ীর শব্দে জানান দিল বরপক্ষ চলে এসেছে। চারদিকে হইচই, হাসাহাসি, আনন্দ।শশী বেলীর আঁচলটা ঠিক করে দিয়ে কপালে একটা স্নেহভরা চুমু দিলো। চোখে জল জমে উঠলেও লুকিয়ে ফেলল হঠাৎ।

“চল অনলের ললিতা। চল আমার রাজকন্যা তোর নতুন রাজ্যতে যাবি। গল্পটা তো এখন শুরু হলো মাত্র।”

সবাই যখন বেলীকে ঘর থেকে নিয়ে আসছে তখন হাসির শব্দে হলঘরটা মুখর হয়ে উঠেছে।অনল বসে আছে সোফার এক পাশে। চোখ নামিয়ে রাখা, ঠোঁট চাপা অনুভূতি যেন কোনো অনুভূতি নেই মুখে। বেলীর আসার খবরেও সে বিশেষ নড়লো না।বেলী আসলো ধীরে ধীরে, মাথা নিচু, নরম পায়ের শব্দে। কিন্তু অনল সে একবারও তাকালো না বেলীর দিকে। বরং পিঁছিয়ে থাকা পাঞ্জাবীটা ঠিক করছিলো অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে।বেলী অবাক হলো।সকলের চোখের আড়ালে নিজের ভালোবাসাকে চিমটি দিলো।

“কী হয়েছে মাই ললিতা?”

“আপনি একবারও আমার দিকে তাঁকালেন না কেন?”

“কারণ তুমি আমার চাঁদ।দিনের বেলাতে দেখে মজা নেই।বিশেষ সময়ের অপেক্ষা তে আছি।”

সিকান্দার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,

“তাহলে বিয়েটা পড়িয়ে নেক।কারণ এখানে সকলে নিজেদের মানুষ। ফর্মালিটির কী দরকার?কী বলো সিয়াম?”

“অবশ্যই আঙকেল।”

অবশেষে সেই মুহূর্ত এলো যখন অনল ও তার ললিতা একটা পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পড়তে চলেছে।ধীরে ধীরে সেই মধুর শব্দগুলো উচ্চারণ করা শুরু করলো কাজী।
সবাই যখন অপেক্ষা করছিলো সেই পবিত্র কবুল শোনার জন্য তখন অনল শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,

“কবুল।”

অনল যতোটা সহজভাবে বলল বেলীর ক্ষেত্রে পুরো বিষয়টা আরো কঠিন হয়ে গেলো।সে কাঁপছে। দারুণভাবে কাঁপছে।রেবেকা তাকে একবার জড়িয়ে ধরলো।বেশ অনেকটা সময় যাওয়ার পর সে নিজেও ‘কবুল’ শব্দটি উচ্চারণ করলো।অনল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।সে তো ধরেই নিয়েছিলো এই মেয়েটা পাছে আবার সিদ্ধান্ত না বদলে ফেলে।মেয়েটির কাঁপা-কাঁপি শেষ হতে প্রথমবারের মতো অনল বেলীর দিকে তাকালো। কী যেন এক চাপা বিজয়ের হাসি ঠোঁটে, চোখে অপার্থিব প্রশান্তি। অবশেষে সে পৃথিবীর সকলের কাছে বলতে পারবে ললিতা শুধু তার।একমাত্র অনলের।

(****)

বাড়ী পৌঁছাতে খুব বেশী রাত হয়নি তাদের।করুণা জাঁকজমকপূর্ণ নিজের পুত্রবধুকে বরণ করে নিলো।সকলে যেন আজ অনেক খুশি।রাতের খাবারের পর রাহিমা তাকে অনলের রুমে রেখে গেলো।ফুল দিয়ে অনেক সাদামাটা সাজানো।কিন্তু এতেই যেন পুরো কক্ষটা আরো সুন্দর হয়েছে।কী অদ্ভূত!এককালে তো সে এই জায়গাটিতেই থাকার ইচ্ছা করতো।মানুষ যখন প্রচন্ডভাবে কোনোকিছু চায় তখন কোনো না কোনোভাবে তা পূরণ করেন সৃষ্টিকর্তা।জানালার পাশটায় এসে সে নিজের বাবার বাড়ীর পানে তাঁকালো।তার রুমের জানালা বন্ধ করা।এখন আর সেখানে কেউ থাকেনা।অবশ্য কখনো থাকবে কীনা সেই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।ঘরের ভিতর মৃদু আলো জ্বলছে। আলোর রেখাগুলো বেলীর শরীরের বাঁকগুলোকে আরও স্নিগ্ধ ও মায়াবী করে তুলছে। প্রতিটি আলোর ঝিলিক যেন তার ত্বকে স্পর্শ করে নরম উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাতাসে ভাসছে তার চুলের ফুলেল সুগন্ধি।লাল শাড়ির আঁচলটা একপাশে পড়ে আছে।জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে আছে সে।এতো ভাবনার মাঝে খেয়াল করেনি অনল চুপচাপ দরজা বন্ধ করে দিলো। যেন বাইরের পৃথিবী এই মুহূর্তটাকে ছুঁতে না পারে।এই নিভৃত নীরবতাকে ভাঙতে না পারে।অনল ধীরে ধীরে মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়ালো। তার নিঃশ্বাস বেলীর গায়ে লাগলো। উষ্ণতা যেন দুজনের মাঝে এক অদৃশ্য সেতু বেঁধে দিল। খুব হালকা গলায় প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,

“এত দূরে কী দেখো? আমি তো এখানে।”

বেলী একটু হাসলো। তার ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকা সেই হাসি যেন অনলকে আরও কাবু করে দিল। তবে সে ঘুরল না। অনল তার চুলের ভেতর মুখ রেখে নিঃশ্বাস নিলো।যেন তার সুগন্ধি দিয়ে নিজেকে ভরিয়ে নিতে চাচ্ছে।তার ঠোঁট হালকা করে স্পর্শ করল বেলীর কানের পাশটা।একটু কাঁপিয়ে দিল তাকে।

“আজ তোমাকে একটু বেশি দেখতে ইচ্ছে করছে। পুরোটা রাত ধরে।”

বেলী এবার ধীরে ঘুরলো। চোখে টানা কাজল, ঠোঁটে হালকা লাজুক লাল রঙ। তার চোখ দুটো যেন অনলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

“আপনি তো বলেছিলেন শাসন করবেন।কিন্তু এখন এত মিষ্টি কথা?”

অনল হাত ধরে টেনে নিজের গালে ঠেকালে মেয়েটির হাত।উত্তরে বুকের ওপর অন্য হাত রেখে কাঁধে মাথা রাখল বেলী। তার শ্বাসের গতি যেন অনলের হৃদস্পন্দনের সাথে মিলে যাচ্ছে।দুজনের শরীর যেন একই তালে নাচতে শুরু করছে।

“ভেবেছিলাম খুব ভয় লাগবে। কিন্তু এখন খুব নিরাপদ লাগছে। জানেন।”

অনল বেলীর কপালে চুমু দিলো।তারপর ধীরে ধীরে নিচে নামল তার গালে, ঠোঁটে। তার চুম্বন যেন একটু একটু করে বেলীর সমস্ত ভয় দূর করে দিচ্ছে। প্রতিটি স্পর্শে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। কিন্তু সেই আগুন নরম, মোলায়েম, ভালোবাসায় ভরা।

অনল আস্তে আস্তে পুনরায়বেলীর মুখ তুলে ধরলো। চোখে চোখ রাখল। তাদের শ্বাস যেন এক হয়ে গেল দুজনের ঠোঁটের মাঝে এক অদৃশ্য টান তৈরি হলো। অনলের ঠোঁট হালকা করে স্পর্শ করল বেলীর ঠোঁট প্রথমে একটু অনিশ্চিত তারপর ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকল সেই চুম্বন। তাদের ঠোঁটের মাঝে যেন এক সুর বাজতে শুরু করলো।ভালোবাসার সেই সুর।

“ভোর হলেও তুমি আমার, রাত গেলেও আমি তোমার। আজ, কাল, সবসময় আমার ললিতা তুমি।আমি কী তোমাকে আজ পেতে পারি ললিতা?”

বেলী নিশ্চুপে মাথা নাড়ালো।অনল ধীরে ধীরে বেলীকে তুলে নিলো যেন দুনিয়ার সব পবিত্রতা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। দুহাতে আস্থার ভর দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল তাকে। লাল শাড়ির আঁচল এলোমেলো হয়ে পড়ল বেলীর কোমরের পাশে। ঘরের মৃদু আলোয় বেলীর চোখদুটো যেন আরও গভীর আরও স্বপ্নিল হয়ে উঠলো। তার গালে হাত রেখে অনল নিচু হয়ে এলো,ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,

“শোনো, আজ শুধু আমি,তুমি আর শায়েরি।”

তারপর ধীরে ধীরে বলে উঠলো।যেন প্রতিটা শব্দ বেলীর গায়ে জড়িয়ে যায়,

“হাজারো ইচ্ছে এমন ছিল,
যে প্রতিটি ইচ্ছে পূরণে প্রাণ বেরিয়ে যেত।
অনেক ইচ্ছে তো পেরিয়ে গেল,
তবুও যেন কিছুই পূরণ হলো না।”

অনল বেলীর কানের কাছে ঠোঁট রাখলো।ফিসফিস করে আরেকটা শায়েরি বলল,

“ইশকের উপর জোর চলে না,
এই সেই আগুন গালিব,
যা ইচ্ছা করলেই জ্বালানো যায় না,
আর চাইলেও নেভানো যায় না।

বেলী চোখ বন্ধ করে শুনছে। যেন প্রতিটা শব্দে তার গা বেয়ে নামছে নরম শিহরণে। অনল থামলো না এবার আরেকটু নিচু হয়ে গলায় চুমু দিয়ে বলল,

“হামকো উনসে ওয়ফা কি হ্যায় উম্মিদ,
জো নাহি জানতে ওয়ফা কিয়া হ্যায়।”

বেলী আস্তে করে অনলের হাত ধরে বলল,

“আর বলুন।আমি শুনতে চাই।শুধু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”

অনল এবার বেলীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে গুনগুন করে বলল,

“এ তো শুধু একটা হৃদয়, পাথর তো নয়,
তাহলে কষ্টে ভরবে না কেন?
হাজার বার কাঁদব আমরা,
যদি কেউ অত্যাচারও করে ভালোবেসে।”

বেলীর গাল ছুঁয়ে অনল আস্তে করে বলল,

“আজ শুধু কথা বলব, শায়েরি বলব। তোমাকে ছুঁয়ে, তোমার চোখে তাকিয়ে, শুধু বলেই যাব।”

বেলী হালকা হাসলো।অনলের বুকের কাছে মাথা রাখল। অনলের আঙুলগুলো বেলীর চুলে খেলতে খেলতে আরও একটা শায়েরি ঝরাল।ভেজা গলা,নরম, গভীর কাঁপা স্বরে,

“কাউকে জিজ্ঞেস করো তো এই দুনিয়া আর আকাশের আসল মানে কী?আসল সুখ তো দুঃখ আর হারানোর যন্ত্রণাতেই লুকিয়ে।”

বেলী চোখ বুজে শুনছে। যেন শব্দগুলো গায়ে মাখিয়ে রাখছে সারারাতের জন্য।অনল তখন তার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বলল,

“এই শায়েরিগুলো শুধু তোমার জন্য।আমি জানি, তুমি ঠিক এগুলোর মতোই। দুঃখের মায়ায় গড়া, মিষ্টি বিষাদে মোড়া।”

বেলী চুপচাপ হাসলো।ঘরের বাতাস নরম হয়ে উঠলো।মৃদু বাতাস জানালার পর্দা উড়িয়ে দিল যেন গালিবের শায়েরির সুরেই সব ভরে গেছে।অনল বেলীর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আজ রাতে শুধু থাকো আমার খুব কাছে। কোনো কথা না, শুধু নিঃশ্বাস ভাসবে বাতাসে।”

বেলী অনলের বুকে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল, ঠোঁট দিয়ে হালকা ছুঁয়ে বলল,

” যতক্ষণ এই দুনিয়া আছে আর যতদিন আপনার মুখ থেকে গালিবের শায়েরি শুনতে পারব।ততোদিন আমি আপনারই ললিতা হয়ে রইবো।”

তারপর নিঃশব্দে সময় থেমে গেল সব।অদৃশ্য কল্পনাময় বৃষ্টির শব্দ আরও মোলায়েম হয়ে এলো।এই ঘরভরা আজ শুধু ভালোবাসা।গন্ধমাখা, শায়েরি-ভরা, নিভৃত ভালোবাসা।

(***)

সময় যেন অনেক দ্রুত চলে যাচ্ছে বেলীর জীবনে।এক সময় তার কষ্টের দিনগুলো কাঁটতে চাইতো না।কিন্তু আজ যেন পরিস্থিতি ভিন্ন।তবে অনলের ব্যস্ততা বেড়েছে।আয়েশার কোম্পানির সঙ্গে মিলে বড় একটা প্রজেক্টে কাজ করছে সে।আয়েশা এককালে অনলের খারাপ করতে এলেও এখন বেশ ভালো হয়ে ওঠেছে মন থেকে।সেই বিশেষ কাগজটার মালিক এখন তারা দুজনেই।এক অনন্য সুগন্ধময় পারফিউম তৈরী করেছে তারা।অবশ্য নামটা দিয়েছে ‘ললিতা’।অনলের সবকিছু এখন বেলীকে ঘিরে।যদিও বেলীর একা থাকতে হয়না।রাহিমা ও করুণা তাকে অনেক সঙ্গ দেয়।এছাড়া বই ও অনলের ছোট ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন সাইন্সের বিষয় আলাপ করতে করতে দিব্যি সময় কেঁটে যায়।বাগানে বসে ছিলো বেলী।হঠাৎ খেয়াল করলো তাদের বাড়ী থেকে অনেক বেশী ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে।সে চমকে উঠলো।হাতে থাকা বইটা ফেলে অনেক দ্রুত সেদিকে দৌড়ে গেলো।একবার ভাবলো ভেতরে প্রবেশ করবেনা।কিন্তু ভেতর থেকে তার বাবার কাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছে।বেলী ধীর পায়ে প্রবেশ করলো।তার মায়ের হাতে তৈরী করা বাড়ীটা আজ অনাদরে কেমন পড়ে আছে।ধোঁয়া আসছে রান্নাঘর থেকে।সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বেলী দেখলো ভাত পুঁড়ে ছাঁই হয়ে গেছে।তোফাজ্জল আলুথালু বেশে কী করবে বুঝতে পারছেনা।বেলী দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।অত:পর এগিয়ে এসে মৃদুসুরে বলল,

“আমি রান্না করে দিচ্ছি।”

বেলীর কথায় তোফাজ্জল ভূত দেখার মতোন চমকে উঠলো।সে ধরে নিয়েছিলো এখন তার বাবা অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিবে।তবে লোকটা যেন শীতল হয়ে গেছে।ধীরভাবে পাশে সরে দাঁড়ালো।বেলীর এই রান্নাঘরটা চিরচেনা।তাই সবকিছু খুঁজে পেতে দেরী হলো না।তোফাজ্জল খুঁতখুতে লোক।সকলের রান্না খাবেনা দেখে বোধহয় নিজে রান্না করে।অনেকটা সময় লাগিয়ে সে রান্না করলো।বহুদিন পর এতো সুন্দর ঝরঝরে ভাত দেখে তোফাজ্জল থামতে পারলো না।কয়েক গ্রাস মুখে তুলে নিলো দ্রুত।বেলীর দেখে খুব মায়া লাগলো।নিজে থেকে গলা পরিষ্কার করে বলল,

“আমি রোজ এসে রান্না করে দিয়ে যাবো।”

“ওই ছেলেটা আসতে দিবে?”

“কোন ছেলে?”

“তোমার স্বামী অনল।”

“কেন দিবেনা?”

“না আমি ওকে বিশ্বাস করিনা।এর থেকে আমাকে ভালো একটা সলিউশন দাও।তোমার মা কে কীভাবে ফিরিয়ে আনতে পারি।আর আর আমি তোমার কাছে মাফ চাচ্ছি।”

“মাফ পরের বিষয় বাবা।মা কে ফিরিয়ে আনতে হলে আগে নিজেকে শুধরাতে হবে।এক কাজ করুন।প্রেমিক পুরুষ হয়ে যান।মা কে প্রেমে ফেলুন।সুন্দর করে তাকে বলুন রেবেকা আই লাভ ইউ।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তোফাজ্জল লজ্জা পেলো।খাওয়া বাদ দিয়ে বেলীর দিকে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে বলল,

“এসব উদ্ভট চিন্তা অনলের সাথে থেকে হয়েছে তোমার।”

“আপনি যাই বলুন বাবা।এছাড়া কিন্তু আপনার গতি নেই।আপনি খান।আমি সকালে এসে খাবার রান্না করে দিবো।ভেবে দেখেন এখনও কিন্তু সময় আছে।”

তোফাজ্জলকে ভাবনায় রেখে বের হয়ে এলো বেলী।কিছু মানুষের স্বভাব বদলায় না।তবুও তাদের সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।তার বাবা এমন ধাঁচের লোক।দরজার কাছটায় এসেই বেলী অবাক হলো।অনল দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি কীভাবে জানলেন যে এখানে আমি?”

বিনিময়ে অনল হাসলো শুধু।নিশ্চয় বাড়ীর কেউ তাকে এখানে আসতে দেখেছে।

“একসাথে হাঁটবে ললিতা?”

নীরব, কোমল রাতে শহরের কোলাহল পেরিয়ে এসে রাস্তার এই ফাঁকা ধারে যেন শুধু তারা দুজন সম্পূর্ণ একা। মাথার ওপর টিমটিমে ল্যাম্পপোস্টের আলো, হাওয়ায় হাওয়ায় শুকনো পাতার শব্দ, দূরে কোথাও হয়তো একটা রিকশার ঘণ্টা বেজে উঠলো।অনল খুব মনোযোগ দিয়ে হাঁটছে না। মাঝে মাঝে পা থেমে যাচ্ছে।বেলী কিছু বলে না। সালোয়ারের ওড়না সামলে নিঃশব্দে হাঁটে। ঠোঁট চেপে ধরা অভিমানটা চোখে যেন কুয়াশার মতো ছড়িয়ে আছে।একটু পর অনল নিজেই থেমে যায়।

“শুনো ললিতা।সময় দিতে পারিনা মানে এই না যে আমাকে না বলে এদিক ওদিক ঘুরবে।”

“আপনি ভীষণ পজেসিভ অনল।”

“অবশ্যই। এতো কষ্টে বউ পেয়েছি তাকে আগলে রাখতে হবে তো।তা কী বুঝলে?তোমার বাবা-মা আবার কী একত্রে হবে?”

“হতেও পারে।”

“আমার মনে হয় হবে।তাছাড়া ডিভোর্সটা নাটক ছিল।সিয়াম ও শশীর প্ল্যান।”

“মনে তো হয়না।”

“তুমি আমাকে এতো অবিশ্বাস করো ললিতা?”

“আপনার প্ল্যান।আপনি ভীষণ কথা লুকান।”

“জি না।আমি কথা লুকাবো আর কোথাকার কোন পুলিশ এসে তোমার কাছে আমার নামে মিথ্যা বলে যাবে।আর তুমি তা বিশ্বাস করে গোয়েন্দাগিরি করবে।”

“লজ্জা দিচ্ছেন কেন?”

“কারণ তখন তোমাকে দেখতে ভালো লাগে।”

দূরের দোকান থেকে ভেসে আসে চায়ের গন্ধ। অনল বলে,

“চলো, দু’কাপ চা হোক। তোমার পছন্দের আদা দেওয়া।”

চা খাওয়া শেষে তারা হাঁটতে শুরু করে আবার।ধীর পায়ে, প্রেমে ভেজা রাতের গোধূলি ধরে।রাস্তাটা তখন একেবারে নীরব হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে বাতাসে গাছের পাতার মৃদু শব্দ আর দূরের গাড়ির হালকা হর্ন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তারা পাশাপাশি হাঁটছে, ধীরে ধীরে, যেন পুরো পৃথিবীর সময় থেমে আছে শুধু তাদের জন্য।একসময় বেলী হঠাৎ থেমে গিয়ে অনলের দিকে তাকায়। চোখে একটু সাহস, একটু লাজুক কৌতূহল।নরম গলায় বলে,

“অনল একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

“এতো ফর্মালিটি কেন?করো।”

“না, বলেন তো আপনি আমায় এত ভালোবাসেন কেন?”

প্রশ্নটা এমন সোজা, অথচ এত গভীর যে অনল একটু থেমে গেলো। চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। জোছনার আলোয় বেলীর মুখটা আরও মায়াবী লাগছে ঠিক যেন অনলের কোনো পুরনো গল্পের প্রিয় চরিত্র।ধীরে ধীরে বলে,

“জানি না, বেলী। ভালোবাসার কারণ কি কখনো ঠিকভাবে জানা যায়?তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম যখন মনে হয়েছিল যেন এই জীবনে অনেক কিছু ভুলে গেছি আর তুমি মনে করিয়ে দিতে এসেছো।তুমি হাসলে আমার দিনটা ভালো হয়ে যায়। তুমি না থাকলে সবকিছু ফাঁকা লাগে।তোমার সাথে থাকলেই মনে হয় বাকি সব কিছু থাক বা না থাক।ঠিক আছি।ভালোবাসার কোনো যুক্তি থাকে না। হয়তো হাজারটা কারণ বলতেও পারবো, কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে তুমি! তুমি বলেই ভালোবাসি। তোমার মতো আর কেউ নেই বলেই ভালোবাসি।”

বেলী একটু চুপ থাকে। চোখ নামিয়ে ফেলে। ঠোঁটে একটা হালকা হাসি খেলে যায়। আস্তে করে বলে,

“তাহলে তো আমাকেও আপনাকে নতুন করে ভালোবাসতে হবে। কারণ আপনিও তো শুধু অনল বলেই ভালোবাসার যোগ্য।”

অনল হেসে বেলীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।বুকের কাছে টেনে এনে বলে,

“আমাকে কীভাবে ভালোবাসবে তুমি আমার ললিতা?সানশাইন হয়ে নাকী মেঘরঙা ললিতা হয়ে?”

বেলী জবাব দেয়না।এক পলকে তাঁকিয়ে থাকে অনলের দিকে।কিছু প্রশ্নের জবাব না হয় তোলা থাক।

(সমাপ্ত)