আমার হৃদয়ে সে পর্ব-১০

0
855

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১০

১০.
একঘন্টা হলো”প্রোডাক্টস এক্সিবিশন অন আর্ট ২০২১” শেষ করে বাসায় ফিরেছি।এরমাঝে ফ্রেশ হয়েছি। খাওয়াদাওয়ার কাজ সেরেছি।সারাদিনে খুব পরিশ্রম গিয়েছে।এখন ভীষণ ক্লান্ত।একটু ঘুম প্রয়োজন।জানলার পর্দাগুলো নামিয়ে দিয়ে কোলবালিশ টেনে কাত হয়ে শুয়ে গেলাম।চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম আলতো ভাবে।কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর চোখে ঘুম জড়িয়ে গেল।ঘুম ভাঙ্গে সন্ধের পর।চারদিকে তাকিয়ে দেখি অনেক রাত হয়ে গেছে।সময় লাগলো আড়মোড়া ভাঙ্গতে।আড়মোড়া ভাঙ্গার পর উঠে বসলাম।তারপর বাথরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে এলাম।ডাইনিং এ খালামণি খাবার জড়ো করছেন।ফাহিম সোফায় বসে খেলা দেখছে।খালামণি আমাকে দেখে বলেন,

“ঘুম কেমন হলো?”
“খুব ভালো।একদম ফ্রেশনেস লাগছে এখন।”

খালামণি মিষ্টি হাসি দেন,
“দুপুরের পরের ঘুম টুকু এরকমই ফিল দেয়।যাইহোক এবার নাস্তা করতে বসো।”

খালামণির কথায় সায় দিয়ে নাস্তা করতে বসলাম।ফাহিমও সাথে যোগ দিলো।খালামণি খাবেন না।পেট নাকি ভরা।নাস্তা খাওয়া অবস্থায় আঙ্কেল অফিস থেকে বাসায় ফেরেন।বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলেন,

“কি করো তোমরা সবাই?”

ফাহিম আওয়াজ তুলে বলে,
“খাচ্ছি বাবা।”

খালামণি বিরক্তি মুখে বলেন,
“দেখো না কি করতেছি?!”

আঙ্কেল খালামণির কথায় আর জবাব দেননি।খানিকটা ফিঁকে হয়ে যান।পরমুহূর্তে আমার দিকে তাঁকিয়ে বলেন,
“পারিসা?আজ সম্ভবত তোমার রেজাল্ট দিবে।”

আঙ্কেলের কথা শুনে খাওয়ার মাঝে আমি কেশে উঠি।আন্টি তরহর জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে তা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে আঙ্কেলকে বলেন,

“তোমাকে কেউ কি জিজ্ঞেস করেছে খাওয়ার মাঝে এত কথা বলতে?এমনিতেই মেয়েটা এক্সিবিশনটা শেষ করে খুব টেনশনে আছে তারউপর আবার রেজাল্টের কথা!
পারিসা পানি খাও।”

খালামণির থেকে গ্লাস টেনে পানিটুকু শেষ করলাম। কাশি ভাব কিছুটা কমে এলো।আঙ্কেল বুঝতে পারলেন রেজাল্টের কথা শুনে আমি খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছি।তাই তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,

“আহা পারিসা এত কাশতে হবে না।যা হবে ভালে হবে।আর রাহেলা ফ্রেশ হয়ে আসছি।খাবার বাড়ো।পারিসার সাথে একসাথে খেতে আসতেছি।”

রাতে আর রেজাল্ট আসলো না।সার্ভারে কি নাকি ঝাঁমেলা হয়েছে তাই পাবলিসড করতে পারেনি।সকালে পাবলিসড করবে।সকাল না হতে পাবলিসড করেও দিলো।কীভাবে বুঝলাম,জানেন?কারণ মাত্র ই-মেইল মেসেজ টোন বেজে উঠেছে।আর ই-মেইলে আমার মেসেজ আসার কথা শুধুমাত্র এক্সিবিশনটা থেকে।আমি আর ল্যাপটপের কাছে গেলাম না।আঙ্কেলকে ডাক দিলাম।আঙ্কেল চোখে চশমা এঁটে সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলেন,

“রেজাল্ট দিয়েছে?”

আমি চুপসে যাই।আমার ভাবান্তরে আঙ্কেল বুঝে যান রেজাল্ট পাবলিসড হয়ে গেছে।তিনি আর কিছু না বলে রুমে আসেন।ল্যাপটপের কাছে যেয়ে রেজাল্ট সম্ভবত চেক করেন।চেক করেই তিনি চোখমুখ কুঁচকে ফেলেন।বলেন,

“হোয়াট আ আনবিলিভএ্যাবল!”

আমার সারা শরীর কেঁপে উঠে।এই বুঝি আমি কেঁদে দিব।আঙ্কেল এটা কেমন কথা বললেন?তারমানে আমি সিলেক্ট হইনি?কাঁপা ঠোঁট যুগলের ফাঁক বেয়ে বেরিয়ে আসে,

“আঙ্কেল, আমি সিলেক্টেড হইনি?”

আঙ্কেল আমার এ’কথার পিঠে হেসে দেন।তারপর ফিরে বলেন,
“তুমি সিলেক্টেড হয়েছো,পারিসা।এটা সত্যিই বিমোহিগ।বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি প্রফেশনাল না হয়ে এতবড় এ্যাচিভ করবে।কংগ্রাচুলেশনস, ডটার!”

এবার আমি সত্যিই কেঁদে দিলাম।চোখের নোনা পানিগুলে খুশির ছিল।অতিরিক্ত খুশির।

১১.
প্রোডাক্টস পেইন্টিং বিজ্ঞাপন হিসেবে টেলিভিশন, ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।প্রকাশের প্রথম দুই তিনদিন তেমন একটা সাড়া পায়নি। চারদিনের মাথায়ই বিজ্ঞাপন আস্তে আস্তে ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়ে যায়।তারা “অটোয়া কোম্পানি ” মানে আঙ্কেলদের কোম্পানির সম্পর্কে জানতে চায়।তাদের প্রোডাক্টসগুলোর চাহিদা বেড়ে যায়।এক সপ্তাহের মধ্যে কোম্পানিটির শত শত প্রোডাক্টস বিক্রি হবার রেকর্ড হয় যা গত বছরের সমীক্ষা থেকে এ’বছর ৩ গুণই বেশি!কোম্পানিটি মোটামুটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির স্টেজে চলে আসে।আঙ্কেলে ত খুব খুশি।বাসায় এসে কতবার যে আমার গুণগান গাইলেন!আমাকে নাকি কোম্পানিতে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করা হবে।মেডেল দিনে।আরো অনেক বড় বড় গ্রিফট।
১২.
সকাল ন’টা বাজে।অবেলায় শুয়ে আছি।মনটা কেনজানি আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে ভীষণ খারাপ।সকালে হুট করেই কতগুলো অতীত মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠলো।জীবনে আমার কতকিছুই পার করে এসেছি। বিয়ে হয়েছে।সংসার হয়েছে। শ্বশুর বাড়ির লোকদেরও দেখা হয়েছে। সবই ভালো ছিল কিন্তু যার সাথে সংসার করেছি তাকেই আমার আজ পর্যন্ত ভালো করে চেনা হলো না।বুঝা হলো না।কখনো ভালোভাবে দেখাও হলো না।স্বচ্ছ কাচের মতন সে ওপাশের দেয়ালেই ঢাকা পড়ে গেল।এখনো ঢাকা পড়ে আছে।খামোখা মাঝখানের এই খন্ডকালীন জীবনটায় যত কষ্ট মুড়েছিল !আজ আমি খুব ভালো অবস্থানেই আছি।স্বামী ছাড়া,নিজের পরিবার ছাড়া।আপনারা হয়তো জানেন না আমাকে অনেক ভালো ভালো কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপন বানাতে বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ কার্ড পাঠায়। অলরেডি আমি অনেকগুলো কোম্পানির বিজ্ঞাপনের সাথে যুক্তও হয়ে গেছি।মাল্টিন্যাশনাল একটা কোম্পানিতেও আমাকে কার্ড পাঠিয়েছে যেটা আমার জন্যে সবথেকে খুশির সংবাদ!আমি উনাদের নিমন্ত্রণ সাগ্রহে গ্রহণ করেছি কেননা মাল্টিন্যাশনালের মতন এতবড় কোম্পানিতে যদি জয়েন হতে পারি তাহলে আমার লাইফ একদম সেটেল!আজ অবশ্যি সেখানে যাওয়ার তারিখ।দুপুরের পরে দেখা করতে বলেছে।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাসা থেকে বের হব এমন সময় মার সাথে দরজা কাছে দেখা হয়ে যায়।মা হয়তো আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন।কালরাতে মার সাথে ঝগড়া করেছি।ঝগড়ার কারণ ছিল জবটা যে করেই হোক ছেড়ে দিতে।বিভিন্ন কোম্পানিতে যেয়ে যেয়ে বিজ্ঞাপন বানাচ্ছি এটা নাকি উনার কাছে চ্যাঁচরা কাজ মনে হচ্ছে।উনার আরো মনে হচ্ছে এসব কাজ করে দরিদ্ররা যাদের পেঁটে ভাত নাই!ঘরে চাল নেই!মার কথা শুনে প্রচন্ড রাগ শলে আসে!সাথে সাথে রেগেমেগে কলটা কেঁটে ফোন সুইচট অফ করে দিই।এতবড় সম্মানিত একটা পেশাকে মার চ্যাঁচরা মনে হলো হাস্যকর!খুবই হাস্যকর!ভাবনার মাঝেই খালামণি বলেন,

“আরেহ আপা,আপনি?হঠাৎ কি মনে করে বোনের বাসায়?”

মা কেমন ভার ভার মুখে খালামণিকে জবাব দেন,
” আসছি এমনি।”
“তো ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?সোফায় এসে বসেন না?”

মা সোফায় গিয়ে বসে।আমি ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি আমার আর দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই।দুটার আগে আগে ওখানে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। গতরাতে এমডি কল করে তাড়াতাড়ি পৌঁছার জোর রিকুয়েস্ট করেছে।আমার পেছনে হালকা ঘাঁড় ঘুরিয়ে মা এবং খালামণিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

“আমি আসছি তাহলে।”

মা ওমনি বলে উঠেন,
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“বিজ্ঞাপনের স্যাম্পল আনতে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে যাচ্ছি।”

মা চোখমুখ খুব তীক্ষ্ণ করে আনেন।খালামণির দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত গলায় বলে উঠেন,

“রাহেলা,কি শুরু করেছিস তোরা ওকে দিয়ে?একটা থার্ড ক্লাস টাইপ চাকরি ধরিয়ে দিয়ে ওকে গরীবদের মতন এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছিস?ওর কি সংসার করা লাগবে না?!এটা করেই কি ওর সারাজীবন কাঁটাবে?!”

“আপা,এসব কি বলতেছো?এটা থার্ড ক্লাস টাইপ চাকরি মানে?এই চাকরি সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?
“আমার কোনো ধারণা রাখতে হবে না।ওকে ভালোয় ভালোয় বল বাসায় চলে যেতে!”

আমি এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না।খালামণিকে থামিয়ে বলে উঠলাম,
“বাসায় যাবো ওই আশা ছেড়ে দাও।আর চাকরিটাও ছাড়ছি বা।আমি আসছি। আমার লেট হয়ে যাচ্ছে।”

বলে মার এবং খালামণির সামনের থেকে চলে এলাম।
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিটিতে পৌঁছার পর এমডির পিএ আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন।তারপর মিটিং রুমে নিয়ে আসেন।সেখানে এসে এমডি,ব্যবস্থাপক আরো অনেক কর্মকর্তাও বসে আছে।তারা সবাই আমাকে বসতে জায়গা করে দেন।আমি বসি।এমডি তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন,

“ম্যাম,সময় মতই আসলেন।যাক টেনশনমুক্ত হলাম।”
“আমি যেখানে কথা দিই সে কথার বলখিলাপ করি না।”
“থ্যাংকস,ম্যাম।তা গরম নাকি ঠান্ডা খাবেন?এতবড় একজন আর্টিস্ট আমাদের অফিসে আসলেন..।”
“আরেহ নাহ আমি কিছু খাবো না।আমি আসার সময়ই ঠান্ডা কিছু খেয়ে এসেছি।”
“তারপরও..?”
“সরি।”

এম ডি আর কিছু বললো না।আমি বললাম,
“তা কাজ শুরু করা যাক…?”
“জ্বী,অবশ্যই।তার আগে ম্যাম,আমাদের কোম্পানির পরিচালককে ডেকে নিয়ে আসতেছি।উনিই বিজ্ঞাপনের ক্যাটাঘরিটা আপনাকে সাজেস্ট করবেন।আপনি একটা কাজ করুন ততক্ষণে আপনি একটু কষ্ট করে আমাদের প্রোডাক্টসগুলো দেখুন।”

বলে এম ডি আমার সামনে ল্যাপটপটা অন করে তাদের প্রোডাক্টসগুলো শো করে।আমি ল্যাপটপটা আমার হাতের কাছে টেনে এনে কি-বোর্ডের উপর চাপতে চাপতে এম ডি কে জবাব দিই,

“নো প্রবলেব।”

এমডি মাথা নেড়ে চলে যায়।কয়েক মিনিটস বাদেই কেউ একজন আমার সামনে এসে বসে।সম্ভবত পরিচালকই।আমি আর সামনে তাকালাম না।ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে থাকলাম।ওপাশ থেকে বলে উঠলো,

“আমার ক্যালিগ্রাফির বিজ্ঞাপন চাই।”

পরিচালকের কণ্ঠের আওয়াজ শুনামাত্রই আমার চোখে কেনজানি আতংক ছুঁয়ে যায়।তরহর করে মাথা তুলে সামনে তাকাই।সামনে তাকিয়ে যেটা দেখতে আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না তাই দেখলাম।আমার সামনে অভি বসে আছে!আমাকে দেখে তার মাঝে তেমন কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলাম না।সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বসে আছে।স্বাভাবিক মুখেই আবার বললো,

“আপনার আগের ক্যালিগ্রাফির ডিজাইনগুলো আমাকে দেখান!যেটা আমার ভালোলাগে সেটা চুজ করবো।”

চলবে…..