#আমার_ললিতা
#পর্ব:৯
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিল ছেলেটির সঙ্গে।অথচ এখন বিয়ে করছে অন্য একজনকে।রুমি মেয়েটা তো ভালো ছিল।চরিত্রহীন মনে হয়নি কখনো।কে জানে কী হলো?”
ব্রেডে পাতলা করে মাখনের প্রলেপ দিতে দিতে শশী কথা গুলো বলল।বেলী ভ্রু কুঁচকে বোনের দিকে তাঁকালো।রুমি তার এলাকার বান্ধুবী।ছোটবেলায় একসাথে খেলাধুলা করেছে।এমনকি রুমির যখন সোহানের সাথে সম্পর্ক শুরু হলো তখুনি জেনেছিল বেলী।
“আশ্চর্য!রুমি এমন নয়।বরং সোহান ভাইকে সে অনেক ভালোবাসে।”
“ছেলেটা কী করে রে?”
“উমম সম্ভবত ত্রিপল ই নিয়ে পড়াশোনা করেন।কর্মজীবন শুরু হয়নি।”
“এজন্যই তো।এখন যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে শিল্পপতী।গাজীপুর কয়েকটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী আছে শুনলাম।তবে মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে।”
“এটা অন্যায়।একজনকে ভালোবেসে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করা কোনো নারীর পক্ষে সম্ভব নয়।আমি রুমিদের বাসায় যাচ্ছি।”
বেলী তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো।যেন সে গেলে সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে রুমি নামের মেয়েটা।শশী বোনের যাত্রাপথের দিকে তাঁকিয়ে পুরোদস্তুর অবাক হয়ে গেলো।
“তুই ও বাড়ীতে গিয়ে কী করবি?দেখ বেশী কিছু বলবি না।বাবা জানলে খবর হয়ে যাবে।”
তোয়াক্কাও করলো না বেলী।বের হয়ে গেলো।রুমিদের বাসা কয়েকটি বাসার পরে।দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে বেলী।রোদের ঝলকানিতে মেদুর গালের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।তোফায়েল তখন বাজার থেকে ফিরছিলো।মেয়েকে এভাবে দ্রুত যেতে দেখে রাস্তায় কিছু না বললেও বাসায় এসে শশীকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলো।বড় কন্যারা সর্বদা পিতাভক্ত হয়।ছোট বোনের গোপনীয়তা রক্ষার থেকে বাবাকে সত্য কথা বলা বেশী বড় দায়িত্ব শশীর নিকট।ব্যস হয়ে গেলো।ছোট মেয়ের এহেন আগ বাড়িয়ে অনধিকার চর্চা মটেও পছন্দ করলো না।ড্রয়িং রুমের সোফাতে বসে অপেক্ষা করলো লাগলো বেলীর।এই সময়টিতে জলটুকুও স্পর্শ করা যেন তোফায়েলের জন্য নিষিদ্ধ।পাছে রাগ কমে যায় যদি?বেলী ফিরলো প্রায় তিন ঘন্টা পর।শুভ্র মুখটিতে অমাবস্যা লেপ্টে গিয়েছে।রুমির বাবা সত্যি মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছে।বেলীর মনে গভীর এক প্রশ্ন চলছে।পিতা, মাতা মাঝেমধ্যে ‘ভালো হবে’ এই দুটো শব্দ দ্বারা কেন সব স্বপ্ন ভেঙে নি:শেষ করে দেয়?
“বেলী।”
বাবার কণ্ঠের গম্ভীরতাতেও চমক ভাঙেনা বেলীর।সে অবহেলাতে জবাব দেয়,
“কিছু বলবেন বাবা?”
“তুমি রুমিদের বাসায় কেন গিয়েছিলে?তাও আবার এমন কিছু বলতে যা তোমার উচিত হয়নি।”
“ওর বিয়েটা…।”
“এতে তোমার কী রাবিশ মেয়ে?তাদের বিষয় নিশ্চয়।এখন যদি ওর বাবা রাতে ফোন করে আমাকে তোমার এহেন কার্যকলাপকে বর্ণনা করে গঞ্জনা দেয় তখন কী করা উচিত হবে?রুমির তো সমস্যা নেই।হলে বিয়েতে কেন হ্যাঁ করতো?”
“বাবা করিয়েছে।এবং তা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে।”
“পিতা-মাতার কথা শোনা সন্তানদের দায়িত্ব।এখানে তো বিয়ের মতোন এতো বড় বিষয়।”
“এবং তা যদি অন্যায় হয়।তখনও শোনা উচিত?”
“অন্যায়?নিজ সন্তানের সাথে কে অন্যায় করবে?”
“যার সাথে সম্পর্ক ছিল।সে অনেক ভালো ছেলে।এটা নিশ্চয় অন্যায় হচ্ছে।”
“চুপ মেয়ে।রুমে যাও।আমার খেয়ে আমার পরে মুখের উপর তর্ক করা শোভা পায়না।”
ব্যথাতুর দৃষ্টিতে বাবার পানে তাঁকিয়ে রইলো বেলী।তোফায়েলের সর্বদা এই একটি খারাপ অভ্যেস।রাগ উঠলে নিজের সন্তানদের ভরণপোষণের কথা বলা।বিশেষ এই কটূ কথাটি সিয়াম ও শশীও পেয়ে এসেছে।এমন নয় বেলী কথাটি প্রথম শুনলো।কিন্তু থাকেনা একদিন সমস্ত ধৈর্য্য ভেঙে যেতে শুরু করে।মুখটাকে যতোটা সম্ভব বিকৃত করে সে নিজ রুমে এসে বিছানার উপর বসলো।হায়!সমস্ত সুখ যেন অদৃশ্য ময়ূর।যেটিকে ধরা যায়না অথবা ছোঁয়া যায়না।
(***)
সিগন্যাল ভাঙতে পীপিলিকার অনুরুপ সারি ধরে সবগুলো গাড়ী চলতে লাগলো।পুরোদিন অফিসে বেশ কষ্ট হয়েছে আজ অনলের।বিশেষ করে সে সহজে মেজাজ বিক্ষিপ্ত করার মানুষ নয়।কিন্তু আজ কী হলো একটা ছেলের উপর চিল্লিয়ে উঠেছে।এটা কী তারমধ্যে বস হওয়ার একটি আত্নগরিমা ফুঁটে উঠছে?হবে হয়তো।মাথা ঘামানোর বিষয় সেটি নয়।ফোন বের সে স্ক্রিনটা অন করলো।অনেক গুলো বন্ধুকে এসএমএস করেছে।কিন্তু কেউ জবাব দেয়নি।একটি বিপদের আশংকা করছে অনল।যেখানে বাজিতে আছে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু আহসান।সে তো ছোট বাচ্চা নয় যে হারিয়ে যাবে?কল এলে ড্রাইভ করতে করতে রিসিভ করলো অনল।ওপাশ থেকে জানালো,
“পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম।তারা আপাতত শান্ত হয়ে থাকতে বলল।কিন্তু অনল জলজ্যান্ত একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।আমি কীভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকি?”
ফোনের ওপাশের নারীটি বিলাপ করে কেঁদে উঠলো।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অনল বলল,
“কেঁদো না নূপুর।আমি আছি।আহসানকে ঠিক খুঁজে বের করবো।”
“ওকে নিশ্চয় কেউ কিডন্যাপ করেছে।তা নয় একা একা চলে যাবার মানুষ সে নয়।”
“এক মিনিট নূপুর।দেখো তো ওর পাসপোর্ট আছে কীনা।”
“কেন?তুৃমি কী ভাবছো অনল?”
“তোমার হাজবেন্ডের পাসপোর্ট আলমারি তে আছে কীনা সেটা চেক করো নূপুর।”
বলিষ্ঠ, গুরুগম্ভীর কণ্ঠ অনলের।স্টিয়ারিং-এ থাকা তার হাত দুটো কাঁপছে।নিজের বন্ধুকে নিয়ে খারাপ সে ভাবতে চায়না।তবে আহসানের কাছে বিশেষ একটি জিনিস আছে।সেটির অবস্থানও অনলের জানতে হবে।মিনিট খানেক বাদে নুপুর ফিরে এসে ফোনে বলল,
“নেই।”
অনল তৎক্ষনাৎ ফোন রেখে দিলো।নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে দেখে গাড়ীও এক সাইডে থামিয়ে দিলো।এক মিনিটের দূরত্বে তার বাড়ীটা।কিন্তু মন হঠাৎ কঠিন হয়ে গেলো।আহসান কী তবে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো?এর বেশী ভাবতে পারছেনা অনল।মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো।সীটে হেলান দিয়ে জানালার কাঁচ গলিয়ে বেলীদের বাসার পানে তাঁকালো।বাগানে ছোট্ট ছিমছাম শরীরের প্রজাপতি হেঁটে হেঁটে বই পড়ছে।মেয়েটির কী হেঁটে হেঁটে পড়ার বাতিক আছে?আহসানকে নিয়ে চিন্তাটা যেন নিজ পথ থেকে খেই হারিয়ে ফেলছে।সেখানে এসে ভর করছে ললিতা।শুধু অনলের ললিতা।
অনেকটা যন্ত্রের মতোন গাড়ী থেকে নেমে এলো অনল।এখন অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে।চারিধার নিস্তব্ধ হয়ে আছে।হঠাৎ যেন মায়াময় একটি পরিবেশের তৈরী হলো।বেলী কারো সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হকচকিয়ে উঠলো।অবাক হয়ে সামনে দন্ডায়মান কান্তিমান পুরুষটিকে দেখছে।আর অনল?সে এগিয়ে এলো।মেয়েটির নরম হাতখানা ধীরভাবে স্বীয় শক্ত গালে ছোঁয়ালো।কেউ বাঁধা দিচ্ছে না।কিংবা কেউ অনুমতি দিচ্ছে না।অনল ফিসফিস করে বলল,
“তুমি ঠিক বায়রনের কবিতা বেলী।যে পঙক্তিতে ইতিহাস হয়ে গিয়েছিল ঠিক সেগুলোর মানব রুপ।”
চলবে।
#আমার_ললিতা
#পর্ব:১০
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
পুরুষটির আঙুলগুলো ঝুরঝুরে বরফের মতোন শীতল।কিন্তু এখন তো শীতকাল নয়।স্মরণে হচ্ছে হিমালয় থেকে নেমে আসা অবিরাম ধারায় পানি পড়তে থাকা ঝর্ণাতে দীর্ঘক্ষণ আঙুলগুলো ডুবিয়ে এরপর বেলীর নরম মেদুর গালে স্পর্শ করেছে অনল।তবে মুখ নি:সৃত কাব্যিক কথাগুলো দেহের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে দিচ্ছে।মেয়েটি কাঁপছে।কেন?সে তো দূর্বল নয়।অনল যেন এই অস্থিরতা টের পায়।হৃদপিন্ডের কাঁপনকে মন ভরে উপভোগ করতে পারে।এক ধাপ এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়।হিমালয়ের গিরিপথের মতোন ভুরু গুলো দুলিয়ে শুধায়,
“প্রেমবিহীন প্রেমিক পুরুষের প্রেমময় কথায় এতো অস্থিরতা কেন প্রেমিকা?”
বেলী জবাব দিতে চাইলো এই কান্তিমান সুপুরুষটিকে।সে তার প্রেমিকা নয়।অথচ ভয় পাচ্ছে।ভীষণ ভয়।যে ভয়ের নাম নেই কোনো।নাকী এই সাঁঝবেলায় এক ভূতের আগমন ঘটেছে তার মস্তিস্কে।
“আমার অনুমতি ব্যতীত স্পর্শ করা উচিত হচ্ছে না অনল।হাতটা সরিয়ে দিন।”
“তুমি কিন্তু বাঁধা দাওনি ললিতা।চলো বিষয়টি ব্যাখা করি।প্রত্যেকটা মানুষ জীবনে চড় খায় স্বীয় চোখ বন্ধ করে।কেন জানো?খোলা চোখে সে দেখতে পায় তার দিকে আগত হাতকে।”
“আপনি নিশ্চয় আমাকে চড় দেননি।বরং হুট করে গালে স্পর্শ করেছেন।এটাকে বলে অনধিকার চর্চা।নিজে নিজে জোর করে কিছু নিয়ে নেওয়া।যদি খুব কঠিন ভাষাতে উচ্চারণ করি হবে সেটা ডাকাত।”
“তোমার ক্ষেত্রে আমার ডাকাত হতেও সমস্যা নেই।”
“কিন্তু আমার লুট হতে সমস্যা আছে।”
বেলীর চোখ দুটো কিয়দংশ ছোট ছোট হয়ে এলো।অনল হেসে উঠলো তার দিকে।অথচ কে বলবে?এই পুরুষটি নিজের মূল্যবান একটি তথ্য পাচার হয়ে যাওয়ায় ভীষণ চিন্তিত।সন্ধ্যা পুরোপুরি নেমে গিয়েছে।আশ্চর্যভাবে অল্প আলোতেও বেলী কষ্ট করে উপন্যাসের লাইনগুলো পড়ছে।ব্যোমকেশ সমগ্রের একটি গল্প যে বুঝতে পারলো অনল।হঠাৎ আনমনে বলে উঠলো,
“অনেক ইজি এই গল্পের রহস্য।মূলত কলমের কালিতে সে মাকড়সার রসটা ভরে সেটা চিঠি লেখার সময় টান দিয়ে খায়।খুব বেশী উত্তেজনাময় নয়।আমার কখনো খেয়াল হয়না ব্যোমকেশ এতো নরম কেইস কেন…।”
বাকীটা বলতে পারলো না অনল।বেলী কান্নামাখা দৃষ্টিতে প্রায় পুরুষটির দিকে তাঁকিয়ে আছে।
“আপনি স্পয়লার কেন দিলেন?জানেন গোয়েন্দাতে সব বলে দিলে কোনো মজা থাকেনা।”
“উত্তম কাজ করেছি।এর থেকে সময়টা লস না করে অন্য একটা বইয়ে কাজে লাগাতে পারো।কিন্তু এভাবে হেঁটে হেঁটে নয়।”
“সেটা আমি বুঝবো।Bad boy কোধাকার।”
হাতের বই দ্বারা অনলের শক্ত মাসলে আ”ঘা”ত করলো বেলী।এ যেন কষ্টের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।অনল এবার উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো।কী মন্ত্রমুগ্ধের মতোন হাসে পুরুষটি।
“ওকে ওকে ললিতা।এতো কষ্ট পেওনা।আমি তোমার ক্ষতিপূরণ হিসেবে লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিতে দিবো।কিন্তু সেটা ধারে।ঠিক আছে?”
“না ধন্যবাদ।এখন যাবেন নাকী মানুষ ডাকবো?”
“মানুষ ডেকে বলবে কী?”
“বাবাকে ডাকবো।”
“হ্যাঁ তোমার বাবা।অনেকদিন ধরে কথা হয়না।তিনি কী বাড়ীতে আছেন?দেখতে হচ্ছে তো।”
বেলীকে পাশ কাঁটিয়ে ভেতরে যাচ্ছে অনল।পুরুষটি লম্বাতে অধিক হওয়ায় দ্রুত বেলী তাকে থামাতে পারলো না।তোফায়েল তখন ড্রয়িং রুমে বসে চা পান করছিলো।দুনিয়াতে সমস্ত কাজে তার খুঁত ধরা চাই।স্ত্রীর চা এর মধ্যে প্রধান জিনিস।হুট অনলকে দেখে কিছু উচ্চবাচ্য করলো না।
“কেমন আছেন আঙকেল?ভাবলাম অনেক দিন আপনার সাথে দেখা করিনা আজ করে যাই।”
তোফায়েল সৌজন্যতাবশত হাসলেও একবার ছোট মেয়ের পানে নির্বিকার ভাবে তাঁকালো।ইতিমধ্যে একবার ছেলেটি বিচার নিয়ে এসেছিল বেলীকে নিয়ে।
“বেলী কিছু করেছে অনল?বিষয়টি জিজ্ঞেস করা গুরুদায়িত্ব।কারণ এতো ব্যস্ততার মধ্যে এখানে এসেছো।”
“বেলী?আপাতত করেনি।কিন্তু সম্প্রতি আমার অফিসে একটি ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল।সিলেক্ট করা হলেও সাড়াশব্দ করলো না মেয়েটি।এখন সে জবটা করতে চায় কীনা তা গুরুদায়িত্ব।যদি অন্য কেউ হতো আমার চিন্তা ছিল না।তবে আপনার মেয়ে নিশ্চয় মজার ছলে একটা অফিসে জবের জন্য যায়নি।”
এতোক্ষণে বেলী বুঝতে পারলো এ পুরুষটির এখানে আসার উদ্দেশ্য।আশ্চর্য ভাবে অনল কী বেলীকে সবসময় বিপদে ফেলতে চায়?বাবার চোখ দেখে মেয়েটা বুঝে গেলো।আর রক্ষা নেই।এমনিতে সকালে রুমির বিষয় নিয়ে তিক্ত অনুভূতি গুলো মিলিয়ে কী যায়নি এখন আবার অনল?চুপচাপ সেখান থেকে সরে গিয়ে রান্নাঘরে মা কে জাপটে ধরলো বেলী।মেয়েকে সাদরে জড়িয়ে নিলো রেবেকা।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালো,
“কী হয়েছে?মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে।”
বেলী কান্নারত কণ্ঠে জবাব দেয়,
“দুনিয়াটা কেমন যেন আমার বিপক্ষে চলছে এক পুরুষের আগমনে।একটু দোয়া করে দাও তুমি মা।খুব খুব খারাপ লাগছে এখন।”
(***)
শশী নিজেকে নিয়ে বেশ সচেতন।মাথার চুল থেকে পা অবধি গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে।সাজসজ্জা কিংবা ফিটনেস ধরে রাখাতে কিঞ্চিত পরিমাণ সমস্যা হলে ঘাবড়ানোর শেষ নেই।রোজ সকালে উঠে কিছুক্ষণ আশেপাশে হেঁটে বেড়াবে।ঠিক জগিং নয়।আজকে সকালের এই নির্জন রাস্তাতে একটি অতি পরিচিত মুখকে দেখলো।যে দ্রুত গতিতে জগিং করে আসছে।অনলের ঘামে ভেজা টি-শার্টটা দেহের সঙ্গে লেপ্টে আছে।শশীর অধর জোড়া নিজ থেকে বিস্তৃত হয়ে গেলো।
“অনল।”
পা জোড়া থামিয়ে দিলো পুরুষটি।শশীকে সে চিনতে পারলো।হাসি ফিরিয়ে দিয়ে শুধালো,
“জগিং?”
“সেমি-জগিং।”
“এরকম কিছু আছে বলে মনে হয়না।এসো পাশাপাশি হাঁটি।”
অনল ও শশী পাশাপাশি হেঁটে চলেছে।নিরবতা ভেঙে শশী শুধালো,
“শুনলাম কাল বাসায় গিয়েছিলেন?বেলী কীযে কাজ করছে ইদানীং।শুধু বাবার কাছে বকা খাচ্ছে।হয়তো আপনার অফিসে এখন বাধ্য হয়ে জবটা করতে হবে।”
“বাধ্য হয়ে?কেন?”
“বাবা বলেছেন মজার ছলে কারো কর্মক্ষেত্রে এহেন কিছু সে বরদাস্ত করবেনা।”
“আমি ব্যতীত বেলী আর কী কী করেছে ইদানীং?”
“বিশেষ কিছু নয়।ওর এক বান্ধুবী আছে রুমি।তার বিয়ে হবে সামনে।”
“তো?”
শশী পুরো বিষয়টি অনলকে ব্যাখা করলো।বেলী যে ভীষণ সাহসী এতে সন্দেহ রইলো না ছেলেটার।হঠাৎ সে শশীর উদ্দেশ্যে শুধালো,
“রুমির ব্যাপারটাতে বেলী কিন্তু দোষী নয়।তা কী খেয়াল করেছো শশী?”
“দোষ অবশ্যই আছে।অনধিকার চর্চা করা কী দরকার ছিল?”
“মাঝেমধ্যে কারো ভালোর জন্য অনধিকার চর্চা করতে হয় শশী।বাদ দাও বিষয়টি তুমি বুঝবেনা।আমি আরেকবার রাউন্ড দিবো এই রাস্তাতে।আর একটা কথা শশী।অচেনা কাওকে কখনো নিজের পরিবারের বিষয় বলতে নেই।সে যতো জিজ্ঞেস করুক না কেন।”
অনল দ্রুত দৌড়ে এগিয়ে গেলো।শশী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো অনলের দিকে।আশ্চর্য!বেলীর পক্ষ নিলো কেন ছেলেটি?
চলবে।
#আমার_ললিতা
#পর্ব:১১
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“আপাতত বিষয়টি দেখে বোঝা যাচ্ছে আপনার সব পরিশ্রম খুব শীঘ্রই কোনো এক কোম্পানির কাছে বিক্রি হতে চলেছে।বিষয়টি দুঃখজনক।কিন্তু একটিবারও বিচলিত হতে দেখা যাচ্ছে না কেন?সিকান্দার স্যার জানলে বিষয়টি খারাপ হবে।”
“সাকিব, বাবাকে তুমি জানাবে বিষয়টি?”
“আরে না স্যার।আমি কেন জানাবো?আপনি জানেন কতোটা লয়্যাল আপনার প্রতি।যার জন্য আমি কষ্ট করি সেই বলে চোর।”
অনল চোখ দুটো কিঞ্চিত ছোট করে ফেললো।সাকিব নামের ছেলেটা তার সব কাজের সঙ্গী।যেকোনো ফরমায়েশ সবার আগে পালন করে।অনল তাকে কখনো পুরোপুরি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাপদন্ডে মাপেনি।তবে হ্যাঁ সে যে বেশী কথা বলে এই বিষয়ে সুনিশ্চিত।ল্যাপটপটা সরিয়ে রাখলো অনল।চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল,
“পারফিউম তৈরীতে ব্লেন্ডিং এর ক্ষেত্রে তিনটে ধাপ আছে।টপ নোটস,মিডল/হার্ট নোটস,বটম/বেস নোটস।আহসানের কাছে টপ ও হার্ট নোটসের সব তথ্য আছে।কিন্তু বেস?সেটা সে কীভাবে করবে?দাবার অন্তিম চাল ঠিক এখানে আছে।আমার মাথায়।”
“বেস?আমি যতোদূর জানি আপনি নিজেও বিশেষ সুগন্ধের বেস নোটস এখনও তৈরী করেননি।”
“করতে কতোক্ষণ?”
“পূর্বের স্যাম্পলগুলো তো হারিয়ে ফেললেন।”
“আহসানকে এখুনি সন্দেহ করার কিছু নেই।পাসপোর্টের সব তথ্য আগে আসুক।কবে নাগাদ আসবে?”
“বলল তো পরশু অবধি পেয়ে যাবেন।এয়ারপোর্টের লোকেরা তথ্যগুলো দিতে চায়নি।”
“স্বাবধান যা করবে বাবার আড়ালে করবে।”
দরজার গ্লাসে মৃদু শব্দ হলো।অনল ভেতর প্রবেশের অনুমতি দিলে সিকান্দার চেহারাতে সবথেকে বেশী গম্ভীরভাব ফুটিয়ে তুলে ছেলের সামনে এসে দাঁড়ালো।অনলের মতোন বুদ্ধিসম্পন্ন, চতুর পুরুষটিরও একটি শত্রু আছে।সেটা তার বাবা।এক কোষে দুই তরবারি হতে পারেনা।এক্ষেত্রে দুটো তরবারির এক কোষে বসবাস।সিকান্দারকে দেখে সাকিব উঠে সালাম দিলো।চোখের ইশারায় তাকে বসতে বলল সিকান্দার।অনল নিজের ল্যাপটপের স্ক্রিনে ডুব দিয়েছে।
“অনল তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।”
“আমার সাথে?আশ্চর্য সিকান্দার স্যার।আপনি না কাল বাসায় জারি করলেন আমার সাথে কথা বলবেন না।কী আর করবেন?আপনার ছেলে হয়েছে এতো সুন্দর, মিষ্টভাষী,নেশালো।যাকে এতো সহজে এভোয়েড করা যায়না।”
ছেলের এই অসহ্যকর কৌতুকগুলো হজম করে নিলো সিকান্দার।প্রচন্ড রেগে বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করলো না।মুখে বলল,
“তোমার নতুন স্টুডেন্টদের মধ্যে থেকে এসিস্ট্যান্ট নেওয়াকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি।শুনলাম একজনকে হায়ার করেছো।”
“অতি উত্তম শুনেছেন।আমি আরো একটি সংযুক্ত করি।বেলী সুন্দরী,যোগ্যতাসম্পন্ন,বুদ্ধিমতী মেয়ে।”
“আমি চিনি ওকে।বেলীর ব্যাপারে স্বাবধান করে দিচ্ছি কোনো প্রকার যন্ত্র” ণা দিবেনা মেয়েটিকে।”
“সে কী বিচার দিয়েছে আপনাকে?”
সিকান্দারের মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো।অনলের মুখে অবিশ্বাসের ছাঁপ।তার ছেলে যে এই মেয়েকে অনেক পছন্দ করে হলফ করে বলে দিতে পারবে।সিকান্দার সাহেব সবার উপর নিজের মর্জি চালাতে পারলেও অনলের উপর কখনো পারেনি।অবশেষে কী সেই সুযোগ বেলী হয়ে ধরা দিলো?
“তুমি কী তাকে নিয়ে বিচার দিয়েছিলে?”
“একদম নয়।শুধু অভিমান ব্যক্ত করেছি।”
“ভাবতে পারো একই বিষয়।বেলী নিজেও অভিমান ব্যক্ত করেছে।যদি সে আরো বেশী অভিমান দেখায় তবে তোমাকে এক বছরের জন্য বনবাসে পাঠানো হবে ব্রাজিলে।চয়েজ তোমার।”
“আমাকে এভাবে হু’ম’কি দিতে পারেন না মি.সিকান্দার।”
“সব পারি আমি।”
অনলকে অবিশ্বাসে ফেলে সিকান্দার সাহেব কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।অনল ফুটবলের অতীব ফ্যান।সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হিসেবে একটি দেশকে পুরোদস্তুর অপছন্দ করে।একমাত্র এটি তার দূর্বলতা।বেলীকে যে আর জ্বা’লা’বেনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে সিকান্দারের অধরযুগলে স্মিত হাসি ফুঁটে উঠলো।সাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“স্যার,আমাকে সাথে নিয়ে যাবেন?”
“দেখো তো বেলী এসেছে কীনা?”
“ওকে।”
মিনিট খানেক বাদে সাকিব নয় বেলী নিজেই ভেতরে ঢুকলো।হাতে তার আজকে একাডেমিক বই।অনলকে পুরোদস্তুর ইগ্নোর করে একটি চেয়ারে বসলো।
“ললিতা,তুমি কী জানো না বসের সাথে কীভাবে সৌজন্যতাবোধ দেখাতে হয়?”
“জানি।আপাতত পড়াশোনা তে ব্যস্ত।ডিস্টার্ব করবেন না।”
“এখানে কাজের জন্য হায়ার করা হয়েছে।”
“ডেকে ডেকে বিপদ আনার মতোন সাহসী একমাত্র অনল।এনেছে যখন তখন তার উচিত চুপ থাকা।কিন্তু না সে থাকবে কেন?লালসালুর মজিদের মতোন শুধু শুধু খেঁকিয়ে উঠবে।হুহ।”
এ যেন এক নতুন বেলী।চঞ্চলতা যার মধ্যে ধীরে ধীরে পরিস্ফুটিত হচ্ছে।অথচ মেয়েটা মাসখানেক আগেও ছিল নির্জীব পুতুল।আপাতত পড়াশোনার চাপে কপাল দুটো কুঞ্চিত হয়ে গেছে তার।অনল কথা না বাড়িয়ে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।হঠাৎ একটি বিষয় মনে হওয়াতে মেয়েটির অগোচরে ছবি তুলে নিলো।দ্রুত কারো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়ে এসএমএস করলো,
“আমার ললিতাকে পূর্বের চঞ্চলাতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম আমি।কিন্তু এরপর তোমার কী হবে সেটা একবারও ভেবে দেখেছো?অনল কিন্তু কাওকে ছাড়েনা।”
ওপাশ থেকে এসএমএসটি সিন হলেও কোনো জবাব এলো না।
(***)
পুরো একটা বিকেল নিরিবিলি পেয়েছিলো বেলী।আগামীকাল সিটি আছে তার।কিন্তু পড়া শেষ হয়েছিল না।সেই একমাত্র এমপ্লয় হবে যে অফিসের প্রথম দিন এসে পরীক্ষা পড়া পড়েছে।অবশ্য জোর করে না আনলে ভালো কিছু হতো।বইগুলো গুছিয়ে রেখে বেলী টেবিলে বসে থাকা অনলের দিকে তাঁকালো।যে ফাইল ঘাটতে ব্যস্ত।কিছু একটার হিসেব মিলছেনা বোধহয় তার।যার জন্য বিরক্তিভাব তার শুভ্র কপালে চাঁদের মতোন ফুঁটে উঠেছে।বেলী অকপটে স্বীকার করতে পারবে তার দেখা সবথেকে সুদর্শন পুরুষটি হচ্ছে অনল।হঠাৎ মনে পড়ে গেলো ছেলেটিকে নিয়ে ল্যাপটপে তৈরী করা ফাইলে সে এখন অবধি একটি অক্ষরও লিখেনি।সত্যিকার অর্থে লিখবে কী সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলনা।বেলীর হাত দুটো যেন সংক্রিয়ভাবে চলল।নোটবুকটা হাতে তুলে লিখতে লাগলো,
“অনল নামের পুরুষটির সৌন্দর্য আকাশসম,অহংকার মহাকাশসম।বুদ্ধিমত্ত্বা ওটা ভূমির সর্বনিম্ন স্তরে।”
শেষের গুণটি লিখতে পেরে বেলী অন্তরে ভীষণ প্রশান্তি পেলো।হাসি তার অধর ছুঁয়ে গেলো।
“হাসছো কেন ললিতা?”
“কিছু সত্যি উপলব্ধি করতে পেরে এমন হাসি পেলো।তা অনল স্যার আমার নামটা বেলী।ললিতা নয়।অর্থ অনুসারে শব্দটি ভীষণ খারাপ।”
“আমি তোমাকে সুন্দরী বলছি এতে দোষ কোথায়?যেমন তুমি আমার সৌন্দর্য আকাশসম লিখেছো।”
চমকে উঠলো বেলী।হাতের কাগজটি দুমড়েমুচড়ে ধরলো।ঠিক তার মাথার উপর যে সিসিটিভি সেটি এখন খেয়াল হলো।অনল আত্নগরীমাতে বুঁদ হয়ে বলল,
“কাগজটি আমাকে দেখাতে পারো।”
বেলী তৎক্ষনাৎ মুখে ঢুকিয়ে চিবুতে লাগলো।জেদ দেখে অনল উচ্চশব্দে না হেসে পারলো না।অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ালো সে।হেঁটে বেলীর পিছনে দাঁড়ালো।ঝুঁকে মেয়েটির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“দাঁত দিয়ে পিষে ফেলার জন্য বহু বিষয় আছে ললিতা।কাগজটি অতি নগণ্য।লেট মি হ্যাল্প ইউ।ডু ইউ ওয়ানা ট্রাই মি?”
শিউরে উঠলো পুনরায় বেলী।হুটহাট পুরুষটি এতো বেপরোয়া করে তুলে কেন তাকে?যেখানে সে প্রতিবাদ করতে অবধি পারেনা।
চলবে।