আমার হায়াতি পর্ব-০১

0
8

#আমার_হায়াতি
পর্ব : ১
লেখিকা: #Nahar_Adrita

সকালের আলো আজ যেন একটু বেশি স্লাম। জানালার পর্দা সরালেই দেখা যায়, ঘন মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। রোদ নেই, বাতাসেও নেই কোনো উচ্ছ্বাস। কাকের কাক কাক ডাক ছাড়া শব্দহীন মহল্লা।

হায়াতের ঘুম ভাঙে অস্থির এক নিঃশ্বাসে।পিট পিট করে চোখ খুলে তাকায় দেয়াল ঘড়ির দিকে, এখন সাতটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আজ থেকে তার নতুন জীবন, নতুন যাত্রা শুরু হবে। বুকে একরাশ ব্যাথা নিয়েও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আফরা শিকদার হায়াত।খুব শান্তশিষ্ট মেয়ে হায়াত।গায়ের রং দুধে আলতা,গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েও বলা যায়।সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষে এখন নতুন কলেজে ভর্তি হবে হায়াত। বাবা আব্দুল শিকদার উলাইল গ্রামের এক ছোট্ট প্রাইমারি স্কুলের দপ্তরি। আর্থিক অবস্থা একটু খারাপই। হায়াতের স্বপ্ন সে অনেক পড়াশোনা করবে,কিন্তু পরিবারের কথা অনুযায়ী সে ভেবেই নিয়েছিলো কলেজে আর ভর্তি হতে পারবে না সে।হায়াতরা এক ভাই এক বোন। হায়াত বড়,তার ভাই সবে ক্লাস নাইনে। হায়াতের মা আলিয়া মেয়ের ভেতরের চাপা কষ্ট বুঝতে পারলেন। এজন্য ঠিক করলেন মেয়েকে তার বোন সালেহার বাসায় পাঠাবেন। বোনের সাভার নিজস্ব একতলা বাড়ি আছে। অবস্থাও মোটামুটি বড়লোকদের চেয়ে কম না।

হায়াত শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছিলো। এর মধ্যেই রুমে প্রবেশ করলো রাব্বি, হায়াতের ভাই।দৌড়ে এসে বিছানায় বসে বললো,
– আপাই তুই আজ চলে যাবি।
– হু। আব্বা রেডি হয়েছে ?
– নাহ আব্বা দোকানে গিয়েছে, তোর পছন্দের খাবার কিনতে।
– অযথা টাকা নষ্ট করতে হবে কেনো,আমি কি বলেছি আমার শুকনো খাবার লাগবে, কিনে দিতে।

এই বলেই আড়মোড়া ভেঙে বসলো হায়াত। মাথার ঘন হাটু অব্দি চুল গুলো হাত দিয়ে খোঁপা করে নিলো। রুমে প্রবেশ করলেন মিসেস আলিয়া। একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে মেয়েকে বললেন,

– আম্মা কোনো দুষ্টুমি করবে না,খালাম্মা বিরক্ত হবে এমন কাজ করবে না। আজে বাজে দিকে মন দেবে না,আমি জানি তো তুমি লক্ষি শান্তশিষ্ট মেয়ে,তবুও বলে দিই। তোমার খালামনি না থাকলে তুমি সাভার কলেজে ভর্তি হতে পারতে না।

মায়ের কথায় মুচকি হাসলো হায়াত। বললো,

– আম্মু চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে তোমাকে নিরাশ করবে না।
এরপর মা মেয়ে দুজন মিলে সব গোঁজ গাঁজ করে নিলো।

বাবা, আব্দুল শিকদার রেডি হয়ে গেছেন। তাঁর মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু চোখের কোণে যে একটু টান, সেটা হায়াত ঠিকই দেখে ফেলেছে।

– চল মা, বাস মিস হইলে ঝামেলা হবে,

বলেই বাবার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা একটু উঁচু করে নেন তিনি। হায়াত চুপচাপ তাঁর পেছন পেছন বেরিয়ে আসে। মায়ের চোখে পানি, কিন্তু তিনি বললেন না কিছু, শুধু দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, যতক্ষণ না তাদের ছায়া অলিতে গায়েব হয়ে গেল।

বাসে ওঠার সময় হায়াতের বুক ধক ধক করছিল। হাওয়া বদলের মতো কিছু একটা। বাবার পাশে জানালার পাশে বসে সে বাইরে তাকিয়ে থাকে। পুরোনো দোকান, পরিচিত গলি, ছোট ছোট দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা—সবই পিছনে পড়ে যাচ্ছে।

বাবা মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছেন,
— কিছু লাগবে।

হায়াত মাথা নাড়ে,বলে,
— না আব্বু।

সাভার রোডে ঢুকতেই বাসে লোকজনের ভিড় বেড়ে যায়। হায়াত জানালা দিয়ে দেখতে পায় খোলা মাঠ, ঘন গাছ, আর দূরে কোথাও একটা কলেজের সাইনবোর্ড।
বাবা বললেন,
— এই কলেজেই তো ভর্তির কথা বলেছি, খালার বাসা কাছেই।

হায়াত মুখ তুলে বাবার দিকে তাকায়। আব্দুল শিকদার একজন সৎ, সরল মানুষ। গ্রামের
ব্যয়বহুল জীবন থেকে মেয়েকে দূরে সরিয়ে সাভারে পড়তে পাঠাচ্ছেন—মধ্যবিত্ত এক বাবার কষ্টের বাস্তবতা।

বাস থামে এক জায়গায়। বাবা মেয়ের হাত ধরে নামিয়ে আনেন। রিকশা নিয়ে সোজা খালার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। খালা দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন,

— এই হায়াত রে, তুই তো বড় হইয়া গেছোস!

হায়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নতুন একটা শহর, নতুন একটা জীবন শুরু হচ্ছে।বাবার মুখের পানে তাকালো হায়াত।আব্দুল শিকদার বুকভরা কষ্ট নিয়ে বললেন,

– আসি রে আব্বু। নিজের খেয়াল রাখিস।

হায়াত সাথে সাথে কান্না করে দিলো,বাবা পরম যত্নে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মিসেস সালেহা মায়া ভরা চোখে হায়াতের পিঠ দোয়াতে থাকলেন।

________

নতুন জায়গা রাতে ঘুম না হওয়াই স্বাভাবিক। রাতটা কোনো রকমে কাটালো হায়াত।কেমন অদ্ভুত লাগছে তার কাছে সবকিছু। কাল তাকে খালাতো ভাই জিসান কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবে। জিসান ছেলেটা সবে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন চোখটা লেগে গেলো হায়াতের।

সকাল সাতটা একটা বোরকা পড়ে হিজাব করে নিলো হায়াত। একটু পর সালেহা বেগম এসে বললেন,

– আম্মুরে রেডি হয়েছিস। জিসান অপেক্ষা করছে।
– হ্যা খালাম্মা, আমি রেডি এক্ষুনি আসছি। বলেই মিষ্টি করে হাসলো হায়াত।

জিসান অপেক্ষা করছিল। হাতে একটা কালো ছাতি আর কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ।

— চল হায়াত, কলেজ বেশি দূরে না। হাঁটতেই যেতে পারবো।”

হায়াত কিছু না বলে চুপচাপ পা বাড়াল ওর পেছনে। সাভারের রাস্তাগুলো শান্ত, শহরের কোলাহল নেই। হালকা হাওয়ায় জামার আঁচল উড়ছিল।

জিসান হাঁটতে হাঁটতে বলল,
— ভয় পাইস না, আমি আছি। মডেল কলেজে ভর্তি নিতে বেশি সমস্যা হয় না। আর মেয়েরা রেজাল্ট ভালো করলে টিচাররাও খুশি থাকে।

হায়াত শুধু হাসল একটু, ঠোঁটের কোণে। জিসানের স্বভাব সে জানে—সবকিছু সহজ করে বলা, সহজ করে নেওয়া। কিন্তু ওর মনটা সহজ নয় আজ।

সেদিনের আকাশটা অদ্ভুতভাবে শান্ত। সাভার মডেল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে হায়াত যেন একটু হালকা নিশ্বাস ফেলতে পারল। কাগজগুলো ব্যাগে গুছিয়ে রেখে, চোখে-মুখে একরাশ অদ্ভুত স্বস্তি নিয়ে সে কলেজ গেট পেরিয়ে যাচ্ছিল।

পাশে হাঁটছিল ওর খালাতো ভাই জিসান।
— “দেখিস, এই কলেজে পড়েই একদিন তুই অনেক বড় হবি,”
বলল সে, গর্ব মেশানো কণ্ঠে।

হায়াত একটু হেসে বলল,
— “স্বপ্ন তো বড়ই… এখন শুধু পথ চলা শুরু।”

ঠিক তখনই, হঠাৎ…

ঠাস!
একজন লম্বা, সুদর্শন পুরুষ হঠাৎ করেই গেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, আর হায়াত সোজা গিয়ে ধাক্কা খেল তাঁর বুকের সঙ্গে।

হায়াত পেছনে একটু হেলে পড়ল, হাতের ভর্তি স্লিপ ও একগাদা কাগজ মাটিতে ছিটকে পড়ল।

— “উফ্! আমি… আমি দুঃখিত!”
হায়াত তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে কাগজ তুলতে লাগল।

পুরুষটি হালকা ভুরু কুঁচকে তাকালেন,মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো আদিব,কালো বোরকা নেকাপ পরিহিত, চোখ গুলো টানা টানা, শান্ত কন্ঠে রয়ে যাওয়া গাম্ভীর্যে ভরা স্বরে বললো,
— সবাই কাগজ হাতেই বের হয়, কিন্তু চোখ তো খোলা রাখতে হয়, মিস!

জিসান দৌড়ে এসে কাগজ তুলে দিয়ে বলল,
— “স্যার, ও আমার খালাতো হায়াত। আজ ভর্তি হল। নতুন এসেছে।

আদিব একবার হায়াতের দিকে তাকালো,ঠিক তখনি দুজনের চোখাচোখি হলো, গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডে লেখা:
সাদাদ আদিব চৌধুরী — অতিথি প্রভাষক (ফিজিক্স)”

— নতুন বলেই ধাক্কা দিবে, সেটা তো না,
আদিব স্যার বললো, তবে ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা দেখা গেল।

— আচ্ছা, সাবধানে চলবে। ক্লাসে দেখা হবে। মাঝে মাঝে দু-একটা ক্লাস নিই, কিন্তু স্যারদের কথা রাখতে হয় তো,
বলেই পকেট থেকে ফোন বের করে চোখ নামিয়ে হাঁটা ধরলো। পেছন থেকে রাজ নামে ছেলেটাও আদিবের সাথে চলে গেলো।

হায়াত স্থির দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। বুকের ভেতর কেমন হালকা ধকধক করছে।
এই প্রথম কোনো শিক্ষক ওকে এমনভাবে দেখে কথা বললেন—একটু কঠিন, কিন্তু গভীর কিছু একটা ছিল দৃষ্টিতে।

জিসান হেসে বলল,
— “এইটা আদিব স্যার। কলেজের গেস্ট টিচার টাইপ, কিন্তু হেভিওয়েট।শহরের নাম করা বিজনেজম্যান রাকিব চৌধুরীর একমাত্র ছেলে, স্যারদের অনুরোধ মাঝে মাঝে ক্লাস নেন। আগে এখানকার টপ বয় ছিলেন,পড়ান অল্প,কিন্তু তার পড়া যে কেউ বুঝে যায়।

হায়াত বলল না কিছু। শুধু ধীরে ধীরে কলেজ গেট পেরিয়ে চলতে থাকল।
তবে পেছনে ফেলে আসা সেই ধাক্কার মুহূর্তটা মনে গেঁথে গেল গহীনে।

সেদিন শুধু ভর্তি হয়নি হায়াত,

সে প্রথমবার হৃদয়ের ভেতর একটা অদ্ভুত স্পর্শও টের পেয়েছিল—যেটা এসেছিল এক অপরিচিত, গম্ভীর, আর একরকম সুন্দর মানুষ থেকে।

#চলবে…………