#আমার_হায়াতি
পর্ব : ৪
লেখিকা : #Nahar_Adrita
একটা মাস কেটে গেছে হায়াত আর আদিবের আংটি পরানোর পর। সময়টা যেনো উড়েই গেলো। আজ শুক্রবার—শান্ত, মোলায়েম একটা সকাল। সকালবেলা থেকেই হালকা গুঞ্জন, উত্তেজনা হায়াতের ঘরে। কারণ আজ হায়াতের বিয়ে—একেবারে ঘরোয়া ভাবে, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন আর কাছের মানুষদের উপস্থিতিতে।
উলাইল থেকে সকালে রওনা দিয়েছিল হায়াতের মা-বাবা। তাদের মুখে ছিল গর্ব আর অদ্ভুত এক আবেগের ছায়া। ছোটবেলার সেই মেয়েটা আজ সত্যি সত্যি বিয়ে করছে! গায়ে একটুখানি লাল কাজের সালোয়ার-কামিজ পরে, সোনালি কাজের ওড়না মাথায় হালকা করে চাপা দিয়ে হায়াত যখন বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল, মা’র চোখে পানি চলে এসেছিল।
সাভারের বাড়িটা আজ অন্যরকম সাজে সেজেছে। ঘরজুড়ে মেহেদি আর আতরের গন্ধ। বারান্দায় টানানো বাতিগুলো সকাল থেকেই জ্বলছে—আলোর মতোই উজ্জ্বল হায়াতের আজকের দিনটা।
আদিব একটু গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে, আবার বারবার ফোন চেক করছে—কেউ যেনো দেরি না করে, কিছু যেনো ভুল না হয়।
বাবা আদিবকে দেখে হেসে বললেন,
– জামাই সাহেব, এখন থেকেই এত টেনশন নিলে চলবে।
আদিব লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ফেললো।বললো,
– বাবা তুমি তো যানোই হায়াত পর্দা করে,খুব ভদ্র মেয়ে। ও হারাম সম্পর্কে জড়াবে না বলেই এতো আগেই বিয়েটা করে ফেলা।
– হ্যা বাজান একদম ঠিক কাজ করেছ,তোমার মা বিদেশ থেকে আসলেও খুব খুশিই হবে।
– মাকে নিয়েই একটু ভয়। কেমন রিয়াক্ট করবে…..
– ওটা পরে দেখা যাবে,চলো গাড়ি বের করেছে রাজ।
– হু। হায়াতি কিন্তু আমার সাথে রেগে আছে বাবা,
– কি বলিস, কেনো।
– ওইদিন একটা ছেলে এসে হায়াতকে প্রপোজ করে,আমার রাগ সামলাতে না পেরে হায়াতকে চড় মেরে বসি, এখন কথায় বলে না আমার সাথে। আল্লাহ জানে আজ কি করবে।
– বিয়েটা হোক সব ঠিক হয়ে যাবে।
—
আকাশে তখন হালকা মেঘের ছায়া, ঘরোয়া বিয়ের আয়োজন চলছে হায়াতদের সাভারের বাড়িতে। ছিমছাম সাজ, উঠানে গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে বিরিয়ানির গন্ধ।
ঠিক তখনই দূরে একটা গাড়ির হর্ন বাজলো। সবাই জানে—জামাই আসছে।
একটু পরেই বাড়ির গেটের সামনে এসে থামলো একটা চকচকে কালো গাড়ি। দরজাটা খুলতেই যিনি নামলেন, সবাই যেন মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
সাদা পাঞ্জাবি আর কালো ওয়েস্টকোট, চোখে হালকা সানগ্লাস, মাথায় ঝুঁকে পড়া চুলগুলো নিখুঁতভাবে সাজানো। সুঠাম দেহে একরকম অভিজাত ব্যক্তিত্বের ছাপ। যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য থেকে হেঁটে আসা মানুষ।
হায়াতের এক চাচী মুগ্ধ হয়ে ফিসফিস করলেন,
-মাশা’আল্লাহ, জামাইটা তো একেবারে নায়ক।
হায়াতের ছোট ভাই তো দেখে দেখে থ হয়ে আছে, আর ফিসফিস করে বলছে,
– বোনজামাই না কি হিরো ? এতো সুদর্শন। আল্লাহ গো
আদিব গেট পেরিয়ে ভিতরে এল, মাথা নিচু করে সবার সালাম নিলো। আদবকায়দায় কারো কোনো অভিযোগ করার সুযোগ নেই। হায়াতের মা একটু চোখে পানি চেপে বললেন,
– আল্লাহ ভালো রাখুক আমার মেয়েটাকে, ভালো মানুষটাই জুটেছে।
আদিব যখন হায়াতের সামনে এসে দাঁড়ালো, হায়াত একটু অবাক হয়ে তাকালো। যেন এই মানুষটাকে নতুন করে দেখছে আজ। আদিব হালকা হেসে ফিসফিস করে বলল,
– এই প্রথম বার সত্যিকারের জামাই হয়ে এলাম, কেমন লাগছে।
হায়াত লজ্জায় রাগে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, কিন্তু ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি লুকিয়ে থাকলো—সেই হাসি, যা শুধু আদিবের জন্য।বললো,
– সরুন কথা নেই আপনার সাথে।
– কেনো
– আপনি আমাকে চড় মেরেছেন।
ঠাসসসসসসসসসসসসস আরো একটা চড় দিলো হায়াতকে আদিব।ড্যাব ড্যাব করে আদিবের দিকে তাকালো হায়াত। বললো,
– আমি কি করলাম আবার মারলেন।
– কিছুই করো নি।এমন মার অনেক খাবা রাগ দেখালেই।
হায়াত ন্যাকা কান্না করে বললো,
– এটা ঠিক না,বিয়ের দিনও মার খেতে হলো,
– ইসরে, বউ আসো আদর করি।
– ন্ না স্ সরুন।
আদিব এতোক্ষণ হায়াতের দিকে খেয়াল করে নি।এই মূহুর্তে তাকাতেই যেন থমকে গেলো আদিব। হায়াতের পড়নে গাঢ় লাল বেনারসি। সোনালী জরির সুক্ষ্ম কাজ।কপালে ছোট্ট স্বর্নের টিকলি,কানে ঝুমকা,গলায় চেইন,হাতে মেহেদীর গাঢ় ছাপ। হাত ভর্তি স্বর্নের চুড়ি। মুখে কোনো প্রসাধনীর রেস পর্যন্ত নেই,তবুও কত্তো অমায়িক লাগছে হায়াতকে। শুকনো ঢোক গিললো আদিব, গম্ভীর ভাব রেখেই বললো,
– শুনো হায়াতি পাখি।
– হু।
– এতো সাজবে না আর,তোমাকে দেখলে আমার সব দাড়িয়ে যাই।
– কিহ।
– আবেগ।
– কেনো।
– বুঝবে না,আমার মাথা ঠিক নেই,সব গুলিয়ে যাচ্ছে, চলো বিয়ে করে ফেলি।
– হ্যা, আজই তো আমাদের বিয়ে।
– ওহ হ্যা আমি গেলাম, তুমি সাজো।
হায়াত কিছুই বুঝতে পারলো না,কি বললো এসব, যাক বাবা আজই তো আমাদের বিয়ে, তাহলে এগুলো বলার মানে কি। ধুর ভাল্লাগে না, আজও মার খেলাম।
___________
বিয়ের ঘরোয়া আয়োজন চলছিল নিঃশব্দ উত্তেজনায়। মৌলানার কণ্ঠে ধীর, সুরেলা তেলাওয়াতের পর হায়াতকে প্রশ্ন করা হলো,
— “আপনি আফরা সিকদার হায়াত , কবুল করছেন এই বিয়েটি ?
সবাই চুপ। সবার চোখ হায়াতের দিকে। কিন্তু হায়াত কিছু বলছে না। সে মাথা নিচু করে বসে আছে, হাত কাঁপছে খানিকটা। বুকের ভিতরটা ঢেউ খেলছে, অজানা এক আবেগে।
আদিব দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ধৈর্য হারিয়ে ফেলেনি, কিন্তু ভেতরে কেমন একটা টানাপোড়েন চলছিল। সে জানে হায়াত ভয় পাচ্ছে না, শুধু একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। সবাই যখন ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে, আদিব হঠাৎই এগিয়ে এলো হায়াতের দিকে।
হালকা মাথা নিচু করে হায়াতের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
– আর কতক্ষণ রাখবে আমাকে অপেক্ষায়, হায়াতি,বাসায় গিয়ে বাসর করবো তো নাকি।
হায়াত চোখ তুলতেই আদিব তার দিকে ঝুঁকে এলো,,,,,,আস্তে করে হায়াতের ঠোঁটে ঠোঁট পুড়ে নিল আদিব, সময়টা একান্ত হয়ে উঠল। কোনো শব্দ নেই, শুধু নিঃশ্বাসে ভরপুর এক নরম স্পর্শ, যা বলল—
“আমি আছি, ভয় নেই।”
হায়াত চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিলো, তারপর মুখ তুলে শান্ত, দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— কবুল।
ঘর যেন হালকা হাসির রোলে ভরে উঠল। মা চোখ মুছলেন, আর আদিব একটু হেসে সরে গিয়ে দাঁড়াল।
এই বিয়ের সাক্ষী শুধু মানুষজন না—একটা সাহসী ভালোবাসার গল্পও।
হায়াতের খালাতো ভাই জিসান বললো,
– দুলাভাই বিয়েটা হওয়ার আগেই তো কাম সেরে ফেললেন,তারপর বিয়ে হলো।
– হ্যা শালা,তোমার বোন টানতেছিলো আমাকে,আমার আর কি দোষ বলো।
নিকা শেষ, মেহমানরা বিদায় নিয়েছে একে একে। সন্ধ্যা এখন গাঢ় হয়ে এসেছে। উঠানে বাতিগুলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। কিন্তু হায়াতের ঘরের ভেতরটা তখনো আলোয় ভরা, আর চোখের জলে ভিজে ভিজে আবছা।
হায়াত বসে আছে লাল বেনারসিতে, পাশে মা, বাবা, খালা—সব প্রিয়জন। কারো মুখে হাসি নেই, আবার কান্না চেপে রাখা চেষ্টার হাসি ঠিকই টের পাওয়া যায়।
হায়াত চোখে পানি ধরে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু যখন বাবার কণ্ঠটা কাঁপে কাঁপে বলল
— মা… তোকে তো ছোটবেলা থেকেই বলতাম, তুই একদিন ঘর ছাড়বি, কিন্তু আজ বুঝলাম… মেয়ে মানুষ জন্মের পর থেকেই একটু একটু করে বিদায়ের জন্য তৈরি হয়…
তখন আর পারলো না হায়াত। ঝাপিয়ে পড়ে বাবার বুকে।
মায়ের গলার স্বর থেমে গেল, কণ্ঠে শুধু ফিসফাস,
– আমার মেয়ে তো আজ ঘরনী হয়ে গেল…”
পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল আদিব, চুপচাপ। চোখে মায়া, আর একরাশ দায়িত্ববোধ।
ধীরে কাছে এসে একহাত বাড়িয়ে দিলো, খুব আলতো করে।
হায়াত তাকাল তার দিকে। সেই পুরোনো চেনা চোখজোড়া… আজ যেন আরও গভীর, আরও নির্ভর।
আদিব বলল:
– চলো হায়াতি, তোমার নতুন ঘর… তোমার পৃথিবী অপেক্ষায় আছে।”
হায়াত চোখ মুছে নিলো। বাবা-মাকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে, পেছন ফিরে তাকিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ভাইটা হঠাৎ বলে উঠলো—
– আপাই তুমি না গেলে বুঝতাম না, বোন হারানো কেমন লাগে…
গাড়ির জানালা দিয়ে হায়াত হাত নেড়ে বলল, চোখ ভিজিয়ে—
– হারায়নি তো… আমি আছি, শুধু ঠিকানাটা পাল্টেছে।”
গাড়ি চলা শুরু করলো…
আর পেছনে থেকে রইলো—একটা শূন্যতা, আর একরাশ দোয়া ভরা ভালোবাসা।
চলবে…….